আশির দশকে তৈরী হওয়া "সালাম বোম্বে"র সময় থেকে আমরা অনেকদূর চলে এসেছি। এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে অতীতের বাণিজ্যিক এবং সমান্তরাল হিন্দি ছবির বিভাজন তাই খুব অস্পষ্ট লাগে। অভিনেতা ইরফান খানের ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে বেরোনোর সময়টা, তাঁর নিজের কথায়, সেই সময়, যখন হিন্দি সমান্তরাল ছবির ধারা শুকিয়ে যাচ্ছে। একটি সাক্ষাৎকারে ইরফান উল্লেখ করেছেন গোবিন্দ নিহালনীর সঙ্গে এন এস ডি থেকে বেরিয়েই একটা ছবিতে কাজ করার কথা, এবং বলছেন সেই ছবিটা সমান্তরাল ধারার যে কাজ, তার একেবারে শেষের দিকের গুলির একটি। সম্ভবত ছবিটি "পিতা"। ১৯৯১ সালের এই ছবিটি সুইডিশ নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গের "দ্য ফাদার" নাটক অবলম্বনে তৈরী। "সালাম বোম্বে" ছবিতে পেশাদার চিঠি লিখিয়ের ভূমিকা থেকে ইরফান তখনও সামান্যই এগিয়েছেন, অন্তত সুযোগ পাওয়ার পরিমাণ যদি কোন মাপকাঠি হয়।
যখন সমান্তরাল ছবির ভবিষ্যৎ খুব একটা ভালো ঠেকছে না, আর বাণিজ্যিক ছবির রোমান্টিক অ্যাকশন হিরোদের স্বর্ণযুগে, গোটা নব্বইয়ের দশ জুড়ে ইরফান অভিনয় করলেন হিন্দি সিরিয়ালে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির চকোলেট এবং/অথবা পালোয়ান হিরোদের যেসব চিত্রনাট্যে দেখা যায়, তার থেকেও হাস্যকর সিরিয়ালে। বাসু চ্যাটার্জ্জি এবং তপন সিংহর ছবিতে (ছোট ছোট ভূমিকা হলেও) কাজ করার পরেও। আজ যখন হিন্দি ছবির জগতে শক্তিশালী পরিচালক, অভিনেতা এবং কলাকুশলী এসে পড়েছেন, এবং বাণিজ্যিক ও সমান্তরাল বলে দুটো আলাদা ধারার আর তেমন করে প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে না, তখন এই ব্যাপারটায় আশ্চর্য লাগার কথা।
কিন্তু যেটা তার থেকেও আশ্চর্যের তা হলো একজন শিল্পী একইসঙ্গে "চন্দ্রকান্তা" এবং "ভারত এক খোঁজ" প্রোজেক্টে কাজ করছেন, এমন কী "জয় হনুমান" সিরিয়ালও, এবং সেখান থেকে উঠে এসে "হাসিল" বা "মকবুল" এর মত ছবিতে কাজ করে "পান সিং তোমার" এ পৌঁছে যাচ্ছেন। একটা দশক জুড়ে প্রায় শুধুই সিরিয়াল করে পরের দশকেই একজন অভিনেতা ধীরে ধীরে পান সিং এর উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়া মনে হয় খুব একটা সুলভ নয়। এবং একই সঙ্গে তৈরী হচ্ছে হিন্দি ছবির স্টারকেন্দ্রীক বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের গল্প বলার রীতি, বক্স অফিসের সমীকরণ কিছু বিকল্প পথ পাচ্ছে।
এই সময়টাকেই, সময়টা ভালোদিকেই যাচ্ছে বুঝতে পারার আগে, সময়টাকে কাছ থেকে দেখা নাসিরুদ্দীন শাহ বলেছেন one of the toughest times in hindi cinema। সম্ভবত সেটাই ইরফানের কাজ পাবার অন্তরায় ছিলো। এর সঙ্গে জুড়তে হবে ছবির জগতে যাকে "ভালো দেখতে" বলা হয়, সেই অদ্ভুৎ বস্তুটির অভাব, যার জন্যে পর্দার মানুষ আর বাস্তবের মানুষ এক সারিতে বসে ভাত খায় না। প্রথম যৌবনে অন্য কিছু কাজ করতে শুরু করেছিলেন ইরফান। সেই সময় এসি সারাইয়ের কাজ করতেন। এসি মিস্ত্রি হিসেবে একসময় রাজেশ খান্নার বাড়িতে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন এই তথাকথিত স্টারডম কীভাবে অভিনেতার মৃত্যু ঘটায়, বাস্তবের থেকে বিচ্যুত করে।
ইরফানের মৃত্যুর পরে বিভিন্ন ভারতীয় পত্র পত্রিকায় তো বটেই, আন্তর্জাতিক খ্যাতির কারনে বিদেশী পত্রিকাতেও তাঁকে নিয়ে লেখাপত্র হয়েছে। সেখানে ইরফান সম্পর্কে এই বিষয়টিতে খুবই বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে যে, তিনি এমন একজন অভিনেতা যাঁর অভিনেতা হওয়ার কথা নয়। এবং তারপরেও তিনি শুধু যে একরকম নতুন স্টারডমের সংস্কৃতিই তৈরী করলেন তাই না, এমন বেশ কিছু ছবিতে খুবই সাবলীলভাবে কাজ করলেন যেখানে তাঁকে কেউ কেউ বিবেচনাই করতে চাইবেন না। এই কথায় সত্যতা আছে। এই কয়েক বছর আগের সাক্ষাৎকারেও ইরফান বলেছেন অভিনয় করতে চাওয়া তাঁর "ইনার কলিং" না, বরং "কাল্টিভেটেড ডিজায়ার"।
একটা লোক, খুব অল্প খানিকটা ইচ্ছেয়, খানিকটা পথ ভুলে, খানিকটা অন্য কিছু না পেয়ে (এসি মিস্ত্রির দোকানের পর ফ্যান সারাই) শেষমেশ অভিনয়কে অবলম্বন করতে চাইলেন, কারণ "সুযোগ এসে গেল এবং আর কিছু ছিলোনা"। এবং ট্রেনিং নেওয়ার পরে বাড়িতে ভিসিআর কিনে ছবি দেখতে দেখতে চেষ্টা করতে থাকলেন যাতে কাজটাকে পছন্দ করতে পারেন ---- এই জায়গাটায় ইরফান বাকি অভিনেতাদের থেকে খুবই অন্যরকম, যাঁরা অভিনেতা হতেই চেয়েছিলেন।
আমি ইরফানের কাজ প্রথমে যখন দেখি (কী ছবি দিয়ে শুরু মনে নেই আজ), তখন তাঁর হয়ে ওঠার সম্পর্কে কিছু জানা ছিলোনা। তারপর ক্রমশ তিনি বিখ্যাত হলেন, এমনকি এরকমও বলা হতে লাগলো যে ইরফানের মতে করে চরিত্রের একেবারে ভেতরে ঢুকে যেতে কম লোকই পারেন। এবং এই প্রশংসাটা "হাসিল" এবং "মকবুল" এর পরে বেশি করে করা হয়। ইরফানকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, তিনি কী করে চরিত্রে হয়ে ওঠেন। তিনি অবলীলায় বলেছিলেন, চরিত্র "হয়ে ওঠা" অসম্ভব, কারণ চরিত্রটি একজন অন্য মানুষ। একজন অভিনেতা বড়োজোর নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে চরিত্রটাকে বোঝার চেষ্টা করতে পারেন মাত্র। এই পর্যবেক্ষণ, প্রচারের আলো পড়লেই যেসব হবু তারকা সাক্ষাৎকারে "মেথড অ্যাক্টিং" এর তত্ত্ব দিয়ে কথা শুরু করেন, তাঁদের নোটবুকে তুলে রাখার মত।
আমার ইরফানের ছবি আবার ফিরে দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে মকবুলের পরে তাঁর কাজ ক্রমশ আরো ভালো হয়েছে। যাঁরা হিন্দি ছবির সাথে পরিচিত নন তাঁদের জন্য, "মকবুল" ম্যাকবেথ অবলম্বনে তৈরী বিশাল ভরদ্বাজের শেক্সপীয়র ট্রিলজির প্রথম ছবি। এরপরে "ওমকারা" (ওথেলো) এবং "হায়দর" (হ্যামলেট) বানানো হয়। মকবুল, ব্যক্তিগতভাবে আমার তিনটির মধ্যে পরিচালকের সবথেকে দুর্বল কাজ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু অভিনেতাদের মধ্যে ইরফান ছাড়াও পঙ্কজ কাপুর এবং টাবুর অসামান্য অভিনয় রয়েছে ঐ ছবিতে। ছবির সম্ভবত অন্যতম উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত অবিশ্বাস, অপরাধবোধ, অনিশ্চয়তা নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নাড়াচাড়া করতে থাকা ইরফানের অভিনয়, অপরাধবোধে ভুগতে থাকা ম্যাকবেথ হ্যালুসিনেট করছেন, ভূত দেখতে পাচ্ছেন --- এইসব দৃশ্যের পূনর্নিমাণ হয়েছে যে অংশটি থেকে শুরু করে, সেই অংশটি। একই সঙ্গে ফিজিক্যাল ও সেরিব্রাল অভিনয় করলেন ইরফান ঐ ছবিতে, দৃশ্যের পর দৃশ্যে, পঙ্কজ কাপুর এবং টাবুর মত ভয়ঙ্কর শক্তিশালী অভিনেতাদের মাঝেও তাঁকে আলাদা করে দেখা যেতে লাগলো।
মকবুল চরিত্র জীবনের যে পর্যায়ে দাঁড়িয়ে ইরফান করলেন, এবং যা তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করলো, তারপরে অভিনেতাদের সামনেই পড়ে থাকে আত্মতুষ্টি ও নিশ্চিন্তির খাদ, বিশেষত, অভিনয়ের "ক্রাফট" যাঁর আয়ত্ত হয়েছে এমন শিল্পীর। অথচ উচ্চপ্রশংসিত মকবুল এবং হাসিলের পরে, একগাদা ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করে ক্লান্ত ইরফান, এই প্রথম, কাজ ছেড়ে দিতে চাইলেন। ছেড়ে দিতে যে হয়নি তা আমাদের সৌভাগ্য, নাহলে ইরফানের সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছবি আমরা পেতাম না। এর মধ্যে অবশ্য ২০০৭ সালে "লাইফ ইন এ...মেট্রো" হয়ে গেছে। ছবিটা ভালই, ইরফান এবং কঙ্কনার কাজের জন্য সম্ভবত যতটা ভালো হওয়ার কথা ছিলো তার থেকে আরো বেশিই ভালো লাগে। কিন্তু এখানেও ইরফান তাঁর নিজস্বতায় এত বেশি ভালো না, যা তিনি এর কয়েক বছর পরেই হয়ে উঠছেন।
"পান সিং তোমর"। আমি এই ছবিটা, যথারীতি, দেখি অনেক পরে। যখন প্রবাসের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হয় ছবিটি। ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি যখন আমি ২০১৬ তে দেখি, আমার মনে হয়েছিলো ক্রমশ ছবিটির প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে, এবং ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। পান সিং একজন সৎ পরিশ্রমী মানুষের গল্প যাকে রাষ্ট্র হক্কের পাওনা থেকে বঞ্চিত করে, নিরাপত্তা দিতে পারেনা, এবং প্রতিবাদ করলে "অপরাধী" বলে দাগিয়ে দেয়, যাতে তার পরেই দরকারে এনকাউন্টার করতে পারে। ভারতের কোটি কোটি মানুষকে ভারত সরকার যেভাবে দেখে, যেভাবে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে চাওয়া মজুরদের রাষ্ট্র "দেখছে", সেই ব্যবস্থার ওপর অধৈর্য সাধারণ মানুষের গল্প "পান সিং তোমর"। ইরফান বলেছেন, এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিলো, এই চরিত্রটা খুব তাঁর কাছের। যেটা সম্ভবত বিনয়ে বলতে চান নি, তাহলো ঐ সততা, ঐ পরিশ্রম, ঐ জেদ এবং ঐ জেহাদ --- এই নিয়েই তিল তিল করে ইরফানের হয়ে ওঠা। যে দৃশ্যে পান সিং রুখে উঠে বলে- "আমি ডাকাত নই, আমি বাগী, ডাকাত পাওয়া যায় পার্লামেন্টে" --- বোঝা যায় মানুষ ইরফানের চেতনা ও রাজনীতি এখানে পান সিং এর চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরোচ্ছে।
"পান সিং তোমর" এর পর থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ইরফানের কাজ খুব ধারাবাহিকভাবে ভালো হয়েছে। হিন্দি ছবি যাঁরা দেখেন তাঁদের কাছে সাতকাহন করে "লাঞ্চবক্স" বা "পিকু"র কথা বলার দরকার নেই। আমার অবশ্য কম আলোচিত "মাদারি", "ব্ল্যাকমেইল", বা "করীব করীব সিঙ্গল" দিব্য লেগেছে। জীবনের যে পর্যায়ে পৌঁছে ইরফান অভিনয় ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সেই অস্থির সময়ের শেষে হঠাৎ একদিন নতুন করে উদ্দীপনা খুঁজে পেলেন, এবং তারপর থেকে তাঁর কাজ আগের থেকে আরো স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। আপনারা যদি ইরফানের কাজ কালানুক্রমিক ভাবে দেখেন, তাহলে খুব সহজেই এটা টের পাবেন।
২০১২ থেকে ২০১৭, মাত্রই পাঁচ বছর। কর্মজীবনের, তর্কযোগ্যভাবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ চড়াইটা ভাঙছিলেন ইরফান, সামনে অনেকটা পথ ছিলো। ২০২০ তে এসে সেই যাত্রা আচমকাই থেমে যাওয়া, ভারতীয় সিনেমার খুবই উজ্বল সময়ে দাঁড়িয়েও, দূর্ভাগ্যের। ইরফানের চলে যাওয়া অনেকটা পান সিং এর পরিণতির মত, যাকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধতে না বাঁধতেই কোন সূক্ষ্য ছিদ্রপথে মৃত্যু এসে সব গোলমাল করে দেয়।
অসম্ভব ভালোলাগল পড়ে...প্রিয় অভিনেতা উনি...আছেন ও থাকবেন সব সময়...