তির্যক সময়ের শ্লোকসমূহ
"একটা রেলগাড়িতে চড়লেই আসলে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে চলে যাওয়া যেত, যদি না পলিটিক্স মাঝখানে সীমানা বসিয়ে রেললাইনটা টুকরো করে দিত।"
'দুষ্কালের আখ্যানমালা'র গল্পগুলো পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে একটা ট্রেনে করে যেতে যেতে জানলা দিয়ে আচমকা কয়েকটি চরিত্রের ঝলক এবং কিছু দৃশ্য দেখছেন, আর এই যাত্রাপথে ট্রেনটা আসলে এগিয়ে যাচ্ছে এক দুষ্কাল থেকে আরেক দুষ্কালের দিকে। চরিত্রগুলোকে পড়তে পড়তে আসলে আমরা যখন এই সামগ্রিক যাত্রাপথের কথা অল্প সময়ের জন্য বিস্মৃত হই, তখনই মাঝে মাঝে দিনের বেলা আচমকা সূর্যগ্রহণের মত এই সমস্ত দুষ্কালের ছায়া নেমে আসে চরিত্র এবং দৃশ্যাবলীগুলির ওপর। এই সংকলনের দশটি গল্পের অধিকাংশ ভুবন জুড়ে অবস্থান করে দীর্ঘায়িত এই ছায়া, যাকে অস্বীকার করার উপায় পাঠকের কাছে নেই। বইটির সুলিখিত ভূমিকায় ইন্দ্রাণী যেমন বলেছেন - "এই জীবন, এই সময় যেন স্বয়ং ব্যাসদেব, তার যাবতীয় কূটশ্লোক লিখে নিচ্ছেন দময়ন্তী।"
দময়ন্তীর গল্পে আমরা নারীদের মধ্যে দুই শ্রেণী দেখতে পাই। একদল ট্রেনে রোজ যাতায়াত করে, খেটে দিন আনে দিন খায়। 'তিমিরের বেদীতে উৎসব' গল্পের নাকুশার মত প্রতিদিনের তিরিশ টাকা মজুরিতে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে পাহাড় পাতলা করে। আরেকদল অর্থনৈতিক ভাবে এদের থেকে একটু ওপরে - 'তিমিরের বেদীতে উৎসব' গল্পের ব্যাঙ্কের পিওন "ধিঙ্গি মৌসি" মঙ্গলা, 'ইসমাইলের পাঁঠার দোকান' গল্পের "ঘাসের মত মেয়েমানুষ" রুমা মিস থেকে 'পরের জা'গা পরের জমি' গল্পের ভারতের তিন জায়গায় বাড়ি ফ্ল্যাটের মালকিন নামজাদা উইনভেস্টার [ওম্যান ইনভেস্টার], যে জানে "ভার্জিনিয়া উলফের সেই একটি মেয়ের নিজস্ব একটি ঘরের স্বপ্ন, পরের জমিতে ঘর বানিয়ে ঘরের মালিক হওয়ার রাস্তাটা আসলেই কতটা আলাদা।"
বিত্ত নির্বিশেষে এই সমস্ত স্বাধীনচেতা চরিত্রের মধ্যে একটাই মিল কাজ করে - এরা সবাই পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে আপসহীন। এই নিজের মত থেকে সরে না আসার রাজনীতি থেকেই 'হৈমবতীর আমগাছ' গল্পে পৃথিবীতে বাকি সবাই তাকে অন্য নামে, সরকারী কাগজে লেখা নামে ডাকলেও, রোগশয্যায় শুয়েও তার নাম ডাক্তার জিজ্ঞেস করলে হৈমবতী বারবার নিজের নাম 'হৈমবতী'ই বলে যেতে থাকেন। 'অহৈতুকী' গল্পে একলা মঙ্গলা যেন হিমালয়ের কোলে এক মহাপ্রস্থানের পথে হেঁটে যান। এই দাঁতে দাঁত চিপে বেঁচে থাকার নাছোড়বান্দা লড়াই করে যাবার প্রসঙ্গগুলো পাঠককে মতি নন্দীর খেলার ওপর লেখা বইগুলোর চরিত্রদের কথা মনে করিয়ে দেবে।
'রানার ছুটেছে তাই', 'ধুলামুঠি' র মত গল্পে বহতা সময়ের দাবি মেনে নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই খেটে খাওয়া চরিত্ররা অনেকে কম্ফিকার্ট, নাস্তা বোলে তো, ইটস ডান, কিরানা বাজারের মত ডেলিভারি কোম্পানি বা এক বৃহত্তর গিগ ইকনমির অংশ, আবার বিঠঠল সালকের মত কেউ কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত কর্পোরেটরদের হাতের অস্ত্র।
দময়ন্তীর গল্পের পৃথিবীতে নারী পুরুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণী এবং আপাত জড়বস্তু দেরও চরিত্র হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব আছে। যেমন কমলেকামিনী নামের পায়রা বা চাক্কু, পতাকা, ফুলু নামের কুকুররা। নির্জন দুপুরবেলা হৈমবতী ঠাকুরঘরের জানলা দিয়ে আমগাছে বাসা বেঁধে থাকা একটা কাকিনীর সঙ্গে গল্প করেন। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় পাঁঠার মাংসের দোকানের কালো পাঁঠা এবং তাকে মারতে উদ্যত চপার তার প্রথম পুরুষে বলা নিজস্ব বক্তব্য পাঠককে পড়াতে থাকে -"ছাগলরা পাঁঠারা অনেক খবর পায়। টাটকা ঘাসেরা খবর দেয় ওদের, পোকারা খবর দেয়, বাতাস খবর দেয়। চপার মরণের গন্ধ পায়, তার জন্মই তো কাউকে মারার জন্য।" 'মেয়ের নাম ফেলি' গল্পে দেব সাহিত্য কুটীরের পূজাবার্ষিকী বইগুলো যেন ফেলির ওপর অভিমানী হয়ে চুপি চুপি একা একা হারিয়ে যায়।
গল্পগুলো পড়তে পড়তে আচমকাই পাঠক আবিষ্কার করেন এই পাঠ প্রতিক্রিয়ার শুরুতেই যে ট্রেনের উৎস এবং গন্তব্য স্টেশনের কথা বলা হল, দময়ন্তী এই যাত্রাপথের মাধ্যমে তাদের দক্ষভাবে মিলিয়ে দিচ্ছেন। 'দুষ্কালের পদধ্বনি' গল্পে ষাটের দশকের অসমের বঙাল খেদা এবং সাম্প্রতিক ডিটেনশন কেন্দ্র গড়ে ওঠার খবর দুই দুষ্কালকে এক করে দেয়। পাণ্ডুরং বাপতের মুলসি সত্যাগ্রহর সঙ্গে মিশে যায় সাম্প্রতিক কিষাণ মহাযাত্রা। স্বাধীনতার পর কোচবিহার ভারতের অংশ হয়ে যাবার সঙ্গে মিলে যায় মহারাষ্ট্রের আলাদা রাজ্য হিসেবে জন্ম। সেই বহু বহু বছর আগেকার প্যাঞ্জিয়া থেকে ছিটকে গন্ডোয়ানা তৈরির সময় অগ্ন্যুৎপাতে তৈরি হওয়া মালভূমির সঙ্গে কোভিড লকডাউনের মধ্যে আগত সাইক্লোনের ঝড় বৃষ্টি একাকার হয়ে যায়।
কিছু কিছু গল্পে ব্যবহৃত মারাঠি শব্দগুলোর ব্যাখ্যা থাকলে ভালো হত। তাউ, গুড়ি পড়ওয়া, মাতোয়ালা, মুলগি, হুরডা পার্টি, গুন্ঠা - অধিকাংশ বাঙালি পাঠক এসব শব্দের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত নন।
হৈমবতীর কাশ্মীরি কাঠের কাজ করা বাক্সর মত এই বইয়ের প্রচ্ছদের ছবিটা নিজেই যেন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ গল্প। দুটো কবজি থেকে গাঁথা লাল মাটির হাতের ছবি যেন মনে করিয়ে দেয় বইয়েরই একটা গল্পের শেষ বাক্য - "এই শহরের নদীতে কোনো লাশ ভেসে উঠবে না। "
বইঃ দুষ্কালের আখ্যানমালা
লেখকঃ দময়ন্তী
প্রকাশকঃ গুরুচণ্ডা৯
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৪০ টাকা