ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতে আজ পর্যন্ত যতগুলি ‘আজাদি’র স্লোগান উঠেছে, তার প্রতিটিরই জন্মলগ্ন থেকে সঙ্গী হল আয়রনি। এর মধ্যে প্রথমটি, অর্থাৎ "ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়" তো প্রবাদপ্রতিম। স্লোগানটি গোটা ভারতে এতটিই জনপ্রিয় (ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুই অর্থেই) হয় যে, সত্তর বছর পরেও মানুষ সেটিকে মনে রেখেছেন। এবং এখানে অব্যর্থ আয়রনিটি এই, যে, হিন্দি ভাষায় উচ্চারিত এই স্লোগানটির জন্মই হয়েছিল হয়েছিল এককেন্দ্রিক ভারত রাষ্ট্র তথা হিন্দির আধিপত্যের বিরুদ্ধতা করে।
সমস্ত ‘আজাদি’র জননী এই স্লোগানের প্রেক্ষিত, ১৯৪৮ সালের। দেশভাগের পর কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস বসে কলকাতায়। কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিনফর্ম তখনও বেঁচে। কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিনফর্ম সে সময় ভারতবর্ষকে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবেই দেখত। প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সমর্থন করা হত। ১৯৪৬ সালের উত্তাল সময়েই পার্টির সম্পাদক পিসি যোশি "জাতীয় বিধান সভাগুলির সম্পূর্ণ এবং সত্যিকারের সার্বভৌমত্ব"-এর কথা বলেছিলেন। বলাবাহুল্য ‘জাতীয়’ শব্দের অর্থ ছিল রাজ্যের বিধানসভাগুলি। গোটা দেশের সংবিধানসভা উল্লেখ করতে গিয়ে যোশি ‘সর্বভারতীয়’ শব্দটি ব্যবহার করেন। গোটা ভারতকে বাম-বুলিতে তখনও একটি ‘জাতি’ ভাবা হতনা (শব্দের অর্থ কীভাবে কালানুক্রমিক ভাবে পিছলে যায়, এর থেকে তার যথোপযুক্ত উদাহরণ বোধহয় আর হয়না)।
১৯৪৮ সালে যোশিকে সরিয়ে শুরু হয় রণদিভে জমানা। নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিও "সমস্ত জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের এবং বিচ্ছিন্নতার অধিকার"-এর সজোর ঘোষণা করে। ভারতে বিপ্লবের বজ্রনির্ঘোষের প্রথম পর্ব শুরু হয়। তেলেঙ্গনায় রাজাকার এবং নিজামের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয় সিপিআই। পরে ভারতীয় সৈন্য প্রবেশ করলে তাদের বিরুদ্ধেও শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ। গোটা ভারত জুড়ে নেওয়া হয় 'সক্রিয় প্রতিরোধ' কর্মসূচি। “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়” -- এই অগ্নিগর্ভ সময়ের স্লোগান।
ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়ে গেলেও, এই স্লোগান কিন্তু কার্যত দু-বছরের বেশি টেকেনি। অভ্যুত্থানপন্থী বনাম সংবিধানপন্থী (পড়ুন চিনপন্থী বনাম কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতাপন্থী) দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে আভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে পার্টি প্রায় দুটুকরো হবার উপক্রম হলে ১৯৫০ সালে স্বয়ং স্তালিন মস্কোয় দুই গোষ্ঠীর নেতাদের ডেকে পাঠান। বাম দিক থেকে রাজেশ্বর রাও এবং ডানদিক থেকে ডাঙ্গে মস্কো যান। সঙ্গে ছিলেন বাসবপুন্নাইয়া এবং অজয় ঘোষ। স্তালিন তেলেঙ্গানার যুদ্ধ বন্ধ করতে বলেন। এবং রণদিভের জমানা শেষ হয়ে যায়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের লাইনকে ‘হঠকারী অতিবাম’ আখ্যা দেওয়া হয়। যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে এই স্লোগানের আয়ুষ্কালও শেষ হয়। রণদিভেকে আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও বাদ যান তিনি। আবার ফেরত আসার জন্য তাঁকে দীর্ঘ ৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৫১ সালে রাজেশ্বর রাওয়ের বদলে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন ডাঙ্গে।
উল্লেখ্য, যুদ্ধের লাইন পরিত্যক্ত হলেও, ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে পার্টির মত কিন্তু বদলায়নি। মোহিত সেনের লেখায় পাওয়া যায়, স্তালিন ভারতবর্ষকে বহুজাতিক যুক্তরাষ্ট্র হিসেবেই ভাবতেন। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে নয়। স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু হয়ে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এই দৃষ্টিভঙ্গির কোনও পরিবর্তন হয়নি। কমিনফর্ম তখনও টিকে। সোভিয়েতের ভারত-বিশেষজ্ঞ দিয়াকভের "জাতীয়তার প্রশ্ন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ" নামক রচনাটিই ১৯৫৩ পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিনফর্মের দৃষ্টিভঙ্গির দলিল। ১৯৪৮ সালের ওই লেখায় দিয়াকভ লেখেন, যে, "ভারতের কোনও সাধারণ ভাষা বা সাধারণ জাতীয় চরিত্র নেই", যে কারণে গোটা ভারতকে একটি জাতি হিসেবে ধরা যায় না। নানা জাতির মধ্যে সাধারণ যে মিলগুলি আছে, সেগুলি ইউরোপের বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জাতির মধ্যে মিলের থেকে বেশি কিছু নয়।
একথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, কথাগুলি উপর-উপর বলে দেওয়া। ভারত সংক্রান্ত বিশ্লেষণে দিয়াকভ বিস্ময়কর দক্ষতা দেখিয়েছেন। ভারতের পূর্ণাঙ্গ জাতিগুলির একটি তালিকা বানান তিনি। তালিকাটি এইরকম: পূর্ব ভারতে বাঙালি, অসমিয়া, ওড়িয়া; পশ্চিম ভারতে গুজরাতি, মারাঠি; দক্ষিণে তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালায়লম। যাদের পূর্ণাঙ্গ জাতিসত্তা গড়ে ওঠেনি, গড়ে ওঠবার পথে, তারা হল হিন্দুস্তানি এবং পাঞ্জাবি। আর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নানা জাতিগুলি, দিয়াকভ লেখেন, অন্যান্যদের চাপে স্যান্ডউইচ হয়ে আছে। বাংলাকে নিয়ে দিয়াকভের বিশেষ আগ্রহ ছিল, দুই বাংলার মিলনের জন্য উন্মুখ ছিলেন। ভারত এবং পাকিস্তান, দুই পক্ষেরই বাংলাকে নিয়ে সমস্যা হবে, দেশভাগলগ্নে লেখেন দিয়াকভ। এবং ১৯৫২ সালে ভারত এবং পাকিস্তান, দুই সরকারকেই তিনি দায়ী করেন, সংকীর্ণ স্বার্থে উভয় বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা জিইয়ে রাখার জন্য। দিয়াকভের স্পষ্ট মত ছিল, এরা বাংলার ‘জাতীয়’ আন্দোলনকে ব্রিটিশ সরকারের পথ ধরেই রক্তে ডুবিয়ে দিতে চায় (পরবর্তীতে ৬৯ এবং ৭১-এ উভয় বাংলাই সেই ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতা প্রমাণ করে)। বিধানচন্দ্র রায় সম্পর্কে ওই ৫২ সালেই দিয়াকভ লিখেছিলেন, যে, উনি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাল দিয়ে চলেন। কারণ? এখন অবিশ্বাস্য মনে হলেও এগুলি দিয়াকভের নিজের লাইন: কারণ তিনি "মারওয়াড়িদের হাতের পুতুল"(stooge of the Marwaris)।
এখন অবিশ্বাস্য লাগলেও এতে আশ্চর্য হবার আসলে কিছু নেই। কারণ তৎকালীন পার্টির বক্তব্যও অন্যরকম কিছু ছিলনা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে হিন্দি চালু করার। ছাত্র ফেডারেশন তখন তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। ‘ইয়ং গার্ড’-এ তখন সোচ্চারে লেখা হচ্ছে, আন্দোলনের বর্শামুখ দুই শত্রুর দিকে: হিন্দি ভাষা এবং মারওয়াড়ি পুঁজিপতি। ‘দ্য কমিউনিস্ট’-এ লেখা হচ্ছে "রাষ্ট্রভাষার দাবি আসলে ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী এবং ঔপনিবেশিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ"। দিয়াকভ নিজেও রীতিমত নাম করে লিখছেন, কেন্দ্রের হাতে বিপুল ক্ষমতা এলে বিড়লা-ডালমিয়াদের উপকারে লাগার জন্য। সমস্ত ভাষাকে সমানাধিকার না দিয়ে হিন্দি-ইংরিজিকে রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এবং একই সঙ্গে গুজরাতি-মারওয়াড়ি শিল্পপতিদের আধিপত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেওয়া হচ্ছে, দুয়ের লক্ষ্য একই দিকে ধাবিত। এর রাজনৈতিক লাইনটি খুবই স্পষ্ট। ভারতবর্ষে বৃহৎ পুঁজির রাজত্বের জন্য স্থানীয় বৈচিত্র্যগুলিকে মুছে দেওয়া দরকার। সে জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে হিন্দি-ইংরিজির স্টিমরোলার। বৃহৎ পুঁজি অর্থে গুজরাতি ও মারওয়াড়ি পুঁজি। তারা নিজেদের বাকি সবার মতো নিজের সংস্কৃতি এবং ভাষাকে বিসর্জন দিতে রাজি আছে, মুনাফা এবং আধিপত্যের স্বার্থে। বৃহৎ পুঁজি এবং বৃহৎ ভাষা উভয়ের আধিপত্য তাই হাতে হাত ধরে চলেছে।
মোটামুটি এই লাইন চলে ১৯৪৮ (বা আরও আগে থেকে) ১৯৫৩ পর্যন্ত। জাতি বলতে তখন বাঙালি বা তামিলকে বোঝানো হত। বিচ্ছিন্নতাবাদ কিছু নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল না। হিন্দি আধিপত্যের বিরুদ্ধে ছাত্র ফেডারেশন আন্দোলন করত। এবং গুজরাতি ও মারওয়াড়ি পুঁজিকে স্বনামে ডাকতে রাজনৈতিক সঠিকত্বের কোনো সমস্যা ছিলনা। যুগটা অন্য ছিল। কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক ঐক্যের সেই শেষ কয়েক বছর। সবে বিপ্লব সমাধা করেছেন মাও, চিন এবং সোভিয়েতে খুব সামান্য মতবিরোধ সত্ত্বেও বন্ধুত্ব অটুট। কমিনফর্ম টিকে। এবং স্তালিন বেঁচে। বস্তুত ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় কমিউনিস্টদেরও সেটাই স্বর্ণযুগ। তেলেঙ্গনার সশস্ত্র লড়াই শেষ হয়ে যায় ৫০-৫১ সালেই। কিন্তু কমিউনিস্ট প্রভাব ঐ এলাকায় কমেনি। ১৯৫১ সালের কেন্দ্রীয় নির্বাচনে ওই এলাকা থেকে বেশ কয়েকটি আসনে জেতে সিপিআই। লোকসভার নবনির্বাচিত কমিউনিস্ট নেতা এ কে গোপালন নির্বাচনের ঠিক পরেই ঘোষণা করেন, ভারতে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনই সেই মুহূর্তে পার্টির লক্ষ্য। এবং সেটিই নবগঠিত রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
নেহরু এবং কংগ্রেস, বলাবাহুল্য এই নীতির ঠিক উল্টোদিকে ছিলেন। নেহরু স্বয়ং তখন বোম্বের সিনেমাকে ঐক্যবদ্ধ ভারতের মুখ হিসেবে দেশে-বিদেশে ঘুরে-ঘুরে প্রচার করছেন। কংগ্রেসের মডেল ছিল, কেন্দ্র হবে সর্বশক্তিমান এবং প্রদেশগুলি ভাষা বা জাতিভিত্তিক স্বায়ত্ত্বশাসিত এলাকা নয়, বরং সীমিত ক্ষমতার অধিকারী প্রশাসনিক একক হবে মাত্র। কিন্তু নেহরু শেষ পর্যন্ত এই ধারণায় অবিচল থাকতে পারেননি। ভাষাভিত্তিক রাজ্যের জন্য, রাষ্ট্রের এই ঊষালগ্নেই নানারকম আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এর প্রতিটিতেই কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সক্রিয় ভূমিকা বা মদত ছিল। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে যোগদানের জন্য মানভূমের আন্দোলনটি সুপরিচিত, কালক্রমে যা থেকে জন্ম হবে পুরুলিয়া জেলার। কিন্তু সবচেয়ে বড় আন্দোলনটি হয় আজকের অন্ধ্রে, যা কোনও কারণে এখন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। মাদ্রাজ প্রদেশের বদলে তেলুগু জনতার নিজস্ব অন্ধ্র রাজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় এই আন্দোলনটি হয় ১৯৫২ সালে। কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও স্থানীয় গান্ধিবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শ্রীরামালু অনশন শুরু করেন ১৯৫২ সালে। কেন্দ্রীয় সরকার মৌখিক কিছু আশ্বাস দেয়, কিন্তু ওই অবধিই। কিছুই না এগোনোয় কিছুদিন অপেক্ষা করে শ্রীরামালু আমরণ অনশন শুরু করেন। এবং যতীন দাসের পর ভারতবর্ষের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে অনশন করে মৃত্যু বরণ করেন। এর পর আন্দোলনের ঝড় ওঠে ওই এলাকায়। পুরোভাগে, যথারীতি কমিউনিস্টরা। নেহরু পিছু হঠেন এবং ভাষাভিত্তিক রাজ্যের জমানার সেই শুরু। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কংগ্রেসের সেই প্রথম পরাজয়। এবং কমিউনিস্টদের যুক্তরাষ্ট্রীয় লাইনের প্রথম জয়।
আয়রনি এই, যে, এই জয়ের সূচনা দিয়ে আসলে ইতিহাসের কিছুই বোঝা যায়না। ইতিহাস ওরকম সরলরৈখিক নয়, বরং আয়রনি ময়। স্বর্ণযুগের মধ্যেই সম্ভবত পতনের বীজ নিহিত থাকে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যেমন। ১৯৫৩ সালে দুম করে মারা যান স্তালিন। মৃত্যু না হত্যা, এ নিয়ে বিতর্ক তখনও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু যা নিয়ে বিতর্ক নেই, তা হল, এরপরই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ঐক্য শেষ হয়ে যায়। ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা হয়। সোভিয়েত তার লাইন বদলে ফেলে। যদিও নামে জোট-নিরপেক্ষ, কিন্তু আদতে দ্বিমেরু পৃথিবীতে ভারতীয় রাষ্ট্র সোভিয়েত-শিবিরে যোগ দেয়। ক্রুশ্চেভের সোভিয়েতের সঙ্গে ভারত রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। এবং দুম করে বদলে যায় কমিউনিস্ট পার্টির লাইনও। ১৯৫৩ সালে তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসে অজয় ঘোষ লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করেন, যে, পার্টি এতদিন ভারতবর্ষের ঐক্যের উপর জোর না দিয়ে বিচ্ছিন্নতাকে গৌরবান্বিত করেছে। খুব স্পষ্ট করেই জানানো হয়, এবার থেকে সংযোগরক্ষাকারী ভাষা হিসেবে হিন্দিকে উৎসাহ দেওয়া হবে। যেখানে হিন্দি বলা হয়না, সেখানেও 'জাতীয়' ভাষার পূর্ণ অধিকার রক্ষা করেই পার্টি হিন্দিকে উৎসাহ দেবে এবং জনপ্রিয় করার চেষ্টা করবে। এখানে 'জাতীয়' শব্দটি লক্ষ্যণীয়। তখনও সর্বভারতীয় শব্দভাণ্ডারে 'আঞ্চলিক' শব্দটি এসে পৌঁছয়নি। স্থানীয় ভাষাকে তখনও বলা হচ্ছে 'জাতীয়', যদিও ঠোঙার ভিতর সম্পূর্ণ বদলে গেছে বাদামভাজা।
কয়েক বছরের মধ্যেই শব্দবিধিও বদলাতে শুরু করে। তেলেঙ্গানায় যে পার্টি কংগ্রেসকে “মারওয়াড়ি পুঁজির দালাল” আখ্যা দিয়েছিল, তাদের দলিল ক্রমশ ভব্য হয়ে ওঠে। ‘মারওয়াড়ি পুঁজি’র বদলে ‘একচেটিয়া পুঁজি’, বা ‘টাকার কারবারি বণিকগণ’ ইত্যাদি ‘সঠিক’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করা শুরু হয়। ১৯৫৫ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রাভদা নেহরুর উচ্চকিত প্রশংসা করে একটি সম্পাদকীয় ছাপে। সংসদে হিন্দির ব্যবহারেরও প্রশংসা করা হয়। বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।
একথা ভাবার অবশ্য কোনও কারণ নেই, যে, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কোনো মতবিরোধ ছিলনা। কিন্তু সেসবও থেমে আসে নানা কারণে। সোভিয়েতকে অনুসরণ করা নিয়ে বিতর্কের অনেকগুলি মুখের মধ্যে একটি ছিল জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। আরও নানা বিষয় ছিল, এবং পার্টি প্রথমবার ভাঙে ১৯৬৪ সালে। দ্বিতীয়বার ভাঙে ১৯৬৯ সালে। জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগই চলে যান নকশালপন্থী অংশে, যে অংশটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানেরও পক্ষে। ১৯৭১-এর মধ্যে প্রথম পর্বের নকশাল আন্দোলন ভারতীয় রাজনীতির মূলধারা থেকে মুছে যায়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে জাতিসত্তার আন্দোলনও মূল ধারায় বৈধতা হারিয়ে ফেলে। রাজ্য এবং প্রদেশের পার্থক্য আলোচ্যসূচি থেকে বাদ পড়ে যায়। আগে যাকে সর্বভারতীয় বলা হত, তা হয়ে যায় জাতীয়, আর আগেকার জাতি হয়ে যায় আঞ্চলিক। বৈচিত্র থেকে নজর সরে যায় ঐক্যে।
৭০ বছর পরে ফিরে দেখলে মনে হয়, বাইরের প্রভাবে নয়, এ আসলে প্রক্রিয়ার অন্তর্গত ব্যাপারই। স্লোগান হিসেবে "ইয়ে আজাদি"র দুটি অভিমুখ ছিল। এক, সমস্ত জাতিসত্তার সমানাধিকার। দুই, একটি সর্বভারতীয় বিপ্লব প্রচেষ্টা। এই দুইয়ের মধ্যে টানাপোড়েনে সর্বভারতীয় হবার আকাঙ্ক্ষাটি বেশি এগিয়ে থাকে, অধিকতর শ্রোতার কাছে পৌঁছনোর লক্ষ্যে স্লোগানটির ভাষা হয়ে যায় হিন্দি। এবং আয়রনি এই, যে, যে মুহূর্তে হিন্দি আধিপত্যের বিরুদ্ধে, জাতিসত্তার সমানাধিকারের পক্ষে একটি স্লোগানের জন্ম দিতে হয় হিন্দিতে, স্রেফ ‘সর্বভারতীয়’ হবার বাসনায়, সেই মুহূর্তেই তার পরিণতিও লেখা হয়ে যায় দেয়ালে। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জাতিসত্ত্বাদের উত্থান যদি রাষ্ট্রের ভাষাতেই করতে হয়, তা আসলে "যোগাযোগের মাধ্যম" হিসেবে হিন্দিকে ব্যবহার করার রাষ্ট্রীয় আখ্যানের পক্ষেই দাঁড়িয়ে যায়। যার অনিবার্য পরিণতিতে কোনও এক সময়ে রাষ্ট্রের আখ্যানকে সরাসরি মেনেও নিতে হয়। এই আয়রনি, "ইয়ে আজাদি" স্লোগানের রক্তের অন্তর্গত। বাইরে থেকে আসেনি।
এবং এই একই জন্মদাগকে আমরা চিনে নিতে পারি পরবর্তীর যেকোনো আজাদির স্লোগানেও। যেকোনো অঞ্চলের সমানাধিকারের স্লোগান, আজাদির স্লোগান এখন সমস্বরে উচ্চারিত হয় হিন্দিতে। অথচ ভারতর্ষের হিন্দিবলয় কখনও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে আজাদি চায়নি। তেলেঙ্গানা থেকে কাশ্মীর চেয়েছে। এন-আর-সি থেকে মুক্তি চেয়েছে বাংলা, আসাম। অথচ তার স্বঘোষিত অগ্রণী অংশ স্লোগান দেয় হিন্দিতে। কারণ, এ স্লোগানের ভিতরে ঢুকে আছে "সর্বভারতীয়" হবার আকাঙ্ক্ষা। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের বদলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দাবি বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিভিন্নতাকে স্বীকার করে তবেই সম্ভব। সমস্ত দাবির ভাষাকে পিটিয়ে সমতল করে দিয়ে কোনওমতে সর্বভারতীয় শ্রোতার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষাই যদি প্রাধান্য পায়, তবে সে স্লোগান আঞ্চলিক জাতিগোষ্ঠীর স্বাধিকারের স্লোগান নয়। অথচ আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে মূলধারার সমস্ত আজাদির স্লোগানই দেওয়া হয়েছে হিন্দিতে। এই আয়রনিই এদের প্রতিটিরই জন্মদাগ। ১৯৪৮ সালের প্রথমটি থেকে যার শুরু।
"অথচ তার স্বঘোষিত অগ্রণী অংশ স্লোগান দেয় হিন্দিতে।" - অনেক সংগঠনের নামও হয় হিন্দিতে।ক্রান্তিকারী, ক্রান্তি, কিষান, মজদুর এইসব থাকে নামের মধ্যে।
"সর্বভারতীয়" হওয়াটাই ভারতীয়ত্বের প্রকৃত পরিচয়, এই ধারণা গেঁড়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলা জাতীয়তাবাদ বা তামিল জাতীয়তাবাদ বা কাশ্মীরি স্বায়ত্তশাসন এর দাবী সবই "বিচ্ছিন্নতাবাদ" বলে দেগে দেওয়া হয়। কারণটাও এই নিবন্ধেই আছে। বৈচিত্র্য না রাষ্ট্রের প্রিয়, না পুঁজির। এতরকম কাস্টমার সেট হলে কোন প্রোডাকশনই মাস স্কেলে করা যায় না। তাই "জাতীয়" ভাবধারায় দেশকে উদবুদ্ধ করা প্রয়োজন
সাধারণত গুরুতে সৈকত নতুন কিছু লিখলে আগ্রহ নিয়ে পড়ে থাকি। তবে আগের লেখাটিতে সৈকত কোনও প্রত্যুুত্তর দেওয়ার পরিশ্রম করেননি। সেটি বুবুভা-তে প্রকাশিত হওয়ার কারণে কি না, তা অবশ্য জানি না। এখানে তিনি যদি উত্তর দেওয়ার প্রচেষ্টা জারি রাখেন, তবে দু-কথা লেখার ইচ্ছে রইল।
আরে আপনি লিখুন না। সম্পাদিত লেখার সমালোচনা হয় তো। সাধারণভাবে সেটাকে ডিফেন্ড করতে নামা ভাল দেখায়না বলে নামিনা। কিন্তু পড়ি তো বটেই। সব কিছুর সঙ্গে একমত হইনা, কিছু পড়ে ঋদ্ধ হই। সবরকমই হয়।
খ, ঠিকই প্যানর প্যানর করা উচিত হয়নি। তবুও সৈকত যেহেতু সংবেদনশীল লেখক এবং তাঁর অনেক লেখাতেই আমি এই বিষয়টা লক্ষ করেছি, তাই মনে হয়েছিল এখানে মনোভাবের আদানপ্রদানটা জরুরি। সৈকতকে উপনিবেশবিরোধী বলেই জানি, এ-ও জানি যে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হিন্দির জন্ম নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন (যদিও তা খুঁজে পাইনি, কেউ তুলে দিলে পড়তে পারতাম)।
কিন্তু ১৮০২ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হিন্দুস্তানির অধ্যাপক গিলক্রিস্ট যে ভাষাকে 'embryonic stage' -এ আছে বলেছিলেন, কিছু দিন যেতে না যেতেই কোন অদৃশ্য ভোজবাজিতে তার সেই দশা ঘুচল এবং হিন্দুস্তানি ভেঙে গেল হিন্দি ও উর্দুতে - আমার মনে হয় তখন থেকেই এই জন্মদাগের শুরু। খেয়াল করলে দেখা যাবে, তখন থেকেই কলেজের ছোকরা সাহেবদের ভাষা হিসেবে প্রথম পছন্দ ফারসি এবং দ্বিতীয় হিন্দুস্তানি যা কালক্রমে হিন্দি হয়ে উঠছে। এবং প্রথমাবধি বাংলা হচ্ছে কলেজের সবচেয়ে অবহেলিত বিভাগ।
ভারতবর্ষের এই বিবিধ বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে তাকে এক জাতি-এক ভাষার দেশ গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা ঔপনিবেশিক 'প্রভু'রা নিয়েছিল তাদের শাসনস্বার্থে, তারই পুনরাবৃত্তি করেছে প্রথমে কংগ্রেস ও পরে বিজেপি। ফাউ হিসেবে কংগ্রেস মুখে এক ধর্মের কথা না বললেও আড়ালে-আবডালে তা বুঝিয়ে দিতে বাকি রাখেনি। বিজেপির সে বালাই প্রথম দিন থেকেই নেই।
কাজেই জন্মদাগের বয়স আসলে কিন্তু অনেক আগের। এটাই বলার ছিল মাত্র। বলা বাহুল্য, সৈকত এগুলোর সবটাই জানেন এবং কোনও ভাবেই তাঁর এই আলোচনার 'ঋদ্ধ' হওয়ার চান্স নেই! আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন!!
গুরুতে প্রেক্ষিতা ঘোষ দেখে পাগলা হয়ে যেতে হত যে বোধি। আর আজ ছ্যাঁকা লাগলে হবে?
ইতি তাপস দাশ (সঠিক বানান হিমালয়ে পাঠাবেন না)
"ইয়ে আজাদী" শ্লোগানের আয়রনি ও আদ্যোপান্ত জেনে ভাল লাগল।
এপারে নয়ের দশকে স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ সরকার বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিজেও শ্লোগান লিড করেছি, দু-একটি শ্লোগান বানিয়েওছিলাম, যেগুলো এখনো সাবেক সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের মিছিলে উচ্চারিত হয়।
এটি বিস্ময়কর, কীভাবে যেন কবিতা এসে শ্লোগানে মিশে যায় :
"আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত/ এই রক্ত কোনোদিন পরাভব না!"
আবার ১৯৭১ এর শ্লোগান ২০১৩ তে এসে শাহবাগ বিস্ফোরণে ফের উচ্চারিত হয় :
"পদ্মা মেঘনা যমুনা/ তোমার আমার ঠিকানা!"
অথবা :
"জয় বাংলা!"
* কিভাবে
"দু লাইন" লিখে কী মজা পাও?
1950 সালে স্তালিনের মধ্যস্থতার reference পাওয়া যাবে?
সিদ্ধান্তটি কী? অতিকেন্দ্রীক রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা ঠিক ছিল কি বেঠিক? কিন্তু ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় বলবার এটাই কারণ ছিল না। একটি উপনিবেশ আধা উনপনিবেশে পরিণত ছিল, ব্রিটিশ সরাসরি শাসন থেকে যাচ্ছিল কিন্তু তাঁর পুঁজির স্বার্থ অক্ষত রেখে যাচ্ছিল--- এবং তা ভারতীয় তাবেদারদের হাতে--সেটিও ছিল বড় কারণ...এই স্লোগানের। দেশের অধিকাংশ লোক যেহেতু হিন্দিটা (না হয় তাকে হিন্দুস্তানী বা উর্দুই বলুন) বোঝে, সেজন্যেও হিন্দিতে স্লোগান দেওয়া হয়। হিন্দি বিদ্বেষের তো কোনো কারণ নেই।