এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  বইপত্তর

  • কেদার ভাদুড়ীর সাক্ষাৎকার (প্রথম অংশ) এবং কয়েকটি কবিতা

    Malay Roychoudhury লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ২৮ নভেম্বর ২০২২ | ১৫৬২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • 1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 | 30 | 31 | 32 | 33 | 34 | 35 | 36 | 37 | 38 | 39 | 40 | 41 | 42 | 43 | 44 | 45 | 46 | 47 | 48 | 49 | 50 | 51 | 52 | 53 | 54 | 55 | 56 | 58 | 59 | 60 | 61 | 62 | 63 | 64 | 65 | 66 | 67 | 68 | 69 | 70 | 71 | 72 | 73 | 74 | 75 | 76 | 77 | 78 | 79 | 80 | 81 | 82 | 83 | 84 | 85 | 86 | 87 | 88 | 89 | 90 | 91 | 92 | 93
    কবি কেদার ভাদুড়ীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরী

    প্রথম অংশ

    (এই সাক্ষাৎকার কেদার ভাদুড়ীর গাঙ্গুলিবাগান-এর একরুমের ঘরে ১৯৯৮ সালে নেয়া। প্রথমে ‘মহাদিগন্ত’ ও পরে ‘বোধ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।  একা থাকতেন, নিজেই রান্না করতেন, বাসন মাজতেন, ছাত্র-ছাত্রী পড়াতেন, রাতে মদ খেতেন আর কবিতা লিখতেন। নাকতলা স্কুলের খ্যাতনামা ইংরেজি-শিক্ষক ছিলেন। বলতেন, সিপিএম বিরোধী বলে ওনার পেনশন আটকে দেয়া হয়েছে। হাত কাঁপতো বলে শেষ দিকে কলম ধরে লিখতে পারতেন না। ছাত্র-ছাত্রীদের বলতেন, লিখে দেবার জন্য। এক ছাত্রীর প্রেমে পড়েন, সে গর্ভবর্তী হয়ে গেলে তাঁকে বিয়ে করার জন্য প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দেন। ছাত্রী-স্স্ত্রীর বয়স তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলের চেয়ে কম ছিল। প্রতিবেশীরা দ্বিতীয় স্ত্রীকে তাঁর নাতনি ভাবতো বলে গাঙ্গুলিবাগানের বাসায় আসতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন; ছাত্রী-স্ত্রী মফসসলের কোনো স্কুলে শিক্ষকতার কাজ পেয়েছিলেন। ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম আর তাঁকে বিয়ে করা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি। আমি আর কবি-সম্পাদক উত্তম দাশ প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা যেতুম কেদারের দশ-স্কোয়ারফুট ঘরে আর তিনজনে মিলে মদ খেয়ে নাচতুম। উত্তম দাশের বাড়িতে ভালোমন্দ রান্না হলে নিমন্ত্রণ পেতেন; মাঝেমধ্যে আমিও পেতুম। এক-কালের উদ্বাস্তুদের মাথা গোঁজার ঠাঁই গাঙ্গুলিবাগান ভেঙে আবাসন উঠেছে। কেদারের জন্ম ১৯২৫ সালের একুশে জুন আর মৃত্যু ২০০২ সালের দোসরা মার্চ। ওনার কাব্যগ্রন্হগুলো পুনঃপ্রকাশিত হওয়া দরকার।)



    মলয় : কেদার, আমি আপনার সাক্ষাৎকার নিওতে চাইছি, এ ব্যাপারটা সম্ভবত বিসদৃশ ঠেকছে আপনার। আপনার আর আমার পাঠকদেরও সেরকম ঠেকবে হয়তো। আমি কিন্তু সাক্ষাৎকারটা নিচ্ছি আমার নিজের কারণেও বটে। এর আগে আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলুম দীপঙ্কর দত্তর। আমি নিশ্চিত যে দীপঙ্করের নাম শোনেনমি। দীপঙ্করও আপনার লেখা পড়েছে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমার। পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্যজগতের শাসক সম্প্রদায় যে একশৈলিক আধিপত্যবাদী অনুশাসন চাপিয়ে দিতে চাইছেন, কেবলমাত্র মিডিয়া-অ্যাকাডেমি-সরকারের মাধ্যমেই নয়, লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমেও, তা কোনো-কোনো কবি সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন। আর তা করছেন যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে। কেননা সমালোচকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজে শেখা বিদ্যায়তনিক জ্ঞানকাঠামোর বাইরে বেরোতে পারেন না বলে কবিরা থেকে যান প্রান্তিক। তাছাড়া সাহিত্যজগতের শাসকদের নিজস্ব বহুবিধ স্বার্থ তো আছেই, বিশেষ করে আর্থিক ও রাজনৈতিক। আমি এসট্যাবলিশমেন্ট বা প্রতিষ্ঠান শব্দটা প্রয়োগ করছি না, কেননা পশ্চিমবঙ্গে ভালগার মার্কসিস্টরা, যাঁরা এতাবৎ প্রচার করে এসেছেন যে ‘গরিব হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো’, তাঁরা আনন্দবাজার প্রাইভেট লিমিটেডকেই প্রতিষ্ঠান বলে চালিয়েছেন।। আমি ব্যাপারটা অতো সহজ বলে মনে করি না। আর আপনি তো আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী নন। প্রতিষ্ঠান আপনাকে ‘ভেন্ন’ করেছে। সে যা হোক। আমার কথাটা বলি। আমি কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ লিখেছি। গোটা পনেরো সাক্ষাৎকার দিয়েছি। কিন্তু সাক্ষাৎকার নেবার চেয়ারটায় বসার অভিজ্ঞতা নেই। এ-ব্যাপারটাও ঝালিয়ে নিতে চাই।  আপনি বয়সে আমার চেয়ে দেড় দশক বড়ো। দীপঙ্কর আমার চেয়ে অনেক ছোটো। আপনার  কিছু বলার আছে? না পরের প্রশ্নে এগোই? 

    কেদার : মলয়, এ পর্যন্ত আমার সাক্ষাৎকার কেউ-কেউ নিতে চেয়েছে কিন্তু নেয়নি। তুমিই প্রথম আমার সাক্ষাৎকার নিতে চলেছ। এতো আনন্দেই ব্যাপার। সুতরাং বিসদৃশ ঠেকবে কেন? আমার? তবে অনেকেরই গা জ্বালা করবে। পেটে খিঁচ ধরবে। কফ নামক এক মুদ্রাদোষে আক্রান্ত হতেও পারে বা। কেননা তুমি শুধু হাংরি নও, অ্যাংরিও বটে। আমার তো তাই মনে হয়। অনুমান, অনুমানই। সত্যিও হতে পারে, মিথ্যেও হতে পারে। দীপঙ্কর দত্তের নাম আমি শুনিনি, তাই নাকি? বহু মাস, বহু বছর ধরে ও তার কাগজ ‘জোরো আওয়ার’ আমাকে পাঠাতো, পাঠিয়েছে। এখন অবশ্য পাঠায় না। তারও কারণ আছে। এখানে বলব? না, এখন বলব না। এসট্যাবলিশমেন্ট বা প্রতিষ্ঠান শব্দ দুটোয় আমো কোনো দিনই পরোয়া করিনি, করিও না। ওরা মানুষ না জন্তু? সে বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। প্রতিষ্ঠান আমাকে ‘ভেন্ন’ করেছে! ছিলাম কখন? ‘দেশে’ এ পর্যন্ত আমার চারটে, মাত্র কবিতা ছাপা হয়েছে। তাতে ‘দেশ’ উদ্ধার হয়ে গেছে বলেই আমার ধারণা। কারণ ওই ‘দেশ’ পত্রিকার এক সংখ্যায় কবি কাম প্রাবন্ধিক জগন্নাথ চক্রবর্তী আমার ও অন্যান্যদের কবিতা নিয়ে অনবদ্য এক আলোচনা করেছিলেন, তা পড়েছি। কথা হলো আমি ওই কবিতা এবং ছাপা হলো না এমন অনেক কবিতাই ডাকে পাঠিয়েছিলাম। বাই পোস্ট। পয়সা খরচ করে। তবে ওই যে বলছ ‘ভেন্ন’ করেছে। ‘ভেন্ন’ কথাটা শুনে আমার খুব মনে-মনে হাসি পেলো। বেড়ে বলেছো। ‘ভেন্ন’! আসলে কী জানো? আমার তো মনে হয় কেউ-না-কেউ বা অনেকেই দাদাদের কাছে গিয়ে চুকলি কেটেছে। এছাড়া তো আমি আর কোনো কারণ দেখিনে। ১৭৮২ সালে রবিনসন বা রবার্টসন, বা ওই রকমই হবে। মনে পড়ছে না ঠিক। তবে সালটা ঠিক। উনি স্টাডি করে বাঙালির দুশো বিরাশিটা নেতিবাচক দিক দেখিয়েছেন। তার মধ্যে চুকলি অন্যতম। এখ আরো দুশো একাশিটি। কি-কি গবেষণা করো গুরু? আমাদের অনেকের ধারণা যে গুরু সব সময়েই বয়সে বড়ো হয়। এক্ষেত্রে নয়। ‘গু’ মানে তো জানো, অন্ধকার। আরো অনেক কিছু হয়, হাগু-টাগু জাতীয়। সেসব বলছি না। ‘রু’ মানে যা অন্ধকার দূর করে বা যিনি অন্ধকার দূর করেন। সেজন্যই তো তোমাকে ‘গুরু’ বললাম। Don’t take it otherwise. এবারে তোমার পরের প্রশ্ন, না ছোটোখাটো এক নিবন্ধে যাই, কেমন?

    মলয় : আপনার জীবন তো বেশ কার্নিভালেস্ক। জন্মেছেন কলকাতায় ১৯২৫ সালের রাবীন্দ্রিক বর্ষায়। পড়াশুনা শুরু করেছিলেন রাজশাহি শহরের জীবনানন্দীয় পাঠশালায়। ১৯৩৯ সালে সুনীল গঙ্গোর ফরিদপুরের কণকদ্বীপে গিয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। মালদায় এসে ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিক দিলেন। কলেজে কোথায় ভর্তি হলেন? মালদাতেই? তারপর ১৯৪৪ সালে নেভিতে যোগ দিলেন, ক্যাডেটদের সঙ্গে আন্দোলন করলেন আর বরখাস্ত হলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান এয়ারফোর্স বেসে দমদমে যোগ দিলেন আণ্ডারক্যারেজ রিপেয়ারার হিসেবে। ১৯৪৮ সালে জয়েন করলেন ব্রিটিশ এয়ারফোর্সে। আট-নয় বছর চাকরি করে সেখানে গোলমাল বাধিয়ে কোর্ট মার্শালে চাকরি হারালেন। এর মাঝে কখন যেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারে ওভারসিয়ার হয়ে গোল্ড মেডালও পেয়েছিলেন। প্রাইভেটে আই.এ. পরীক্ষা দিলেন ১৯৫৭ সালে। ওই বছরেই শেষের দিকে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে ডায়েটিশিয়ানের চাকরি নিলেন। ছেড়ে দ৮ইয়ে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত বেঙ্গল পটারিজে সুপারভাইজারের কাজ করলেন আর তার মধ্যেই বি.এ. পাশ করলেন। ১৯৬৩ থেকে টানা তিরিশ বছর শিক্ষকতা করলেন নাকতলা হাইস্কুলে। ইতিমধ্যে ১৯৬৮ সালে এম’এ. পাশ করেছিলেন। আপনার প্রথম স্ত্রী নমাসে-ছমাসে একদিন আসতেন, কলকাতায় কাজ থাকলে। প্রথম স্ত্রী থাকা সত্বেও নাতনির বয়সী ছাত্রীর প্রেমে পড়ে বিয়ে করলেন, কেননা সে অন্তসত্বা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিও আপনার সন্তানকে নিয়ে আসেন না লোকলজ্জার ভয়ে। পরিবারহীনতা, গাঙ্গুলিবাগানের এই একঘরের ফ্ল্যাটে, যে অবস্হায় আপনি নিজেকে পাচ্ছেন বা রাখছেন, তা কিন্তু আপনার কবিতাকে পেড়ে ফেলতে পারেনি। মনে হয়, পরিবারহীনতা, যোগাযোগহীনতা, স্বজনহীনতা, বন্ধুহীনতা, এগুলো বরং উল্টে আপনাকে আহ্লাদিত করছে, যার দরুণ আপনি অজস্র প্রতিস্ব ক্রিয়েট করে আহ্লাদের একটা কারেন্ট বজায় রাখেন প্রতিটি কবিতায়। আধুনিকতাবাদী অনুশাসনে, যা বোদলেয়ার থেকে শুরু হয়ে টি.এস.এলিয়ট প্রমুখের হাই মডার্নিজমে পৌঁছেছিল, আহ্লাদের অনুমোদন ছিল না। আপনি কিন্তু অবিরাম বজায় রেখে গেছেন প্রতিটি কবিতায়। জীবন যাপনের ঝুঁকি এক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছেন, জেনে বা অজান্তে, নাকি?

    কেদার : আপনার জীবন তো বেশ কার্নিভালেস্ক। ভালোই বলেছ। একবার, একবার কেন বহুবার, বহুজনকে বলেছি, এক বছর সময় দিলাম, বেশিও নিতে পারো, চিন্তাভাবনা করে এমন একটা অভিজ্ঞতার কথা বলো, যা আমার জীবনে ঘটেনি। পারলে পিটার স্কট খাওয়াবো। পারেনি। ‘রাজশাহি’ কেন? হবে তো রাজসাহী। যা আমি লেখেছি সারাটা জীবন। রাজসাহী শহরের স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এই বানানই ছিল এবং আছে। নাটোরের মহারাজা রামজীবনের জমিদারির নাম ছিল রাজসাহী। বিস্তৃতি ছিল ১২,৯০৯ বর্গ মাইল, আর আয় ছিল সিক্কা ২,৭০২,৪০০ টাকা। ভাবো। জীবানন্দীয় পাঠশালা বলছ। কাব্যি করছ? আমার তো পাঠশালার নাম ছিল ‘সাবিত্রী শিক্ষালয়’। তার আগে অন্যান্য পাঠশালায় পড়েছি। এমনকী কাশীতেও, বাঙালিটোলায়, সেই প্রথম। মালদায় কেন? অথচ মালদায়। আসলে চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে ম্যাট্রিক পাস করি। ম্যাট্রিকে স্কলারশিপ পেয়েছিলাম বলে রাজসাহী গভর্নমেন্ট কলেজে ভর্তি হতে হলো। নিলাম  বিজ্ঞান। ওই সময়ে ওই কলেজে কবি উত্তম দাশের মা, মানে মাদার-ইন-ল ভর্তি হয়েছিলেন। তখন আলাপ হয়নি। মেয়েদের জন্য বিরাট বিরাট ব্যারিকেড বসানো হতো ক্লাসরুমে। তাই! এখন  হয়েছে। ‘সুনীল গঙ্গো’ কেন? তেল দিচ্ছ? যাই হোক, আমাদের গ্রামের নাম ছিল, এখনও বোধহয় আছে, কৌড়কদি। কণকদ্বীপ নামক পদার্থটির অপভ্রংশ। ‘ক্যাডেট’ নয়। নেভিতে রেডিও মেকানিক হিসেবে যোগ দিই। আমেরিকান এয়ারফোর্স থেকে যুদ্ধশেষে গোল্ড মেডাল পেয়েছি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে নয়। তারই মুনাফায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাব-ওভারসিয়ার। বছর আড়াই কাজ করে ছেড়ে দিই। লোকে বলে কোর্ট মার্শাল। আসলে রাজনীতির কারণে দিল্লিতে চোদ্দ দিন চোদ্দ রাত জেরায় জর্জরিত হয়ে চাকরি নট। অফিশিয়ালি ডায়েটিশিয়ান নয়। বাস্তবে কিন্তু তাই। শুধু ক্যানসার হাসপাতালে নয়, সেবাসদনেও। দেশবন্ধুর বাড়িতে কাজ করে ঘুষ নেবো? অঢসম্ভব। ভাবনায় আসে না। তাই আবার চাকরি ছেড়ে দিই। ১৯৬৮ সালে কোনো পরীক্ষাই দিইনি সুতরাং এম.এ. পাশ করার প্রশ্নই ওঠে না। আসলে আমি ইংরেজিতে অনার্স এবং ইংলিশ ইন্স্টিটিউট থেকে ড.ই.এল.টি. – ব্যাস। তুমি বলছো ‘পরিবারহীনতা, যোগাযোগহীনতা,স্বজনহীনতা, বন্ধুহীনতা, এগুলো বরং উল্টে আহ্লাদিত করেছে আপনাকে।’ এগুলো সবই একদিকে সত্যি, অন্যদিকে নয়। গোটা পৃথিবীর মানুষজনই, জন্তুজানোয়ার, গাছপালা, বৃক্ষলতা, এরা সবই আমার পরিবারভুক্ত বলেই আমি মনে করি। লোকে অবশ্য পাগল-টাগল এরকমকিছু একটা বলবে। বলুক। বলে-ও। একটা ইন্টারন্যাশানাল আউটলুক না থাকলে প্রকৃত কবি হওয়া যায় না। বিশ্বাস। এই আইডিয়া কিন্তু মোটেই বানানো নয়। সহজাত। মাতৃগর্ভ থেকে উৎসারিত। বিলিভ ইট অর নট। তাইই। তুমি বলছ ‘আহ্লাদ’। আমার কবিতা পড়ে তোমার তাই মনে হয়েছে বোধহয়। আসলে আমি যন্ত্রণায় নীল হয়ে আছি সব সময়। এসব দেখতে হলে একটি তৃতীয় চক্ষু চাই। আমার মনে হয় আমার তা আছে। বৈশিষ্টটা তাই। 

    মলয় : আপনার যৌনজীবন সম্পর্কে নানা কানাঘুষা শোনা যায়। ‘জাস্ট ডু ইট টু মি’ ধরণের অভাবনীয় ঘটনা। এখন তো সত্তর পেরিয়েছেন। একটু স্মৃতিচারণ করুন না, শোনা যাক।

    কেদার : ‘আপনার যৌনজীবন নিয়ে কিছু কানাঘুষা শোনা যায়।’ কবি মাত্রেই এক ধরণের অ-সামাজিক জীব। তাও আবার বাঙালি। তাও আবার যৌন। কানাঘুষা করবে না? স্ল্যাণ্ডারিঙ? জেনে রাখো, হাফ আ ট্রুথ ইজ অলওয়েজ আ গ্রেট লাই। প্রবচন। ভালোবাসা, কবিতা, রোমান্টিকতা ছাড়া এ জীবনে আর কিছু নাই। আমার জীবনে ছেলেরা যেমন এসেছে, মেয়েরাও তেমনি। এখনও আসে। যৌনতা কি জীবন থেকে আলাদা কিছু? এতো আগ্রহ কেন তোমার? কই, আমার রাজনৈতিক জীবন সম্বন্ধে তু কিছুই বলছ না? ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে চাপাই নবাবগঞ্জ শহরটা তিন দিন বস্তুত অধিকার করে রেখেছিলাম আমরা ক’জন স্কুলের ছেলেরা। ধরা পড়িনি। পড়লে ভালো হতো। এখন ফ্রিডাম ফাইটারের পেনশনটা অন্তত পেয়ে যেতাম। অন্তত বেশ কয়েক ডজন পিটার স্কটের বোতল এসে যেত ঘরে। আপসোস করছি না। কিন্তু ঘটনাটা তাইই। একেক দিনে একেকটা কবিতার বই বেরিয়ে যেতো। কলমে, আড়াই ঘণ্টায় সাতান্নটা কবিতা লিখেছি। রেকর্ড। প্রয়াত কবি অশোক চট্টোপাধ্যায় তার কয়েকটা পড়েই মুগ্ধ। পরে আলাপ। খোজারা কি খুব ভালো কবিতা লেখে? কখনও? কবিতা লিখতে হলে বীর্যবান হতে হয় মলয়। বীর্যবান। জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে হয়। তেরোবার, ঠিক তেরোবার, মৃত্যু নামক মাগিটা বুকে হিসসস তুলে বেরিয়ে গেছে। অভাবনীয়ভাবে বেঁচে গেছি, রয়েছি, এখনও। ‘মনে হয়’ কেন? আমি নিশ্চিত। রবার্ট ক্লাইভ দুবার এভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। তৃতীয়বার নয়। তুমি জানো? পরিশেষে বলি। তোমার হয়তো কাজে দেবে। অ্যাডমিরাল রিকোভার, ফাদার অব আমেরিকান নিউক্লিয়ার নেভি, একবার বলেছিলেন, Great minds discuss ideas, average minds discuss events, small minds discuss people. সুতরাং কানাঘুষা যারা করে থাকে তাদের Sexually perverted বললে কি খুব মিথ্যে বলা হবে? ‘কানাঘুষা’কে ইংরেজিতে কী বলে? Hearsay. এবং কোনো আদালতেই  ethical, moral অথবা legal কোনো আদালতেই ধোপে টেকে না। 

    মলয় : টাক পড়ে গেছে বলে ইনহিবিশান আছে? আপনার যৌন এক্সপ্লয়েটগুলোয় অসুবিধে হয়নি টাকের জন্য? আমি তো আমার টাকপড়া চেহারা ভাবতেই আতঙ্কিত বোধ করি। টাকমাথা কবি, কেমন যেন আধুনিকতাবাদী মিসনোমার। অনেকে বলেন যে বয়স অনুযায়ী কবিতাভাবনায় পরিবর্তন দরকার। যেমন কবিরুল ইসলাম বলেছেন যে, আমার কবিতায় যৌনতা থাকাটা এই বয়সে অনুচিত। বয়স অনুযায়ী পালটাতে হবে, এভাবনাটা আধুনিকও নয়, বলা যায় প্রাগাধুনিক। আপনি তো শারীরিকভাবেও, মানে অ্যাপিয়ারেন্সের দিক থেকে, বেশ কিছুকাল যাবৎ কান্তিচ্যূত, কিন্তু যৌনতামুক্ত করেননি নিজেকে, বা করতে পারেননি। নিজেকে নিয়ে ভেবেছেন কখনও এভাবে? কলকাতায় কবিতার রাজনীতির মাঝে সতত নেশাগ্রস্ত কবিরা নিজেদের সম্পর্কে যেটুকু ভাবেন, তা সামনে সাহিত্যসমাজটাকে দাঁড় করিয়ে। আপনি একা নিজেকে অ্যাসেস করেছেন কখনও? আপনার সামনে কেউ নেই, পাঠক নেই, তেমনভাবে?

    কেদার : Euphemism বোঝো না? অতো টাক-টাক করছ কেন? বলতে পারো না, উদাত্তকপাল? আমার যতোদূর মনে পড়ে সক্রেটিসেরও উদাত্তকপাল ছিল। ঈশ্বরচন্দ্রেরও। নেতাজীরও। আমার জানা অন্তত শ’খানেক গ্রেটদের নাম করতে পারি। আসলে উদাত্তকপাল মায়েরই স্নেহভার। উদাত্তকপাল মাতৃকুলজাত। তাকে অবহেলা করি কী করে বলো? কবিরুল ইসলাম কী বলেছেন, তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি জানি, আমার ভিতরে আরেক কেদার বাস করে। তার বয়স কিছুতেই চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়। কমও হতে পারে। তার তো উদাত্তকপাল দেখি না। অভাবনীয়? আর অ্যাসেস? একথাটি বলছো?  আমাদের সাহিত্যসমাজটিকে জানিনে, জানতেও চাইনে। আরে, আমার পাঠক থাক বা না থাক, উত্তম তো আছে, উত্তম দাশ। কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, পি.এইচ.ডি., রিডার। দ্যাখোনি? প্রতি সংখ্যায় আমার কবিতা প্রথমেই ছাপা হয়। এ তার মহত্ব। মহত্বই বলব। আমি বলিনি কখনো। এই তো সন্মান। আর কী চাই? চাই নাকি? নিজেই জানি না। আর ‘কান্তিচ্যূত’ বলছ? তা তো হবোই। কাল সবকিছুই খায়, খেয়ে ফ্যালে। এই হলো জাগতিক নিয়ম। উপেক্ষা করতে পারি। কিন্তু লঙ্ঘন করতে পারি না।  এবং এক মজার কথা হলো – মজার কথাই বলি। ক্লাস টুয়েলভে ইংরেজির ক্লাস নিতে-নিতে সুদেষ্ণা নামে এক মেয়ে, সুদেষ্ণাই বটে। বলেছিলো : ‘স্যার, একটা চোস্ত জিনস পরবেন, একটা ঝকঝকে নতুন। তিন হর্স পাওয়ারের একটা বাইক নেবেন। ঋভালা দেবেন। আমাদের মতো যেকোনো মেয়েকেই পেছনের সিটে তুলে নিতে পারবেন, এখনও।’ আরেকজনের কথা বলি। সেও দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তো, এই কিছুদিন আগেও। বলেছিলো, কথায় কথায় বলেছিলো, ‘মেয়েদের পেতে হলে.স্যার, স্রেফ হরণ করতে শিখতে হয়। মেয়েরা বলুক বা না বলুক, মনে মনে এই চায়, জানেন?’ এতে আমার অবশ্য কিছু যায় আসে না। কিন্তু ওদের মানসিকতা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়। কথাটা পরে ভেবে দেখেছি, ইতিহাসগতভাবে ঠিক। অতো কান্তি-টান্তির দরকার নেই, যা দরকার তা হলো শক্তির। বলো আমি ‘শক্তিচূত’ হয়েছি।

    মলয় :  আপনার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল হাতে লেখা মশাল পত্রিকায় ১৯৩৬ সালে, মানে এবারো বছর বয়সে, সম্পাদক ছিলেন অমিয়কৃষ্ণ সান্যাল।  বাঙালি কিশোরের টিপিকাল অভিব্যক্তি। ১৯৪৯ থেকে রেগুলার কবিতা লেখা শুরু করলেন। বেঙ্গল পটারিজ আর এয়ারফোর্সের হাউস ম্যাগাজিনেও লিখেছেন। তখন তো এখনকার মতন লিটল ম্যাগাজিন ছিল না। ছটফটানি সামলাতেন কোন উপায়ে? আপনার প্রথম বই ‘শুকনো জল’ বেরিয়েছে বহু পরে, ১৯৬৯ সালে। এতো দেরিতে কেন? সম্ভবত এই গ্রন্হের জন্যই আপনাকে ছয়ের দশকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, নইলে একাধবছর পরে বের করলে সত্তর দশকের তালিকায় যেতেন। ছয়ের দশকের যে-দুটি পরস্পরবিরোধী ধারা আছে, কাঠের পা-অলা কবি এবং ঘোড়ার পা-অলা কবির, আপনি বোধহয় তার মাঝের লিংক। ওই ভাঙনের জায়গাটাই নৈতিক-নানন্দনিক জলবিভাজক, আধুনিকতাবাদী মানদণ্ডগুলো ভেঙে ফেলার কাজ আরম্ভ হয়েছিল। আপনার দ্বিতীয় বই ‘পাথরের স্লেট’ ১৯৭৪ সালে, ‘চারপুরুষ এক নারী’ ১৯৮০ সালে, ‘তিন ভূবনের প্রেম’ ১৯৮২ সালে আর ‘এই তো ঠিকানা’ ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপ[র বোধহয় বেরোয়নি কোনো বই। 

    কেদার : প্রথমে কারেক্ট করে দিই। অমিয়কৃষ্ণ সান্যাল নয়। অমলকৃষ্ণ সান্যাল। পরে লেখক অমল সান্যাল। সেন্ট লরেন্স স্কুলের মাস্টারমশায় ছিলেন। প্রয়াত হন ১৯৮৭ সালে। ওনার অনেকগুলো বই আছে। শেষ বই কণকদীপ’। উপন্যাস। পুনাতে থাকতে, সেই ১৯৪৯ সাল থেকে কবিতা লিখতে শুরু করি। গড়ে দুটো করে প্রতিদিন। আজ ১৯৯৯ সালে বছর পূর্তি শুরু করি। এই উপলক্ষে খাওয়াবে না? স্কচ? সত্যি কথা বলতে কি ছাপানোর জন্য ‘ছটফটানি’ কোনোদিনই অনুভব করিনি। এয়ার ফোর্সের কিছু-কিছু বন্ধুদের শোনাতাম। কেউ কেউ কোনো কোনো কবিতায় আবার সুর দিতো হারমোনিয়াম ও তবলায়। ব্যাস, এইটুকুই। ১৯৬৯ সালেও ‘শুকনো জল’ বেরোতো না যদি না নাকতলা স্কুলের ইংরেজির মাস্টারমশায় অশোক ঘোষ উদ্বুদ্ধ করতেন।  তখন পর্যন্ত, জানতাম না বাংলায় কে কে কবিতা লিখছেন। তাদের কাঠের পা নাকি ঘোড়ার পা আছে বা নেই খোঁজই রাখতাম না। রাখার প্রয়োজনও বোধ করিনি কখনও। এই হিসেবে বাংলার কাব্যজগতে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত এই আমি। পরে, ১৯৭১ সালে স্বনামধন্য দেবকুমার বসুর সঙ্গে আলাপ হয়। আলাপ অবশ্য একটু-আধটু এর আগেও হয়েছে। ১৯৭১ সালে গভীর। দুজনে মিলে ‘সমায়ানুগ’ পত্রিকা বের করি। ক্রমে অন্যান্য পত্রিকায় আমার কবিতা বের হতে থাকে। এবং পরিচয়ও হতে থাকে অনেকের সঙ্গে। কিছু-কিছু নাম বলি। উত্তম দাশ, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, পরেশ মণ্ডল, অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়, রবীন সুর, আনন্দ ঘোষ হাজরা, অভিজিৎ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, অতীন্দ্রিয় পাঠক, ঈশ্বর ত্রিপাঠী এবং আরো আরো আরো। আইপারবোলিক হয়ে গেল না। হলো। কিন্তু সেটাও তো ভাষারই অলঙ্কার।  ‘ণেতিক-নান্দনিক জলবিভাজক ও আধুনিকতাবাদী মানদন্ডগুলো ভেঙে ফেলার কাজ আরম্ভ হয়েছিল’। বলেছো। আমি কিন্তু এসবের কোনো খবরই রাখি না। ইহাই আমার কৃতি, প্রকৃতি। আন্দোলনের মাধ্যমে আধুনিকতাবাদী হওয়ার কোনো চেষ্টাই আমার নেই। শব্দই আমার সুর, শব্দি আমার লয়। মন যা বলে তার লক্ষ-কোটি ভাগের একভাগ আজ তক লিখেছি কিংবা লিখে ফেলেছি। শতশত কবিতা চুরি হয়ে গেছে, স্রেরফ চুরি। সহস্র সহস্র কবিতা উইপোকায় খেয়েছে। কোনো ক্ষোভ নাই। কোনো দুঃখ নাই। মহাকালের ঘোড়া আসছে টগবগিয়ে। কোথায় আমাকে নিয়ে যাবে তার হদিশ পাবো না। তবে একটা যন্ত্রণা আছে। লক্ষ কোটি ভাগের একভাগ কেন, তার বেশি নয় কেন, তারই। সেকথা থাক। ‘এই তো ঠিকানা’ বেরোবার আট বছর পরে উত্তম দাশের প্ররোচনায় এবং তারই তত্ত্বাবধানে এবং তৎপরতায় ১৯৯১ সালে বেরোয় ‘নির্বাচিত কবিতা’। এই বই বেরোবার পর আমার খ্যাতি বোধহয় বেড়েই গেছে। বেশ কয়েকটা পুরস্কার পেয়ে গেলাম কিনা, তাই। আলসেমির একটা সীমা আছে। অন্যকে দোষ দিই না, নিজেকেই। প্রতি বছরই আমি একটা করে বই বের করতে পারি। অনায়াসেই। মনে হচ্ছে কপাল খুলেছে একটু, আমার। একজনকে পেয়েছি, ভারি ইনটেলিজেন্ট এবং সুন্দর। আমার প্রাক্তন ছাত্র এবং বর্তমানে বন্ধু। সেই কপি করে দেবে। মনে হয়। নাম অর্ঘ্য বাগচী। বারিন্দির। দেখি কী হয়। দু’হাজার সালে বইমেলায় এবং যদি বেঁচে থাকি, তার পরেও।

    মলয় : আপনার ঘরে খবরের কাগজ বা নিউজ ম্যাগাজিন দেখি না। আপনি কি সংবাদপত্র পড়েন না? বাংলা খবরের কাগজগুলো অবশ্য নিজের নিজের বাস্তবতা বানায়। ‘বর্তমান’ পড়লে সঙ্গে ‘গণশক্তি’ পড়তে হবে। ‘আনন্দবাজার’ পড়লে সঙ্গে ‘আজকাল’ পড়তে হবে। তারপরেও প্রকৃত ঘটনা জানতে পারবেন না। সত্যের মালিকানা কেবল ক্ষমতাধিকারীর। বাচ্চাদের বসে আঁকো প্রতিযোগীতার মতন বয়স্কদের নিজে খবর বানাও প্রতিযোগীতায় টেনে নামায় সংবাদ-মাধ্যমগুলো। তার ওপর কাদের বানান সঠিক আর কাদের ভুল সে আরেক নরক। আপনার কি মনে হয়, সংবাদ মাধ্যমের বানানো হাইপাররিয়্যালিটি  আপনার ইম্যাজিনেশনের জগতে হস্তক্ষেপ করে? নাকি, এমনিই পড়েন না? জাস্ট বোরড অফ এভরিথিঙ। আমার কথা যদি বলেন, আমি সংবাদপত্র আর নিউজ ম্যাগাজিন তো পড়িই, আমি বিবিসি, সিএনএন, জিটিভি, আইআইডাবল্যু, স্টার নিউজ চ্যানেলগুলোও সারফিঙ করি। আপনার তো টিভিটাও খারাপ হয়ে পড়ে আছে দেখলুম। ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক, ডিসকভারি এসব চ্যানেলগুলো দ্যাখেন, নাকি কেবল ‘দূরদর্শন’? আমার তো কেমন সন্দেহ হয় যে আপনি নিজেকে সম্পূর্ণ ব্লক করে নিয়েছেন। হয়তো আপনার কবিতার ফুর্তি বানাতে অমন ব্লকেজ দরকার। কিন্তু সাহিত্যজগতে এই মুহূর্তে কী ঘটছে তা জানার জন্যেও তো প্যারিস রিভিউ, টাইমস লিটেরারি সাপলিমেন্ট, এপিআর, পোয়েট্রি, লন্ডন ম্যাগাজিন ইত্যাদিতে অন্তত চোখ বোলাতে হবে! সাহিত্য সম্পর্কে বিদ্যায়তনিক চিন্তাধারা ওব্দি পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, সমালোচনা ইত্যাদি বিভিন্ন জঁরের আধুনিকতাবাদী, মতান্তরে সাম্রাজ্যবাদী, বৈধতার ও নৈতিকতার ভিত্তিটাই তো বদলে যাচ্ছে। আপনি কি এসমস্তকে পাশ কাটিয়ে যেতে চান। থাকতে চান আপনার ফুর্তিবাজ কাব্যজগতে?

    কেদার : উরিব্বাবা! অনেকগুলো নাম করে ফেলেছো! এর অনেকগুলোর নামই শুনিনি কখনও। তুমি বলছ, সাহিত্য সম্পর্কে বিদ্যায়তনিক চিন্তাধারা ওব্দি পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে। ঠিক। এই পাল্টে যাওয়াটাই তো ভেরি ন্যাচারাল। আমি চাইলেও যাবে, না চাইলেও যাবে। নেচার কে কি কখনও অস্বীকার করা যায়? গেলেও যাওয়া কি উচিত? সারফিং করার জন্য আমার আরেকটি টিভি আছে, তার নাম ‘সময়’। সেই আমাকে সব জানিয়ে দেয়। সবকিছু। আমি তো লিখব শুধু কবিতা। এখন। আগে গদ্যও লিখেছি অনেক। তার অনেকগুলি ম্যানিফেস্টো। কিছু বেরিয়েছিল, বেশ কিছু ‘সময়ানুগ’-এ। আর কিছু ‘ব্যতিরেক’ পত্রিকায়। ‘ব্যতিরেক’ পত্রিকা বিপ্রতীপ গুহ, শুভানন রায় আর আমিই চালাতাম। পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের নাম শুনেছো কখনও? তিনি বলেছিলেন, “খবরের কাগজ একজনকে পাঁঠা করার পক্ষে যথেষ্ট। আমি রামকৃষ্ণদেব নই। খবরের কাগজ কখনো রাখি কখনো রাখি না। আর ‘গণশক্তি’ পড়লে আমার সর্বাঙ্গে র‌্যাশ বেরোয়। তুমি  যাই মনে করো আর তাই মনে করো। সত্যি। বেটাদের সঙ্গে অনেক অনেক অনেক বছর কাটিয়েছি। অভিজ্ঞতার কি কোনও দাম নেই! নাকি? ফুর্তিবাজ জগৎ কেন বলছ?  বারে, বারে। পাঁঠাকে ধরে আড়াই প্যাঁচ যখন বধ করে কসাই তার ছটফটানি লক্ষ্য করেছ কখনও। শালা শুয়োরের জগতে আমি এক পাঁঠা। কলজে থেকে বেরিয়ে আসে এক নিখাদ যকৃৎ। রঙ তার সেই নারীটির মতো। আমি ছটফট করি, কাতরাই, কেউ কিছু খবর রাখে না। কেননা ঘরে থেকেও আমি একা। একাই। আসলে নারীরা ঠিক জলের মতো। বর্ণ নেই। নিমকের মতো। কোনো স্বাদ নেই। স্বাদিষ্ট হয় তখন যখন আমি, আমিই গ্রহণ করি তাকে। ভারতে গান্ধিজি না এলেও, সূর্য সেন না এলেও, নেতাজী না এলেও, বিশ্বাস করি, পরিপূর্ণ বিশ্বাস করি, একদিন-না-একদিন-না-একদিন ভারতবর্ষ স্বাধীন হতোই। তুমি এক ছাগল। এই সম্বোধনে তুমি আবার কিছু মনে করলে না তো? যাকে খুউব ভালোবাসি তাকে মুখ ফসকে বলে ফেলি। এই বিশেষত্ব। এসবের কোনো খবরই রাখো না। আমি যদি সমালোচক হতাম তবে ওইসব ম্যাগাজিনগুলোয় অন্তত চোখ বোলাতাম। আমি যা করি তা হলো এই। ধ্যান। নির্জনতায় ধ্যান। ধ্যান মানে খুব সহজ, আবার কঠিনও। এক জায়গায় বসে মনকে মননশূন্যতায় নিয়ে যাওয়া চাই। কিম্বা যেকোনো একটি দৃশ্যে বা বস্তুতে অপলক অনেকক্ষণ দৃষ্টি রাখা চাই। এরকম বেশ কয়েকমাস অভ্যাস করলেই কে যে শেয়াল আর কেই বা সিংহ মুখ দেখেই চেনা যায়। অদ্ভুত এক শক্তিস্ফূরণ হয় তাতে। ফলে কবিতা বা যেকোনো শিল্পের অবস্হান সর্বকালীন এবং সর্বগ্রাসী হয়ে পড়ে। আমি যে একা থাকি বা থাকতে হয় আমার পক্ষে ও দুটোই — নির্জনতা এবং ধ্যান, বেশ সহজলভ্য। তুমি এসব একটু প্র্যাকটিস করে দ্যাখোই না কী হয়।

    মলয় : কবি-লেখকদের ঘর দেখেছি বইপত্তরে ছড়াছড়ি। আপনার ঘর দেখছি একেবারে ফাঁকা। কড়িকাঠের কাছে তাকটায় যেসব বইপত্র অগোছালো রাখা, তা বোধহয় আপনার রান্নাঘরের ধোঁয়ায় বহুকাল যাবত বোরখা পরে বসে আছে। কিছু বই বোধহয় আপনার নিজের, দপ্তরির প্যাকিঙের মধ্যেই রয়ে গেছে। আপনি বইপত্র সংগ্রহ, রেফারেন্সের জন্য রাখা, পরে আবার পড়া, এগুলো করেন না সম্ভবত। বইটই পড়েন? ব্রিটিশ লাইব্রেরি, ন্যাশানাল লাইব্রেরি, সাহিত্য পরিষৎ যান? লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকরা পত্রিকা পাঠান? আমি কিন্তু বইপত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করি না। পড়া হয়ে গেলে আগ্রহীদের দিয়ে দিই। পাটনায় অবশ্য আমার ভালো ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল।গিন্সবার্গ, জেমস লাফলিন, ফেরলিংঘেট্টি, হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড, কার্ল ওয়েসনার, মার্গারেট র‌্যানডাল, ক্যারল বার্জ, ডিক বাকেন এঁরা অজস্র বই পাঠিয়েছিলেন। আমি লখনউ চলে গেলুম, বাবা-মা মারা গেলেন, তারপর এদেশে দুষ্প্রাপ্য বইগুলো চুরি হয়ে গেল। কলকাতায় যখন ১৯৯৪ সালে মুম্বাই থেকে এলুম, তখন শুনলুম অধিকাংশ বই মেরে দিয়েছিল দাদার এক ভায়রাভাই রঞ্জু ভট্টাচার্য, যেহেতু বই চুরি করাটা আধুনিকতাবাদী সদর্থক মূল্যবোধ। আমাদের উত্তরপাড়ার আদিবাড়িতে বিরাট একটা সিন্দুকে তালপাতার অমূল্য সব পুঁথি ছিল। ঠাকুমা মারা যেতে সেগুলোও হাপিশ। পড়াশুনা অবশ্য ছাড়িনি। লেখালিখির চেয়ে পড়াশুনা আমি বেশি করি। আপনি তো একা থাকেন, পড়াশুনা ছাড়া তো বেশ ভয়াবহ হবে প্রতিদিনের সময় কাটানো। তার ওপর হাত কাঁপে বলে লিখতে পারছেন না কিছু। এ তো চরম দুর্দশা। মোকাবিলা করছেন কী ভাবে? কবে থেকে চলছে? কেনই বা?

    কেদার : আমার একটা নেশা ছিল। বই কেনা। বই কেনা। বই কেনা। কিন্তু ওগুলো কবি উত্তম দাশের মতো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবো সেই প্রতিশ্রুতি আমার ছিল না কখনও, নেইও। তার অনেকগুলি উইপোকায় খেয়েছে। অনেকগুলি, তোমার মতোই, হাপিশ। আবার অনেকগুলো অন্যদের দিয়ে দিয়েছি। উপহার। এখন অবশ্য কিনিনা বিশেষ। খুব কাছেই আমার এক বন্ধু থাকে। সুভাষকুমার মজুমদার। মাস্টারমশায়, বিয়ে-থা করেনি। একা। তারও ওই রোগ। কতো লক্ষ টাকার বই কিনেছে ও-ও জানে না। দরকার পড়লে যেকোনো বই যেকোনো সময়ে যে কোনো মুহূর্তে নিয়ে আসতে পারে।  না থাকলে নিজে কিনে এনে দেয়। এমন। সেদিন চেলেনি পড়লাম। তার ডায়রি। ওই একটা বই পড়লেই ইতালির মধ্যযুগটা, ভয়ঙ্কর মধ্যযুগটা, বেশ জানা যায়। আসলে আমি যেসব বই পছন্দ করি, তা হলো সত্যি সত্যি সত্যি যা তাই। যেমন—ইতিহাস। নেপোলিয়ান অবশ্য বলেছিলেন ‘What is history but a fable agreed upon?’ আবার মজাটা দ্যাখো, আনাতোল ফ্রাঁ বলেছিলেন ‘All the historical books which contain no lies are extremely tedious.’ যেমন ভূগোল, যেমন ভ্রমণ বৃত্তান্ত – মার্কো পোলো, স্টিভেনসন, ক্যাপ্টেন স্কট, কতো আর নাম বলব, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি! যেমন দর্শন, দর্শনের বই। যেমন অটোবায়োগ্রাফি। উপন্যাস ও গল্প একসময়ে অনেক পড়েছি। যেমন টলস্টয়। ডস্টয়েভস্কি। জ্যাক লণ্ডন। অসকার ওয়াইল্ড। এমন এমন অনেক। ডান হাত কাঁপে। বাঁ হাত একটু। কবিতা তো লিখি। ওই বাঁ হাত দিয়েই কাজ সেরে ফেলি। কপি করার জন্য অবশ্য ছাত্ররা আছে। ছাত্রীও। একে চরম দুর্দশা বলছ কেন? কতোজনের তো দুটো হাতই নেই! তারা আবার পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দেয়। দেখেছি। এভাবেই মোকাবিলা। অনেক বছর থেকে। আর ‘কেনই বা’? ঈশ্বরের ‘আশীর্বাদ’ ছাড়া আর কী-ই বা বলি! 

    মলয় : জীবনে প্রথম যে গালাগালটা খেয়ে স্তম্ভিত হয়েছিলেন, সে-ব্যাপারটা একটু বলুন। আমার শৈশব কেটেছে পাটনা শহরের ইমলিতলা নামে এক ক্রিমিনাল এলাকায়, কাহার-কুর্মি-দুসাধ অধ্যুষিত দাগি পাড়ায়। তাই গালাগাল ব্যাপারটায় আক্রান্ত হয়ে ইনোসেন্স মুক্তির অভিজ্ঞতা আমার নেই। আপনি তো রাজসাহিতে ঘোড়ামারা গ্রামে ছেলেবেলা কাটিয়েছেন। প্রথম গালাগালের ধাক্কার তীব্রতা, যা দিয়ে মানবসমাজে আপনার আধুনিকতাবাদী ইনিশিয়েসন হলো, সে-অভিজ্ঞতার কথা বলুন একটু। লেনি ব্রুসের প্রথম শোনা আর প্রথম দেয়া গালাগালের জীবনে ভূকম্পন-ঘটানো একটা লেখা পড়েছিলুম, বছর তিরিশেক আগে। অসাধারণ মনে হয়েছিল। বাঙালি কোনও লেখক বা কবির অমন অভিজ্ঞতার বয়ান কোথাও পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। আপনারটা শোনা যাক।

    কেদার : মহাভারতে কর্ণের চরিত্রে যা-যা বৈশিষ্ট্য ছিল তার অনেকগুলো আমারও। বোধহয়। ভেবে দেখেছি বহুবার, সংখ্যাতত্বের দিক দিয়েও এক। সূর্য ও ইউরেনাসের প্রভাব প্রকট। এখন কর্ণের জীবনটা জানা থাকলে আমার জীবনটাও জানা হয়ে যাবে, অনেকটা। বৃষকেতুকে বধ করে কর্ণ যেমন, আমিও তেমন। ঘোড়ামারাটা গ্রাম নয়, একটা পাড়া, রাজসাহি শহরের। তখনও ক্লাস ওয়ানে উঠিনি। পাড়ার এক ভদ্রলোক আমাকে একদিন– এখন আমাকে যা দেখছো, রূপে, তেমন নয়–এতই ফরসা ছিলাম যে মাকে ডাক্তার ডাকিয়ে পরীক্ষা করানো হয়েছিল, রোগটোগ নয়তো! এতো ফরসা হয় কী করে?---জিজ্ঞাসা করেছিল, খোকা তোমার বাবার নাম কী? এমন অদ্ভুত প্রশ্ন আমি জীবনে শুনিনি। হকচকিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘কেন, বাবা’। বাবার যে একটা নাম থাকতে পারে সে বোধ তখনও হয়নি। অবশ্য এর পেছনে অনেক কারণও আছে। বললে বড়ো গল্প হয়ে যাবে। থাক। একদিন সকালে বাজারের ব্যাগ হাতে বাজার যাচ্ছিলাম। তখন টুতে পড়ি। আমার উল্টো দিক থেকে আমারই বয়সী একটা ছেলে আসছিল। চেনা নয় অথচ চেনা। আলাপ-টালাপ হয়নি কখনও। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ ছেলেটা বলে উঠলো ‘শা-লা’। শুনে আমি স্তম্ভিত। বিস্মিত। কা্ছে কেউ নেই যে ও অন্য কাউকে ও-কথা বলেছে। মুখ দিয়ে ‘শালা’ কথাটা বলা যায়, এ যে কী বিস্ময়, এবং অশ্লীল। মুখের মধ্যেই যে ভগবান থাকেন, এ বোধ অন্তত তখনো ছিল। নইলে গালের ওপর একটি চড়ে পাঁচ আঙুলের স্পষ্ট দাগ ফেললাম কী করে? যা হোক, ছেলেটি কেঁদে ফেললো। আমিও অনেক দূর এগিয়ে গেছিল যখন এগিয়ে গেছি তখনও ছেলেটা ওখানে দাঁড়িয়েই আবার বললে, ‘শা-লা’। আমি শুনলাম, দাঁড়ালাম, ঘুরে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম আস্তে-আস্তে। ও কিন্তু পালালো না। সহজেই পালিয়ে যেতে পারতো। দৌড়ে। আমিও গিয়ে আবার একটা চড়, আরো জোরে। এরকম বারবার তিনবার। ওর চোখে জল, টপ টপ করে ঝরে পড়ছে, এখনও দেখছি। এই চুয়াত্তর বছর বয়সেও। ভাবছি, মেরে কাউকে কিছু শেখানো যায় না। এই শিক্ষাই আমার জীবনে প্রথম শিক্ষা। এখন অবশছ ‘শালা’ কেন, আরো ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর শব্দ স্বচ্ছন্দে বসিয়ে দিই। যেমন 

    ‘সারা দেশ মাগী হলে আমি তবে গডসে হয়ে যাবো।
    গুলি করবি? ফাঁসি দিবি? আয় শালা, গুলি করে দেখ
    রক্তবীজ, রক্তবীজ, ওরে শালা রক্তবীজ আমি’

    এটা একটা সনেটের শেষ তিন লাইন। ছোটোবেলায় ভগবান ছিলাম। এখন ভুত হয়ে গেছি।

    মলয় : আপনি তো একা একা প্রতিদিন মদ খান বলে মনে হয় ল হুইস্কি সম্ভবত। ছয়ের দশকে আমরা যখন খালাসিটোলা, বারদুয়ারিতে মদ খেতে গেছি, তখন কখনও দেখিনি আপনাকে। আমি এখন আর দিশি মদ খাই না। মুম্বাইতে থাকার সামাজিকতার অভ্যাসের দরুন প্রতিদিন দেড় পেগ হুইস্কি খাই। নানান হুইস্কি এসেছে বাজারে। রাতে মদ না খেলে, কিছু একটা করা হয়নি, এরকম ভীতি বোধ হয়কি? মানে, মদ কি অজুহাত হিসেবে খান? অনেক কবি সাহিত্যিক মহলে মাতলামিকে ডিসকোর্স হিসেবে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। অন্যান্য নেশা করেছেন? হার্ড ড্রাগস? ট্র্যান্স, ডিলিরিয়াম, হ্যালুশিনেশানের অভিজ্ঞতা আছে?
    কেদার : বারদুয়ারি! রানি রাসমনির বাড়ির কাছেই। ছয়ের দশকে অবশ্যই কবিতা লিখতাম। কোনো কবির সঙ্গেই আমার আলাপ ছিল না। একেবারেই। তখনও বারদুয়ারিতে গেছি। দুচারদিন। কিন্তু খালাসিটোলা নামটা শুনেছি। ঠেকটা যে কোথায়, জানতাম না তখনও। জানার চেষ্টাও করিনি। কখনও। ১৯৭৪ সালে ‘পাথরের স্লেট’ বেরোবার পর কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত আমাকেওখানে প্রথম নিয়ে যায়।। আরে! ১৯৪৩ থেকে ১৯৭৪ ওই খালাসিটোলার পাশ দিয়ে গেছিও, এসেছি বহুবার। বুঝতেও পারিনি ওখানে এরকম একটা বিরাট ঠেক রয়েছে। আশ্চর্য। ১৯৪৫ সালে আমেরিকান সোলজারদের পাল্লায় পড়ে, কয়েকদিন জিন খেয়েছি, ক্যান বিয়ার খেয়েছি শুয়োরের মাংস ফ্রাই করে। ১৯৪৫ সালের আগস্টে যুদ্ধ তো বন্ধ হয়ে গেলল মহাযুদ্ধ। তারপর দুতিন দিন। দুএক পেগ, ফরেন। যেমন হোয়াইট হর্স, রেড লেবেল। তিন টাকা পেগ। মনে আছে। কেন খেয়েছি? আমার তো মনে হয় মনের মধ্যে প্রেম নামক যে অদ্ভুত জীবটি আছে তারই দুপাশে দুটো ডানা গজানোর ব্যর্থতম প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়। ১৯৫১ সালে যখন শ্রীনগর গেলাম, দেখি মিউল রাম-এর ছড়াছড়ি। তাও ফ্রি। সুতরাং অল ইন্ডিয়া ক্লাসে, যেখানে সব রাজ্যেরই ছেলে ছিল, জমাটি আড্ডা হতো। অফ ডিউটিতে।  সুতরাং ওই শীতের মধ্যেই প্রথমে একটু-আধটু। তারপর পাঁইট পাঁইট। ভুখারিতে, মানে টিনের ফায়ার প্লেসে, মাংস গরম হতো, চাপাটি হতো, প্রায় নরক গুলজার। ১৯৫৬ সালে Fired; চাকরি নেই, মদ খাবো কি! বাপের হোটেল নেই; মদ খাবো কি! দুচারটে বড়োলোকের বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াই। তাও আবার তারা মাইনে দেয় না। উল্টে যায়। বাস ভাড়া। মদ খাবো কি! নেশা যখন ভুলতে বসেছি, তখনই ভুল ভাঙলো। ঈশ্বর আছেন তাহলে। চাকরি মিললো। মিললেও কোনো বন্ধু নেই, কোনো প্রেম নেই, কোনো সম্পর্ক নেই, শুধু দেখভাল করেন ভাগ্য। 

    মলয় : আধুনিকতাবাদী তত্ব অনুযায়ী স্কুল শিক্ষকরা তো মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের কাজ সবাইকে পিটিয়ে একইরকম মানব বানানো। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে স্কুল শিক্ষকরা তো এসট্যাবলিশমেন্ট নামের অক্টোপাসের বিষাক্ত শুঁড়গুলোর অন্যতম। তাহলে আপনার এমন অবস্হা কেন? গাঙ্গুলিবাগানের এই ছোট্ট অন্ধকার ঘরে সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন। শুনছি শাসক বিরোধিতার জন্য পেনশনও আটকে দিয়েছে নাকতলা হাইস্কুল। শৈলেশ্বর ঘোষকে দেখেছি গেটঅলা বড়ো বাড়ি বানিয়েছে দেবদারু গাছে ঘেরা, বইয়ের মলাটে ভিকিরির ছবি থাকলেও পনেরো হাজার টাকা খরচ করে আমাকে গালমন্দ করে পুরো একটা গাঁজাখুরি বই লিখে ফেলেছে আরেক স্কুল শিক্ষক বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে। স্কুল শিক্ষক পপদীপ চৌধুরীকেও দেখেছি রিজেন্ট পার্কের সুন্দর ফ্ল্যাটে এয়ার কাণ্ডিশানার লাগানো; বাংলা-ইংরেজি-ফরাসি তিনটে ভাষার পত্রিকা ‘ফুঃ’ নিয়মিত প্রকাশ করে। সুভাষ ঘোষ সিপিএমের চন্দননগর লোকাল কমিটির সদস্য। কিন্তু আপনার চলেই বা কীভাবে? এরা তো আনন্দবাজারকে এসট্যাবলিশমেন্ট চিহ্ণিত করে সাহিত্য অকাদেমি, বাংলা অ্যাকাডেমি, সিপিএম, লোকাল কমিটি সবাইকে তোয়াজ তদবিরে রেখেছে। আপনি ক্ষমতাকেন্দ্রেরই বিরোধিতা চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনি কি ভাবছেন কথোপকথনের সময়ে যেসব আক্রমণ-আগ্রাস চালাচ্ছেন, সেগুলো মালিক বাহাদুরদের কানে পৌঁছোয় না? সারা পশ্চিমবঙ্গে স্কুল শিক্ষকরা যে আখের গোছানো কোম্পানি প্রায়ভেট লিমিটেড খুলেছে তার শেয়ার হোল্ডার হলেন না কেন? কবি কেদার ভাদুড়ী কী চাইছেন? কী প্রমাণ করতে চান? আত্মনিরুপণের কোন মাত্রা ব্যাখ্যা করতে চান নিজের কাছে, পাঠকের কাছে? নাকি রিজাইনড টু ফেট?

    কেদার : এতোক্ষণে মলয় রায়চৌধুরীকে মলয় রায়চৌধুরী বলে চেনা গেল। তুমি তো জবরদখল কলোনিতে এসে  কয়েক বছর মাত্র আস্তানা গেড়েছ। কী করে জানবে জবরদখল কলোনির মানুষজনের নোংরাতম ইতিহাস? তার মধ্যেই কাটাতে হলো। গাঙ্গুলিবাগানের সরকারি বস্তির এক চিলতে এক ঘরে। প্রায় একচল্লিশ বছর এখানে আছি। কুড়ি টাকা ভাড়া। জাস্ট কুড়ি। তাও আবার দেয় না বা দিতে পারে না ষাট শতাংশ মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকেই অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট কিনেছে, ওঠে না। বাড়ি বানিয়েছে, যায় না। মোটর সাইকেল, স্কুটার, এমনকি মোটর গাড়িও আছে অনেকের। ঘরের সামনে একটা ছোটো বাগান করেছিলাম, হাজার টাকা খরচ করে। বালতি বালতি সিমেন্টের চাঙড় তুলেছিলাম।পরিশ্রম। রঙ লাগিয়েছিলাম। আমার ঘরে তো এর আগে দুতিনবার এসেছো। লক্ষ্য করোনি বুঝি? ওটা এখন একটা ডাস্টবিন। নোংরা ফেলছে তো ফেলছেই। ওখানেই। বোকার মতন বেশ কয়েক বছর টাকা দিয়ে পরিষ্কার করাতাম। এখন বুদ্ধির জল এসেছে মাথায়। কাজের লোককে বলেছিলাম ভেঙেটেঙে তুলে নিয়ে যা। খুঁটিগুলো, কাঠগুলো যা সব আছে নিয়ে যা। নিচ্ছে। কিছু কিছু। বেশ কয়েকদিন পরই দেখবে ফরসা। তবে আমি খুশি। বিশটাকা ভাড়ায় আর কোনো ফ্ল্যাট কলকাতায় আছে নাকি? চব্বিশ ঘণ্টা জল, বিদ্যুৎ। এখন অবশ্য ওই বিশটাকাও সরকার নেয় না। মহানুভবতা নয়। উচ্ছেদের নোটিস দিয়েছে। কিন্তু কেউ ওঠেনি। উঠবেই বা কোথায়? বাড়িভাড়া নিলে হাজার দুয়েক টাকা মাসে-মাসে গচ্চা। আমরা রিফিউজি না! সোজা কথা! এদের নাইনটিনাইন পারসেন্ট লোকও কোনো দিন পূর্ববঙ্গে থাকতে, চারতলা বাড়ি চোখেও দ্যাখেনি। আর ‘কবি কেদার ভাদুড়ী কী চাইছেন’? কি আর চাইবো! দশদিন আর দশরাত্রি সমানে অনশন করেছি ওয়েলিংটন স্কোয়ারে। জেলে গেছি বার বার। আর্মিতেও একবার ঢুকতে গিয়েছিলাম। পালিয়েছি। দুনম্বর এগজিবিশান রোড, পাটনা থেকে। পছন্দ হলো না। পালিয়েছি। ঢ্যাম ঢ্যাম ভি.ভি.আই.পির সঙ্গে সংঘর্ষে এসেছি। প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর টনক নড়ে গিয়েছিল। শত-শর রাজনৈতিক কারণে, তাদের মধ্যে অনেকেই, কেদার ভাদুড়ীর হাল-হকিকৎ জানিয়েছিল। অনেকে বলতে যারা আমাকে চিনতো তাদের কথাই বলছি। আমিই একমাত্র ব্যতিক্রমী পুরুষ যে একজনের নামও প্রকাশকরেনি। করলেও, ‘আর করিব না’ এই বণ্ড লিখে দিলে কর্পোরাল কেদার ভাদুড়ীর চাকরিটা অন্তত বাঁচতো। ‘কেদার ভাদুড়ী কী চাইছেন?’ আমি কিছুই চাইছি না। আমি শুধু আমার মতনই বেঁচে থাকতে চাই। আমাদের ছোটোবেলায় অলিখিত এক অনুজ্ঞা ছিল। একজনের সঙ্গে একজনই লড়তো। রাইট অর রঙ। যে জিততো, মেনে নেয়া হতো। এখন পাঁচশোজন এসে পেটায়। খুন হলে গণপ্রহারে মারা গেছে এইসব বলে। আবার ছাপ দেয়, সমাজবিরোধী। গণপ্রহারের একটা সুবিধে আছে। মামলা-টামলা হয় না। এখানে আমি অন্তত বিশ-বাইশজনকে খুন হতে দেখেছি। আমিও হতাম। হইনি। অনেকেই চুপিচুপি জ্ঞান দিয়েছে, কেটে পড়ুন মশাই, কেটে পড়ুন। তাও চুপিচুপি। পালানো জিনিসটাই তো শিখিনি কোনোদিন। ফিল্ড মার্শাল মন্টেগোমারির ভাষায় একে বলে A successful retreat. তবুও দ্যাখি কি সুন্দর বেঁচে আছি। সোজাকথা স্পষ্টভাবে বলছি। ভাগ্যদেবীকে মানি। I believe in faith. তবে  fatalist নই। একটা ছোটো ঘটনা বলি। ১৯৬৫ সালে ফাইভে এসে ভর্তি হলো। চোখে পড়ার মতো নয়। সেই ছেলেই দেখি হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় ফার্স্ট হলো। হাফ ইয়ার্লিতে ফার্স্ট হলে তো কোনো প্রাইজ নেই। আমি তাকে হাজরার মোড় থেকে একটা পাঁচ-ছটাকা দামের ফাউনটেন পেন কিনে ক্লাসের মধ্যে উপহার দিয়ে বসলাম। পরের দিনই একঠোঙা লজেন্স ও একটা চিঠি। লজেন্স তো বেটে দিলাম দুটো-দুটো করে ক্লাসের সব ছেলেকে। দেখলাম ওর বাবা একজন মাস্টারমশাই। মেট্রোপলিটান স্কুলের।  ফ্রিডাম ফাইটারও। স্বাধীনতা সংগ্রামী। লিখেছেন, অনেক অনেক কথার মধ্যে একথাও লিখেছেন, “আমি বিশ্বাস করি না সমগ্র ভারতবর্ষেও আপনার মতো আর দ্বিতীয় কোনো মাস্টারমশায় আছেন।” পরবর্তীকালে দেখা গেলো, He never stood second from five to Higher Secondary. নাম অভিজিৎ গুহ। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। বস্তি জেলায়, উত্তরপ্রদেশে। কবি। তার একটা সনেট ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় বেরিয়েছে কয়েক সংখ্যা আগে। এটাকে কি ‘প্রাপ্তি’ বলব না?  এই রকম বেশ কিছু প্রাপ্তি নিয়ে বেঁচে আছি। এখনও। তোফা।

    মলয় : আধুনিকতাবাদী সমাজে ডিসেন্ট অর্থাৎ মতের অনৈক্যকে নষ্ট করার প্রথম অস্ত্র হলেন স্কুল-শিক্ষকরা। যার সঙ্গে মতের মিল হচ্ছে না, সেই বালক-কিশোরকে বাধ্য-বশ্য করেন তাঁরা। বস্তুত ইংরেজরা আসার আগে নিল ডাউন বা স্ট্যাণ্ড আপ অন দি বেঞ্চ জাতীয় নির্দিষ্ট অপমানজনক শাস্তি ছিল না। স্বাভাবিক কারণে আধুনিকতাবাদের বিরোধিতায় ছাত্ররা বিভিন্ন উপায় বের করে ফেলেছে যাতে বাধ্য-বশ্য হওয়া প্রতিরোধ করা যায়। তাছাড়া শিক্ষরাও যে উত্তরআদর্শবাদী জীব, তার পরিচয় তারা পাচ্ছে অহরহ। মানব জীবনে বালক-কিশোরের প্রবেশকালীন এই সমস্যাকে কী ভাবে ট্যাকল করেছেন? কোনও কবিতায় এই টেনশনটা দেখলুম না তো!  নাকি কবিতার জগতকে এই এলাকাটার বাইরে রাখতে চেয়েছেন? কিন্তু কবিতার জগত তো কফিহাউস, মিডিয়া দপতর বা লিটল ম্যাগ আড্ডা নয়। আপনি তো বাংলা-ভাষাভাষি জগতের অধিবাসী। বাংলাভাষা জগতটাই তো আপনাকে পড়ছে অবিরাম। বাঙালির ভাষা-ব্রহ্মাণ্ডে শিক্ষক ও কবি কেদার ভাদুড়ী তো জীবনের অধিকাংশ তেজ আর সংসাধন খরচ করেছেন। তাহলে?
    কেদার : তুমি আর কয়টি কবিতা পড়েছ আমার? দুশো? পাঁচশো? তার বেশি কখনই নয়। আমার কবিতার সংখ্যা কতো তা আমি নিজেই জানি না। বারো-চোদ্দো-পনেরো-আঠারো হাজার তো হবেই। তাহলে? ট্যাকল করেছি ভালোবাসা দিয়ে ও বন্ধু হিসেবে মিশে। শাস্তি দিইনি তা নয়। ঢ্যামঢ্যাম বড়ো লোকদের ছেলেরা যখন উন্নতনাসা হয়ে থাকতো তখন ক্লাসরুমে এমন পিটিয়েছি যে আলিপুর ক্রিমিনাল কোর্টে আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হলো। কয়েকবার। একটি কেসে, মনে আছে, এক জজসাহেব মন্তব্য করেছিলেন, ‘I am biased. অন্য ঘরে মামলা নিয়ে যান মশাই ল কী করেন? কাপড়ের ব্যবসা? তাই করুন গিয়ে। মাস্টারমশাই পিটিয়েছে বলে মামলা? মাস্টারমশাই ছাড়া আর কে পেটাবে? অ্যাঁ?’ এরকম খুচরো খবর আমি অনেক দিতে পারি। তাহলে?

    মলয় : শিক্ষক-অধ্যাপকদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যায়। মানে, কবি-লেখকদের কথা বলছি আমি। তাঁরা অনেকেই, নিজেকে, পাঠকদের, আর ছাত্রদের ঠকান। যেমন ক্লাসরুমে জসীমুদ্দিন, গোলাম কুদ্দুস, কুমুদরঞ্জন প্রমুখের পক্ষে ভ্যালু-জাজমেন্ট দেন, আর লেখার সময়ে বা নিজের লেখার বৈধতা প্রমাণের জন্য ওনাদের নান্দনিক মূল্যবোধের বিরোধিতা করেন। যে শিক্ষক-অধ্যাপকরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী ঘোষণা করেন, তাঁরা সিপিএমের সভায় হাত তুলে-তুলে ইনক্লাব জিন্দাবাদ চেল্লান। অনেকে নিজেদের লেখাকে বলেন আণ্ডারগ্রাউন্ড সাহিত্য, আর সরকার বা অকাদেমির ল্যাজ ধরের তরে যাবার তালে থাকেন। অনেকে ক্লাসে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের জয়ধ্বনি করেন অথচ বাইরে পাঠকদের কাছে এঁদের ডাউনগ্রেডিঙ করেন। বুদ্ধদেব বসু এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ওনার ‘সাহিত্যচর্চা’ প্রবন্ধে উনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন, “সত্যি বলতে, মাইকেলের মহিমা বাংলা সাহিত্যের প্রসিদ্ধতম কিংবদন্তি, দুর্মরতম কুসংস্কার। কর্মফল তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে ভুল স্বর্গে, যেখানে মহত্ব নিতান্ত ধরে নেওয়া হয়, পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। আধুনিক বাঙালি পাঠক মাইকেলের রচনাবলী পড়ে এ-মীমাংসায় আসতে বাধ্য যে তাঁর নাটকাবলী অপাঠ্য এবং যে-কোনও শ্রেণীর রঙ্গালয়ে অভিনয়ের অযোগ্য, ‘মেঘনাধবধ’ কাব্য নিস্প্রাণ, তিনটি কি চারটি বাদ দিয়ে চতুর্দশপদী পদাবলী বাগাড়ম্বর মাত্র, এমনকি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যেও জীবনের কিঞ্চিৎ লক্ষণ দেখা যায় একমাত্র তারার উক্তিতে।” এগুলো কোনও ছাত্র পরীক্ষার খাতায় লিখলে আপনারা তাকে নির্ঘাত ফেল করিয়ে দেবেন। শিক্ষক-অধ্যাপক কবিদের এই ডুয়ালিটি বা চরিত্রে কারচুপি কেন? নিজের সমাজ আর নিজেরকবিতাকে তাঁরা কি একই জ্ঞানপরিধির অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না। মাইকেল আর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আপনার অবস্হান?
    কেদার : মাইকেলের জীবনধারা আমার ভালো লাগে। গুরুর সঙ্গে গোমাংস খেতেন কিনা জানি না, ওল্ড মিশন চার্চে ধর্মান্তরের ব্যাপারটাও মেনে নিতে পারি। একদিক থেকে। রেবেকাকে ছেড়ে হেনরিয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে আসাটাও। ইংরেজি ভাষাটা ভালোই শিখেছিলেন। ট্যালেন্টেড নিঃসন্দেহে। স্কুলে, কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ওঁর বই পড়ানো না হতো, বাই ফোর্স, তবে কয়জন বাঙালি পকেটের টাকা খরচ করে বই কিনে পড়তেন জানি না। পয়ারকে ব্ল্যাংকভার্সে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সনেটকে বাংলা সাহিত্যে আমদানি করেছিলেন। প্রথম। মানতেই হয়। দুতিনটে সনেট ছাড়া আর সবই অপাঠ্য। বিদ্যাসাগরমশাই না থাকলে, প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর, কী যে ওতো বলা যায় না। এবারে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। কবিতা? আট-দশটা। গানে? সারা জীবন ডুবে থাকা যায়। সারাটা জীবন। গল্পে? তুলনাবিহীন। গীতাঞ্জলিতে ওঁর নোবেলপ্রাপ্তি, এখনও আমার লজ্জা হয়। গল্পেই পাওয়া উচিত ছিল। ওঁর ভাষাজ্ঞান অসাধারণ। ভাষাগত জ্ঞান, তাও অসাধারণ। গরুকে গোরু প্রথম লিখেছিলেন বলে কি যাতনাই না সহ্য করতে হয়েছিল। বাংলা ছন্দে কেউ আর ওঁর পদধূলিরও যোগ্য নয়। নির্মাণেও তাঁর কৃতিত্ব, ভাবতে বসলে আমার ব্যকরণ ভুল হয়ে যাবে। সুতরাং গুরু থেকে গুরুদেবে উত্তরণ যথার্থই। ওই সময়। ওই স্হান। ওইসব পাত্রমিত্র। ওই স্বর্ণসিংহাসনে অবস্হান করতেন বলেই, বুঝে নাও, দ্বিতীয়বার বিবাহের দিকে যাননি। এটা আমার ব্যক্তিগত মত। তাছাড়া মননে কি কাদম্বরী দেবী ছিলেন না? ‘তুমি কি কেবলি ছবি। শুধু পটে লিখা?’ ‘দ্রুত হাঁটছে, পা রয়েছে স্হির।’ এ ধরণের কবিতা কি লিখতে পারতেন না? আসলে ভয়। সিংহাসনচ্যূতির ভয়। ভয়ানক।

    মলয় : আপনার ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইটার ভূমিকায় বছর দশেক আগে উত্তম দাশ লিখেছিলেন যে, আপনি একজন প্রতিভা এবং এই জন্য অবহেলিত ও অবাদৃত যে, বঙ্গভূমিতে প্রতিভার বিচার ঠিক মতন হয় না। উনি এও লিখেছিলেন যে, এমন একদিন আসবে যেদিন আপনার দিকে সিংহাসন এগিয়ে দেয়া হবে। কারণ হিসেবে উনি লিখেছিলেন, ওনার কথাই বলছি হুবহু, “বাংলা কবিতায় নিজস্ব এক পঠনভঙ্গীর প্রতিষ্ঠা কেদারের স্বকীয়তার দান। তাঁর নিজস্ব উচ্চারণ গেঁথে থাকে, যাকে শব্দবন্ধ বাক্যবিন্যাস থেকে আলাদা করা যায় না; করলে তাঁর কবিতার রহস্যই যেন হারিয়ে যায়। এজন্যে এক বিশেষ ভাষাভঙ্গী আবিষ্কার করেছেন কেদার। বাংলা কবিতার শব্দবন্ধের প্রায় বিপর্যয় থেকেই পপতীত হয় এক ভিন্ন জাতীয় অর্থবোধ।” সত্যি বলতে কি প্রতিভা জিনিসটা যে ঠিক কী, এবং কবিতা লেখার সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে কিনা, ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আপনি অবহেলিত আর অনাদৃত সিম্পলি বিকজ আপনি আধুনিকতাবাদের প্রধান নির্দেশ মানছেন না একেবারেই। আধুনিকতাবাদী অনুশাসন অনুযায়ী প্রতিটি কবিতাকে হতে হবে একশৈলিক আর্টপিস বা শিল্প এবং তার জন্য রচনাটিকে হতে হবে গম্ভীর এলিটিস্ট একটি একক, তার সুস্পষ্ট আদি-অন্ত লজিকাল লিনিয়রিটি থাকবে। আপনি প্রতিটি কবিতাকে উপস্হাপন করছেন বাচনিক যৌগ হিসেবে, যার আদি কোনও এক অস্পষ্ট কালখণ্ডে থেকে থাকবে। প্রতিটি কবিতার প্রথম পংক্তি এবং সেই অতীত অজানা ঘটনার অনিশ্চয়তার মাঝে তৈরি স্পেসটায় পাঠককে ঠেলে দিচ্ছেন আপনি। হিন্দুদের দেবী-দেবতারা যেমন জয়দেব বা বড়ু চণ্ডিদাসের সময়ে মন্দিরে অধিষ্ঠানকালে ছিলেন আদিহীন-অন্তহীন, কিন্তু ইংরেজ আর মার্কিনীরা তাঁদের উপড়ে বা মুণ্ডু কেটে নিয়ে গিয়ে সংগ্রহালয়ে আর্টপিস বানায়। আপনি তো সীমা লঙ্ঘন করছেন, নান্দনিক সীমাকে অস্পষ্ট করে দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনার কবিতার শিরোনাম দিয়ে কবিতার কেন্দ্র বা বিষয় চিহ্ণিত হয় না। মানে, শিরোনামটা কবিতার টাইটেল হোল্ডার নয়। যার দরুণ পাঠক প্রথম পংক্তির পরও প্রবেশপথ খুঁজে বেড়ায়। আপনার ১৯৬৯ সালে পপকাশিত ‘শুকনো জল’ থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি কবিতার আদরায় রয়েছে বৈশিষ্ট্যগুলো। এ-ব্যাপারে আপনি ভেবেছেন কিছু? ভাবার দরকার মনে করেছেন? আমার কথা যদি বলেন, আমি নিজেকে অবহেলিত বা অনাদৃত মনে করি না। কারণ আমি একজন OUTSIDER.

    কেদার : আমি যখন কবিতা লিখতে শুরুকরি, তার হাজার বর্গমাইলের মধ্যেও এমন কেউ ছিল না যার কাছ থেকে আমি অণু-পরিমাণ গাইডেন্স পেতে পারি। আমার তখন ২৪ বছর বয়স, ১৯৪৯ সালে। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমি শুধু আমার মতো করেই লিখে গেছি। আমার মতো মানে আমার মধ্যে আর এক ‘আমি’ আছে। আসলে সেই লিখতো। মনে হয়েছিল, এখনও হণ, যে, আমি মানুষটা তিন জনের মিশ্রণ। বুগোর জাঁ ভালজাঁ, ডিকেন্সের কপারফিল্ড আর শরৎবাবুর ইন্দ্রনাথ। সুতরাং অভিজ্ঞতা এবং যন্ত্রণা কতো গভীর এবং কতো বিস্তৃত হতে পারে, ব্যাপক, কল্পনাও করতে পারবে না এমন একজন বাঙালি আমি। শিল্প হলো কি হলো না, আধুনিকতাবাদের প্রধান নির্দেশ মানছি কি মানছি না, এসবে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। ছিলও না। কোনোদিন। আমি কি নিজেকে অবহেলিত বা অনাদৃত মনে করি? একেবারেই না। আমারই কবিতা অন্যের নামে ছাপিয়ে দিয়ে দেখলাম, কাব্যগ্রন্হটির মধ্যে ওটাই, সমালোচকদের মতে, ওটাই দ্য ভেরি বেস্ট।এরকম আরো একটা। একটি মেয়ের নামে শতকার ৯৯.৯শতাংশ লেখা একটা কবিতা পাঠিয়ে দিয়ে দেখি বড়ো বড়ো ম্যাগাজিন থেকে সম্পাদকদের বিনীত অনুরোধ আসছে, এই তো লেখা! এমন লেখা চাই। চাই-ই। অনেক কলেজের অধ্যক্ষরা জানিয়েছেন, লিখিত জানিয়েছেন, ভাদুড়ী ইজ গ্রেট, শিয়োরলি গ্রেট। চাকরি ছেড়ে দিয়ে আপনার পেছনে চব্বিশ ঘণ্টাই আমার ঘোরা উচিত, জানা উচিত কী করে লেখেন এসব কবিতা! ভারত কাঁপানো কোনো পুরস্কার পাইনি বটে, শত শত ছেলের ভালোবাসা পেয়েছি। কবিতায় আকৃষ্ট করেছি। এও কি কম কিছু? আমি মনে করি কোনো কবিতারই কোনো শিরোনাম যথাযথ হতে পারে না। নাম্বার দেওয়া উচিত। শেক্সপিয়র যেমন দিয়েছেন ১,২,৩…। নামও দেওয়া উচিত নয়। গাড়িতে যেমন নাম্বার থাকে অনেকটা তেমনি। কে শক্তি, কে সুনীল, কে জয়, কে মলয়, আর কেই বা উত্তম কেউ জানলো না। বোঝা যেতো তখন ব্যাপারটা। আর পঠনভঙ্গীর কথা? এমন সব কবিতা আছে আমার, আমি ছাড়া আর কেউ ঠিক মতো পড়তে পারবে না। পারে না। দেখেছি। একবার ঋষিণ মিত্র আমার এক কবিতায় সুরারোপ করেছিল। তখন বুঝেছি কবিতাও মার্ডার হতে পারে। বলিনি, কিছুই বলিনি। কেননা এমন কোনো আদালত নেই যেখানে এই খুনের মামলার বিচার হবে। একটা কবিতা যখন একবার পড়েই লোকে বুঝে যায় তখন বাঁদরামির নীল ইতিহাস আমার জানা হয়ে যায়। এছাড়া আর যা-যা বলছ, মানছি। আসলে কবিতা তো মেয়েমানুষ। যদি সুন্দরী হয় তো কথাই নেই। হাজার দৃষ্টিকোণ থেকে হাজার লোক হাজার ভাবে নিতে পারে। নেয়ও। তাই না?

    মলয় : আধুনিকতাবাদী অনুশাসন অনুযায়ী প্রতিটি কবিতার একটি বিষয়কেন্দ্র থাকা দরকার, অনেকটা সাম্রাজ্যবাদে সম্রাটের মতন, বা রাষ্ট্রের রাজধানির শাসনের মতন। তার ভাব, অর্থাৎ ক্ষমতাকেন্দ্রটির ভাব, এমন হবে যে তাকে সম্প্রসারিত করা যাবে, সাম্রাজ্যবাদের বা নয়া-ঔপনিবেশিকতার বিস্তারের মতন।এই ভাবটি আবার অপরিবর্তনীয়, সব্বাইকে তা মেনে নিতে হবে, শাসকের হুকুমের মতন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিরোনামটির সাহায্যে আধুনিকতাবাদী কবি তাঁর ক্ষমতাকেন্দ্রটি চিহ্ণিত করতেন, সম্রাটের মুকুট বা দেশনেতার হোয়াইট হাউস-ক্রেমলিনের মতন। আপনার কবিতায়, অধিকাংশ কবিতায়, অমন বিষয়কেন্দ্রের উপস্হিতি নজরে পড়ে না। দ্বিতীয়ত, কবিতার যেটুকু ভাব আঁচ করা যায়, তার সঙ্গে শিরোনামের মিল সচরাচর খুঁজে পাওয়া যায় না। তৃতীয়ত, প্রকরণকৌশলের ফুর্তিবাজ বাচনিকতার কারণে, ভাবের ওটুকু রেশও ডিসপ্লেসড হয়ে যায়। অর্থাৎ, চালু সার্কলে আপনার স্বীকৃতি না পাওয়ার এ-ও এক কারণ। কেননা, কবিতা যে ভাববিশেষের যৌক্তিক রূপ হিসেবে না-ও উপস্হিত করতে পরেন কবি, আর কেন্দ্রটির বহুবিধ ট্যানজেন্ট রূপে তাকে গড়তে পারেন, তা আপনি কবিতার পর কবিতায় দেখিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তা সত্বেও আধুনিকতাবাদীরা আপনাকে শৈলীনির্মাতা বলে মানছেন না। শৈলী বা ব্র্যাণ্ডিঙ -এর শিরোপা এই জন্য দেয়া হচ্ছে না যে, একটা কবিতা, পাঠকের কাছে ওয়ান মর্সেল ভোগ্য কমোডিটি হয়ে উঠতে পারছে না। কমোডিটি না হলে ব্র্যান্ডিঙ হয় না। জানি না এ-ব্যাপারগুলো ভেবেছেন কি না। মঙ্গলকাব্য বা পদাবলী রচয়িতাদের ব্র্যাণ্ডিঙ সম্ভব ছিল না। লক্ষ্য করবেন যে তাঁদের কাব্য ইষ্টদেবতায় নিবেদিত বা কোনও দেবী বা দেবতার স্বপ্নাদেশে লেখা। রচনার অথরিটির উৎস ছিলেন সেই দেবী বা দেবতা, লেখক নিজে নয়। আধুনিকতাবাদে লেখক  হয়ে উঠলেন নিজেই নিজের লেখার অথরিটি। মানে, একটা কবিতার বিষয়কেন্দ্রের, যে কেন্দ্রটি থেকে আবার উৎসারিত মানে অপরিবর্তনীয়, তার নিয়ন্ত্রণকারী হয়ে উঠলেন। আধুনিকতাবাদী কোকেন হেরোইনে অভ্যস্ত পাঠক বা সমালোচক, যদি দেখেন যে তাঁর কাঙ্খিত কেন্দ্রটি নেই, তাহলে আপনার কবিতা সম্পর্কে মিডিয়া-অকাদেমি-সরকারের কর্তাদের উইথড্রল সিম্পটমকে দোষ দেয়া যায় না। কেন্দ্রটিকে শক্ত-সমর্থ করার জন্য পংক্তির পর পংক্তি বসিয়ে রেললাইন বরাবর কবি লজিকালি শেষ পংক্তিতে পৌঁছোন। সাধারণত আধুনিকতাবাদী কবিতায় সেটাই টারমিনাস। আপনার কবিতা সেভাবে টার্মিনেট করে না। এমনকি ফুর্তি বজায় রেখে পরের কবিতায় চলে যাওয়া যায়, একের পর এক কবিতায়, আহ্লাদের ব্যাপক গেমপ্ল্যানের দরুন। আপনি এব্যাপারে নিজের দিকটা একটু বলুন।  আমার সঙ্গে অ্যাগ্রি করার দরকার নেই।
    কেদার : ধরো, যারা আছে তারা সবাই মরেছে। ধরো, ওই সময় বা ওরও বেশি, ৫০ কি ৬০, ধরো, আর, যদি আমি আমার অপ্রকাশিত কিছুটাও প্রকাশ করে যেতে পারি তাহলে মূল্যায়ন জিনিসটার তখনি মূল্যায়ন হতে পারে। কবি জীবনানন্দের জীবনে অনেকটা তাই ঘটেছে। আমার বিশেষভাবে ভালো-লাগা একটা কবিতা, ‘আট বছর আগের একদিন’ পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক সুধীন দত্তসাহেব ছাপেননি। বলেছিলেন, ওটা কবিতাই হয়নি। ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর হাত দিয়ে। আর আহ্লাদ বলছ? ফুর্তি বলছ? কই, আমি দেখি না তো! চোখের জলের টসটসানি দেখোনি কি কোনোদিন? আমারই দুর্ভাগ্য! ব্যাস, আমার জবাব হয়ে গেল।

    কেদার ভাদুড়ীর কয়েকটি কবিতা
    হঠাৎ পুস্পিতা
    ………………….
     
    হঠাৎ পুষ্পিতা এসে বললো‌: দেখুন স্যার,
    আমাকে না জানিয়ে অনেকেই প্রপোজ করে, কি করি?
    বললাম‌: করবেই তো
    মেয়েরা প্রপোজিত হবে, তবেই না মেয়ে!
    পুষ্পিতা কি এমনই হয়েছো?
    ভ্রুণ থেকে ভ্রুণাতীত, জন্ম থেকে জন্মাতীত তুমি
    প্রজাপতি আসুক, কী আছে!
    একদিকে প্রজা, অন্যদিকে পতি, দ্বৈতবাদ, সেইতো সুন্দর।
     
    পুষ্পিতা বললো, কি কথা! অনন্য। অন্যতর স্বাদ।
    তখুনি ঘরে ঢুকলো একফালি অন্ধকার, একফালি পোড়-খাওয়া পূ্র্ণিমার চাঁদ।
     
    ___________
     
    চুমো কনজিউমার গুডস্
    ……………………………..
     
    বাবা বলেছিলেন, অত গল্প পড়িস কেন, খোকন?
    সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে মেশ, দেখবি গায়ে গল্প লেখা থাকে।
     
    সেই থেকে আজতক আমি গোগোল পড়িনি
    সেই থেকে আজতক আমি জ্যাক লন্ডন
    সেই থেকে আজতক আমি টেগোরের গল্পগুলো
    চেকভের গল্পগুলো লু শ্যুনের গল্পগুলো মোপাসাঁ ইস্তক।
     
    শুধু একবার চুরি করে ভিক্টর হুগোর গল্প
    সেই-যে-সেই ছেলেটি, দ্বীপের মেয়েটি,জাহাজডুবি……….
    যাচ্চলে, মনে নেই।
     
    মনে থাকে কি কখনো এইসব বাঁদরের, ইঁদুরের গল্প?
    রোমানফ কী বলেন? টলস্টয়? আনাতোল কী বলেন? ডুমা?
    বৃদ্ধ মানুষটি এবং সমুদ্রের গল্প লিখে যে ছেলেটি গুলি খেলো, সেও
    রেমারএ কী বলেন? টুর্গেনিভ কী বলেন? মম?
    খেজুরগাছের দেশে মাদী চিতাবাঘের পাল্লায় টুঁটিকাটা ছাড়া
    উপায় থাকে না।
     
    উপায় কি থাকে না কখনো? আমি শুধু দুটি, দুটি মাত্র স্টেট এক্সপ্রেস খাইয়ে
    রুশী মেয়েটির গায়ে গল্প পেয়েছিলুম, দু’গালে দ? চুমো।
     
    _____________
     
    একটি চুমোর জন্য আমি
    …………………………….
     
    তোমার একটি চুমোর জন্য আমি রাজত্ব ছেড়েছি
    রাঁধুনীকে বলি আমি, আহা গিন্নি রান্নাঘর দেখ
    তোমার একটি চুমোর জন্য আমি সাম্রাজ্য ছেড়েছি
    ধোপানীকে বলি আমি, আহা গিন্নি স্নানঘরে যাও
     
    তোমার একটি চুমোর জন্য আমি সাম্রাজ্য বেচেছি
    চাকরাণীকে বলি আমি, আহা গিন্নি ঘরদোর মোছো
    তোমার একটি চুমোর জন্য আমি রাজত্ব ছেড়েছি
    সেবিকাকে বলি আমি, আহা গিন্নি মাথা টেপো দেখি
     
    তোমার একটি চুমোর জন্য আমি অপমানি হব
    রক্ষিতাকে বলি আমি, আহা গিন্নি আলোটা নিবাও
    তোমার একটি চুমুর জন্য আমি অপমানি হব
    বিয়োনিকে বলি আমি, আহা গিন্নী গর্ভবতী হও
     
    তোমার একটি চুমোর জন্য আমি মৃত্যুমুখি হব
    রাজত্ব সাম্রাজ্য ছেড়ে আমি নরকে পৌঁছবো
     
    ___________
     
    মোহ
    …….
     
    চারিদিকে বৃক্ষ অগুনতি। তারই একটা হেভেনলি ফ্লেইম,
    ফ্লেইম? না ইনফার্নো?এই জেনে এক গুচ্ছ ফুল নিয়ে
    ইন্ডিয়ান লেবার নামের, পাশে লুকিয়ে হঠাৎ……….
    হঠাৎ্ই শুনতে হ’লো সেই স্বর, বাংলায়‌: অসভ্য!বাঁদর!
     
    মাধোরায়, গুর্জরদেশের এই মন্দিরের পাশে
    যে অরণ্য আছে সহস্র শিল্পের, শিল্পের কর্মের,
    নবম কি একাদশ শতকের, আমি শুধু তার
    স্তনের উজ্বল মসৃণতা দেখেছিলুম ব’লেই
    হাত দিয়ে, বাঁ হাত দিয়ে, ছুঁয়ে, মসৃণতা
    দেথেছিলুম ব’লেই শুনতে হ’লো সেই স্বর বাংলায়‌: অসভ্য, বাঁদর!
     
    কিন্তু বাংলায় কেন? গুর্জরদেশের ভাষা ওকি ভুলে গেছে, মেয়ে?
    উৎকল দেশেও তাই, একবার, কোনারক, সূর্যের মন্দিরে,
    বিজয়নগরে, কেশব মন্দিরে, মদনিকা, আর্শিতে যখন
    মুখ দেখেছিলো একা, হঠাৎ তখুনি স্তনে হাত রেখেছিলুম ব’লেই……...
    আহা, মামাল্লাপুরমেও তা। লালচে, কালো, সাদা পাথুরে মেয়েরা
    ভাবতে ভাবতে লজ্জা, না লজ্জা নয়, শরমে মরে যাই শুধু।
     
    কেননা, আমার ভিতরে যে মেয়ে থাকে, চুল বাঁধে, নাচে, গায়
    স্তনে সর মেখে শুয়ে থাকে, উপন্যাস পড়ে, পিয়ানো বাজায়,
    পার্টিতে চিকেন স্যুপ খায়, হরিদ্বারে গিয়ে পিদিম জ্বালিয়ে
    পিতৃপুরুষের দায়ে একবার ভাসিয়েছিলো গঙ্গায়, সেই।
     
    ___________
     
    অনিবার্যকারণবশত
    …………………………..
     
    অনিবার্যকারণবশত
    আমি কাল দিব্য আঁধারে গাছের তলায় দাঁড়াতে পারিনি রাধে।
    বেলগাছে ভূত থাকে, থাকেনা কি? ব্রহ্মদত্যি, এ কথা তো জানা,
    কিন্তু যেটা জানা ছিলোনা তা’হলো তার পক্ক বিম্বাধর ফল, লোভ
    পয়োধরা তুমি, পয়স্বিনী, অববাহিকায় আছো।
     
    থাকো, কিন্তু ক্ষমা করবে তো, বলো? অনিবার্যকারণবশত
    তুমিও তো একদিন এইদিন এতোদিন, আহা—
    অনিবার্যকা-র-ণ-ব-শ-তঃ।
     
    ___________
     
    লিপস্টিক
    …………...
     
    আমি এক গো-পন্ডিতের মতোই বুরবাক।
     
    ছেলেরা চুল কাটে
    মেয়েরা চুল রাখে, কেন?
     
    ছেলেরা ধুতি পরে
    মেয়েরা শাড়ি পরে, কেন?
     
    ছেলেরা দেড় মিটারের জামা পরে।
    মেয়েরা কোয়ার্টার মিটারের
    জামা পরে কেন?
    রহস্য বুঝিনি।
     
    ___________
     
    এইসব ব্রতকথা
    ……………………
     
    এতদিন আমি তাই ছিন্ন কন্থা সোহাগে ভরেছি
    দুধেল ওয়ারে যেন, ভারতীয় রিঠে দিয়ে কাচা।
    কে বানিয়েছিল, বুনেছিলো ঘুঘুসই চিত্র দিয়ে?
    দেবযানী? শাড়ির সবুজ সুতো লাল সুতো নীল
    উঠিয়ে উঠিয়ে? ধৈর্যের পুরাণ থেকে নাদব্রহ্ম
    শুনে শুনঅ? ছুঁচ তার কতবার ফুটে গেছে, ব্যথা,
    আঙুলের অগ্রভাগে রক্তবিন্দু চুষে নিয়ে শে্ষে
    হেসেছিলো মৃদু জ্যোৎস্না, তালপাতা শুয়েছিলো পায়ে।
     
    এইসব ব্রতকথা শতাব্দীর শুরু হ’তে শেষ।
    এখন? চন্দনা নদীটির কাছে কোনো ঘর একা
    দাঁড়িয়ে থাকেনা দেখি, কদলীবৃক্ষের মাথা, ভ্রাতঃ
    দোলেনা বাতাসনির্ভর, বলেনা চন্দনা নদীটি
    কবে বুঁজে গেছে, মেঠো ঘেরি সরে গেছে, মেছুয়ারা
    ভাটিয়ালি ভুলে গেছে, সুজন নাইয়া আজ কই?
     
    ____________
     
    ক্যাপ্টেনের নাম কেন্ রবিনসন
    ………………………………………
     
    বাংলা বলতে জানেন হিন্দিও
    চোস্ত উর্দুতে কথা বললে বোঝাই যায় না
    অ্যাংলো ইন্ডিয়ান
     
    ক্র্যাক পাইলট বলে তাঁর নাম আছে
    এয়ার পকেট পেলেও
    বাম্প করে না তাঁর কাইট—
    ডি.সি. ফোর হান্ড্রেড ফোর
     
    শুক্কুরবারের ফ্লাইটে তাঁর কায়রো যাবার কথা
    মাঝখানে কুয়ায়েত
    নাবতে হবে
     
    কাইটে পেট্রোল ভরা হয়ে গেছে
    থাউজেন্ডস্
    অ্যান্ড থাউজেন্ডস্ অব লিটারস্
    হান্ড্রেড অকটিন
    এখন এখন শুধু
    ফ্লাইং কনট্রোল থেকে সিগন্যাল স্রেফ বাকি
     
    রেডি থামস্ আপ
    একটা টিহি-টিহুউউ শব্দ করে জেট
    ডি.সি. ফোর হান্ড্রেড ফোর উড়ে গেল
     
    তিরিশ নম্বর সীটে তিরিকলাল বললেন
    আপেলের রস
    তেত্রিশ নম্বর সীটে বাচ্চা ছেলেটা
    বমি করল
     
    এয়ার হোস্টেস মিস স্যানিয়াল
    অদ্ভুত তৎপরতায়
    বমি আর আপেলের রস
    সামাল দিয়ে উঠল
     
    ককপিটে তখন কেন রবিনসন
    কো-পাইলটকে বললেন
    হোলড্ দ্য জয়স্টিক
    ড্রাইভ স্ট্রেট অ্যাহেড
    তারপর
    আরব সাগরের সবটুকু ব্লু ক’রে
    স্কাইকে স্কাই ক’রে ফরেনসিক
    ইন্টারকমে বললেন, মিস স্যানিয়াল
    সী মি অ্যাট ওয়ানস্
     
    বমি আর আপেলের রস
    ব মি আ র আ পে লে র র স
    মিস স্যানিয়াল ইন্টারকমেই উত্তর দিলেন
    স্যর, আয়াম অফুলি বিজি, অফুলি……….
     
    তিন মিনিটে তিন ক্যান
    ফরাসী শ্যাম্পেন গলায় ঢেলে
    কেন্ রবিনসন
    গকগক্ করে দরজা খুললেন
    গকগক করে লাফিয়ে পড়লেন
    উইদাউটা প্যারাশুট
    ডি.সি. ফোর হান্ড্রেড ফোর উড়ে গেল
    নিচে নীল সমুদ্র
    সবুজ আয়নার মতো ছড়িয়ে আছে
    দিগদিগন্ত
     
    কেন্ নাবতে লাগলেন
    একটা শকুন এসে বলল
    হাই, মে আই ইট ইনটু ইউ
    কেনের টিউনিক উড়ে গেল
    একটা চিল এসে বলল
    লুক্ দিসিজ হাউ উই সুপ
    কেনের ট্রাউজার্স খুলে গেল
    বাজপাখি যে বাজপাখি
    দ্য ডিউফল হক্
    সেও বলল
    কাম্ অন্, টেক আউট ইয়োর
    আন্ডার ভেস্টস, উইল ইউ
    কেন্ ন্যাংটো হয়ে গেল
     
    সূর্য তখন ডুবুডুবু ডুবছে
    চাঁদ তখন উবুউবু উঠছে
    ঠিক তখনি
    বিশ হাজার ফিট নিচে সমুদ্রের বুকে
    বিশ ফুট জল লাফিয়ে উঠল
    বলল, কাম্ ইন চাম, কাম্ ইন
    দু-ফিট সমুদ্রের তলে
    দুটো সার্ডিন খেলা করছিল
    একজন আরেকজনকে চোখ টিপে বলল
    দেখেছে
    তিন ফিট সমুদ্রের তলে
    তিনটে হেরিং তিনশো মালিক তাড়া করছিল
    একটু দাঁড়াল
    তারপর তার চোখে এইসা ঢুঁ মারল যে
    চোখ গলে গেল
    পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একটা অক্টোপাস
    শুঁড়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল
    আ উইন্ডফল
    পৃথিবীর মাটি
    পৃথিবীর আকাশ জল
    টলটল করলেও
    সময়ে সময়ে টলোমল
     
    পরদিন খবরের কাগজে বরুল
    দ্য পাইলট অব দ্য ডি.সি. ফোর হান্ড্রেড ফোর
    ওয়াজ হাইজ্যাকট ইন দ্য মিড এয়ার
    আমরা ফ্লাইং সসারের কথা
    ভাবতে বসলুম
     
    কেউ জানল না
    কেউ জানল না কেউ
    শুধু আমিই জানলুম—
    দ্য কো-পাইলট
    আমিই জানলুম
    আ উইন্ডফল
    মিস স্যানিয়াল এখন
    আঃ আমিই জানলুম
    আ উইন্ডফল
    ( পরবর্তী অংশ মাসখানেক পর দেয়া হবে )

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 | 30 | 31 | 32 | 33 | 34 | 35 | 36 | 37 | 38 | 39 | 40 | 41 | 42 | 43 | 44 | 45 | 46 | 47 | 48 | 49 | 50 | 51 | 52 | 53 | 54 | 55 | 56 | 58 | 59 | 60 | 61 | 62 | 63 | 64 | 65 | 66 | 67 | 68 | 69 | 70 | 71 | 72 | 73 | 74 | 75 | 76 | 77 | 78 | 79 | 80 | 81 | 82 | 83 | 84 | 85 | 86 | 87 | 88 | 89 | 90 | 91 | 92 | 93
  • বইপত্তর | ২৮ নভেম্বর ২০২২ | ১৫৬২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ফাজিল | 37.12.***.*** | ২৮ নভেম্বর ২০২২ ১৪:৫১514215
  • এটা পড়ে কাঁদব না হাসব ঠিক করতে নারলাম
  • বাদলাপোকারজ্ঞান | 110.226.***.*** | ২৮ নভেম্বর ২০২২ ১৭:১৫514217
  • সিজারিয়ান না নর্মাল ? সিজারিয়ান হলে হাসুন । নর্মাল হলে কাঁদুন । নাড়াবার দায় নার্সের ।
  • কেদার ভাদুড়ী | 136.226.***.*** | ২৮ নভেম্বর ২০২২ ১৯:৩৩514219
  • আরে, ইনি তো আশ্চর্য লোক, কাল্টিভেট করতে হচ্ছে। 
  • লেহালুয়া | 110.226.***.*** | ২৮ নভেম্বর ২০২২ ১৯:৩৫514220
  • এক বা আরও বেশি ব্যক্তি-এর একটি আর্ট হতে পারে
  • Ranjan Roy | ২৯ নভেম্বর ২০২২ ২১:৫৮514252
  • মলয়বাবু,
    আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
    ১৯৬৬-৬৭ তে আমি কেদার ভাদুড়ি মশাইয়ের অন্যতম প্রিয় ছাত্র ছিলাম। অনেক আশকারা দিয়েছেন। ইংরেজি ভাওনারষায় দখলের কিছু ইশারা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি শিখেছিলাম কবিতাকে ভাল লাগাতে, ভালবাসতে।
    হাতে লেখা একটি কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন -- 'ইচ্ছে করে তামাক পাতা বুনে দিয়ে যাই'। পরে একটি লিটল ম্যাগে বেরোলে কপি দিয়েছিলেন।
    আবার সিপিএমের ইলেকশন সভায় ভিয়েতনাম নিয়ে একটি কবিতা পড়েছিলেন। সেটা আমাদের শুনিয়ে বললেন -- ওদের কেমন ভেবলে দিলুম বল!
    একটা জিনিস আমাদের চোখে লাগত। গাট্টাগোট্টা ঢিপ কপালে কেদার স্যার অনায়াসে মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতেন, এমনকি এক সহকর্মীর বাড়িতে বসে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও।
    একটু কি জেলাস হতাম?
    তারপর আমি কোলকাতা ছেড়ে ছত্রিশগড়ের গাঁয়ে। তখন কয়েক দশক বাংলা সাহিত্য পড়া হয় নি। একবার দেশ পত্রিকার বিজ্ঞাপনে চোখে পড়ল ওনার কবিতার বই বেরিয়েছে --" শুকনো জল"। এরপরে চোখে পড়ল নির্বাচিত কবিতা।
    ভাবলাম কোলকাতা গেলে তাঁর বাড়ি যাব পিটার স্কচ নিয়ে। কিন্তু ওনার বয়েস যে আজ ৯৭!
    ব্রহ্মপুরের অনুজ কবিবন্ধু বিকাশ গণ চৌধুরি জানাল উনি গত হয়েছেন অনেক দিন। ওনার কবিতা সংকলন এখন কোন বইয়ের দোকানে পাওয়া যায় না। কিন্তু কবি দেবারতি মিত্র তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বিকাশকে দিয়েছেন কেদার ভাদুড়ির দুই খণ্ড নির্বাচিত কবিতা। বলেছেন -- খুব বড় মাপের কবি, মন দিয়ে পড়বে।
    আমি পেয়ে যাব জেরক্স করা ওই দুটি বই আর কবিতা পড়তে গিয়ে মনে পড়বে আমার সহপাঠিনীর হাত ধরে ওঁর চশমা পরা ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখে মুচকি হাসি -- কী দাদ্দা! কেমন চলছে?
  • Argha Bagchi | ২৫ জুলাই ২০২৪ ১৬:৫০535311
  • মলয়বাবু, আপনিও তো গত হলেন। কেদার আগেই গেছিলেন, অবশেষে উত্তম দাশও গেলেন। জানিনা আবার কবে কোথায় কোন এক কামরার ফ্ল্যাটে আপনাদের মদ্যপানের আসর বসবে। আমায় চিনতে পারলেন না তো? আমিই সেই কপি-কল। অবশ্য বেঁচে থাকলেও আপনি আপনার এই প্রতিবেশীকে চট করে চিনতে পারতেন না কেননা আমাদের দেখা হয়েছিল গুণে গুণে তিনবার মাত্র। তার চেয়ে উত্তম দাশ আমায় বেশি রিকগনাইজ করতে পারতেন। আমার পরম সৌভাগ্য কেদারের সান্নিধ্যে থাকার ফলে তাঁর সাইটেশনে স্থান পাওয়া। হি ওয়াজ মাই মেন্টর। আমার কেদার স্যার। এবং আমার নিকটতম বন্ধু।
     
    "মনে হচ্ছে কপাল খুলেছে একটু, আমার। একজনকে পেয়েছি, ভারি ইনটেলিজেন্ট এবং সুন্দর। আমার প্রাক্তন ছাত্র এবং বর্তমানে বন্ধু। সেই কপি করে দেবে। মনে হয়। নাম অর্ঘ্য বাগচী। বারিন্দির। দেখি কী হয়। দু’হাজার সালে বইমেলায় এবং যদি বেঁচে থাকি, তার পরেও।" - সাক্ষাৎকারে আমার উল্লেখটুকু এক পরম সম্পদ। স্যার আই ডু নট মিস য়ু , নেভার।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন