ফণীভূষণ আর সুধারাণীর যে বছর বিয়ে হয় সেই বছরই ফণীভূষণ ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। বাবা বুঝেছিলেন ডানপিটে এই ছেলেকে ঘরে রাখা যাবে না। একমাত্র বাবাকেই কিছুটা ভয় পেত, আর কাউকে তো পাত্তাই দিত না সেই ছেলে। কাজেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই হেডমাস্টার বাবা অক্ষয়কুমার ছেলেকে বসিয়ে দিয়েছিলেন বিয়ের পিঁড়িতে। আপত্তি থাকলেও বাবার মুখের ওপর না করতে পারে নি।
বিয়েত পিঁড়তে বসার সময় সুধারানীর বয়স তখন তেরো। ফুটফুটে মুখের মেয়েটি জন্মের সময়েই এত সুন্দর দেখতে হয়েছিল যে আদর করে ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল ফুটু। একই গ্রামের অর্থাৎ অক্ষয়কুমার যে গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার, সেই খলিসাকোটা গ্রামেই যখন দ্বারিকানাথ সেনগুপ্ত ডাক বিভাগের কর্মী হিসেবে বদলি হয়ে এসেছিলেন, তখনই ফুটুকে দেখে পছন্দ হয়ে যায় অক্ষয়কুমারের। হয়ত মনে মনে নিজের ছেলের জন্য পাত্রীও তখনই ঠিক করে ফেলেছিলেন।
খলিসাকোটা গ্রামের হেডমাস্টারমশাই এর ছেলের বিয়ে ধুমধাম করেই সম্পন্ন হল। বাবা নিশ্চিন্ত হলেন যে ছেলে এবার আর বাহিরমুখী হয়ত হবে না। বাবার চিন্তার একটা বড় কারণ ছিল গ্রামে যুগান্তর দলের বাড়াবাড়ি আর ছেলের এই দলের সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষা পাশ করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় যাওয়া সাব্যস্ত হল ফণীভূষণের। বাবার আদেশ। মেনে নিতেই হবে।
সুধারাণীর থেকে বিদায় নিয়ে ফণীভূষণ কলকাতা যাওয়ার সময় কিশোরী সুধারাণীর চোখ ছলছল করে উঠেছিল। বিয়ের পরপরই এত বড় বিচ্ছেদ! কিশোরীসুলভ চপলতায় হয়ত বলেও ফেলেছিল আর যদি আমাদের দেখা না হয়! শুনে ফণীভূষণ মুচকি হেসেছিল হয়ত। মুখে বলেছিল কেন দেখা হবে না? এ আবার কি! যাই হোক, দুজনের কী কথা হয়েছিল তা আমরা ঠিক জানি না, কিন্তু তখনো অব্দি ভাগ্য মানা ফণীভূষণের ভাগ্য হয়ত মুচকি হেসেছিল।
কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজে বিএসসি অনার্স নিয়ে ভর্তি হল মেধাবী ফণীভূষণ। এরপর এই ফনীভূষণকে আমাদের আপনি আপনি করে বলতে হবে। কলেজ পড়ুয়া শিক্ষিত যুবক উনি এখন।
গ্রাম ছাড়ার সময়েই গ্রামের কিছু দাদারা কলকাতায় গিয়ে ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিল কোথায় কোথায় যোগাযোগ করতে হবে। কলকাতায় এসে সেইসব ডেড়ায় যাতায়াত শুরু হল ফণীভূষণের। লেখালেখির হাত ছিল বলে তাঁকে বিশেষ একটি কাজের দায়িত্ব দেওয়া হল। যুগান্তর গ্রুপের পত্রিকা প্রকাশিত হবে যার নাম দেওয়া হবে 'স্বাধীনতা', সেই স্বাধীনতা পত্রিকার সম্পাদনার কাজ।
১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম ইস্যু বেরনোর সাথে সাথে সরকারের নজর পড়তে থাকে স্বাধীনতার ওপর। যা সমস্ত বিপজ্জনক কথা লেখা ছিল তাতে, ব্রিটিশ সরকারের তা সহ্য হওয়ার কথা নয়। হলও তাই। ১৯২৮ এর জুন মাসে সিডিশন চার্জে গ্রেপ্তার করা হল স্বাধীনতার সম্পাদক ফণীভূষণ দাসগুপ্তকে আর পত্রিকাকে নিষিদ্ধ করা হল। এর বেরোল না স্বাধীনতার কোনো ইস্যু। তবে এর বেশ কয়েকবছর বাদে ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসেবে সেই স্বাধীনতা পত্রিকারই পুনর্জন্ম ঘটে।
তিন মাসের জন্য সিডিশনের চার্জে জেলে যাওয়ার পরই ফণীভূষণ নিজের জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন। বিপ্লবী জীবনই হবে তাঁর জীবনের লক্ষ্য। জেল থেকে বেরোনোর পর গোপন কর্মকাণ্ড শুরু হয়। বাড়ির সাথে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেছিল। এবার থেকে একেবারেই ছিন্ন হয়ে গেল।
খবর পাওয়া যায় বেশ কয়েকজন বিপ্লবী প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক জমা করছেন। একটা বড়সর অ্যাকশন করার পরিকল্পনা রয়েছে। কলাবাগান বস্তিতে সেই বিস্ফোরক জমার কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন ফণীভূষণ। এই পরিকল্পনার পূর্বে একটা ইতিহাস রয়েছে। সেটা বিবৃত না করলে ঠিক বোঝা যাবে না কেন কলাবাগানের ওই বস্তিতে বিপ্লবীরা ডেরা বেঁধেছিলেন।
১৯২৫ সাল নাগাদ হিজলি জেলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেশিরভাগ বিপ্লবীদের বন্দি করে একত্রিত করা হয়েছিল। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের বিপ্লবীরা এই প্রথম এতজন এক জায়গায় একসাথে হওয়ার সুযোগ পেলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করলেন আর বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে নয়, এবার থেকে সবাই একসাথে একটাই গুপ্ত বিপ্লবী সঙ্ঘ তৈরি করে অ্যাকশন চালানো হবে। এর আগে অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর সমিতির তরুণদের মধ্যে পুরনো নেতৃত্ব যারা সন্ত্রাসবাদের জায়গা থেকে সরে আসতে চাইছিলেন, তাঁদের অস্বীকার করে একটা প্রবণতা দেখা দিচ্ছিল। তরুণ বিপ্লবীরা চাইছিলেন আগের গোপন বিপ্লবী পথই বজায় রাখতে। এই অংশটার নাম দেওয়া হল রিভোল্টিং গ্রুপ। মূলত সতীশ পাকড়াশীর নেতৃত্বে এই রিভোল্টিং গ্রুপের সদস্যরা কাজ করতে চাইছিলেন।
মেদিনীপুর জেলের অধিকাংশ বিপ্লবী এই রিভোল্টিং গ্রুপের সদস্য হয়ে মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিলেন।
জেল থেকে এক এক করে যখন ছাড়া পেতে থাকলেন তখন তাঁরা জেলের বাইরে গোপন সংগঠন তৈরি করতে উদ্যোগী হলেন। মিলিত হলেন রংপুরের প্রাদেশিক সম্মেলনে।
সেই সম্মেলন থেকে ঠিক হল বাংলাদেশের তিনটি অস্ত্রাগারে অস্ত্র লুন্ঠন করা হবে আর ঢাকা আর কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় বোমা বর্ষণ করা হবে একইসাথে।
কলকাতার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাঁরা কলাবাগান অঞ্চলের মেছুয়াবাজারের একটা বাড়িতে ডেরা বাঁধলেন। সেখানেই বিপ্লবী কাগজপত্র অস্ত্রসস্ত্র, বোমা তৈরির ফর্মুলা সহ বোমার মশলা মজুত করতে শুরু করলেন। ফণীভূষণও রিভোল্টিং গ্রুপের সদস্য হিসেবে মেছুয়াবাজারের ওই বাড়িতে যাতায়াত শুরু করলেন।
১৯২৯ সালের ১৮ ই ডিসেম্বর পুলিস কোনো সুত্র থেকে খবর পেয়ে সেই বাড়ি ঘিরে ফেলে সব বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করল। ১৯৩০ এর এপ্রিল থেকে শুরু হল বিচার। ইতিহাসে এই ঘটনা মেছুয়াবাজার বোমা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে খ্যাত। এই ষড়যন্ত্র মামলায় দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার হলেন ফণীভূষণ।
বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আলিপুর জেলে থাকার সময়ে সুধারাণী দেখা করতে চান তাঁর স্বামীর সাথে। অনেককে ধরাধরি করে যখন দেখা করার অনুমতি মিলল ঠিক তখনই জানা গেল জেলারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জেলারের লাঠি দিয়েই জেলারকে বেধরক মেরেছেন জেলের মধ্যেই৷ শাস্তিস্বরূপ বাড়ির লোকের সাথে দেখা করা বন্ধ হয়ে গেল। সুধারাণীরও আর দেখা করা হল না স্বামীর সাথে।
বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সেই বিখ্যাত হিজলি জেলেই স্থানান্তরিত করা হল যা আজ খড়গপুর আইআইটি ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত। মেদিনীপুরের হিজলি জেলে আলাপ হল নলিনী দাসের সাথে। জেলে তারকেশ্বর সেনগুপ্ত ও সন্তোষ কুমার মিত্রকে গুলি করে হত্যা করার বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ সবাই গর্জে ওঠেন। দুজনকে হত্যা করা ছাড়াও আরো বহু বিপ্লবী বন্দি আহত হয়েছিলেন। সেই আহতদের জেল হাসপাতালে সেবা করার ডিউটি পড়ে ফণীভূষণ আর নলিনী দাসের। হাসপাতাল ডিউটি করার সময়েই জেল হাসপাতাল থেকে পরিকল্পনা করে পালান দুজনে মিলে। নলিনী দাস পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট নেতা হন।
ফণীভূষণ পূর্ববঙ্গে চলে আসার পর সেখানেও গোপন জীবন কাটাতে শুরু করেন। বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য টাকা সংগ্রহের তাগিদে বরিশালের সিঙ্গা গ্রামে এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে ডাকাতি করলেন। ডাকাতিতে চৌকিদার এনতাজুদ্দিনের মৃত্যু হল ফণীভূষণেরই ছোঁড়া গুলিতে।
দু মাস পর ২৯শে সেপ্টেম্বর ১৯৩২ এ আরেকটা অ্যাকশন করতে যাওয়ার সময়ে ধরা পড়লেন পুলিশের হাতে আরেক বিপ্লবী সুধাংশু সেনগুপ্তর সাথে।
ধরা পড়ার পর বাকেরগঞ্জ স্পেশাল কোর্টের ট্রাইবুনালে কালাপানির সাজা হল। আন্দামানে নিয়ে যাওয়ার জন্য বন্দিদের প্রথমে রাখা হত আলিপুর জেলে। এখানে আবার দ্বিতীয়বারের জন্য জেল টপকাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। অকথ্য অত্যাচার ও নৃশংসভাবে মার দেওয়া হয়। জেলের নির্জন কুঠুরিতে বিপজ্জনক আসামীর তকমা দিয়ে রাখা হয়। এরপর আন্দামানে চালান।
প্রথমবার জেলে যাওয়ার পরই সুধারাণী বুঝে গেছিলেন তার বিবাহিত জীবনের পরিণতি কী হতে চলেছে। তার মেধাবী স্বামী শুধু পড়াশোনা করার জন্যই কলকাতায় যান নি। পড়াশোনার পাশে পাশে দেশকে স্বাধীন করার সংকল্পও নিয়ে রেখেছেন। গোপন বিপ্লবী জীবন কাটানোর মাঝেমাঝে হয়ত গ্রামে এসে কোনো এক রাতের জন্য স্ত্রীর সাথে দেখা করতেন, আবার সকাল হলে চলে যেতেন। পুলিশ খবর পেলে বাড়িতে হানা দিত। এভাবেই চলত দিনের পর দিন। কখনো বা স্বমীর অনুরোধে কোনো বিপ্লবীকে লুকিয়ে রাখতেন বাড়িতে। তার পরিচর্যা করতেন। একদিনের জন্যও হয়ত বিবাহিত জীবনের সুখ লাভ করেন নি। তবু কোনোদিনও কোনো অভিযোগ করেন নি। দেশের কাজ মনে করেই হয়ত হাসিমুখে সমস্ত কিছু সহ্য করে গেছেন।
যখন কালাপানির সাজা হল তখন থেকে দেশের কাজের পাশাপাশি সংসারের হাল নিয়েও দুশ্চিন্তা শুরু হল৷ বৃদ্ধ শ্বশুর তখন পুরোপুরি ছেলের বৌ এর ওপর নির্ভরশীল। বিয়ের সময় সুধারাণী পড়তেন ক্লাস এইটে। পড়াশোনায় বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর তখনকার প্রথা অনুযায়ী পড়াশোনা ছাড়তে হয়৷ এরপর স্বামী ঘরছাড়া থাকার সময়ে বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা শেষ করেন। সংসারে টানাটানি দেখা দিল চাকরির চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু একেই তো চাকরির পক্ষে বয়স বেশি হয়ে গেছিল, তারওপর যখন সবাই শুনতেন ফণীভূষণের স্ত্রী, তখন আরোই ভয়তে চাকরিতে বহাল করতেন না। হয়ত কয়েকমাসের জন্য কোথাও পড়ানোর কাজে ঢুকেছেন, ফণীভূষণের স্ত্রী পরিচয় বাইরে আসার সাথে সাথেই চাকরিটা খোয়াতে হত। এভাবেই কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সংসার।
১৯৩৫ সালে বিপ্লবী বন্দিরা আন্দামানে কর্তৃপক্ষের অন্যায় ও অকথ্য শারীরিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমরণ অনশন শুরু করলেন। কথিত আছে ওখানে জেলবন্দিদের ওপর এতই অত্যাচার করা হত যে তাতে অনেকে নাকি অসুস্থও হয়ে পড়তেন। আর কোনো খবর যেহেতু বাইরে আসার উপায় ছিল না তাই জেল কর্তৃপক্ষ নিজের ইচ্ছেমত জেলবন্দিদের ওপর অত্যাচার চালাত।
এই অনশন আন্দোলনে ফণীভূষণ যোগ দেন। তার আগেই সুধাংশু দাসগুপ্ত প্রমোদ দাসগুপ্ত সতীশ পাকড়াশী শিব ভর্মাদের তৈর কমিউনিস্ট কনসোলিডেশনে যোগ দিয়েছিলেন। অবশ্য আন্দামানে বন্দি থাকা নব্বই শতাংশ বিপ্লবীই কমিউনিস্ট কনসোলিডেশনে যোগ দিয়ে পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হন।
শরীর তখন থেকেই অল্প অল্প করে ভাঙতে শুরু করে। শরীরের রোগের সাথে সাথে বাসা বাধল মানসিক রোগ। সেলুলার জেলেই মাঝেমাঝে চৌকিদার এনতাজুদ্দীনকে দেখতে পেতেন। পেটের দায়ে চাকরি করতে আসা একজন গরীব মানুষকে খুন করে ফেলার দায় নিজের মাথা থেকে নামাতে পারেন নি কোনোদিনই। মানসিক রোগ বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছাল যে আর লোকজনকে চেনা সম্ভব হত না।
১৯৩৮ সাল থেকেই গণ আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার আন্দামানের বন্দিদের মুক্তি দিতে শুরু করে। প্রথম বছরেই মুক্তি পান ফণীভূষণ।
বরিশালের গ্রামে যখন খবর গেল যে কালাপানির বন্দিরা ফিরে আসছে সবাই, খুশিতে ভেসে গেছিল ফণীভূষণের বাড়ি। অলক্ষ্যে আনন্দে চোখের জল ফেলেছিলেন সুধারানী। কিন্তু সেই আনন্দ স্থায়ী হয় নি। আন্দামানের জাহাজ যখন বন্দিদের মিয়ে কলকাতায় নোঙর ফেলে, ফণীভূষণ তখন প্রায় উন্মাদ বলা যায়।
মেডিকাল কলেজে ভর্তি থেকে দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা চলে। ডাক্তাররাও বুঝতে পারছিলেন পুরোপুরি সুস্থ হয়ত আর কোনোদিনই হবেন না, তাও চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। সুধারাণী আত্মীয় বাড়িতে থেকে যতটা সম্ভব শুশ্রুষা চালিয়ে যেতে থাকেন। এই সময়ে পাশে ছিলেন মুজফফর আহমেদ। হাসপাতালে তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখেন। চিকিৎসার খোঁজখবর সহ চিকিৎসায় সহায়তা সমস্ত কিছুই কাকাবাবুর তদারকিতে হতে থাকে৷
খানিকটা সুস্থ হতেই দেশের বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। বরিশালে ফিরে সুধারাণীর সাথে প্রথমবারের মত দাম্পত্য উপভোগ করেন। সন্তান হওয়ার পর সারা জীবন যে স্বপম দেখেছেন সেই নামেই ছেলের নাম দেন 'বিপ্লব'। তবে এই দাম্পত্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ১৯৪৩ সালে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে যখন ফণীভূষণ মারা যান তখন ছেলের বয়স দু বছর। এর কয়েক বছর পরেই মারা যান সুধারাণী।
ফণীভূষণ দাসগুপ্তের প্রতিকৃতি আন্দামানের সেলুলার জেলে আর কলকাতার মহাজাতি সদনে রয়েছে। হয়ত অনেকেই পরিচিত নন এই বিপ্লবীর সাথে, তবে অন্তত দু জায়গায় প্রতিকৃতিতে স্থান পেয়েছেন তিনি। তবে মজার বিষয় হচ্ছে আধুনিক যুগের বিপ্লব অনিমেষরা করে আর মাধবীলতারা যেমন বিপ্লবের সেবাদাসী হয়ে থেকে যায়, সেরকমই সুধারাণী সকলের অলক্ষ্যে বিপ্লবের সেবাদাসী হয়েই থেকে গেছেন। তাঁকে মনে রাখে নি কেউই।
উল্লাসকর দত্তের কথাও মনে পড়ল। এতো বিপুল মূল্যে পাওয়া স্বাধীনতা চোখে মণির মতো রক্ষা করতে পারলাম না আমরা। দিকে দিকে অপচয়।
আধুনিক যুগে বিপ্লব হল কোথায় যে অনিমেষরা অংশ নেবে। এখন অনিমেষ মাধবীলতারা সবাই কর্পোরেট হাউজের সেবাদাস সেবাদাসী। শেষটা অপ্রয়োজনীয়।
তোর লেখার চুম্বকের মত আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে।
প্রতিভা দি, উল্লাসকর দত্তের জীবনটা আরো ইন্টারেস্টিং।ছোটবেলার প্রেমিকা বৃদ্ধা বয়সে হাটতে চলতে পারে না, তার সেবা করে গেছে শেষদিন অব্দি। নিজে তখন মানসিক ভারসাম্যহীন। এদের জীবনগুলো খুব অবাক করে। কীভাবে পারতেন এসব করতে! এঁদের উত্তরসুরী হিসেবে নিজেদের ভাবলেই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে।
'ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে, গোলা বন্দুক বোমার আগুনে
আজও রোমাঞ্চকর'
-সতীশ পাকরাশি-র কথা পড়েছি আজিজুল-এর কারাগারে ১৮ বছরে। পড়েছি উল্লাসকরের কথা । দেশের সুসন্তানেরা। প্রতিভার কথাই মনে হয় - এত মূল্যে পাওয়া স্বাধীনতা, কত আত্মত্যাগ, কষ্ট সওয়া সারা জীবন।
ফণীভূষণ আর সুধারাণী - র কথা জানতাম না। ধন্যবাদ অরিজিৎ। খুবই সুন্দর লেখা
ভীষণ ভালো লাগল। তথ্য সমৃদ্ধ আকর্ষণীয় লেখা।