২০২২এর জানুয়ারি শেষের এক সায়াহ্নে একষট্টি পার সুমন পড়ছিল গুরুচণ্ডা৯ সাইটে রঞ্জন রায় লিখিত সুলিখিত, রম্য স্মৃতিকথা - "হারিয়ে যাওয়া কলকাতার গল্প"। ১৯৫০-৬০ এর কলকাতার বৃত্তান্ত। পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল পরিবারটি এসে উঠেছে কলকাতায়। আশ্রয় পেয়েছে পার্ক সার্কাসে ধাঙর বাজারের কাছে এক মুসলমান বাড়িওলার অনেক গুলি ঘরওয়ালা একটি বড় দোতলা বাড়িতে। ২০২২এ সদ্য সত্তরের উত্তীর্ণ লেখক সেই স্মৃতিকথার প্রোটাগনিস্ট - তখন একটি বালক - ১৯৫১ সালে যার কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভূমিশয্যায় জন্ম। পার্ক সার্কাসের সেই আস্তানায় সেই বালকের দাদু পূর্ববঙ্গ থেকে আগে এসে উঠেছেন। পরে এসেছে ছেলেরা। বারো থেকে বাইশজন চেষ্টা চরিত্তির করে সেখানে এঁটে যেতো বলে লেখক সেই স্নেহময় দাদুর আস্তানাকে উল্লেখ করেছেন - "দাদুর দস্তানা" বলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেটি ছিল একটি বনেদী গণিকালয়। দোতলার বারান্দা থেকে নগরনন্দিনীরা বিকেল পার হলে বিলোতেন বিলোল চাউনি। রবিবার হোতো একটু অন্যরকম। সেদিন আমেরিকান গোরা সৈন্যদের একটা দল নীচে এসে শীস দিয়ে, ইশারায় দরদস্তুর করে যে যার পছন্দের পুরললনাকে নিয়ে দোর দিতো ঘরে। সামরিক কর্মজনিত শ্রান্তি অপনোদনের সাপ্তাহিক রুটিন - প্রকৃতির আশীর্বাদে চিরন্তন প্রাকৃতিক পন্থায়। যদি তারা বারবনিতা না হোতো - যদি সেই সৈন্যরা হোতো শত্রুপক্ষের এবং ললনারা তাদের সাথে মিলিত হোতো স্বেচ্ছায় বা পরিস্থিতির প্রভাবে - তখন তারা অভিহিত হয়ে যেতো - Collaborator Girls হিসেবে, who sleep with the enemies out of compassion or subtle compulsion but never for the lure of money. যেমনটা হয়েছিল ১৯৪০ সালে। জার্মানির কাছে পতনের পর চার বছর ফ্রান্সে নাজি জার্মানির অধিগ্ৰহণ কালে। তখন বেশ কিছু ফরাসী মহিলার জার্মান সৈন্যদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় যার ফলে জন্মগ্ৰহণ করে প্রায় দু লক্ষ শিশু যাদের জননী ফরাসী, জনক জার্মান। তবে সেসব অন্য প্রসঙ্গ।
যখন সেই ছিন্নমূল পরিবারটি সেখানে ১৯৫০ সালে এলো তার বেশ কয়েক বছর আগেই অবশ্য গণিকালয় বন্ধ হয়ে গেছে। সেই বড় বাড়ির অনেক ঘরে তখন স্বল্পবিত্ত ফুলগেরস্ত ভাড়াটের বাস। তারই তিনটি ঘরে দাদুর দস্তানায় ঠাঁই হোলো আঠারোজন সদস্যের। তারই মধ্যে পালাক্রমে আগমন হোলো আরও চারটি শিশুর। ধরায় প্রাণের ধারা বহমান রাখার তাগিদ যে অপ্রতিরোধ্য। বাড়িতে সবাই নিজেদের মধ্যে বাঙাল ভাষায় কথা বলে। দাদু তাঁর পেয়ারের নাতির সাথে বরিশালী ডায়ালেক্টে নানা গল্প করেন। তাই আজন্ম কলকাতার হাওয়া বেশ কয়েক বছর খেয়ে বালকটির কলকাত্তাইয়া ঘটিদের ভাষা রপ্ত হলেও বন্ধুদের সাথে খেলাধুলার মাঝে কখনো অজান্তে মুখ দিয়ে একটু আধটু বাঙাল ভাষাও বেরিয়ে যায়।
তিন বছর ধরে সে বাড়ির কাছে পার্কে জয়ন্তী মণিমেলা সংঘে যায়। তখন তার বয়স নয়। কিছুদিন যাবৎ তার একটি দশ বছরের বালিকাকে 'অন্য রকম' ভালো লাগতে শুরু করেছে। ছুতো খোঁজে তার কাছে যাওয়ার, কথা বলার। কিন্তু কাছে গিয়ে কথা বলতে গেলে গলা কাঁপে। একদিন সংঘের বিজনদা কাউকে বললেন, ওই মেয়েটিকে ডেকে আনতে। সে বললো — "আমি যাচ্ছি"। কিন্তু কাছে গিয়ে তার এমনই বুক ঢিপ ঢিপ করলো যে মুখ দিয়ে শুধু বার হোলো — "বিজনদা আপনারে ডাকসে।" মেয়েটি ফ্যাক করে হেসে ছেলেটির অনুকরণে বলে – "কে ডাকসে?" ছেলেটি লজ্জায় অধোবদন হয়ে যায়।
এই জায়গাটা পড়ে সুমনের মনে পড়ে এ জাতীয় একটা ঘটনা তো ওর জীবনেও ঘটেছিল। তবে কেতকী সেদিন ফ্যাক করে হেসে সুমনকে তাচ্ছিল্য করেনি। সাধারণ কথাই বলেছিল, তবু সুমনের মনে ছাপ ফেলেছিল 'অন্য রকম' অভিঘাত। তখন অবশ্য সুমনের বয়স বালক রঞ্জনের মতো নয় নয়, নয় নয় করে সোয়া ষোলো। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে টইপত্তর পড়ে সবুজ ডাবের অন্তরে জমতে শুরু করেছে রোমান্টিক শাঁসের সদ্য পরত।
চেষ্টা চরিত্তির করে নাইন টেনে ত্রিকোণোমিতি মোটেও কব্জা করতে পারেনি সুমন। স্কুলে অংকের স্যার জয়দেববাবু এতো দ্রুত অংক করাতেন যে প্রথম দিকের দু তিনটে বেঞ্চির পরে বসা সুমনের তা মাথার ওপর দিয়ে চলে যেতো। যাদের অংক শেখার ইচ্ছে ও বাবার পয়সা ছিল তারা নিতো ওনার বাড়িতে প্রাইভেট কোচিং। সুমন অংক ভালো পারতো না, তাই বসতো পঞ্চম বেঞ্চে। ক্লাসেও ঠিক বোঝে না, প্রাইভেট টিউটরও নেই, তাই ত্রিকোণোমিতি তখন সুমনের লাগতো কাঁকড়াবিছের মতো - সভয়ে দূরত্ব বজায় রাখতো।
মাধ্যমিকে ৩০ নম্বর ত্রিকোণোমিতি না ছুঁয়ে ৭০ এ ৩০ পেয়ে কোনোরকমে ফেলের হাত থেকে মুখ রক্ষা হয়েছে। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে পিওর সায়েন্সে অংকে দুটো পেপার। এবার আর পালিয়ে বাঁচা যাবে না।
সুমনদের স্কুলে ক্লাস ফাইভ থেকে এইটের ইতিহাসের স্যার ছিলেন তারাপদবাবু। লম্বা মিশকালো সুঠাম চেহারা। কালকেউটের মতো শীতল হিসহিসে ব্যক্তিত্ব। পরে সুমন বুঝেছে তিনি ছিলেন স্যাডিস্ট। পড়া না পারলে বা পান থেকে চূণ খসলে বালক বা সদ্যকৈশরের ছাত্রদেরও করিডরে নীলডাউন করাতে এবং কচি আঙুলের ফাঁকে পেনসিল ঢুকিয়ে খ্যাঁচাকল পদ্ধতিতে নির্যাতনে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। স্নেহময় ভালো শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধা, ভক্তি নয়, তাঁর ঐ অত্যাচারের পদ্ধতির জন্যই ছেলেরা যমের মতো ভয় পেতো তাঁকে।
সুমনকে একবার তিনি ক্লাস সিক্সে ক্লাসের সামনে বারান্দায় নীলডাউন করিয়ে দিয়েছিলেন। সুমনের দাদাও তখন ঐ স্কুলেই এগারো ক্লাসে পড়ে। স্কুলের পিছনে কুখ্যাত সদর বক্সি লেনের বার কয়েক ফেল মারা কয়েকজন গুণ্ডা গোছের সহপাঠীর সাথে দোস্তি ছিল তার। স্কুলে নীলডাউন অবস্থায় সুমনকে দেখে বাড়িতে জিজ্ঞাসা করেছিল, কী করেছিলি তুই ক্লাসে? সুমন বলে, কিছুই করিনি, তুষারের সাথে একটু কথা বলেছিলাম, তাতেই স্যার রেগে গেলেন।
দাদা পরদিন ওর স্যাঙাৎদের নিয়ে ছুটির পর গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল। তারাপদবাবু বেরোতে বলেছিল, এরপর কোনোদিন আর আমার ভাইকে অযথা শাস্তি দিলে মজা ছুটিয়ে দেবো আপনার। সালটা তখন একাত্তর - কালটা মোটেই ভাল নয় - হুটপাট এখানে ওখানে লাশ পড়ছে। ধাতানিতে কাজ হয়েছিল। তারপর সুমনকেই শুধু নয়, ওদের ক্লাসের কাউকেই উনি আর বাইরের করিডরে নীলডাউন বা আঙুলে পেনসিল থেরাপি করেন নি। তবে স্বভাব যায় না মলে। তাই কখনো কাউকে ক্লাসের মধ্যে বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিতেন। অন্য ক্লাসে কী করতেন তা অবশ্য জানতো না সুমন।
সাতাত্তরের শুরুতে তারাপদবাবু টু পাইস এক্সট্রা রোজগারের জন্য একটা কোচিং ক্লাস খুললেন। তাঁর পক্ষে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান শাখায় পড়ানো সম্ভব নয়। তিনি নিলেন ম্যানেজারের ভূমিকা। জুটলো সাতটি গিনিপিগ। পড়ুয়াদের লিঙ্গানুপাত ৫৭:৪৩ - মানে তিনটি মেয়েও ভর্তি হয়েছে। অগ্নিশিখার প্রতি পতঙ্গের আকর্ষণের ফর্মুলায় আরো কয়েকটি ছাত্র জুটতে পারে। নতুন ভেঞ্চার - তাই মাইনে রাখা হয়েছে কম - মাসে মাত্র ৭৫ টাকা। স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি লেভেলের তিনজন স্যারকে ভজিয়েভাজিয়ে কোচিং ক্লাশ চালানোর হাতেখড়িতে নামলেন তারাপদ গুহ।
সুমনদের স্কুলের স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষে উচ্চশিক্ষিত, ট্রিপল MA (Physics, Math & Economics) ত্রিগুণাতীত চট্টোপাধ্যায় নেবেন অংক আর ফিজিক্স। পেচুর পড়াশোনা করা তিগুণবাবু (ছেলেদের কাছে ওনামেই পরিচিত ছিলেন তিনি) একটু আত্মভোলা টাইপের হাসিখুশি মানুষ। অংকের বই লিখেছেন, হাওড়া গার্লস কলেজ ও কলকাতার কলেজে পার্টটাইম পড়াতেন। আচমকা কোনো অংক দিলেও একবার দেখে তারাপদবাবুর সাথে কথা বলতে বলতেও কষে ফ্যালেন খসখস করে। মানে অংক ওনার হৃদয়স্থ। চাইলে অন্য কোচিংয়ে পড়িয়ে বা প্রাউভেট টিউশন করেও অনেক বেশি পয়সা কামাতে পারতেন। কিন্তু বড়লোকের বাড়ির আপনভোলা পড়ুয়া টাইপের মানুষটির পয়সাকড়ির প্রতি বিশেষ আসক্তি ছিল না। হয়তো একই স্কুলের সহকর্মী তারাপদবাবুর অনুরোধ ফেলতে না পেরেই ঐ ধ্বচা কোচিংয়ে ওদের মতো কটা গজাদের সপ্তাহে তিনদিন পড়াতে রাজী হয়েছিলেন।
শেয়ালের মতো গোঁফ, গোয়েন্দার মতো ধূর্ত দৃষ্টির নগেনবাবু নেবেন মেকানিক্স। জীবনবাবু নেবেন জীববিজ্ঞান। শেষোক্ত যুবক স্যারটি আবার অতি সিরিয়াস এবং বেশ গোঁড়া প্রকৃতির। সালোকসংশ্লেষ, চলন, গমন, পাচন, রেচন, অযৌন জনন অবধি ঠিক আছে কিন্তু প্রজননতন্ত্র ব্যাখ্যা করে যৌন জনন চ্যাপটার উনি চারজন ছাত্র ও তিনজন ছাত্রীকে আলাদা করে দু খেপে পড়িয়েছেন। সাতটি পড়ুয়াই ছিল পিওর সায়েন্সের। ওদের বায়োলজি ছিল অপশনাল সাবজেক্ট, যাতে পাশ মার্কের ওপরে পাওয়া নম্বর টোটালেও যোগ হবে না। অথচ একটা অপশনাল সাবজেক্ট নেওয়া ছিল কম্পালসরি। কী জ্বালা। তাই ওদের কাছে বায়োর বিশেষ গুরুত্ব নেই। কোনরকমে পাশ মার্ক পেলেই হোলো। তারাবাবু ওনাকে সাথে রেখেছিলেন ভবিষ্যতে যদি বায়োসায়েন্সের ছাত্র ছাত্রী পাওয়া যায় সে জন্য। মানে ব্যাবসায়িক দূরদৃষ্টি।
কোচিংয়ে কেমেস্ট্রি পড়ানো হবেনা কারণ তার স্যার জোটেনি। স্কুলে বয়স্ক, সিরিঙ্গে চেহারার, তিরিক্ষে মেজাজের 'খাইদ্দ্য লবন' স্যার নেন প্র্যাক্টিক্যাল আর কয়েকটি ক্লাস। তিনি ওদের স্কুলের প্রাচীন কেমেস্ট্রি শিক্ষক। পূর্ব বঙ্গের মানুষ। বাঙাল ভাষায় সোডিয়াম ক্লোরাইডের প্রতিশব্দ বলে ছাত্রমহলে এমনই বিখ্যাত হয়ে গেছিলেন যে ওনার আসল নাম যে মাধববাবু ছেলেদের তা মনেই থাকতো না।
প্রধান কেমেস্ট্রি শিক্ষক ছিলেন বছর চল্লিশের কাজলবাবু। তাঁর অবসেশন ছিল ক্লাসে পড়াতে এসে বছরের পর বছর ছাত্রদের স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরূদ্ধে তাতানোর বৃথা প্রচেষ্টা। তাতে না তাতে ছেলেরা, না হয় ভালো করে পড়ানো। বেগতিক বুঝে সুমন কিনে নেয় Chemistry Tutor - সহায়িকা পুস্তক। ওতেই যা হয় হবে।
মধ্য হাওড়ায় জিটি রোডের ওপর মল্লিক ফটক চৌমাথা। সেখান থেকে পশ্চিমে রামরাজাতলার দিকে চলে গেছে নেতাজী সুভাষ রোড। মল্লিক ফটক থেকে অনতিদুরে সেই রাস্তার ওপর একটা ধ্যারধেরে পুরোনো দ্বিতল বাড়ির একতলায় একটি ১০x১২ ঘরে উদ্বোধন হোলো কোচিং ক্লাসের। দু তিন দোকান ছেড়ে নানকু সাউয়ের ধাবার কষা মাংস বিখ্যাত, সন্ধ্যা হতেই জোটে পাঁড় মাতালের দল। লাগোয়া সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত গাঁজা ও আফিমের ডিপো। কোচিং ক্লাসের পক্ষে উপযুক্ত পরিবেশই বটে। তবে মাসে ৭৫ টাকায় এর বেশী আশা করা বাতুলতা।
তবে ওসবে সুমনের কিছু এসে যায় না। ও গেছে পড়তে - অন্তরের তাগিদে। ফিজিক্স ওর প্রিয় বিষয়। মাধ্যমিকে নিজে পড়েই ভদ্রস্থ নম্বর পেয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে ক্লাসে তিগুণবাবুর পড়ানো মন দিয়ে শোনে। বাড়িতে পড়ে বুক সিন্ডিকেট প্রকাশিত চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্তর প্রাঞ্জলভাবে বোঝানো ঝকঝকে ছাপার ফিজিক্স বই। কিনেছে Physics Tutor সহায়িকা। এতেই ওর হয়ে যায়। ও কোচিং ক্লাসে ভর্তি হয়েছে মূলতঃ অংক শিখতে। যেটা ওর পক্ষে নিজে পড়ে রপ্ত করা কঠিন। তাই স্কুলে প্রায়শই ডুব মারলেও সুমন কোচিং ক্লাস কখনো কামাই করতো না। এছাড়া ছিল ৪৩% এর ৩৩% ফুরফুরে ইনসেনটিভ - কেতকী। ত্রিকোণোমিতিতে কাঁচা হলেও শতাংশের সেই পাটিগণিত কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই উপলব্ধি করেছিল সুমন। একেই বলে মেল ইনস্টিংক্ট।
মান্ধাতা আমলের এক কামরার ঘরটা বহুদিন ছিল একটা দোকানের গোডাউন। তাতে পাতা একটা ৬x৪ চৌকি। হয়তো দারোয়ান গোছের কেউ রাতে শুতো ওতে। তবে তাতে সাতজন পড়ুয়া ও শিক্ষক আঁটতো না। তার থেকে মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে বসা ভালো। কোচিং ম্যানেজার তারাপদবাবুর এককালীন ইনভেস্টমেন্ট ছিল একটা শতরঞ্চি, একটা তালা ও দুটো একশো পাওয়ারের বাল্ব। রেকারিং খরচ বলতে মাসে ঘর ভাড়া ৫০ ও বিজলী বিল ও ফ্যান ভাড়া ২৫ - মানে এক পড়ুয়ার মাইনে। ঘরে কোনো জানলা নেই - দুটো দরজা। কোচিং শেষে একটা দরজা ভেতর থেকে খিল তুলে অন্যটা বাইরে থেকে তালা দিতেন তারাবাবু।
কতদিন যে ও ঘর বন্ধ ছিল ঠিক নেই। তাই ঐ ক্ষুধিত পাষাণ মার্কা প্রাচীন ঘরের নিয়মিত আবাসিকরাও থাকতো ক্ষুধার্ত। ফলতঃ পড়াশোনার মাঝে মাঝেমধ্যেই শোনা যেতো চটাশ পটাশ শব্দ। মশার আর দোষ কি। নরম ত্বক বলে শিশু ও তরুণীদেরই বেশী কামড়ায় মহিলা মশা। মশক সমাজে পুরুষের রক্তচোষা বলে দূর্নাম নেই। কারণ তাদের হুল নারীদের মতো পোক্ত নয়। তাই ওরা পিওর ভেজ। পান করে শুধু ফুল, ফল, সবজির রস। তবে তিনটি তরতাজা তরুণী পেয়ে প্রমীলা মশাদের স্ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ।
একদিন শর্মিলা হাতে বসা একটা মশা চটাস করে সাবড়ে সাড়ে চুয়াত্তরে ভানুর সেই "মাসীমা মালপো খামু" ধরণে কাতর আদিখ্যেতা মিশিয়ে বলে, স্যার, খুব মশা কামড়ায় যে! শুনে তারাবাবু তেতে লাল - কী? এতো আস্পদ্দা! আমি থাকতে আমার ছাত্রীদের খাওয়া? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। পত্রপাঠ কিনে আনলেন একটা ফিনিট স্প্রে। ঝুঁকে পড়ে বন্দুক চালানোর ঢঙে চৌকির তলায় ফ্যাঁশ ফ্যাঁশ করে চালিয়ে দিলেন স্প্রে গান।
আর যায় কোথায়! এতোক্ষণ তবু দু চারটে সাহসীকা চপেটাঘাতে অকালমৃত্যুর সম্ভাবনা স্বত্বেও ক্ষিধের জ্বালায় পোঁ পোঁ করে উড়ে সুযোগ পেলেই প্যাঁক প্যাঁক করে হুল ফোটাচ্ছিল উন্মুক্ত কোমলাঙ্গে। তারাবাবুর ফিনিট গানের ফ্যাঁশফ্যাঁশানির চোটে এবার তারা প্যান্ডোরা বক্সের ঢাকনা খোলার মতো পিলপিল করে চৌকির তলা থেকে বেরিয়ে সারা ঘরে উড়ে বেড়াতে লাগলো। তারাবাবু বললেন, তোমরা কিছুক্ষণ বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, মশাগুলো ততক্ষণে মরে যাবে।
একদা 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত 'কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই' রম্যরচনায় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় রাতে শোয়ার সময় মশার কামড় থেকে বাঁচার এক অভূতপূর্ব নিদান দিয়েছিলেন। ওনার শলা ছিল - শোয়ার ঘরে রাখতে হবে দুটো খাট। সন্ধ্যায় দরজা জানলা বন্ধ করে একটা খাটে মশারী টাঙাতে হবে। তাতে থাকবে খান চারেক ধূপকাঠি দিয়ে সুষ্ঠুভাবে করা ফুটো। মশাদের স্বভাবই হচ্ছে মশারীতে ফুটো দেখলে ঢুকে পড়া। ডিনারের পর ঐ ফুটো গুলো সেলোটেপ দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। ফলে ঘরের সব মশা তখন মশারীর ভেতরে আটক। জানলা দরজা বন্ধ বলে বাইরের অন্য মশাও আসতে পারবে না। এবার শুয়ে পড়ো অন্য খাটে - বিনা মশারীতে - ঘুমাও রাতে আরামে - বিনা কামড়ে।
আধ ঘন্টা বাদে ওরা ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে - সে এক দৃশ্য! মেঝেতে, চৌকির ওপরে পড়ে আছে বেশ কিছু নিথর মশা। কিছু খাবি খাচ্ছে। তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক নিরাপরাধ পুরুষ মশাও আছে। রক্তখাকী মশানীগুলোর জন্য তারাও বিনাদোষে পটল তুলবে। যাদের ইমিউনিটি বেশী তখনও উড়ে বেড়াচ্ছে। নাকে রূমাল বেঁধে বন্ধ ঘরে দাঁড়িয়ে তারাবাবু পর্যবেক্ষণ করছেন - আর কতো মরা বাকি। ওরা বাইরের রকে হেসে লুটোপুটি। সেদিন আর ওদের পড়া হোলো না। কারণ তারাপদবাবুর এস্টিমেটের তুলনায় মশাগুলো মরতে বেশ সময় নিলো। তাছাড়া ঘরে ম ম করছে মশা মারা তেলের মাথা ধরানো ঝাঁঝ।
পরদিন ওরা একটু আগে এসে চৌকির তলাটা ভালো করে ঝাড়ু দিলো। ওখানে হয়তো শেষবার ঝাড়ু পড়েছিল ঘরে চৌকিটা ঢোকানোর আগে - হয়তো দশ, পনেরো বছর আগে। তলা থেকে ঝাঁট দিয়ে আধখাওয়া বিড়ি, চায়ের ভাঁড়, আধলা ইট ইত্যাদির সাথে ঝুল, ধুলো মিলিয়ে কিলো দুয়েক মাল বেরোলো। অতঃপর মশার উপদ্রপ অনেকটা কমলো।
কোচিং চালু হওয়ার হপ্তা দুয়েক বাদে একদিন তিগুণবাবু ত্রিকোণোমিতিক অভেদ (Trigonometric Identities) অধ্যায়ের অংক করাচ্ছেন। ঐ যে, প্রমাণ করো LHS = RHS গোছের বদখৎ সব অঙ্ক। ওরা শতরঞ্চিতে গোল হয়ে বসে। হঠাৎ সুমনের নজর খাতার পাতায় লেখা অংকের লেফট রাইট থেকে সরে গিয়ে লেপটে গেল সামনে শতরঞ্চির ওপর অন্য পাতায়। শিমূলরঙা শাড়ির তলা দিয়ে বেরিয়ে আছে কেতকীর মাখন সাদা মোলায়েম পায়ের পাতা। নখে হালকা গোলাপি নেলপলিশ। ওরে বাবা রে! নিঃশব্দে ঢোঁক গেলে সুমন। চরণপুরের পদ্মদীঘির পারই যদি এমন হয় তাইলে চাঁদনীরাতে মধুপুরে সুশ্রী নদীর খোয়াই কেমন হবে রে ভাই!
অবশ্য ওহেন কাব্যিক উপমা তখন সুমনের মাথায় আসেনি। সেসব এসেছে পরে - স্বপ্ন লজ্জাহীন, সবিনয় নিবেদন বা বাংরিপোসির দু রাত্তির জাতীয় মুচমুচে উপন্যাস পড়ে। বছর দুয়েক পরের কথা, কেতকীর সাথে সুমনের আলাপ তখন কেতকীদের বাড়ির ছাদে নিয়মিত সান্ধ্যআড্ডার সুবাদে জমে ক্ষীর। সুমন গেছে হায়দ্রাবাদ বেড়াতে। সালারজং মিউজিয়ামে Awakening of Galatea ছবির সামনে অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সুমন। এক অদ্ভুত ভালো লাগার আবেশে ছেয়ে যায় সুমনের মন। ব্রিটিশ চিত্রকর হার্বাট গুস্তভ শ্মালজ অঙ্কিত ১৯০৭ সালের সেই অয়েল অন ক্যানভাসের প্রতিলিপির অভিঘাত উদ্দাম উন্মাদনাময় নয়, বরং আচ্ছন্ন করা এক শিরশিরে মাদকতায় যেন অবশ হয়ে যায় সত্তা। অনন্য সুন্দর সেই সৃষ্টি! দু বছর আগে সেই সন্ধ্যায় চাঁদনী রাতে সুশ্রী নদীর খোয়াইয়ের যে অস্পষ্ট খোয়াব ভাবনায় উঁকি দিয়েছিল - তার স্বরূপ যেন তখন চোখের সামনে উদ্ভাসিত।
দু বছর আগে সেই সন্ধ্যায় কোচিং ক্লাসে সুমন প্রথমদিকে খুব মন দিয়েই অংকটা বোঝার চেষ্টা করছিল কিন্তু মরমে নরম পাতার ঘোর লাগা আচ্ছন্নতার মাঝেই তিগুণবাবু প্রমাণ করে ফেললেন LHS = RHS. বাকিরা বুঝলেও, সুমন গেল ভেবলে। কিন্তু ও তো কোচিং ক্লাসে যায় অংক শিখতে। তাই একটু লজ্জা করলেও জিগেস করেই ফেললে, স্যার শেষের তিনটে লাইন ঠিক বুঝলাম না। স্যার কিছু বলার আগেই কেতকী বলে উঠলো, বুঝলে না? আচ্ছা, আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। স্যার, আপনি বলবেন তো আমি ঠিক বুঝেছি কিনা।
কথায় বলে - Teaching is the best form of learning - মানে তুমি যদি কাউকে সঠিক বোঝাতে পারো, তাইলে তোমার বোঝা সার্থক। সেদিন কেতকীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল সেই আপ্তবাক্যের মতো, প্রতিবর্তী প্রেরণায়। ও যে সুমনের থেকে অংক ভালো বোঝে তা প্রতিপন্ন করার উচ্চমন্যতার তাগিদে নয়। অন্ততঃ কেতকীর বোঝানোর আন্তরিকতায় সেদিন তা মনে হয়নি সুমনের। কেতকী বলে, দ্যাখো, আমরা জানি, পাইথাগোরিয়ান ট্রিগোণোমেট্রিক থিয়োরেম অনুযায়ী ওয়ান প্লাস কট স্কোয়ার এ ইজকল্টু কোসেক স্কোয়ার এ, ঠিক আছে? তাহলে কট স্কোয়ার এ প্লাস….।
নাঃ, ঠিক লাগছে না সুমনের। মাথা ঝিমঝিম করছে। অংক না বোঝার জন্য নয়, ওতে ও অভ্যস্থ। কেতকীর মুখের দিকে তাকিয়ে। সুমনের কী দোষ? পাঁচ ব্যাটারীর টর্চের ফোকাসের মতো কেতকী সটান সুমনের মুখে ফেলেছে ওর মন্মোহক দৃষ্টি। বিগত কদিনে সুমন কয়েকবার লুকিয়ে চুরিয়ে টেরিয়ে কেতকীকে দেখেছে। তাতেই মোটামুটি কাহিল অবস্থা ওর। সেদিন ওর আচ্ছন্ন করা চন্দনী রূপ, মিষ্টি দৃষ্টির প্রলেপ, ওষ্ঠের আদুরে নড়াচড়া - অতো কাছ থেকে দেখে অংকের শেষ তিনটে লাইন বুঝতে গিয়ে পুরোটাই গেল গুলিয়ে।
দু বছর পরে সালারজং মিউজিয়ামে সুমনের যে অভিভূত অবস্থা হয়েছিল, সেদিন কোচিং ক্লাশেও তেমনই বিহ্বল উপলব্ধিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেছিল ও - অক্সিটোসিনের প্রভাবে গভীর মুগ্ধতার আবেশ। তখন নাদান সুমন সেসব বোঝেনি। কিন্তু কিছু অনুভবের ক্ষেত্র জ্ঞানের, জানার, বোঝার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। তার বিচরণ ভাষাহীন উপলব্ধির জগতে। কদিন আগে স্কুলেও সুমনের হয়েছিল তেমনই একটু দিশেহারা অবস্থা।
সুমন একটা বাংলা মাধ্যম ছেলেদের স্কুলে ক্লাস ফাইভ থেকে পড়তো। সুমন ১৯৭৬ এর মাধ্যমিক প্রথম ব্যাচের পাশ আউট। সে বছরই চালু হোলো ১০+২ মডেলের নতুন উচ্চমাধ্যমিক। আর সেই বছর থেকেই ওদের স্কুলে উচ্চমাধ্যমিকে চালু হোলো সহশিক্ষা বা কোএডুকেশন। তবে এক ক্লাসে নয়। শাস্ত্রমতে ঘৃত ও অগ্নির নিকট সহাবস্থানে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা। স্কুলের মাঝে একটি মাঝারি প্রাঙ্গন। তার তিন দিকে তিনতলা স্কুল ঘর। পুবে তখনও দোতলা। ললনাদের শ্রেণীকক্ষ ধার্য হোলো পশ্চিমের তিনতলায়। অভাগাদের পূবের দোতলায়। টিফিন টাইমে পূবালী বারান্দা থেকে পশ্চিম পানে ধাবিত হয় কিছু তৃষিত দৃষ্টি। বিনিময়ে পশ্চিম থেকেও বর্ষিত হয় কিছু কৃপাদৃষ্টি।
তখনও বাড়ি থেকে জলের বোতল নিয়ে বাইরে যাওয়ার কালচার শুরু হয়নি। প্রাঙ্গণের উত্তর পশ্চিম কোনে কলতলায় ছিল একটি হ্যান্ডপাম্প। তেষ্টা পেলে সেই চাপাকলেই সবাই যেতো জল খেতে - কখনো না পেলেও আশপাশে ঘুরঘুর করতো। এবং তখনই ছিল অগ্নি ও ঘৃতের কাছাকাছি আসার সামান্য সুযোগ। তবে তাতে অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা কম। কারণ কাছেই তো আছে জল - সেই টিউকল - যেখানে আসা যাওয়া লেগেই আছে অবিরল। যে বস্তুটি কাছাকাছি আসার নিমিত্ত সেটাই আবার কাবাব মে হাড্ডির কারণ।
সেদিন টিফিনে নয়, দুটি ক্লাসের ফাঁকে সুমন গেছিল কলতলায়। তাই ভীড় নেই। শুনশান কলতলায় ওর আগেই কেতকীও এসে এদিক ওদিক দেখছে। ততোদিনে কয়েকবার কোচিংয়ে দেখা হয়ে মুখচেনা। সুমনকে দেখে পরিচিতির হাসি দেয় কেতকী। সুমন বলে, টিপে দিই? কেতকী সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে ঝুঁকে পড়ে কলের মুখে। সুমন আস্তে আস্তে হাতল টেপে। জল খেয়ে কেতকী কোমরে গোঁজা পুঁচকে রুমাল বার করে মুখ মোছে। সুমনের চোখ চলে যায় চকিতে উন্মুক্ত এক চিলতে পেলব রূপালী সৈকতে। ছলাৎ ঢেউ ওঠে কোথাও অলক্ষ্যে। কেতকীর নজর এড়ায় না। প্রকৃতি ওদের দিয়েছে বিল্ট ইন স্ক্যানার - ছেলেদের মুগ্ধতা মাপার। মুচকি হেসে বলে, এবার আমি টিপে দিই?
সুমন ততক্ষণে ভুলেই গেছিল ও কেন এসেছিল কলতলায়। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, না, না, ঠিক আছে, লাগবে না। একটা মেয়ে টিপবে চাপাকল - আর ও খাবে জল? এ্যাতো অবল ও নয়। ডান হাতের তালুতে কলের মুখ চেপে ও বাঁ হাতে কয়েকবার টিপে নেয় টিউকলের হ্যান্ডেল। তারপর মুখ ঝুঁকিয়ে জল খায়। কেতকী কলতলার পাশে বারান্দায় উঠে ভদ্রতাবোধে সুমনের জল খাওয়া অবধি দাঁড়িয়ে ছিল। সুমন মুখ তুলে ওর দিকে তাকাতে, মৃদু হেসে চলে গেল সিঁড়ির দিকে। সুমনের মনে হোলো কলতলাটা হঠাৎই যেন ভীষণ নির্জন হয়ে গেল। লাগতেই পারে - গানেও তো আছে - "তোমারি ঝরণা তলার নির্জনে - মাটির এই কলস আমার ছাপিয়ে গেল কোন ক্ষণে"।
সেদিন কোচিং ক্লাশে অভেদের অংকের শেষ তিন লাইন কেতকীর আন্তরিক চেষ্টাতেও সুমন বোঝেনি। তবে কেতকীর জড়তাহীন কথা বলার ভঙ্গিতে সুমনের অবশিষ্ট জড়তা কেটে গেল। শুরু হোলো বিলম্বিত লয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী আবেশের সূত্রপাত - যা কোনওদিন দ্রুত লয়ে ঝালায় উঠে সমে এসে মিললো না বটে তবে রেখে গেল এক মাধূর্যের রেশ - নেভা ধূপের হালকা সুবাসের মতো।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।