ফ্যাসিবাদ এই মুহূর্তের প্রধানতম বিপদ, সুতরাং তাকে রুখতে হবেই। এই অবধি কারোরই কোনো দ্বিমত নেই। প্রশ্নটা হলো সেই রুখবার কাজটা চালু সংসদীয় বৃত্তের মধ্যে থেকেই, অথবা সংসদ বহির্ভূত প্রতিরোধের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। অনেকেই বলবেন জানি, "দুটোই"। আর কেউ কেউ বলবেন "উফ! সেই আমরা ওঁরা! ফ্যাসিবাদকে রুখতে গিয়ে এত কূটকচালি আর বিতর্ক দেখে ফ্যাসিবাদ নিজেই পালাবে!" অর্থাৎ আমরা যদি মনেও করি, কোনো আহ্বান জনগণের সামনে ভুল দিশা নিয়ে হাজির হচ্ছে যার ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারেন , তা সত্ত্বেও সেই সব বিতর্ককে কম্বলচাপা দিয়ে একটা ঐক্য ঐক্য ভাব করতে হবে! আর সেই অসমাধিত, নড়বড়ে পথের উপর দাঁড়িয়ে আরএসএস-বিজেপি-র মতো একটা সুসংহত রেজিমেন্টেড মতাদর্শভিত্তিক দলের পরাজয় নিশ্চিত করব! মাফ করবেন, এতটা "আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে"-তে আমাদের বিশ্বাস নেই।
আমাদের কিছু বন্ধু ফ্যাসিস্ট আর এস এস - বিজেপি'র বিরুদ্ধে বাংলা' নামে একটি মঞ্চ গঠন করেছেন। তাঁরা স্লোগান দিয়েছেন: No Vote to BJP (বিজেপিকে ভোট নয়)। কিন্তু বিজেপি'র বিরুদ্ধে কাকে ভোট দিতে হবে, সেই একান্ত প্রযোজনীয় প্রশ্নটির স্পষ্ট কোনো উত্তর তারা দিচ্ছেন না। এর ফলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। স্লোগানটির মধ্যে একধরনের 'পপুলিজম' রয়েছে, চটজলদি ডিজিট্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হওয়ার উপাদানও কিছু কম নেই। ইতিমধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু No Vote to BJP-র উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি এমনকি বলেছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের 'ভাই' রা দলের পতাকা ছেড়ে No Vote to BJP-র উদ্যোক্তাদের ডাকা ১০-ই মার্চের মিছিলে যোগ দেবেন। ব্রাত্য তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী। দলের সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জির অনুপ্রেরনা ছাড়া তিনি এমন কথা বলতে পারতেন না। গত ১০ বছরে বিরোধী দলের পার্টি অফিসগুলি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া, দখল করে নেওয়ায় অভ্যস্ত তৃণমূলের এ হেন বদান্যতা অভাবনীয়! আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, ব্রাত্যর বক্তব্য নিয়ে No Vote to BJP-র উদ্যক্তাদের নীরবতা। তারা তৃণমূলের সমর্থন নেবেন কিনা তা তারা আজ পর্যন্ত বলেন নি। মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। তাদের এই মৌনতা আসলে সম্মতির লক্ষণ কিনা, পর্দার আড়ালে কোনও গড়াপেটা খেলা চলছে কিনা, আমাদের জানা নেই। তাই আমরা নিস্পৃহভাবেই No Vote to BJP- এই স্লোগানটির কার্যকারিতা খতিয়ে দেখতে চাইছি, তা এই মঞ্চ এ' রাজ্যের কত শতাংশ ভোটারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন সে প্রশ্নটিকে উহ্য রেখেই।
বিজেপিকে ভোট না দিলে তৃণমূলকে ভোট দিতে হয়। নাহলে সিপিআই(এম)-কংগ্রেস জোটকে ভোট দিতে হয়। নাকি এসইউসিআই কে বা লিবারেশনকে ভোট দেব? অথবা যে কোনও দলের মধ্যে থাকা "সৎ" কোনও প্রার্থীকে বেছে নিয়ে ভোট দেব? আসুন, সম্ভাবনাগুলিকে একে একে খতিয়ে দেখা যাক।
১) তৃণমূলকে ভোট দেব?
ধরা যাক বিজেপিকে ঠেকাতে আমার এলাকার তৃণমূল প্রার্থীকে ভোট দিলাম। কিন্তু দল বদলের যা হিড়িক পড়েছে, তাতে আমার ভোটে জিতে আসা তৃণমূল প্রার্থীটি যে ভোটের পরেই বিজেপিতে চলে যাবেন না, এমন গ্যারান্টি কি No Vote to BJP-র উদ্যোক্তারা দিতে পারবেন? স্বয়ং মমতা ব্যানার্জিও তো এমন গ্যারান্টি দিতে পারবেন না! তাহলে বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলকে ভোট দিয়ে লাভ কি হবে? তাছাড়া গত দশ বছরে তৃণমূলের দুর্নীতি, দাদাগিরির ফলে রাজ্যের এক বিরাট অংশের মানুষ চরম ক্ষুব্ধ। No Vote to BJP'র উদ্যোক্তাদের অনুরোধ/নির্দেশ মেনে তারা আবার সেই তৃণমূলকেই ভোট দেবেন? এটা কষ্ট কল্পনা নয় কি?
২) সিপিআই(এম)-কংগ্রেস জোটকে ভোট দেব?
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে সিপিআই(এম)-এর প্রায় ২২ শতাংশ ভোট বিজেপিতে চলে গেছিল। ‘মুখে বাম, ভোটে রাম’- এমন যে হয়েছিল তা সীতারাম, বুদ্ধদেবরাও স্বীকার করেছিলেন। এবারও যে তেমন হবে না, এমন গ্যারান্টি কি No Vote to BJP-র উদ্যক্তারা দিচ্ছেন? দেওয়া যায় কি? তাহলে সিপিআই(এম)-কংগ্রেস জোটকে ভোট দিয়ে লাভ কি?
৩) নাকি এসইউসিআই বা লিবারেশন?
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এসইউসিআই ভোট পেয়েছিল ০.৭ শতাংশ। লিবারেশন তার চেয়েও কম। এদের ভোট দিয়ে বিজেপিকে ঠেকানো যাবে, এমন কথা শুনলে ঘোড়াতেও হাসবে!
৪) যে কোনও দলের "সৎ" প্রার্থীকে ভোট?
সংসদীয় দলগুলির মধ্য থেকে "সৎ" প্রার্থী খুঁজে বার করার চেয়ে খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজে বার করা সহজ। তবু যুক্তির খাতিরে যদি মেনেও নেওয়া হয় যে এমন কয়েকজন "সৎ" প্রার্থী আছেন, তাহলেও হাতে গোনা, মুষ্টিমেয় এমন কয়েকজন ব্যক্তিকে ভোট দিলেই বিজেপি হেরে যাবে?
৫) ভোট ভাগাভাগির সম্ভাবনা? তাও কি নেই?
No Vote to BJP-র উদ্যোক্তারা বলেছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে। ফলে এমন হওয়াই স্বাভাবিক যে বিজেপি'র বিরুদ্ধে কেউ তৃণমূলকে ভোট দেবেন, কেউ সিপিআই(এম) কে। কেউ বা আবার কংগ্রেস বা এসইউসিকে। এমন ঘটলে বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হবে। আর উদ্যোক্তা সংগঠনগুলির নিজেদের মধ্যে ভোটের লড়াই হলে ভোট ভাগাভাগি তো আরও বাড়বে। এই সব সম্ভাবনার কথা No Vote to BJP-র উদ্যোক্তারা ভেবে দেখেন নি?
আসলে No Vote to BJP - এই স্লোগানের মধ্যে চমক আছে। ভাবনার গভীরতা নেই। বাস্তববুদ্ধি নেই। No Vote to BJP'র উদ্যোক্তারা আবেগের স্রোতে ভেসে গিয়েছেন। কোনও কিছুই তলিয়ে ভাবেন নি। তাই "বিজেপিকে ভোট নয়"- এই স্লোগান বিজেপি বিরোধী শিবিরে একরাশ বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। ৪ জানুয়ারির সভাতেও এই বিভ্রান্তির আঁচ পড়েছে। ভোট যত এগিয়ে আসবে, এই বিভ্রান্তি তত বাড়বে। আর No Vote to BJP-র উদ্যোক্তারা যদি তৃণমূলের বিরোধিতা না করেন, বিশেষত ব্রাত্য বসুর বক্তব্যের পর, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে এমনকি তৃণমূলের সঙ্গে গোপন 'ডিল' করার অভিযোগও উঠতে পারে।
সত্যি কথা বলব? আমরা কিন্তু সত্যিই চাই না এরকম কোনো অভিযোগ উঠুক। যে সৎ মানুষেরা যান্ত্রিক ফ্যাসিবাদবিরোধী-চেতনা থেকে এই স্লোগানটিকে সমর্থন করেছেন, তারা কিন্তু বড্ড প্রতারিত বোধ করবেন তা'হলে।
তাহলে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা কীভাবে হবে?
ভোট দিয়ে ফ্যাসিবাদকে ঠেকানো যাবে না। আমরা যদি ভুলে যাই যে দেশি-বিদেশি কিছু বড় কর্পোরেট সংস্থা দেশীয় বড় ভূস্বামীদের সঙ্গে জোট বেঁধে বিজেপিকে আর্থিক এবং অন্যান্য সাহায্য দিয়ে তাদের অর্থনৈতিক লাভের স্বার্থেই দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করতে চাইছে, তবে সেই ভুল হবে অমার্জনীয়। বিজেপি যে আদানি- আম্বানিদের মদত করছে না, বরং আদানি- আম্বানিরাই যে বিজেপিকে পোষে, এই কঠিন সত্যটি ভুলে গেলে No Vote to BJP'র মত চমকদার কিন্তু অন্তর্বস্তুতে বালখিল্য স্লোগান মাথায় আসবে।
তাই ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করার লড়াই আসলে ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তির বিরুদ্ধে লড়াই।
তাই আমরা বলছি:
১.Jio এবং Fortune সহ আম্বানি, আদানিদের সমস্ত পণ্য ও পরিষেবা বয়কট করতে জনমত গড়ে তোলার কাজ শুরু করুন। ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ভিতে আঘাত হানতে আর যা যা করা দরকার, তাই করতে মানুষকে সংগঠিত করুন।
২. বিজেপি'র প্রার্থীরা যাতে এলাকায় ঢুকে তাদের বিষাক্ত প্রচার না করতে পারে তা বোঝাতে গ্রামে, শ্রমিক বসতিতে, পাড়ায় পাড়ায় জনগনের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে অবিলম্বে হাত লাগান। (ফ্যাসিবাদকেও "গণতান্ত্রিক স্পেস" দিতে হবে, এমন কথা যাঁরা বলবেন, তাঁদের জন্য রইল অকুন্ঠ করুণা!)
৩. এর মাধ্যমে যে অগণিত মানুষ আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত, জনবিরোধী সংসদীয় দলগুলির থেকে পরিত্রাণ চাইছেন, একটি প্রকৃত বিকল্প খুঁজছেন, তাঁদের সংগ্রামের পক্ষে জয় করে আনুন।
আপাতত আমরা এটুকুই বলছি।
'বিজেপি যে আদানি- আম্বানিদের মদত করছে না, বরং আদানি- আম্বানিরাই যে বিজেপিকে পোষে'
- এটা বোধহয় পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার, কেউ কাউকে পোষে এমন নয়। দু পক্ষই পরস্পরকে মদত দেয়