আমাদের এলাকায় গোয়ালপট্টি বলে একটা এলাকা আছে। ঘোষ পট্টি বললে হয়ত ঠিকঠাক নামকরণ হত, কিন্তু নামের উপরে কারও হাত নাই। এখানে সব মিষ্টির দোকান। এক সাথে পনেরো বিশটা দোকান। আগে আরও বেশি ছিল কি না জানি না। এখানে দোকানের পিছনেই কারখানা, সাথেই সবার বাড়ি। এক সাথে অনেক হিন্দু পরিবার এখানে থাকে। মিষ্টির দোকানের পরেই শহরের সবচেয়ে বড় বড় থান কাপড়ের দোকান গুলো এখানে। এরাও সব হিন্দু ব্যবসায়ী। পাঁচ আগস্টের সেই কালো রাতের একটা বর্ণনা শুনলাম। গায়ে কাটা দেওয়ার মতো। ছেলেটা আমাদের বয়সই। মুখ চেনা, সরাসরি কথা কোনদিন হয়েছে কি না মনে নাই। আজকে এক জায়গায় কথা উঠল। ও ওর অভিজ্ঞতা বলল আমাকে। বলল এই গণ্ডগোলের দুইদিন আগে ও দোকানে মাল তুলেছে। ওর বেশি বড় দোকান না, রাস্তার পাশে ছোট একটা চালার নিচে কমদামী গার্মেন্টস বিক্রি করে। বেশি টাকার ব্যবসা না কিন্তু ওইটাই ওর সম্বল। ও বলছে যে দোকানের যদি কিছু হয় তাহলে ওরা আমাকে না মারলেও আমার মরতে হবে এমন পরিস্থিতি আমার! আমি নিঃস্ব হয়ে যাব একবারে। কিন্তু কিছু তো করার নাই। ও দোকানেই বসে আছে। ওর বাড়িও কাছেই। ওর বাবা ভয় পাচ্ছে, বলছে তুই বাড়ি আয়। ও যে কয়েক কদম হেঁটে বাড়ি যাবে এই উপায় নাই। লুটেরাদের প্রধান টার্গেটই ছিল গোয়ালপট্টি। হিন্দু বেশি এখানে, বড় ব্যবসায়ী আছে। আর কী চাই? ও বলতেছে ভাই, একজনের হাতে লাঠি নাই! সবার হাতে দা চাক্কু! আমি যে হেঁটে যাব কোন ভরসায় যাব?
ও বিএনপি করে বন্ধু মানুষকে ফোন দিয়েছে। বলছে ভাই তোরা না আসলে আমি শেষ, আমার দোকান শেষ। দুই একজন আসছে। এসে কিছুক্ষণ থেকে চলে গেছে। তারাও ওকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সাহস পায় নাই। বা বলে নাই যা, দোকানের কিছু হবে না, চিন্তা করিস না। শরীর কাঁপছে ওর। কিছু করার নাই। বিএনপি করে বন্ধুরা বেশিক্ষণ থাকতে পারে নাই, ওদেরও তো বিশাল সুযোগ এসেছে। এখানে কতক্ষণ বসে থাকবে? চলে গেছে। এই ছেলের দোকান শেষ পর্যন্ত কিছু হয় নাই। কিন্তু ওর চোখের সামনে যা হয়েছে তা ভয়ংকর সব গল্প।
সমানে মানুষ আসছে। ভিড় করে বসে আছে। কই থেকে আসছে, এদের নেতা কে কেউ জানে না। টাকা দাও না হলে আগুন। হিন্দু অনেক নেতা আছে যারা বিএনপির রাজনীতি করে। তাদেরকে ফোন দেওয়া হয়েছে, তারা ফোন ধরে নাই। তারাও বড় শিকারে ব্যস্ত ছিল। ক্যাশ থেকে, মাল নিয়ে একে দোকান থেকে পাঁচ দশ লাখ করে নিয়েছে বিনিময়ে দোকানকে ছেড়ে দিয়েছে। দামি দামি শাড়ি, থান কাপড় নিয়ে গেছে মাথায় করে। চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
এইটা গেল ওইদিনের কাহিনী। এখন, যখন অনেকেই মনে করছে দেশ আবার স্থিতিশীল হয়েছে। তখন কী হচ্ছে? দুইটা ঘটনা শুনলাম। হিন্দু ছেলেরা যারা বিএনপি করত তারা সামনে আসছে। হিন্দুদের রক্ষার জন্য তারা ভূমিকা রাখবে না? না, ওরাও জানে এইখানেই টাকা! নতুন করে পূজা উদযাপন কমিটি করেছে, ওরাই সভাপতি, সেক্রেটারি হয়ে বসেছে। তো তারা বসবে কই? হিন্দু আরেকটা ছেলে যে অল্প বয়সে ব্যবসা করে মোটামুটি টাকা বানাইছে। আওয়ামীলীগের নেতাদের সাথে খাতির ছিল। এইটাই ওর দোষ। ওর একটা সুন্দর গোছানো অফিস আছে। ওইটার যে মালিক, যার কাছ থেকে ও ভাড়া নিয়ে অফিস বানাইছে, তারে এই নতুন নেতারা গিয়ে বলছে ওই অফিসের চাবি দেন! উনি বলছেন ওইটার চাবি আমি কই পাব? ওইটা তো অমুকের কাছে। ওর কাছ থেকে এনে দেন! কেন? ওইটাতে এখন থেকে আমরা বসব! তিনি বলছেন আরে এমন করে হয় না কি? ওরে ছেড়ে দিতে বললে তো সময় দিতে হব, ও আরেক জায়গা খুঁজে তারপরে না ছাড়বে। না, ওরে কিছুই বলতে হবে না, আপনে চাবি এনে তালা খুলে দেন, আমরা ওর মালপত্র বাহিরে বের করে দিচ্ছে, ও নিয়া কই যাবে যাক। ওই অফিস আমাদের লাগেব।
এই লোক মানে মালিক ওই এলাকার হিন্দু বড় এক বিএনপির নেতাকে ফোন দিয়ে এইটার একটা ফয়সালা করার জন্য বলেছেন। তিনি উত্তর পাইলেন কি? তুমি এগুলার জন্য আমাকে ফোন দিছ কেন? এগুলা সুপারিস কেন করছ? পুলাপান অফিস চাইছে ওইটা, গুছানো অফিস, দিয়া দেও ওদের। ওরা কই বসবে? চায়ের দোকানে বসেব?
শেষ! কেস ডিসমিস!
নতুন পূজা উদযাপন কমিটির কয়েকজনকে আমি চিনি। কী অদ্ভুত পরিবর্তন! কয়েকজন রাস্তায় দেখলে সালাম আদাব দিত। কালকে তাদের নতুন কমিটির কথা আমার সামনেই বলতেছিল আরেকজনকে। আমাকে তাকায় দেখল না পর্যন্ত!
আমাদের বন্ধু হয়। এখানের অন্যতম বড় মিষ্টির দোকান। আমরা ওদের বাড়ির লোকজনকেও চিনি। মাঝে মধ্যে আমাদের ওদের দোকানের ভিতরে যেখানে সব মিষ্টি তৈরি হয় সেখানে নিয়ে ছেড়ে দেয়। বলে যা খাইতে পারস খা! অত মিষ্টি একসাথে দেখে খাওয়া ভুলে যাইতে হয়। আর মিষ্টি খাইলেও আর কয়টা খাওয়া যায়।
এদের দোকানে একজন মহামান্য আসছেন। দশ কেজি মিষ্টি ওজন করতে বলেছেন। মিষ্টি ওজন করে প্যাকেট করা হয়েছে। তিনি বললেন, খাতায় লিখে রাইখেন। আমার বন্ধুর কাকা দোকানে বসা। তিনি মহা ঘাড় ত্যাড়া লোক। তিনি জবাব দিলেন খাতা নাই আমার। আমি বাকি বিক্রি করি না, খাতা দিয়া কি করমু? যা বানাই বেচি, আবার বানাই আবার বেচি! কোন বাকির কারবার নাই! মহামান্য জবাব দিলেন, আচ্ছা, তাইলে পরে দিয়া যাইতেছি। কাকা হাত থেকে মিষ্টি রেখে দিছেন! শুরু হয়ে গেল গালিগালাজ! আরও খারাপ দিকে যাইত এই মধ্যে আমার বন্ধু এসে গেছে। ও এসে বলছে কি হইছে? টনি জবাব দিলেন, এইটা ক্যাশে কে বসে আছে? ও বলছে ম্যানেজার। আপনে কে? আমার বন্ধু বলছে আমি মালিক, বলেন কি হইছে। যা না তা বলছে ওর কাকাকে। এখন এইখানে জুতা দিয়া বাড়ি দেওয়া উচিত ইত্যাদি। পরে ও বলছে ব্যবসাপাতি খারাপ, বুঝেনই তো। আমরা এইটার উপরেই বেঁচে আছি। মনে করে পরে টাকাটা দিয়া যায়েন। মহামান্য খুশি, বলল এইটা হইল না কথা! বলে মিষ্টি নিয়ে চলে গেল। আমার বন্ধু আমাদেরকে বলছে কাকা ওকে এরপরে ধমক দিতেছিল, কেন এমন করলি! ও আমাদের বলছে যে এখন কউ কাকারে কেমনে বুঝাই!
এই সংস্কৃতি বিএনপির আগের সময়েও ছিল। আমার একটা অভিজ্ঞতা বলি। আমার এক বন্ধু বিএনপির রাজনীতি করে। আমাকে বলল চল দই খাব। দুই বন্ধু মিষ্টির দোকানে ঢুকি, না দই নাই! যে দোকানে ঢুকি ওই দোকানেই নাই! আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম। সব দোকানে দই নাই? এইটা কোন কথা? ও হুট করেই বুঝল। আমাকে বলল গোপালদের দোকানে গিয়া তুই দই চা, থাকলে আমাকে ফোন দিস। আমি গেলাম, দই চাইলাম, বলল আছে, বস। আমি ওকে ফোন দিলাম। ও আসল, গোপালের কাকার মুখ শুকায় গেল! আমি অবাক! ও একটু বিচার বুদ্ধি রাখে, তাই আমাকে বলল ক, এখন পরিস্থিতি যদি এমন হয় তাইলে কেমনে কী করবি? বিএনপির করে এমন ছেলে দেখলেই তারা আতঙ্কে পরে যাচ্ছে। এতদিন পরে একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে!
চাঁদা চাইতে এখন কোন কিছুই লাগছে না। শুধু সাহস করে চাইতে হবে আপনাকে। ছোট শহর আমাদের। সবাই প্রায় সবাইকেই চিনে। শহরের একেবারে ছাঁট বাছাই করে ফেলে দেওয়া যে মাল গুলো। দেড়শ টাকা দামের দেশি মদ যাদের নেসার দৌড়, কিংবা আরও নিচে যারা গাম দিয়ে নেশা করে তারা চাঁদা চাচ্ছে দশ লাখ! ও জানেও না দশ লাখে কয়টা শূন্য থাকে! দশ লাখ যে আসলে কত টাকা এইটা ওর ঘিলুতে নাই। চায়া বসছে এমন ভাবে যেন এক হাজার টাকা চাইছে। গাম খাওয়া এক পার্টিকে চার লাখ টাকা নিতে দেখছি আমি নিজেই। ওর জীবনে ও এত টাকা এক সাথে দেখছে কি না সন্দেহ। কিছুক করার নাই। কাকে বলবে? একজনকে ফোন দিয়া শুনছে না কেন ফোন দিছেন? কেন সুপারিস নিয়া আসছেন? পুলাপান করবে না এগুলা?
দেশের খবর শুনেন। ডক্টর আইনুন নিশাত ইমেরিটাস অধ্যাপক। পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একটা মতামত দিয়েছেন চলমান বন্যা নিয়ে। যে কোন সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তির মতোই তিনি একে ভারতের তৈরি বন্যা না বলে বলেছেন এইটা প্রাকৃতিক কারণেই হয়েছে। যে বাঁধ নিয়ে এত কথা, তিনি বলছেন ওই বাঁধ হওয়ার পরে ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশ, দুই জায়গায়ই বন্যার প্রাদুর্ভাব কমেছে। এই দিকে যে গত ত্রিশ বছর বন্যা হয় নাই এইটা হচ্ছে এই বাঁধের ফলে। এই যে তিনি ভারতের দোষ খুঁজে পাইলেন না এইটাই হল কাল! এখন তাঁকে হেনস্থা করা হচ্ছে। তাঁকে ভুয়া বলা হচ্ছে, তার ডিগ্রি নকল কি না তা দেখতে বলা হচ্ছে! সবাই বিশেষজ্ঞ শুধু বিশেষজ্ঞরা ছাড়া।
এই বন্যা নিয়ে যে ভয়ংকর রাজনীতি হচ্ছে দেশে এইটা কানার ভাই অন্ধও বলতে পারবে কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতের পক্ষে যায় এমন কিছু বলা যাবে না তাই অনেকেই চুপ। কিন্তু এইটা যে কেমন ক্ষতির সামনে ফেলছে তা বুঝেব কবে? রাজশাহীতে মন্দির ভাঙতে গিয়ে ধরা পরেছে এক ছেলে। দুর্গা মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের সময় আটক হয় এই ছেলে। মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এক সময়। এখন বাড়িতেই থাকে, তাবলীগ করে। কেন ভাঙছে প্রতিমা? উত্তরটা শুনলে আঁতকে উঠবে যে কেউ, তিনি বলেছেন, "বোনের ফোনে দেখেছেন, ভারত থেকে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশের মানুষ বন্যার পানিতে ডুবে যাচ্ছে। এই ভিডিও দেখে তিনি সারারাত ঘুমাতে পারেননি। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে একাই মন্দির ভাঙতে গেছেন।”
এই যে নির্দোষ আবেগকে কেউ নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত করছে এইটা নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না!
আজকে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। বেশ লম্বা ভাষণ। সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন। গত সরকারের দোষ অন্য সরকারদের মতো করেই গেয়েছেন। গত ১৫ বছরকেই স্বৈরশাসন বলেছেন। কেন বলেছেন জানি না। প্রথম পাঁচ বছর তো দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচনে পাশ করে আসা সরকার ছিল আওয়ামীলীগ। ওইটাকেও স্বৈরশাসন কেন বলা হচ্ছে? এইটা দেখছি সবাই বলছে। পুরো আওয়ামীলীগ আমলকেই একটা কাতারে ফেলা হচ্ছে। ইউনুস সাহেবও তাই করলেন। সময় চাইলেন, বললেন দেশের জনগণ যেদিন চাইবে সেইদিনই চলে যাবে তার সরকার। এর আগে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ বিচার বিভাগকে নিয়ে কাজ করতে চান। যেন আর কখনও এদেরকে কোন সরকার নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার না করতে পারে। আন্দোলনে শহীদদের পরিবারকে রাষ্ট্র দেখাশোনা করবে। আন্দোলনের সময় করা সব মামলা প্রত্যাহার করা হবে।
আমি এই বক্তব্যে পুরোপুরি খুশি না। আমি আরও কিছু শুনতে চেয়েছিলাম। তিনি আন্দোলনের সময় করা মিথ্যা মামলার কথা বললেন যে প্রত্যাহার করা হবে। এখন যে মিথ্যা মামলা হচ্ছে এই ব্যাপারে কিছু বললেন না কেন? পাঁচ তারিখের পর থেকেই শুনছি নতুন বাংলাদেশ তৈরি হবে। আমিও লিখছিলাম নতুন সূর্যের গল্প আমার শোনান হচ্ছে আমাদের। তো কই সে নতুন আশার সূর্য? যে যেমন ইচ্ছা তেমন মামলা করে চলছে। সাকিব আল হাসানের নামেও হত্যা মামলা দিয়েছে! এমন মামলা আমাদেরকে আবার আগের সেই বস্তাপচা সিস্টেমের কথাই মনে করে দেয় না? সাকিব যখন হত্যা মামলার আসামি হয় তখন পুরো দুনিয়ার কাছে এই ম্যাসেজ পরিষ্কার হয় না যে এখানে আসলে কী চলছে? না ইউনুস সাহেব ভাবছেন আমাকে মামলা দিয়ে দৌড় পারিয়েছে আমি এখন তাদেরকে দৌড় পারাব! এইটা ভালো খেলা না?
কিন্তু আমার কথায় কোন লাভ নাই। সবাই মানে বিশাল সংখ্যক মানুষকে দেখলাম খুব প্রশংসা করছে উনার ব্যক্তবের। এই ব্যাপারে কালকে একজনের একটা ফেসবুক পোস্ট দেখেছিলাম, তিনি লিখেছেন, "ড. ইউনূস মুখ খুলে কিছু কইলেই একদল বলতেসে, 'আহা! কী সুন্দর কথা, মাশাল্লাহ। আবার কিছু না কইলেও বলতেসে, 'আহা! কী সুন্দর নিরবতা, মাশাল্লাহ।'নতুন প্রেমের মতো আরকী!" ঠিক এইটাই হচ্ছে!
সাবেক বিচারপতি শামছুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নানা দোষ ছিল। কট্টর আওয়ামীলীগ পন্থি ছিলেন। ঠোঁটকাটা ছিলেন এই আন্দোলনের তুঙ্গ অবস্থায় এক উপস্থাপিকাকে রাজাকার ডেকে নিজের সর্বনাশের চূড়ান্ত করেছেন। এই লোককের এইগুলা দোষ থাকতে পারে কিন্তু তিনি তো কোন মামলার আসামি না। তবুও তাকে ধরা হয়েছে সিলেট সীমান্ত থেকে। বলা হচ্ছে তিনি সেদিক দিয়ে পালাতে চাচ্ছিলেন। কেন পালাতে চান? নিজের জীবনের উপরে হামলা হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। এইটা অনেকেই হাসাহাসি করছে, ওরে কে মারবে? যাই হোক, হাসি তামাসার উপরে তাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এবং নোবেল বিজয়ীর দেশে প্রিজন ভ্যান থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় উকিল নামের কিছু প্রাণী তার উপরে ঝাঁপিয়ে পরে। পুলিশ হেফাজতে থাকা একজনকে এমন ভাবে মারা হয় যে তার জীবন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তার অণ্ডকোষ ফাটিয়ে ফেলা হয়েছে, আইসিইউয়ে রয়েছেন তিনি! এইটা কোন মাপের বর্বরতা? তিনি ব্রিটিশ নাগরিক, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবিধানিক আইন পড়ান। তাকে এমন করে মারার কারণ কী?
এর উত্তর জানতে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। তিনি বর্তমান উপদেষ্টা মণ্ডলীর অন্যতম চাল্লু মাল আসিফ নজরুলকে একবার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার আদেশ দেন। অনেকেই মনে করছেন এই রাগ থেকেই এমন একটা ঘটনা ঘটতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি এইটা হয়ত আরও একটু গভীরের বিষয়।
বিচারপতি মানিকের নানা দোষ ছিল, এইটা আমি প্রথমেই বলেছি। তিনি সুবিধার লোক ছিলেন না। তার উপরে আওয়ামীলীগেরও অনেকের রাগ ছিল। কিন্তু সেটা ঘটনা না। ঘটনা হচ্ছে মানিক ছিলেন রাজাকার সাইদির যে ট্রাইব্যুনাল তার বিচারক। সেই বিচারে আরও চারজন বিচারক ছিলেন। একজন সাইদিকে মুক্তি দেন তার রায়ে। তিনজন দেয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আর মানিক দেয় মৃত্যুদণ্ড! আমি যদি মনে করি এইটা জামাত ভুলে নাই, মানিক যে জীবনের উপরে হামলার ভয় পাচ্ছিলেন তা মূলত এইটার কারণেই, খুব ভুল ভাবা হবে? আমার মনে হয় না। জামাতের প্রতিহিংসা এমনই, কেবল শুরু। সামনে এমন ঘটনা আরও দেখতে পাব বলেই আমার আশঙ্কা।
আনসারদের নিয়ে গতকাল যা হয়ে গেল তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। তাদেরকে জাতীয়করণ নিয়ে আন্দোলন চলছিল। আনসাররা মূলত স্বল্প প্রশিক্ষণ নিয়ে বসে থাকে। আধা সরকারি একটা বাহিনী। এদেরকে যখন যেখানে প্রয়োজন মনে করা হয় সেখানেই কাজে লাগানো হয়। যে কেউ তাদেরকে কাজের জন্য নিতে পারে। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করে। কোন বড় আয়োজন হলে তারা দায়িত্ব পালন করে। যারা তাদেরকে লম্বা সময়ের জন্য নেয় তারা দৈনিক ৫৪০ টাকা হিসেবে কাজে নেয়। তিন বছর পরে তাদেরকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে যেতে হয়। এই ছুটি বেতন সহ ছুটি না। এইটা বেতন ছাড়া ছুটি! অবিশ্বাস্য লাগছে না? এই বাহিনীর মূল নাম হচ্ছে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। এরা সাধারণত বাড়িতেই থাকে। কাজের সময় ডাক আসলে কাজে যোগ দেয়। নির্বাচনের সময় এদেরকে দেখা যায়। নানা জায়গায় কাজ করে। এখন তারা এই অবস্থার উন্নতি চাচ্ছে। সচিবালয় ঘিরে বসে আছে এই একেবারে সাধারণ গ্রামের লোকজন গুলা।
প্রধান উপদেষ্টা নিজেও বলেছেন তাদের দাবি যৌক্তিক। দাবি মানা হবে। মজার বিষয় হচ্ছে আজকে তারা তাদের যে প্রধান আছে তার কাছ থেকে লিখিত একটা ঘোষণা চেয়েছিল। খুব অন্যায় না এই দাবি? এইটা নিয়ে সারাদিন তাদেরকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এরা যখন রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে ক্ষিপ্ত হয় তখন আরেক কাণ্ড। সচিবালয়ে মন্ত্রী বা উপদেষ্টারাই সাধারণত থাকেন, কাজ করেন। সেখানে সরকারের তরফ থেকে কথা বলে দুইজন সমন্বয়ক! তারা কে? তাদের কথা কে শুনবে? তুমুল গণ্ডগোল শুরু হয়। এই মহান ছাত্র নেতারা ঠিক আগে যেমন পুলিশ না ডেকে অনেকেই ছাত্রলীগকে ডাকত তেমন করে এরা ডাক দিয়েছে তাদের ছাত্রদের। এই ছাত্ররা আন্দোলন করে করে এখন পাকা সবাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সচিবালয় বেশি দূরের জায়গা না। সবাই হিড়িক মেরে চলে আসছে। এই অল্প বেতনের বেশির ভাগ গ্রাম থেকে যাওয়া মানুষ গুলোকে বেদুম মারা হয়েছে। ওরা এমন আক্রমণ সামাল দেওয়ার মতো লোক না। যদিও সমন্বয়করা এবং বাকি চেলাচামুণ্ডারা বলছে এগুলা হচ্ছে সব আওয়ামীলীগের লোক! এরাই এমন করে সচিবালয় ঘেরাও করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে! ঠিক কপি পেস্ট না? যাই করবেন সব এখন বিরোধীদলের ষড়যন্ত্র বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে।
কেউ সমন্বয়করা সচিবালয়ে কী করে এই প্রশ্ন কেন করে না? তারা কেন এই সব জায়গায় থাকবে আবার এমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলতে আসবে? কোন জবাব আছে এগুলার?
আমার কাছে সবচেয়ে বেশি খারাপ যেটা লাগছে সংবাদ মাধ্যম গুলো সবাই ছাত্রদের দেবতা জ্ঞান করে এই সংবাদ প্রচার করছে। দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে তবুও কেন তারা বসে ছিল? কেন সমন্বয়কদের সাথে মারামারি শুরু করল? আর যথারীতি এখন সমস্ত আনসারদেরকেই চাকরীচ্যুত করার কথা বলা শুরু হয়েছে। এই বাহিনীই আর রাখার দরকার নাই এমন বলা হচ্ছে? বেশ কিছু পরিচিত মিডিয়ার লোকজন দেখলাম খুব খুশি এমন মেরে তাদের তাড়িয়ে দেওয়ায়। একটা, একজন তো তাদের বক্তব্যটা তুলে আনবে! শুনছি একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে ছাত্ররা! এইটাও সব ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে মেনে নিতে হবে? কী হয়েছে, কেন তারা যেতে চাইল না এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে না কেউ? আমি কাওকে পাই নাই। মারামারির মধ্যে একজন লাইভ করছে, সম্ভবত কালবেলা পত্রিকা থেকে। যিনি সাংবাদিক তিনিই বলছেন এগুলা আগের সরকারের দোসর! ফাইন না?
তবে গতকালের সেরা চমক পেয়েছি টুইটারে! আমাকে একজন একটা স্ক্রিনশট দেখাল। ইউএস নেভাল ইনিস্টিটিউট নামের একটা একাউন্ট থেকে গত ২২ আগস্ট একটা টুইট করা হয়েছে। তাতে লেখা "Bangladesh could be an important security partner for the United States, with desirable facilities on the Bay of Bengal and an interest in a free and open Indo-Pacific." এর পরে তাদের ওয়েবসাইটের একটা প্রতিবেদনের লিংক দিয়েছে। আমি এইটা সত্য না মিথ্যা তা দেখার জন্য টুইটারে ঢুকলাম। ঢুকে নিশ্চিত হলাম যে না এইটা যা দেখছি তা সত্যই দেখছি। প্রতিবেদনটাও পড়লাম। নানা বিষয় আলোচনা করেছে সেখানে। কেন আমেরিকার একটা নৌ বাহিনীর ঘাটি বঙ্গোপসাগরে দরকার! এখানে একটা জাহাজ তৈরির শিল্প তৈরি হয়েছে, এইটাও তাদের কাজে লাগবে! জাহাজ মেরামত করা কাজে লাগবে। বাংলাদেশ নৌ বাহিনী আর ইউএস নৌ বাহিনী মিলে এই অঞ্চলে কত দারুণ সব কাজ করা সম্ভব তাও লিখেছে! দারুণ না? এইটা দেখেই মনে হল “এতক্ষণে”- অরিন্দম কহিলা বিষাদে!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।