– কীভাবে মনঃসংযোগ করেন?
– অভিনয়ের দিন কারুর সঙ্গে কথা বলি না। একদম স্ক্রিপ্ট নিয়ে ঘরে দরজা করা। এমনকি ফোনও ধরি না। সবাই জানেন এখন। আসলে প্রায়রিটি বেছে নিতে হবে তো; শিল্পচর্চা একটা। সাধনা, যেখানে মানুষকে একা হতে হয়।
– তাই জন্যই কি রবীন্দ্রনাথ? বা ভার্জিনিয়া?
– হ্যাঁ, কাজের একটা নিজস্ব পরিমণ্ডল দরকার হয়। অনেক সময়ই জীবন আর কাজ মেলে না। যৌথ কাজ করা ভাল। কিন্তু সমমনোভাবাপন্ন মানুষ পাওয়া... খুব শক্ত, খুব শক্ত।
এটা কোনো ইউটোপিয়ান চিন্তা নয়। আমার মনে হয় প্রত্যেক কাজের একটা যুক্তি থাকা চাই। যুক্তি যদি শক্তিশালী হয়, তবে কাজটা মেনে নেওয়া যায়। সেটা যদি কেউ বোঝেন... বুঝতে পারলে সুবিধে হয়।
– রবীন্দ্রনাথ কি সেখানে কাজে আসেন?
– অনুভবের স্তরে। হ্যাঁ, একাকিত্ব হোক বা না হোক, একটা জায়গায় মনন আর হৃদয় মিলে গেলে একটা উপলব্ধির সুযোগ হয়, যেটা প্রতি মূহূর্তে ধ্বনিত হয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করে। সেটাই প্রাপ্তি।
– ভার্জিনিয়া আপনার একটা অংশ কী করে হয়ে যায়?
– ভার্জিনিয়া তো গ্যালিলিওতে একটা নগণ্য চরিত্র। বড় বড় আলোচনা সে কিছুই বোঝে না। আমি আর স্বাতীলেখা বসে মাইম করতাম। ভার্জিনিয়ার ‘না বুঝতে পারা’টা এস্ট্যাবলিশ করা খুব দরকার ছিল।
– গ্যালিলিওর তো মেয়ে ছিল না? এটা তৈরি করা হয়েছিল....
– হ্যাঁ, বলা নেই কোথাও? একটা বার করে নেওয়া চরিত্র... নাটকসূত্র নেই, এই চরিত্রটাকে বার করা খুব চ্যালেঞ্জিং হয়েছিল... প্রতিবার নিজেকে গড়ে নেওয়া। ওটাই তো থিয়েটার। ২১টা শো’তেও অভিনয় আইডেন্টিকাল হয় না। প্রতিবার নতুন অভিনয়।
– আর দ্রৌপদী? নাথবতী অনাথবৎ ?
– ইঙ্গিত পেয়েছিলাম ইরাবতী কার্ভের ‘যুগান্ত’ পড়ে। বাবার কিন্তু দ্রৌপদীকে নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা ছিল না। গান্ধারীকে নিয়ে বলতেন, কুন্তীকে নিয়ে বলতেন – কিন্তু দ্রৌপদী কখনো নয়... ‘যুগান্ত’ পড়ে বাবাকে বললাম। বাবা বললেন – দ্রৌপদীকে নিয়ে কি বিশেষ কিছু করার আছে? দ্যাখ। তারপর মহাভারত পড়া শুরু করলাম – কাশীরাম দাস, কালীপ্রসন্ন সিংহ। চরিত্রটার একটা আন্দাজ পেতে চাইছিলাম। লেখা শেষ হলে, বাবা পড়ে বললেন, পয়েন্ট, যুক্তি আছে।
আসলে মহাভারত তো লোকআঙ্গিকে পাল্টে গেছে। সেই সমাজটাকে বোঝা দরকার।
– এই সমাজ নিয়ে আপনার একটা ‘খটকা’ আছে বলেছিলেন?
– হ্যাঁ, ঐ যে বলছে রাধার দোষে কৃষ্ণ কালো হয়ে গেছে, না হলে কৃষ্ণ তো আগে ‘গোরা’ই ছিল। এ থেকে বোঝা যায় সমাজটা কতটা পুরুষের তৈরি – তারপর ঐ যে কর্ণকে নিয়ে। কর্ণ রাজা ছিলেন। দ্রৌপদী কিন্তু কর্ণর প্রতি কখনো আকৃষ্ট হননি। পাঁচস্বামীকে সমান ভালোবাসতেন। অথচ রাজেয়ানজী বলছেন – অন্যরকম। দোষ দেওয়া হচ্ছে দ্রৌপদীকে।
– রাজা কর্ণকে ছেড়ে দ্রৌপদী গরীব ব্রাহ্মণকে বেছে নিলেন, এটা কি তার রোমান্টিসিজম?
– হ্যাঁ, দ্রৌপদী রোমান্টিক তো বটেই। না হলে, একটা রাজার মেয়ে হয়ে গরীবের হাত ধরে বেরিয়ে যায়?
– এবার ‘সীতাচরিত্র' লিখেছেন— ?
– সেটা অবশ্য অন্যভাবে। শ্রীকৃষ্ণচরিত্র লিখেছি, চৈতন্যর ওপর লিখেছি, শ্রী অরবিন্দ। সীতাকে নিয়ে ঠিক নিজে থেকে নয়, লিখতে বলা হয়েছিল।
– আর ‘পুতুলখেলা’র প্রয়োজন? ২০০৪ সালে?
– ‘পুতুলখেলা’ প্রথম হয়েছিল ২০০২ সালে। পুংশাসিত সমাজে নারী এবং পুরুষের কিছু নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে তো! যেমন, পুরুষকে রোজগার করতেই হবে, তাকে নিজেকে নির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত করতেই হবে আর মেয়েকে ইনফিরিওর হতেই হবে, মিষ্টি মিষ্টি হতেই হবে। এগুলি কিন্তু সমাজ-আরোপিত ভূমিকা। যে যা নয়, সেরকম তাকে করতে হচ্ছে, ভান করতে হচ্ছে। এখন এরকম ব্যাপার তো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও ঘটছে। স্বামী-স্ত্রীর ইউনিট-এর মধ্যে, অর্থাৎ যেটা সমাজের মূল অংশ, সেখানে যদি ভান থেকে যায়, মিথ্যাচার থাকে, আর তার মধ্যে বাচ্চারা বড় হয় – সেই মিথ্যাচার তারাও গ্রহণ করবে, আর সেই মিথ্যাচারের বিষ সমাজে ছড়াবে। সমাজকে সুস্থ করতে হলে অসুখটা সারানো দরকার, সিম্পটম দূর করে তো অসুখ সারানো যাবে না। দরকার হল, নিজেদের নিজেরা ঠিক করা।
আবার ‘ডলস্ হাউস’-এ নোরার বান্ধবী ক্রিস্টিন, এখানে যে কৃষ্ণা – এই চরিত্রটাকে কিন্তু ভর দিয়ে দাঁড় করানো হয়নি। ব্যক্তি হিসেবে রিয়ালাইজেশনের খুব দরকার আছে। একটি নারী তো আগে একজন ব্যক্তি। এই ব্যক্তি মানুষ হিসেবে নারীর বা তার স্বামীর রিয়ালাইজেশনটা খুব দরকার।
– নাটক দেখে তো অনেকে ‘খুব ভাল, খুব ভাল’ বলবেন – তবু তার মধ্যে হিপোক্রিসি থেকে যাবে না? কোনো কাজ হবে মনে হয়?
– আমার বাবা যখন থিয়েটার করতেন, বহুরূপীর ঐ থিয়েটারগুলি না দেখলে কিন্তু ‘আমি’ হতাম না। আমার যেমন বাবার ‘দশাচক্র' (An Enemy of People) দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। তখন সদ্য কৈশোর তো, একটা যেন নাড়া খাওয়া। তখনই ভেবেছি, থিয়েটার করলে এরকম থিয়েটার করতে হবে। বড় পার্ট করব তা ভাবিনি। এরকম কাজের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে –
– আর কোন কোন নাটক নাড়া দিয়েছিল?
– রক্তকরবী, রাজা – এসব নাটক সামাজিক চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভাবার জায়গা করে দেয়। নিজের পরিশুদ্ধি হয় – যেমন অয়দিপাউসে। অন্ধ হয়ে সে জীবনের গভীরতা খুঁজছে। যতদিন চোখ ছিল ততদিন দেখে শিখিনি, এবা উপলব্ধির পালা। অয়দিপাউস তো শেষে সমাজের একটা ভালো লোক হয়ে উঠছে – সে যেখানে যায়, সে দেশ ফুলে ফলে ভরে যায়—একটা আধুনিক মিথ। সামাজিক চিন্তার চেয়েও বড় চিন্তা একটা। সে তো বেছে নেয় অন্ধকারে চলে যাওয়া। আলো কী, অন্ধকার কী – খোঁজে। ডায়ালগ আছে – এর থেকে তুমি মরে গেলে না কেন? তাতে অয়দিপাউস বললেন – তোমরা আমাকে কেউ কোনো উপদেশ দিও না, কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ - কিছু নয়। তখনকার বিশ্বাস অনুযায়ী যদি আমার মৃত্যু হত চোখ নিয়ে... আমি স্বর্গে যেতাম, আমার বাবা-মার দিকে আমি কোন চোখে তাকাতাম? অর্থাৎ আমার চোখটা আর দরকার নেই। অনেক কিছু দেখেছি, দেখে কিছু শিখিনি, এবার আমার উপলব্ধির পালা। শেষে তো সমস্ত রাজ্য তাকে নিয়ে যাবার জন্য আগ্রহী – এই পুরো মিথোলজির একটা মানে আছে তো? এটা এখনও আধুনিক।
– এখন সেই ‘মিথ’কে কীভাবে পাচ্ছেন?
– এই যে এত চোখ-ধাঁধানো সামগ্রী চারপাশে। তাতে আমরা আলোকিত হচ্ছি কী? এই প্রযুক্তির যুগে এত কুসংস্কার কেন, এত জ্যোতিষ কেন? এত গ্রহরত্ন কেন? তাহলে আধুনিকতার সংজ্ঞাটা কী? হাতে একটা মোবাইল নিয়ে তো আলোকিত হওয়া যায় না। তার জন্য উপলব্ধি দরকার। কম্পিউটার শিখে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হলেই তো আলোকিত হওয়া নয়, যদি না উপলব্ধি থাকে। দরকার মনের মধ্যে ডুব দিয়ে সত্ত্বা যাচাই করা, কত পাপ লুকিয়ে আছে। কুসংস্কারকেই আমার অন্ধকার মনে হয়।
– অয়দিপাউসের তো সজ্ঞানে কোনো পাপ ছিল না?
– না অয়দিপাউস নয়, আমি বলছি সমাজের অন্ধকারের কথা। অয়দিপাউসের যে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস, সে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছিল, সেখানেই অন্ধকার – কোরাসের কতগুলি কথা আছে না – সে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে – তাই ‘পুতুল খেলা’ও শুধু নারী স্বাধীনতার কথা বলছে না – মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করছে। আমি যদি আলোকিত হই তবে আমি অন্য পাঁচটা লোককে আলোকিত করতে পারব। তা না হলে এত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, Marxist বলে পরিচিত লোক হাতে এতগুলো আংটি পরতেন না। কাজেই আলোকিত হতে হলে আমাকে অন্ধকারে ডুব দিতে হবে। মিথ্যাচারের প্রতিবাদের জন্যই পুতুলখেলা – আমার চেষ্টা (হাসি)
– ছোটবেলায় দেখা আর কোনো নাটক বা বিদেশী নাটক?
– আমি তো বিলেত যাইনি, আমেরিকায় গেছি। সেখানে যা নাটক দেখেছি, আমার দুর্ভাগ্য, সেগুলি খুব Inspiring নয়।
– ভারতীয় নাটক কি উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
– Production ভাল লেগেছে ঘাসিরাম কোতোয়াল, খুব ভাল লেগেছে চরণদাস চোর।
– ঐ নাটকের ধাঁচ তো একদম আলাদা। এ প্রসঙ্গে আপনার মত?
– আমার যেরকম মনে হয়েছিল প্রথমদিকে – এটা একটা লোকজ ভঙ্গি। তার সঙ্গে যা বলবার কথা তা মিলে যাচ্ছে, যেমন চরণদাস চোর। ইতিহাসের যে পটভূমিতে যে নাটকটা করেছিলেন ওঁরা, তাতে আঙ্গিকটা মিলে যাচ্ছে। সেজন্য অত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
– পার্থক্য সেভাবে বলা যায় না।
– বিষয়ের সঙ্গে আঙ্গিকের একটা গাঢ় সম্পর্ক আছে। কোন বিষয়টা আমি কোন আঙ্গিকে প্রকাশ করব। অর্থাৎ আমি যদি মৃচ্ছকটিক-এর মত নাটক লোকজ আঙ্গিকে করি, তবে তা সফল হবে না, কারণ মৃচ্ছকটিক গল্পটা নগরভিত্তিক। সেখানে আমি গ্রাম ঢুকিয়ে দিতে পারি না, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মেলবন্ধনটা সুসংহত হলে, নাটকটা যে ভাষাতেই হোক না কেন, ভাল লাগে।
– লেখালেখির সূত্র কি নাটকের জন্য? না এটা আলাদা...
– এটাও নাটকের জন্য (হাসি) নাটক থেকেই প্রবন্ধ – তারপর গল্প।
– ব্যক্তিগতভাবে কার লেখা ভাল লাগে?
– রবীন্দ্রনাথ।
– সে তো বুঝতেই পারছি। তারপরে? রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের পরে?
– তারাশংকর ভীষণ ভাল লাগে, বিভূতিভূষণ, বঙ্কিমচন্দ্ৰ...
– সবই তো ক্ল্যাসিকাল— আধুনিক লেখা?
– আশাপূর্ণাদেবীর কিছু কিছু লেখা পড়তে খুব ভাল লেগেছে, সমরেশ বসুর ছোট গল্প অসাধারণ...
– এগুলিকে নাট্যরূপ দেওয়ার কথা ভেবেছেন?
– রেডিওর জন্য অনেক দিয়েছি, নাটকের জন্য নাট্যরূপ দেওয়ার কথা ঠিক ভেবে উঠতে পারিনা। নাটকটা এত আলাদা একটা ফর্ম যে গল্পটা অনেকসময় ঠিক ঢোকানো যায় না।
– একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন – মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ – অনেকে তো উগ্রতা দিয়েও করেন। আপনি কীভাবে নেন?
– উগ্রতায় বিশ্বাস করি না। আমার মনে হয় মানুষের প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে, নিজের সমগ্রতাকে, সম্মানকে বজায় রাখা – সে যাই প্রতিবাদ করুন, মর্যাদাসম্পন্ন প্রকাশ হওয়া চাই।
কেউ হয়তো খুব চেঁচিয়ে ঝগড়া করে প্রতিবাদ করবে, কেউ নিঃশব্দে প্রতিবাদ করবে। মানুষকে ঠিক করতে হবে সে কী করবে।
এরপর শাঁওলিকে উঠতে হল – গৌড় দেখতে যাবেন।
(এই কথোপকথন শুরু হয়েছিল যে প্রশ্ন দিয়ে, তা হল – এতদিনের নাট্যজীবনে মালদায় এই প্রথম কেন? শাঁওলি বললেন – ‘ডাক পাইনি।’ উত্তরটি ইঙ্গিতবাহী বটে। আমরা আশা করতেই পারি ‘নাথবতী অনাথবৎ’ বা ‘কথা অমৃতসমান’, যা কলকাতায় বহুবহু রজনী অভিনীত হয়ে গেছে, মালদার মানুষের কাছে, বিশেষত উৎসাহী তরুণ প্রজন্মের কাছে শুধু ‘নাম’ হয়ে থাকবে না, তাদের ভাবনার অংশ হয়ে উঠবে।)