এবারের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের চরিত্রটি বেশ আলাদা। গণতন্ত্র-জনমতের সঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক বয়ানের যে আশ্চর্য মিশেল আমাদের দেশের জনজীবনে ঘটে চলেছিল, এবার তার তলপেট বড় বিশ্রী ভাবে বেআবরু হয়ে গেছে। এই সময়পর্বে গণতন্ত্রের একটি প্রান্তে থাকা কিছু মানুষের স্বর শোনার একটা প্রয়াস করা গেল।
চলন্তিকা অভিধানে 'গণতন্ত্র' মানে দেওয়া আছে - "জনসাধারণ কর্তৃক রাজ্যাদি পরিচালন, প্রজাতন্ত্র।' 'প্রজা ও তন্ত্র' বইতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা - "সাধারণতন্ত্র, যার অর্থ রাজা ব্যতিরেকে প্রজার প্রতিনিধিবর্গ কর্তৃক রাষ্ট্রপরিচালনা।" প্রজা কারা? কারাই বা রাষ্ট্রপরিচালনা করে? এ কি স্বতঃস্ফূর্ত প্রান্তিক স্বর? না ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার চাপিয়ে দেওয়া বয়ান - যা নির্ধারণ করে এই প্রজাতন্ত্র নামক সোনার পাথরবাটিকে? তারই সন্ধান করতে পৌঁছে যাওয়া গিয়েছিল দুর্গাপুরের কয়েকটি অঞ্চলে। গোপালপুর পঞ্চায়েত, আড়াহাট, মাজিপাড়া ওরফে মাঝেরপাড়া, আড়াগ্রাম, ঘোষপাড়া, শিবতলা সহ কয়েকটি অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা তাহাদের কথা, এখানে।
দুর্গাপুর মুচিপাড়া থেকে কিলোমিটার দুয়েক গেলে আড়াগ্রাম। এফ সি আই কোয়ার্টার থেকে আড়ার দিকে আসার জন্য জঙ্গলের মধ্যে শর্টকাট পথ। কিছুটা এগোতেই দেখা মিলল, ছাগল চরাতে যাওয়া এক বৃদ্ধার সঙ্গে। নিবাস তাঁর মাঝিপাড়া। বাউরি। পঞ্চায়েতের কাজকর্ম ঠিক ভাবে চলছে কিনা জানতে চেয়ে লাভ হল না। বুড়ি অতশত জানেনা। রান্নার চাল মেলে বটে, তবে মাথার উপরের যে চাল, তা জোটেনি। ঘর তাদের অধরাই। অনেকে পেয়েছে। এই বুড়ি পায়নি।
কাকে ভোট দেবেন এবার? বৃদ্ধার উত্তর - "সে কাউকে দেব একটা"। কাকে? সেটা সে বলবে না। অথবা হয়ত ঠিকও করেনি কিছু। আড়ামোরের সাপ্তাহিক হাটে ঢুঁ মেরে আসা গেল। হাটের এক কোণে মাছ বাজার। শীতলা বাউরি (নাম পরিবর্তিত)-র সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ২১-এর ভোট নিয়ে প্রশ্ন করায়, তার জবাব - "কী জানিরে বাবা। ওসব বড় মানুষদের বেপার।" বাউরিদের গ্রামে অনেকে ঘর পেয়েছে। শীতলা পায়নি। লকডাউনে চাল পেয়েছে বটে, তবে আমফান ঝড়ের টাকা মেলেনি তার। পঞ্চায়েতে নাকি চুরি হয়েছে! সে শুনেছে। তাহলে ভোট কাকে? শীতলা চুপ। এবার সোজাসুজি প্রশ্ন - তাহলে কি বিজেপিকে? এবারও সে নিরুত্তর। তা কেন্দ্রের সরকার কি ভালো কাজ করছে - এবার নড়েচড়ে বসল সে। 'আর বলিসনা, নোট বাতিলের সময় কী যে সমস্যায় পড়লাম। আনখাই সব।' তাহলে ভোট কাকে? তার জবাব - "সে দেব তো। কী যে ঝামেলা আসবে..." ক্যামেরা বের করতেই সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে - "এসব কুথায় দেখাবি নাতো। আমি খোঁড়া মানুষ। কী ঝামেলা হবে?" তাকে আশ্বস্ত করলাম। সম্ভবত সে স্থিতাবস্থাই চায়।
আড়া মোড় থেকে এগিয়ে গেলে, মাঝিপাড়া। বাসিন্দার মুখে মাঝেরপাড়া। শ'দুয়েক প্রান্তিক আদিবাসীর বাস। পাড়ার ভেতর এগিয়ে যেতে নজরে এল মাটির বাড়ি। পুরুষেরা বেশিরভাগ কাজে গেছে। দু-একজন মহিলাকে ভোটের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে জবাব এল তারা এসব বিষয়ে জানে না। পাড়ার শেষে মাঠ। মাঠটা শিবতলা গিয়ে উঠেছে। ছাগল চরাচ্ছিল বছর সত্তরের শিবু মাঝি। এ কথা, ও কথার পর তার জবাব সে ভোট দেয়। এবারও দেবে। কিন্তু এখনও ঠিক করেনি। পঞ্চায়েতের কাজ কেমন হয়েছে? উত্তর এল - ভালো না। পরে খবর নিয়ে জানা গেল মেম্বার একেবারে অকর্মণ্য। পাড়া থেকে বেরনোর মুখে দেখা হল লক্ষ্মী বেসরার সঙ্গে। ভরদুপুরে টলতে টলতে পথ চলছিল লোকটি। থামালাম। নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করায় তার জবাব - "আমি ওসব জানি না।" সরাসরি প্রশ্ন করলাম - "এবার ভোট কাকে দেবেন?" সংশয়হীন তার জবাব - "যাকে দিতে বলবে, তাকে ভোট দেব।" কে বলবে? - "ওই যে ওরা।" আসলে সে নেতাদের কথা বলতে চেয়েছে। খটকা লাগল। গায়ত্রী স্পিভাক চক্রবর্তীর 'গণতন্ত্রের রহস্য' নিয়ে ভাবতে গিয়ে সংশয় লেগেছিল। আজও সংশয় আছে। প্রশ্ন জাগল, এই কি তবে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র! দীর্ঘ তথাকথিত 'বাম' শাসনের পরও প্রান্তিক মানুষকে তাদের কথায় ভোট দিতে হবে? তাহলে? সংসদীয় গণতন্ত্রের এই রহস্য তোলা থাক আপাতত। কথা এগোনোর পর লক্ষ্মী যা খোলসা করল, তা হল মেম্বারের কথায় ও ভোট দেবে। লকডাউনে ও চাল পেয়েছিল।
আড়া মোড় থেকে এগিয়ে শিবতলা। যাওয়ার পথে গোপ পাড়া। পাড়ার কাছে শ্মশানের আগের চাতালে দু-একজনের সঙ্গে দেখা হল। ভোট নিয়ে কথা বলতে ওরা চুপ করে গেল। একজন এগিয়ে এল। নাম জিজ্ঞাসা করে জানলাম জীবন গোপ। বছর বাইশের যুবককে প্রশ্ন করি, এখানে কে জিতবে? সরাসরি তার উত্তর - দিদি। জানতে চাইলাম কেন, তৃণমূল কেন? এই এলাকায় কি দুর্নীতি হয়নি? জীবনের জবাব, হয়েছে। তবে অন্য এলাকার থেকে কম। চুরি তো হয়ই... যেন স্বাভাবিক বিষয় এটা। বিজেপিকে ভোট তারা দেবে না। কথা বলতে বলতে একজন প্রাক্তন মেম্বার হাজির হলেন। তাঁর গলায় হতাশার সুর। কী যে হবে এবার! কিন্তু জীবনরা আশাবাদী। তবে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের উপর তার বিরক্তি যথেষ্ট। 'বামরা' এলে ভাল হতো। তবে এবার বামরা যা করল! জানতে চাইলাম - কী করল? সম্ভবত ফুরফুরাপন্থীদের জোটের কথা সে বলতে চাইল।
আরও এগিয়ে গিয়ে আড়া গ্রাম। ঢোকার মুখে একটা চায়ের দোকানে থামতে হল। পাশ দিয়ে বিজেপির গাড়ি প্রচার চলে গেল। চায়ের দোকানে কয়েকজন লোক। তাদের কথা শোনার চেষ্টা করছি। তিনটে লোক। দুটো বাইক ওদের সঙ্গে। প্রচার থেকে আসছে। কিন্তু প্রচার ভ্যানটা আড়া গ্রামে ঢোকেনি। তার ক্ষোভ। একজন বাইকের তেলের টাকা চাইতে, হোমরাচোমরা গোছের একজন জানাল, উপর থেকে টাকা দিতে বারণ করেছে। গজগজ করে উঠল টাকা চাওয়া লোকটি। সাবধানে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম - কারা জিতবে এবার? সটান উত্তর - 'আমরা।' কেন তার এমনটা মনে হচ্ছে? প্রশ্ন করার সঙ্গে লোকটা অবাক হয়ে তাকাল। উত্তর দিল না। অপর দুজন তাড়া দিচ্ছে- "ওরা চলে গেছে। চল চল। মাংসভাত খাওয়াবে। আগে চল।" বাইক স্টার্ট করে চলে গেল তারা।
শিবতলার দিক হয়ে আবার আড়ার দিকে ফিরছি। কাজ থেকে বাড়ি ফিরছিল লোকটি। সাইকেলে। গতি কমিয়ে তার সঙ্গে চলতে থাকি। সে খয়রাশোলে থাকে। সরকারি সুবিধা কিছু কিছু পেয়েছে। তবে তার পাশের বাড়ির লোকটার পাওয়া সুবিধা আরও বেশি। বললাম, এবার ভোটে কী হবে? সে চুপ। আবার বললাম, যারা আছে তারা থাকবে, না নতুন কিছু? ফিসফিস করে বলল লোকটা - "নতুন হোক। দেখি নতুনটাকে।"
আড়া হয়ে মুচিপাড়া ফেরার পথে, আড়া হোস্টেল মোড়ের কাছে মাঝের পাড়ার আর একটা পথ। রিক্সায় বসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব চালক। নাম অজয় যাদব। কাকে ভোট দেবেন? "দেবো। কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল, দেব একজনকে।" প্রতিবার এক একটা দলকে সে ভোট দেয়। এবার এখনও সে ঠিক করেনি কাকে ভোট দেবে।
বিধান সুইটসের কাছে কথা হল তরুণ ভোটারের সঙ্গে। নাম ঋত্বিক নোনিয়া। অণ্ডাল ছাড়িয়ে উখরার দিকে থাকে। হিন্দিভাষী। পুলিশের চাকরির জন্য সে লাইন দেয়। এখানে বেঙ্গল কলেজে পড়ে। কাকে ভোট দেবে সে - তার সরাসরি উত্তর, "দিদিকে।" কেন দিদি? কেনই বা মোদী নয়? সরাসরি ঝাঁঝালো উত্তর এল - "মোদী শালা চুতিয়া। পেট্রোল কা লিটার কিতনা? "বললাম, শ' কা আশপাশ। প্রতিপ্রশ্ন এল - "তো, আপই বলিয়ে।" না, আমার কিছু বলার নেই। দীর্ঘ যাত্রাপথে যে উত্তর এল তা, প্রতিনিধিত্ব, গণতন্ত্র এসব চেনা তাত্ত্বিক কথাগুলোর বাইরের এক অবস্থান। ধর্মের মতই একটা বিশ্বাস কোথাও ভোট নামক প্রতিনিধিত্বের উৎসবের চালিকাশক্তি বলে মনে হল। তৈরি করা জনমত, গণমতের বাইরে এই বিপুল জনসমষ্টির ক্ষেত্রে বিশ্বাস, অপর কে কী ভাবছে, বলছে, এটাই মতামতের নির্মিতি। এই নির্মিতি নিয়ে ভোট হয়েছে, হবেও। তবে এবারের রাজ্য রাজনীতির রোমহষর্ক সময়পর্বে জনমত কতটা গণেরই মত হয়ে ওঠে, তা দেখার জন্য আরও প্রতীক্ষা করার সময়টুকুতে হাতে পেন্সিলটাই থেকে যাচ্ছে কেবল।
কোনোরকম কর্পোরেট ফান্ডিং ছাড়া সম্পূর্ণরূপে জনতার শ্রম ও অর্থে পরিচালিত এই নন-প্রফিট এবং স্বাধীন উদ্যোগটিকে বাঁচিয়ে রাখতে
গুরুচণ্ডা৯-র গ্রাহক হোন
যাদের ভোটের উপর জয়-পরাজয় শাসক-বিরোধী নির্ধারিত হয়, তাদের ভোট বেশ আর্বিট্রারিলি আসে।
এইটা খুব ইন্টারেস্টিং বিষয়, যেটা নিয়ে প্রায়শঃই লেখা হয় না।
এর ফলে ভোট পাওয়ার থেকে ভোট করাতে পারার উপর বেশি জোর দেওয়া হয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। গণতন্ত্রের ধোঁকার টাটির আড়ালে ক্ষমতা বিনিময়ের রাষ্ট্রীয় নির্মাণ ঢাকা পড়ে যায়।
ইনডি প্রেসও সিভোটারের মতই অপশন দিয়ে দেয়? উত্তর টাও গেস করে দেয় পাঠকের জন্য?
সোমনাথদা, তাদের ভোটটা, নির্বাচন নিয়ে ' মাথা না ঘামানো' রাষ্ট্র সাধারণত দেখে না।আবার গণতন্ত্রে তাদের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।