গ্রাম উঠে আসে নাগরিক স্থাপত্য নিয়ে তাঁর লেখায়। খনি অঞ্চলের মানুষ। খনন করেন মানুষের মন, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, দল—শ্রমিকের উদ্যমে, কৃষকের আবেগে, বুদ্ধিজীবীর পাণ্ডিত্যে, আবহমান বাংলা কবিতার সুরে।
তিনি নজরুল।
চাষিক সরলতার পাশে গ্রিসীয় জ্ঞানদীপ্তি, পুরাণি সংস্কৃতির তীব্র সংরাগী অনুধ্যান, ইউরোপীয় ব্যবস্থার প্রত্যাখ্যান, লেটোর গতিময়তা, ছান্দিকতা, কিছুটা মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতা, তার সঙ্গে কালী ও কবিতাকলি আনমনা প্রেম, ইসলামি গণতান্ত্রিকতা—তাঁর কাব্য জীবনধারাকে করেছে অনন্য, ব্যতিক্রমী, উদ্ভাসী ও আকাঙ্ক্ষামুখর।
বল বীর--
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
এই দিয়ে যে কবিতা শুরু হয়, সেই কবিতাতেই শোনা যায়, ‘খোদার আরশ আসন ছেদিয়া’, বিদ্রোহী ভৃগু হয়ে ভগবান-বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ও অহংদীপ্ত অভ্রংলিহ অহংকার। কবিতার নাম, বিদ্রোহী। আর, এই কবিতাতে সুন্দরী তরুণীর নাকের হীরের মিনে করার মতো শোনা যাবে: আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-করে দেখা-অনুখন,/আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন চুড়ির কন্-কন্।
বাংলা কবিতায় দুটি স্মরণীয় নাম রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। বিশ শতকের বিশ ত্রিশ চল্লিশের দশক নজরুলকে বাংলা কবিতার জগৎকে অনেকটা সম্মান দিলেও সাহিত্য সমালোচক, বিশেষ করে বিদ্যাজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁকে নিয়ে চর্চায় একটা গোপন অনীহা দেখা যেত। অনেকটা চাঁদ সওদাগরের মনসা পূজার মতো। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য সাহিত্যের ইতিহাস বইয়ে তাঁকে একজন উল্লেখ করে গেলেন ‘হাবিলদার কবি’ হিসেবে, আর-একজন দায় সারলেন। সিত-অসিত ভূমিকা প্রায় অনুরূপ।
তাঁর সংগীত নিয়ে যতখানি আগ্রহ সাহিত্য নিয়ে কম। বামফ্রন্টের আমলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মদিন গ্রামেগঞ্জে পালিত হত। অনেকেই তাকে ‘রসুন’ বলে প্রীত হতেন। যদিও সাধারণ সংগীতপ্রেমী বা কবিতাপ্রেমী মানুষের মনে নজরুলকে নিয়ে প্রবল আগ্রহ ছিল। বিশেষ করে গ্রামবাংলায়। নজরুলগীতি (নজরুলসংগীত বলা হত না) গাইতে না পারলে গায়ক হিসেবে স্বীকৃতি মিলত না মফস্বলি বাংলায়। কিন্তু নগর কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয়ে তা প্রায় অনুপস্থিত।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনে ‘সঞ্চিতা’ পাঠ্য ছিল। কিন্তু ক্লাস হত না। পরীক্ষায় একটা প্রশ্ন থাকত। এবং তার অথবা হিসেবে যে-প্রশ্নটি আসত সেটি আগেই মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে যেতো এক অদ্ভুত আনন্দে। ১৯৯৮-এ নজরুল জন্মশতবার্ষিকী আয়োজনের বছরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সঞ্চিতা’ বাদ দেওয়া হয়। সে নিয়ে এই আলোচক ‘আজকাল’ সংবাদপত্রে লেখেন, এবং মজার বিষয়, ‘সঞ্চিতা’ বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে কলেজস্ট্রিটে একটা সংগঠন মিছিল করে, সেটি বিজেপির যুব সংগঠন, রাহুল সিনহার নেতৃত্বে! এই আলোচকের অনুরোধে। পরে অনিল বিশ্বাস হস্তক্ষেপ করায় ‘সঞ্চিতা’ ফেরে।
একটা বই সমালোচনায় এ-সব প্রসঙ্গ কেন? অবস্থাটা বোঝাতে। ২০১১-য় একটু পরিবর্তন হয়। যদিও বেতারে এখন সেভাবে নজরুলের গান বাজে না, এফএম চ্যানেলেও ব্রাত্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নজরুল আকাদেমি গড়েছেন। কিন্তু সেখানেও তেমন কিছু কাজ হয়েছে বলে জানা নেই। চুরুলিয়ায় নজরুল একাডেমি ছিল। বছরে সাতদিন তাঁরা একটা মেলা করতেন, আলোচনাসভা হতো ও পুরস্কার দিতেন—এই পর্যন্ত। ২০১৫-তে সেখানেও আবেগ স্তিমিত দেখে যন্ত্রণা পেয়েছি। নজরুলের ভাইপো মঙ্গুভাই প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। ইতিমধ্যেই নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয় একটা অসাধারণ কাজ করেছে যশস্বী অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তীর দায়িত্বে একটা দিকনির্দেশী বই প্রকাশ করে। বইটির ছাপা বাঁধাই পরিবেশন অত্যন্ত আধুনিক মানের।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যৌথবাহিনী গড়ে কাজ করেছে। সম্পাদনা করেছে। চর্চা করেছে। কিন্তু নজরুল ইসলামকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এইধরনের বইয়ের পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন প্রথম। উচ্ছ্বাস অনুচিত। উচ্ছ্বাস সরিয়ে রেখেই বলব, সুমিতা চক্রবর্তী নজরুল গবেষণায় যে ধারা নির্মাণ করলেন, তা শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নানা কবিকে ঘিরে এই আয়োজন করতে পারেন—‘কাজী নজরুল ইসলাম: কবিতার জন্ম—পাঠকের অন্বেষা’ বইটির গবেষণাকর্মকে মডেল হিসেবে রেখে।
বাংলাদেশও ভাবতে পারে। যদিও বাংলাদেশের বিশিষ্ট নজরুল গবেষক জাতীয় অধ্যাপক, বর্তমানে বাংলাদেশ বাংলা একাডেমির সভাপতি রফিকুল ইসলাম ‘কাজ’-টি দেখে দিয়েছেন এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। রফিকুল ইসলামকে অনুসরণ করা যায় এখানে: ‘‘কবিতার সাম্রাজ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। কিন্তু এর মধ্যে একটি প্রশ্নও আছে। আছে কিছু শর্ত। পাঠক বা শ্রোতার দিক থেকে একটি কবিতাকে গ্রহণ করতে হবে বিভিন্ন মাত্রায়। পাঠককে জানতে হবে কবির জীবন ও মনের পরিচয়। পাঠককে অবহিত থাকতে হবে রচনাটির সময়কালের ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে। জানতে হবে যে-দেশ ও সাংস্কৃতিক বাতাবরণে কবির আবির্ভাব তার অতীত ঐতিহ্য ও বর্তমানের বাস্তবতা। সেই সঙ্গে একটি কবিতার প্রতিটি শব্দ, বাগধারা, বাক্যবিন্যাস, যতিচিহ্নের তাৎপর্য—সবই বুঝতে হবে। কবিতার উপমা, চিত্রকল্প এবং রচনাশৈলীগত বিভঙ্গের বৈশিষ্ট্য জানতে হবে তাঁকে। এইভাবে কবিতা পাঠ করেন এমন পাঠক অবশ্যই আছেন কিন্তু তাঁদের সংখ্যা কম।’’
এই গ্রন্থের রচয়িতা সুমিতা চক্রবর্তী নিবিড় ভাবে পাঠ করেছেন নজরুল ইসলামের চোদ্দোটি কবিতা। প্রতিটি কবিতাকে ঘিরে তাঁর যে অন্বেষণ তা এই গ্রন্থের পাঠকদের বিস্মিত করবে। রচয়িতা তুলে ধরেছেন প্রত্যেকটি রচনার পশ্চাদ্পট। একটি কবিতার সঙ্গে সমকালীন দেশ-কালের ইতিহাস, রাজনীতি এবং আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির অবিচ্ছিন্ন সংযোগ থাকে। সেই সঙ্গে যে জাতি-গোষ্ঠীতে কবির জন্ম তার আবহমান সংস্কৃতির নির্যাসকেও কবি ধারণ করেন নিজের মধ্যে। তিনি দিয়েছেন প্রত্যেকটি কবিতার বিস্তৃত শব্দ-টীকা এবং সেই শব্দ প্রয়োগের প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা। সেই ব্যাখ্যার মধ্য থেকে উঠে আসে কবির পঠনপরিধির বিস্ময়কর ব্যাপ্তি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্তর্গত ঐতিহ্য, পুরাণ, ইতিহাস, ধর্মশাস্ত্র ও সাহিত্য সম্পর্কে নজরুল ইসলামের জ্ঞান কতটা গভীর ছিল তা অনুভব করা যায় এই আলোচনা থেকে।
সুমিতা চক্রবর্তী যে কবিতাগুলি নির্বাচন করেছেন সেগুলি কেবল নজরুল ইসলামের বহুলপরিচিত কবিতাই নয়, সেগুলির মধ্য দিয়ে কবির জীবন-ভাবনার বিভিন্ন পর্যায় উঠে আসে। তাঁর স্বাদেশিকতা বোধ, দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর প্রবল আকাঙ্ক্ষা, সাম্যবাদী চেতনা, দেশ-কাল, ও আন্তর্জাতিক বাতাবরণের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সংযোগ পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয় যে কবিতাগুলির সাহায্যে সেই কবিতাগুলি আলোচনায় এসেছে বিশেষ ভাবে। সেই তুলনায় কবির একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গগুলি কিছুটা বর্জন করেছেন।
রফিকুল ইসলামের সংযোজন: ‘‘এই গ্রন্থ থেকে পাঠকের বিশেষ প্রাপ্তি হবে প্রতিটি কবিতাকে ঘিরে কবির জ্ঞান, উপলব্ধি ও সৃষ্টি-কৌশলের যে বিপুল পরিসর তার পরিচয়। কোনো কোনো কবিতা থেকে বৈশ্বিক রাষ্ট্রনীতির উপনিবেশবাদী চরিত্র ও তার বিরুদ্ধতাবাদী সংগ্রামের ইতিহাস উঠে আসে (কামাল পাশা, চিরঞ্জীব জগলুল); কোনো কবিতায় মূর্ত হয় ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস (কাণ্ডারী হুঁশিয়ার, আনন্দময়ীর আগমনে, সব্যসাচী); কোনো কোনো কবিতায় উৎপীড়িতের পাশে দাঁড়িয়ে উৎপীড়কের প্রতি কবি নিক্ষেপ করেন তাঁর বিদ্রোহের ও সাম্যের বাণী (বিদ্রোহী, সাম্যবাদী কবিতাগুচ্ছ); কোনো কবিতায় ফুটে উঠেছে দেশের সমাজ রাজনীতির প্রতি কবির ব্যঙ্গ-তির্যক কটাক্ষের কশাঘাত (আমার কৈফিয়ত, প্যাক্ট)। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শব্দ-টীকা থেকে কবির যে বিপুল অধ্যয়নের সাক্ষ্য মেলে তা-ও কম বিস্ময়কর নয়। কোনো কোনো কবিতার ক্ষেত্রে অধ্যাপক চক্রবর্তী কয়েকটি অনুবাদকেও সামনে এনেছেন। মূল কবিতার সঙ্গে অনুবাদের পার্থক্য; আবার একটি অনুবাদের সঙ্গে আর-একটি অনুবাদের পার্থক্যের মধ্য দিয়ে দুজন পাঠকের অনুভূতির সূক্ষ্ম প্রভেদ দৃষ্টিগোচর হয়। বোঝা যায়, প্রতিটি কবিতা গ্রহণ করবার ক্ষেত্রে প্রত্যেক পাঠকের ভাবনার স্বাতন্ত্র্য কতটা অনুভূতি-সাপেক্ষ। এই গ্রন্থ থেকে অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তীর যে শ্রম, নিষ্ঠা এবং কবিতা-গ্রন্থি উন্মোচনের সন্ধানী প্রয়াস লক্ষ করা যায় তা নজরুল ইসলামের কবিতাকে নতুন ভাবে গ্রহণ করবার জন্য পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে বলে প্রত্যাশা করি।’’
রফিকুল ইসলামের এই মনোজ্ঞ মন্তব্য ঘিরে আমরা যদি প্রবেশ করি বইয়ের অন্দরে, দেখব, ১৪ টি কবিতার গবেষণামূলক বিশ্লেষণ করেছেন সুমিতা চক্রবর্তী। এ-কাজে সহযোগীও ছিলেন পাঁচজন—সঞ্জীব মান্না (তিন মাস), মহম্মদ সাহিন সরওয়ার, সঙ্গীতা রায়, সৌমি বসাক, গায়ত্রী দাস। এই বইয়ে রঁলা বার্ত কথিত লেখকের মৃত্যু ঘটেনি, কবি পুনর্জীবিত হয়েছেন। কবিতা মূল পাণ্ডুলিপি, কবিতা রচনার ইতিহাস, প্রেক্ষাপট, সামাজিক রাজনৈতিক কাব্যিক প্রতিক্রিয়া, সমকালীন সময়ের রাজনীতি সমাজ—সব উঠে এসেছে এই গ্রন্থে।
‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র শারদীয় সংখ্যার জন্য লেখা হয়েছিল ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি। কিন্তু ‘আনন্দবাজার’ ছাপতে সাহস দেখায়নি। প্রকাশিত হয় নজরুল ইসলামের নিজের সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায়। ১৯২২-এর ২৬ সেপ্টেম্বর। এই কবিতা লেখা ও ছাপার জন্য কবি ও পত্রিকার প্রকাশকের জেল হয়।
এক প্রভাবশালী আত্মীয় আজিজুল হকের চেষ্টায় ছাড়া পান পত্রিকার প্রকাশক আফজালুল হক। নজরুলদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পক্ষে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর নাম স্যার আবদুর রহিম। মুসলমান মুসলমানকে দেখে এই মিথ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লা থেকে নজরুলকে গ্রেপ্তার করে আনা হয় ২৩ নভেম্বর। গ্রেপ্তার যে হবেন সেই অনুমানে পত্রিকার স্বত্ব বিরজাসুন্দরী দেবীর নামে লিখে দিয়েছিলেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি ছিলেন। বিচার হয় কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. সুইনহোর আদালতে। নজরুলের পক্ষে দাঁড়ান বিশিষ্ট আইনজীবী মলিন মুখোপাধ্যায়। এই মামলার রায় বের হয় ১৬ জানুয়ারি ১৯২৩। একবছরের সশ্রম কারাদণ্ড। তার নয়দিন আগে নজরুল ইসলাম আদালতে পড়লেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। জর্জ ডিমিট্রভের অনেক আগের ঘটনা এটি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্র অপুর বন্ধু পথপ্রদর্শক প্রণবও পরে জবানবন্দি দেয়। এইসব ইতিহাস পাবেন পাঠক আলোচ্য গ্রন্থে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার পরই নজরুলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। দেখার বিষয়, নজরুল জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাঁকুড়া যাচ্ছেন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে। আর সেখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজের অধ্যক্ষ মি. ব্রাউন। ব্রাউন সাহেব খদ্দরের পোশাক পরতেন। ভারতীয় সংস্কৃতির অনুরাগী। স্টেশনে ছাত্রদের নিয়ে হাজির হচ্ছেন অধ্যক্ষ মি. ব্রাউন। আর ছাত্রদের অনুরোধে, সভায় নয়, স্টেশনেই নজরুল আবৃত্তি করছেন ‘কামাল পাশা’ কবিতা (পৃ. ১৯৪)।
0
বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরে দলমাদল কামানের পাশে
এইরকম অজস্র নতুন পুরাতন তথ্যে সমৃদ্ধ সুমিতা চক্রবর্তী-সম্পাদিত এই বই। নজরুলের লেখায় রাজনীতি প্রবল ভাবে আছে। আর তাকে যার্থাথ্য দিতে হাজির পুরাণ ও ইতিহাস। অসংখ্য নাম উঠে আসে প্রতীক রূপে। শব্দ যে কেবলমাত্র শব্দ নয় বরং ইতিহাস পুরাণ ও ব্রহ্ম—তা বুঝিয়ে দেন নজরুল।
নজরুলের কবিতা মানে ভাবোচ্ছ্বাস। তাতে সাহিত্যমূল্য ততখানি নেই, যতখানি আছে আবেগ—এই ধারণার মূলোচ্ছেদ ঘটাবে এই বইয়ের নিবিড়পাঠ ও পর্যবেক্ষণ। সুমিতা চক্রবর্তীর স্বীকারোক্তি: শব্দ ধরে পাঠ করার অভ্যাস। সেইসময় একদিন চমকিত হলাম বহুবার পূর্ব-পঠিত ‘বিদ্রোহী’-র ‘বোররাক’ শব্দটিতে। এতদিন ধরে কবিতাটি পড়েছি এবং শুনেছি কিন্তু কোনও দিন সচেতন ভাবে ভেবে দেখিনি যে, শব্দটির যথার্থ অর্থ জানা নেই। জেনে নিতে খুব কষ্ট হল না। কিন্তু তারপর থেকে কাজী নজরুল ইসলাম আমাকে নতুন করে আকৃষ্ট করলেন।… পুনর্বার পড়লাম তাঁর কবিতা এবং বিস্মিত হলাম এই জেনে যে, কাজী নজরুল ইসলামকে কত কম বুঝেছি এতদিন। অধ্যাপক চক্রবর্তীর অনুসন্ধিৎসার ফসলে আমিও জানলাম ‘বোররাক’ শব্দের অর্থ— কোরাণে বর্ণিত দিব্য অশ্ব। সাদা রঙের, অতি কোমল মুখমণ্ডল। আর ‘তাজি’ শব্দটির অর্থও ঘোড়া হতে পারে, অথবা তাজ বা মুকুট পরিহিত। এতদিন অনেকেই নজরুল পড়েছেন আবেগ অথবা অনুকম্পা নিয়ে। এই বই তাঁদের প্রাণিত করবে কাব্যসৌন্দর্য শিল্পসুষমা খুঁজতে।
আমাদের একটা সমস্যা আছে, যা কিছু জনপ্রিয় তাকে সস্তা বলে দেগে দেওয়ার। কম জনপ্রিয়তা যেন শিল্পবিচারের একটা মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘কাজী নজরুল ইসলাম কবিতার জন্ম—পাঠকের অন্বেষা’ এমন ধারণার মূলে একটা সপাট চপেটাঘাত। মোট ১৪ টি কবিতার আলোচনা আছে। আছে মূল কবিতা, তার ইংরেজি বা হিন্দি অনুবাদ। কবিতার ইতিহাস রাজনীতি কাব্যসৌন্দর্য শব্দসম্ভারের বিস্তৃত পরিচয়। ইংরেজি বা হিন্দি অনুবাদ যেখানে যথাযথ মনে হয়নি, তা ধরিয়ে দিতে কুণ্ঠা করেননি সম্পাদক।
নজরুলকে কেউ কেউ ‘রবীন্দ্রবিরোধী কবি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু দু-বার দু-রকম মন্তব্য করেছেন নজরুল নিয়ে। পরে স্বীকার করেছেন, রবীন্দ্রনাথের পর প্রথম মৌলিক কবি নজরুল। ‘খুন’ শব্দ ব্যবহার নিয়ে দ্বন্দ্ব বেধেছিল রবীন্দ্রনাথ নজরুলে। লেখালেখিও হয়েছিল কিন্তু তিক্ততা স্থায়ী হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জন্মদিনে অ্যালবার্ট হলে তাঁর পাশের আসনটি নজরুলের বসার জন্য রেখে দিয়েছিলেন। তাতে তথাকথিত রবীন্দ্রভক্তরা ক্ষুণ্ণ হন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহ ও প্রীতির পরিচয় রাখেন। নজরুল জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়ে চিৎকার করে গাইতে পারতেন, ‘দে গোরুর গা ধুইয়ে।’ রবীন্দ্রনাথ জানতেন, সমাজে সূক্ষ্ম সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা আছে। নজরুল সেই চাপা প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষের শিকার। নিজের লেখা ‘বসন্ত’ নাটিকা তাঁকে উৎসর্গ করেন। কিন্তু তা বলে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার বিরোধিতা করতে কুণ্ঠিত হননি নজরুল। রবীন্দ্রনাথের ভাষা যখন পেলব, কোমল, মেদুর—তখন নজরুল লিখছেন, ‘ও মা! তোমার দাদুর নাকে কে মেরেছে ল্যাং?’ জাতীয় লেখা। ল্যাং যে বাংলা কবিতায় আসতে পারে—এই ভাবনা প্রথম নজরুলের। পরে আমরা দেখব ‘পচা কানকোর খোসা’, ‘কাঁঠালের ভূতি’-ও আশ্রয় পাচ্ছে রবীন্দ্রকবিতায়।
নজরুলকে বুঝতে গেলে শিল্পের সৌন্দর্যের দরজা দিয়ে যেতে হবে—শুধু আবেগ ভাবোচ্ছ্বাস—নজরুলচর্চার চাবিকাঠি নয়—পাঠক বুঝবেন বইটি পড়লে। হিরণ মিত্রের অসাধারণ প্রচ্ছদ। দু-একটি বানান ভুল আছে। পরিসরের কথা ভেবে আলোচনা এখানে থামালাম, কিন্তু নতুন পাঠের আগ্রহের শুরু। নব আরম্ভ। বইটি সংক্ষেপে: নজরুলচর্চার আকরগ্রন্থ।
Good piece. But anybody to make a comment on an article by a MUslim critique on another muslim poet.
নজরুলের অনালোকিত বিষয়ের পাঠ পর্যলোচনা ভাল লাগলো।
তার অসামান্য “বিদ্রোহী” কবিতা শতবর্ষ পূর্ণ করলো। ভাবতে অবাক লাগে, কি মারাত্মক প্রতিভার বিচ্ছুরণে ভরপুর এই কবিতা মাত্র ২২ বছর বয়সে লেখা। এ নিয়ে আরো দু-চার কথা বেশি লিখলে পারতেন।
বইটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশি মূদ্রায় ডাক মাশুলসহ প্রায় পৌনে দুহাজার টাকা পড়বে, করোনাকালে নিশ্চয়ই অনেক টাকা। তবু পড়ার আগ্রহ রাখি।
প্রচ্ছদটি খুব ভাল। অনেক ধন্যবাদ
পড়লাম। দারুণ লাগল। বইটি জোগাড় করতে হবে।