এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • দেবেশ রায়ঃ স্রোতের বিপরীতে এক প্রতিস্পর্ধী চলন

    সৈকত মিস্ত্রী
    অন্যান্য | ১৭ মে ২০২০ | ১৪৭৯ বার পঠিত
  • https://postimg.cc/9zpqg9Xv
    " মুজবতা আলীকে আমি ঘৃণা করি।ওঁর সাহিত্যকে উচ্চমানের সাহিত্য বলে মনে করিনা।"- কথাটা শুনে চমকে গেছিলাম। বলে কি লোকটা? সহমত হইনি।আজও হবনা। এমন করে কেউ বলতে পারে! একান্ত ঘরোয়া পরিসরে ২০১০ সাল নাগাদ কথাটা শুনেছিলাম।তখন তাঁর সাথে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হত। আর একদিন মজলিসি চালে উপন্যাসের গঠন রীতি নিয়ে কথা বলছিলেন। বলতে বলতে থেমে গেলেন।তাঁর পর বললেন -" আসলে বাংলা সাহিত্যে যে প্রচলিত যুগবিভাগ করা আছে, তেমন যুগ বিভাগ হয়না।" বলেই মৃদু হেসে বলেছিলেন - আমি যেভাবে বলছি,আপনারা সেভাবে বলবেন না।
    সেভাবে বলা যায় না।ওটা দেবেশ রায় বলতে পারেন। আসলে তিস্তা পারের ছড়ানো বৃত্যান্তেই ওঁর পরিচয় থমকে গেল, তার বাইরে জ্ঞান চর্চার বহুধা শাখায় ওঁর ছিল অবাধ যাতায়াত। ইতিহাসকে অন্যভাবে দেখতে শিখতে হয় - কথাটা ওঁর কাছে যেভাবে শুনেছি, তা আজও মনে দাগ কেটে আছে। একটি সারস্বত প্রতিষ্ঠানের সিঁড়ি দিয়ে নামছেন,সাথে সাথে চলতে চলতে অনর্গল কথা বলছেন। সিঁড়িদিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে বললেন - " আজকাল চারিদিকে কি গন্ডোগো। কাউতাল না কাকতাল বলে একটা কথা শুনছি।ভাবছি কোথাও ব্যবহার করব।" কোথাওত তিনি সেটি ব্যবহার করেছেন বলে জানিনা। সব সময় তাঁকে আপনি সম্বোধন করতে শুনেছি। বলতাম - আপনি বললে অস্বস্তি হয় বড্ড। তিনি দাঁতে পিষে বলে চলতেন - আসলে কি জানেন, আমাদের মাস্টারমশাই সুনীতি বাবুরাও আপনি বলতেন।" এই নিয়ে তারপর আর কথা চলে না। আমারা কয়কজন বন্ধু পারস্পরিক আলোচনা করতাম - " উনি কি বাড়িতেও আপনি আজ্ঞে করেন নাকি!" উত্তর পাইনি।
    ধোপদুরস্ত পোশাকে চেয়ারটায় বসতেন, খুব সাবধানে প্লেট থেকে কাপটা তুলতেন।তার আগে অনেকক্ষণ পেয়ালাটাকে প্লেটে ঘষে শেষ বিন্দু চাটুকু প্লেটে ঝরিয়ে দিতেন।তারপর স্বস্তিতে চুমুক দিতে দিতে বলতেন - "আসলে যারা বলে কঠিনকে সহজ করে বলার কথা,আমি বলি কঠিনকে সহজ করে বলা যায় নাকি! কঠিনকে কঠিন করে বলতে হয়।" ওঁর ভাবনা কঠিন লাগত। কোন বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করলে এতটা গভীরতায় যেতন, একসময় হাঁপিয়ে উঠতে হতো।একটা আলোচনায় সমাধানে পৌঁছানো যাচ্ছিল না।সময় বেড়ে যাচ্ছ৷ আমরা এক বন্ধু ওঁর সামনে অধৈর্য হয়ে হাত ঘড়ি দেখতে বিরক্ত হয়ে একবার থেমে বললেন -" হাত ঘড়ি আমারও আছে।" কিন্তু তবু তিনি থামেননি।
    এমন টুকরো টাকরা স্মৃতিতে এখনও ধুলো পড়েনি।
    সাহিত্য আসলে রাজনীতির একটি ভাষ্য।ভাষ্যকার কোন সমাজের কথা বলেন,কোন রাজনীতির কথা বলেন - তার উপর নির্ভর করে সাহিত্য। রাজনীতি বর্জিত সাহিত্য চর্চা হয়না, যারা তা করতে চায় তাদের কাছে সাহিত্য আদৌ গল্প ছাড়া অন্যমানে নেই। এমন একটা বোধ দেবেশ রায়ের চর্যায় বার বার ধরা পড়েছে।আমিও এই কারণে ওঁর চিন্তাকে নিয়ে অনেকেটা সময় ধরে ভেবেছি। আজও ভাবি।তবে একটু অন্যভাবে।
    রাজশক্তিকে একটা লেখার রেফারেন্স টেনে একদিন তাঁকে বলতে শুনেছি সংখ্যালঘু। একটা সারণী তৈরির অক্ষম চেষ্টা করলাম-
    মুখ্যধর্ম
    রাজশক্তি ও পুরোহিত মধ্যজনতা শূদ্রজনতা
    সংখ্যালঘু ধর্মান্তরণ সংখ্যাগুরু
    - সমাজের ঘটনাবলী চলামান। ফারক শুধু দেখার দৃষ্টিভঙ্গীতে।সেই ভিন্ন দৃষ্টি বোধের আলোয় তাঁকে অনন্য মনে হয়।
    দেবেশ রায়ের জীবন আর বামপন্থী রাজনীতি মিলেমিশে চলেছে।আসলে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা না থাকলে সমাজকে বুঝবেন কিভাবে স্রষ্টা। সমাজ না বুঝলে লিখবেন কি করে সমাজের ভাষ্য? সেই জানা বোঝার কাজটা তিনি করেছেন। ওঁর একটি কথায় খটকা লেগেছিল - সাহিত্যে Form হল আকার।আকারটাই আলোচ্য।Form টাই Content! আসলে আকারটা নাকি অন্তঃপ্রবিষ্ট। তাই অভিন্ন।কথাটার সাথে সহমত হইনি।আমার বুঝতে না পারাও হতে পারে। ওঁর অনেক বিষয়ের সাথে আজও সহমত নই। ২০০৬-২০০৯ সাল পর্যন্ত এরাজ্যজুড়ে ক্ষমতাসীনের রাষ্ট্রীয় পিড়নের বিপ্রতীপে তিনি দাঁড়াননি। শাসকের
    " বড় প্রিয় মানুষ, তাদের কর্মের সমর্থক বন্ধু" হয়ে থেকেছেন।আবার একটি সদ্য গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপদেষ্টা হিসেবে তার নেতিবাচক ভূমিকাকে কখনো মানতে পারব না।সেটা ওঁর রাজনৈতিক মতামত। আমার অবস্থানের বিপরীতে।

    আজকাল কানপাতলেই রাষ্ট্রের হুঙ্কার শুনি।মানুষকে উদ্বাস্তু করার এক রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি হয়েছে।আপাতত মহামারীর অবরোধে সাময়িক ছেদ পড়েছে।কিন্তু সব মিটে গেলে ভয় হয় আবারও বহু উদ্বাস্তুর ভিড় দেখব।যেমন দেখছি পরিযায়ী শ্রমিজের খিদে পেটে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়ার ছবি। এই দুর্লগ্নে মনে পড়ে " উদ্বাস্তু " গল্পটির কথা। একদিন সত্যব্রতকে দুজন এসে জানিয়ে যায় থানায় যাওয়ার জন্য। বহুদিন ধরে বল্লভপুরে দুইপুরুষ ধরে বাস করছে সত্যব্রত।সে মৃত পুণ্যব্রত লাহিড়ীর পুত্র। একদিন সেই সত্যব্রত জানতে পারে - সত্যব্রত লাহিড়ী নামক কোন ব্যক্তি বল্লভপুর মিউনিসিপ্যালিটির ২৩০/এ/ ৬ নং হোল্ডিং মোকানের মালিক নয়।সেই সাথে এতদিন সে যাকে তার স্ত্রী বলে জেনে এসেছে সেও তার স্ত্রী নয়।এক জটিল রাষ্ট্রীয় সমস্যার আর অভিবাসনের সঙ্কটের নির্মম দলিল গল্পটি। " নিরস্ত্রীকরণ কেন", " পশ্চাদভূমি", " ইছামতী " গল্পের বয়ণের জটিলতার সাথে বিষয়গত অভিনবত্ব চিরলকালীন সঙ্কটের মাইলফলক হয়ে থাকবে।
    ১৯৭০ সালের ডুয়ার্সের সেটেলমেন্টের জরিপ এবং তিস্তাপারের বৃত্যান্ত নিয়ে না বললে বলাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মহাকাব্যিক উপন্যাসে সমাজ, সমাজসঙ্কট ও সামাজীকিকরণকে, তার মিথোষ্ক্রিয়াকে নৃতাত্ত্বিকের মতো বয়ন করেছেন লেখক।লোকাল কালার, উপভাষার চমৎকারিত্ব আর সব কিছু ছাপিয়ে যায় রাষ্ট্রীয় নিপিড়নের ভয়াবহতা। আর বাঘারু নামক চিরকালীন অবহেলিত মানুষের এক প্রতিনিধি জেগে থেকে।এগিয়ে চলে। " সেইঠে মোর নাম হয়া গেইল বাঘারু"। বাঘের মুখ থেকে বাঘারুর মত শ্রমিক- কৃষকরা বেঁচে মরে। শেষ পর্যন্ত মাদারির হাত ধরে উদ্বাস্তু বাঘারুকে ছাড়তে হয় তিস্তা পার।যেমন স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়নের নামে জল- লঙ্গল জমি থেকে প্রায় আট কোটি আদিবাসীকে উৎখাত করেছে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রটি।সেই সব মানুষের প্রতিনিধি হয়ে যায় বাঘারু। ' ব্যারেজের আলোহীন উচ্চতা,নির্জনতা,বিস্তার তাদের গ্রাস করে ফেলে।তার আর্তনাদ - "এইটে গেট বানাইছে, জল আটকি রাখিছে"- অন্তিমে তিস্তা পার ছেড়ে বাঘারু মাদারিকে চলতে হয় অনির্দিষ্টের পথে।বাঘারু মাদারিকে নিয়ে হাঁটুক হাঁটুক হাঁটুক। যেমন গোটা দেশের শত সহস্র বাঘারু আজ হেঁটে চলেছে অন্তহীন পথে,ঠিকানার পথে।সেই ভাষ্যই যেন কঠিনকে কঠিন করে বলতে চাওয়া দেবেশ রায় ভাবী ইতিহাসের গর্ভে বয়ন করে দিয়ে গেলেন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন