স্বাধীনতার ৫৩ বছর, আমরা এত বছর পরে এখনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছি! হাস্যকর হলেও এইটাই বাস্তব। আমরা আজও কেন এই সব নিয়ে চিন্তা করব? এগুলা মীমাংসিত বিষয় না? কিন্তু এমনই কপাল এই জাতির যে এইটা নিয়ে কথা না বললে কে যে কোন ইতিহাস খাওয়ায় দিবে বুঝা মুশকিল। অথচ আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন দিক গুলো নিয়ে ভাবতে পারতাম। আমরা মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধ ছাড়াও অন্য অপরাধ গুলো নিয়ে ভাবতে পারতাম। আমরা ভাবতে পারতাম ধর্মের নামে কীভাবে মানুষ হত্যা সমর্থন করতে পারে একটা দল! আমরা গবেষণা করতে পারতাম কী মনস্তত কাজ করেছিল একজন রাজাকারের মনে, তার কী চিন্তা ছিল? পাকিস্তান রক্ষা করা? এর জন্য এত এত নিজের এলাকার, পরিচিত ভাইদেরকে অনায়াসে তুলে দেওয়া যায় পাকিস্তানিদের হাতে? নিষ্ঠুর হওয়া যায়? ধর্ষণ করতে পারে? শিশু হত্যা করতে পারে? এইটা কোন মাপের দেশপ্রেম? এইটা কেমন ধর্ম পালন? আমরা নানান দিকে আমাদের চিন্তা ভাবনা প্রসারিত করতে পারতাম। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদেরও যদি কোন যুদ্ধাপরাধ হয়ে থাকে তা নিয়ে আলোচনা করতাম। বিহারিদের ওপরেও নানা অত্যাচার হয়েছে, মানুষ হত্যা হয়েছে। আমরা এখন এইসব নিয়ে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু না! আমরা আজও সীমাবদ্ধ হয়ে আছি পক্ষ বিপক্ষ নিয়েই।
আমাদের আর কোন রাস্তাও নাই, কী করব? এত বছর পরেও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসকে কথিত গণঅভ্যুত্থান থেকে পাওয়া সরকার হাস্যকর বানিয়ে রেখে দিতে পারল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তরের নাম পরিবর্তন করে বিজয় ২৪ রাখা হল এই ১৪ ডিসেম্বরেই! ৫৩ বছর পরে যে বিজয় দিবস আসল তার নাম পরিবর্তন করে দিয়েছে জাতীয় শিল্পকলা অ্যাকাডেমি! কুচকাওয়াজ বন্ধ হয়েছেই, কথা ছিল বিজয় উৎসব করবে। শিল্পকলা অ্যাকাডেমি ওইটাকে বানিয়েছে ডিসেম্বর উৎসব! আর ডিসেম্বর উৎসবের প্রথম আয়োজন কী? কাওয়ালি! কাওয়ালি দিয়ে শুরু হবে অনুষ্ঠান।
এখানেই শেষ না। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিজয় দিবস উপলক্ষে বিশাল বিশাল পোস্টার, ব্যানার বানানো হয়েছে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে আবু সাইদ, এইটা হচ্ছে বিজয় দিবসের পোস্টার!
১৪ তারিখ ছিল বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের ১৪ তারিখ, পরাজয় বুঝতে পারে অদ্ভুত কুৎসিত এক কাজ করে যায় আল বদরেরা। নাম ঠিকানা তালিকা করাই ছিল। জয় সুনিশ্চিত জেনে বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই বাড়িতেই ছিলেন। ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে। মেরে ফেলা হয় সবাইকে। জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকিল্পনা যে কাজে লেগেছে তা ৫৩ বছর পরে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। যত ফালতু আবর্জনা মাথার ওপরে ঘ্যাঁট হয়ে বসে আছে, কিচ্ছু করার নাই। আর তাই শুনতে হয় বুদ্ধিজীবীরা কেমন বুদ্ধিজীবী ছিল যে যুদ্ধের মধ্যে বাড়িতেই বসে ছিল? কেউ প্রশ্ন করছে আচ্ছা, এইটা ভারতের কাজ না তো? সেই সময় তো পাকিস্তান সেনাবাহিনী নাই বললেই চলে, ওরা আবার মানুষ মারতে গেছে? এইটা নিশ্চিত ভারতের কাজ! বাংলাদেশকে ধ্বংসের জন্য এই কাজ করেছে!
৫৩ বছর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া এক ছাত্রনেতা, সমন্বয়ক হু হু করে কাঁদছে মাইকের সামনে এই বলে যে আলেমদেরকে মুক্তিযুদ্ধ ব্যবহার করে আওয়ামীলীগ ফাঁসি দিয়েছে! এই অন্যায়ের বিচার না কি তারা করবেই!
আমাদের কী করার থাকে আর? চুপ করে বসে থাকা? হ্যাঁ, তোমাদের দিন আসছে, কর যা ইচ্ছা তাই। কিন্তু দিন থাকবে না বলে তামশা দেখাই কাজ? নির্বোধ হলে সুবিধা হত, এগুলা দেখে চুপ করেই কাটিয়ে দেওয়া যেত এই জীবন। পরিস্থিতি পরিবর্তনের পরে বুঝতে ছিলাম এমন দিন সামনে আসবে কিন্তু যখন আসলেই সামনে আসল তখন মানতে কষ্ট হচ্ছে। এমনও সম্ভব? এই দেশে এইটা সম্ভব প্রধান উপদেষ্টা জুতা পরে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে শ্রদ্ধা জানাতে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে উঠে যাবেন? যুদ্ধের পরে ভুট্টুর কথা মনে পড়ল। তাকে যখন স্মৃতিসৌধে নিয়ে যাওয়া হয় শহীদের প্রতি সম্মান জানাতে, সেদিন তিনি রঙ্গিন জামা পরে মাথায় হ্যাট পরে গেছিলেন! স্পষ্ট অপমান করার চেষ্টা। নোবেল ম্যানের জুতা পরে স্মৃতিসৌধের বেদিতে উঠে দেখে আমার প্রথমেই এইটা মনে হয়েছে। একই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতিও গেছেন, তিনি জুতা খুলেই গেছেন। এই কাণ্ডের ব্যাখ্যা কী?
এমন না এইটাই প্রথম। বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়ে এর আগেও নানা উল্টাপাল্টা কথা শোনা যেত। অপমানজনক কথাবার্তা। এরা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের বেতন ভাতা নিত, এঁদেরকে কেন এত সম্মান দেওয়া? এরা প্রত্যেকেই যে পাকিস্তানের পক্ষেই আছি, চাকরি করছি, বেতন নিচ্ছি এইটা দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সাহায্য করে গেছে এইটা কে বুঝাবে? কিন্তু এগুলা বিএনপির মতো দলের নেতারা হরহামেশা বলে গেছে। আজকে তাদের চেলারা বলে যাচ্ছে। এমনই কপাল খারাপ আমাদের এই জাতির।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে এই দেশে। সেনাবাহিনীর অফিসারদের যুদ্ধের সময় একটা কথা শোনা গেছে, ভয়ংকর সেই উচ্চারণ - আদ্মি নেহি মাংতা, হম্ মিট্টি মাংতা! নির্বিচারে মানুষ মেরে গেছে একটা দেশের সেনাবাহিনী। তাদের দোসররা সাহায্য করেছে। আজকে যখন আপনি দেখবেন সেই দেশের লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে আপনার দেশে, দেখবেন সেই দোসররা গলা ফুলিয়ে বলছে পক্ষ নেওয়া তো অপরাধ না! জামাত পক্ষ নিলেই ভুল কী করেছে? কোন ভুল নাই, শুধু যে দেশের বিপক্ষে, যে দেশের মানুষের রক্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই দেশ ছেড়ে চলে গেলেই হত! যাদের পক্ষ নিয়ে ছিলেন তাদের কাছে থাকলেই তো ভালো থাকতেন, আমাদের এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হত না আর!
কয়টা লেখব? ডিসেম্বর মাস আসলে আগে রাজাকারদের শরীরে জ্বালা ধরে যেত। এবার দেখছি সরকারের শরীরে জ্বালা ধরে গেছে। যত ভাবে পারছে চেষ্টা করছে মুক্তিযুদ্ধকে সরিয়ে ২৪ আন্দোলনকে সামনে আনার। সংসদ ভবনে বিজয় দিবস উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন, কী? ২৪ সালের আন্দোলনের স্লোগান, গ্রাফিতি প্রদর্শনী! ভালো না?
আমাদের এমনই দিন চলছে। আমরা জয় বাংলা বললে এখন রাষ্ট্রদ্রোহি মামলা খেয়ে যাব। আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে ভারতের দালাল ট্যাগ খেয়ে যাব। আমরা সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার কথা বললে হিন্দুত্ববাদের সমর্থক, বিধর্মী, নাস্তিক ট্যাগ খেয়ে বসে থাকতে হবে।
সহজেই মানুষকে এই সব দিয়ে ভুলিয়ে রাখা গেছে, যাচ্ছে। ভারত বিরোধী বাতাস প্রবল ভাবে চালানো হচ্ছে, হিন্দুরাই সব ঝামেলার উৎস, আওয়ামীলীগের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে এমন সব কথা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা যাচ্ছে সব ব্যর্থতা। এদিকে আরাকান আর্মি মায়ানমার বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলের দখল নিয়ে নিয়েছে, নাফ নদীতে নৌকা চলতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আরাকান আর্মি! কেউ এইটা নিয়ে লং মার্চও করে না, কেউ গরম গরম বক্তব্যও দেয় না, কোন সাবেক আর্মি অফিসারকেও দেখলাম না রাস্তায় মিছিল করতে যে চার দিনেই আরাকান আর্মির ঘর দখল করে ফেলবে! কোন সারা শব্দই নাই। অথচ এইটা বাস্তব সমস্যা, ভয়ংকর সমস্যা। আরাকান আর্মির সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ নাই। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের বিদ্রোহী গোষ্ঠী কুকি চিনের সাথে দহরম মহরম। এমনেই মায়ানমারের সাথে আমাদের সম্পর্ক যতখানি খারাপ হওয়া সম্ভব তারচেয়ে ঢের বেশি খারাপ। তার মধ্যে এই যন্ত্রণা। অথচ এইটা নিয়ে ভাবার সময় নাই কারো। এদিকে কলকাতা চারদিনে দখল করে ফেলতে পারলে আজকেই রউনা দিয়ে দেয়!
আর ভালো লাগে না এই হিপোক্রেসি! স্বাধীনতা বিরোধীদের ঘাড়ে হাত রেখে যখন সরকার প্রধান বলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হবে তখন মাথা ক্র্যাক করে। রিসেট করে সব মুছে ফেলতে চাওয়া লোকটা যখন আগামীকাল স্মৃতিসৌধে ফুল নিয়ে যাবে তখন কেমন লাগবে আমার? যে বিজয় দিবস উপলক্ষে তিনি তার উপদেষ্টা মণ্ডলী নিয়ে যাবেন সাভারে সেই বিজয়ের প্রধান স্তম্ভ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি এখন পর্যন্ত ধ্বংস স্তূপ হয়ে আছে, এইটা কোন মাপের ভণ্ডামি? মুক্তিযুদ্ধের গল্প হচ্ছে, স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে, অথচ কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম নিচ্ছে না! এমন কাঁঠালের আমসত্ত্ব দৈনিক বানানো হচ্ছে। ভেড়ার পাল তা চেটেপুটে খাচ্ছে। চলছে জীবন…
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।