ঠাকুরদার মনে হয়েছিল আমাদের বাড়িতে একজন অতিথি আসবেন। এজন্য তিনি প্রতিদিনই এক মুঠো চাল আলাদা কলসিতে রাখতে বলেন মাকে। যেন অতিথি এলে চাল নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা না থাকে। অতিথিকে ভালোভাবে আপ্যায়ন করা যাবে। সঙ্গে প্রতিবেশী দুএকজনকেও ডেকে নেওয়া যাবে। পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাবে।
মাকে প্রতিদিনই ঠাকুরদা জিজ্ঞেস করেন, চাল রেখেছো তো বৌমা?
মা মাথা নেড়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো জবাব দেয়, রেখেছিলাম। কাল রাতে রেঁধে ফেলেছি। আজ বিকেল থেকে আবার রাখতে শুরু করব।
এ কথায় ঠাকুরদা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তিনি জানেন তাঁর একমাত্র ছেলের বৌটি কোনো ছল জানে না।
কাল বিকেলে হাট থেকে ফেরার সময়ে চাল আনা যায়নি। একবার ভেবেছিলেন, থাক, আজ বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। গিয়েই বা কী হবে। ছোটো ছোটো নাতিপুতিদের শুকনো মুখগুলো তার সহ্য হবে না। মণ্ডল মশাই তাঁকে ডেকেছিলেন। তাঁদের বাড়িতে অতিথি এসেছে। সঙ্গে দুটো মধুমতীর ইলিশ। ঠাকুরদা এলেমদার মানুষ। এরকম ইলিশ আনা-অতিথির সঙ্গে ঠাকুরদাকে চিনপরিচয় করানো গেলে তাঁদের মানমর্যাদা বাড়বে।
মণ্ডল মশাইয়ের সঙ্গে তিনি গেলেন না বটে, তবে চালের কথা ভুলে গিয়ে তাঁর মনে হলো তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া দরকার। এখন সবে বৈশাখ মাস। বৃষ্টি নেই। আকাশ থেকে আগুনের হল্কা নেমে আসছে। বাড়িতে গিয়ে বৌমাকে গিয়ে তাড়া দেওয়া দরকার। বলা দরকার, অতিথি আসার আর দেরি নেই। যেকোনো সময়েই এসে পড়বে। দীঘা ধানের ভাতের সঙ্গে ইলিশের পাতুরি হবে। এজন্য তাঁদের কলাগাছ থেকে পাতা কেটে আনবেন। পাতুরি রান্না বৌমা করতে না জানলে তিনি নিজেই দেখিয়ে দেবেন।
বাড়ির আঙিনায় আসতেই তার মনে পড়ে গেল আজ চাল আনা হয়নি। এই দুঃখে বাড়ির ভেতরে আর পা চলল না। তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তিনি বাইরে অন্ধকারে সজনে গাছের নিচে মাথা নিচু করে বসে রইলেন।
তাঁর মনে হলো বাড়িটা বেশ স্তব্ধ হয়ে আছে। বউমা রান্নাঘরের বাইরে মাথা নিচু করে বসে আছে। তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। নাতি নাতনিরা খিদেয় কান্নাকাটি করা ভুলে মায়ের কাছে চুপ করে বসে আছে। তাদের এই তরুণী মা তাদের কাঁদতে দেখলে দিশেহারা হয়ে পড়বে। হয়তো গলা ফুড়ে কান্নার শব্দ বের হবে। লোকে মন্দ বলবে। এটা অসহনীয়। তিনি উঠে দূরে কোথাও চলে যাবেন ভেবে উঠতে যাবেন তখন তাঁর বড়ো নাতি এসে বলল, মা ভাত বাড়ছে। ঘরে আসো দাদু।
---ভাত বাড়ছে! তিনি অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ভাত রান্না হইছে? কেমনে হলো রে?
তার উত্তর না দিয়ে ছেলেটি বাড়ির মধ্যে ছুটে গেল। তিনি সন্দিগ্ধভাবে বাড়ির ভেতরে গেলেন। বউমা তার গামছা এগিয়ে দিয়ে বলল, হাত মুখ ধুয়ে আসুন। দেরি করবেন না। ভাত জুড়ায় যাবে।
গরম গরম ভাতের সঙ্গে খলসে মাছে তরকারি। মাখিয়ে খেতে খেতে ঠাকুরদা শুধালেন, মাছ পেলে কোথায় বৌমা?
---ওপাড়ার নারান কাকু দিছেন। লগে চাপিলা মাছের ঝোল রানতেছি।
পেয়াজ রসুন দিয়ে চাপিলার স্বাদই আলাদা। দুখানা বেশি চেয়ে নিলেন। ছোটো নাতি বেশ ছোটো। কাঁটা বেছে খেতে তার সমস্যা। গলায় বেঁধে যায়। খুব সাবধানে তাকে বেছে দিতে হচ্ছে। খেতে বসেই তার ঘুম পায়। তাকে জাগিয়ে রাখার জন্যই ঠাকুরদা গল্প বলেন, একবার মধুমতী নদীতে চাপিলা ধরতে গিয়ে পেয়ে গেলাম দুটো ইলিশ। বেশ বড়ো সড়ো। রূপোলী বন্ন। আর কানসের কাছে সামান্য লাল দাগ। বাবা শুনে বললেন, বোশেখ মাসে ইলিশ চলবে না।
তাহলে এই ইলিশ দুটোর কী হবে? ইলিশ তো সিং মাছ না যে জীবিত থাকলে পুকুরে ফেরত দেওয়া যাবে। মালতী পিসি মাছ দুটো নিঃশব্দে এসে নিয়ে গেল। মালতী পিসির বিয়ে হয়েছিল দূর গায়েঁ। খুব বেশি বালিকা বলে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, মেয়ের ঘাড়ে ভুত আছে। সেই থেকে মালতী পিসি বাপের বাড়ি থাকে। থাকে উঠোনের পাশে আলাদা একটি ঘরে। কারো সঙ্গে কথা বলে না।
মালতী পিসি কেটে কুটে হলুদ মাখানো মাছ ভাজতে লাগল। তখন অনেক রাত। চারিদিকে হাওয়ায় ভাসতে লাগল সেই ঘ্রাণ। যখন সরিষাবাটা দিয়ে সেই মাছ রাঁধা হলো তখন বেশ জ্যোৎস্না উঠেছে। চারদিক ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমাদের চোখে ঘুম নেই। জানালার কাছে পিসি ঠক ঠক করে শব্দ করল। আমরা চুপি চুপি বাইরে বেরিয়ে এলাম। পিসির পিছে পিছে মাঠ পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম নদীর ঘাটে। বুড়ো বটগাছ থেকে ঝুরি নেমেছে-- সেঁধিয়ে গেছে মাটির মধ্যে। তার নীচে সাফ সুতরো করে বসেছি আমরা। পিসি কলাপাতায় ভাত বেড়ে দিচ্ছে। সঙ্গে ইলিশ। খেতে বসব ঠিক তখনই গাছ থেকে নেমে এসেছে লক্ষ্মীপেঁচা। বকপাখি। আর কয়েকটি কাক।
কাকপাখি ক্র ক্র করে একটু উসখুস করে উঠল। মালতী পিসি আমাদেরকে বলল, কাক হবে ক্যান। ওরা হলো বায়স-- বায়সপক্ষী।
বায়সপক্ষীরা তখন গুটি গুটি করে মালতী পিসির কোল ঘেষে দাঁড়িয়েছে। বলছে, খাতি দেও, খিদা লাগছে।
মালতী পিসি তাদেরকে মাছ ভাত বেড়ে দিল। বকপাখি এসে গুরুগম্ভীর চালে কাকেদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল। বলল, আমার খাবার কই। পিসি তার খাবারও বেড়ে দিল। লক্ষ্মীপেঁচা লক্ষ্মী মেয়ের মতো বলল, আমি তোমার সঙ্গে খাবো।
সেই আলো ও জ্যোৎস্নার মধ্যে মালতী পিসি ঘুরে ঘুরে লক্ষ্মীপেঁচাকে খাওয়াতে লাগল। সুন্দর করে ভাত মাছ মাখিয়ে দলা পাকিয়ে পেঁচার মুখে ধরে। আর সে কপ করে গিলে নেয়। সেটা দেখে বকপাখিও বায়না ধরল সেও পিসির হাতেই খাবে। আর কাকপাখিগুলো বায়স বলে নিজেরাই খেতে লাগল।
খাওয়া দাওয়া শেষে পাখিরা নাচল। গাইল। ততক্ষণে মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। জ্যোৎস্না একটু হেলে পড়েছে। তার মিটি মিটি আলো বটপাকুড়ের ঝুরি বেয়ে নামতে লাগল। সেই আলো একে বেকে গড়িয়ে গড়িয়ে যেতে লাগল নদীর জলে। পাখিগুলো কিচকিচ করে বলতে লাগল, পিসি চলো। পিসি চলো। পিসি হেসে বলল, দাঁড়া সব গুছিয়ে নেই।
গোছগাছ সারা হলে পাখিগুলো মালতী পিসিকে নিয়ে উড়ে গেল।
আমরা অবাক হয়ে শুধাই, উড়ে গেল-- কোথায় উড়ে গেল?
একটু থেকে ঠাকুরদা উত্তর দিলেন, আকাশে। চাঁদের আলোর ভেতরে।
---এখন কোথায়?
--- চাঁদের কাছে।
--- আর আসে নাই।
--- আগে মাঝে মাঝে আসত। এটা সেটা কতো কী নিয়ে আসত।
--- ইলিশ মাছ নিয়ে আসত?
--- নিশ্চয়ই। ইলিশ, মুরগি, খাসি, চাল, ডাল যা যা দরকার সব নিয়ে আসত।
--- আমরা তো দেখি নাই।
-- এখন মালতী পিসি বুড়ি হয়ে গেছে। হাঁটতে কষ্ট হয়। হাঁপেও ধরেছে। আসতে পারে না। তবে---
--- তবে লোকের হাত দিয়ে পাঠায়।
এবার আমরা খুশি খুশি হই। তাইলে আসবে আবার। শুধাই, এই লোক কে?
--- অতিথি।
আমরা এবার একটু উসখুস করি। বলি, আমাদের তো অতিথি আসে না ঠাকুরদা!
--- আসবে। অবশ্যই আসবে। মালতী পিসির সময় হলেই অতিথি পাঠাবে। অতিথি আসবে বলেই তো তোর মাকে বলেছি, একমুঠো চাল তুলে রাখতে। এলে তার জন্য রান্না হবে। যত্ন করতে হবে। মালতী পিসির লোক বলে কথা। চিন্তা নাই।
আমরা চিন্তা করি না। চিন্তা করেই বা কী লাভ? আমাদের ঠাকুরদা এই গল্পটি প্রায়ই বলে। আর এই প্রশ্নগুলো আমরা করে থাকি। তবু শুনতে ভালো লাগে। বিশ্বাস করতে ভালো লাগে। আজ না হোক কাল। কাল না হোক পরশু-- অতিথি আসবে মনে করে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
আমরা অপেক্ষা করি। অতিথির জন্য অপেক্ষা করি। আমরা একটু একটু করে বড়ো হই। ঠাকুরদা বুড়ো হয়। চুল পাতলা হতে থাকে। মা কোনো মতে ডাল ভাত রাঁধে। রাঁধে শাক আনাজ। আর মাঝে মাঝে দেশি মাছ। পুঁটি, টাকি। পাবদা। ট্যাংরা। অন্য বাড়িতে অতিথি আসে। আমাদের আর আসে না। মালতী পিসির অতিথি আসে না। আমাদের মন কেমন করে।
সেটা বুঝতে পেরে মা একদিন খুব নিচু স্বরে আমাদের ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলে, তোদের ঠাকুরদার মালতী পিসি পাখিদের সঙ্গে যায় নাই। গেছে ডাকাতদের সঙ্গে। ডাকাতরা তাকে তার একলার ঘর থেকে তুলে নিয়ে গেছে। কখনোই তার সন্ধান পাওয়া যায় নাই।
তখন আমাদের খুব ঘুম এসে গেছে বলে মায়ের কথাগুলো পুরোটা শুনতে পাই না। শুনলেও মনে রাখি না। ডাকাতদের গল্প শুনতে ভয় করে। সত্যি সত্যি যদি ডাকাতরা মালতী পিসিকে ধরে নিয়ে থাকে তবে কি পিসিকে তারা মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে? পিসি ভুত হয় গেছে? একথা মনে করতে ইচ্ছে হয় না। ইচ্ছে হয় ঠাকুরদার মালতী পিসি বেঁচে থাকুক। পাখিদের খাবার দিক। আমাদের জন্য অতিথি পাঠাক। তাই মনে হয়, মা যেন অন্য কোনো গল্প বলেছিল। অন্য কোনো মালতী পিসির গল্প। সে মালতী আর ঠাকুরদার মালতী পিসি এক নয়। তারা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ।
মা আরেকদিন বলে, এ বাড়িতে কখনো অতিথি আসবে না। একবার এসেছিল। এসেছিল তার বিয়ের পরে। এ বাড়ির লোক তাকে হাঁকিয়ে দিয়েছে। সে কথা জানে সবাই। আর কেউই আসবে না।
হয়তো হতে পারে। হয়তো হতে নাও পারে। আমরা কেনো জানি ধরে নেই, মা একথাটি বলেনি। বলেছে অন্য কোনো লোকের কথা। হয়তো লোকটি ঠিক লোক ছিল না। ছিল হয়তো দুর্বৃত্ত। দস্যু। তস্কর। তাই তাকে হাঁকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের অতিথি আসবে। সেই অতিথি আসবে বলেই আমরা অপেক্ষা করে আছি। অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করে থাকব।
---কোন লোক?
আমাদের এই প্রশ্নে মা চুপ করে থাকে। অন্ধকারে চুপ করে থাকে। আমরা তার চোখ দেখতে পাই না। কিন্তু চোখের জল পড়ে আমাদের গায়ে।
আমরা মাকে একদিন জিজ্ঞেস করি, মা তুমি ইলিশের পাতুরি রান্না করতে পারো?
মা হেসে শুধায়, কেনো রে? খেতে ইচ্ছে করছে?
আমরা বলি, না। এমনি।
মা বলে, তোদের বাবাকে একদিন ইলিশ আনতে বলব। সেদিন পাতুরি রান্না করে দেবো। কাঁটা দিয়ে কাঁচা কলার তরকারি রান্না করব। আর ডিম দিয়ে পিঁয়াজু করব।
আমরা ভেবে নেই, অতিথি যেদিন আসবে, সেদিন নিশ্চয়ই মা ইলিশের পাতুরি রান্না করবে। নিশ্চয়ই রান্না করবে কলার তরকারি-- ডিমের পিঁয়াজু। এর মধ্যে অবশ্যই ইলিশের ঝোল আর সর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ করতে মা বাদ দেবে না।
তবে এতো ইলিশ বাবা কি আনতে পারবে? মনে হয় না। তার তো সময়ই নেই। তাহলে?
তাহলে ঠাকুরদাকে জিজ্ঞেস করি, অতিথি কি ইলিশ আনবে সঙ্গে করে?
ঠাকুরদা মাথা নেড়ে জবাব দেয়, নিশ্চয়ই আনবে। বড়ো বড়ো ইলিশ আনবে। জোড়া ইলিশ। খাঁটি পদ্মার ইলিশ। এতো বড়ো ইলিশ এ অঞ্চলের মানুষ চোখে দেখেনি। আর তার বর্ণ---
--- বর্ণ?
--- হলুদ।
---সে কী? ইলিশ তো রুপোলি। কাঁচা টাকার মতো। নতুন টিনের মতো। ঝকঝকে। হলুদ হয় কী করে?
এবারে ঠাকুরদা একটু চিন্তা করে। চোখ বোজে। চোখ বোজা রেখেই বলে, ইলিশ রুপোলিই। কিন্তু মালতী পিসির ইলিশ হলুদ। মালতী পিসি হলুদ মাখিয়ে রেখেছে। এতো বাজারের হলুদ না। এ হলো আকাশের হলুদ। ঊষাদেবী ভোরে সিঁদুরের ফোঁটা হয়ে জাগেন। তারপর তিনি জবা কুসুম। ধীরে ধীরে ডিমের কুসুম হয়ে ওঠেন। তারপর হলুদ মেখে তার আলো ছড়ান। মালতী পিসি ভোর বেলাকার এই হলুদ নিয়ে ইলিশের গায়ে মাখিয়ে দেয়। তার লোকের হাতে পাঠায়। এই হলুদ ইলিশ রাঁধতে কোনো বাড়তি হলুদ লাগে না। মুখে দিলে মাখনের মতো গলে যায়।
ঠাকুরদা বলে বহুক্ষণ মৌনী হয়ে থাকে। চোখ বন্ধ। পাপড়ি বেয়ে একটু একটু জল নামে। জল নয়--- অশ্রু। তবে সেটা আনন্দের অশ্রু, না বেদনার অশ্রু সেটা বুঝতে পারি না আমরা। শুধু মাখনের স্বাদ মাখা সেই হলুদ ইলিশ আমাদের ঘুমের মধ্যে চলে আসে। ঠাকুরদাও যেন স্বপ্নে ঢুকে পড়ে। বলে, স্বপ্ন নয়-- সত্যি। সত্যি। সত্যি ইলিশ। বলতে বলতে ঠাকুরদার গলার রগ ফুলে ওঠে। আমাদের পাত থেকে সেই সব হলুদ ইলিশ লাফিয়ে ওঠে। স্থির হয়ে থাকা চোখ পিট পিট করতে থাকে। মুখ হা করে আর বন্ধ করে। খলবল করে ওঠে হাওয়ার ভেতরে। আমরা শুনতে পাই, সেইসব ইলিশ বলছে, সত্যি সত্যি। সত্যি।
আমরা হেসে উঠি। হেসে হেসে বলি, সত্যি তো। সত্যিই তো। স্বপ্নের চেয়ে মধুর আর কোনো সত্যি নেই।
এইসব দিনে বাবার খুব বেশি দেখা পাই না। হাট থেকে ফেরে কি ফেরা না, ফিরলেও কখন ফেরে, কখন চলে যায় --- আমরা টের পাই না। বুঝতে পারি মায়ের দীর্ঘশ্বাস বাড়ছে। ঠাকুরদা কাজের সন্ধান করে। কিন্তু বুড়ো বলে কেউ নিতে চায় না। দাওয়ায় বসে থাকে ঝিম মেরে। মাঝে মাঝে হাঁক ছাড়ে। বলে, বউমা, মুষ্টি চাল ঠিকঠাক মতো রাখো। অতিথি আসবে। এলে রান্নাবান্না করতে হবে।
ঠাকুরদার হাঁক শুনে মা হাসে। তারপর খাল পাড়ে যায়। সামান্য কাপড় তুলে জলে পা রাখে। আমরা দেখতে পাই, মায়ের পা থেকে সোনা গলে গলে জলে ভাসে। সেটা দেখে মাথার উপর থেকে একটা পাখি করুণ স্বরে বলে, ও বৌ--- ঘরে যাও।
মা অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। কাকে যেন খোঁজে। শ্বাস ঘন হয়ে পড়ে। শরমে জড়িয়ে আসে পা। ফিসফিস করে বলে, আইসেন না। আইসেন না।
পাখি আবার বলে, ও বৌ---ঘরে যাও।
কাউকে দেখতে না পেয়ে মায়ের স্বস্তি আসে। তারপর ঘোমটা একটু নামিয়ে জলে হাত রাখে। তুলে আনে চিকন বেতি। জলে রূপো গলে গলে ভেসে যায়। ঠাকুরদা শুধায়, ও বৌমা, ইলিশ মাছ আনছ নাকি?
মা সেই বেতি শুকিয়ে পাটি বানাতে থাকে। রঙিন সুতো বেয়ে সেই বেতির উপর ইলিশ নামে। লেজ নাড়ে। এঁকে বেকে আসে লতা আর পাতা। আর আসে নীলপদ্ম। এক ফড়িং উড়ে এসে পাটির উপর উড়ে উড়ে ঘোরে। বিনবিন করে বলে, এই ফুলের গায়ে বসতে চাই। বসতি দাও।
ঠাকুরদা বলে, ও বৌ মা, অতিথি আসলে পাটিতে বসতে দিও।
অতিথির চেয়ে বাবার আসার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকি। কেউ কেউ বলে, তকে ঘোষের চরের দিকে রাতের আঁধারে হাঁটতে দেখা গেছে। কেউ কেউ বলে মানিকদিয়ার স্টিমারে উঠে গেছে। কেউ কেউ বলে ঝিকড়গাছা হয়ে বেনাপোলের দিকে দেখেছিল একবার। সঙ্গে একজন ঘোমটা পরা বৌকে নিয়ে বর্ডার পার হয়েছে। কেউবা বলে তাকে ফুলবদিনা গ্রামের পথে যেতে যেতে পথ ভুল করে নদীর ভেতরে হাঁটা দিয়েছে।
এসব কথা শোনার সময় নেই দিশেহারা আমাদের মায়ের। আমরা খাল খেতে থেকে বেতি তুলে আনি। নিচু হয়ে মা পাটি বুনতে থাকে। আমরা অপেক্ষা করি পাটি বোনা শেষ হলে, রান্নাঘরে ঘরে যাবে। লক্ষ্মীদীঘা চাল ধুয়ে মাটির হাড়িতে ভাত তুলে দেবে। টগবগ করে হাঁড়িতে বলো উঠবে। তার মধ্যে কটা জামাইপুলি সীম, গোল গোল দাদা বেগুন আর ঝিঙ্গা ফেলে দেবে। আমরা থালা পেতে বসে অপেক্ষা করব। কাঁচা মরিচ দিয়ে ফেনা ফেনা ভাত। আর ভর্তা। আমাদের মধ্যে যে ছোটো সে একটু আগেই চেটে পুটে খাবে। তারপর একটু লজ্জা লজ্জা চোখে বলে বসবে, আর দুগগা দাও গো মা।
ঠাকুরদার তখন উন্মাদ দশা। তিনি বটতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকিয়ে তাকিয়ে খুঁজছেন অতিথিকে। মাথায় চিরুনি পড়ে না। চোখের নিচে কালি। ধুতি হাঁটুর উপরে উঠে এসেছে। ফতুয়ার পকেট ছেঁড়া। গলা ধরে এসেছে। তবু জনে জনে শুধাচ্ছেন, আমাগো বাড়ির অতিথিরে দেখছো।
কারো কারো শোনার সময় নেই। কেউ কেউ এই প্রশ্নটি এতো বেশি শুনেছে যে আর তারা শুনতে চাইছে না। কেউ কেউ তাকে একটু ঠেস দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ছেলের বদলে অতিথি খুঁজছেন কেনো?
এ কথার উত্তর তিনি দেন না। দেবেন কেনো? এটা কোনো প্রশ্ন হতেই পারে না। হতে পারে, তার ছেলে, আমাদের বাবা অতিথি খুঁজতে গেছে। হয়তো সে অতিথির খবর পেয়ে গেছে। মনে করেছে অতিথি তাদের বাড়ির ঠিকানা ভুল করতে পারে। হতে পারে অতিথি মনে করছেন, কেউ হয়তো তাকে নিতে আসবে। এভাবে একা একা যাওয়া যায় না। একা একা গেলে গৃহস্বামীর অকল্যাণ হতে পারে। অথবা মনে করেছে, অতিথি হয়তো আসতে সাহস পাচ্ছেন না। হয়তো তিনি শুনেছেন, তাদের বাড়িতে এক অতিথি এসেছিলেন। সেটা তাদের বিয়ের পরে। সাইকেলে চেপে। ক্রিং ক্রিং করে বেল বেজেছিল।
তাকে দেখে নববধুটি একটু প্রগলভ হতে গিয়ে মুখ লুকিয়ে ফেলেছিল। তার ননদিনী সইয়ের কাছে বলেছিল, এই সেই। এ সেই লোক।
ননদিনী শুধিয়েছে, কে এই লোক? কে এই লোক?
নববধুটি অগ্রপশ্চাৎচিন্তা না করে ননদিনীকে বলে ফেলেছে, এই ইনি আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। আমার দিদির কাকাতো দেওর হন। বলেছিলেন, এ মেয়েকে ছাড়া তার জীবন বৃথা। বৌলতলী বাজারে তার রাখী কারবার আছে। তিনটি গয়না নৌকা আছে। এই বাইরে তিনি কর্নেট ক্লারিওনেট বাজান। মাঝে মাঝে মাথুর কীর্তন করেন।
ননদিনী ফস করে বলে ফেলে, আর আসে নাকি সেই লোক?
---না। আসে না। তবে---
--- তবে মাঝে মাঝে খবর পাঠায়। আসতে চায়। দেখা করতে চায়।
ননদিনী তার মাঝ চেপে ধরে। বলে, না। না। বৌদি গো। তুমি তারে আসতে দিও না।
তার বৌদি মুখ নিচু করে রাখে। কিছু বলে না। ননদিনী আবার বলে, এরা কেউ জেনে ফেললে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবে।
সেটা জানে। জানে বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। এ বড়ো কঠিন ফয়সালা।
ঠাকুরদার বাবার বোন মালতী এর ফয়সালা করে দেবেন। তার আগে ঠাকুরদা একজোড়া ধুতি পাঞ্জাবি পাটপাট করে তোরঙ্গে তুলে রাখে। মাঝে মাঝে ন্যাপথলিন রাখে। এই ধূতি পাঞ্জাবি ঠাকুরদার বাবার হতে পারে। ঠাকুরদার ঠাকুরদারও হতে পারে। হতে কোনো এক পরদাদার। কোরা করা ধুতি। গিলে করা পাঞ্জাবি। হয়তো সোনার বোতাম ছিল। হয়তো এখনো আছে। হয়তো থেকে থাকবে অতিথি আসার দিন তক। তোরঙ্গে বড়ো সড়ো তালা লাগানো থাকে বলে আমরা চোখে দেখতে পারিনি। হয়তো তার মধ্যে সোনার মোহর আছে। আকবার বাদশার দরবার থেকে পেয়েছিল সেই পরদাদা। সেই পরদাদাই হয়তো আকবর বাদশার সঙ্গে এই ধুতিপাঞ্জাবি পরে দেখা করতে গিয়েছিল। হয়তো লর্ড কর্নওয়ালিসের সংবর্ধনায় হাজির হয়েছিল। হয়তো জোড়াসাঁকোতে দেবেন ঠাকুরের প্রার্থনাসভায় যোগ দিয়েছিল।
এই ধুতি পাঞ্জাবি কখনো কাছ থেকে আমরা দেখিনি। দেখার সুযোগই দেননি। ঠাকুরদা সবার স্পর্শ বাঁচিয়ে তাদের রাখেন। বলেন, অতিথি এলে তিনি পরবেন। হলুদ ইলিশ রাঁধা শেষ হলে তাকে নিয়ে খেতে বসবেন। অতিথি তখন কাঁসার থালায় হাত দিয়ে গিয়ে আলাদা এক সম্ভ্রম নিয়ে দেখবেন এই প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তানকে। দেখবেন, চাঁদ নম্র হয়ে নেমে এসেছে ঠাকুরদার মাথার উপরে। মলয় পাহাড় থেকে ছুটে এসেছে স্নিগ্ধ হাওয়া। কোথাও বেজে উঠেছে পাখোয়াজ। অতিথি খাওয়া ভুলে যাবেন। একটু বেশি রকম ঝুঁকে বলবেন, আপনাকে কুর্নিশ করি। কুর্নিশ গ্রহণ করুণ হে মান্যবর।
আর তক্ষুণি ভেসে আসবে রাগ হংসধ্বনি। বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই। শুনে সব ঘরবাড়ি থেকে পথে নেমে আসবে শহরবাসী। তারা সমস্বরে ঠাকুরদার নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে নদীর দিকে চলে যাবে। জয়ধ্বনি দিতে দিতে তারা ফুলের মালা নিয়ে ফিরে আসবে।
ঠাকুরদা এরকমই জানেন। মাকে বলেন, এক মুঠো চাল তুলে রেখো বৌমা। অতিথি আসবে। সঙ্গে আসবে দুটো হলুদ ইলিশ। ইলিশ ভাজির গন্ধ সারা শহর জুড়ে ভেসে বেড়াবে। জয়ধ্বনি করতে করতে যারা আসবে তারাও খাবে।
আমরা এইক্ষণে এসে ঠাকুরদাকে শুধাই, দুটি মাত্র ইলিশ দিয়ে শহরের সব মানুষের খাওয়া হবে কী করে?
শুনে ঠাকুরদা হাসেন। ততোদিনে ঠাকুরদা বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন। দাঁতের সংখ্যা কমে গেছে। কথা বললে হাওয়া সরে যায়। কথাগুলোতে আর আগের মতো তেজ নেই। ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে।
ফ্যাঁস ফ্যাঁস করেই ঠাকুরদা তখন আমাদের যিশুর ভোজ পরবের সুসমাচারটি বলতে থাকেন। বলেন, তখন দুপুর হয়ে গেছে। পাহাড়ের ঢালে চার হাজার শিষ্য যীশুর কথা শুনছে। অনেকের ক্ষিদে পেয়ে গেছে। তাদের কোনো খাবার ছিল না। এদের যদি আমি না খাইয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেই তবে পথে এরা অজ্ঞান হয়ে পড়বে। আবার এদের কেউ কেউ অনেক দূর থেকে এসেছে।
তার শিষ্যরা উত্তর দিয়ে বললেন, এই নির্জন জায়গায় এই সব লোকের জন্য কোথা থেকে এতো রুটি পাবো?
তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কাছে কয়টি রুটি আছে?
তারা বললেন, সাতটা রুটি আছে।
তিনি লোকদের জমিতে বসতে বললেন। সেই সাতখানা রুটি ছিড়ে টুকরো টুকরো করলেন।
তাদের কাছে কয়েকটি ছোটো ছোটো মাছও ছিল।
আমরা শুধাই, সাতটা রুটি আর কয়েক টুকরো মাছ দিয়ে চার হাজার লোকের খাবার হয় কী করে?
ঠাকুরদা হাসেন। বলেন, হবে। হবে। হবে। যিশু ঠাকুর বললেই হবে। যদি না হবে তবে তিনি যিশু ঠাকুর হন কী প্রকারে?
আমরা মাথা নাড়ি। না নেড়ে উপায় নেই। কথা সত্যি হলে মাথা আপনি আপনি নড়ে ওঠে। ঠাকুরদা কখনো মিথ্যে বলেন না।
ঠাকুরদা বলেন, যিশু সেই রুটি আর মাছের টুকরো লোকদের মধ্যে বিলি করতে বললেন শিষ্যদেরকে।
সবাই পেট পুরে খেলো। অবশিষ্ট আরো কিছু রুটি আর মাছ ছিল। সেগুলো জড়ো করলে সাত ঝুড়ি হলো।
---আমাদের ইলিশও সাত ঝুড়ি হবে।
-ৃ- হবে। হবে। হবে। সাত নয়-- নয় ঝুড়ি হবে।
--- নয় ঝুড়ি নয়--- তাইলে দশ ঝুড়ি হলুদ ইলিশ বাড়তি থেকে যাবে। আমরা বহুদিন ধরে খেতে পারব।
ঠাকুরদা খুন খুন করে হাসে। আমরাও হাসি। হাসতে হাসতে আমাদের খিদে পায়। খিদে পেতে পেতে আমরা হাসিটাকে ভুলে যাই। আমাদের চোখ থেকে জল ঝরতে থাকে।
ঠাকুরদার তখন হাত কাঁপে। গলা কাঁপে। পা কাঁপে। ঠুক ঠুক করে বাড়ির বাইরে আসে। অশোক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষা করতে থাকে। মাথার উপরে রোদ ওঠে। ঝর ঝর করে বৃষ্টি ঝরে। মেঘ ডাকে। হাওয়া ওঠে। ছায়া নামে। অন্ধকার ঘিরে আসে। জোনাকি ওড়ে। তারা ফোটে। চাঁদ জাগে। জ্যোৎস্না নামে।
ঠাকুরদা হাসি হাসি মুখ করে বলে, আর দেরি নাই। অতিথি রওনা হয়ে গেছে।
আমরা ঘন হয়ে আসি। বলি, কোথায়?
ঠাকুরদা বলে, ওই যে, হোথায়।
--- আমরা তো দেখতে পাচ্ছি না।
-- ভালো করে চোখ মেলে দেখ। বলে, ঠাকুরদা আঙুল তুলে দেখান। ওই যে--- মাঠ পেরিয়ে, বন পেরিয়ে, জল পেরিয়ে অতিথি আসছে। হাতে দুটি হলুদ ইলিশ।
আমাদের মা মানুষটি তখন ননদিনীকে ডাকে। ননদিনী চোখ ডলতে ডলতে জেগে ওঠে। ভয় পেয়ে বলে, কী হয়েছে বৌদি?
--- কিছু হয়নি। তিনি আসছেন।
-- কে আসছেন?
--- তিনি। আর কিছু বলল না মা। তার মুখ সামান্য লাল হয়ে এসেছে। তার এখন অনেক কাজ। ঘর গোছগাছ করতে হবে। উঠোন নিকোতে হবে। স্নানের জল তুলতে হবে। শিউলিতলায় আল্পনা দেবে।
ননদিনী ছুটে এসে বলে, তোমার ভয় করছে না? আবার যদি আগের মতো তাকে বকা দেয়? তাড়িয়ে দেয়?
এর উত্তরে মা কিছু বলে না। বলে ননদিনীকে চুল বেঁধে নিতে। পরে নিতে বলে, তোরঙ্গে রাখা শাড়ি।
ননদিনী চুল বাঁধবে কি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, তার বৌদির মনটি ফুরফুরে। একটু যেন গুনগুন করে গানও গাইছে। গানটির সুরের সঙ্গে শিউলি ফুল একটু একটু ঝরে পড়ছে। উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে সে ফুলগুলো তুলে ননদিনীর আঁচলে তুলে দিয়ে বলল, স্নান সেরে একটা মালা গেঁথো গো বোন।
এরমধ্যে রাত্রি বাড়ি বাড়ে। ছাতিম গাছটি থেকে তীব্র ঘ্রাণ হাওয়ায় ভেসে আসে। ঠাকুরদাকে ধরে ধরে বাইরে থেকে উঠোনে নিয়ে আসে। একটা পুরনো ইজি বসানো হয়। আড়া থেকে তোরঙ্গ নামানো হলো। অতিথি এলেই ঠাকুরদা পরবে সেই বাদশাহি পাঞ্জাবি আর ধুতি। একজোড়া কোলাপুরি জরিদার চটি ছিল। সেটা এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য ঠাকুরদা উসখুস করছে। না পাওয়া গেলে একটা অনর্থ হবে। সেটা ভুলে গিয়ে ঠাকুরদা বলল, মুষ্টি চালগুলো বের করো গো বৌমা।
মুষ্টি চালের কলস শূন্য। ঝম ঝম করে বাজে। সেটা শুনে ঠাকুরদা হায় হায় করে ওঠে, চাল রাখো নাই বৌমা?
আমাদের মা ছুটে এসে ঠাকুরদাকে কাছে এসে বলল, অতিথি মোটা চালের ভাত খেতে পারে না। অতিথি দিনাজপুরের বালাম চাল নিয়ে আসবে। সেই চাল রান্না করে দেবো।
--- আনবে বলছ?
--- আনবে।
--- তুমি জানলে কী করে?
এ কথায় মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার মুখে কোনো কথা আসে না। চুপ থেকে কথা খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে তার চোখ ভিজে আসে। এই বুড়ো মানুষটিকে মিথ্যে বলতে মন চায় না।
--- বৌমা, ও বৌমা, তুমি কথা না বলে কই গেলে? বৌমা, ও বৌমা--- বলে গেলে না।
উত্তর না পেলে কথা বলতেই থাকবে ঠাকুরদা। শেষ একদম শিশুর মতো কেঁদে উঠবে। কাঁদতে কাঁদতে তার হেচকি উঠে পড়বে। শেষ শ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।
তার আগে মা এসে তার হাত দুটো ধরে। আঙুলগুলো টিপে দেয়। তার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ে। শিউলি ফুলের পাতা নড়ে। বলে, মালতী পিসি অতিথির হাত দিয়ে সুগন্ধী চাল পাঠিয়ে দেবেন। আপনি বলছিলেন।
এবার ঠাকুরদা একটু অবাক হয়। কবে বলেছিল মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু মনে করতে পারে না। মাথা শূন্য শূন্য লাগে। তখন ভাবে, হয়তো বলেছিল। বলে না থাকলে বৌমা জানবে কীভাবে? না জানলে বলবেই বা কেনো? সে মিথ্যে বলতে জানে না। তার বৌমাটি বড়ো ভালো। সব সয়ে থাকে। সয়ে থাকা ছাড়া তার উপায় নেই। সয়ে থাকে বলেই তারা সবাই টিকে আছে।
হাসি হাসি মুখ করে ঠাকুরদা বলে, দিনাজপুরের বালাম চাল আনবে। আরও আনবে সাক্করকোরা চাল। পায়েস রানতে হবে। সঙ্গে গোলাপ জল।
কিন্তু---
--- কিন্তু কী?
--- ইলিশ?
--- নিশ্চয়ই ইলিশ আনবে। মা ঠাকুরদার মুখ আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেয়। পাতলা হয়ে আসা চুলে কাঁকুই দিয়ে আঁচড়ে দেয়।
ফিসফিস করে বলে তার এই বুড়ো খোকাটিকে, কলাপাতায় ইলিশ রান্না করব। আপনার রসনা তৃপ্ত হবে।
ঠাকুরদার হাই ওঠে। ধীরে ধীরে চোখ মুদে আসে। শ্বাস গভীর হয়। তার মধ্যে জড়ানো গলায় বলে ওঠে, দুগগা মুষ্টি চাল রেখো গো মা।
অতিথি এলে রান্না করে দেওয়া যাবে। তাকে খাওয়ানো নিয়ে চিন্তা থাকবে না।
তার মাথাটা এলিয়ে পড়ে। একটা জুনি পোকা তাকে ঘিরে ঘিরে উড়ে বেড়ায়। ফিরিক ফিরিক করে জ্বলে আর নেভে।
এই রাতের আধো অন্ধকারে পুকুর থেকে স্নান করে আসে মা। একটা হলুদ রঙের কাপড় পরে। ফিতে দিয়ে চুল বাঁধে। ঠোঁটে মাখে ঠোঁটবিলাস। পায়ে লাগায় রক্তালাল আলতা। দেখে ননদিনী কেঁপে ওঠে। ভয়ে ভয়ে বলে, কী করছ বৌদি? কী করছ?
মা একটু আলতো করে হাসে। চোখে গভীর করে কাজল আঁকে। ননদিনীকেও এঁকে দেয়। কাঁঠালচাপার ফুল তুলে ঘাড়ে গলায় মাখে।
তার তিনটি ছেলেমেয়ে। তবু তাকে এখনো তরুণীই লাগে। মনে হয়, এখুনি সেজেগুজে স্কুলে যাবে।
এ সময় বাড়ির বাইরে একটি কোকিল ডেকে ওঠে। না, নিষ্ঠুর বাঁশি—কর্নেট ক্লারিওনেট? না, সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ? শুনে ননদিনী হাহাকার করে ওঠে। মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে। তার হাত ছাড়িয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়।
ননদিনী এবার কেঁদে ওঠে। বলে, যেও না। যেও না। কলঙ্ক হবে।
মা সেই হাত ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। আধো অন্ধকারে মিশে যায়।
ননদিনী তখন তরঙ্গ খোলে। তরঙ্গ থেকে বাদশাহি পাঞ্জাবি আর ধুতি বের করে। খুব মিহি তার সুতোর বুনোট। মৃদু ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। সেই ঘ্রাণ পেয়ে ঠাকুরদা মাথাটা ডানদিক থেকে বাঁদিকে হেলে দেন। তাঁর নাকের নিচে রেশমের মতো গোঁফ ফুলে ফুলে ওঠে।
ননদিনী পাঞ্জাবিটা নিয়ে ঠাকুরদার কাছে এগিয়ে যায়। পরাবে বলে দুহাতে উঁচিয়ে ধরে। হালকা হাওয়ায় সেই মিহি রেশমি পাঞ্জবিটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে হাওয়ায় উড়ে যায়। তখন সূর্য উঠছে। সেই নতুন আলোর মধ্যে গুঁড়োগুলো দুটো ইলিশের আকার ধারণ করে। ভেসে ভেসে আসে। ভেসে ভেসে এসে ঠাকুরদার পায়ের কাছে থামে। ননদিনীকে বললে, অতিথ আইছে, বসতি দাও।
কী অদ্ভুত সুন্দর লেখা! স্বপ্ন না সত্যি না সাহিত্য বোঝা যায়না, মিলেমিশে যায় সব। এই লেখা পড়ার পরে সব কাজ মাথায় ওঠে!
অদ্ভুত আশ্চর্য একটা লেখা। অপার্থিব মায়া জড়ানো গায়ে। আগেও পড়ে এই কথাই মনে হয়েছিল।
অদ্ভুত আশ্চর্য একটা লেখা। অপার্থিব মায়া জড়ানো গায়ে। আগেও পড়ে এই কথাই মনে হয়েছিল।
একটা আনন্দময় পরিভ্রমন!
এই লেখকের লেখা ব্যতিক্রমী সুন্দর।
বড় গভীর দুঃখ ,গহীন অসহায়তা আর চাঁদীম স্বপন গুলে আঁকা.....