সকাল নটা দশে, ২৫ ডিসেম্বরের শীত-সকালে শাঁওলি মিত্র বলছিলেন তাঁর সমস্ত কাজকর্ম, শৈল্পিক উৎকর্ষ – এসব বাদ দিয়েও, মানুষ হিসেবে তিনি নিজেকে যেমন পেয়েছেন, সেই ‘নিজের কথা’, তাঁর ভাষায় ‘ব্যক্তিগত মানুষ হিসেবে আমার নিজের, আমি মানুষটাকে খুব খারাপ লাগে না’। এবং তার সঙ্গে একমুঠো হাসি। সঙ্গে সঙ্গে অভিনেত্রী শাঁওলি, নাট্যকার শাঁওলি, শম্ভু মিত্র – তৃপ্তি মিত্রর কন্যা শাঁওলি – এই সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে তিনি একজন ভাল লাগার মানুষ হিসেবে প্রতিভাত হয়ে উঠলেন। তাঁর সঙ্গে খুব সহজভাবে কথা বলা যায়। টানা দু’ঘণ্টা একটুও বিরক্ত না হয়ে কথা বলা শাঁওলিকে বলছিলাম, লেখায় যা পাইনি, অর্থাৎ তাঁর লেখার বাইরে কিছু বলতে – ধরা যাক ছেলেবেলা দিয়েই।
– ‘মুকুরে মুখ না মুখোশ’ নামে আমার যে বইটি আছে, তাতে কিছু লিখেছি। আমার বাবা-মা শুধুমাত্র নয়। আসলে পারিবারিক বাতাবরণটা খুব ভাল ছিল। আমি ছোটবেলা থেকে একা তো – কিন্তু সব সময়ে বাড়িতে লোকজন। ঐ যে বহুরূপী পরিবারের কথা লিখেছি। একা হলেও আমার কিন্তু একটা সামাজিক সত্তা তৈরি হয়ে গেছিল। সেটা তো খুব জরুরী, ঐ ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক।
– আরো একটু বিশদ বলুন।
– যেমন ধর, সবসময় একটা কাজের পরিবেশে বড় হয়েছি। যেন কিছু একটা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কবিতা আবৃত্তি। তখন বহুরূপীতে কোরাস কবিতার একটা চর্চা হত। ঐ কবিতাগুলো সবসময় শুনতে শুনতে বড় হয়েছি – রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি, তারপর ঐ যে আছে না... ঈশানের পুঞ্জমেঘ বা সেদিন সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে। তখন মানেটানেও বুঝতাম না। তারপর খুব গান হত বাড়িতে। মা তো সবসময় গুনগুন করতেন। আগুন জ্বালো, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা, মারের সাগর, এদিন আজি কোন ঘরে গো, আরো আরো প্রভু – এসব গানগুলো খুব বেশি হত বাড়িতে। তারপর মা গাইতেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের নবজীবনের গান – এসো মুক্ত করো। এগুলি কোথাও একটা কাজ করেছে, আমাকে আজকের ‘আমি’ হতে সাহায্য করেছে।
কোরাস কবিতা হত, আবার কখনও একক। তখন বহুরূপী আবৃত্তির অনুষ্ঠান করত – আমি তখন খুব ছোট। পরে নাটকের চাপ পড়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তবে নাটকের জন্য গলার চর্চার ব্যাপারটা থেকে গেল।
– গলার চর্চা, আপনি কী করে করেছেন?
– নাটকের জন্য তো সবই করেছি। একটু নাচতে পারি, একটু গাইতে পারি, একটু আবৃত্তি করতে পারি। কিন্তু আবৃত্তি সবচেয়ে কঠিন শিক্ষা। গলার চর্চা মানে তো কৌশল। গলার পর্দার রেঞ্জ বাড়ানো, প্রক্ষেপণের ব্যবহার। আমি খুব কষ্ট করে শিখেছি বাবার কাছে। বেশ বড় হয়ে। আবৃত্তি কখনও হয়ে যায় না। কষ্ট করে শিখতে হয়। এটা সবচেয়ে কঠিন। কবিতা তো সবচেয়ে উঁচুস্তরের শিল্প। তার গভীরতা অনুধাবন করা এবং তারপর ছবিটা শ্রোতাকে পৌঁছে দেওয়া – বলা, উচ্চারণ, মনন, চিন্তা – এত কিছু দিয়ে একটা উপলব্ধি আমার নিজের হলে, তবে তো অন্যকে পৌঁছে দেওয়া যায়। তারপর সেই উপলব্ধিটি ‘কোন গলায়’ বলব –
– ‘কোন গলা’ সম্পর্কে আরো একটু বলুন।
– হ্যাঁ, যেমন ধর, বেশি গলা খেলালে তো গলাটা কৃত্রিম হয়ে যাবে। তাই ভারসাম্য রাখবার প্রয়োজন। যেমন, ‘আছে আছে স্থান... না হয় হবেই ঘেষাঘেঁষি’।
(তিন রকমভাবে ‘না হয় হবেই’ বললেন শাঁওলি। শেষবার খুব হাল্কা করে।)
এই যে সাবজেক্টিভিটি অর্থাৎ ভিড় সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যাটা শ্রোতাকে পৌঁছে দেওয়া চলিত কথোপথনের সুরটা – ‘না হয় হবেই–!’ এটা খুব কঠিন। যেমন দুর্যোধনের হাসি – (হা হা করে হাসলেন) দুর্যোধন কেমন করে হাসতেন, তা তো জানি না। আমার ভাবনায় তিনি হা হা করে হাসতেন। সেই ভাবনাকে শ্রোতার কানে পৌঁছানো। তাই চিন্তার পেছনে একটা যুক্তি থাকতে হবে – যে দুর্যোধনের মত লোক এইভাবে হাসতে পারে! এই ‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে’ (দু’ভাবে বললেন) একটা সুরে কবিতা বলা, আর একটা আবৃত্তি। আবৃত্তির একটা ব্যাখ্যা থাকবে।
– গানও তো একই ব্যাপার? ভাবনা, ব্যাখ্যা?
– গানে যে একটা স্বরলিপি তৈরি থাকে। সেটা তো সুবিধে। আবৃত্তিতে তৈরি করা স্বরলিপি নেই, নিজেকে তৈরি করতে হয়, তারপর কবিতাকে এখনকার সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে হয়। গানে তো বড় অবলম্বন স্বরলিপি। আবৃত্তি অনেক কঠিন। রেকর্ড করেও ঠিক বোঝা যায় না। নিজেকে বোঝার জন্য, খুব শক্ত। তারপর কাহিনীভিত্তিক কবিতা হলে আলাদা। কিন্তু অন্য কবিতা, তার অনুভবের দিক, মননের দিক, খাটনি অনেক বেশি। আসলে সব শিল্পই একটা স্তরের পর খুব কঠিন হয়ে যায়। আমাকে তো নাকানি-চোবানি খেয়ে শিখতে হয়েছে। বাবার সঙ্গে একমঞ্চে করতে হবে, তখন শেখা, বাধ্য হয়ে বাবা শেখালেন। প্রায় বাইশ-তেইশ বছর বয়স তখন।
– শেখানোর ধরনটি বলুন?
– বাবা তখন অন্য বাড়িতে। আসলে তখন আমারও একটু নামডাক হয়েছে। বাবার কাছেও প্রচুর লোক আসে, মার কাছেও প্রচুর লোক আসে, আমার কাছেও প্রচুর লোক আসে। ছোট ফ্ল্যাটে আর হয় না। তাই বাবার কাছে হাঁফাতে হাঁফাতে পাঁচতলায় উঠে সারা সকাল – প্রায় রগড়ানো। খালি বলতেন ‘হচ্ছে না’। আবার বাড়ি এসে আনমনা হয়ে থাকতুম। কবিতাটা মাথায় ঘোরাফেরা করত। তারপর আবার বিকেলে বাবার কাছে।
– আর গানের কথা?
– গানের চর্চাও ঐ গলা তৈরির জন্য। দেখলাম অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত, ক্ল্যাসিকাল-এর ট্রেনিং না থাকলে গাইতে পারছি না। আবার আওয়াজ তৈরি করা দরকার ছিল। নিজেই একটা ন্যাশনাল স্কলারশিপ যোগাড় করে নিজের পয়সায় তানপুরা, তবলা কিনলাম। আমার গুরুজি ছিলেন ধীরেন দাস। নাম করা লোক নন, কিন্তু অসাধারণ শিক্ষক।
– আর সুচিত্রা মিত্র?
– হ্যাঁ। সেইজন্যে ওঁর কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সবিতাব্রত দত্ত, আমার মেসো। একটা গান গাইতে বললেন। আমি তো নার্ভাস হয়ে গেছিলাম। সুচিত্রাদি বললেন রবিতীর্থে থার্ড ইয়ারে ভর্তি হয়ে যেতে, উনি নিজেই ক্লাস নেবেন। রবিতীর্থতে গেলাম। ওঁরা কিছুতেই থার্ড ইয়ারে আমাকে নেবেন না। নাম করব না এখন আর, দুঃখ পাবেন। বললেন – মাত্রা-টাত্রা জানো না। তো আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, নবতাল তো জানি – ‘নিবিড় ঘন আঁধারে’-টা নবতালে না? তখন বাধ্য হয়ে নিলেন। তারপর সুচিত্রাদির কাছে শেখা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
– অসাধারণ কেন বলছেন?
– কী যত্ন করে গানের গ্রামার শেখাতেন। প্রথমদিন নিজের হাতে খাতায় স্বরলিপি লিখে দিয়েছিলেন। তারপর গানের কলি নিজে গেয়ে আমাদের স্বরলিপি তৈরি করতে দিতেন।
– নাটকে এটা কিভাবে কাজে লেগেছে?
– হ্যাঁ, যেমন ‘রাজা’তে আমি সুরঙ্গমা করেছি। নাটকে তো অনেক লাইন পুনরাবৃত্তি করা হয়, সেটা মূল স্বরলিপিতে নেই। আমি চড়ায় গাইতে পারতাম না। একটা গান হয়তো খাদেও আছে, চড়াতেও আছে। সুচিত্রাটি আমাকে নিচের এফ-শার্পে গানটা তুলে দিতেন। মঞ্চে গাইলে অনেক নামী শিল্পীও বলতেন – তুই যখন গানটা ধরলি, ভাবছি গাইবি কেমন করে? (হাসি) সুচিত্রাটি বললেন, এরকম পুনরাবৃত্তি হয় না। আমি বললাম হ্যাঁ, এখানে রিপিট হবে নাটকে, আমি শুনেছি, আগেও তো রাজা হয়েছে। তখন – ‘ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর... তোমার প্রেম তোমারে এমন করে করেছে নিষ্ঠুর’, উনি রিপিট করে শোনালেন। প্রথমবার স্বরলিপি অনুসারে গাইলেন, তারপর ‘প্রেম তোমারে’ বলে একটু থেমে আর এমন করে ধরে দেখালেন – গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হল, এইভাবেই পুনরাবৃত্তি সার্থক হয়।
– এরপর দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে শিখতে গিয়ে কেমন লাগল?
– জর্জমামার কাছে তো আরও পরে। উনি একদম তালের ধার ধারতেন না। বলতেন, ‘আমি তো বেতালা, বেরাগ – আমার রাগ নাই। তেওরা, ধামার দিয়া কি হইব?’ উনি কথাকে সুর দিয়ে প্রকাশ করা শিখিয়েছেন। বললেন, গান দিয়েছি, গানটা ভাল করে গাও।
– যখন ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো’তে ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’ গান হচ্ছে, তখনকার অনুভূতি?
– তখন তো আমি অনেক ছোট। জানতামই না কে গেয়েছেন। গানটা তো জর্জমামার গাওয়া না সুশীল মল্লিকের গাওয়া, সে নিয়ে একটা তর্কও ছিল। আমি শুধু পরিচালক যা বলেছেন করে গেছি।
– আর ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা?
– উনি তো নিয়ম না মানা মানুষ। এত বোহেমিয়ান। কিন্তু অভিনয়টা আমায় করে দেখাতেন। যা বলতেন, কিছু না বুঝে করে দিতাম।
– মেয়েটির ভূমিকাটিও ঋত্বিক অভিনয় করে....?
– হ্যাঁ, উনি ঐ মেয়েটির ভূমিকাও অভিনয় করে দেখিয়েছেন। এবং ঐ বয়সী একটি মেয়ের চরিত্র উনি অবিকল ফুটিয়ে তুলতেন।
– পরে আর ফিল্মে অভিনয়ে এলেন না?
– ডাক পাইনি তো – লোভনীয় কোনো ডাক পাইনি।
– দেবব্রতও তো নিয়মভাঙা মানুষ ছিলেন?
– না না। সে শুধু গানে। বাড়িতে প্রচণ্ড ডিসিপ্লিন্ড। একটি ইজিচেয়ার নিয়ে হারমোনিয়ামের সামনে বসে থাকতেন। সেই হারমোনিয়ামেই গান, তার ওপরই লেখা, তার ওপরই থালা রেখে খেতেন। শ্রীকান্ত, অনন্ত ছিল, কিন্তু নিজে রান্না করতে খুব ভালবাসতেন। ভীষণ ভাল রান্না করতেন। সেই আমাকে চিকেন রোটি শেখাবেন বলেছিলেন, আর রসুন দিয়ে শাকভাজা – হারমোনিয়ামের সামনে জর্জমামা – একটা ছবি হয়ে গেছে।
– ডিসিপ্লিনের ব্যাপারটা আপনার শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে...?
– আমার বাবাও বলতেন, ডিসিপ্লিন না থাকলে তো শিল্পী হওয়া যায় না। গলা, শরীর, সবকিছু তো সচল রাখতে হবে। শুধু গলা নয়, শরীরও, ব্যায়ামও করা দরকার। দুম করে স্টেজে ওঠা যায় না। ডিসিপ্লিন থাকতেই হবে।
– কখনও নিয়ম ভাঙেননি?
– (হেসে) সে অল্প জায়গায়। জানো, ভাবলাম সিগারেট খেয়ে দেখি। বাবার প্যাকেট থেকেই সিগারেট খেলাম। মা তো বাথরুমের সামনে গিয়ে (বাবা তখন স্নানে) চেঁচাচ্ছেন... দ্যাখো, তোমার মেয়ে কী করছে! বাবা কিছুই বললেন না! তারপর আরো এক কাণ্ড। বহুরূপীতে হিমাংশু কাকা বললেন – তুই সিগারেট খেতে পারিস? আমি বললাম – এ আর এমন কী? পারি তো! তবে আমি ঐ সব চারমিনার-টিনার খাই না, ডানহিল-টিল হলে খাই। হিমাংশুকাকা বললেন – এই নে, খা। ছোটবেলায় একেকটা অদ্ভুত জায়গায় অহংকার থাকে না? যে এটা আমি পারব না? খেলাম। আর বহুরূপী ভীষণ ডিসিপ্লিন্ড জায়গা। সেখানে আমি সিগারেট খাচ্ছি – সবাই ভয়ে কাঁটা। যথারীতি বাবার কানে উঠে গেল। বাবা ডেকে বললেন – তুই সিগারেট খেয়েছিস? খেতে পারিস, সেটা কিছু নয়, তবে কিনা গলাটা খারাপ হয়ে যাবে... অভিনয়টা আর করতে পারবি না। বাবার ঐ ধরণ ছিল।
– আপনি নিজে? দলের ক্ষেত্রে?
– আমি তো সবাইকে সিগারেট খাওয়া ছাড়াই। শুধু বাবুকে ছাড়ানো যায়নি। তবে মহলার সময় ধূমপান কেউ করেন না। রিহার্সাল চত্বরেও, দু’-একজন খেলে – বাইরে গিয়ে। শিল্পীকে তো সংযত হতে হবে। ডায়েট পর্যন্ত। বেশি খাবে না – অ্যাসিডিটি হলে অভিনয় অ্যাফেক্টেড হবে। সেটা তো আমি অ্যাফোর্ড করতে পারি না। আমি তো প্রোফেশনালি পারফর্ম করছি। আর তাছাড়া নিজের কাছেও একটা দায়বদ্ধতা থাকে...
ক্রমশ...
মূল ছবিটির কপিরাইট: By Government of India - This file or its source was published by Press Information Bureau under the ID 2181 and CNR 17156. (direct link)This tag does not indicate the copyright status of the attached work. A normal copyright tag is still required. See Commons:Licensing, GODL-India, Link