গত এক যুগ পরম্পরার বিনিয়োগ পুঁজি এবং চতুর্বর্গীয় পুঁজি ব্যবস্থার বাইরে থাকা হকার-কারিগর অর্থনীতিকে কব্জা করার জন্যে ডিজিটাল ফাটকা পুঁজি যে কটা উদ্যম নিয়েছিল, তার অধিকাংশই সফল। ভারতের দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্র কব্জা করতে বিনিয়োগ পুঁজির অন্যতম রাজনৈতিক মুখ কংগ্রেসকে দু’দুবার ভোটের ময়দানে ধরাশায়ী করে ডিজিটাল পুঁজির রক্ষক মোদী-শাহর ভারত মঞ্চে আবির্ভাব। বিজেপির অক্ষদণ্ড ব্রাহ্মণ বানিয়া কর্পোরেট তত্ত্বকে উল্টে ব্রাহ্মণ বানিয়াকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র থেকে সামাজিক এলাকায় ছুঁড়ে ফেলে, বিদেশি-স্বদেশি গুজরাটি আর ডিজটাল কর্পোরেটদের স্বার্থ দেখেন মোদী-শাহ।
মোদী-শাহকে ক্ষমতায় এনে ধাপে ধাপে বাজার দখলের পরিকল্পনায় অনেকটা সফল ডিজিটাল পুঁজি। ২৫০ বছর দক্ষিণ এশিয়ায় পণ্য ও সেবার বিপুল বাজার কব্জা করা বিনিয়োজিত পুঁজি আর হকার-কারিগরদের পরিকল্পিতভাবে বাজার ছাড়া করার জন্যে প্রথমে নোটবাতিল, চার বছর পর বিশ্বজোড়া করোনা পরিকল্পনার হাতিয়ার লকডাউন নেমে এল ভারত জুড়ে। বিনিয়োজিত পুঁজির ওপর মোদী-শাহর প্রহার বর্তমান লেখার বিষয় নয়, সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে আলোচনা করা যাবে। এখানে শুধুই হকার কারিগর অর্থনীতির শহুরে অক্ষদণ্ড হকারদের ওপর প্রভাব নিয়ে আলোচনা।
আরও পড়ুন, অতিমারীর মার এবং গৃহপরিচারিকারা
তবে বলে রাখা যাক বিনিয়োগ পুঁজির হালত খারাপ সে বিষয়ে পুঁজি তাত্ত্বিক টমাস পিকেটি আর রঘুরাম রাজন ১৫ বছর ধরে হুঁশিয়ারি দিয়ে চলেছেন, ‘মনে আছে আমি সেবার জ্যাকসন হোল-এ (রঘুরাম রাজন যে সম্মেলনে ২০০৮ ধ্বসের ইঙ্গিত দেন) বক্তৃতা দিলাম। ফেডারেল রিজার্ভের দুই প্রবীণ আমলা বললেন, এগুলো সমস্যাই না। বেসরকারি সংস্থা জানে, কীভাবে সামলাতে হয়। এদের মত স্মার্ট আমলা হয় না - এরা বিপুল মাইনে পায়। তুমি যে হুঁশিয়ারি দিলে, এরা সেই ঝুঁকিটাই নেবে না’। তিনি বলছেন "পরের ঘটনা ইতিহাস... ২০০৮এর ধাক্কাটা এল"।
পুঁজির রক্ষাকর্তারা কান দেন নি। লকডাউনে শ্রমিক প্রত্যাঘাতের বিহ্বল প্রতিক্রিয়া, করোনার বাহানায় স্পেন সরকার জনগণকে নিশ্চিত রোজগার দেওয়ার উদ্যমে প্রমাণ, সময়মত বিনিয়োজিত পুঁজি ডিজিটাল পুঁজির বিরুদ্ধে আক্রমণের বোড়ে সাজাতে ভুল করেছে। কর্পোরেট অর্থনীতির বাইরে আজও হকার কারিগর অর্থনীতি ভারত জুড়ে বিপুল পরিমাণ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তা অঙ্কের হিসেবে কত, তার সামাজিক ব্যাপ্তির পরিমাণ কত, সেসব না হয় অন্য কোনও দিন আলোচনা করা যাবে, শুধু বলা যাক, সে অঙ্কের তুলনায় কর্পোরেট অর্থনীতি তুশ্চু। আর চাষ অর্থনীতি জুড়লে লিলিপুটে পরিণত হবে ভদ্রবিত্তের কর্পোরেট দৈত্য।
ভারতকে হকার-কারিগর অর্থনীতি থেকে বের করে আনতে, মোদী-শাহ জুটির নোট বাতিল বড় ভূমিকা নিলেও তার তুলনায় অনেক বেশি সফল হয়েছে লকডাউন। নোট বাতিলে বেশ ক্ষতি হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্ত লকডাউনে গত পাঁচ মাস ধরে যে এক টাকারও পণ্য বিক্রি করতে পারে নি, পরিষেবাও দিতে পারেনি তথাকথিত অসুরক্ষিত হকার সমাজ। বেবাক শূন্য স্থানে জাঁকিয়ে বসেছে ডিজিটাল অর্থনীতি। জেফ বোজ থেকে মার্ক জুকারবার্গ থেকে মুকেশ আম্বানি প্রত্যেকের সিন্দুক উপচে পড়ছে লকডাউনের ফলে।
গত দুবছর ধরে হকারেরা বুঝতে পারছিলেন তাদের বাজারে থাবা বসাচ্ছে নতুন বাড়ি বাড়ি পণ্য পৌঁছে দেওয়া ডিজিটাল ব্যবস্থা। ন্যাশনাল হকার ফেডারেশনের সম্পাদক শক্তিমান ঘোষের কথায়, ‘গত দুবছরে হকারেরা অন্তত ৩০-৪০% বাজার হারিয়েছেন হোম ডেলিভারি কর্পোরেটদের ধাক্কায়’। আম্ফানে বিপুল বিরাট কাঠামোগত ক্ষতির পাশাপাশি লকডাউনের ধাক্কায় সামগ্রিক ব্যবসা বন্ধ হল গত পাঁচ মাস। ‘দিন আনি দিন খাই হকারেরা নিজেদের পুঁজি আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায়। পাঁচ মাস সঞ্চিত পুঁজি ভাঙতে শুরু করলেন। এই পাঁচ মাসে তিনজন আত্মহত্যা করেছেন ব্যবসা না-থাকার হতাশায়, যাদের মধ্যে একজন ১৯৯৬ সালের অপারেশন সানশাইনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন’, বললেন শক্তিমান ঘোষ।
আরও পড়ুন, করোনাকণ্টকিত ভারতের তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রের কর্মীরা
তবুও অদম্য হকারদের দমিয়ে রাখা যায় নি। লকডাউনে চরম দুর্দশায় পড়া হকারেরা শহরের অন্যান্য অসুরক্ষিত পেশাদার উদ্ধারে ব্রতী হলেন। ১৫৬ দিন ধরে কলকাতায় তিনটে এলাকায় সেক্টর ফাইভ, কলেজ স্ট্রিট এবং রুবি অঞ্চলে দাপটে গণরান্নাঘর আয়োজন করলেন। সমান্তরালভাবে চালিয়ে গেলেন অন্তত ২৫ হাজার মানুষকে নানা ধরণের ত্রাণ দেওয়ার কাজ। বিশেষ করে আমফানে কলকাতা সহ দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় খুবই ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে অসামান্য উদারতায় আজও চালিয়ে যাচ্ছেন ত্রাণ শিবির।
খাপ বললে কিছু বছর আগে কলম বা তলোয়ারের অনুষঙ্গ আসত। এখন অবশ্য ফেসবুক, কিংবা হরিয়ানা। খুব জোর যোগেন্দ্র যাদব কী বলেছিলেন বা রায়া সরকার! সিরিয়াস৯-র পরের সংখ্যা খাপ নিয়ে। লিখছেন তাতিন বিশ্বাস, বল্লরী সেন, প্রতীক, শাশ্বতী দত্তরায়, অভিজ্ঞান সরকার। খাপ এড়াবেন না।
ভেবেছিলাম হকারদের দৈন্যের খবরের হাহাকারে এই রিপোর্টাজ ভরিয়ে দেব। কিন্তু দেশিয় অর্থনীতির, কর্পোরেট নিরপেক্ষ অর্থনীতির অনন্যস্তম্ভ নিজেদের দুর্ভোগ লুকিয়ে রেখে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তাদের বন্ধু পেশাদারদের উদ্ধারে সেটা প্রায় রূপকথাসম এক গাথা, বিশেষ করে ভদ্রবিত্ত নেতৃত্বাধীন নানান শ্রমিক সংগঠনের ইতিহাসে প্রায় বিরল বললেও অত্যুক্তি হয় না। ইতিমধ্যে স্বউদ্যমে তৈরি করে ফেলেছেন হকার বাজার নামে একটা ব্লকচেন নির্ভর ই-কমার্স প্লাটফর্ম, কয়েকজন বাঙালি যুবকের উদ্যোগে, ডিজিটাল কর্পোরেটদের পাল্লা দেবার প্রতিস্পর্ধায়। হকার সংগ্রাম কমিটির সহযোগী সংগঠন ক্লিকচেনের যুবা কর্তা অয়ন হাজরা জানালেন, তাঁরা যে ওয়েবসাইটটা বানিয়েছেন সেটা হকারদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা মাথায় রেখে। শুধু হকারদের তৈরি খাদ্য বাড়িবাড়ি পৌঁছে দেওয়াই নয়, সফটওয়ারকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যাতে অন্যান্য পণ্যও হকারেরা বিক্রি করতে পারেন। তাই হকারেরা জোট বাঁধছেন চাষিদের সঙ্গে যাতে হকার বাজার ওয়েবসাইট নির্ভর করে সুলভ মূল্যে দেশিয় প্রথায় চাষ হওয়া নানা রকম সব্জি বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে পারেন।
দিগম্বরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সঙ্গে হকার দল গিয়ে কথা বলেছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় এই পঞ্চায়েতের সহ-প্রধান রবীন্দ্রনাথ বেরা জানালেন, ‘পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে বড়ভাবে চাষের উদ্যোগ নিচ্ছি। ইতিমধ্যে শক্তিমান ঘোষের নেতৃত্বে দুবার হকার নেতৃত্বের একটা বড় দল গিয়ে চাষিদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। আগামী দিনে কীভাবে এটাকে যৌথ আন্দোলনে রূপান্তরিত করা যায় সে বিষয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করব’। শক্তিমান জানালেন ‘হকাররা আজ রিক্ত, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এই নতুন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তৈরি, আমরা পাল্টা রণনীতি তৈরি করছি। কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করেছি হকারদের ১০ হাজার টাকা ঋণ দিতে। এই ঋণ শোধ করলে দ্বিগুণ অর্থ ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে’। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ৫০০০ কোটি টাকা নিয়ে হকারদের ঋণ দিতে প্রস্তুত। এই বিষয়টা নিয়েও ভবিষ্যতে লিখতে হবে, কেন হকারেরা নীরব মোদী নন, সেটা প্রমাণ করার জন্যে।
হকারেরা উদ্ভাবনী ক্ষমতায় অন্যদের টেক্কা দিতে প্রস্তুত। বড় পুঁজি নির্ভর ব্যবস্থায় পাল্টা লড়াই দিতে হকারেরা নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় কতটা সমর্থ হবেন বলা মুশকিল, এই উদ্যমে তারা শেষ অবধি কর্পোরেটদের সাপ্লাইচেনে পরিণত হবেন কী না সেসব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সমীচীন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমরা যেন মাথায় রাখি, বঙ্গভাগের পর বছরের পর বছর ভূমিভাগের ব্যথা সহ্য করে বাংলার নানান অঞ্চল উদ্বাস্তুদের আত্মীকরণের লড়াই চালাচ্ছিল, সে সময় বিপুল সংখ্যক প্রায় সব হারিয়ে আসা মানুষ পথকে বেছে নিয়েছিলেন জীবিকার পাথেয় হিসেবে। কলকাতা, অন্যান্য অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল শহুরে নিম্নবিত্তদের জন্যে বিপুল স্বাভাবিক বাজার এবং ক্রমশ কলকাতার কপালে উঠেছিল শস্তাতম শহরের তকমা। ৭০ বছর আগে উদ্বাস্তুরা কলকাতার যে সব অঞ্চলে বাজার/বসতি সাজিয়ে বসেছিলেন, সেই সব অঞ্চল আজকে গুরুত্বপূর্ণতম বাজার/বসতি এলাকায় পরিগণিত।
আরও পড়ুন, উন্নয়নের ভুগোল ও করোনা সংক্রমণ
সেরিবা-সেরিবানদের উত্তরাধিকারী হকারেরা মার খেয়েও পাল্টা লড়াই দিতে জানেন। নোট বাতিল, লকডাউনের জোড়া ফলায় বিদ্ধ হকারেরা বঙ্গভাগের পরের পূর্বজদের মত পাল্টা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কী না সময় বলবে, কিন্তু তারা পড়ে পড়ে মার খেতে প্রস্তুত নন, পাল্টা দেওয়ার জন্যে তৈরি, ওয়েবসাইট এবং বন্ধুসম পেশাদারদের দুর্দশায় উদ্ধার করে বন্ধু বানানো হকারেরা তাই জোট বাঁধছেন। জোট যার মুলুক তার নতুন এই আপ্তবাক্য হকারেরা হৃদয় দিয়ে জানেন।
বিশ্বেন্দুদা, এই লেখায় পাঠকের ফিডব্যাক কি আপনার কাছে পৌঁছচ্ছে? কিংবা আপনি কি তার উত্তর দেওয়ার মতো জায়গায় সড়গড় হয়েছেন? যদি দুটি ক্ষেত্রেরই উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে বলব গুরুর এই বিস্তীর্ণ চারণভূমিতে আসুন আমরা দোঁহে মিলে উপনিবেশ-বিরোধী তাঁবু খাটিয়ে ফেলি। দেখবেন, এবং দেখে আনন্দ পাবেন, আমাদের তাঁবুতে লোক ক্রমে বাড়িতেছে। আপনি সম্ভবত এই চারণভূমিটি এক্সপ্লোর করে উঠতে পারেননি। এটাকে কাজে লাগান অচিরেই।
খুব জরুরী বিষয়, ট্রেন বন্ধ হয়ে হাজার হাজার রেল হকার কিভাবে বেঁচে আছেন তারাই জানেন, ট্রেন চালু হলে,এই সুযোগে স্টেশনে ও ট্রেনে হকারদের ওপর কিছু বিধি নিষেধ চাপিয়ে, রুটি রুজি মারার চেষ্টা করবে বলেই মনে হ।।
ভালো লাগলো। শুধু বিরোধিতা নয় - সঙ্গে অন্যভাবে ভাবাটাও রয়েছে বলে আরো বেশি করে।
আশিস বাবুর সাথে একমত - ট্রেন চালু হলে অন্য কায়দা ভাবা হবে স্বল্প পুঁজির লোকদের রুটি-রুজি মারবার। প্লাটফর্মে বসা চালু নিয়মেই বারণ, কাজেই আরপিএফকে লেলানো যেতেই পারে।