

অভিযোগ, কবি শ্রীজাত নাকি লেখক কনিষ্ক ভট্টাচার্যের লেখা চুরি করেছেন। শ্রীজাতর উপন্যাসের নাম ‘খরগোশ ও মারুবেহাগ’। এ বছর শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত। আর যা থেকে চুরির অভিযোগ, কনিষ্ক ভট্টাচার্যের সেই ছোটোগল্পটির নাম ‘এইচ এম টি’ (গ্রন্থাকারে অন্য নামে প্রকাশিত)। ২০১৮র ‘বাতিঘর’ বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত। অভিযোগ, প্রত্যুত্তর, সবই সাধারণ্যে প্রকাশিত, হইচইও প্রচুর হয়েছে। ফলত দু’টি লেখাই পড়ে ফেললাম। চুরি-চামারি হয়েছে না হয়নি, অভিযোগ যথার্থ না অমূলক, এসব কিছুই এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। কিন্তু হইচই না হলে, এই দুই লেখার কোনোটাই পড়া হত না। তাই পর্যবেক্ষণটুকু লিখে দেওয়া যাক। যে, যথাসাধ্য অভিনিবেশ সহকারে পড়েও আমি ‘চুরি’র অভিযোগের কোনো যথার্থতা খুঁজে পাইনি। দু’টি আখ্যানের মধ্যে মিল এই, যে, দু’টিতেই একজন করে ব্যর্থ জাদুকর আছে। একটিতে আছে একজন ব্যর্থ সানাইবাদক, অন্যটিতে একজন ব্যর্থ কণ্ঠীশিল্পী। একে মিল বললে মিল। কিন্তু সমস্যা হল জাদুকরের উপর তো কপিরাইট নেওয়া যায় না। দুনিয়ায় যখন জাদুকরের অভাব নেই, তখন তারা গল্পে-উপন্যাসেও থাকবে। একাধিক আখ্যানেও থাকতেই পারে। খুবই স্বাভাবিক, তারা জাদুই দেখাবে। বুড়ো হলে সে নিয়ে জাবরও কাটবে। মাস্টাররা পড়ায়, নাবিকরা সমুদ্রে ভাসে, জাদুকররা জাদু দেখায়, ইডেন গার্ডেনে গিয়ে সাধারণত ক্রিকেট খেলে না। দুনিয়ার ওইরকমই নিয়ম। আমার নিজের উপন্যাসেই আছে জাদুকর ম্যানড্রেক। সে আবার সম্মোহনের ভঙ্গি করে সম্মোহনও করে। সব্বাই জানেন, একদম নাম-ধাম সমেত একই চরিত্র আছে কমিক স্ট্রিপে। এবং ভেবেচিন্তে সেই নামই উপন্যাসে ব্যবহার করা হয়েছে। এবার কেউ এসে “আপনি তো মশাই অমর-চিত্র-কথা থেকে টুকেছেন” বললে ভারি দুঃখ পাব। অভিযোগটা ভুল, ভুল তো বটেই, কিন্তু সেজন্য নয়, পুরো চরিত্র-সৃষ্টিটাই মাঠে মারা গেল, এই কথা ভেবে।
তো, জাদুকরদের উপস্থিতি ভিন্ন দু’টি লেখার মধ্যে আর বিশেষ কোনো মিল খুঁজে পাইনি। আখ্যান এবং ঘটনাপরম্পরায়। হ্যাঁ, প্রেম এবং ব্যর্থ প্রেম আছে। সে তো পৃথিবীর অর্ধেক আখ্যানেই আছে মনে হয়। ও দিয়ে মিল খুঁজতে গেলে সবাই ‘বনলতা সেন’ থেকে টুকেছেন বলতে হয়। মূল চরিত্রদ্বয়ের মধ্যেও জাদু দেখানো ছাড়া আর কোনো মিল নেই। উপন্যাসের জাদুকর, ম্লানমুখ নির্ভেজাল ভালোমানুষ, আর গপ্পের জাদুকর, ব্যর্থ হলেও, কামকাতর অ্যাকশন হিরো, ব্যর্থ এবং ভেঙে পড়া এক জেমস বন্ড যেন। উপন্যাসের সানাইবাদক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পোক্ত, মারুবেহাগের দুইটি মধ্যম নিয়ে তার দাবীর শেষ নেই। ওদিকে গপ্পের কণ্ঠীর সঙ্গীতপ্রতিভার একমাত্র পরিচয়, যে, সে পুং-নারী দুই গলায়ই গাইতে পারে। প্রসঙ্গত, গপ্পের গায়ক নারীভাবাপন্ন, উপন্যাসের নায়ক বিচ্ছিরি রকমের সোজা, ট্রেনে কাটা পড়া প্রেমিকার স্মৃতি নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেয়।
অবশ্য এসব পর্যবেক্ষণই, কোনো রায় নয়। ফলে, কেউ বলতেই পারেন, যে, মূল দু’টি চরিত্রকে একটি গল্প থেকে তুলে উপন্যাসে অন্যভাবে বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। সে হতেই পারে, সৃষ্টির প্রক্রিয়া ঠিক কী, নেহাৎই ভিতরের খবর না থাকলে সেটা বলা মুশকিল, যা আমার কাছে নেই। কিন্তু যদি তাও হয়, তবে বলতেই হবে, চরিত্রদের সম্পূর্ণ অন্যরকম করে তৈরি করা হলে, সেটা আর টোকা হয় কী করে? আমি যদি হ্যারি-পটারের থেকে জাদুকরটিকে তুলে নিয়ে, পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে ফেলে দিই, তো হ্যারি-পটারের চরিত্রটাই তো আমূল বদলে যাবে। তাকে তো আর হ্যারি-পটার বলা যাবে না। সে হয়তো হয়ে উঠবে মফঃস্বল শহরের চায়ের দোকানের এক বিফল পিসি সরকার, যে, পাড়ার মোড়ে নানা ম্যাজিক দেখায়, লোকে তাকে প্যাঁক দেয়। তারপর কোনো একদিন আসে, যখন তার কোনো ম্যাজিক হয়তো পাড়াটাকেই বদলে দেয়।
এটা লিখতে গেলে অবশ্য বিস্তর ঘাম ঝরাতে হবে, যদি প্রসাদগুণ আনতে হয়। প্রসাদগুণও এই লেখার উপজীব্য নয়, কিন্তু উপন্যাসটা যখন কষ্ট করে পড়েই ফেললাম, তখন ধান-ভানতে সেই নিয়েও দু’-চার কথা বলে নিই। বিগত মোটামুটি বছর-দশেক আমি মূলধারার শারদীয়ার উপন্যাস পড়ি না। তার আগে পড়তাম। বেশিরভাগ সময়েই গাল দিতাম, কোনো-কোনো ক্ষেত্রে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু পড়তাম। কারণ, জনপ্রিয় লেখালিখির জগতে বেশিরভাগ লেখাই খারাপ হবে, হাতে-গোনা কিছু চমৎকার হবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। মোটামুটি বছর দশেক আগে পড়া বন্ধ করি, কারণ, শারদীয়াগুলি, ওই সময়েই, উপন্যাসের ধরণ বদলে ফেলে। ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায়, যে, আপনি পড়ছেন উপন্যাস, কিন্তু মনে হবে টিভি-সিরিয়াল দেখছি। পরপর হইহই করে নানা ঘটনা ঘটে যাবে, কম্পোজিশনের মাথামুণ্ডু থাক বা না থাক। আমার আন্দাজ, এই চরিত্রবদলের সিদ্ধান্তটা প্রতিষ্ঠানেরই, কিন্তু তার পক্ষে কোনো সাক্ষ্য ইত্যাদি আমার হাতে নেই। কিন্তু এইটা আন্দাজ করেই আমি পড়া ছেড়ে দিই। ফলে এবার যখন এই উপন্যাস পড়তে গেলাম, তখনও টিভি সিরিয়াল দেখব, এর চেয়ে বেশি কোনো প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু ওই শারদীয়ার খান-দুই পড়ে যা দেখলাম, চুরি-টুরি একেবারেই গ্রহণযোগ্য কোনো অভিযোগ না বটে, কিন্তু এগুলো কি পাঠযোগ্য ভালো লেখা? সত্যি কথা বলতে কী, বাংলা ভাষার পাঠকরা যদি বাংলা ফিকশন পড়া ছেড়ে “এর চেয়ে তো টিভি ভালো” বলে টিভি দেখতে বসে যান, কিংবা ফেসবুকে নাগাড়ে সেলফি পোস্ট করতে থাকেন, তাঁদের বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। গতি-নেই, বাঁধুনি-নেই, কম্পোজিশনের বালাই নেই, শুধু শুদ্ধ এবং কড়িমা সম্পর্কে বক্তৃতা, এ উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে পড়াই কঠিন। সিরিয়ালে তবু গতি থাকে, এতে কী আছে? শুধু কয়েকটা ভালো বাক্য, সঙ্গে মনের মধ্যে দারুণ ভাব, এদের যোগফল তো সার্থক আখ্যান হতে পারে না। আখ্যানের জন্য ন্যূনতম যা দরকার, তা হল, আখ্যানসুলভ কম্পোজিশন। শুধু এই উপন্যাসে নয়, কৌতুহলে আরও একখানা উপন্যাস পড়েও তার কোনো চিহ্নমাত্র দেখা গেলনা। কেন লেখা, কীইই-বা সম্পাদনা, বোঝা কঠিন শুধু নয়, অসম্ভব।
তা, এই লাইনে এ লেখার সমালোচনা হওয়া খুবই সম্ভব ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। হয়নি, সেটাই এই লেখার উপজীব্য। হয়নি, কারণ, একটা বড় অংশের লোক, যাঁরা হইচই করছেন, তাঁরা উপন্যাস এবং গল্প, কোনোটাই পড়েননি। কী পড়েছেন? না, ফেসবুক আর আনন্দবাজারের চিঠি। কনিষ্কর অভিযোগ, শ্রীজাতর উত্তর। হয় প্রোফাইলে গিয়ে পড়েছেন, কিংবা তাও নয়, স্ক্রিনশট পেয়েছেন, হাতের গোড়ায়, এবং চোখ বুলিয়ে উদ্ধার করেছেন। এরকমও লোকজন গর্ব করে বলছেন, যে, দু’পক্ষের বক্তব্যই পড়লাম, অমুকেরটা আমার বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। অতএব অমুক চোর (অথবা নয়)। এ যেন, “জানলার বাইরে কি বৃষ্টি পড়ছে?” – এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি বলছেন, “গুগল আর ইয়াহু দু’জনেরই বক্তব্য পড়লাম। আমার জানলার বাইরে বৃষ্টি পড়ছে কিনা, এ ব্যাপারে ইয়াহুর বক্তব্যই অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হল”।
এ এক অর্থহীন অনুশীলন। উকিলরা ফৌজদারি মামলায় এরকম করে একটা কেস বিচারকের কাছে উপস্থাপন করেন। সেখানে সেটা জরুরি, কারণ, পুরোটা কারও জানা নেই। তদন্ত এবং তার প্রক্রিয়ার অনুধাবন – এর উপরেই অনেক কিছু নির্ভরশীল। কিন্তু এখানে তো তা নয়, এখানে হাতের কাছেই লেখাদুটো আছে। চাইলেই ঝপ করে পড়ে নিতে পারেন। নাও পড়তে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে মতামতটা কীসের ভিত্তিতে? আখ্যান ছেড়ে, স্রেফ দু’খানা চিঠি পড়ে?
যাঁরা কষ্টটা করেছেন, এবং তারপরও আমার মতের উল্টোদিকে, তাঁদের মতামত নিয়ে অবশ্য কিচ্ছু বলার নেই। সবই পর্যবেক্ষণ এবং মনে হওয়া, ফলে উল্টোটাও মনে হতেই পারে। কিন্তু তার পরেও যেটা নিয়ে বলার থাকে, তা হল, লেখা নিয়ে এঁরা কিচ্ছু বলছেন না। শুধু চুরিবিষয়ক মন্তব্য বা খণ্ডন। এছাড়া লেখা বিষয়ক কোনো আলোচনা নেই। অথচ, আলোচনা-সমালোচনা, প্রয়োজনে লেখাবিষয়ক গালাগাল, লেখার স্বার্থেই এগুলো দরকার। লেখককে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করা খুবই অনুচিত, কিন্তু লেখার নির্মম সমালোচনা তো দরকার। সেটা হচ্ছে না। সেটা একটা বিরাট সমস্যা। কিন্তু তার চেয়েও বেশি সমস্যাজনক হল, এর বাইরে বিপুলসংখ্যক একটা সংখ্যার মানুষ আছেন, যাঁরা এই পড়ার কষ্টটাও করছেন না, কিন্তু কিছু একটা মতামত তৈরি করে সজোরে ঘোষণা করছেন। ফলত সমালোচনার ক্ষেত্রটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, লেখার চেয়েও বেশি সঙ্কটময়। একদল লোক, মূল লেখা পড়ছেন না, কেবল টীকা পড়ছেন – টীকা বা টীকার স্ক্রিনশট। শুধু এই লেখা নয়, কোথাও কোনো বিষয়েই টীকার স্ক্রিনশট ছাড়া আর কিছু পড়ছেন না। এবং তারপর তার ভিত্তিতেই তাঁরা নির্ধারণ করে ফেলছেন, কে চোর, কে নয়। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, নাকি পড়ছে না। অমুক ডাইনি, নাকি নয়। অমুক ধর্ষক, নাকি নয় (সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটা গপ্পের স্ক্রিনশট নিয়ে নানা কাণ্ড হয়েছিল, অনেকেই মনে করতে পারবেন)। তারপর দলবদ্ধ মতামত-প্রকাশ ‘ট্রেন্ড’ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। আর আমরা নিরাপদে বাস করছি আমাদের স্ক্রিনশট সভ্যতায়, যেখানে টেক্সট নয় – মানেবই-ই সত্য, সমালোচনা নয় – ডাইনিসন্ধানই মোক্ষ, বিষয়বস্তু নয় – ট্রেন্ডই ঈশ্বর। কারণ, এর বাইরে আর কিছু চোখে পড়ে না।
dc | 45.95.***.*** | ০৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:০৭501747
&/ | 151.14.***.*** | ০৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:০৯501748
:|: | 174.25.***.*** | ০৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১১:১৭501752
!! | 103.76.***.*** | ০৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১৫:১২501765
আফতাব | 2409:4061:2d12:4634::e28a:***:*** | ০৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১৮:৫৬501772
&/ | 151.14.***.*** | ০৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৪৭501797
b | 14.139.***.*** | ০৬ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:৫৭501801
&/ | 151.14.***.*** | ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:০১501885
একক | ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৬:৪৭501898
HH | 202.94.***.*** | ১৩ ডিসেম্বর ২০২১ ১৮:৩৩502061
Neptune_Plato | 180.149.***.*** | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:১১504153