নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
ক্যারন্ডেলেল স্ট্রিটের উপর নিউ অরলিন্সের কটন এক্সচেঞ্জ। সামনের চত্বরে বড় বড় তুলোর বস্তা ডাঁই করে দর হাঁকা হচ্ছে। বিকিকিনির চাপা উত্তেজনায় আসক্ত বাতাস। তুলো বেচাকেনা করতে এসেছে প্ল্যান্টেশনের মালিক, চাষি আর ব্যবসায়ীরা। কাঁচা পয়সার লেনদেন হচ্ছে। মনে খুশি থাকলে লোকে দু’চারটে জিনিস কিনে ঘরে ফিরবে। সেই আশায় আলেফ মাঝেমাঝেই ঢুঁ মারে এখানে। আজকেও সাইকেল এক ঠেঁঙে রেখে নিজের পশরা সাজিয়ে বসেছিল।
এখানে হই চই জাগলেও, দূরে দূরে বসত বাড়িগুলো যেন এখনো সকালের আড়মোড়া ভাঙছে। বেলা এখনো চড়া হয়নি, নোনা বাতাস চলছে মৃদুমন্দ। লবণ-মাখানো শুয়োরের মাংসের স্যুপ হচ্ছে, সঙ্গে বাঁধাকপি-পাতা সেদ্ধ। তার সুগন্ধে হাওয়া ভারি। একটা বাড়ির চিমনি থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, হয়তো শুয়োর রান্না হচ্ছে ওখানেই। নিউ অরলিন্সের সন্ধ্যা যদি বর্ণময়, দিনের শুরুর দিকটা হাত-পা গোটানো, ঝিমধরা। কেজো লোক ছাড়া পথে এখন কেউ থাকে না।
এমন সময়ে দাভে দ্য রাজার উদয় হল। আসলে তো ডিওয়েন। অ্যাবিয়েলের মারফত সেটা জেনেছে আলেফ। বারকয়েক কথাবার্তাও হয়েছে। লোকজনের সামনে ডিওয়েন এই হিন্দু ব্যাপারিদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে আরও বেশি উৎসাহী, নিগ্রোদের দিকে চেয়ে থুথুও ফেলে না। আলেফকে পাকড়িয়ে বসেছিল কটন ইয়ার্ডের ধার-ঘেঁষে। যেন এমন তুলো কেনাবেচা দেখেনি কস্মিনকালে, তেমনিধারা আলুক-সুলুক চাহনি। সঙ্গে কথা চলছিল নিচু স্বরে। রোদ বাড়তে কটন ইয়ার্ড থেকে একটু সরে এসে বিটারনাট গাছের তলায় উবু হয়ে বসেছিল দু’জনে।
পোশাক-আশাকে হিন্দুয়ানার খোঁজে মাঝেমাঝেই এটা-সেটা কেনে লোকটা। শুধু কেনা নয়, মুখে তার হাজার একটা খোঁজ। কালী কে, শিব কেমনধারা ঠাকুর তাদের, বেদ পড়েছ? হিন্দু দেব-দেবীর কথা আলেফ অত কী জানে? শিবের গাজন হতে দেখেছে। সেনহেট থেকে সীতারাম বহুরূপী হরেক সাজ সেজে গাঁয়ের পথে ভিক্ষে মেগে বেড়াত, তাই দেখে যেটুকু কালী, গণেশ এসব জেনেছে। পাত পেড়ে সিংহ বাড়ির দুর্গাপূজার প্রসাদ খেয়েছে। হিন্দু-মুসলমান সবাইকে দিত, তাদের পাত পড়ত এক ধার ঘেঁষে। সেসব যা জানে, বলেছে আলেফ; এর বেশি সে জানবে কোথায়? সে বলতে পারে ফজরের আজানের কথা। বাল্যকাল থেকে আজানের ডাকে তার ঘুম ভাঙত। প্রতিদিন নামাজ না পড়লে গুনাহ হয়, আল্লার পথে থাকার জন্যে আব্বুর হুঁশিয়ারি চলত। এখানে সেই আজানের ডাক আর কোথায়? ভোরের মিঠা বাতাসে ভেসে আসা আজানের সেই ধ্বনির অভাব আলেফকে পীড়িত করে।
কেন, তুমি হিন্দু হয়ে এসব কথা জানো না? নিগ্রোরা যেমন চার্চে যায়, তোমরা তোমাদের দেবতার কাছে যাও না বুঝি?
একসময় এপিকোস্টাল চার্চে রোজ হাজিরা দিয়েছে। ঝগড়া করেছে ধর্ম আঁকড়ে মুখ-বুজে মার খাওয়া নিগ্রোদের সঙ্গে, গরীব মানুষের ধর্ম ছাড়া আর আশ্রয়টা কী! এখন তা-ও যায় না, হিন্দু সাজার পর থেকে চার্চে যেতে হিচকিচায় ডিওয়েন। ওখানে যাওয়ায় বিপদ আছে, সন্তর্পণে এড়িয়ে চলে সেসব। তার নাহয় পাশ কাটানোর একটা কারণ আছে। হিন্দুদের ধর্মের প্রতি টান নেই – সেটা তার বিশ্বাস যায় না। সে শিকাগোতে ধর্ম সম্মেলনে কত হিন্দুকে ধর্মের কথা বলতে শুনেছে।
হিন্দু কথাটা এই দেশে এসে বেশি বেশি শুনছে আলেফ। তাদের গা গেরামে বামুন, কায়েত, বৈদ্য, কৈবর্ত এসবই শুনেছে। আর তাঁতিপাড়ায় যত মুসলমান। নিজেদের হিন্দু কেউ বলত না কি?
আমরা ঠাকুর পুজোর হিন্দু নইকো, আমরা মোছলমান। আমরা আল্লার ঠেঙে নামাজ পড়ি, মসজিদে যাই। অনেক কথা খুঁজে খুঁজে বোঝাতে চেয়েছে আলেফ। পাঁচওয়ক্ত নামাজ পড়ে, বাকি সময় যায় রোজগারের ধান্দায়। না হলে, এত দূর দেশে আসা কেন? ধর্ম নিয়ে এত মাথা ব্যাথা করলে ব্যাপারি-মানুষদের চলে না।
মুসলমানদের নিয়ে তেমন ধারণা নেই ডিওয়েনের। তোমাদের আল্লা মসজিদে থাকে? মসজিদ কোথায়? দেখিনি তো এখানে।
নিউ অরলিন্সে মুসলমান ছিল না কোনোকালে, না আছে কোনো মিনার-মসজিদ।
এখেনে নেই, আমরা নিজেরাই নামাজ পড়ি। আমাদের গাঁয়ে মসজিদ ছিল, ইমাম ছিল গিয়াসুদ্দিন তায়েব। এখানে আমানুল্লা ভাই বিয়েশাদি করায়, কলমা পড়ায়।
রোদটা এতক্ষণে মাথার উপরে চড়ছিল। আর তো ছাউনি নেই কোনো, বিটারনাটে অত বড় ছায়া পড়ে না, তাদের গাঁয়ের বটগাছ তো নয়। আলেফ মাল বেচতে এই চৌহদ্দিতে এসে পড়েছিল, আগেও এসেছে নিউ অরলিন্সের এই কটন ইয়ার্ডে। বেশ খানিকটা তাদের হাটের মত। বাবনানের হাট বসত বিষ্যুত আর শনিবারে, আব্বুর হাত ধরে ছোটবেলার থেকে বোঁচকা মাথায় গেছে সেখানে। সেই হাটে পাওয়া যেত সব কিছু, এক কোনায় তারা বসত শাড়ি, গামছা নিয়ে আর সব তাঁতিদের সঙ্গে।
এখানে সবই তুলোর ব্যাপারি। সার দিয়ে প্ল্যান্টেশনের ওয়াগন দাঁড়িয়ে। সাদা চামড়ার মালিকেরা হুমদো মুখে বসে, কোথাও নিগ্রো দাসেদের সর্দাররাও থাকে। ক্রেতার প্রত্যাশায়। ফড়েরা হাতে লম্বা লম্বা সরু ছুরি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুরে ঘুরে তুলোর বস্তায় ছুরি ঢুকিয়ে বের করে নিচ্ছে মুঠোভর তুলো। তুলোর দৈর্ঘ্য যাচাই করে ফের বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছে। এক ঘাড়-কুঁজো বুড়ো নিগ্রো খালি বস্তা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাতাস থেকে সেই তুলো খামচে ধরে ভরে রাখছে। এক এক খামচি তুলোয় তার একবারের তামাকুর দাম ওঠে। পুরো বস্তা ভরে গেলে দেবে বেচে কোনো ব্যাপারিকে, যা দাম পায়।
দেখে ফারাক যত না পায়, নিজের গাঁয়ের সঙ্গে মিল পায় ঢের বেশি। দেওয়ানবাবু জুতো মশমশিয়ে গেলে, তারা ছেলে-ছোকরারা হুল্লোড় থামিয়ে দিত, আব্বাজান হুক্কাতামুক নামিয়ে জো হুজুরি দিত। এখানেও সাদা মালিকের সঙ্গে আসা নিগ্রো বাহনদারেরা তেমনি পিঠ ঝুঁকিয়ে, ঘাড় এলিয়ে, হুকুম তামিল করছে। এখানে সাদা মালিকের মধ্যে মালকিনও আছে, তারাও আসে তুলো বেচতে। এমনধারা তাদের গাঁয়ে গেরামে কখনো হবে না।
ডিওয়েন আলেফের পাশে বাবু হয়ে বসেছিল। যেটা সচরাচর করে না, নিচু স্বরে বলছিল নিজের কথা। আলেফের উপর বিশ্বাস জন্মেছে আজকাল, সেটাও কারণ। তুলোর কেনাবেচা শেষ হলে লোকের চোখ পড়বে আলেফের পশরার উপরে, তার আগে নয়। কান খাড়া করে শুনছিল ডিওয়েনের কথা, অপেক্ষার সময়টাও এই ভাবে পার হয়ে যাবে।
আমরা ছিলাম পেনেলোপ প্ল্যান্টেশানে। আলেফের চোখে জিজ্ঞাসার ছায়া বুঝে ডিওয়েন বিশদে যায়। কাপাস তুলোর আবাদ গো, চার-পাঁচশ’ একর জুড়ে এক একটা মালিকানা। পেনেলোপের পাশে ছিল মিলার, অন্য ধারে জোনাথন স্মিথের প্ল্যান্টেশন। সব সাদা হুজুরদের এক্তিয়ারে, আমরা তাদের বিনাপয়সার খিদমতগার।
যদিও বলছে ওই আবাদে বড় হয়েছে, বলার ধরণে কোনো গভীর শাঁস ছিল না। না প্রকাশ পাচ্ছিল ফেলে আসা সেই দিনগুলোর জন্য কোনো টান। ডিওয়েনের মাথায় তেমনি গেরুয়া পাগড়ি, পরনে কমলা রঙের আলখাল্লা। তবু কথা বলতে বলতে গালের চামড়ার ভাঁজে, চোখের চাহনিতে নিগ্রো রক্ত ঠেলে বেরোচ্ছিল।
তুলোর প্ল্যান্টেশনেই জন্ম আর বড় হওয়া। মামা আর প্যাপি মরে গেল সোয়াম্প ফিভারে। আমি বড় হলাম প্ল্যান্টেশনের রান্নাঘরে। রান্নাঘর মানে ধর, ছয় ফিট বাই আট ফিট একটা চালাঘর, যেখানে চার নিগ্রোমামা পঞ্চাশজন লোকের রান্না করছে, আমি তাদের পায়ের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াতাম। মাটি থেকে তোলা খাবার খেয়েই কেমন বড় হয়ে গেলাম। বলে হা হা করে হাসল ডিওয়েন, কিন্তু ঠোঁটের কোনায়, চোখের নিচের হাসিতে, কুঁচকে যাওয়া চামড়ায়, রাগের রেখাগুলো অমলিন রইল। এই আমাদের জীবন, বুঝলে আলেফ?
ফেলে আসা গ্রামে আলেফের অবস্থা এমন কিছু স্বচ্ছল ছিল না। নানা, আব্বু দিনভর তাঁত চালাত, আম্মি, ফুফু ফোঁড় তুলত। মিলের কাপড় চালু হবার পরে দিনে দিনে বিক্রি কমছিল, সংসারে টানাটানি। তবু ডিওয়েনের কথা শুনে মনে হয়, তারা বেশ ছিল, যতদিন কাজে লাগার বয়েস হয়নি, মাদ্রাসায় তালিম নিতে যেত খানিক। বাকি সময় খালে-বিলে-মাঠে-ঘাটে ফুর্তিতে কোনো বাধা ছিল না। শুনে ডিওয়েন হাসল আবার, যে হাসিতে চোখে আগুনের হলকা ধকধক করে জ্বলে। বারো বছর অবধি স্কুলে পাঠাত এই না ঢের!
নিজের কথা যখন বলে ডিওয়েন, সাদাদের উপর তার রাগ ফুটে ফুটে বেরোয়। সেটাও আলেফকে অবাক করে। হিন্দু সেজে সাদাদের মহল্লায় ঘোরাঘুরি করছে, অথচ তাদের দু’চক্ষে দেখতে পারে না। আর কালো মানুষেরা তার ভাই বেরাদর, তাদের সঙ্গে মোলাকাত এড়িয়ে চলে। বড় আতান্তরে থাকে লোকটা।
হয়তো সাদাদের উপর রাগটাই চালিয়ে নিয়ে চলে ডিওয়েনকে। এখনো পুরোনো কথা মনে করে রাগে ফুঁসছিল সে।
এইসব প্ল্যান্টেশনে সবচেয়ে কিসের অভাব জানো? খাবার। যেমন থাকতে দিত গাদাগাদি করে, তেমনি খেতে দিত মেপেজুপে। কোনোমতে বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু লাগে। কিন্তু রান্নাঘরের মেঝেতে বসে থাকলে অনেক টুকরো-টাকরা পাওয়া যায়। আবার হা হা করে হাসল ডিওয়েন, রাগের রেখাগুলো নরম হচ্ছিল। কারও সঙ্গে মনের কথা বলতে না পেরে বুকের মধ্যে দিনে দিনে লাভাস্রোত জমা হয় ডিওয়েনের, দু’চার কথা বলতে পেলে কিছুটা লাঘব হয়।
তাহলে তোমার জাতভাইদের মধ্যে ফিরে যাও না কেন?
কি লাভ হবে? আবার রেলের লাইনের কুলি হব? সাদা মালিকের জো হুজুরি করব? তবে আর পড়াশোনা শিখলাম কেন?
তুমি গেছ ইস্কুলে?
রান্নাঘরে থেকে খাওয়ার অভাব হয়নি আমার, লেখাপড়াও শিখেছি। আমাদের প্ল্যান্টেশনে স্কুল ছিল একটা, নিগ্রো ব্রাদাররা অন্তত অক্ষর পরিচয় পেত সেখানে। সেইখানেই পড়া শুরু। পড়া আর লেখার কাজটা বেশ ভাল পারতাম, বুঝলে। তবে সেসব চলত, যতদিন নিগ্রো বাচ্চারা হাতে পায়ে শক্ত না হয়। বারো বছর হলেই তো আমাদের প্ল্যান্টেশনের কাজে জুতে দেওয়া হত, আমাকেও দিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আমি লিখতে শিখেছিলাম। দাঁত বের করে হাসল এবার ডিওয়েন। না শিখলেই বুঝি ভাল ছিল।
কেন, শিখলে তো ভালই। আলেফের পেটে বিদ্যা বেশি নেই। আজকাল শুনেছে এলিস আইল্যান্ডে ঢোকার সময় হিন্দুস্তানিতে একটা পরচা পড়তে দেয়। নিজের ভাষায় দুই ছত্র না পড়তে পারলে এই দেশে ঢুকতেও দেয় না। ভাগ্যিস সে যখন এসেছিল, এমনধারা ছিল না, তাহলে তাদের আর এই দেশের মাটিতে পা দেওয়াই হত না।
লিখতে-পড়তে না জানলে নিজের ভাগ্য নিয়ে মনস্তাপ থাকত কম। যে খুদকুঁড়ো জোটে, সেটাতেই দুরুস্ত হয়ে যেতাম। এখন – বলে ডিওয়েন উদাস হয়ে গেল। ঘাষ ছিঁড়ে দাঁতের ফাঁকে কাটতে কাটতে হারিয়ে গেল নিজের ভাবনায়।
একটু আধটু লিখতে আলেফও শিখেছিল মাদ্রাসায়, কিন্তু এখন সব ভুলে হেজে গেছে। অভ্যাস না থাকলে কতটুকুই বা মনে থাকে!
আমার অভ্যাস ছিল, ইস্কুল ছাড়িয়ে তুলোর আবাদে জুটে যাওয়ার পরেও। অনেক বুড়ো নিগ্রোর হয়ে চিঠি লিখেছি, হিসাব রেখেছি। প্ল্যান্টেশানের কাজ করার সময়েও যেখানে যেমন লেখা পেতাম, পড়ে ফেলতাম। রাতে কাজ থেকে ফেরার পর অন্য নিগ্রোদের বাইবেলের গল্প পড়ে শোনাতাম। একদিন আমাদের প্ল্যান্টেশনের যে মালকিন, আমায় ডেকে পাঠাল। আমি তো ভয়ে – আমরা নিগ্রোরা একদম ছোট থেকেই ভয় পেতে শিখি, আমাদের নিজের কী হাল-হকিকৎ সেটা পাখি পড়া করে শেখানো হয়। কখনো পিঠে চাবুক মেরে। তাই মালকিনের ডাক পেয়ে আমি তো ভয়ে এইটুকুন।
ঘরটা কি বিশাল। আমাদের স্লেভ কোয়ার্টারে একেকজনের বাড়ি হয় আট ফুট বাই দশ ফুট। সে তোমার দুটো বাচ্চাই হোক, কি দশটা। মালকিনের এই বসার ঘরটা দোতলায়, প্ল্যান্টেশনের এই দিকটায় আমি আসিনি কোনোদিন। ঘরে কত বড় জানালা। জানালার নিচে ম্যাগ্নোলিয়ার ঝাড়, আর দূরে দেখা যায় তুলোর আবাদ। মিস মে বসেছিল একটা আরাম কেদারায়, গায়ে শাল জড়ানো। এমন দুধ-সাদা তার শরীর, নীল শিরা স্পষ্ট দেখা যায় বুঝি। একরাশ বাদামী চুল, তার ফাঁক দিয়ে হীরের দুল ঝিকমিক করছে। আমি ভাবছি, কী দোষ করেছি, কেন ডেকেছে! মিস মে মেঝেতে হাত দেখিয়ে বললেন, যা, বস ওখানে।
আমি যেখানে বসলাম, সেখানে একটা বই রাখা ছিল। নাম কি জানো তার?
আলেফ কী জানবে? অবশ্য ততক্ষণে বুঝে গেছিল আজ ডিওয়েন কথা বলতে চায়, মুখের কাছে একজোড়া কান চাই শুধু, সে বুঝুক চায় না বুঝুক।
রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য কনফেডারেট গভর্নমেন্ট। জেফারসন ডেভিস। সরল করে বুঝিয়ে দিয়েছে কেন স্লেভ হয়ে থেকে গেলেই আখেরে নিগ্রোদের লাভ। বলে কিনা, ক্রীতদাস থাকতেই নিগ্রোরা ভালবাসে।
বলতে বলতে ডিওয়েনের গলা শিরিষ কাগজের মত খরখরে হয়ে গেল। অতসব না বুঝলেও, এটা একটু অবাক করে দিল আলেফকে। সত্যি, তাই বুঝি?
সেদিন রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছিল ওখানে। ইচ্ছা করছিল মিস মের দিকে বইটা ছুঁড়ে মারি। আমাকে ডেকে এই বই পড়ানোর অর্থ কী? কিন্তু তখন আমার কী-ই বা বয়স। শুধু পড়লাম না, মিস মের আদেশমত বইয়ের সাদা পাতায় লিখে দিলাম মিস মে পেনটোড, আমার হাতের লেখা সত্যিই খুব ভাল ছিল। কিন্তু বয়েস যেমন বাড়তে থাকল, বুঝলাম, জেফারসন ঠিক বলেছে। কালোরা দাস হয়ে থাকলেই সুখি। ওটাই নিগ্রোদের অসুখ। ধিকিধিকি আগুনের মত চাপা স্বরে বলছিল ডিওয়েন। আমরা যা পাই তাতেই খুশি থাকি, প্রশ্ন করতে শিখিনি।
তুমি কেন করোনি? বলতে ইচ্ছা করল আলেফের। নিজে হিন্দু সেজে ঘুরে না বেড়িয়ে, করো না প্রশ্ন। কথাটা মনে এলেও মুখে বলেনি আলেফ। কিন্তু চোখের প্রশ্নটা ঠিক বুঝে নিল ডিওয়েন।
আমি প্রশ্ন করেছি, কোনো লাভ হয়নি। আমাদের নিগ্রোদের নিজস্ব চার্চ ছিল, আশপাশের প্লান্টেশনের যত নিগ্রো সেখানেই যেতাম আমরা, সেখানে ভাল থাকার উপদেশ শুনতাম সবাই। আমি যেতাম, কিন্তু প্রিচারের কথায় কান ঝাঁ ঝাঁ করত। একদিন বলেই ফেললাম। আমরা কোনো প্রশ্ন করি না কেন? কেন সব ঘাড় গুঁজে মেনে নিই?
ততদিনে আমরা আর ক্রীতদাস নই, কিন্তু সে কেবল নামেই। মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করে যাওয়ার বাইরে কিছুই শিখিনি। রেভারেন্ড ওয়ালেস তার বক্তিমে থামিয়ে আমার দিকে সোজা চোখে তাকাল। কী বলতে চাইছ হে ছোকরা? আমার হাতে একটা বই ছিল, সেটার দিকে তাকিয়ে বলল, দু’পাতা পড়েই নিজেকে পন্ডিত ভাবছ বুঝি? শুনি তোমার বিদ্যের বহর। কী বলতে চাও?
বললাম তো। যা দেখছি চারদিকে সব কিছুকে প্রশ্ন করতে হবে।
আমরা এখানে ভগবানের কথা বলছি – জেসাস। সেটা কি মাথায় ঢুকেছে খোকা?
তাকেও প্রশ্ন করো।
চু-উ-প! ফেটে পড়েছিল রেভারেন্ড ওয়ালেস। আর একটা কথা না।
আমার তখন রক্ত নবীন, হেঁকে উঠলাম, কেন চুপ করব? সাদাদের ভগবান নিয়ে আমাদের এত আহ্লাদ কিসের?
দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে জমায়েতের দিকে তাকিয়ে রেভারেন্ড ওয়ালেস বলে উঠল, দ্যাখো, এই জন্যেই কি আমরা নিগ্রো বাচ্চাদের পড়তে-লিখতে শেখাচ্ছি?
আমার মাথায় তখন আগুন দপদপ করছে। আমিও সমানে চেঁচিয়ে বললাম, তুমি কিছুই শেখাচ্ছ না, সাদাদের বলে দেওয়া বুলি আওড়াচ্ছ।
তোর বাপ-মা কোথায় রে ছোকরা?
নেই কেউ, ওই সাদাদের জন্য কাজ করতে করতে সব মারা গেছে।
অ, সেই জন্যেই তোর এত রাগ ভগবানের উপর?
না রাগ নয়, আমি প্রশ্ন করছি। প্রশ্ন করছি তোমার ভগবানকে। স্বাধীনতা, ভগবান – এইসব শব্দের মানে কী জিজ্ঞেস করছি, কালারড শব্দের মানেও। জানো তুমি, কেন কালো হলেই কালারড, সাদা কি লাল হলে নয়? এখানে এইসব শব্দের মানে জানতে চাই আমরা, কোনো মনগড়া গল্প শুনতে নয়।
আমরা মানে কে?
এই যে সবাই এখানে, বলে আমি চার্চে জড়ো হওয়া সবার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখালাম। হাঁটু মুড়ে বসা এতগুলো লোক মিলে যেন এক বিশাল প্রস্তর মূর্তি, সেখানে হাওয়া চলাও বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে।
তোর জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে।
আমার জন্য? নিজের জন্য দুঃখ কর, দুঃখ কর এখানে জমা হওয়া সব মানুষের জন্য। তুমি তোমার ভগবানে বিশ্বাস কর, কারণ একটা সাদা লোক তোমাকে সেটা শিখিয়েছে। কেন? যাতে তুমি সারা জীবন বোকা থাকতে পার, তোমাকে প্রশ্ন করতে শেখায়নি। আর তুমি সেই শেখানো বুলি কপচে এতগুলো লোককে পাথর বানিয়ে রেখেছ।
রেভারেন্ড ওয়ালেস এবার ধীরে ধীরে নেমে আসতে থাকল, খুব ধীরে। আমি তবু বসে রইলাম ঠায় ওর চোখের উপর চোখ রেখে।
উঠে দাঁড়া! ঠিক আমার সামনে এসে এক বিকট হুঙ্কার ছাড়ল রেভারেন্ড। আমি দেখছিলাম ওর কালো কপালজুড়ে নীল শিরাগুলো দপদপ করছে একদম।
আমি তবু টসকাইনি। উঠে দাঁড়ালাম, কিন্তু ওপর চোখ থেকে চোখ সরাইনি। সঙ্গে সঙ্গে আমার গালে ঠাস করে এক চড় মারল। আমি ঘুরে পড়ে গেলাম, কতই বা বয়স আমার তখন। আমাকে ঘেঁটি ধরে তুলে এরপর এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করল বিশাল চেহারার রেভারেন্ড ওয়ালেস। একঘর লোক বসে রইল পাথরের মত।
আমি মার খেয়ে শুয়েই রইলাম, রেভারেন্ড তার পিউতে ফিরে গিয়ে বলতে শুরু করল তার গসপেলের বুলি। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পরে বেরিয়েছিলাম আমি, তারপর বহুদিন আর ঢুকিনি চার্চে। ফিরে যাইনি আমার প্ল্যান্টেশনেও। ওখানে সাদা সাহেবদের মার দেওয়ার অধিকার তখনো কেউ কেড়ে নেয়নি তো, জানতাম এতক্ষণে খবর চলে গেছে। আমি বেরিয়ে পড়লাম সব ছেড়ে। এসে জুটলাম রেলরোডে। তবে এটাও বুঝলাম, পিঠ ঝুঁকিয়ে চলাটাই এই জাতের ভবিতব্য। এই নিগ্রোদের জীবন আমি বদলাতে পারব না, আমার নিজের জীবনটা বদলাচ্ছি তাই।