ছত্তিশগড় রাজ্যের জঙ্গলে ঘেরা জেলা বাস্তার।স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয় এই জেলা।এরপর, ১৯৯৯ সালে ত্রিখন্ডিত হয়ে বাস্তার, দান্তেওয়াড়া এবং কাকেঁর জেলা তৈরি হয়, যা ২০১২ তে পুনরায় খণ্ডিত হয়ে কোন্দাগাও নামে এক নতুন জেলার আত্মপ্রকাশ ঘটে। বরাবরই আদিবাসী অধ্যুষিত এই জেলার সত্তর শতাংশ অধিবাসী হল আদিবাসী। সম্ভবত, এই কারনেই স্বাধীন ভারতের সরকার বারবার এই জেলাটিকে নানারকম প্রশাসনিক অজুহাতে খণ্ডবিখণ্ড করেছে। যাতে, কোনোভাবেই আদিবাসীরা একত্রিত হতে না পারে।এখানকার আদিবাসীদের নিজেদের ঐতিহ্যের প্রতি অফুরন্ত আবেগ ও ভালোবাসা রয়েছে, যার ফলে, তারা খুব সহজে বাইরের দুনিয়ার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে না।কিন্তু আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজ কি আর সে কথা মানে! যারা আমাদের মত নয় তারা সবাই আলাদা - এই ওয়ান লেয়ার ডায়নামিক্স সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যে সর্বগ্রাসী আগ্রাসন আজকাল দেখা যাচ্ছে, বাস্তারে তা শুরু হয়েছিল বহুদিন আগেই । জাগদলপুর লিগাল এইড গ্রুপের পক্ষ থেকে বস্তারের বিচারাধীন বন্দীদের নিয়ে একটা সমীক্ষা চালানো হয়। সেই সমীক্ষায় চমকে দেওয়ার মত কিছু তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। বাস্তার ডিভিসনে মোট তিনটে জেল আছে - জাগদলপুর সেন্ট্রাল জেল, দান্তেওয়াড়া ডিস্ট্রিক্ট জেল ও কাকেঁর ডিস্ট্রিক্ট জেল। যদিও তার আগে একটা তথ্য পেশ করা বাঞ্ছনীয় যে, সারা ভারতের মধ্যে, একমাত্র ছত্তিসগড় রাজ্যেই বিচারাধীন বন্দীর সংখ্যা সবচাইতে বেশি। ভারতবর্ষের জেলগুলোতে এমনিতেই সর্বমোট ধারণ ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি কয়েদি গাদাগাদি করে থাকে। যেখানে,ভারতবর্ষের সব জেল মিলে কয়েদী ধারণ ক্ষমতা ৩,৪৭,৮৫৯ সেখানে বন্দীর সংখ্যা ৪,১১,৯৯২। অর্থাৎ, ১১৮% বেশি বন্দী ভারতের জেলের মধ্যে গাদাগাদি করে থাকে। ছত্তিসগড় রাজ্যে এসে এই অংকটা একলাফে বেড়ে দাঁড়িয়ে যায় ২৬১ শতাংশে। এখানে ৬,০৭০ জন বন্দীর জায়গায় রয়েছে ১৫,৮৪০ জন বন্দী। অর্থাৎ, একজনের হিসাবে জেলে যা সুবিধা বজায় রাখা যেত, সেই একই সুযোগ-সুবিধা ভাগ করে নিতে হচ্ছে ২.৬১ জনের মধ্যে।
এবার তাকানো যাক বাস্তার ডিভিসনের দিকে। জাগদলপুর সেন্ট্রাল জেলে এই শতাংশের হিসেব টা ২৬০%, মানে ৫৭৯ জনের জায়গায় ১৫০৮ জন, দান্তেওয়াড়া ডিস্ট্রিক্ট জেলে ৩৭১%, ১৫০ র জায়গায় ৫৫৭ জন আর, কাকেঁর ডিস্ট্রিক্ট জেলে ৪২৮%। এখানে আবার ৬৫ জন বন্দীর জায়গায় রয়েছে ২৭৮ জন বন্দী। অবাক করে দেবার মতন বিষয় হল, এইসকল বন্দীদের মধ্যে সিংভাগই হচ্ছে আদিবাসী পুরুষ, যাদের গড় বয়স ১৮ থেকে ৩০ এর মধ্যে। এখন মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে- আচ্ছা, এই সমস্ত কয়েদীই কী তাহলে অপরাধী? সেক্ষেত্রে আরেকটা হিসেবের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। ভারতবর্ষে বিচারাধীন আর সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর শতাংশের হিসেব হল যথাক্রমে ৬৭.৬% এবং ৩১।৫%। মানে ১০০ জন বন্দীর মধ্যে যেখানে ৩১.৫ জন অপরাধী দোষী সাব্যস্ত হয় আর বাকি ৬৭.৬ জন বিচারাধীন থাকে, সেখানে ছত্তিসগড় রাজ্যে এই শতাশের হিসেব ক্রমান্বয়ে ৫৮.৩% ও ৪১.৬%। কাঁকের ডিস্ট্রিক্ট জেলের ৩৩৬ জন বিচারাধীন অপরাধীর মধ্যে মাত্র ১২ জন দোষী সাব্যস্ত,যেটার শতাংশ করলে দাঁড়ায় ৩.৪%।দান্তেওয়াড়া ডিস্ট্রিক্ট জেলের ৫৪৬ জন বন্দীর মধ্যে ১১ জন দোষী সাব্যস্ত। শতাংশের হিসেবে যেটা মাত্র ২%। সেইভাবে দেখতে গেলে তুলনায় জাগদলপুর সেন্ট্রাল জেলের অবস্থাটা কিছুটা হলেও ভালো - ৮৩৫ জনের মধ্যে ৬৭৩ জন। ২০১৩ সালে, ভারতে প্রতি লাখে যেখানে ২১ জন কারাবন্দী হয়েছে, কাকেঁরে সেই সংখ্যাটা ৩৭, দান্তেওয়াড়াতে ৪৪ আর দক্ষিণ বাস্তারে এই সংখ্যাটা ১০৫। ২০১৩ সালের গ্রেপ্তারির অপর একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, প্রতি হাজারে যেখানে ভারতে ৬.৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, ছত্তিসগড়ে সেই সংখ্যাটা ১১।৬ এবং কাকেঁরে ১৪।৯। মানে সারা ভারতের গড়ের থেকে বেশ খানিকটাই বেশি। ২০১৩ র আরেকটা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিচারাধীন বন্দীদের জেলবন্দী থাকার টাইম পিরিয়ড সারা ভারতের থেকে ছত্তিসগড়ে অনেকটাই বেশি, আর বাস্তারে সেই হিসেবটা ছত্তিসগড়ের বাকি অংশের থেকেও বেশি। তিন থেকে পাঁচ বছর অব্দি বিনা বিচারে বন্দীর হার সব থেকে বেশি বাস্তারে। সমস্ত বন্দীর প্রায় কুড়ি শতাংশ তিন থেকে পাঁচ বছর অব্দি জেলে খাটছে বিনা বিচারে, যেখানে সারা ভারতে সেই গড় প্রায় পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি। এমনকি,পাঁচ বছরের ওপরে বিনা বিচারে জেল খাটার সংখ্যা যেখানে সারা ভারতে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি, সেখানে জাগদালপুর সেন্ট্রাল জেলে সেইসব বন্দীও রয়েছে, যারা পাঁচ বছরের ওপর বিনা বিচারে জেল খাটছে।
এই সমস্ত পরিসংখ্যান দেখে একটা কথা মনে হতেই পারে যে, হয়ত বাস্তার বা সামগ্রিক ভাবে ছত্তিসগড় রাজ্যটিই অপরাধ প্রবণ। তাহলে, সেক্ষেত্রে সব রকম অপরাধেরই তীর্থক্ষেত্রে হয়ে ওঠার কথা ছত্তিসগড় বা বাস্তার অঞ্চল। এখানে আবার একটা মজার ব্যাপার রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০০৫ থেকে ২০১৩ অব্দি যে কটা কেস ফাইল করা হয়েছে, তাতে মার্ডার আর অ্যাটেম্পট টু মার্ডার এর ঘটনা দান্তেওয়াড়া ডিস্ট্রিক্ট জেলে প্রায় ৮৬% এর কাছাকাছি । অপর দিকে মহিলাদের ওপর হওয়া অপরাধের হার দশ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ, অন্যান্য অপরাধ, যেমন, অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা বা দাঙ্গা লাগানো, এরকম অপরাধের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। ভারতবর্ষে, মার্ডার আর অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের চার্জ সমস্ত অপরাধের ৩৩%। অন্যান্য অপরাধ, বিশেষ করে মহিলাদের ওপর হওয়া অপরাধ ভারতবর্ষের অপরাধের মানচিত্রের সিংহভাগ স্থান দখল করে রেখেছে। কিন্তু উলোটপুরাণ দেখা যায় বাস্তারের ক্ষেত্রে।এ তো গেল কিরকম চার্জ দেওয়া হচ্ছে তার পরিসংখ্যান।চার্জ দেওয়ার পর শুরু হয় আর এক প্রহসন- দীর্ঘায়িত বিচারপ্রক্রিয়া। যত দিন যাচ্ছে তত দেখা যাচ্ছে এই বিচারকালীন সময় ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। আর বিচারকালীন সময় বেড়ে যাওয়া মানেই আন্ডারট্রায়ালদের জেলবন্দী থাকার সময়ও বেড়ে যাওয়া৷ ২০০৫ সালে,যেখানে দান্তেওয়াড়াতে প্রায় ৩৫% কেসের ফয়সালা হয়েছিল এক বছরের মধ্যে এবং ৪০% কেসের ফয়সালা হয়েছিল দু বছরের মধ্যে, সেখানে ২০১৩ তে, ৪০% কেসের ফয়সলা হতেই লেগেছিল ৩ বছর।এমনকি ছ'বছর ধরেও ফয়সলা হয়নি সেরকম কেসের সংখ্যাও নেহাতই কম কিছু নয়।একে তো জেলগুলোতে চরম অমানুষিক পরিবেশের মধ্যে একজনের জায়গায় চারজনকে গাদাগাদি করে রেখে দেওয়া হচ্ছে, তারপর বছরের পর বছর বিচারপ্রক্রিয়ার শ্লথ গতি কীভাবে ওখানকার আদিবাসীদের একটা বড় অংশকে জেলে রেখে পচিয়ে মারছে, তা এককথায় কল্পনাতীত। অথচ, আগেই দেখেছি শতাংশের হিসেবে হয়ত এদের খুব কম জনেরই অপরাধ প্রমাণিত হয়। তাহলে হিসেবটা কী দাঁড়ালো? ওখানকার আদিবাসীদের, ইচ্ছে হলেই প্রশাসন গ্রেপ্তার করে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। এইভাবে বছরের পর বছর বিচার চলার পর হয়ত তাদের সিংহভাগ বেকসুর খালাস হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু ততদিনে তাদের জীবনের অনেকটা মূল্যবান সময় জেলের ভেতরের ঐ অমানুষিক পরিবেশের মধ্যে হারিয়ে যায়। আঁতকে ওঠার মত পরিসংখ্যান হল - ২০০৫ থেকে ২০১৩ অব্দি বেকসুর খালাস পাওয়া কয়েদির শতাংশের হিসেব হচ্ছে ৯৬.১%।
লিগাল এইড গ্রুপ এরপর ওখানকার বেশ কিছু কেস স্টাডি করে। যার ফলে, এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে যে, কিভাবে পুলিশ মিথ্যে মামলা সাজায় বা নিজের খেয়ালখুশি মত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। যেমন, স্টেট ভার্সেস জোগা, জুগল অ্যান্ড সুদারের কেসে, পাঁচ মাসে তেরো খানা এফ আই আর দায়ের করা হয়েছিল নানা ব্যক্তির নামে। যদিও, সেই এফ আই আরে কোথাও জোগা, জুগল আর সুদারের নাম ছিল না। এর কিছুদিন পরেই, পুলিশের স্টেটমেন্টে ওই তিনজনের নাম যোগ করে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে অবশ্য তিনজনেই বেকসুর খালাস হয়েছিল। আরেকটা কেসে ৫০ জনের নামে এফাইআর দায়ের হওয়ার পাঁচ মাস পরে পুলিশের হটাৎ করে আরো তিনজনের নাম মনে পড়ে যায় এবং তাদেরকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করা হয়। মানে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে, যত দিন যায়, পুলিশের মেমোরি তত শক্তিশালী হয়।
অন্যদিকে,অপর আর একটি কেসের দুই অভিযুক্ত, মিদিয়াম লাচু ও পুনেম ভিমার নাম পুলিশের চার্জশিটে কোথাও ছিল না , শুধুমাত্র ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের একটা রিপোর্টে তাদের নাম উল্লেখ করা ছিল।পুলিশ সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তাদের দুজনকে গ্রেপ্তার করে এবং বিনা বিচারে তারা জেল খাটছে আজ ছ'বছর ধরে।স্টেট ভার্সেস মাদকাম কোসার কেসে পাঁচজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অবশেষে, চার বছর পর তারা সবাই বেকসুর খালাস হয় এবং জানা যায়, অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল নকশালপন্থীদের দ্বারা।
ভীমা কদাতি, একটি উনিশ বছরের কিশোর, যে কিনা ওই বয়সেই বারোটি কেসে অভিযুক্ত হয়েছিল। যদিও,চার বছর ধরে কেস চলার পরে বেকসুর খালাস হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ততদিনে সে মেডিকাল নেগ্লিজেন্সির শিকারে সদগতি লাভ করেছে। জেলেই বিচারাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। এসব ছাড়াও, আইন প্রক্রিয়ায় ইচ্ছাকৃত দেরি, পুরনো কেসের রিওপেনিং, এইরকম নানা পদ্ধতিতে পুরো বাস্তারকে জেলে পচিয়ে মেরে ফেলার এক অবিরত ও সুসজ্জিত চক্রান্ত চলছে।