আমি বিস্তর সমস্যায় পড়ে গেলাম, কারণ সপ্তদশ শতকে ফ্রান্সের কোনও এক রাজা ক্রোয়েশিয়া থেকে ভাড়াটে সেনা আনিয়েছিলেন।
তো? সেই ভাড়াটে সেনাদের পোশাকে আটকানো থাকতো এক ফালি লম্বা কাপড় যেটা রাজামশাইয়ের সাঙ্ঘাতিক পছন্দ হয়ে গেল আর তিনি আদেশ জারি করলেন যে রাজ পরিবারের সদস্যদের পোশাকেও ওই বস্ত্রখন্ডটি ঝোঝুল্যমান রাখিতে হইবেক।
তাতে কি হল? আরে ওই “এক ফালি লম্বা কাপড়” থেকেই তো এল টাই যেটা প্রথমে ছড়ালো বাকি ইউরোপে, তারপর তাদের হাত ধরে, থুড়ি গলা ধরে, চলে গেল অন্যান্য মহাদেশে তাদের কলোনিগুলোতে।
তাতেই বা কি হল? আরে বাবা সে জন্যই তো সাড়ে তিনশো বছর পর আমার ল্যাজে গোবরে অবস্থা হল জীবনের প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে, যখন বন্ধুবর দীপাঞ্জন ঘোষণা করলেন ইন্টারভিউ দিতে গেলে টাই পরে যেতে হয়।
আমিঃ কেন?
দীপাঞ্জনঃ কেন মানে? টাই পরলে কত স্মার্ট লাগে জানিস না?
আমিঃ আমি স্মার্ট নই বলতে চাস?
দীপাঞ্জনঃ হ্যাঁ হ্যাঁ সে আমার জানা আছে।
আমিঃ না না শোন না, বলছিলাম কি আমাদের মত গরম দেশে টাই-এর মত টাইট পোশাকের কোনও দরকার আছে কি?
দীপাঞ্জনঃ নাম্বার ওয়ান – টাইটা পোশাক নয়, অ্যাক্সেসরি। নাম্বার টু – আমাদের মত গরম দেশে এখন শীতকাল চলছে। আর কপচাবি না। টাই পরে ইন্টারভিউ দিতে যাবি ব্যস।
নাহ, দীপাঞ্জনকে ইন্টারভিউ দিতে যাব বলাটাই আমার ভুল হয়েছে। ব্যাটা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ত, “তাই তাই” করার বয়স থেকে টাই পরছে। তা ছাড়া, সত্যি কথা বলতে স্মার্টনেসেও ওর চেয়ে আমি অনেকটাই ইয়ে...
আমিঃ আমার টাই নেই।
দীপাঞ্জনঃ আমারটা নিয়ে যাস।
আমিঃ আমি টাই পরতে পারি না।
দীপাঞ্জনঃ ওহহহ... ইন্টারভিউ কটায়?
আমিঃ সাড়ে বারোটায় যেতে বলেছে।
দীপাঞ্জনঃ কবে? কোথায়?
আমিঃ অমুক জায়গায়, তমুক দিনে।
দীপাঞ্জনঃ গুড। যাওয়ার আগে আমার বাড়ি আসবি। পরিয়ে দেব। কোট বা ব্লেজার আছে?
আমিঃ কোট আর ব্লেজারের মধ্যে ডিফারেন্স কী রে?
দীপাঞ্জনঃ একটা ফরম্যাল, অন্যটা নয়।
আমিঃ কোনটা ফরম্যাল? ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ার সময়ে আমার কোনও একটা ছিল।
দীপাঞ্জনঃ স্কুল ইউনিফর্ম?
আমিঃ না না। আমাদের স্কুলে নেভী ব্লু সোয়েটার পরতে হত।
দীপাঞ্জনঃ তাহলে ওটা কোটই হবে। যাকগে, তুই কি আমার ব্লেজারটা পরবি?
আমিঃ পাগল? এমনিতেই আমি রোগাপ্যাংলা। তার ওপর তোর মত বুলওয়ার্ক করা হ্যান্ডসাম ছেলের ব্লেজার পরলে কাকতাড়ুয়া মনে হবে।
দীপাঞ্জনঃ তাহলে এমন সোয়েটার পরবি যাতে টাইটা দেখা যাবে।
দীপাঞ্জন তো বলে খালাস, এদিকে ইন্টারভিউ-এর দিন সকালে সোয়েটার পরতে গিয়ে দেখি একটা হাই-নেক, আর অন্যটা – যেটা বিয়েবাড়ি-টাড়িতে পরা হয় - সেটা লন্ড্রিতে, নিয়ে আসার মত সময় নেই। আর যে দুটো আছে তা পরে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া যায় না। মা বললেন বাবার সোয়েটার পরে যেতে। আইডিয়া আচ্ছা হ্যায়, কিন্তু বাবার সোয়েটারের রং আমার পছন্দ হয় না। এসব করতে করতে দেরি হয়ে গেল। যা হোক, শেষ পর্যন্ত এক খানা পরে গেলাম টাই বাঁধাতে। লোকে ছবি বাঁধাতে যায়, আমি টাই বাঁধাতে গেলাম।
দীপাঞ্জন খান তিনেক টাই বার করল আলমারি থেকে। একটা চওড়া মাস্টার্ড রঙের, একটা তুলনায় সরু, নীলচে ধূসর, তাতে আবার টেরচা সাদা স্ট্রাইপ। আর তিন নম্বরটা খয়েরি। এক এক করে তিনটেই আমার অ্যাডামস অ্যাপলের কাছ থেকে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে দেখে পরখ করল কোনটা আমার সোয়েটার আর শার্টের সাথে ম্যাচ করে। বার দুই দেখে নিয়ে খয়েরিটা পছন্দ করল।
আমিঃ নীলটা বেশি ভাল হত না?
দীপাঞ্জনঃ সাদা শার্ট আর হলদেটে সোয়েটারের সাথে ব্লু কালার যায়? গাধা...
আমিঃ আসলে ওইটা দেখতে বেশি ভাল লাগছিল।
দীপাঞ্জনঃ তাহলে আমার ব্লেজারটাই পরতে হবে।
আমিঃ না না। যেটা ভাল মনে হয় সেটাই দে। বাপরে, প্রচুর বেজে গেল যে, তাড়াতাড়ি কর।
দীপাঞ্জন খয়েরি টাই বেঁধে দিল ঝড়ের বেগে, আর মুখ চালাল আরও স্পিডে। এই রকম বোতামওয়ালা সোয়েটার নাকি বয়স্ক লোকেরা পাঞ্জাবির সঙ্গে পরে, ইয়ং ছেলেরা ইন্টারভিউ দিতে গেলে পরে না, আর টাই-এর সঙ্গে তো নয়ই, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু করার নেই, মুখের ভেতর থেকে কথা আর বাড়ির ভেতর থেকে সোয়েটার একবার বেরিয়ে গেলে আর পালটানো যায় না। আয়নায় এক ঝলক নিজের “স্মার্ট” চেহারাখানার দিকে তাকালাম, খুব একটা ইম্প্রেসিভ লাগল না। সত্যিই ওই সোয়েটারের সাথে টাইটা ম্যাচ করছে না। মোদ্দা কথা হল, বুঝে গেলাম চাকরি যদি আমার না হয় তা হলে ওই সোয়েটারের জন্যই হবে না।
হলও না। তবে সেটা সোয়েটারের দোষে, নাকি আমার, তা জানি না।
সেলসের চাকরি, ওয়াক-ইন ইন্টারভিউ। কারও কাছে শুনেছিলাম এক বেচুবাবু এক বাড়িতে দুটো ওয়াটার পিউরিফায়ার গছিয়েছিল, একটা রান্নাঘরে ফিট করা হবে - খাওয়ার জন্য, আর অন্যটা বাথরুমে - স্নানের জন্য। “স্যার, আপনার এমন চমৎকার চুল, সল্টলেকের জলে একদম নষ্ট হয়ে যাবে” - এই সব বলে নাকি কাস্টমারের ঘাড় ভেঙেছিল। এ গল্পের সত্যিমিথ্যে জানি না, তবে সল্টলেকের জলে তখন সত্যিই বড্ড আয়রন থাকত। লোকে বলে সেলসের কাজে প্রচুর বকতে হয়। তা বকবক করতে আমি ভালই পারি, তবে সেটা বেচার কাজে লাগবে কি না জানি না। এমন ভাবে মাল বেচা প্রায় যুদ্ধেরই সামিল।
যাই হোক, ক্রোয়েসিয়ার সেনাদের মত যুদ্ধযাত্রা করলাম। মানে তমুক সময়ের খানিক আগে অমুক জায়গায় পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি ওয়েটিং রুমে টেবিল পেতে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। আমারই মত কয়েকজন চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে। টেবিলের ভদ্রলোককে যখন জানালাম যে আমি তোমাদের কোং-কে ধন্য করতে এসেছি, তখন এরা সবাই আমার দিকে তাকাল, মানে মেপে নিল। কিন্তু কিমাশ্চর্যম! তার পর আর একবারও আমায় দেখল না। মানে আমায় ধর্তব্যের মধ্যেই আনল না। কেন রে বাবা? তোরা টাই পরেছিস, ফুল শার্ট পরেছিস (আমিও তাই), তোদের ইস্তিরি করা ফুল প্যান্ট (আছি), কালো জুতো (আছি)। তারপরই কারণটা বুঝে গেলাম। আমার মত সোয়েটার কেউই পরেনি। হয় কোট (অথবা ব্লেজার) পরেছে, নয়তো শুধই শার্ট। ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে ভেটারেন হয়ে গেছে এরা। আমার শ্রী-অঙ্গে নিজের জামা, দীপাঞ্জনের টাই, আর বাবার সোয়েটার দেখেই বুঝে গেছে আমার চাকরির স্বপ্নে একটি অতি বৃহৎ অপক্ব কদলী ছাড়া আর কিস্যুটি নেই।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ডাক এল, দুরুদুরু বক্ষে পাশের ঘরে গেলাম ইন্টারভিউ দিতে। দীপাঞ্জন শিখিয়ে দিয়েছিল গিয়েই চাকরিদাতাকে উইশ করবি, করলাম। বসতে বলা হল, বসলাম। কাগজপত্র চাওয়া হল, দিলাম। তিনি কাগজ এবং আমি উভয়কেই মনযোগ সহকারে দেখলেন। আমাকে (না কি আমার পোশাককে) একটু বেশিই দেখলেন মনে হল। তারপর ইন্টারভিউ মোটামুটি এই রকম হল—
চাকরিদাতাঃ আগে কোথাও কাজ করেছেন?
আমিঃ না।
চাকরিদাতাঃ মোটরবাইক আছে?
আমিঃ না।
চাকরিদাতাঃ চালাতে পারেন?
আমিঃ না।
এত নেগেটিভের সঙ্গে লড়াই করে বীরপুরুষ কবিতার খোকা হয়তো জিততে পারত, আমি না। হয়ে গেল, জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ-এর মেয়াদ সব মিলিয়ে মিনিট পাঁচ।
অমুক জায়গা থেকে সোজা গেলাম দীপাঞ্জনকে টাই ফেরত দিতে। ভেবেছিলাম আর এক প্রস্থ লেকচার শুনব, কিন্তু না। সব শুনে সান্ত্বনা দিয়ে টাই বাঁধা শিখিয়ে দিল। সকালে সময় পাওয়া যায়নি। সোয়েটারটা খুলে ফেলতে বলল, তারপর স্লো-মোশনে টাই পরাল আমায়, তখন ফাস্ট ফরোয়ার্ডে পরিয়েছিল। গ্রামের দিকে অনেকে কাঁধে গামছা রাখে, অনেকের আবার সেটা গলার দু দিক দিয়ে ঝোলে। টাইটাও অমন দু দিকে ঝুলিয়ে দিল। তারপর এ দিক দিয়ে ঘুরিয়ে, ও দিক দিয়ে নামিয়ে, সে পাশ দিয়ে পেঁচিয়ে কিসের যেন ফোঁকর দিয়ে গলিয়ে দিল। ব্যাস, হয়ে গেল টাই পরা। বাবাজীবন দ্বিতীয়বারের মত সুন্দর ভাবে চেপে বসলেন আমার গলায়। কোন একটা ইংরেজি সিনেমায় দেখেছিলাম এক মহিলা তাঁর হাজব্যান্ডকে টাই পরিয়ে গলার কাছে কী সব করছিলেন। এখন দীপাঞ্জনকেও অমন করতে দেখে বুঝলাম ফাইন টিউন করছে। কাজ সারতে সারতে বলল একটা টাই কিনে নিতে, এখন ঘন ঘন লাগবে, সব সময়ে তো ও নাও থাকতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সোয়েটারমুক্ত কিন্তু টাইযুক্ত হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম, দেখলাম মন্দ লাগছে না। ইসস, তখন সোয়েটারটা না পরে গেলে হয়তো আমার চাকরিটা হয়ে যেত। এখন আর কিছু করার নেই। অ্যাঙ্গল বদলে বদলে নার্সিসাসের মত নিজেকে অবলোকন করলাম নানা ভাবে। তারপর লজ্জা লজ্জা গলায় বললাম, “বাঁধা তো শেখালি, এবার খোলাটাও শেখা। নইলে যে অভিমন্যুর মত অবস্থা হবে।”
কলোনিয়াল হ্যাংওভারে করপোরেট কুপোকাত।
খুবই প্রাণবন্ত লেখা। নিয়মিত লিখুন।
#
লেখার শেষাংশে ফেসবুক ইত্যাদি ঘোষণা বাহুল্য মনে হয়েছে। ইচ্ছে হলে সম্পাদনা করে এটি বাদ দিতে পারেন।
ধন্যবাদ b. আপনার উল্লেখ করা টাই-এর হিন্দি প্রতিশব্দটা শুনেছিলাম, তবে সেটা সত্যি কি না সন্দেহ ছিল।
ধন্যবাদ বিপ্লব রহমান। আপনার পরামর্শ মেনে বাহুল্য বর্জন করলাম।
গ্রম্য মানুষ বলতো , টাই পরতে না কি BA পাশ লাগে , আপনার মতামত চাই বা সঠিক তথ্য চাই , সত্যি কি টাই পরতে শিক্ষার যোগ্যতা লাগে?
"গ্রম্য মানুষ বলতো , টাই পরতে না কি BA পাশ লাগে , আপনার মতামত চাই বা সঠিক তথ্য চাই , সত্যি কি টাই পরতে শিক্ষার যোগ্যতা লাগে?" কোনও একটা পোশাক (বা অ্যাক্সেসরি) পরার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার কী প্রয়োজন? আসল কথা হল আমি একটা বিশেষ পোশাকে স্বছন্দ বোধ করছি কি না, সেটাকে ক্যারি করতে পারছি কি না। ঐ বি-এ পাশের ব্যাপারটা সম্ভবত "লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে"-র একটা বিশেষ সংস্করণ।
খুব ভালো লাগল নির্মাল্য ।