সোমনাথ রায়ের 'অরূপ বৃন্দাবন ও অন্যান্য পদ' পড়লাম। শুরুতেই 'প্রথম দর্শনে দেখি' পদে দর্শন-অদর্শনের আনন্দ - বিষাদের ঘনঘটা। শেষ পর্যন্ত সোমনাথ থামেন, 'প্রথম স্পর্শ তাই গরলবিলাসী' - স্পর্শন আর গরল বিলাসিতায় কোথায় সমাপতন খোঁজেন সোমনাথ সেটা স্পষ্ট হলনা। সমগ্র পদে যতিচিহ্নের অনুপস্থিতি সত্বেও ভাবের প্রকাশে হেরফের হয়না। 'মাধব মথুরা মত যাও'- মাধবের মথুরা গমনের বিষাদ তৃণ থেকে ব্রজপথে সঞ্চারিত। ত্রিপদীতে অগ্রসরমান চরণের একটা জায়গায় খটকা লাগে -' রাজবেশ ইঁহা না বসাও।'- ভাষারীতির দিক থেকে এ তো ভোজপুরি, ব্রজবুলি বা বাংলা নয়- এ এক মিশ্র ভাষারীতি। শুনতে খটকা লাগে। তবে 'কিরীটীর কাঁটা কাঁহে চাও'- চরণে এসে কাঁহে শব্দবন্ধের এই ভোজপুরি ভাষারীতি শ্রুতি মাধুর্য বাড়িয়ে তুলেছে। 'খুলো না ওর হাতের দড়ি'-তেও না ছাড়ার আকুতি প্রবল। লোকপুরাণের কৃষ্ণের জন্ম- শৈশবকথার ফ্রমে বার বার উঁকি মারে একাল। আসে রাজার শাসন, দেশের রানি কিংবা নিতান্ত নগররাষ্ট্রিক গণতান্ত্রিক পরিসরের দেশ ও দশের প্রসঙ্গ। 'তথাপি আসিও প্রেমে'- দহনমাসে প্রেম ও কামনার (সোমনাথ প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করেন স্বর্গীয় রম্যতায়, কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছায়) শরে বিদ্ধ হন রাধা। কুঞ্জ থেকে যমুনার অনুসঙ্গ ভিড় করে। মেঘের কাব্যরূপ 'মেঘা' বা বিপথ হয়ে ওঠে 'বেপথুয়া'। এই পদের অন্তিমে কবি ভিন্নতায় আত্মপ্রকাশ করেন। 'যখন শ্যামের দ্বারে' পদে বৃন্দাবন থেকে একালের রাষ্ট্রিক জীবনের ফ্রেমে ঢুকে আসেন পদকার। 'রাজার কুটিল ন্যায়', রণরক্ত ক্ষিদে থেকে রাষ্ট্রচিন্তা - শব্দবন্ধে ধরা যায় সেকাল আর একালকে। 'বৃন্দাবনের গানে' লোকপুরাণের থেকে একালে বাস্তবতায় অনায়াস যাওয়া- আসা। আসা- যাওয়ার পর্বে 'রাষ্ট্রনীতি', রাজার শাসনের খামতির সংবাদ জানান দেন পদকার। মেবার থেকে দ্বারকায় তাঁর অবাধ যাতায়াত। তবু ' অসমপ্রেমে' তাঁর সংশয়। প্রেম-প্রণয়ে সমতা-অসমতার শব্দ বন্ধ অনুশাসনের কথা শোনায়। সেই অনুশাসন কি নেই এখানে? বাংলাজুড়ে বহমান বৃন্দাবনের গানে সংশয়ী শাসন ক্রিয়াশীল থেকেছে। তাকে অস্বীকার করেননা পদকার। বালিবধে এসে ছন্দের চলনে হোঁচট খেতে হয়। গদ্যছন্দ বা অক্ষরবৃত্ত কোথাও স্থিত হতে পারেন না সোমনাথ। একালের তথাকথিত 'উন্নয়নের' সোপান জল-জঙ্গল -খনিজ লুঠেরারা ধরা দেয় ফ্রেমে। 'অরূপ বন্দাবন এবং অন্যান্য পদে' সজ্জিত এই পদাবলী বৃন্দাবন ছেড়ে আসার পর খেই হারিয়ে ফেলে বলেই মনে হয়। বিষয় বৈচিত্র্য ভিড় করে। বিধর্মীর বাড়ি পোড়া থেকে অতীন্দ্রিয় বিরহের জগতে পদকারের চারণা। কখনও 'ফসলের সুষম বন্টনে' ধর্মকে খুঁজতে চায় এই পদ। আবার আশাবাদী হয়ে সে উচ্চারণ করে –‘যে সভ্যতায় কেউ ভাবেনি অস্ত্র শালার কথা'- অথচ সভ্যতার বয়ানেই অস্ত্র আর রণরক্ত, ইউরোসন্ট্রিকতা। রণরক্তের বিপ্রতীপে পদকার খুঁজে চলেন - এদেশের 'সব মানুষই দেবতা হয়।' - পদে এমন অতিশায়ক্তিতে পৌঁছে যাওয়া আছে। এদেশে চণ্ডাল শিক্ষকের উপস্থিতির পাশেই তো ছিল শম্বুকের মুণ্ডপাতের আখ্যান - যাকে এড়িয়ে একটি একদেশদর্শী অবস্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা আছে পদাবলীতে। প্রশ্ন জাগে, পদকারের কেন এই অতীতচারিতা? আবার আশাবাদও যথেষ্ট। রাষ্ট্রিক ধারণার নিপাত চেয়ে স্বদেশী সমাজে ফেরার আকুলতা কবিতার অন্তিমে আলোরছটা ঢেলে দেয়। আসলে আমাদের 'সকলের গালে খুলির চিহ্ন লেগে থাকে'- রাষ্ট্রিক ভাবনা তাকে ভুলিয়ে চলে। চলতে থাকে। সেই বিস্মরণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে চায় এই পদাবলী।