এমন ভাবে মারো যেন দাগ না থাকে। বলে কোনো খচ্চর। কম্বল ধোলাই চালু করা দলেরা আজো মরে নি। ঘুষ খেয়ে বা না খেয়ে গোপন বিদ্বেষ থেকে মার দেয়। শরীরের আইনের হামলা ও মামলায় চলে যুগপৎ ধোলাই। মাথা তোমার নামাতে চাইবেই। কিন্তু মাথা কেটে নিলেও মাথার শ্রম-- লেখা ও যাবতীয় সমাজকর্ম বেঁচে থাকবে। ইতিহাস খুঁড়ে কেউ না কেউ লিখবেই উপেক্ষিত একঘরে করে রাখাদের ইতিহাস।
'দিনগুলি রাতগুলি'র ডোমের মতো তাঁরা বলবেন না, সেলাইয়ের দাগ পাবেন না।
এক ছাত্রাবাসে থাকা এক সহবাসী সঞ্জয় মারা গেছে। জলে ডুবে। হাসপাতালে তাঁকে শনাক্ত করতে পারেন না কাহিনির কথক।
একের পর এক মুখ আসতে থাকে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অরিন্দম, শাশ্বত, সুপ্রভাত। এমনকী উত্তমকুমারের মুখের সঙ্গে মিশিয়ে দেন কথক, 'গালটা আরেকটু ফুলিয়ে, চুলটাকে পেতে দিয়ে দিব্যি মিলিয়ে দিই মৃত মুখের সঙ্গে।'
সত্যজিৎ রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবার মুখ মনে পড়ে। আর কথক আমাদের শুনিয়ে যান, মানুষে মানুষে কী মিল ভাবা যায় না'।
বৃষ্টির গুঁড়ো গুঁড়ো আওয়াজ, আর খকখকে ভয় জাগানো করোনাতঙ্কী কাশি সমালোচকের কলমহীন আঙ্গুল টেপাটেপি অমসৃণ করে তুলতে চায়--শুধু মুখ দেখলে মানুষ আর শিম্পাঞ্জিরই বা কম মিল কীসে?
মৃত সহাধ্যায়ী সহবাসীর জলে ডোবা অকাল মৃত্যু দেখে কথকের মনে পড়ে চন্দ্রবোড়ার বাচ্চাকে নিজে না মেরে মেথরকে দিয়ে মারানোর ঘটনা।
নিজে মারেন নি।
কেন?
নোংরা কাজটা ওরাই করুক। মৃত্যুর দাগ যেন হাতে না লাগে। শেষ কাজটা যে করে, সেই ঘাতক, বাকি সব অ্যাননিমাস, অবয়বহীন।
জলে ডোবা সঞ্জয় সম্পর্কে শুধু এটুকুই মনে পড়ে কথকের, ও একটা বই নিয়েছিল।
লোকে বই নেয় বলে। চটি জুতা নেয় না বলে। হোস্টেলে। আমাদের ছাত্র জীবনে নতুন জামা কেউ কিনলে প্রথম সে যদি পরল তো পরল না হলে পুরো ৬২ দিন পর সে পাবে ফেরৎ। সবাই পরবে একবার করে। আমাদের চেহারাও সব এক ছিল। দু একজন ছাড়া সব দিওয়ারের অমিতাভ বচ্চন। এবং সিকি সিলভার স্ট্যালোন। গায়ে পাঁচটা পাইপ ঢুকিয়ে দিলেও এক চামচ চর্বি পাবে না। এবং সবার পেটে অগস্ত্য মুনি। সাতটা রান্নাঘর সাফ করে দেবে সাড়ে ৬১ খানা পেট। একজন একটু কম খেতো, তাই সাড়ে একষট্টি।
সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় একজন অতি বিপজ্জনক লেখক। ওঁর লেখা পড়লে আমি নিশ্চিত নরেন্দ্র মোদিরও নরেন্দ্র দেব হয়ে কবিতা লিখতে ইচ্ছে হবে। আমার নিজেরও তাই ইচ্ছে করে। এই যে মাঝরাতে আধ ঘুম ঘুমিয়ে জেগে উঠলাম, ওঁর লেখা বাঘের মতো ঘাড় ধরে লেখাচ্ছে।
আফজাল সৈয়দের কবিতা পড়লে আমাকে কবিতায় পায়, একদা নেরুদা ও মায়াকোভস্কি পড়লে তাই হতো, সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় আমার লিখন আলস্য ঘুচে যায়। ইচ্ছে করে দিস্তে দিস্তে লিখি। লেখার দাস হয়ে যাই।
সৈকতের লেখার যাদুতে তালু চালু হয়ে যায়, বনস্পতি বৃক্ষের মতো ছায়া জাগায় কলমে, মরমে ওঠে বসন্তের অকাল গুঞ্জন।
ও লেখা, ঘুমন্ত লেখা, জেগে ওঠো।
সৈকতের লেখা আমি বেশি পড়ি না। কেন পড়ি না। মাসে একটার বেশি ওঁর বই পড়ি না। কারণ? ওঁর লেখা পড়লেই আমাকে কবিতায় পায়। কবিতা অক্ষমের আস্ফালন, বলে মাঝে মাঝে মনে হয়। আবার কখনো মনে হয়, কবিতা কলম অস্ত্র। সৈকতের লেখা পড়লে আমার মন আলুথালু হয়ে ওঠে। খুব করে আচার খেতে ইচ্ছে করে। আলুকাবলির চাট ডাকে। হোস্টেল জীবন ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ১৮ বছরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। তাই মাসে একটার বেশি সৈকতসান্নিধ্যে যেতে আমার ভয়। নন্দনের রেলিংয়ে পা দোলানো জীবন তো সারাজীবন থাকে না। সে জীবন কস্তুরীময় হয়ে ওঠে। একটা তিল, সামান্য বোতাম খোলা ইশারাময় ছোটো স্তনখণ্ড, শ্রমণার হাত আর সোনালী আলোড়িত রোম বেয়ে নন্দিত যৌনতায় পৌঁছে দেয়।
লেখক সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় একটা কৈফিয়ত গোছের লেখা ঝুলিয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞপ্তির মতো বইয়ের শুরুতে।
'গঙ্গার ওপারের অদ্ভুত, অলৌকিক সেই কলেজ, আর এপারের জরাজীর্ণ পুরানো কলকাতার দিনগুলি এবং রাতগুলির এই কাহিনি বর্ণে বর্ণে সত্য। তার মানে অবশ্য এই নয়, যে, বাস্তবে সবকিছু ঠিক এভাবেই ঘটেছিল। কিছু জিনিস হয়তো অন্য ছিল। অন্য বা অন্যরকম। কিন্তু তারা নির্দ্বিধায় এরকমও হতে পারত। সবকিছুই যে ঘটেছিল তাও নয়। কিন্তু তারাও ঘটতেই পারত, কোনো কারণে ভূমিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে নি, এই মাত্র। এইটুকু সামান্য কারণে এ আখ্যান তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না।'
পরাবাস্তব জীবন, জাদু মন, বিভ্রম, মায়া, কল্পনা-- মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে 'দিনগুলি রাতগুলি' ।
সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রিয় লেখক কবিদের বইয়ের নাম অক্লেশে ব্যবহার করতে পারেন। জীবনানন্দের 'কারুবাসনা' শঙ্খ ঘোষের 'দিনগুলি রাতগুলি'র মতো তাঁর দুটি উপন্যাসের নাম। এক সহবাসী সঞ্জয়ের মৃত্যু দিনে কথক বুনো এক কল্পিত তরুণী কস্তুরীকে দেখতে পান। পাঠক বোঝেন এ বিভ্রম। কিন্তু বুনোর বন্ধু সিদ্ধার্থ বোঝে না। বুনোও। সিদ্ধার্থ মেয়েদের ছেড়ে যাওয়ার ছাত্রাবাসে থাকে। সেখানে সে মেয়েদের সেন্টের গন্ধ পায়, লম্বা চুল পায়, কালো টিপ পায়, মেঝেতে পাউডার মাখা পায়ের ছাপ পায়। পরে জানা যায়, এক বন্ধু সিদ্ধার্থের অবর্তমানে বান্ধবীকে নিয়ে আসে তার ফাঁকা ঘরে। কিন্তু তাতে তো কস্তুরী মিথ্যা হয়ে যায় না। গল্পের কথক সিদ্ধার্থের ঘরে কস্তুরীকে দেখে। স্পষ্ট করে। 'ঘাড় অবধি চুল। শ্যামলা চেহারা। গোল ভুরু। গালে টোল। ... গায়ে সাদা সালোয়ার কামিজ। তার উপরের বোতামগুলো অদ্ভুতরকম ভাবে খোলা।'
এরপরই ছটফট করে ওঠে সৈকতের কিবোর্ড।
'যেন এই মাত্র একচোট ভালোবাসাবাসি হয়ে গেল'।
আমরা জানি এই পংক্তিগুলো আবার ফিরিয়ে দেবেন লেখক, কবিতার গানের ধ্রুবপদের মতো। না দিয়ে উপায় নেই। ১৯৯৫ এর জানুয়ারিতে এই তরুণীদের ডেবোনিয়ারের মধ্য পৃষ্ঠায় ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে দেখা যেত। বাস্তব নয়। স্তনের মোমগলানো চামড়া দেখেনি তখন ৯৯% কলেজ পড়ুয়া। মরে যেত স্রেফ মরে যেত তারা। 'ব্লু লেগুন' আর কতখানি দিতে পারত তাঁদের। আমাদের সবার জীবনে একটা কস্তুরী থাকে। আমাদেরই নির্মাণ। সেই নির্মাণকে বাস্তব করেছেন সৈকত।
লিখে ফেলেছেন:
স্তনের উপরের খাঁজটা দৃশ্যমান। ছোটো ছোটো স্তন। মসৃণ ত্বক। কপালে একটা বড়ো টিপ।
এরপরই সেই প্লেটোনিক ভিক্টোরিয় মন-- শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ছাপিয়ে জেগে ওঠে-- আমাকে দেখেই কামিজটা টেনে নেয় সামনে।
আমরা চেয়েছি ছাত্র জীবনে, আমাদের কল্পনার নারীরা লজ্জাবতী হবে শ্যামল সৌন্দর্যে।
সৈকতের নায়ক বুনোর প্রিয় দুই নারী -- রেখা ও অপর্ণা সেন।
অপর্ণা সেনকে সামনাসামনি দেখতে পান সাজানো নন্দনে। দেখতে পেয়ে মনে হয়, অপর্ণা তাকেই আনুকূল্য করেছেন। সস্মিত হাসিতে। চিনতে পারেন না চেনা মানুষকে।
চিনতে পারেন না একঘন্টা ধরে গিটার শুনে আসা মানুষকে, পিয়ানো বাজানো মহুয়াকে।
মহুয়াকে নয়, মহুয়ার দুই হাতে নাচের মুদ্রায় বিভঙ্গ দেখতে থাকেন বুনো।
'শব্দ না, আমি হাঁ করে এই হাতের বিভঙ্গ দেখতে থাকি। ধপধপে সাদা হাত। নিখুঁত আঙুল। তারা ভেসে যাচ্ছে পাশাপাশি একই ছন্দে। এভাবেই নীল সমুদ্রের উপর দিয়ে চলে যায় পালতোলা নৌকার নৌকার সারি। নীল আকাশের গায়ে একঝাঁক মরশুমি পাখি।'
হাত দেখেন আর গন্ধ পান। সদ্যস্নাতা নারী শরীরের গন্ধ।
শ্রমণার হাতও তাঁকে টানে বইমেলায়। শ্রমণা যেন তাঁকে গাইয়ে নেয়। তাঁতের শাড়ির খড়খড়ে গন্ধ। কাঁধের ওপর ব্রায়ের কালো স্ট্র্যাপ। সত্তর আশি নব্বইয়ের দশকের ছাত্র ঈষৎ যৌন অবসেসন ফুটে ওঠে উপন্যাসে। হোস্টেল জীবনের বাওয়ালি, জল বাওয়ালি, মনে পড়বে সব ছাত্রাবাসীর। কারো ঘরে কোনো বান্ধবী এলে কীভাবে হইহই জাগে তরুণ মনে, তার ছবি ভেসে ওঠে।
রাকেশের মত চরিত্র আমাদের অজানা নয়। যে ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েকে বান্ধবী বানাতে চায়, এবং ধেড়ে মেয়েরা তার ট্রাক রেকর্ড জানিয়ে সব ভেস্তে দেয়।
এবং রাকেশ প্রতিজ্ঞা করে। এবং নিজেকে গাল দেয়।
'আমি একটা অমানুষ। লজ্জাশরম নেই। শেষে একটা মাগির হাতে জুতোর বাড়ি খেলাম। ঘেন্না। ঘেন্না। আমার মরে যাওয়া উচিত।' এইসব বলে এবং আবার মেয়েদের পেছনে ঘোরে।
ঘুরতেই থাকে।
রাকেশ, সিদ্ধার্থ, মণিময়রা আমাদের চেনা। শ্রমণা মহুয়ারাও অচেনা নয়। কস্তুরীরা আধো চেনা। মায়া কল্পনায়। কিন্তু কস্তুরীরা বেঁচে থাকে। সবার জীবনে। আধো ছোঁয়া হয়ে।
আসলে 'সব কিছু মিলে মিশে একরকম হয়ে যায়'।
এবং সবাই কাঁদে। কাঁদে নিজের জন্য।
একটা উপলক্ষ ঘিরে। সঞ্জয়ের আত্মহত্যা সেই উপলক্ষ।
আমরা সবাই নিজের কান্না কাঁদতে থাকি। একরকম করে।
কাঁদি।
এবং পড়ি। রাতগুলি দিনগুলি।
আরেক রকম ভাবে।