মুর্শিদাবাদ নামটি শুনলে অনেকের মনে প্রথমেই উদয় হয় পলাশীর যুদ্ধ, নবাব সিরাজের পরাজয় ও মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। অনেকে মুর্শিদাবাদের মানুষকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে ভরসা করতে ভয় পান এমন ঘটনাও প্রচুর রয়েছে। অথচ নবাব সিরাজের বাড়িও যে মুর্শিদাবাদেই ছিল সেকথা অনেকেই বেমালুম ভুলে যান।
মুর্শিদাবাদ বাসীদের যেখানে বিশ্বাসঘাতক কিম্বা বিশ্বাসঘাতকের জেলার মানুষ হিসাবে গণ্য করা হয় সেখানে মীরজাফরের বংশধরদের কী অবস্থা হয়? তাঁরা কী তবে নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখেন? পূর্ব পুরুষদের কর্মকাণ্ডের জন্য লজ্জা পান? নাকি তাঁদের পূর্ব পুরুষদের গায়ে লেগে থাকা 'বিশ্বাসঘাতক' তকমার বিরোধিতা করেন নিজস্ব যুক্তি দিয়ে? চলুন কেল্লায় বসবাসকারী নিজামত পরিবারের কিছু প্রবীণ সদস্যদের কাছ থেকে এই বিষয়ে জানা যাক।
কেল্লায় বসবাসকারী নিজামত পরিবারের সদস্যরা পলাশীর যুদ্ধের অন্যরকম যুক্তি দিয়ে থাকেন। সেই যুক্তি গতানুগতিক যুক্তির চেয়ে অনেকটাই আলাদা। তাঁরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন নবাব সিরাজ উদ দৌলা একজন অবৈধ নবাব ছিলেন। কারণ সিংহাসনে বসার সময় তাঁর কাছে দিল্লীর মুঘল বাদশাহের কোন বৈধ ফরমান বা অনুমতি পত্র ছিলনা। অবশ্য নবাব দিল্লীর ফরমানের তোয়াক্কাও করেননি। অন্যদিকে মীরজাফর ছিলেন দিল্লীর বাদশাহের প্রতিনিধি, জগৎশেঠ ছিলেন দিল্লীর বাদশাহের খুব কাছের মানুষ অথচ সিংহাসনে বসে নবাব এই সব সম্মানীয় ব্যক্তিদের অপমান করেছেন, তাদের লাঞ্ছিত করেছেন।ইংরেজদের সাথে হওয়া মুঘল বাদশাহের বোঝাপড়া নবাব সিরাজ মেনে না নিয়ে ইংরেজদের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের আক্রমণ করে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। পূর্নিয়ার শাসক সিরাজের মাসির ছেলে সৌকত জং ঘসেটি বেগম ও জগৎশেঠের প্রচেষ্টায় বাংলা সুবার নবাবী ফরমান লাভ করলেও সিরাজ তাঁকে অন্যায় ভাবে হত্যা করেছেন।
ইংরেজ কোম্পানি ও জগৎশেঠ উভয়ের সাথেই মুঘল বাদশাহের অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। মুঘল বাদশাহরা তাঁদের সমীহ করে চলতেন, অথচ বাদশাহ অধীনস্থ এক অবৈধ প্রাদেশিক শাসক তাঁদের ক্রমাগত অপমান করেন এবং তাঁদের কাজে বাঁধা দেন। তাছাড়া সৌকত জং কে ফরমান দিলেও সেই ফরমান না মেনে সিরাজ বাদশাহর মনোনীত নবাবকে হত্যা করলে বাদশাহ সিরাজের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। এক সময় বাংলার সিরাজ বিরোধী গোষ্ঠী সিরাজের বিরুদ্ধে মুঘল বাদশাহকে অভিযোগ জানালে তিনি তাঁর প্রতিনিধি মীরজাফরের কাছে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করেন এবং এই অবাধ্য অহংকারী নবাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাকে ক্ষমতা চ্যুত করার আদেশ দেন।
আসলে নবাব সিরাজ যে সবার জন্যই বিপদজনক হয়ে উঠেছিলেন সে কথা সিরাজ তাঁর আচরণ দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সিরাজকে ক্ষমতা থেকে সরাতে জগৎশেঠ বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন বিশেষ করে সিরাজের বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠী তিনিই যে নির্মাণ করেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু বিরোধী গোষ্ঠী হলেই হবেনা, সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নবাবের বিশাল সৈন্যবাহিনীর কাছে সিরাজ বিরোধী গোষ্ঠী ছিলেন অত্যন্ত অসহায়। কারণ তাঁদের কূটনৈতিক বুদ্ধি থাকলেও কোনো সৈন্যবাহিনী ছিল না, তাই তাঁদের এই অসুবিধের কথা মুঘল বাদশাহকে জানালে তিনিই নাকি তাঁদের পরামর্শ দিয়েছিলেন ইংরেজ কোম্পানির সৈন্য ভাড়া করার জন্য।সেই সময় ইংরেজ কোম্পানি মোটা টাকার বিনিময়ে তাঁদের প্রশিক্ষিত সেনা বাহিনী ভাড়া দিত।তাই সিরাজ বিরোধী গোষ্ঠী বাদশাহের পরামর্শ মতো ইংরেজ সৈন্য ভাড়া করেছিল। অন্যদিকে ইংরেজদেরও নবাবের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষোভ ছিল এই সব কিছুর ফলশ্রুতিই হল পলাশীর যুদ্ধ।
নবাব পরিবারের বহু সদস্যরা অভিযোগ করেন যে শুধুমাত্র মীরজাফরকেই বিশ্বাসঘাতক বলা হয়ে থাকে অথচ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল জগৎশেঠ ও ঘসেটি বেগম সহ অনন্যারা। মীরজাফরকে অনেক পরে তাঁদের দলে নিয়ে আসা হয়েছিল। কারণ সিরাজকে ক্ষমতা থেকে সরালে একমাত্র মীরজাফরই ছিলেন নবাব হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি এবং মুঘল বাদশাহরও এতে সমর্থন ছিল বলে জানা যায়। কারণ মীরজাফর নিজেও ছিলেন মুঘল বংশের মানুষ। মীরজাফর কেনো নবাব পদের যোগ্য ছিলেন? চলুন তবে মীরজাফরের সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
নিজামত পরিবারের কিছু প্রবীণ সদস্যের মত অনুযায়ী মীরজাফর ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর বংশধর। বিশেষ করে হযরত মুহাম্মদ (সা:)নাতি হাসানের বংশধর। কথিত রয়েছে একবার হজ করতে গিয়ে মুঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের সাথে মীরজাফরের দাদু সৈয়দ হুসেন তাবাতাবাই বা হুসেন নাজাফির দেখা হয়েছিল, তখন তিনি ইরাকের কারবালা শহরে অবস্থিত হাসান হোসেনের সমাধির দেখভাল করার দায়িত্বে ছিলেন। বাদশাহ ঔরঙ্গজেব তাঁর পাণ্ডিত্য দেখে তাঁকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারকের পদ গ্রহণের অনুরোধ জানান। প্রথমে তিনি সেই অনুরোধে সাড়া না দিলেও বাদশাহের বহু অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হন এবং ২৪শে এপ্রিল ১৬৭৫ সালে তিনি দিল্লীতে এসে বসতি স্থাপন করেন।
হুসেন নাজাফির ছেলে আহমেদ নাজাফির বিয়ে হয়েছিল ঔরঙ্গজেবের ভাই দারাশিকোর মেয়ের সাথে, তাদের সন্তান হলেন মীরজাফর, মীরজাফরের জন্ম (জন্ম ১৬৯১ সাল) হয়েছিল দিল্লীর লালকেল্লায়। নিজামত পরিবারের কথা অনুযায়ী দিল্লীর বাদশাহ মীরজাফরকে বাংলায় পাঠিয়েছিলেন বাদশাহের প্রতিনিধি হিসেবে। ঠিক যেমন আজকের রাজ্যপাল। মীরজাফরের কাছে সব সময় নিজস্ব সেনাবাহিনীও থাকতো। মীরজাফরের কাজ ছিল নবাবী প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মুঘল বাদশাহকে তথ্য সরবরাহ করা।
অভিযোগ করা হয় যে মীরজাফর বিদেশি শক্তি ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে ছিলেন, তবে তো একথাও বলতে হয় যে, নবাব সিরাজও পলাশীর যুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য গ্রহণ করেছিল, এমনকি পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথমে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, করেছিল ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রের বাহিনীই।
নিজামত পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা জানান যে, অনেকেই মনে করেন যে মীরজাফর বিদেশী শক্তির হাতে দেশকে তুলে দিয়েছিলেন, আসলে এই কথাটি একেবারেই সত্য নয়। মীরজাফর কখনোই দেশকে বিদেশীদের হতে তুলে দেয়নি, কারণ, পলাশীর যুদ্ধের পর মীরজাফর নবাব হয়েছিলেন এবং নবাব মনসুর আলি খান ফেরাদুন জা পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮৮১ সাল পর্যন্ত বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুবেদারি নবাবদের হাতেই ছিল। পরবর্তী সময় কিছু টাকার বিনিময়ে নবাব ফেরাদুন জা নিজ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আর ১৭৬৫ সালে ইংরেজ কোম্পানিকে বাংলা সুবার দেওয়ানী বা রাজস্ব আদায়ের অধিকার মীরজাফর নয় দিয়েছিলেন মুঘল বাদশাহ, এই বাংলা সুবার রাজস্বই ইংরেজদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছিল।
নিজামত পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের মতে মীরজাফরের যদি বাংলার মসনদের উপরে লোভ থাকতো, তবে তিনি আলিবর্দী খানের মৃত্যুর পরই অল্প বয়সের সিরাজকে হত্যা করে বাংলার মসনদে বসতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি বরং সব সময় তিনি সিরাজকেই সমর্থন করে এসেছেন। বিভিন্ন পারিবারিক জটিলতায় সিরাজকে নিরাপত্তা দিয়েছেন, ভরসা যুগিয়েছেন। আসলে অল্প বয়স্ক সিরাজকে মীরজাফরের বিরুদ্ধে ভুল বোঝানো হয়েছিলো কিছু সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে যার ফলে সিরাজ একসময় মীরজাফরকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, এবং সেই অবিশ্বাস থেকেই এক সময় সিরাজ মীরজাফরকে শত্রু ভেবে গৃহবন্দী করে রাখেন। তবে এক সময় সিরাজ নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মীরজাফরের বাড়ি থেকে সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেন। শুধু তাই নয়, সিরাজ নিজে মীরজাফরের জাফরাগঞ্জে প্রাসাদে গিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন তিনি যেন তাঁকে আসন্ন যুদ্ধে সাহায্য করেন। কিন্তু মীরজাফর সেদিন সিরাজকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, "তোমার আচরণে মুঘল বাদশাহ ভীষণ ক্ষুব্ধ। তিনি তোমাকে মসনদ চ্যুত করতে চান তাঁর আদেশেই এই যুদ্ধের আয়োজন করা হয়েছে। আর আমি মুঘল বাদশাহর প্রতিনিধি তাই এই যুদ্ধে তোমার হয়ে লড়াই করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়"। কিন্তু নাছোড়বান্দা সিরাজ সব শুনেও মীরজাফরকে অনুরোধ করেন তাঁকে অংশগ্রহণ করতে হবেনা কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রে মীরজাফরকে তাঁর সাথে সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতে হবে। একথা শুনে মীরজাফর নাকি তাতেই রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু তবুও সিরাজ তাঁর মানসিক প্রশান্তির জন্য এই বিষয়টি আরো মজবুত করতে মীরজাফরকে কোরআনে হাত দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন। নিজামত পরিবারে কথিত রয়েছে, আসলে নবাব সিরাজের মনে পরিকল্পিত ভাবে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে তিনি যুদ্ধে গেলে মীরজাফর তাঁর মসনদ দখল করে নিতে পারেন। তাই এই অদ্ভুত আশঙ্কা থেকেই নবাব মীরজাফরকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
মীরজাফর যেহেতু কোরআনে হাত দিয়ে শপথ করেছিলেন, তাই তিনি সিরাজের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন কিন্তু পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি যুদ্ধ করেননি। মীরজাফরের প্রাসাদে সিরাজ ও মীরজাফরের মধ্যে হওয়া এই চুক্তির কথা হয়তো অন্যরা জানতেন না তাই মীরজাফরের সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রে নীরব থাকার ঘটনা দেখে অনেকেই তাঁকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে ভুল করেছিলেন। যুদ্ধের ফলাফল সিরাজের পক্ষে এলে পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস হয়তো অন্য ভাবে লেখা হতো।
মীরজাফরের বংশধররা জানান, প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী পলাশীর যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন মীরজাফর অথচ এই কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যে। কারণ তিনি প্রধান সেনাপতি হলে তাঁর আদেশ ছাড়া পলাশীর প্রান্তরে সেদিন কিভাবে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল?
তাঁরা আরও বলেন সিরাজ যদি এতোই জনপ্রিয় নবাব ছিলেন তবে পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসার পর নবাব সিরাজকে শহরবাসী রক্ষা করলনা কেন? কেন তাঁকে প্রাণ ভয়ে রাজধানী শহর ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে হয়েছিল? তৎকালীন সময়ের সাধারণ মানুষ সিরাজকে যদি এতই ভালোবাসতো তবে তাঁর বিরুদ্ধে বিজয়ী বাহিনী যখন মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করলো তখন শহরবাসী কেন তাদের বাঁধা দেয়নি সেদিন? কেনো বিশ্বাসঘাতক নবাব মীরজাফরের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদ করেনি?
নিজামত পরিবারের মানুষদের কাছে মীরজাফরের সমর্থনে এমন অজস্র যুক্তি রয়েছে যা প্রমাণ করে মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না। মীরজাফর সত্যিই বিশ্বাসঘাতক ছিলেন নাকি সিরাজ দোষী ছিলেন সেকথা সময় প্রমাণ করবে। তবে একথা ঠিক যে, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে মীরজাফরকে বিশ্বাসঘাতক বলে ঘৃণা করা হলেও মুর্শিদাবাদ শহরে কিন্তু এই ঘৃণার তীব্রতা অনেক কম। বরং মীরজাফরের বংশধরদের শহরবাসী আজও যথেষ্ট সম্মান জানান। আর সম্মান জানাবে নাই বা কেন? শিক্ষা, স্থাপত্য, শিল্প-সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে মীরজাফর বংশীয় নবাবদের প্রচুর অবদান রয়েছে যা মুর্শিদাবাদ বাসী কোনো দিনই ভুলবেনা।