হুইস্কি নিয়ে ইন্টারেষ্ট ছিল বলে এক সময় পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু ডিষ্টিলারিতে ঘুরে দেখেছি – তো আজ ভাবলাম তেমনি এই ডিষ্টিলারি-র কথা ভাগ করে নেওয়া যাক সবার কাছে।
মদ্যপান করেন বা হুইস্কি ভালোবাসেন এমন কোন ব্যক্তি জ্যাক ড্যানিয়্যালস্-এর নাম শোনেন নি এটা হতে পারে না। যাঁরা বেশী ভালো বাসেন তাঁরা আবার হয়ত আমার থেকে অনেক বেশী জানবেন। তবে এখানে পরিসর কম লেখার – সব কিছু বিস্তারে লেখা যাবে না। ইন্টারেষ্টিং কিছু জিনিসপত্রেই আলোচনা সীমিত রাখব। আর হুইস্কির ইতিহাসও বড় বিচিত্র এবং আজকাল তা কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। তা সেই হুইস্কির ইতিহাস এবং বিবর্তন নিয়ে লিখব যখন স্কটল্যান্ডের হুইস্কি-তে আসব। কারণ মোটামুটি এটা স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, হুইস্কির জগতে ‘স্কচ্ হুইস্কি’-ই শেষ কথা!
তো বুঝতেই পারছেন, সেই হিসাবে দেখতে গেলে “জ্যাক ড্যানিয়্যালস্” হুইস্কি-কে মোটেই পৃথিবীর সর্বোত্তম হুইস্কির তকমা দেওয়া যাবে না। কিন্তু আমেরিকায় এখনো সর্বাধিক বিক্রীত হুইস্কি এই “জ্যাক ড্যানিয়্যালস্” – এর ই! ইনফ্যাক্ট ভারতীয় মধ্যবিত্ত-দের কাছেও এটাই সর্বাধিক জনপ্রিয় বিদেশী হুইস্কি। আমি পৃথিবীর বিভিন্ন এয়ারপোর্টে ভারতীয় যাত্রীদের যে হুইস্কি কিনে দেশে ফিরতে দেখেছি, সেখানেও “জ্যাক ড্যানিয়্যালস্”-এর প্রাধান্য।
আচ্ছা এবার কিছু বেসিক জিনিস কভার করে নেওয়া যাক – বাংলায় হুইস্কি লিখলেও, লক্ষ্য করে দেখেছেন কি যে ইংরাজীতে এর বানান ‘Whiskey’ এবং ‘Whisky’ এই দুই ভাবেই লেখা হয় – মানে একটা ‘ই’ এর তফাত! টাইপো ভাবছেন বা ভাবছেন আমেরিকান ইংলিশ? না, আদপে ব্যাপারটা তা নয়। মনে রাখবেন এটা কোন আইন নয়, কিন্তু হুইস্কির ইতিহাসে আগে একটা কাষ্টম ছিল যে, ‘Whisky’ লেখা হত স্কচ্, কানাডিয়ান এবং জাপানীজ হুইস্কির জন্য। আর ‘Whiskey’ লেখা হত আইরিশ এবং আমেরিকার হুইস্কির ক্ষেত্রে। কিন্তু আজকাল আর সেই কনভেনশন মেনে চলা হয় না – খোদ আমেরিকাতেই “মেকারস্ মার্ক” (কেনটাকির এক বোরবন প্রস্তুতকারক), বা জর্জ ডিকেল (টিনিসি-র এক হুইস্কি প্রস্তুতকারক) বেশ কিছুদিন আগেই তাদের হুইক্সি থেকে ‘ই’ পরিত্যাগ করেছে। আজকাল পৃথিবীর নানা দেশের যে হুইস্কি প্রস্তুত হচ্ছে, তাদের প্রস্তুতকারকেরা নিজেদের ইচ্ছেমত সে কোন একটা স্পেলিং বেছে নিচ্ছে।
হুইস্কির বানানে কিছু আসে যায় না - কিন্তু আসে যায় কোন দেশে বা কোন ডিষ্টিলারি-তে কিভাবে এই হুইস্কি বানানো হচ্ছে। মল্ট, গ্রেন, ব্লেন্ডেড, ভ্যাটেড, লিক্যুয়র – কিভাবে? একটু তলিয়ে দেখলে জানা যাবে যে হুইস্কি প্রস্তুতকারী আদি দেশগুলির নিজস্ব স্বকীয়তা ছিল এই ব্যাপারে। তবে এই সব নিজে আলোচনা অন্য পর্বে।
স্কটল্যান্ড ছাড়া আর চারটি দেশ যদি আপনাকে বেছে নিয়ে হয় যারা পৃথিবীতে হুইস্কি উৎপাদনে প্রথম দিকের স্থান গ্রহন করে আছে, তো সেই দেশগুলি হল – আয়ারল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা এবং জাপান। আমরা এই পর্বে যেহেতু “জ্যাক ড্যানিয়্যালস্” এর গল্প করতে যাচ্ছি, তাই চট করে একবার আমেরিকার হুইস্কির কেসটা দেখে নেওয়া যাক।
কথায় বলে আমেরিকা হল “ল্যান্ড অব্ ইমিগ্র্যান্টস্” – তো সেই হিসাবে এটা জেনে আশ্চর্যের কিছু নেই যে আমেরিকায় এই হুইস্কি ডিষ্টিল করার কায়দা এবং হুইস্কি প্রীতি দুই-ই প্রচলন করেছিল প্রথম দিকের ইউরোপিয়ান যারা আমেরিকায় গেড়ে বসে – জার্মান, ডাচ, ইংলিশ, আইরীশ এবং স্কট। প্রথমদিকে আমেরিকার যে রাজ্যগুলিতে হুইস্কির ব্যপক প্রচলন হয় সেগুলি হল – পেন্সিলভিনিয়া এবং মেরিল্যান্ড। কিন্তু ১৭৯৪ সালে ওই হুইস্কি প্রস্তুতকারক-দের সাথে রাজ্য সরকার গুলির বিরাট ঝামেলা লেগে যায় ট্যাক্স নিয়ে – প্রস্তুতকারকেরা বিদ্রোহ করে বসে – যেটাকে বলা হয় “হুইস্কি রেবিলিয়ান”। রাজ্য সরকার বেশী বাড়াবাড়ি করলে, এই প্রস্তুতকারকেরা বলল ধ্যুত্তুরি – চল শালা অন্য রাজ্যে! এই এই ভাবেই তারা চলে গেল দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকের রাজ্যগুলিতে – ভার্জিনিয়ার ওদিকে দিয়ে কেনটাকি এবং টিনিসি-তে। আমাদের সিঙ্গুরের ন্যানোর ফ্যাক্টরির মত কেস আর কি!
আমেরিকায় হুইস্কি বানানো পদ্ধতি পুরোপুরি স্কটল্যান্ডের মত না হলেও, আমেরিকান মূল হুইস্কির লক্ষ্য কিন্তু ছিল স্কচ গ্রেন হুইস্কির মতই – মানে হুইস্কি অবশ্যই ডিষ্টিল করা হবে ৯৫% অ্যালকোহল বাই ভ্যলিউম এর নীচে যাতে করে হুইস্কির স্বাদ, সুগন্ধ এবং বিশেষত্ব বজায় থাকে। এর থেকে বেশী মাত্রায় ডিষ্টিল করলে তা আমাদের ধেনোর (দেশী মদ) মত হয়ে যাবে!
আমেরিকায় মূলত তিন প্রধান প্রকারের হুইস্কি খ্যতিলাভ করেছেঃ বোরবন হুইস্কি, রাই হুইস্কি এবং টিনিসি ‘সাওয়ার মাস’। এই তিন প্রধান প্রকার ছাড়াও আছে দুই প্রধান ব্লেন্ডেড হুইস্কিঃ ব্লেন্ডেড রাই বা বোরবন, ব্লেন্ডেড আমেরিকান হুইস্কি।
আচ্ছা এখানে ‘মাস’ বলতে বোঝানো হচ্ছে যে মূল উপাদান থেকে আপনি হুইস্কি বানানো শুরু করবেন তার পরিমাণ বা অনুপাত কেমন। মানে শুধু রাই, বা বার্লি বা গম বা ভুট্টো – নাকি এক বিশেষ অনুপাতে এদের মিশ্রণকে গেঁজানো হবে ইষ্ট দিয়ে। অনেক বছর ধরে (বা এখনো) পারিবারিক ডিষ্টিলার-রা মনে করে যে শুধু বার্লি-গম-ভুট্টোর অনুপাত নয়, তার থেকেও বেশী প্রভাব শালী হচ্ছে আপনি ফার্মেন্ট (গ্যাঁজানো) করতে কি ‘ইষ্ট’ ব্যবহার করছেন! এই ইষ্টের প্রকারভেদের জন্য নাকি হুইস্কির স্বাদ বদলে যায়! আর তাই হুইস্কি প্রস্তুতকারকেরা নিদেন পক্ষে কাউকে জানাতে চায় না ঠিক কি ইষ্ট ব্যবহার করে তারা! হুইস্কি ব্যবসার সবচেয়ে গোপন রহস্য –
“জ্যাক ড্যানিয়্যালস্” এর ডিষ্টিলারি আছে আমেরিকার টিনিসি রাজ্যে লিঞ্চবার্গ শহরে। আর আজ যেহেতু জ্যাক ড্যানিয়্যালস্ এর গল্প বলতে বসেছি, তাই আমেরিকান হুইস্কির কথা সীমাবদ্ধ থাক টিনিসির হুইস্কি নিয়েই। এই যে টিনিসির হুইস্কি প্রস্তুতির পদ্ধতি, এটা কিন্তু রাই হুইস্কি বা বারবোন হুইস্কির মতনই প্রায়, কেবল শেষ দিকে গিয়ে একটু টুইষ্ট। টিনিসি-তে ডিষ্টিল করার পর স্পিরিট-টাকে পাঠানো হয় বিছোনো কাঠকয়লার মধ্যে দিয়ে, মানে উপর থেকে নীচে। এই বিছানো কাঠকয়লা প্রায় দশ ফুট মত গভীর হয়।
ইষ্ট ছাড়া আরো দুটো জিনিস যা হুইস্কি প্রস্তুতিতে বিশাল ভূমিকা নেয় তা হল – জল এবং ওক কাঠ (যাতে হুইস্কি ম্যাচিওর করা হয়)। হুইস্কি উৎপাদনে জলের ভূমিকা নিয়ে অনেক অনেক লেখা লিখি হয়েছে বহুদিন ধরে। পাবলিকের আগে বদ্ধ ধরণা ছিল যে হুইস্কির ফাইন্যাল প্রোডাক্টের যে স্বাদ, তার মূল অবদান নাকি সেই ডিষ্টিলারি যেখানে আছে সেখান থেকে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক জলে। আর ঠিক এই কারণেই নাকি জ্যাক ড্যানিয়েল বেছে নিয়েছিলেন টিনিসির ওই জায়গাটা ডিষ্টিলারি গড়ে তোলার জন্য।
বেশ কিছু বছর আগে গিয়েছিলাম “জ্যাক ড্যানিয়্যালস্” ডিষ্টিলারি দেখতে। যেটা হয় আর কি, গাইড সাথে করে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিল সেই ডিষ্টিলারি, সঙ্গে বলতে লাগলো তাদের ইতিহাস। যদি আপনার ইন্টারেষ্ট থাকে এই ব্যাপারে, তাহলে অতীব ভালো লাগবে সেই ট্যুর। যতদূর মনে পড়ছে, সেই গাইডেড ট্যুর ছিল ফ্রী।
জ্যাক ড্যানিয়্যাল কারখানার গোড়াপত্তন করেন ১৮৭৫ সালে। এদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড হল old No. 7 - আসলে এটা জ্যাক ড্যানিয়ালসের সেই সময়ের ডিষ্টিলারির প্রথম রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার। যদিও পরে সেই ডিষ্টিলারির রেজিষ্ট্রেশন নম্বর পালটে যায় – কিন্তু ততদিনে খুব জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া old No. 7 এর ব্রান্ড নেমটা আর পাল্টাননি তিনি। এখানে হুইস্কি বানানো হয় কর্ণ, রাই আর মল্টেড বার্লি থেকে এবং পরে তামার পাত্রে ডিষ্টিল করে। এবং তার পরে সেই স্পিরিটকে কাঠকয়লার মধ্যে দিয়ে পাঠানোর কথা তো আগেই বলেছি। এই সব হয়ে গেলে একদম শেষ ধাপে এই হুইস্কিকে ম্যাচিওর করা হয় হাতে বানানো ওক কাঠের ব্যারেলে। এই কাঠের ব্যারেলে ম্যাচিওর করা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ধাপ – কারণ এই সময়েই হুইস্কি বেশীর ভাগ স্বাদ এবং সুগন্ধ নিয়ে আসে নিজের মধ্যে। old No. 7 ছাড়াও জ্যাক ড্যানিয়্যালস্ এর আরো ১৪-১৫টা জনপ্রিয় প্রোডাক্ট আছে।
ট্যুরের শেষে যতদূর সম্ভব লেমনেড বা অন্য কিছু সার্ভ করেছিল – কারণ এই ডিষ্টিলারি যেখানে আছে সেটা টিনিসির অনেকগুলি ড্রাই কাউন্টি-র একটা। ফলতঃ সেখানে অ্যালকোহল বিক্রী নিষিদ্ধ। তাতে কি – আপনার পছন্দ হলে অন্য কোন দোকান থেকে কিনে নেবেন!
সাথের ছবি গুলি সেই জ্যাক ড্যানিয়েলস্ ডিষ্টিলারি ঘুরতে গিয়ে তোলা –
আগ্রহের সাথে পড়ছি।
অসাধারন! সুকান্তবাবুর খোলা টইগুলো একেকটি রত্ন!
বাঃ! চমৎকার লেখা! পড়তে পড়তে তেষ্টা পেয়ে গেল!
চিয়ার্স। অনেক কিছু জানা গেল। স্কটল্যাণ্ডেও আসবেন আশা করি।
sundor lekha