ঠিক দুপুরেই লোকটা এসেছিল। ঠিক দুপুর কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না। কারণ বটগাছটির বিস্তার বেশ বড় বলে তার ছায়া পূবে-- কি পশ্চিমে, ঠিক মাথার উপরে বা নিচে-- এগুলো কখনোই বোঝা যায়নি। তারপর ছিল শীতল হাওয়া। দূরে কয়েকটি চিল টি টি করে ডেকেছিল। এ-ই শেষ।
এই টুকু শুনে শরিফুন্নেছা একটু হাসে। মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ একটু আলাভোলা মানুষ। সন্ধে ঘনিয়ে এলে মাঠ থেকে ফেরে। তখন বেশ কিছু রহস্যময় কথা বলে।
শরিফুন্নেসার সেগুলো শুনতে হয়। তার কিছু শুলোক সন্ধান দিতে হয়। নইলে বেচারা স্বস্তি পায় না। এমন কি রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়।
--দুপুর কি বেহান সেইডা দিয়া কাম কি মেয়া। মাঠ দিয়া লোকজন আসেই। এইডা তো আর নতুন কিছু না।
মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ একটু দম খায়। কথা সত্যি। এই মাঠের মধ্যে দিয়েই সিধে পথ। এই পথ দিয়েই নীলফা বাজারে লোকজন যায়। বটতলায় এসে কেউ কেউ জিরিয়ে নেয়। তার সঙ্গে টুকটাক বাতচিত করে। তাড়া থাকলে শুধু সেলামালেকুম বলেই হেঁটে যায়। তাকে না বলে কেউ যায় না। এটাই এই এলাকার দস্তুর।
এই কথাটা শরিফুন্নেসা জানে। সে বলে, তাইলে কেউ আসে নাই। আপনে খোয়াব দেখছেন।
এই খোয়াবের কথাতেই মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের ভ্যাল লেগে যায়। তার খোয়াব দেখার বাই আছে। সে কারণে তাকে বাল্যকালে বেশ ভুগতে হয়েছে। বাপে ক্ষেত খামারের কাজে লাগাতে পারেনি। কাঁচি হাতে পাঠালেই হয় তার হাত কাটত। অথবা কাকপায়া ঘাসের বদলে ধান গাছ কেটে ফেলত। এমন কি মাঝে মাঝে তার সন্ধানই পাওয়া যেত না। পাওয়া যেত, বটতলার ঝুরির ভেতরে চিত হয়ে সে ঘুমিয়ে আছে। মুখে মিটি মিটি হাসি। এই করেই শেষ পর্যন্ত পাঞ্জু শাহর দলে ঢুকে পড়েছে।
পাঞ্জু শাহর কাজই ছিল খোয়াব দেখা মানুষজন নিয়ে কায় কারবার। কপালে তর্জনী রেখে তিনি বাক্যি দেন, এই যে তোর বাপো ছিল, ছিল কিনা কে জানে। হাছা হইল, তোর বাপে ছিলই না। ছিল তোর খোয়াবে। এই যে তুই আছিস, এটাও তোর খোয়াব। আর একদিন নাই হবি, সেইটাও মস্ত খোয়াব।
--আর বিবিজান?
-- আহ হা হা, সেইটা হইল গিয়া আসল খোয়াব।
তবে আজ খোয়াব দেখেছে বলে তার মনে হয় না।
বেচারাকে গভীর চিন্তিত দেখে শরিফুন্নেসা তেল গামছা এগিয়ে দেয়। বলে, গোসল সাইরা আসেন। ভাত বাইড়া রাখছি।
গোসল করতে করতে তার যদ্দুর মনে পড়ে, লোকটা এসেছিল বটে। বসেওছিল বটতলায়। কিন্তু তার সঙ্গে কোনো বাতচিত করেনি।
যে দুপুরের কথা বলা হচ্ছে, সেই দুপুর অথবা বিহান যে কাল হোক না কেন তখন মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের গায়ে একটু ঢিলা লাগে। যে শিকড়টির গায়ে কে বা কারা দা দিয়ে লিখেছিল, ঘুমই শান্তি-- সেই শিকড়ের উপরে মাথাটি সে হেলিয়ে দিয়েছে। চোখটা বুজে আসে। এর মধ্যেই তার মনে হয়-- হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। অথবা শান্তিটা ঠিক আসছে না বলে তাকে কোনোভাবেই ঘুম বলা যাবে না। কলাই ক্ষেতের পাশে জয়তুন নামের সাদা গরুটি ঘাস খাচ্ছে। সরু লেজটা থেকে থেকে মাছি তাড়াচ্ছে। একবার গলাটা সামান্য তুলে দুবার হাম্বা করে ডাক দেয়। স্বভাব বশত মুহাম্মদ আব্দুস সামান্য হেসে উত্তর দেয়, সোভানাল্লা। সব কিছু সাফ সুতরো আছে। তখনই আবার চোখ মুদে আসে।
এসব কায়দা কানুন শরিফুন্নেসা জানে। কিন্তু জানে না ঠিক তখনই একটি ঘুল্লি হাওয়া শো শো করে এগিয়ে আসে। তার মধ্যে ধুলো আছে-- কুটোকাটা নেই। একটি লোক গরমে হাফাতে হাফাতে সেই ঘুল্লি হাওয়া থেকে বেরিয়ে আসে। বিড় বিড় করে বলে, গেইছি রে বাপ। অখন তো আর বাঁচনের উপায় নাই।
শরিফুন্নেসা টক বেগুনের সালুন এগিয়ে দিতে গিয়ে শুধায়, তাইনরে দেখতে কেমন?
পাকনা মাথা-- চান্দিতে চুল নাই।
চান্দিতে চুল নাই, কিন্তু কাঁধে ঝোলা আছে। ঝোলাটা চেপে ধরেছিল। পরণের শান্তিপূরী ধুতিটা সামলে মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের পাশে এসে বসে। ধূসর চোখে আকাশের দিকে তাকায়। ততক্ষণে ঘুল্লি বাতাস হো হো করে পুব দিকের আচি খালটি পার হয়ে যাচ্ছে।
এটা দেখতে গিয়েই লোকটি পকেট থেকে এক প্যাকেট স্টার সিগারেট বের করে। কিন্তু পকেটে দেশলাই খুঁজে পায় না। তার ঝোলাটির মধ্যেও হাতড়ে পায় না। ঝোলাটা উপুড় করে জিনিসপাতি বের করে। তার মধ্যেও নেই। ততক্ষণে একটি সিগারেট ঠোটে চেপে বসেছে।
এই সময় মুহাম্মদ আব্দুস সামাদকে লোকটির চোখে পড়ে। লোকটি এবার একটু ভরসা পায়। সিগারেটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে তাকে ডাকতে যাবে। কিন্তু ডাকতে গিয়ে দেখতে পেল, এর বুক ধীরে ধীরে ওঠে আর নামে। চক্ষু মুঞ্জে আছে। তাকে ডাকা ঠিক নয়। ফলে লোকটি সিগারেটটি আবার পকেটে ভরে রেখে উঠে পড়ে। তাকে বহুদূর যেতে হবে।
মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ এই সময় ঘুমোয় না। ঘুমোনোর কথাই নয়। তবে তাকে ঘুমন্ত মনে করে লোকটি কী করে সেটা দেখার জন্য মটকা মেরে পড়ে থাকে।
ঠিক তখনই বুঝতে পারে, লোকটি কিছু দূর হেঁটে যেতেই আরেকটি ঘুর্ণি হাওয়া এসে তাকে ঢেকে দিল। চোখের পলকে ঘুর্ণি হাওয়া মিলিয়ে গেলে দেখা যায়-- তার চিহ্নই নেই। এভাবে এক পলকে কারো নাই হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। ফলে লোকটি যে এখানে এসেছিল সেটা নিয়ে ধন্ধ জাগা স্বাভাবিক।
শরিফুন্নেসা বলে, আপনে আজ সত্য সত্য ঘুমাইয়া পড়ছিলেন। ঘুমাইয়া খোয়াবই দেখছেন।
এই কথা শুনে মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ, তার ট্যাক খুলে একটা সিগারেট বের করে। সেটা দেখিয়ে বলে, এই দ্যাখো।
মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ কখনো সিগারেট খায় না। হুকো টানে। হুকোটা পেয়েছে শরিফুন্নেসার বাপ পাঞ্জু শাহর কাছ থেকে।
এবারে শরীফুন্নেসা একটু গম্ভীর হয়। হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নেয়। ভালো করে দেখে বলে, এইটা দেখি আমাগো এলাকার স্টার সিগারেট নয়। এইটা-- পাসিং শো।
শরীফুন্নেসা এই পাসিং শো সিগারেট প্যাকেটটি চেনে। তার আব্বাজান পাঞ্জু শাহ কোলকাতায় সেবার যখন কবি গান গাইতে গিয়েছিলেন কবিয়াল বিজয় সরকারের সঙ্গে, তখন এই সিগারেটের প্যাকেটটি উপহার পেয়েছিলেন হাওড়ার ক্ষুদে জমিদার শবদার আলী চৌধুরীর কাছ থেকে। পাঞ্জু শাহ তখন বয়সে তরুণ। মুরুব্বী লোকের সামনে ধুমপান করেন না। সেই সিগারেট খাননি পাঞ্জু শাহ। ঘরে স্মারক চিহ্নের মতো যত্নে রেখেছিলেন।
সেবার ঝড়-বইন্যায় পাঞ্জু শাহর ঘর ডুবে গেলে সিগারেট প্যাকেটটি পানিতে ভেসে যায়।
সেটা ১৯৪৩ সালের কথা। স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। গোরা সৈন্যরা হা হা হো হো করে হাসছে। লাখে লাখে মানুষ না খেয়ে মরতে বসেছে। জাপানি বোমা খিদিরপুরে লম্ফ দিয়ে পড়ছে। আর কারা কারা হাক পেড়ে বলছে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। এর মধ্যে সিগারেট তো সিগারেট, ছিলুম টানারও বিলেস থাকে কি করে!
একবার বড় বন্যায় তাদের ঘর থেকে অনেক কিছুর সঙ্গে তেতাল্লিশ সালে পাওয়া পাসিং শো সিগারেটের প্যাকেট ভেসে গেল।
কথা এটা নয়। মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ হাইতনার পাশে একটু উবু হয়ে বলল, একটা গান করছিলেন উনি।
-- কী গান?
--সেইটা মনে নাই। ঘুল্লি হাওয়ায় উবে গেছে। কিন্তু গভীর রাতে শরিফুন্নেসা যখন পাশ ফিরে নাক ডাকতে যাবে, ঠিক তখনি শুনল, উঠোনের উত্তর পাশে বেনুবন খুব মৃদুভাবে কেঁপে উঠেছে। একটি পুঁইডগার মতো কী একটা সুর লতিয়ে উঠেছে। ঘরে মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ নেই। বেণুকায় সে সুর তুলেছে। সুরটি শুনে তার গভীরতর ঘুমের ভেতরে তার চলে যাওয়ার কথা। তার বদলে ঘুম টুটে গেল। তাদের জানালার পাশে রাখা টবে রজনীগন্ধা ফুল গাছে বহুকাল পরে এই প্রথম কলি বেরিয়েছে। মনে পড়ল, এই সুরটি সে জানে। গানটি তার বাপজান পাঞ্জু শাহ ইন্তেকালের আগে শুনিয়েছিলেন--
রজনীগন্ধ্যা ফুল তোমারি--
এই একটি লাইন। আর নয়। ইন্না লিল্লাহ… রাজেউন।
তবে ইন্তেকালে যেতে যেতে বাপজানের গলায় ঘড় ঘড় উঠলে পরে শরিফুন্নেসা মুখের কাছে কানটি নিয়ে শুনতে পেল, বাপজান অতি অস্পষ্টভাবে যা বললেন, তার অর্থ হলো, আমি পারি নাই। তুই গানডারে খুঁইজা বাইর করিস রে। এ কালে আর কিছুই চাওয়ার নাই।
পাশ থেকে কে একজন মুরুব্বি বলে ওঠেন, এখন কলমা রসুল কন। আর কিছু কওনের দরকার নাই।
ততক্ষণে এ পৃথিবীর কারো কথাই শোনার এলেম পাঞ্জু শাহের আর নেই।
শুধু অস্ফূট ঘড় ঘড় শব্দের মধ্যে দিয়ে তিনি ‘রজনীগন্ধ্যা ফুল তোমারই’ বাক্যটা বলতে পারলেন।
শরিফুন্নেসা মুহাম্মদ আব্দুস সামাদকে অতি প্রত্যুষে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। সে আরেকটু ঘুমাতে চাইছে। চোখ বন্ধ রেখেই বলল, তুমি ঠিকই কইছ বউ। কাল লোকটারে সত্যি সত্যি দেখি নাই। খোয়াবই মনে হয়।
এই বলে সে পাশ ফিরতে যাবে তখন তাকে শরিফুন্নেসা ঠেলে দিল। বলল, আপনে খোয়াব দেখেন নাই। সত্যি দেখছেন।
শরিফুন্নেসা একটু চোখ বোজে। তারপর জানায়, ওনার নাম বিধুবাবু। খাটরা রায়বাড়ি সাকিন। যাত্রা দলের অধিকারী। সারা বছর যাত্রা নিয়ে এদিক ওদিক ব্যস্ত থাকলেও দুর্গাপূজা গোণে আসেন। পাড়ার বিচিত্রা অনুষ্ঠানের দেখভাল করেন। নিখুঁতভাবে গানের তালিম দেন। তিনি তালিম দেওয়ার আগে গানের বিষয়কে ভাবকে ছন্দকে শব্দকে, উচ্চারণকে আগে আত্মস্থ করান। ভিন্ন দেশের ভাষা হলে তিনি গানটি অনুবাদ করান। গায়ককে সেটা গভীরভাবে বুঝতে বলেন।
সেবার পূজা কমিটির সভাপতি মহিতোষ উকিল কোলকাতায় গিয়েছিলেন। তার স্ত্রী তখন খুবই অসুস্থ। কোলকাতার হাসপাতালে। ডাক্তার শেষ দিনের তারিখ ঠিক করে দিয়েছেন। সবার মন খারাপ। একদিন জোর করে মেয়ে শেফালীকে পাঠালেন সিনেমা হলে। অমল পালেকরের অভিনীত একটা সিনেমা চলছিল। সিনেমাটি ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড পেয়েছে। মহিতোষ বাবু স্ত্রী লতা মুঙ্গেশকরের গানের ভক্ত। তারা সিনেমা থেকে ফিরতেই তিনি মেয়েকে শুধালেন, লতাজীর কোন গান ছিলরে বেবি?
মেয়ে উত্তর দিল, লতাজীর রজনীগন্ধা ফুল তোমারি গানটি। সিনেমা দেখার মধ্যেই গানটির দুলাইন গলায় এসে গেল। মাকে সে দুলাইন গেয়েও শোনাল।
শুনে তার মা রোগযন্ত্রণা ভুলে গেলেন নিমিষের জন্য। চোখ বুজে রইলেন কিছুক্ষণ। গানটি মধুর। গানটি তার গাইতে ইচ্ছে করছে। এই দুই লাইনই তিনি রোগশয্যায় আপন মনে মৃদু লয়ে গাইতে লাগলেন। সুস্থ থাকলে নিজে সিনেমা হলে গিয়ে এই এই গানটির পুরোটা গলায় তুলে আনতে পারতেন। বিয়ে হওয়ার পর থেকে তাদের ছোট্ট শহরের দুর্গা পূজার বিচিত্রা অনুষ্ঠানে করেন। তিনি নিজে লতার গান খুব ভালো করে গাইতে পারেন। এবার গাওয়ার সুযোগ থাকবে না। তিনি স্বামীর হাত দুটি ধরে অনুরোধ করলেন যেন অনুষ্ঠানে এই রজনীগন্ধা গানটি গাওয়ার ব্যবস্থা হয়।
এই গানটি লিখেছেন মধু ভান্ডারকর। সুরকার সলিল চৌধুরী।
গানটির লং প্লে রেকর্ড তখন বের হয়নি। সেটা জুলাই মাসে বের হবে। মহিতোষ বাবু সেজন্য সংগ্রহ করতে পারেননি। তবে রজনীগন্ধা ফুল গাছের চারা সংগ্রহ করলেন। এ শহরে এই ফুল নেই। লোকে ফুলটিকে এর আগে দেখেনি। একটি বড়োসড়ো টবে লাগালেন। গাছের যা গতিক তাতে ভাদ্র আশ্বিনে ফুটবে। স্টেজে ফুলটিও শ্রোতাদের দেখার জন্য রাখা হবে। গান শেষে গায়িকাকে উপহার দেওয়া হবে।
স্ত্রী বিয়োগের পরে মহিতীষ বাবু দেশে ফিরলেন। শঙ্কর যাত্রা অপেরার অধিকারী বিধুবাবুকে ডেকে মেয়ে শেফালীকার গলায় গানটির দু লাইন শোনালেন। বিধুবাবু শুনে খুব তারিফ করলেন। পুরো গানটি যোগাড় করার অনুরোধ করলেন। তিনি শেফালিকাকে তালিম দেবেন। সব চেয়ে ভালো হয় গানটির লং প্লে রেকর্ড যদি সংগ্রহ করা যায়।
শহরের মিউজিক স্টোরের মালিক রসিক মল্লিক কোলকাতা থেকে জনপ্রিয় গানের লং প্লে রেকর্ড এনে থাকেন। এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইক ভাড়া দেন। সেখানে এই রেকর্ডগুলো বাজে। জুলাই মাসে তিনিই মহিতোষ বাবুকে গানটির রেকর্ড এনে দিলেন এইচএমভির স্টোর থেকে। দাম নিলেন না। শুধু শর্ত দিলেন, গানটি শেখার পরে রেকর্ডটি তাকে ফেরত দিতে হবে। অনুষ্ঠানের পরে তিনি মাইকে বাজাবেন।
এবারে এই বিচিত্রা অনুষ্ঠানের শতবর্ষী পূর্তি হবে। এই অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ দিতে শহরের কজন গণ্যমান্য ব্যক্তি ঢাকা গেলেন। এ শহরের শেখ সাহেব তখন দেশের প্রেসিডেন্ট। তিনি মহিতোষ উকিলের জিগরি দোস্ত। দুজনে স্থানীয় মিশন স্কুলে পড়তেন। ফুটবল খেলতেন।
শেখ সাহেব বিচিত্রা অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। অনুষ্ঠানসূচিতে লতা মুঙ্গেশকরের গান আছে দেখে খুব খুশি হলেন। লতাজীর তিনিও ভক্ত। একাত্তর সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাঁকে আটক করে রাওয়াল পিন্ডিতে নিয়ে যায়। তাঁকে ফাঁসীর দণ্ড দেওয়া হয়। রায়টি শোনার পরে কনডেমন্ড সেলে লতাজীর গাওয়া একবার ‘বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানটি নিয়মিত গাইতেন। মহিতোষ বাবুকে ক লাইন গেয়েও শোনালেন।
গান শেষ করে শেখ সাহেব আয়েশ করে পাইপ ধরালেন। মোহিতোষ উকিলকে বললেন, বিচিত্রা অনুষ্ঠানে গানটি লতাজী নিজেই গাইবেন। ভারত থেকে লতাজীকে আনার ব্যবস্থা করে দেবেন।
লতাজীর আসার খবরে এই ছোটো মফস্বল শহরে বেশ সাড়া পড়ে গেল। সরকারি উদ্যোগে রাস্তাঘাট ঠিক করা হলো। স্থানীয় ডাকবাংলোটিতে নতুন করে তিনটি রুম বানানো হলো। কলেজমাঠে ঘূর্ণয়মান স্টেজ করা হবে।
যেদিন স্টেজের মালামাল আসবে সেদিন শেখ সাহেবের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যাওয়া মৃতদেহ এলো হেলিকপ্টারে। শহরের ডাকবাংলোতে আর্মির অফিস হলো। সারা জুড়ে তারা টহল দিতে শুরু করল। শহরেকয়েকটি ছেলের লম্বা চুল কেটে বেলটাক করে দেওয়া হলো। হরেকেষ্ট সাহার মদের দোকানটি বন্ধ করা হল না বটে, তবে মাতাল অবস্থায় হাবিল মিয়াকে রাস্তায় পাওয়া যাওয়ায় কালিবাড়ির পুকুরে চোবানো হলো। একটি মানত করা ষাঢ় খুব অন্তরঙ্গ ভাবে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াত। স্থানীয় একটি শিশু স্কুলের গেটের সামনে ষাঢ়টিকে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। ষাঢ়টি দাপাতে দাপাতে মারা গেল। সেটা দেখে তিনটি শিশু অজ্ঞান হয়ে গেল। সেলিম কন্টাক্টরের পাগল ছেলেটি স্বভাববশত বটতলায় উর্ধ্বমুখী হয়ে গ গ আওয়াজ করছিল। তাকে আর্মিরা টহল ভ্যানে চড়িয়ে রাস্তায় রাস্তা ঘোরালো। তার বাবা সেলিম কন্টাক্টর এর প্রতিবাদ করায় তাকেও ছেলের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। আর একটি জাম্বুরা কেটে তার আধখানা তার মুখে চেপে বসিয়ে দেওয়া হলো। আর বাকি আধখানা পাগল ছেলেটির মাথায় মুকুটের মতো বসানো হলো। এটা শুনে বাসা থেকে ছুটে এসেছিল পাগল ছেলেটির মা। তাকেও ভ্যানে তোলা হবে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু আর্মির সেই টহল টিমটি ছিল মানবিক। তারা শাড়িপরা রোদুদ্যমনা মায়ের পেটের সামান্য খোলা অংশটিতে একটু আলকাতরা মাখিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিল। একটি উৎফুল্ল সুখী সুন্দর ছোট্ট শহর স্তব্ধ হয়ে গেল।
মোহিতোষ উকিল খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। খুব উদ্বিঘ্ন হয়ে তার বন্ধু লাল মিয়া সাহেবের কাছে গেলেন। তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান। দুজনে বন্ধু মানুষ। তুই তোকারি বোল ভুলে গিয়ে লাল মিয়া বললেন, দিনকাল খারাপ। মানুষেরই বাঁচন নাই, আর তুমি চিন্তা করছো বিচিত্রা অনুষ্ঠান নিয়া!
মোহিতোষ উকিল তো তো করে বললেন শতবর্ষ থেকে অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। লতা মুঙ্গেশ্বর আসবেন।
এবারে লাল মিয়া মুখটা উকিলের কাছে নিয়ে বললেন, লতার আশা বাদ দেও। নিজেরাও কিছু করতে পারবা না। জানপরান নিয়ে টিকতে পারো কিনা সেইতা দ্যাখো।
মোহিতোষ উকিল খুব মুষড়ে পড়লেন। উপায় দেখতে না পেয়ে তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেল। তার স্ত্রীর শেষ বাসনা পূর্ণ হচ্ছে না। ‘রজনীগন্ধা ফুল তোমারই’ গানটি গাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
মোহিতোষ উকিলের নাইনে পড়া মেয়ে শেফালিকা বাবার এই দশা দেখে থানার প্রবীণ ওসির কাছে গেল। ওসির কাছে উকিল বাবু অপরিচিত নন। শেফালিকার দিকে চেয়ে বলল, আমাদের কিছু করার নাই। তুমি মেজর সাহেবের কাছে যাও। তার কথাই আইন।
ক্যাম্প অফিসে মেজর আতিক দাবা সাজিয়ে বসেছিলেন। শেফালিকাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি দাবা খেলতে পারো?
শেফালিকা উত্তর দেওয়ার আগেই মেজর আতিক বললেন, তুমি যদি আমাকে দাবা খেলায় হারাতে পারো তবে যার জন্য এসেছ তা বলার অনুমতি পাবে।
মেজর আতিক সিরিয়াস। মুখ গম্ভীর করে বসেছেন। শেফালিকার বাবা মা দুজনে দাবা খেলতেন। সেও খেলতে জানে। তবে সেটা কোনো শর্তামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো নয়। চুপ করে রইল। তাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মেজর আতিক সিগারেট আনতে পাশের রুমে গেলেন। একজন সৈন্য দুই কাপ চা রেখে গেল। সঙ্গে মেরি বিস্কুট। তাকে বলল, চুপ করে থাকবেন না। খেলতে যখন বলছেন উনি, তখন না খেলে যেতে পারবেন না। কোনো মাফ নাই।
মেজর আতিক সিগারেট খেয়ে ফিরে দেখতে পেলেন শেফালিকা দাবার চাল দিয়েছে। খেলা শুরু হলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শেফালিকা বুঝতে পারল, এ খেলায় তার জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তার মুখ কালো হয়ে উঠল। বুঝতে পারল, তার আশা পুরণ হবে না।
শেষের দুএকটা চাল দেওয়ার আগেই মেজর আতিক খেলা থামিয়ে দিলেন। গুটিগুলো এলোমেলো করে ফেললেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল শেফালিকার বুক থেকে। সে উঠে দাড়াল চলে যাওয়ার জন্য। মেজর আতিক তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেনো এসেছিলে?
--বিচিত্রা অনুষ্ঠানের জন্য।
-- হবে। মেজর আতিক সহাস্য মুখে জানালেন। নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠানটি হবে। সে সময়ে যাবতীয় সহযোগিতাই তিনি করবেন।
আরো জানালেন, দেশের অন্যতম সেরা শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ তার খালাতো বোন। পাকিস্তানের সামরিক একাডেমি কাকুলে তিনি যখন ট্রেনিং নিয়েছিলেন, সে সময় নূর জাহানের অনেক মাহফিলে অংশ নিতেন। নূর জাহানের সঙ্গে তোলা তার একটা ছবিও দেখালেন। মেহেদী হাসান সাহেব তাকে একটা গজল শেখাতে শুরু করেছিলেন। বেশ সুরেলা গলায় মেজর গেয়ে উঠলেন--
পেয়ার ভরে দো শর্মিলে নাই,
জিনসে মিলা মেরে দিলকো চেইন,
কোই জানে না কৌন মুঝেসে শরমায়ে,
ক্যায়সে মুঝে তড়পায়ে--
গজলটি লিখেছেন খাজা পারভেজ। সুর রবীন ঘোষ। গেল বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত চাহাত উর্দু ছবিতে গানটি আছে। মেজর একটু অনুবাদ করেও শোনালেন--
ভালোবাসায় ভরা ঐ লাজুক চোখ
এ তো আমারই মনের সুখ
কেউ জানে না কেন আমারই জন্য এ শরম?
কিভাবে, এ যে আমারই মরণ!
কড়া সামরিক শাসনের মধ্যেও বিচিত্রা অনুষ্ঠান হবে জেনে মোহিতোষ বাবু খুব খুশি হলেন। শহরের শঙ্কর অপেরার বিধুবাবুকে ডেকে পাঠালেন। বিধুবাবু শেফালিকাকে গানটির তালিম দিতে লাগলেন। গানটি বিধুবাবু শেফালিকার গলায় তুলে দিয়ে রেকর্ডটি রসিক লাল মল্লিকের মিউজিক স্টোরে ফেরত দিয়েছেন।
এইরকম একটি দিনে এতদ অঞ্চলের বিখ্যাত জারীগায়ক পাঞ্জু শাহ এ শহরে ঢোল কিনতে এসেছিলেন। ফেরার পথে মোহিতোষ উকিলের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার পা থেমে গেল। তার কানে এলো দোতলা বাড়ি থেকে রজনীগন্ধা গানটি। মনে হলো কোনো মানবীর কণ্ঠ নয়-- পরীর কণ্ঠ শুনছে। এই গান তার মর্ম স্পর্শ্ব করল। গানটির কয়েকটি লাইন গলায় তুলে নিলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, তার অন্ত:সত্ত্বা বিবিকে নিয়ে আস্বেন বিচিত্রা অনুষ্ঠানে। তাকে শোনাবেন। বিবির মধ্যামে তার সন্তান এই অনুপম কণ্ঠ মাধুর্য্য পাবে। এর চেয়ে জীবনে অন্য কোনো চাওয়া নেই।
বিচিত্রা অনুষ্ঠানের আগের সপ্তায় মোহিতোষ বাবুর বাড়ির সামনে একটি জিপ এসে থামল। মেজর আতিক নামলেন। তিনি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দেখতে এসেছেন। খুব মনোযোগ দিয়ে গানগুলো শুনলেন। খুব তারিফ করলেন। তিনি শেফালিকার খুব কাছে এগিয়ে গেলেন। শেফালিকা খুব ভয়ে জড়ো সড়ো হয়ে গেল। কিন্তু মেজর আতিক চেনা মানুষের মতোই স্বাভাবিক। শেফালিকার গলায় একটি লকেট ঝুলছিল। সেটা ঝঁকে পড়ে দেখলেন। তাতে খোদাই করে লেখা-- শেফালিকা। শেফালিকা শব্দের প্রতিটা অক্ষরের উপর খুব যত্ন করে আঙুল ছোঁয়ালেন। বললেন, বড়ে আচ্ছা হ্যায়।
লকেটটি সোনার নয়। সাদা শঙখ কেটে বানানো। শেফালিকার প্রয়াত মা লকেটটি মেয়েকে উপহার দিয়েছিলেন। মায়ের স্মৃতি সে কাছ ছাড়া করে না। সব সময় গলায় পরে থাকে।
শেফালিকা একটু জড়ো সড়ো হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মেজর আতিক ছিলেন খুবই স্বাভাবিক।
মেজর আতিক গানের তালিমদাতা বিধুবাবুর সঙ্গে খুব শক্তভাবে হ্যান্ডশেক করলেন। তিনি যখন গাড়িতে উঠছেন তখন দোতলার বারান্দায় শেফালিকা এসে দাঁড়াল। তার দিকে হাসি মুখে হাত নাড়লেন মেজর আতিক।
এর দুদিন পরে এ বাড়িতে রজনীগন্ধা গানটি শোনা গেল না। মোহিতোষ বাবুকে উদ্ভ্রান্ত হয়ে থানাপুলিশ করতে দেখা গেল। শহরে কয়েকটি গুজব উঠল--
১. শেফালিকা নিখোঁজ হয়ে গেছে।
২. কে বা কারা শেফালিকাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে।
৩. শেফালিকা কোনো যুবকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
৪. কেউ কেউ অনুমান করল, সে আত্মহত্যা করেছে।
৫. কেউ কেউ ফিসফাস করতে লাগল, মেজর আতিক তার প্রেমে পড়েছিলেন। সেটা টের পেয়ে মোহিতোষ বাবু মেয়েকে গোপনে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন।
৬.দু:সাহসী কয়েকজন সন্দেহ করল, মেজর আতিক তাকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে গেছেন। তাকে বিয়ে করেছেন। ঢাকায় পাঠিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তবে কেউই একথাটি মুখে বলতে পারল না। মেজর আতিক কিছুদিন এ শহরেই ছিলেন। তারপর শোনা যায়, কাকুলে উচ্চতর ট্রেনিং নিতে চলে গেছেন।
বিজয়া দশমীর পরের দিন বিচিত্রা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত তারিখ ছিল। সেদিন পাঞ্জু শাহর নৌকা এসে থামল। তার স্ত্রীর তখন প্রসবকাল ঘনিয়ে এসেছে। খুব ধীর লয়ে চলাফেরা করে। খুব যত্ন সহকারে স্ত্রীকে ধরে ধরে অনুষ্ঠান স্থলের দিকে গেলেন। সেখানে অনুষ্ঠানের কোনো নাম নিশানা নেই। শহরের পথঘাট জনশূন্য। ঘরগুলো বন্ধ। কোনো কোনো জানালা সামান্য খুলে অতিরিক্ত কৌতুহলী দুএকজন পথের দিকে গভীর সন্দেহ নিয়ে উঁকি মারছে। পাঞ্জুশাহের স্ত্রীর গা ছম ছম করে। সে স্বামীর হাত আরো জোরে আকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, কোনো ভূতের জায়গায় নিয়া আসেন নাই তো?
পাঞ্জুশাহের সাহস বেশি। তার মনে হচ্ছে, লোকজন সভাই বিচিত্রা অনুষ্ঠান দেখতে টাউন মাঠে চলে গেছে। একটু ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এইবারের গান বাজনা মনে হয় আগেভাগে শুরু হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চল।
অনুষ্ঠানস্থলের কাছে আসতেই তারা দেখতে পেল, স্টেজে কে একজন প্রিন্সেস রোশনী হেলে দুলে নাচছে। নাচতে নাচতে তার পোষাক খুলছে। এক একটা করেখোলা পোষাক আর্মিদের মধ্যে ছুড়ে দিচ্ছে। আর আর্মিরা লাফিয়ে দাপিয়ে উল্লাশ করে সেই পোষাক ধরার চেষ্টা করছে। তারা চেঁচিয়ে বলছে, জানেমন প্রিন্সেস রোশনী বানু।
এই রোশনী বানুকে এর আগে কখনো দেখা যায়নি। মোহিতোষ বাবু বা তার মেয়ে অথবা বিচিত্রা অনুষ্ঠানের আয়োজনকারী কাউকেই এখানে দেখা গেল না। এমন কি এ শহরের অন্য কোনো লোকজনও এ মাঠে নেই।
পাঞ্জুশাহের স্ত্রী এই নাচ গান দেখে বেশ লজ্জা পেল। মরে গেলেও তার ছেলেমেয়েদের এই গান শিখতে দেবে না। তার স্বামী লোকটি দেশ বিদেশে জারিগান গেয়ে বেড়ালেও তার স্বভাব চরিত্র খুব সাফ সুতারো। সন্দেহ করার কিছু নেই। মাথা নিচু করে অনুরোধ করল, চলেন, বাড়ি ফিরে যাই। গান শোনার দরকার নাই।
কিন্তু পাঞ্জু শাহ এভাবে ফিরে যেতে চান না। বিড় বিড় কিরে বললেন, কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে।
অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে মোহিতোষ উকিলের বাড়ির দিকে রওনা করলেন। দেখল, মোহিতোষ উকিলের বাড়ি শূণ্য। মোহিতোষ বাবু হার্ট এটাক করে স্বর্গগত হয়েছেন। তার একমাত্র সন্তান শেফালিকার হারমোনিয়ামটা বসার ঘরে পড়ে আছে। শেফালিকা নেই। বারান্দায় একটি টবে রজনীগন্ধা গাছটি আছে। কলি এসেছে। দুএকদিনের মধ্যেই ফুটবে। তবে মাটিতে জলের অভাব। এভাবে জল বিনা পড়লে থাকলে গাছটি মরে যাবে।
রজনীগন্ধা গানটি স্ত্রীকে শোনাতে পারল না। তবে রজনীগন্ধা ফুলের টবটি নিয়ে চলে যেতে মনস্থির করলেন। এ সময়ে রাস্তায় গাড়ির হুইসেল শোনা গেল। আর্মির গাড়ি। ভয় পেয়ে তার স্ত্রী সিঁড়ি থেকে পা ফসকে পড়ে গেল। সেদিনই তার স্ত্রী একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিল। শিশুটির একটি পা খোঁড়া। পতনের ধাক্কা সামলাতে না পেরে শিশুটির পাটি খোঁড়া হয়ে গেছে।
সেকালে খাটরা বার্তা নামে একটি চারপৃষ্ঠার সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো জয়ন্তকুমার সরকারের সম্পাদনায়। পত্রিকাটিতে শেফালিকার অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে কোনো সংবাদ ছাপা হয়নি। তবে একটি খবর তৃতীয় পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছিল--
শঙ্কর অপেরার সত্ত্বাধিকারী শ্রী বিধুভূষণ রায়কে মৃতপ্রায় অবস্থায় কংশুর গ্রামের ভুতের ভিটায় অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। তাহার পাঞ্জাবীর পকেটে পাসিং শো নামে এক প্যাকেট সিগারেট পাওয়া যায়। ইহা আমদানী নিষিদ্ধ পার্শ্ববর্তী শত্রু রাষ্ট্রের পণ্য। দুই দিন পরে তাহার জ্ঞান ফিরিলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেন নাই। তবে তিনি অস্ফুট স্বরে রজনীগন্ধা ফুল তোমারি নামে একটি হিন্দি গান গাহিতেছিলেন। প্রকাশ থাকে যে, দেশের ঈমান আকিদার সহিত অসামাঞ্জস্য হওয়ায় যাত্রা পালার অভিনয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হইয়াছে।
আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তরের বরাত দিয়ে খাটরা বার্তা আরও লিখেছে, স্থানীয় বাজারের রসিক লাল মল্লিকের ঐতিহ্যবাহী মিউজিক স্টোরটিতে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে অগ্নিকাণ্ড হইয়াছে। উক্ত স্টোরে রক্ষিত বিজাতীয় শিল্পীদের রেকর্ডসমূহ সম্পূর্ণভাবে দগ্ধ হইয়াছে। সেখানে অনতিবিলম্বে ধর্মীয় কিতাবিস্তান স্থাপন করা হইবে।
মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ এইসব জানে না। জানার দরকারও নেই। বালিশের পাশে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে তার বাঁশের বেণুকাটি খুঁজল। এই ভোরে, সূর্য ওঠার লগ্নে গানটির কলিদুটি বাজাতে পারলে বেশ হয়।
শরিফুন্নেসা তাকে তাড়া দিয়ে বলিল, সেদিন আপনে যারে দেখছেন সেই লোকটা বিধুবাবু হইবেন। তারে ডাইকা নিয়া আসেন। আমার বড়ো দরকার।
একবার মনে হয়েছিল মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের যেন তাকে বলে দেয়-- পারলে তুমি যাও। আমার অন্য কাম আছে।
কিন্তু একথা বলার উপায় নেই। শরিফুন্নেসার একটি পা ল্যাংড়া। লেঙচে লেঙচে সে বেশি দূর যেতে পারে না। এই ল্যাংড়া পায়ের জন্যই মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। সঙ্গে মরহুম শ্বশুর পাঞ্জু শাহর দু বিঘে চাষের জমিও পেয়েছে। আর একটা দুধেল গাই। তার চ্যাত ভ্যাত নেই।
এসবেরর সঙ্গে তিনি মেয়েকে মোহিতোষ বাবুর বাড়ি থেকে আনা রজনীগন্ধা ফুলের টবটিও দিয়েছেন। টবে রজনীগন্ধা গাছটি আছে, প্রতি মৌসুমে কলির উদগমও দেখা যায়, কিন্তু তা পরিণত হওয়ার আগেই পচে নষ্ট হয়ে যায়। ফুল ফোটার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। তবে একদিন ফুটবে নিশ্চয়ই। লতাজীর গাওয়া রজনীগন্ধা ফুল তোমারই গানটি পূর্ণভাবে গাওয়া হলে ফুল ফুটবে বলে শরিফুন্নেসার বাপ পাঞ্জু শাহের ধারণা ছিল। তিনি কখনো মিছে কথা কন নাই। সেই আশায় টবটিকে খুব যত্ন আত্তি করে।
মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ সেদিন আগে ভাগেই মাঠে চলে যায়।। বটতলার নিচে আয়েস করে ঘুমও দেয় না। চোখ খোলা রেখে ঘুল্লি বাতাস খোঁজে। তার মধ্যে লোকটি থাকতে পারে। কিন্তু আজ আকাশ ঝিমিয়ে গেছে। ঘুল্লি বাতাসের দেখা মেলে না। এরপর দিনও না। তারপর দিনও না। শরিফুন্নেসা উতলা হয়ে আছে। ভোর ভোর তাড়া দিয়ে বলে, লোকটির তল্লাশে বের হন।
তৃতীয় দিনে জয়তুন গরুটিকে নিয়েই বের হল মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। সেদিন সেই ঘুল্লি হাওয়া বটতলার পাশ দিয়ে যে খালের দিকে চলে গিয়েছিল, সেই খাল পার হলে চেচানিকান্দি। সেখানে বদ্যিবাটির বুড়ো বদ্যি মশাই দাওয়ায় বসে ছিলেন। তার মাথাটা খাড়া থাকে না। ঝুলে থাকে। চোখের দৃষ্টি নেই। তিনি জানালেন, একজন বুড়ো লোক সেদিন এসেছিলেন বটে। যেতে যেতে বুড়ো লোকটি তাকে একটু কেশে বলেছিলেন, গরম কাশির নিদান কী? বদ্যি মশাই বলেছিলেন, কাউয়াঝিঙ্গার পাতা। সিদ্ধ করা জলে তিনদিন স্নান। আর আদাসহযোগে পান চিবান। সর্দি কাশি একেবারে বাপ বাপ করে পালানোর পথ পাবে না।
মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ একটু বুদ্ধি করে সুধালো, তার হাল সাকিন কি?
-- সেইটা জানি না বাপ। আমি বদ্যি মানুষ। রোগবালাইয়ের নিদান জানি। মাইনসের হাল সাকিন দিয়ে কাজ কি। তবে--
-- তবে। বদ্যি মশাই কাশি থামিয়ে বললেন, একটু সন্দেহ হলো। জিগালাম, মশাইর গলাটা চেনা চেনা লাগে।
লোকটি উত্তর দিলেন, চিন পরিচয় নাই।
দীঘারকূল গ্রামের ছলেমুদ্দি মাঝি পুকুরপাড়ে বড়শি পেতে মাছ ধরছিলেন। তার কাছে বুড়ো লোকটির আরেকটি খবর পাওয়া গেল। লোকটি তার মাছ ধরা দেখেছেন বটে। যাওয়ার কালে বিড়বিড় করে একটা পার্ট বলতে বলতে চলে গেছেন। পার্টটি ছলেমান মাঝির মনে আছে। তিনি স্মরণ করে শোনালেনও মুহাম্মদ আব্দুস সামাদকে--, বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব দাদু তুমি বলেছিলে…
ছলেমান মাঝি হেসে বললেন, এইটা নবাব সিরাজদৌলার পার্ট। যাত্রাপালায় দেখছি।
এর পরে রঘুনাথপুরের রবীন বিশ্বাস লোকটিকে চিনেছেন বলে মনে করছেন। কিন্তু নাম মনে করতে পারছেন না। তিনি বললেন, মাঝিগাতির বুড়ো ইমাম সাহেব তাকে চিনলেও চিনতে পারেন। তার অচেনা কেউ নেই।
স্ত্রী বিয়োগের পরে ইমাম সাহেব থাকেন মেয়ের বাড়ি। এখন আর ইমামতি করার তাগদ নেই। তিনি মুহাম্মদ আব্দুস সামাদকে দেখে বললেন, আমার কাছে অনেক লোকই মোলাকাতে আসে। তুমি কোন লোকটির হদিশ চাও বাবা।
আব্দুস সামাদ লোকটির বর্ণনা দিলেও ইমাম সাহেব ঠিক ঠিক চিনতে পারলেন না। বললেন বুড়ো হলে সব মানুষের চেহারাই এক রকম হয়ে যায়। তুমি তার অন্য কোনো ইশারা থাকলে দাও।
তখন মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ তার বেণুকা বাঁশি বের করে রজনীগন্ধা গানটির সুর বাজিয়ে শোনাল।
শুনে তিনি জানালেন, এই সুর তার চেনা। যিনি তাকে সুরটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন সেই লোকটিকে চেনেন। তার বিশিষ্ট দোস্ত মানুষ। বহুকাল আগে তিনি ইমাম সাহেবের কাছে একটা শায়ের নিয়ে এসেছিলেন অনুবাদ করতে। সেটা করেওছিলেন। বলে, ইনাম সাহেব খুব পুরনো একটা খাতা বের করলেন। একটা পাতায় লেখা আছে--
তারিখ : ১২ রা জুলাই, ১৯৭৫.
(রজনীগন্ধা ফুল তোমারি, মেহাকে ওহি জীয়ন মে)
তোমার এই রজনীগন্ধা ফুল, আমার জীবনে সৌরভ হয়ে ছেয়ে থাক
(ওহি মাহাকো প্রিত পিয়াকি মেরে অনুরাগী মান মে)
এমনই ছেয়ে থাক, প্রিয়ার প্রেম আমার অনুরাগী এই মন জুড়ে
(আধিকার এ জব সে সাজান কা হার ঢাড়কান পার মানা মেনে)
প্রিয়াকে যেদিন থেকে অধিকার দিয়েছি এই মনের, সমস্ত হৃদয়স্পন্দন জুড়ে
(মেই জব সে উন কে সাথ বান্ধি, এ ভেদ তাভি জানে মেইন)
যেদিন থেকে তার সাথে বন্ধনে ধরা পড়েছি, যেন আমি এই রহস্য অনুভব করতে জেনেছি
এর পরের স্তবকগুলো নেই। খাতা থেকে সেই পৃষ্ঠাটি হারিয়ে গেছে।
ইমাম সাহেব বললেন, তার নাম বিধু রায়। শঙ্কর অপেরার মালিক। তিনি ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাসে ফেরার হয়ে যান। তবে তিনি কোথায় গিয়েছেন সেটা জানেন না। তবে কেউ কেউ বলেছিলেন, তিনি মারা গেছেন। তার লাশ পাওয়া যায়নি। তবে মারা যে গেছেন সেটাতে নিশ্চিত নন।
মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের মন খারাপ হয়ে গেল। লোকটির সন্ধান হদিশ পেতে পেতে পাচ্ছে না। লোকটি বিধুবাবু হলে গানটি উদ্ধারের সুযোগ ছিল। ইমাম সাহেবের ভাষ্যমতে বিধুবাবু মারা যাওয়ায় সে সুযোগটি নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবে ব্যর্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলে শরিফুন্নেসা হতাশ হবে। সে গানটি উদ্ধার করার আশায় আছে। মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ রাত্রিকালটা বটতলায় কাটিয়ে দেবে।
রাত্রি যখন মধ্য যাম অতিক্রম করে গেল, শুকতারা উঠবে উঠবে করছে, ঠিক সেই সময় বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না আমায় কথা দিয়েছে গানটির সুর তার ঘুম ভেঙ্গে দিল। পাঁচটি যুবক গানটি গাইতে গাইতে আসছিল। বটতলায় এসে তারা মুহাম্মদ আব্দুসকে ঘিরে ধর বিচিত্র ভঙ্গিতে নেচে নেচে গাইতে লাগল। এদের মধ্যে একজন জামার নিচে গামছা ভরে নারীদের মতো বক্ষ বানিয়েছে। লুঙ্গিটা হাটুর উপরে ধীরে ধীরে তুলছে। আবার ঝট করে নামাচ্ছে। মুহাম্মদ আব্দুস সামাদকে টেনে তুলে তার বুকে পিঠে নারীভঙ্গিমায় স্পর্শ দিতে দিতে বলছে, ভয় পাইও না নাগর--
আমি আপনের প্রিন্সেস শেলি খান।
সব দিতে পারি যা আপনে দেখতে চান।।
মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ এখানে এসে একটু লজ্জা পায়। সে সরে সরে আসে। তারা ঘিরে ঘিরে নাচে। গায়। শুনে তার একটু আশাও জাগে। সে এদের একজনকে শুধায়, আমি যা শুনতে চাই তা তিনি শোনাতে পারেন?
--নিশ্চয়ই পারেন। বলে নারীরূপী মানুষটি তার থুতনি নেড়ে দেয়। আর হা হা করে হাসে। জিজ্ঞেস করে, কী শুনতে চাও গো বাবুসাব?
এবারে মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ ইমাম সাহেবের লেখা কাগজটি বের করে দেয়। দেখে তারা সুর করে গেয়ে ওঠে, রজনীগন্ধা ফুল তোমারি গানটির দুই লাইন। ঘুরিরে ফিরিয়ে এই দুই লাইনই তারা গাইল। আর পারল না।
মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, এই গানটি পুরোটা জানো?
তারা মাথা নেড়ে জানাল, না। তারা পুরোটা জানে না। তবে পুরোটা জানে প্রিন্সেস শেলি খান। সে এই পৃথিবীর সব গানই সম্পূর্ণভাবে গাইতে পারে।
-- প্রিন্সেস শেলি খানরে কোথায় পাব?
এই প্রশ্নের উত্তরে তারা জানালো, খাটরা শহরেই তাকে পাওয়া যাবে। বেলি ড্যান্স করতে প্রিন্সেস শেলি খান এসেছে। তারা পাঁচ বন্ধু মিলে তার নাচ গান দেখে ফিরছে। একটা পর্যায়ে এই পাঁচ বিচিত্র যুবকবেশ কয়েকটি হিন্দি উর্দু আরবী গানের কলি গেয়ে শুনিয়েছে। বলেছে, এই গানগুলি শুনতে হলে প্রিন্সেস শেলি খানের কাছে বুকিং দিয়ে যেতে যেতে হবে।
রাত্রিভর সিঙ্গেল ম্যান আয়োজন। এরজন্য স্পেশাল নজরানা দিতে হবে। বেশি না-- বলে তারা হাতের পাঞ্জা তুলে দেখাল, পাঁচ... ।
--পাঁচ টাকা?
--না।
--পঞ্চাশ টাকা?
--না।
--পাঁচ শো টাকা?
--না। এবারে হেসে গড়িয়ে পড়ল তারা। বলল, শহরের বিখ্যাত লোকজন বুকিং দিচ্ছে। আর মাত্র দুদিন বাকি। এরপর ফুড়ুৎ।
প্রিন্সেস শেলি খান।
হেজিপেজি কেউ নন।।
এরপর পাঁচ যুবকের আর দাঁড়ানোর সময় নেই। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাদের আরো দূরে ফিরতে হবে। তারা প্রিন্সেস শিউলি খানের গান গাইতে গাইতে চলে গেল।
অন্য সময় হলে মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের এইসব ঘটনাকেই তার নয়া খোয়াব বলে উড়িয়ে দিত শরিফুন্নেসা। কিন্তু সে এবার উড়িয়ে দিতে চাইল না। বলল, এই প্রিন্সেস শিউলি খানের কাছেই যাওন লাগবে।
কিন্তু যাওন বললেই তো যাওয়া যায় না। মেলা টাকা লাগবে। তাদের সারা বছর কষ্টে সৃষ্টে চলে যায়। হাতে জমা কিছু থাকে না।
শরিফুন্নেসাকে এবার মরিয়া হয়ে মুহাম্মদ আব্দুস সামাদই বলল, বিবিজান, এসব কিছুই সত্যি না। সব খোয়াব দেখছি।
সেটা আর মানতে রাজী নয় শরিফুন্নেসা। ঘরে মাটির ভাড়, বাঁশের খুঁটির খোঁড়ল, পুরনো ট্রাঙ্কের গুপ্ত পকেট খুঁজে খুঁজে বের করল পাঁচশো ছাব্বিশ টাকা তিন আনা মাত্র। কিছু আনাজ পাতি, কুঁড়হার ডিম বেঁচে, মাঝে সাজে মনে রেখো ভুলোনা আমায়-- কাপড় সেলাই করে এইরকম টুকটাক সঞ্চয় হয়েছে।
মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের হাতে এই টাকা তুলে দিয়ে বলল, এইটা নিয়ে প্রিন্সেস শিউলিবালার কাছে যান।
এটা দেখে সে দহলিজে পাশ ফিরে শুলো। বলল, এই টাকা দিয়ে কিছুই হবে না বিবি।
-- তাহলে কত লাগবে?
-- পাঁচ। নগদ পাঁচ হাজার টাকা।
শুনে শরিফুন্নেসা ঘাবড়ে গেল। পাঁচ হাজার টাকা মুখের কথা নয়। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে আবার ঘরে গেল। তার গুপ্ত ট্রাংক থেকে বের করে আনল এক ছড়া হার। তার আম্মাজান বিয়ের সময় দিয়েছিল। এই হার ছড়া দিয়ে বলল, এইটা বেঁচে দিন।
হার ছড়াটা দেখেও দেখল না মুহামমদ আব্দুস সামাদ। চোখ বন্ধ রেখে বলল, এইটা সোনার হার না। রূপার হার। এই জিনিসের দাম নাই।
-- তাইলে?
-- তাইলে আর গান শুনে কাজ নাই।
-- কিন্তু আমার বাপজানের শেষ হাউসের কী হবে?
এই কথার কোনো উত্তর নেই। মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ জয়তুন গরুটিকে নিয়ে আবার মাঠে গেল। তার বারবার মনে হতে লাগল, শরিফুন্নেসা তার মতোই খোয়াব দেখতে শুরু করেছে। এরমধ্য নিন্দ কেটে গেলে সে খোয়াব শরিফুন্নেসা ভুলে যাবে।
সন্ধ্যা ঘুরে গেলে বাড়িতে ফিরে দেখল, শরিফুন্নেসা তার জন্য ভাত বেড়ে বসে আছে। পাশে বাপজানের দেওয়া মোহিতোষ বাবুর বাড়ি থেকে আনা রজনীগন্ধা ফুলের টব রাখা। তাতে ফুলের কলি ধরেছে। খুব তরতাজা এই কলি। পঁচে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। কলিতে কয়েকটি ফুল আধ ফোঁটা হয়ে আছে। আজ সবগুলো পাপড়ি মেলবে বলেই মনে হয়।
সেটা দেখিয়ে শরিফুন্নেসা তাকে বলে, আর দেরি করবেন না। তাড়াতাড়ি খেয়ে নেন।
--এত তাড়া ক্যান বিবি?
-- কাজ আছে।
খাওয়া শেষ হতে না হতে শরিফুন্নেসা কাপড় পরে তাকে বলল, চলেন। দেরি করণ যাবে না।
একটু অবাক হলো মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এভাবে তার বিবি কোথাও যায়নি। চোখে একটু কাজলও দিয়েছে। মাথায় আধা ঘোমটা। দেখে আশ মেটে না। বলে, কোথায় যাব?
-- শহরে। প্রিন্সেস শেলি খানের থানে।
-- টাকা?
-- চিন্তা নাই। লগে জয়তুনকেও নিয়া লন।
--জয়তুন? তারে নিয়া কাম কি?
--একা রাখনের বিপদ আছে। চোর ডাকাতে নিয়া যেতে পারে।
বলে হাসল শরিফুন্নেসা। ঘাটে নৌকা বাঁধা ছিল। নৌকায় তারা তিনজন উঠল। শরিফুন্নেসার হাতে রজনীগন্ধার আধ ফোঁটা স্টিক। মাঝিকে বলল, হাত টেনে চালান। জয়তুন গরুটি একবার গলা তুলে বলে, হাম্বা।
হাওয়ায় পাল্লা দিয়ে ছুটে চলল নৌকা। আকাশে বেশ বড়ো করে চাঁদ উঠেছে। এর মধ্যে শরিফুন্নেসা গুণগুণ করে গাইতে শুরু করেছে তার বাপজানের কাছে শোনা রজনীগন্ধা ফুল গানটির দুটো লাইন। আজ গানটি সম্পূর্ণ শুনে গলায় তুলে নিতে পারবে। তারপর সে তার বাপজান পাঞ্জু শাহর কবরে যাবে। গেয়ে শোনাবে। বাপজানের রুহু শান্তি পাবে।
এই মৃদু আলো হাওয়ার মধ্যে শরিফুন্নেসার কণ্ঠস্বর মিলে মিশে গেলে মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের মনে হয় সে জেগে নেই। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নতুন খোয়াব দেখছে। তার চোখ মুদে আসে।
এ শহরে প্রিন্সেস শেলি খান নামে কেউ এসেছে কিনা সেকথা শহরের কেউ বলতে পারে না। তখন রাত দশটা ছুঁই ছুঁই করছে। কারা লাশ দাফন করে ফিরছিল। কাঁধে শূন্য কফিন। মাথা নিচু লোকগুলোও কিছু বলতে পারল না। কলেজ মোড়ে একজন ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বেচারা একটু নড়ে নড়ে উঠল। তখনই জয়তুন গরুটি একটু চড়া স্বরে ডেকে উঠল, হাম্বা। শুনে ট্রাফিক পুলিশটি পকেট থেকে বাঘ মার্কা দেশলাই বাক্স বের করে দিল। বলল, এই নেন। বারুদ ঠিকই আছে।
তাকে মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ ঘুম ঘুম গলায় একটু কেশে শুধাল, প্রিন্সেস শেলি খানের থানটা কোথায়?
ট্রাফিক পুলিশ এবারে, হাত দিয়ে বাম দিকের সড়ক দেখিয়ে দিল, বলল, ওইদিকে। ওইদিকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি বাস ছাড়ে।
সেদিক পানেই জয়তুন গরুটি হাটতে শুরু করল। তার পিছু পিছু চলেছে মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। আর শরিফুন্নেসা চলেছে পা টেনে টেনে। তার মুখ ঘেমে গেছে। আর ডালুমালু করে তাকিয়ে খুঁজে চলছে প্রিন্সেস শেলি খানের থান।
নদীর পাড়েই ডেইলী পাসেঞ্জারি বাস স্ট্যান্ডে কয়েকটি পুরনো বাস দাঁড়িয়ে আছে। আর গোটা পাঁচেক স্ক্রুটার। ধু ধু চর। একটা পাতি শিয়াল উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে। আর কেউ কোথাও নেই।
দেখে ভেঙে পড়ল শরিফুন্নেসা। তাকে তুলে ধরতে যাবে ঠিক তখনই জয়তুন গরুটি পাতি শিয়ালটির দিকে শিং বাগিয়ে এগিয়ে গেল। গগণ বিদারী রবে ডেকে উঠল হাম্বা। সেটা দেখে পাতি শিয়ালটি সরে গেল নদীর চরের দিকে। আর তক্ষুণি চাঁদের আলোতে দেখা গেল সেখানে একটি মানুষ পড়ে আছে। মৃত। মৃত মানুষটিই আড়মোড়া করছে। তাদেরকে দেখে, একটু বিরক্তি সহকারে চেঁচিয়ে বলল, এখানে কী চাও?
--প্রিন্সেস শেলি খানকে চাই। কথাটি পালটা চেঁচিয়ে বলল মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এতো জোরে এর আগে কখনো সে কখনো কথা বলে না। ভয় পেয়ে শরিফুন্নেসা তাকে আকড়ে ধরল। মানুষটি ভুত হতে পারে। গুণ্ডাও হতে পারে।
মানুষটি খুব কড়া গলায় জবাব দিল, আছে। শেলি খান আছে।
তার খোঁজ করেন কেন? নাচ দেখবেন?
--না। নাচ দেখব না। গান শুনব।
--কোন গান?
-- রজনীগন্ধা ফুল তোমারি।
--শেলি খান জানে এই গান। টাকা আনছেন?
মাথা নাড়ল মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। টাকা আনছে। মানুষটির হাতে পাঁচশো ছাব্বিশ টাকা উনত্রিশ পয়সা তুলে দিয়ে দিল।
সেটা গুণতে গুণতে বলল, এই টাকা দিয়ে তো শেলি খানের গান শোনা যাবে না।
-- আর টাকা নাই। শরিফুন্নেসা মিনতি করে বলল, এই জয়তুন গরুটারে নেন। দাম আষ্ট হাজারের কম হবে না।
গরুটির নধর কান্তি চেহারা দেখে মানুষটি বেশ খুশি হলো। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। গরুটার কাঁধ ডলে দিল। গোছড়টি হাতে নিয়ে বলল, ওই যে দেখেন প্রিন্সেস শেলি খান।
-- কোথায়?
--নদীতে।
নদীর মধ্যে একটা ঘুল্লি হাওয়া উঠল। সেটা সরে যেতে যেতেই তার জায়গায় একটা পানসি দেখা গেল। তার উপরে কে একজন ঘাগরা বিছিয়ে বসে আছে। হাওয়ার উড়ছে চুল। সেই চুলে জবাকুসুমের ঘ্রাণ-- জলের হাওয়ায় ভেসে যায়। আর ভেসে যায়, একটু মৃদু গানের সুর--
কিতানা সুখ হ্যায় বন্ধন মে
হার পল মেরি ইন আখোঁ মে বাস রাহাতে হ্যায়
স্বপনে উন কে মন কাহাতে হ্যায় মে রংগন কে
এক পেয়ার ভরে বাদলি বন কে
বরষো উন অঙ্গন মে
রজনীগন্ধা ফুল তোমারি
মাহাকে ও হি জীয়ন মে
শুনে মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের চোখ মুদে আসে। এই গান কেবল খোয়াবে শোনা যায়। এর মধ্যে রজনীগন্ধা ফুলটি সম্পূর্ণ ফুটে গেছে।
পানসিটা তরতর বেগে দূরে মিলিয়ে যায়। শরিফুন্নেসা জলের দিকে পা ঘষটে ঘষটে এগিয়ে যায়। রজনীগন্ধা ফুল জলে ভাসিয়ে দেয়। ভাসিয়ে দিয়ে দেখতে পেলো চাঁদের আলোতে জলের নিচে কী একটা চকচক করছে। নিচু হয়ে তুলল। সেটা একটা লকেট। শাদা শঙখের এই লকেটটিতে লেখা, শেফালিকা।