শিরোনাম দেখে এটা একটি বিদগ্ধ নিবন্ধ না ভাবাই ভালো। এটা নিছক কিছু ভাবনার অনু্রণন। বছর পাঁচেক আগে এক ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু রামকিঙ্কর বেইজ এর ওপর আবীর মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখা পাঠিয়েছিল। আবীরের প্রতিবেদন ভালো লাগে। আগেও ওর কয়েকটা লেখা পড়েছি, আবাপ রবিবাসরীয়তে। দরদী লেখার হাত। এ লেখাটাও সেদিন অপূর্ব লেগেছিল। এখন আর একবার পড়ে আপ্লুত হলাম। কি অদ্ভুত জীবন! পাঠের শেষে চোখ ঝাপসা। মনশ্চক্ষে ভেসে বেড়াচ্ছিল অদেখা কিন্তু বহুশ্রুত কিছু শান্তিনিকেতনী দৃশ্যকল্প - খোয়াই, শালবন, ধূ ধূ প্রান্তর… সেই প্রসঙ্গেই কিছু ভাবনা ধরতে চেয়েছি এখানে।
১৯৩৪ সালে, মাত্র ৩১ বছর বয়সে, আমেরিকার প্রথিতযশা লেখক আর্ভিং স্টোন, বহু গবেষণা করে প্রখ্যাত ডাচ্ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গখের উপর লিখেছিলেন একটি জীবনাশ্রয়ী উপন্যাস - Lust for Life. সেটি আমি পড়িনি। কিন্তু ঐ বইটি থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে নারায়ন সান্যাল ভারতীয় পটভূমিকায় লিখেছিলেন একটি অনবদ্য কাল্পনিক উপন্যাস - "আবার যদি ইচ্ছা কর।" তাতে উনি যোগ করেছিলেন আর এক বিখ্যাত ফরাসী চিত্রকর পল্ গঁগা-র অনুরূপ একটি চরিত্র। বিষয় বৈচিত্র্য ও প্রকাশভঙ্গীর মুন্সীয়ানায় পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নারায়ন সান্যাল আমার প্রিয় লেখক। ওনার ঐ বইটিও আমার অপূর্ব লেগেছিল। রামকিঙ্কর এর ওপর আবীরের লেখা পড়ে আযইক বইটার কথা মনে পড়ে গেল।
আবীরের লেখায় রামকিঙ্কর এর একটি কথা আমায় খুব নাড়া দিল। পূর্ণেন্দু পত্রী, অমর্ত্য সেন ও অমিতাভ চৌধুরী পৌষমেলায় শান্তিনিকেতনে গিয়ে রামকিঙ্করের সাথে দেখা করতে গেছেন। উনি পূর্ণেন্দুর মেলায় দেখে আঁকা একটি ছবি দেখে বললেন, রিয়ালিটিকে হুবহু কপি করতে নেই। কি ছিল সেই ছবিতে? একটি ছোট ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে। আর তার দুই জংঘার মধ্যে গোঁজা রয়েছে আর একটি বাঁশি। রামকিঙ্কর বললেন, বাস্তব হলেও পায়ের ফাঁকে গোঁজা বাঁশিটি বাদ দেওয়া উচিত ছিল। ওটি ছবিতে ভালো লাগছে না।
রামকিঙ্করের কথায় মনে হোলো বাস্তবের কিছু উপাদান অবাঞ্ছিত মনে হলে তা চিত্রে না রাখাই ভালো কারণ তা ফটোগ্ৰাফ নয় - হুবহু বাস্তবের প্রতিফলন চিত্রে জরুরি নয়। চিত্রকলার মতো কথাসাহিত্যেও এটা প্রযোজ্য। শ্রদ্ধেয় বিমল মিত্র শংকরকে বলেছিলেন, বাস্তব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সাহিত্য নয়, তা খবরের কাগজের রিপোর্টিং। এই ধারণা অনুসরণ করেছেন সুনীল (সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব-পশ্চিম), নারায়ন সান্যাল (রূপমঞ্জরী) এর মতো সাহিত্যিকরা। তাঁরা ঐতিহাসিক ঘটনা, বিখ্যাত বাস্তব চরিত্র আশ্রয়ী উপন্যাসে কথাসাহিত্যের খাতিরে ঐতিহাসিক চরিত্রের মুখে বসিয়েছেন কাল্পনিক সংলাপ। সুনীলতো জোর গলায় বলে গেছেন, উনি কখনোই ইতিহাস লিখতে চাননি, লিখেছেন উপন্যাস তাই বাস্তবের প্রতি একান্ত সত্যনিষ্ঠতার দায়বদ্ধতা ওনার নেই। তাই ঐতিহাসিক ঘটনা বিকৃত না করে, কাল্পনিক সংলাপের ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের স্বাধীনতা নিয়েছেন।
আমারও একটু আধটু লিখতে ইচ্ছে করে। তার কিছু বিষয়ধর্মী রচনা। কিছু গল্পের আদলে লেখা। তাতে থাকে কিছু ঘটনা, চরিত্র ও সংলাপ। সব লেখা পাঠকের ভালো নাও লাগতে পারে তবে (অনুবাদ না হলে) সব লেখাই লেখকের ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রয়াস। যদি তা কোন বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে হয় তবুও জ্ঞানে, অজ্ঞানে লেখক তার সৃষ্ট চরিত্র, ঘটনাক্রম ও সংলাপের মধ্যে অবধারিত ভাবে মিশিয়ে ফেলেন কিছু কাল্পনিক উপাদান। কিন্তু কেন? যে কারনে রামকিঙ্করের মনে হয় পায়ের ফাঁকে বাঁশিটা বাস্তবে থাকলেও চিত্রে বর্জনীয়, লেখকেরও মনে হয় লেখাটি সুষমামন্ডিত করার জন্য প্রয়োজন কিছু কাল্পনিক সংযোজন।
এই কারণে আমার কাছে বেশিরভাগ ভ্রমণবৃত্তান্ত ভ্রমণসাহিত্য পদবাচ্য নয়। "ভ্রমণ" নামক বহুলপ্রচারিত পত্রিকার লেখাগুলি রঙীন ছবি সহযোগে "কোথায় যাবেন-কিভাবে যাবেন-কোথায় থাকবেন-কি দেখবেন" সংক্রান্ত গাইডবুক লিঙ্গোতে বাস্তব অভিজ্ঞতার ধারাবিবরণী। শারদীয় সংখার কিছু লেখা অবশ্য বেশ মননশীল। আবার বন্ধ হয়ে যাওয়া "যারা পরিযায়ী" বা "ভ্রমণ আড্ডা" জাতীয় ভ্রমণ পত্রিকার বেশ কিছু লেখা আমার অনবদ্য লেগেছে। ভ্রমণকেন্দ্রিক হলেও প্রকাশভঙ্গীর সুষমায় সেসব লেখা যেন সাহিত্যরসে ভরপুর।
অনেকদিন আগে আমি ইংরেজিতে দুটি দীর্ঘ কাহিনী লিখেছিলাম। Castaway এবং Full moon at Shushunia. প্রথমটির সময়কাল ২০১০ এর ফেব্রুয়ারি। আমি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে সেটি গল্পের আঙ্গিকে লিখেছিলাম। শেষও হয়েছিল ছোটগল্পের মতো। সেটা পড়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেছিল, এটা কিরকম হোলো? কেন হোলো? ইত্যাদি। আমি তাদের জানিয়েছিলাম, যা লিখেছি তা সম্পূর্ণ বাস্তব। কেন হয়েছিল তা আমি না জানলেও কিছু অনুমান করেছিলাম। তবে তা গোয়েন্দা গল্পের মতো ব্যাখ্যা করার দায় বোধ করিনি, পাঠকের অনুমানের ওপর ছেড়ে দিয়েছি।
দ্বিতীয় লেখাটার সময়কাল আশির দশকের শুরুতে দোলের সময়। চরিত্রগুলিও রঙীন। তাই শুশুনিয়ার পটভূমিকায় সে লেখায় মনের মাধুরী মিশিয়ে শব্দ নিয়ে দোল খেলেছি। পরে "রূপান্তর" শিরোনাম দিয়ে বাংলায় লিখতে গিয়ে সে লেখা প্রজাপতির মতো ডানা মেললো। বুঝতে পারছি বাস্তবের সাথে মিশে যাচ্ছে অনেক কল্পনা তবু লিখতে লিখতে ঘটনাপরম্পরার মায়ায় জড়িয়ে পড়ছিলাম, মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছিলাম সেগুলো যেন সত্যিই ঘটছে। সে লেখার ক্লাইম্যাক্স কয়েকজনের বেশ পছন্দ হয়েছিল।
এই ব্যাপারটা - মানে লেখক কিছু একটা ভেবে লিখতে শুরু করলেও ক্রমশ ঘটনাপ্রবাহ, চরিত্রগুলি যেন লেখককে অন্য কোথাও টেনে নিয়ে যায় - এই ভাবনার প্রতিফলন পড়েছি সুনীলের নিজের জবানিতে। সেটা এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছি:
একটা মাত্র উপন্যাসের সঙ্গে আমি বড় বেশি জড়িত হয়ে পড়েছিলাম, ‘একা এবং কয়েকজন'। এই উপন্যাসটি লেখা হয় প্রায় দু-বছর ধ'রে, এইসময়ে উপন্যাস রচনায় অনেক রহস্য আমার কাছে উদ্ঘাটিত হয়। দুটি বছর ধ'রে কাহিনীটি যেমন বেড়ে ওঠে, আমিও সেই সঙ্গে-সঙ্গে পরিবর্তিত হই। যেন আমার জীবনটাই বদলে যাচ্ছে। উপন্যাসটি শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কিছু আগেকার পটভূমিকায়, একটি বালককে কেন্দ্র ক’রে। সেই বালকটি আমি। অথচ উপন্যাসটি আমার আত্মজীবনী নয়। আমি বর্ণনা করতে চেয়েছিলাম, ওই সময়ের মধ্যে বেড়ে উঠছে একটি বালক, যে দেখেছে মহাযুদ্ধ, বেয়াল্লিশের আন্দোলন, দাঙ্গা, দেশবিভাগ ও স্বাধীনতা—অভিজ্ঞতাগুলি আমার, কিন্তু চরিত্র ও পরিবেশ হবে আলাদা। কিন্তু এই আলাদা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এমনই একটা গতি নিয়েছিল, যা আমাকে স্তম্ভিত ক'রে দেয়—যেন ব্যাপারটা আমার জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার মধ্যে নয়, আমিই লিখছি অথচ আমি জানি না আমি কোথায় যাব। সপ্তাহের পর সপ্তাহ আমি নিজের উপন্যাসটির বিষয়ে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে থাকতাম, যেন অন্য কারওর লেখা পড়ব। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি।
‘একা এবং কয়েকজন’ লিখতে-লিখতে আমি ঢাকা বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার স্বভাব অনুযায়ী, উপন্যাসের ইনস্টলমেন্ট আগে দিয়ে যায়নি, ঢাকা থেকে লিখে পাঠাতে হবে। সেবারে গিয়েছিলাম মনোজ বসুর সঙ্গে, প্রথম দু-একদিন কবি জসীমউদ্দিনের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলাম। উপন্যাসটি লেখা হচ্ছে না, আমি দারুণ ছটফট করছি, একদিন সকালবেলা কবি জসীমউদ্দিনকে বললাম, “আমাকে কয়েকটা সাদা কাগজ দিতে পারেন, আর দু-ঘণ্টার জন্য নিরিবিলি কোনও ঘর?' উনি বোধহয় আমাকে লেখার বাতিকগ্রস্ত পাগল-টাগল কিছু ভেবেছিলেন! ওঁর দোতলার ঘরে কাগজ কলম নিয়ে ব’সেই আমি ঝড়ের মতন দ্রুত লিখে যেতে লাগলাম: মহাযুদ্ধের আগেকার কলকাতার রাস্তা, একটি বনেদি বাড়ি, ঠাকুর দালানের পাশে দুটো পাথরের হাতি, সেখানে অন্যদের সঙ্গে খেলা করছে একটি বালক, ঠিক আমার মতন, অথচ ওই-রাস্তায়, ওই-রকম বাড়িতে আমি জীবনে কখনও যাইনি। লিখতে-লিখতে আমি ফিরে যেতাম আমার কৈশোরে—কিন্তু লিখতাম আর-একটি অচেনা কিশোরের জীবনী।
উপন্যাসটা বেশ খানিকটা লেখার পর সূর্য নামে একটা চরিত্র এল। এই ছেলেটা কোথায় ছিল, কী ক'রে এল কিছুই জানি না! ক্রমশ এই ছেলেটা প্রধান হয়ে উঠতে লাগল, আমি একে হঠাতে চাইলেও পারি না। দু-তিন পরিচ্ছেদ আমি এর কথা চেষ্টা করে বাদ দিয়ে যাই, আবার সে দুম ক’রে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সে অগাস্ট বিপ্লবে যোগ দেয়, আমি দিইনি, আমার সে-বয়স ছিল না, সুতরাং বিপ্লবের পটভূমিকা জানার জন্য আমাকে ইতিহাস পড়াশুনা করতে হয়। তারপর পরাধীন আমলের সশস্ত্র বিপ্লবের যাবতীয় ইতিহাসের প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে এটা আমার উপরি লাভ। সূর্যই আমার এই উপকার করে।
পুরো দুটি বছর সে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়েছিল। সে আমার কম ক্ষতিও করেনি। সে যে-মেয়েটাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে চায়, বাল্যকালে ওই-রকম একজনই তো আমার প্রেমিকা ছিল। সে কি অন্য কোনও মেয়েকে ভালোবাসতে পারত না? শেষ দিকে, আমি সূর্যকে মারতে চাইনি, তবু সে হঠাৎ একদিন ম'রে যায়, কিংবা মরতে বাধ্য হয়। তারপর দারুণ মন খারাপ হয়ে যায় আমার, দু-দিন কারওর সঙ্গে ভালো ক'রে কথা বলতে পারি না, গলার কাছে বাষ্প জ’মে থাকে, যেন আমার প্রিয় বন্ধু মারা গেছে। আমার অসহ্য বোধ হয়, সূর্যকে বাদ দিয়ে আমি বাঁচব কী ক'রে? দুটি বছর সে আমার প্রতিদিনের চিন্তার সঙ্গী ছিল। সে যেন আমারই দ্বিতীয় সত্তা। সে কি এ-রকমভাবে হঠাৎ ম'রে যেতে পারে? প্রেসে কপি দেবার পরও মনে হয়েছিল, ছুটে গিয়ে ওকে আবার বাঁচিয়ে দিই। কিন্তু কোনও মৃতকে বাঁচাবার ক্ষমতা কি আমার আছে! সেই সঞ্জীবনী মন্ত্ৰ আমি জানি না।
সেদিন লাল্লনটপে বিশাল ভরদ্বাজের সাক্ষাৎকারেও সুনীলের ভাবনার হুবহু প্রতিফলন দেখলাম। উনি বললেন, কোনো ছবির চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে কয়েকবার হয়েছে - শুরুতে চরিত্রগুলির হাত ধরে কাহিনী বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি - একসময় দেখি ওরাই আমার আঙুল ধরে লিখিয়ে নিচ্ছে। আমার সৃষ্ট কোনো চরিত্র যেন আমাকেই বলছে - না এটা আমায় মানাবে না, বা এখানটা ঠিক হচ্ছে না, তুমি অন্যভাবে ভাবো। উনি উদাহরণ দিয়ে বললেন - 'ওমকারা' সিনেমার শেষ দৃশ্যে ইন্দু ত্যাগী (কঙ্কনা সেনশর্মা) যেভাবে তার স্বামী ঈশ্বর ত্যাগী ওরফে ল্যাংড়ার (সইফ আলী খান) নলি কেটে মেরে ফেললো - মুল ভাবনায় তা ছিলোই না - এই দৃশ্যটি যেন ইন্দু আমায় দিয়ে করিয়ে নিলো।
আমার বরাবরই যে কথা মনে হয়, রামকিঙ্করের এই কথায় তা প্রবলভাবে অনুরণিত হোলো। বিমূর্ত চিত্রকলা বা কবিতার ক্ষেত্রে তো বাস্তব, কল্পনা, যাদুবাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে কিন্তু সরল কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও বাস্তবকে হুবহু অনুসরণ করতে নেই। আবীরের লেখায় এক জায়গায় রামকিংকরে বক্তব্য নিম্নরূপ:
‘‘জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে, এটা সত্যি। কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউ এসেছে মানসিক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। কিন্তু ছাড়িনি কাউকে। ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব।…আমার মডেলরা আমার বহু স্কেচে, ছবিতে, মূর্তিতে, বেঁচে আছে। মডেলরা তো এভাবেই বেঁচে থাকে।’’
এটা পড়ে, মনে পড়লো, বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পিকাসো সম্পর্কে তাঁর এক নাতনীর মন্তব্য যা নেটে পড়েছিলাম :
How Picasso Bled the Women in His Life for Art By
Cody Delistraty November 9, 2017
Sixteen years ago, Marina Picasso, one of Pablo Picasso’s granddaughters, became the first family member to go public about how much her family had suffered under the artist’s narcissism. “No one in my family ever managed to escape from the stranglehold of this genius,” she wrote in her memoir, Picasso: My Grandfather. “He needed blood to sign each of his paintings: my father’s blood, my brother’s, my mother’s, my grandmother’s, and mine. He needed the blood of those who loved him.”
After Jacqueline Roque, Picasso’s second wife, barred much of the family from the artist’s funeral, the family fell fully to pieces: Pablito, Picasso’s grandson, drank a bottle of bleach and died; Paulo, Picasso’s son, died of deadly alcoholism born of depression. Marie-Thérèse Walter, Picasso’s young lover between his first wife, Olga Khokhlova, and his next mistress, Dora Maar, later hanged herself; even Roque eventually fatally shot herself.
“Women are machines for suffering,” Picasso told Françoise Gilot, his mistress after Maar. After they embarked on their affair when he was sixty-one and she was twenty-one, he warned Gilot of his feelings once more: “For me there are only two kinds of women: goddesses and doormats.”
Marina saw her grandfather’s treatment of women as an even darker phenomenon, a vital part of his creative process: “He submitted them to his animal sexuality, tamed them, bewitched them, ingested them, and crushed them onto his canvas. After he had spent many nights extracting their essence, once they were bled dry, he would dispose of them.”
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি গল্পের নিম্নোক্ত অংশেও পিকাসোর নাতনির বক্তব্যে ছায়া পাওয়া গেল:
ড. রণবীর পোদ্দারের আমেরিকা আবিষ্কার
৫২-য় শুরু হলেও মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ড. রণবীর পোদ্দারের ১২ বছর ধরে হস্তরতি-নির্ভর বিপত্নীক যৌনজীবনের নতুন করে শুরু হয়েছিল যাকে বলে—উইথ এ ব্যাং! ৫২ বছর বয়সে ফিফথ ইয়ারের ছাত্রী দ্বীপশিখা পাইন তাঁর জীবনে উঠে এল, তুলনামূলকভাবে বললে বলতে হয়, ভূমধ্যসাগরের ভেতর থেকে যেমন ভেনাস, ঝরে পড়া জলকণা ছাড়া যার গায়ে সুতোটি নেই। অবশ্য বিখ্যাত গার্ডলটিও যদি ভেনাস থেকে খুলে নিতে চান, তাহলে আলাদা।
আমাদের আলোচ্য গল্পের নায়িকার বয়স ২২ আর তাঁর ৫২ — দুটি ক্ষেত্রেই অন্তত শুক্রের অবস্থানের দিক থেকে একটা অর্থাৎ বয়সের গরমিলে যে মিল সেদিক থেকে তুলনামূলক রয়েছে বৈকি। এবং রবীন্দ্রনাথ। সেও কিন্তু সেই তিরিশের ফের। যদিও এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ৬২ এবং ভিক্টোরিয়া ৩২। রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর দেহতত্ত্বের ব্যাপারটা চিরতরে সাব্যস্ত করতে তিনি গিয়েওছিলেন আর্জেন্টিনায় – সে-বছর ১৯২২-এ তপতী গোস্বামী ওপেন হাইমারকে ডিঙ্গি মেরে তিনি যেবার মেরিল্যান্ডের ওপেন ইউনিভার্সিটি অফ ডায়িং কালচার থেকে গ্রান্টটা পেলেন। সান ইসিদ্রো-ফিসিদ্রোর বাগানবাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করলেন। স্প্যানিশ দোভাষীর সাহায্যে পড়লেন ভিক্টোরিয়ার ডায়েরি।
রবীন্দ্রনাথ চেয়ারে বসে আছেন, পিছনে ভিক্টোরিয়া — হয়তো চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন অসুস্থ কবির—যখন অন্তত একবার স্তনস্পর্শ পেলেন কবি। হাতে দিয়ে ধরলেনও একবার। ব্যাস, ঐটুকুই। ভিক্টোরিয়ার মনে হল, যেন গাছের আপেল ধরেছেন। ছিঁড়লেন না। এই সেই ভিক্টোরিয়া, সান ইসিদ্রোর নির্জন বাগানবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের ঘরের পাশের যে শুয়ে থাকে, অভিযাত্রী অধ্যাপক যেতে যেতে আরও দেখলেন, 'কুকুরের মতো' কবির একটি ইশারার অপেক্ষায়— যদিও শালীনতার কারণে বাঙালি অনুবাদে 'কুকুরের মতো’ হয়ে দাঁড়ায় 'প্রাণী বিশেষের মতো। ভিক্টোরিয়া তো রবীন্দ্রনাথের ৬২ বছর দেখেননি - গবেষণা করতে গিয়ে ড. পাইন যা পেলেন — দেখেছিলেন, এক পরমপুরুষের 'সুগঠিত গ্রীবা।' আর রবীন্দ্রনাথের অনুভব তো ছড়িয়ে আছে 'পুরবী'র ছত্রে ছত্রে। যেমন :
'ফিরিয়া যেও না শোনো শোনো
সূর্য অস্ত যায়নি এখনও
সময় রয়েছে নাকি সময়েরে
দিতে ফাঁকি ভাবনা রেখো না মনে কোনও।'
ইত্যাদি
ভিক্টোরিয়া প্রস্তুত ছিলেন দেহে এবং মনে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ? পারলেন না। কারণ শান্তিনিকেতনে মনীষী ক্ষিতিমোহন থেকে চাকর বনমালী, তিনি সকলেরই গুরুদেব। সত্যি, খ্যাতির বিড়ম্বনা আর কাকে বলে। 'স্বখাত সলিল'ও বলা হয়ে থাকে একে। তখনও গবেষণা-গ্রন্থের একচ্ছত্রও লেখা হয়নি (এখনও হয়নি)। কিন্তু এইসবই—এই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তার গবেষণামূলক আবিষ্কারের গল্প দিয়েই, বিমুগ্ধ ছাত্রী দ্বীপশিখার কুমারী দেহতত্ত্বের উপকূলে তাঁর জলদস্যু-অবতরণ।
'কিন্তু ওঁর তো তখন ৬২ – '
রবীন্দ্রনাথের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে দ্বীপশিখা বলে।
‘তাহলে পিকাসো?” নাকের ডগা থেকে প্রফেসর পোদ্দারের চশমা বুকে পড়ে যায়। ভাগ্যিস কর্ণে বাঁধা ছিল, 'ফ্রাঁসোয়া জিলোকে বিয়ে করলেন কবে? যখন ৭২। সন্তানাদিও হয় এবং পরে ডিভোর্স হলেও তারা পিকাসোর বলেই প্রকাশ এবং তারা তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারীও হয়নি কি?”
'জিলো এসেছিল মডেল হতে।' অধ্যাপক জানালেন তাঁর জ্ঞানতাপসী ছাত্রীকে। তথ্যে সমৃদ্ধ করছেন, কাজেই খুলে বলতে তাঁরও অসুবিধার কিছু থাকতে পারে না, যখন বললেন, 'পিকাসো মাঝে মাঝে গিয়ে বুক টিপে অসেন ফ্রাঁসোয়া জিলোর। দোষের মধ্যে জিলো জানতে চায়, ‘মঁসিয়ো, আপনি তো আমার নিউড আঁকছেন না, আঁকছেন জামাকাপড়-পরা ছবি – তাহলে এ-সবের দরকার পড়ছে কেন?'
‘তুমি কি ভাবছ,' অয়েল ক্যানভাসের বুকে রঙ বোলাতে বোলাতে তুলির বাঁট দিয়ে ছবির স্তনশিখর চেপে ধরে পিকাসো জানতে চাইলেন, 'এখানে কোনও মাংস নেই? শুধু রঙ আর রেখা? এখানে কতটা মাংস লাগবে, আমি সেটাই দেখে নিচ্ছি তোমার বুকে হাত রেখে।'
'আচ্চা এ-সব কি সত্যি ?”
“তুমি জিলোর - 'মাই লাইফ উইথ পিকাসো' বইটা পড়ে দেখো না। সঙ্গে জন বার্জারের লেখা পিকাসো-অ্যাসেসমেন্টটা। ঐ তো সেল্ফ-এ রয়েছে'— দ্বীপশিখা হাত পাচ্ছে না দেখে ড. পোদ্দার এই সময় উঠে গিয়ে ছাত্রীর বাহুসন্ধির নিচে দু-হাত রেখে দ্বীপশিখাকে তুলে ধরেন বই-এর নাগাল যাতে সে পায় সেজন্যই— এবং দ্বীপার স্বাস্থ্যদুটি কেমন তা প্রথমে জানতে পারেন, যদিও দ্বীপশিখা তাঁর সুগঠিত বাহুদ্বয় আগেই লক্ষ্য করেছিল। তখন লং প্লেয়িং-এ বাজছিল মোৎসার্টের 'ম্যারেজ অফ ফিগারো।
= ★ = ★ = ★ =
আগ্ৰহী পাঠকের জন্য রইলো আবীর মুখোপাধ্যায়ের যে লেখাটি পড়ে বেশ লেগেছিল ও Paris Review এর লিংক যাতে পিকাসোর নাতনির বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল।
আবীর - আবাপ
Paris Review Link
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।