কেশব সেনের ব্রাহ্ম সমাজ
প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সময় থেকেই খ্রিস্ট মিশনারিরা একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম সমাজের গতিপ্রকৃতির দিকে গভীর নজর রেখেছিলেন। ব্রাহ্ম পরিমণ্ডলের যারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন, তাঁদের আদি ব্রাহ্মরা, বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথ উদ্যোগী হয়ে ১৮৫৬ থেকে ব্রাহ্মসমাজ থেকে নির্বাসন দেন। আদি সমাজের বহু যুবাকে খ্রিস্ট মিশনারিরা প্রলুব্ধ করলে তাদেরও সমাজে আসা নিষিদ্ধ হয়। ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে বিভেদ শুরু হয়। ১৮৬৭তে আদি ধর্ম ক্রমশ জাতীয়তাবাদী ঝোঁক বাড়তে থাকে। আদি সমাজ থেকে বহিষ্কৃত খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা বাংলার বাইরে থেকে আদি সমাজের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে থাকেন। অন্যদিকের দলের মাথা মিশনারিদের আগ্রাসী মনোভাবে বিরুদ্ধ যুবা পড়ুয়াদের বেদ অধ্যয়ন করতে বেনারসে পাঠানো হয়। তবে ব্রাহ্মসমাজে যে সব কিছু ঠিক ছিল না – সেটা লাল বিহারী দে-র বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, “I myself was a Brahmo though not in name yet in reality but I enjoyed no peace of mind. I could be sure He would pardon my sins”। এই বক্তব্য মিশনারীরা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
১৮৬৪র এপ্রিলে বাগ্মী কেশবচন্দ্র সেন সমাজে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করতে লিখলেন দ্য ব্রাহ্মসমাজ ভিন্ডিকেটেড। ক্রমশ বোঝা যাচ্ছিল কেশবচন্দ্র ইউনিটেরিয় মিশনারি চার্লস ডলের প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন। তাঁর এই পরিবর্তনে ঘনিষ্টভাবে নজরদারি চালাচ্ছিল সরকার এবং মিশনারিরাও। প্রফেসর ওমান লিখছেন, “From the time of his secession from the parent Society, Keshub by his writings and public lectures enlisted the sympathies of the Viceroy, Sir John Lawrence, who took a deep interest in the work of the native reformer, particularly as Keshub had spoken publicly of Christ in terms which seemed to justify the belief that he was Christian in all but open profession of the faith”। অনেকেরই ধারণা হচ্ছিল কেশব খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলেও হতে হতে পারেন।
১৮৭০এ তাঁর লন্ডনযাত্রা ঔপনিবেশিক কলকাতা এবং লন্ডনের সমাজে বেশ আলোড়ন তুলল। ওয়াল্টার হাউটন লিখছেন পশ্চিমের সমাজে যে বস্তুবাদের দিকে ঝোঁক তৈরি হচ্ছে সেটা কেশবকে দিয়ে নিউট্রালাইজ করা সম্ভব (“Keshub may be the person to restore equilibrium”)। অনেকেই মনে করছিলেন কেশব উপনিবেশে মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের কাজে সহায়ক হয়ে উঠবেন (“Hindu genius might give to the teaching of the Bible an interpretation so fresh that it might attain a new force for our own England, where, checked by the rapidly growing importance of the industrial arts and of physical science, the influence of the Christian faith seems to have reached a standstill, if it has not begun in some degree to recede. While Keshub was in England many missionary organizations expressed their hope that he would prove to be a valuable ally in moving his countrymen along the road towards Christianity”)। সাম্রাজ্যের মানুষেরা যে কেশবচন্দ্রকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে চায়, সেটা কোনও গোপন এজেন্ডা ছিল না। কেশবের খ্রিস্টধর্মে মতি দেখে ম্যাক্সমুলার প্রকাশ্যে বলেছিলেন, একমাত্র বিশপ কটন কেশবচন্দ্রকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে পারেন। কেশবচন্দ্রকে যে সাম্রাজ্য উপনিবেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রজা হিসেবে গণ্য করছে, সেই ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হয়ে যায় সাম্রাজ্য-কর্ত্রী ভিক্টোরিয়া তাঁকে দু’টি বই উপহার দেওয়ায়। সাম্রাজ্য তাঁকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ায় তিনি ৪০টা ব্রিটিশ শহর এবং আমেরিকা থেকে বক্তৃতা দেওয়ার ডাক পাবেন।
কেশবচন্দ্রের ছায়াসঙ্গী প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মনে করতেন, লন্ডনে তার নেতাকে নিয়ে নায়ক পুজো করেছে। ১৮৭০এর ৪ জুন সানডে রিভিউ কেশবচন্দ্রের খ্রিস্টধর্ম অনুরাগ বিষয়ে মন্তব্য করে লিখল, “Keshub Chunder Sen is an example of what Western, and especially English, civilization is making of native gentlemen in Bengal. He has thrown himself into the study of English religion and English books till he has thoroughly made himself at home with the ideas and general ways of thinking at least of our generation ... He is earnest in announcing his religious views, and his earnestness is of the English rather than the Oriental type”। পাঞ্জাবে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের নায়ক স্যর লরেন্স লন্ডনে কেশবচন্দ্রের সঙ্গী ছিলেন। তিনি মনে করতেন কেশব সাম্রাজ্যের পক্ষে দ্বৈত ভূমিকা পালন করছেন, এক দিকে তিনি সাম্রাজ্যের দায়িত্ব মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অন্যদিকে ভারতবর্ষীয়রা কীভাবে সাম্রাজ্যের সঙ্গী হয়ে উপকৃত হতে পারে সেটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন।
ম্যাক্সমুলার বহুকাল থেকেই বাংলার ধর্ম আন্দোলনের নেতাদের বিষয়ে খোলামেলা মত প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। রামমোহন সম্বন্ধে তার বীতরাগ যথেষ্ট যে ছিল সেটা প্রমাণ হয় রামমোহন সম্বন্ধে এই উক্তিতে – “men of the type of Rammohun Roy”। তিনি বললেন, খ্রিস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ে এইসব মানুষের মনে সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়, এমনকি রামমোহনেরও নয় (“These men Could not, and did not, shut their eyes to the superiority of Christianity from an ethical point of view. They despised in their heart the idols, as worshipped by the vulgar and had long learnt to doubt the efficacy of their sacrifices”)। দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রে যোগাযোগ থাকলেও, তাঁর সম্বন্ধে তিনি বললেন, “So far I can judge, Debendranath and his friends were averse to unnecessary innovations, and afraid of anything likely to wound the national feelings of the great mass of the people”।
কিন্তু তিনি কেশবের বিষয়ে মুক্তকচ্ছ। তাঁর ধারণা ছিল, কেশবের হাত দিয়েই ভারতবর্ষে খ্রিস্টধর্মের আদত গোড়াপত্তন ঘটবে। ১৮৬৬তে কেশবের ‘Jesus Christ: Europe and Asia’ বক্তৃতার পরে মুলার মন্তব্য করলেন, “... native and European felt convinced that Keshub Chandra Sen would openly embrace Christianity”। ব্রাহ্মসমাজ সম্বন্ধে মুলারের ধারণা ছিল, “A most active missionary organization was constituted and the preachers were sent to travel from one part of the country to the other”। ১৮৭০এ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি মুলারকে পাঠালেন কলকাতার বিশপ ড মিলান। মুলারের ধারণা ছিল, সত্যেন্দ্রনাথ দেশে বেদের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম প্রসারে সহায়ক হবেন। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের খ্রিস্টধর্ম বিষয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে মুলার ব্যর্থ হন।
কেশব এবং আর্য আগ্রাসন তত্ত্ব
কেশবচন্দ্র ‘Jesus Christ: Europe and Asia’ বক্তৃতায় বললেন, যিশু যেহেতু এশিয়াজাত, তাই এশিয়রা একমাত্র বাইবেলের মর্মার্থ বুঝতে পারবে, “And is it not true that an Asiatic can read the imageries and allegories of the Gospel, and its descriptions of natural sceneries, of customs and manners, with greater interest, and a fuller perception of their force and beauty, than Europeans?” কেশবের পক্ষে ব্রিটিশ সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার কোনও দ্বিধা ছিল না, তিনি সাম্রাজ্যের সামাজিক এবং নৈতিক আশীর্বাদে আস্থা রাখতেন। এশিয় খ্রিস্ট সম্বন্ধে কেশব বললেন, “They deliberately and voluntarily cut themselves off from native society as soon as they are baptized, and, as an inevitable consequence, come to contract a sort of repugnance to everything Oriental, and an enthusiastic admiration for everything European. (Hear, hear.) They seem to be ashamed of their country and their nationality. They forget that Christ, their master, was an Asiatic, and that it is not necessary in following him to make themselves alien to their country or race.”
শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনারিদের ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া খুব বিশদে ব্রাহ্ম সমাজের খবর ছাপত এবং ব্রিটেনে ব্রাহ্ম আন্দোলন জানানোর সূত্র ছিল এই পত্রিকা। ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া থেকে ব্রাহ্মদের সংবাদ ছাপত পল মল গেজেট আর বার্মিংহাত ডেলি পোস্ট। ১৮৭০ অবদি তারা কেশবচন্দ্রের কাজকর্মের সমর্থক ছিল। কেশবচন্দ্রের “Primitive Faith and Modern Speculations” সমর্থন করে, কারণ “a great key principle of religion which cannot fail to spread, and spread for good”।
মুলার, কেশবচন্দ্র এবং আর্যতত্ত্ব
এর আগে আমরা দেখেছি মুলার অন্যান্য ব্রাহ্ম নেতা সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ হলেও কেশবচন্দ্র বিষয়ে বেতর। মুলারকে রাজা রাধাকান্ত দেব এবং বালগঙ্গাধর তিলক ভট্ট মোক্ষমুলার নাম দিয়েছিলেন। রাধাকান্তের সঙ্গে মুলার চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখতেন। মুলার বার বার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, “why then should there be no Christian Vedantists?” উইফ্রেড কান্টওয়েল স্মিথ চমৎকার উত্তর দিচ্ছেন, “turning the Hindu Veda into a written book is an entrancing instance of nineteenth-century Western cultural imperialism, here quietly imposing the Western sense of ‘Scripture’ ”। মুলার চাইতেন হিন্দু ধর্ম আর খ্রিস্টধর্ম কাছাকাছি আসুক (“It is most interesting to watch the compromise made between Hinduism and Islam four hundred years ago and to compare it with the compromise between Hinduism and Christianity that is now so eloquently advocated by the followers of Rammohun Roy and Keshub Chunder Sen”)। খ্রিস্টিয় চার্চে কেশবচন্দ্রের আনুগত্য নিয়ে তিনি লিখলেন, “Woe unto us, if I ever conceived the project of setting up a movement against the Church of Christ! Perish these lips if they utter a word of rebellion against Jesus”। কেশবও খ্রিস্টধর্ম বিষয়ে গভীরভাবে উৎসাহী ছিলেন। ‘নিউ ডিসপেনসন’-এ তাঁর মত, অ্যাংলিকান চার্চের প্রার্থনা বইয়ের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। তিনি নিউ ডিসপেনসনে ‘আর্য’ শব্দ স্পষ্টভাবে লিখলেন (“the Sacred Laws of the Aryans of the New Dispensation”)। তিনি যে আর্য – ভাষা নয় – জাতি হিসেবে দেখছেন, এটা স্পষ্ট। তিনি আরও বললেন, “It is only the national law of the Aryans of the New Church in India”। এই আর্যতত্ত্ব ভারত, ব্রিটেন এবং বেদকে একসাথে মেলাল। তিনি এই পবিত্র আইনের সঙ্গে মেলালেন ঋগ্বেদের সঙ্গে জর্ডন নদীর তীরে ভগবানের পুত্রের ব্যাপ্টিজমের আইনগুলোকে।
ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের আর্যতত্ত্ব পৃষ্ঠপোষণা
ভিক্টোরিয় সাম্রাজ্য যেমন প্রাচীন বিশ্বাস দেখেছে, তেমনি বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদেও ছিল; সে আঞ্চলিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক কারখানা নির্ভর যুদ্ধপুঁজিবাদও তার সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটিয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় আধিপত্যকে ন্যায্যতা প্রমাণের শক্তিশালী তত্ত্ব প্রচার প্রসার ব্রিটিশ অভিজাতদের কাছে বিশেষ করে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কাছে অজানা বিষয় ছিল না। উদীয়মান জ্ঞানচর্চা হিসেবে নানান ধরণের জাত, ভাষা, কৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব শীঘ্রই আত্মস্থ করে ফেলত রাজতন্ত্র। এই কাজে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে থেকে ক্ষমতাকেন্দ্রে থাকা মানুষজনের জাতিবাদী ধারণা তৈরি করার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মুলার।
ড্যালিয়েল লেরয় ‘Raciological Thought in Victorian Culture A Study in Imperial Dissemination’ গবেষণায় বলছেন, কীভাবে মুলারের মত ভাষাতাত্ত্বিকদের থেকে ভিক্টোরিয় সাম্রাজ্য নানান বুলি শিখছে (“The new imperial culture in speeches, addresses, and myriad public utterances, described itself with a vocabulary learned from the philologists, and the ‘Britons’ and ‘Anglo-Saxon’ which emerged from the antiquarian studies of Max Müller”)। ভিক্টোরিয় যুগে রাজতন্ত্রের কাছাকাছি থাকা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক ছিলেন ম্যাক্সমুলার। ১৮৫৬র ২৫ আগস্ট, অর্থাৎ সিপাহি যুদ্ধের এক বছর আগে ব্যারন ভন বুনসেন লিখছেন, “After the last annexation the territorial conquest of India ceases – what follows next is the struggle in the realm of religion and of spirit, in which, of course, centre the interests of the nations. India is much riper for Christianity than Rome or Greece were at the time of St. Paul. Dhulip Singh is much at Court, and is evidently destined to play a political part in India. I wish I could get in touch with him in some quite natural way. Could it be managed with the help of Prince Albert or would you help me to it?” মাথায় রাখা দরকার ব্রিটিশ রাজদরবারে এবং ভিক্টোরিয়ার স্বামী যুবরাজ এলবার্টের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন প্রুশিয় রাজদূত ভন বুনসেন। বুনসেনের প্রটিজি হলেন মুলার। তাঁর মাধ্যমেই মুলারের রাজসকাশ গমন এবং ইচ্ছাপূরণ।
১৮৬৪র চিঠিতে আমরা ইঙ্গিত পাচ্ছি রাজদরবারে মূলারের দ্রুত উত্থানের। তিনি লিখছেন, রাণী দয়া করে জানিয়েছেন তিনি আমার বক্তৃতার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন (“The Queen was very kind, said she was looking forward to the lectures”)। রাণী তাঁর স্বামীর সঙ্গে মুলারের ভাষার বিজ্ঞান বিষয়ে বক্তৃতা শুনতে আসতেন; মুলার লিখছেন, “She listened very attentively, and did not knit at all, though her work was brought”। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র, ভিক্টোরিয়া এবং এলবার্টের অসবোর্ন প্রাসাদে মুলারের বক্তৃতা আয়োজন করে; সকালে তিনি রাজকুমার আর্থার এবং রাণীর শল্য চিকিৎসক স্যর জেমস ক্লার্কের সামনে যে বক্তৃতা করেন, তার শেষ স্তবকটি ছিল, “When the last two volumes of Veda are published we shall have saved from destruction a work, older than Iliad, older than any other literary document of that noble race of mankind to which the greatest nations in the world’s history have belonged – a race which after receiving from a Semitic race, from the Jews, its best treasure, its religion, the religion of the Old and New testaments, is now with the English in the van, carrying on slowly but irresistibly the conquest of the world by means of commerce, colonization, education and conversion”। এইটুকু বক্তব্যের মধ্যেই মুলারের কাজের সংক্ষিপ্তসার, সাম্রাজ্যের পক্ষে আর্যতত্ত্বের দরকারি শাঁসটুকু স্পষ্ট করে দেন। এই সংক্ষিপ্তসারে তিনি উচ্চাশার সিঁড়ির রাস্তা স্পষ্ট হয় – এই অংশে ব্রিটিশ জাতিবাদী শ্রেষ্ঠত্ব আছে, উপনিবেশে শাসনের বৈধতা আছে এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে ইলিয়াডের থেকেও পুরোনো কোনও কিছুর সঙ্গে জোড়ার বার্তা আছে – যেটা ইওরোপিয় প্রাচ্যবাদী রোমান্টিসিজমের মূল কথা। মাথায় রাখতে হবে মুলার একাই রাজতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ ছিলেন না, ভিক্টোরিয়ার চ্যাপলেইন ধ্রুপদী হিব্রু পণ্ডিত যোসেফ বারবার লাইটফুটও রাজতন্ত্রের কাছাকাছি ছিলেন। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭৫এর মধ্যে তিনি জাতিবাদ নির্ভর ভাষাবিদ্যাগত এবং বুৎপত্তিগত প্রমাণ সহযোগে নিউ টেস্টামেন্টের বহু ভাষ্য লিখেছেন।
১৮৭০এ যখন কেশবচন্দ্র ইংলন্ডে পৌঁছচ্ছেন, তখন তার জন্যে আর্যতত্ত্ব প্রচারের মঞ্চ তৈরি হয়েই ছিল। মুলারের মত পণ্ডিতপদের থেকে রাজপরিবার যে জ্ঞান আহরণ করেছিল, কেশবচন্দ্র সেই জ্ঞানচর্চা লাইনে তাঁর শিক্ষকসম মানুষটির কথাগুলোই নতুন করে বলবেন।
ব্রাহ্ম সমাজের রাজনীতিকরণ: সাম্রাজ্যের হাতিয়ার
সাম্রাজ্যের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে প্রাচীন শাস্ত্রসমূহের আবিষ্কার এবং আর্যতত্ত্বকে হাতিয়ার করল ঔপনিবেশিক শাসকেরা। ম্যাক্সমুলার এবং কেশবচন্দ্রের ভাব আদানপ্রদানে, একই সঙ্গে মিশনারিদের অত্যধিক উৎসাহে আর্যতত্ত্ব প্রায় সবস্তরে মান্যতা পেল। কার্জন ভাষায় ‘সাম্রাজ্যের প্রয়োজনীয় হাতিয়ার’ হয়ে উঠল আর্যতত্ত্ব।
কেশবের জন্মের বহু আগে ১৮০৪এ আলেকজান্ডার টড লিখেছিলেন, “the translation of the best works extant in the Sanskrit into the popular language of India would promote the extension of science and civilization”। কিন্তু শাসিতের ইতিহাস, কৃষ্টির বাখান সাম্রাজ্যের স্বার্থ অনুযায়ী উপনিবেশের প্রজাদের উপযোগী করে উপস্থিত করা প্রয়োজন হয়ে উঠছিল গ্রামগঞ্জের বিপ্লবমুখী জনগণের প্রতিষেধক হিসেবে। ১৮৫৭র লড়াই শাসককে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শুধু হাতে গোনা জমিদার বা রাজাকে পাশে টেনে শাসনের দিন শেষ, আরও বেশি ইংরেজি শিক্ষিত অনুগত ভদ্রবিত্ত সাম্রাজ্য চালাতে প্রয়োজন। সিপাহি যুদ্ধের তিন বছর আগে চার্লস ট্রেভলিয়ন ভারতবর্ষ এবং ইওরোপের ঘটমান বৈপ্লবিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে ম্যাক্সমুলারের থেকে প্রাচ্য ভাষা বিষয়ে নতুন গবেষণার প্রস্তাব আহ্বান করেন; মুলার তাঁকে নিরাশ করেননি। মুলারের প্রস্তাবনা থেকে যেমন সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ শাসকেরা সরাসরি পাঠ নিচ্ছেন, তেমনি খ্রিস্ট মিশনারিরাও মুলারের প্রস্তাব রূপায়নে কোমর বাঁধলেন।
এই প্রচেষ্টার প্রথম উদ্যম হল ভারতবর্ষকে সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা থেকে বার করে এনে মুঘল দরবারের অনুকরণে ১৮৭৬এ ভিক্টোরিয়া ভারতের সাম্রাজ্ঞী হিসেবে সিংহাসনে আরোহন এবং পরের বছর দিল্লি দরবার আয়োজন করা। মেরিডিথ বর্থউইক দেখাচ্ছেন রাণী এবং সামগ্রিকভাবে সাম্রাজ্যের প্রতি কেশবচন্দ্রের প্রশ্নহীন আনুগত্য সে সময়ের সার্বিকভাবে শিক্ষিত প্রজাদের সাম্রাজ্য অনুগামী মানসিকতার প্রতিনিধিস্বরূপ। স্বাভাবিকভাবে কেশবচন্দ্র উপনিবেশের শাসক ব্রিটিশ সমাজ, বিশেষত শাসকবর্গের কাছে প্রিয় হয়ে উঠছিলেন (“It increased his influence with them too, as having unmistakably established his loyalty; he could then go on to criticize the British without being accused of ingratitude”)। ফলে মাঝেমধ্যে তাঁর ব্রিটিশ শাসন নিয়ে বেসুরো কথাবার্তা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা হত। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিষয়ে তাঁর মত কিছুটা পরিবর্তিত হলেও আর্যতত্ত্বে তার আস্থা বিন্দুমাত্র টলেনি, কেশবচন্দ্র বারবার প্রকাশ্যে আর্যতত্ত্বের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
১৮৭৭। সিপাহি যুদ্ধের দুদশক পেরিয়েছে। রাজ্যহারা শিখ আর অনুগত গোর্খারা তখনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সহায়। কেশবচন্দ্র প্রকাশ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানীতে দাঁড়িয়ে রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। শিক্ষিত দেশিয় প্রাজাদের রাণীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশে আহ্বান জানিয়ে বললেন, ব্রিটিশেরা তোমাদের উদ্ধার করতেই এসেছে (“British government that came to your rescue, as God’s ambassador, when your country was sunk in ignorance and superstition and hopeless jejuneness, and has since lifted you to your present high position…”)। এটাই মুলারিয় আর্যতত্ত্বের অন্যতম উপপাদ্য।
তিনি ব্রিটিশদের হয়ে দেশিয় প্রজাদের প্রতি যে আহ্বান পেশ করেছেন, সেটা ছিল চরম বাস্তব। ব্রিটিশ শাসনের আগে শাসকেরা দেশের কারিগর উৎপাদন ব্যবস্থা বদলাবার চিন্তা করে নি। কারণ তারা শোষক হলেও লুঠেরা ছিল না। সে সময় ভদ্রবিত্তরা ক্ষমতায় থাকলেও তারা ছোটলোকদের নিয়ন্ত্রণ করার মত ক্ষমতাবান ছিল না, হাতে ছোটলোকেদের মাথা কাটার যোগ্যতা, ক্ষমতা অর্জন করেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম কর্ণধার উইলিয়াম জোনসের উদ্যমে ব্রাহ্মণ এবং ভদ্রলোকেদের পুনর্বাসন হল এবং এর প্রতিদানে ভদ্রবিত্তরা অতিআগ্রহে দেশিয় উৎপাদন কাঠামো ধ্বংসে ব্রিটিশ সঙ্গী হয়। কেশবচন্দ্র বললেন, এই প্রতিদানটা ভদ্রবিত্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে দিক, সাম্রাজ্য/রাণীর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে, কারণ ব্রিটিশ শাসনে ভদ্রবিত্তের মুক্তি হয়েছে, তার আগে ঘোর অমানিশা ছিল (“India in her present fallen condition seems destined to sit at the feet of England for many long years to learn Western art and science. Thus while we learn modern science from England, England learns ancient wisdom from India. তিনি বললেন Gentlemen, in the advent of the English nation in India we see a re-union of parted cousins, the descendants of two different families of the ancient Aryan race”)। ‘বিছড়ে হুয়ে ভাই’ বা ‘parted cousins’ শব্দবন্ধ আদতে সাম্রাজ্য লুঠের কাজে, সাম্রাজ্য রক্ষায় নানান বিদ্রোহ/স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করার কাজে নিয়োজিত শিক্ষিত ভদ্রলোকেদের প্রতি সাম্রাজ্য আনুগত্য আহ্বানের প্রকাশভঙ্গী।
মাথায় রাখা দরকার, কেশবচন্দ্র তাঁর মত করে আর্যতত্ত্বকে দুমড়েমুচড়ে উপস্থিত করলেও মুলার রুষ্ট হননি, বরং তিনি পরের দিকের বক্তৃতায় কেশবের অবস্থানকে মান্যতা দিয়েছেন। আগেই বলেছি রাজপরিবারের এবং শাসকদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়েও যখন মুলার চাহিদামত চাকরি পান না, তাকে অক্সফোর্ডের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপনার পিটুলিগোলা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়, তিনি পূর্বের অবস্থান সংশোধন করে আর্যকে জাতি হিসেবে যতটা মান্যতা দিয়েছেন, তার অনেক বেশি মান্যতা দিলেন আর্যতত্ত্বের জাতিবাদিতার নখ দাঁত উপড়ে ফেলে ভাষা হিসেবে। ১৮৮৩তে রামমোহন রায়ের ওপর বক্তৃতা দিতে গিয়ে মুলার বললেন, “Ram Mohan Roy was an Aryan belonging to the south-eastern branch of the Aryan race and he spoke an Aryan language, the Bengali. . . . We recognize in Ram Mohan Roy’s visit to England the meeting again of the two great branches of the Aryan race, after they had been separated so long that they lost all recollection of their common origin, common language and common faith”। কেশবচন্দ্র এবং মুলার এই বিষয়ে একমত হয়ে ‘ভাষাগত’ শাখার উৎসকে ‘সাধারণ বিশ্বাস’ পর্যন্ত প্রসারিত করার ভাবনা ভেবেছেন।
১৮৮০তে গ্ল্যাডস্টোন ক্ষমতায় ফিরে রিপনকে ভাইসরয় মনোনীত করায় ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে শহুরে অভিজাত ভদ্রবিত্তের অধিকার এবং দায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে নতুন উদারবাদী পরিকল্পনার উদ্যমের যুগ এলেও, উপনিবেশে রিপনের উদারবাদ প্রচলনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ সিপাহি যুদ্ধের পরের যুগে পিতৃতন্ত্রের ঝোড়ো হাওয়া ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল (“a stormy interlude in the era of paternalism which had swept over India since the Mutiny”)।
ক্রমশ...
তথ্যসূত্র:
Banerjee, SC (2016) Brahmo Samaj as an Actor in the Dissemination of Aryan Invasion Theory (AIT) in India.
International Journal of Asian Studies 13:19–59