বাঙালির নববর্ষ নিয়ে অদ্ভুত কিছু বিতর্ক উত্থাপন করা হয়েছে। কে এই নববর্ষের উদ্গাতা—আকবর, নাকি শশাঙ্ক? এর পুরোটাই চলছে, প্রায় হাওয়ায় হাওয়ায়—হোয়াটস-অ্যাপ প্রচার যেমন হয়। তাই ঝট করে একবার দেখে নেওয়া যাক, আইন-ই-আকবরি-তে এই নিয়ে কী লেখা আছে।
১। তারিখ, ক্যালেন্ডার।
আইন-ই-আকবরির দ্বিতীয় খণ্ডের একদম শুরুতেই সারা পৃথিবীর ক্যালেন্ডার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন আবুল ফজল। খ্রিশ্চান, হিজরি (হিজরা), হিন্দু, চৈনিক, ইহুদি, ইত্যাদি-প্রভৃতি। সৌরবর্ষ এবং চান্দ্রবর্ষ নিয়েও বিস্তারিত এবং ভয়ানক খুঁটিনাটি আলোচনা আছে। সেসময়ের সর্বাধুনিক গণনাপদ্ধতি ছিলে মির্জা উলুগ বেগের—যিনি সৌরবর্ষের মাপকে সেকেন্ডের পর্যায়েও প্রায় নিখুঁত করে মেপে ফেলেছিলেন। তা নিয়েও আলোচনা আছে। যাঁরা জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহী, তাঁরা পড়ে দেখতে পারেন। কিন্তু এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হল হিজরি এবং হিন্দু মাপজোক। হিজরি সন—আবুল ফজল লিখেছেন—কৃত্রিম – চান্দ্রবৎসর এবং চান্দ্রমাস অনুযায়ী চলে। তার কী অসুবিধে—যা আমরা সবাই জানি—ফজলও জানতেন এবং লিপিবদ্ধ করেছেন। উল্টোদিকে হিন্দু ক্যালেন্ডার—ফজল লিখেছেন—চলে সৌরবর্ষের মাপে, কিন্তু মাসগুলো চান্দ্রমাস। তাতে হিসেবের সমস্যা হয় প্রচুর। কয়েকবছর অন্তর মাসগুলোকে একটু সরিয়ে আবার ঠিক জায়গায় আনতে হয়। (পদ্ধতিটা অনেকটা এখনকার ‘মল মাস’-এর মতো)।
এই দুটো পদ্ধতিরই সমস্যা নিয়ে আকবর ওয়াকিবহাল ছিলেন। ফলে তিনি নতুন একটা পদ্ধতি চালু করেন। সেটা সম্পূর্ণ সৌরমাস নির্ভর। সেটারই নাম তারিখ-ই-ইলাহি। ফজল যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘পবিত্র যুগ’ (ইংরিজি অনুবাদে ‘ডিভাইন এরা’) বলে উল্লেখ করেছেন জিনিসটাকে।
২। তারিখ-ই-ইলাহি।
ক। এর শুরুর বছর, আকবরের রাজ্যাভিষেকের বছর। হিজরি ৯৬৩। যদিও জিনিসটা চালু হয় কয়েক বছর পরে। হিজরি ৯৯২।
খ। জিনিসটা ছিল বিচ্ছিরিরকম ধর্মনিরপেক্ষ। আবুল ফজলের জবানি এরকম: “আকবর হিজরি সন অপছন্দ করতেন। যদিও সেটার খুবই গুরুত্ব ছিল, কিন্তু কিছু স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন মূর্খ লোক ভাবত, যে, ধর্মের সঙ্গে, কালের মাপের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে, তাদের জন্য।” (হুবহু অনুবাদ নয়। ইংরিজি অনুবাদে আসলটা পড়তে হলে দ্বিতীয় খণ্ডের ৩০ পাতা দেখুন)।
গ। নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিলেন আমির ফতেউল্লা সিরাজি। তিনি মির্জা উলুগ বেগের আধুনিকতম মাপজোকের উপর ভিত্তি করে নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। শুরুর বছর ছিল আকবরের সিংহাসনারোহণের বছর।
ঘ। এই নতুন মাপজোকে কিছু কি আমূল বদলে দেওয়া হয়? না। পুরোনো মাসের নানাপ্রকার নাম, একই রাখা হয়। কেবল মাপজোকটা চান্দ্রবৎসর বা চান্দ্রমাস থেকে পুরোপুরি সৌরবৎসর এবং সৌরমাসে নিয়ে চলে আসা হয়। হিসেব মেলানোর জন্য নানা মাসে দিনের সংখ্যা বদলে দেওয়া হয়। আকবর নতুন কোনো মাস বা নাম চালু করেননি। শুধু পরিমাপের পদ্ধতিটা বদলায়। তারিখ-ই-ইলাহি এইটুকুই।
(এই পুরোটাই পাবেন আইন-ই-আকবরির ইংরিজি অনুবাদে দ্বিতীয় খণ্ডের ৩০ নম্বর পাতায়, যা নিচে দেওয়া হল)।
৩। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ - এইসব মাস কোথা থেকে এল?
আগেই বলা হয়েছে, আকবর কোনো নতুন মাস চালু করেননি। এই মাসগুলো—ফার্সি বা খ্রিস্টান মাসের মতোই—বহুযুগ আগে থেকেই ছিল। সেটা জানার জন্য আইন-ই-আকবরি পড়ার দরকার পড়ে না। কালিদাস এর অনেক আগেই লিখে গেছেন, ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’। আকবর বা সিরাজি যা করেন, তা হল, মাপজোকগুলো বদলে দেন। নাম অপরিবর্তিত থাকে, কেবল গণনাপদ্ধতি বদলায়। এই নতুন গণনাপদ্ধতিতে কোন পদ্ধতির কোন মাসের সঙ্গে কোন মাস পাশাপাশি বসবে—তার বিস্তারিত হিসেবও তাঁরা করেন। ফজল, এর একটা সংক্ষিপ্ত সারণী রেখেছেন, আইন-ই-আকবরি তে। সেটা নিচে দেওয়া হল। লক্ষ্য করবেন, এই সারণীতে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সবই আছে। ফলে, তারিখ-ই-ইলাহি একটি নতুন গণনাপদ্ধতি। নতুন নামকরণ-পদ্ধতি নয়। এই জন্যই, তারিখ-ই-ইলাহির কোনো মাসের নাম আলাদা করে টিকে নেই। কিন্তু নববর্ষ-সমেত গণণাপদ্ধতিটা এখনও হুবহু চালু।
৪। তারিখ-ই-ইলাহি - প্রশাসনে কীভাবে চালু করা হয়েছিল, এবং কীভাবে ব্যবহার করা হত?
এই পুরো ব্যাপারটাই রাজ্যশাসন, রাজস্ব-আদায়ের সঙ্গে জুড়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় প্রশাসনে কোতোয়ালের দায়িত্ব সম্পর্কে যে ফরমান জারি করা হয়, তা এই এরকম: নববর্ষ এবং অন্য উৎসবের দিন, কোতোয়াল সেই উৎসব পালন করবেন, বাকিদের পালন করতে উৎসাহ দেবেন। হিন্দু এবং ফার্সি পঞ্জিকারদের ইলাহি-যুগের পদ্ধতি মেনে নিতে নির্দেশ দেবেন। এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে মাসের নাম অপরিবর্তিত থাকবে।
এটাই, আকবরের সেই সমন্বয়ের নীতি। কাউকে কোনো নাম বদলাতে বলা হল না। কেবল গণনাপদ্ধতি বদলাতে বলা হল। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ, ইলাহি-যুগের আগে থেকে আজ অবধি আছে। এবং আকবরের বদলে দেওয়া গণনাপদ্ধতিও তার সঙ্গে মিশে গেছে অবলীলায়। চালু হয়েছে নতুন নববর্ষ। কোনো ধর্মযুদ্ধ ছাড়াই।
(আইন-ই-আকবরি, দ্বিতীয় খণ্ড - পাতা ৪৮)
৪। শুরুর বছর।
ইলাহি শুরুর বছর, নিঃসন্দেহে আকবরের রাজ্যাভিষেকের বছর। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, যে, কোনো নতুন নামকরণ আলাদা করে এই পদ্ধতিতে চালু করার তেমন চেষ্টা হয়নি। আবুল ফজল, তাঁর লেখাতে দু-ভাবেই এই নতুন গণনাপদ্ধতিকে বর্ণনা দিয়েছেন। কোথাও লিখেছেন, “পবিত্র যুগের ৪০তম বর্ষে”। কোথাও লিখেছেন, “পবিত্র যুগের ষষ্ঠ বর্ষ, যা চান্দ্রবৎসর ৯৬৮-র সঙ্গে চলে”। ফলে, আইন-ই-আকবরির সাক্ষ্য অনুযায়ী, ইলাহি-৬ বা নবচন্দ্রবর্ষ-৯৬৮, এই দু-রকমভাবেই বস্তুটা বলা যায়। আন্দাজ করা যায়, যেহেতু ফার্সি-মতে হিজরির সঙ্গে পরবর্তী সৌরবৎসর যোগ করে দিলে লোকের বুঝতে সুবিধে হয়, সেটা করা হয়ে থাকতেই পারে। আবার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠকে সেই হিসেবে নিয়ে নেওয়া হয়েছে, কঠিন ফারসি নাম বাদ দিয়ে। এরকম হয়ে থাকতেই পারে। হলে সেটা আকবরের ধর্মসমন্বয়ের নীতির সঙ্গে চমৎকার খাপও খায়। কিন্তু স্রেফ আইন-ই-আকবরি থেকে এটা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। অন্যান্য ফারসি নথিপত্র ঘাঁটা দরকার।
৫। উপসংহার।
তাহলে কী কী জানা যায় আইন-ই-আকবরি থেকে?
ক। ইলাহি গণনাপদ্ধতি, সারা ভারতে চালু করেন আকবর। সেটা আজও চালু।
খ। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি নাম—আকবর চালু করেননি। বহু আগে থেকেই ছিল।
গ। নববর্ষ উৎসব (নওরোজ) আকবরই চালু করেন।
ঘ। ইলাহি এবং হিজরির যোগফল—সঙ্গে হিন্দু মাস—এই খিচুড়ি ক্যালেন্ডার আকবরের সময় থেকে চালু হওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু আকবরি থেকে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না।
কিন্তু যেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব, সেটা হল, ১৪ই এপ্রিল নাগাদ যে নববর্ষ উদযাপন, সেটা ভারতবর্ষে চালু করেন আকবরই। তিনি যে উদ্যাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সে তো দেখাই যাচ্ছে। তার আগে, এই উদযাপন সম্ভব ছিল না। কারণ কোনো ক্যালেন্ডারেই বছরটা ওই জায়গায় শুরু হত না।
পুনশ্চ: যদিও এখানে অপ্রাসঙ্গিক, তবুও বলে রাখা উচিত, যে, ভারতের ভূগোল, হিন্দু দর্শন-শাস্ত্র-ক্যালেন্ডার-রীতিনীতি নিয়ে যে বিপুল অনুসন্ধান আকবরের সময় হয়েছিল—যার কিয়দংশ লিপিবদ্ধ আছে আইন-ই-আকবরিতে—তা দেখলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। সতীদাহ থেকে সাংখ্য, সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর-কলি ভিত্তিক গণনা থেকে মহাভারত – পুরোনো ভারতের বিস্তৃত গাইডবুক হিসেবে কাজ করতে পারে এই গ্রন্থ। এই মাপের অনুসন্ধান, নিঃসন্দেহে এই হোয়াটস্যাপ জমানার থেকে অনেকগুণ এগিয়ে ছিল।