বড়দিনের ছুটিতে সুমন স্ত্রী, পুত্র, শ্বশুর, শাশুড়ী সহ দ্বিতীয়বার এসেছে দেওঘর। আগের বার এসেছিল এক দশক আগে, আরো বড় পারিবারিক দলে। সেবারও উঠেছিল এই আশ্রমের অথিতিশালায়। অনেকটা জমিতে গাছপালায় ঘেরা শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটি, যেটি এখন আশ্রমের অতিথিনিবাস, সর্বাঙ্গে অতীত জড়িয়ে অলস অজগরের মতো পড়ে আছে। খাওয়া দাওয়া স্বাদু, তায় দেওঘরের হজমী জল। ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাই সুমন সকাল বিকেলে নন্দন পাহাড়ে হাঁটতে যায়। দুপুরে স্নানের আগে ছাদে রোদে বসে গায়ে তেল মাখে। এবারের এক সপ্তাহের এই পারিবারিক দেওঘর ভ্রমন এক অলস অবসর যাপন।
প্রাতরাশের পর হিমেল মিঠে রোদে ছাদে চেয়ার পেতে সুমন মোবাইলে পড়ছিল সুনীলের 'অরণ্যের দিনরাত্রি'। বহুকাল আগে প্রথম পড়েছিল। সে ঘোর আজও কাটেনি। তাই পূনঃপাঠ। অনবদ্য লেখনীতে জীবন্ত হয়ে ওঠা চার যুবকের সাথে সুমনও যেন মানসভ্রমণ করছিল ধলভূমগড়ের আশপাশের অরণ্যে।
একটা কাঠবেড়ালী চিড়িক চিড়িক করে ডাকছে ছাদের প্যারাপেটে। মাঝে মাঝে কালো পুঁতির মতো চোখ মেলে দেখছে ওকে। ওর মিষ্টি রকমসকম দেখতে গিয়ে সুমনের চোখ সরে যায় বই থেকে। ক্রমশ মনটাও ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে শুরু করে ছত্রিশ বছর আগে দেওঘরে আসা এক সদ্য একুশের তরুণের সাথে। সুমনের অতীত।
II ২ II
সেটা আশির দশকের শুরু। সুমনের চলছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তৃতীয় বর্ষ। তিন বছর আগে সুমনের থেকে কেতকীর শিক্ষাগত পথ আলাদা হয়ে গেছে। কেতকীর সাথে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় কোচিং ক্লাসে আলাপ। পরে ওদের বাড়ীতে বহু যাতায়াতে সে আলাপ ঘনিষ্ট হয়। কেতকী কলেজে পড়ছিল জীববিজ্ঞান নিয়ে। তবে স্কুল পেরিয়ে কলেজের বাইরেও ওদের বন্ধুত্বটা রয়ে গেছে। সপ্তাহে দু একবার ইচ্ছে হলেই সুমন চলে যায় ওদের বাড়ি। ছাদে বসে চুটিয়ে আড্ডা দেয়। ওদের বাড়ির দরজা সুমনের জন্য অবাধ।
ঐ বয়সের দুটি ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনো বিশেষ বিষয় ছাড়াই আড্ডা চলতে পারে দীর্ঘসময়। দেওয়ালে হেলান দিয়ে কেতকী বসতো ছাদের নীচু পাঁচিলে। সুমন বসতো ছাদে পাতা মাদুরে পা ছড়িয়ে। কখনো শুয়েও পড়তো মাথার তলায় হাত দিয়ে। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ অন্ধকারে শায়িত সুমনের মুখ অস্পষ্ট হয়ে গেলে কেতকী বলতো, ‘তুই এখানে এসে বোস না, মুখ না দেখলে গল্প করতে ভাল্লাগে না।’ উপরে অনন্ত আকাশ। কাছে কেতকীর ডিমের মতো চিকন মুখে রাস্তার আলো - পেলব, নিদাগ, মোহময়ী। সুন্দরী মেয়েরা কস্তুরী মৃগের মতো। রুপের গরবেই আচ্ছন্ন। কিন্তু কেতকীর সৌন্দর্য্য একাদশীর জোৎস্নার মত আবিষ্ট করা - উজ্বল অথচ স্নিগ্ধ - পূর্ণিমার মতো চোখ ধাঁধানো নয়। মাদুরের ঐ ভ্যান্টেজ পয়েন্ট ছেড়ে উঠতে চাইতো না সুমন।
আশির দশকের শুরুতে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেলামেশায় শারীরিক নৈকট্যের অতো চল ছিল না। স্যাটেলাইট টিভির প্রভাবে সর্বসমক্ষে বীয়ারহাগ বা ইজিকিসির প্রচলনও তখন শুরু হয়নি। হটপ্যান্ট ও স্লিভলেস টি-তে মেয়েদের রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেও ঢের দেরী। সেসময় আলতো স্পর্শ বা হঠাৎ সরে যাওয়া আঁচলের কৃপায় আশ্চর্য উপত্যকার চকিত আভাষেই আবিষ্ট হয়ে যেতো মন। সব রহস্যই অচিরে উন্মোচিত হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। এমনটা মনে হোতো তখন সুমনের। পরিণত বয়সেও সে ধারণা বদলায়নি। হয়তো ও আধুনিক নয়, একটু সাবেকি চিন্তাধারার।
চার বছরের মেলামেশায় ওদের সম্পর্কটা যে নিছক বন্ধু্ত্বেই সীমাবদ্ধ ছিল না সেটা ওরাও বুঝতো কিন্তু তার স্বরূপটা ছিল অস্পষ্ট। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এসব ক্ষেত্রে অসংখ্য বার নিভৃতে গাঢ় স্বরে উচ্চারিত তিনটি শব্দের বাক্যটিও ওরা কেউ কাউকে বলেনি। হয়তো তার প্রয়োজন মনে হয়নি। নিঃশ্বাস নিতে কি বাতাসের স্বীকৃতি লাগে? তেমনই সহজ ছিল ওদের বন্ধুত্ব। তার পরিণতি নিয়েও কিছু ভাবেনি ওরা। সুমনের মনে হোতো এই যে ওদের বাড়িতে ওর অবারিত দ্বার, ইচ্ছে হলেই গিয়ে, কেউ না থাকলেও, ঘন্টার পর ঘন্টা ওর সাথে নির্দ্বিধায় আড্ডা দিতে পারে, এটাই তো অনেক পাওয়া। কোনো কারণে তা বন্ধ হয়ে গেলে খুব খারাপ লাগবে। খুব ফাঁকা লাগবে মাসের কয়েকটা সন্ধ্যা।
কেতকী কি ভাবতো? তা ঠিক জানতো না সুমন। কিন্তু কখনো এক দু দিনের গ্যাপে পরপর কয়েকদিন গিয়েও কেতকীর মধ্যে কোনো আগ্ৰহের অভাব লক্ষ্য করেনি। একদিনের কথা। দুদিনের গ্যাপে পর পর তৃতীয়বার গিয়ে হাজির সুমন। উঠোনের দরজা খুলে কেতকী বলে, তুই একটু বাবার সাথে গল্প কর, আমি রাতের রুটিগুলো চটপট করে নি কেমন? তারপর ছাদে গিয়ে বসবো।
কেতকীর বাবা তখন ষাটোর্ধ্ব। গ্লুকোমায় অনেকদিন ধরে দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। উঠোনের পাশে একটি বাইরের বসার ঘরে শুয়ে বসে থাকেন। ক্ষীণদৃষ্টি সত্ত্বেও মুখের কাছে বই এনে পড়েন। সুমন, ‘কেমন আছেন মেশোমশাই’ বলে চৌকিতে গিয়ে ওনার পাশে বসলে, ‘ভালো আছি, বোসো’ - বলে বই রেখে - দেওয়ালে হেলান দিয়ে - চোখ বুঁজে ব্যারিটোন ভয়েসে সুমনের সাথে কথা বলতেন। সুমনের সাথে গল্প করতে ভালোবাসতেন উনি। সুমনেরও ভালো লাগতো। নানা আকর্ষণীয় প্রসঙ্গের অবতারণা করতেন। প্রশ্ন করতেন। সুমনের মতামত জানতে চাইতেন। ষাটোর্ধ্ব এক ক্ষীণদৃষ্টির প্রায় স্থবির মানুষের সাথে আড্ডা চলতো একুশের এক তরতাজা তরুণের যে এসেছিল তার সুন্দরী মেয়ের টানে, তার সাথে কিছু মধুর সময় কাটাতে।
সেদিন প্রসঙ্গটাই এমন তুলেছিলেন মেশোমশাই যে সুমন জমে গেছিল আলোচনায়। মাঝে একবার কেতকী এসে দরজার পাশ থেকে হাতছানি দিয়ে ইশারায় জানিয়েছিল, হয়ে গেছে আমার কাজ, চল যাই ছাদে। কিন্তু প্রায়ান্ধ, সঙ্গীহীন এক বয়স্ক মানুষ আগ্ৰহ নিয়ে কথা বলছেন, তার মধ্যে আচমকা আলোচনায় ছেদ টেনে তো আর চলে যাওয়া যায় না। অমন অসৌজন্যতা সুমনের আসে না। তাই নিজে থেকে আর কথা না বলে - হুঁ, হ্যাঁ, ঠিক ইত্যাদি দিয়ে অপেক্ষা করছিল ওনার আলোচনায় ইতি টানার জন্য। তিনিও জানেন সুমন আসে তাঁর ছোটমেয়ের টানে।
তবু কেতকীর হাতছানির পরেও কিছুক্ষণ কেটে গেছে। এবার কেতকী ভেতরের দরজার কাছে এসে চোখ পাকিয়ে, কিল মারার ভঙ্গি করে। তখন গরমকাল। গা টা ধুয়ে, ঘরে পরার শাড়ি ছেড়ে, চুল আঁচড়ে, সামান্য রূপটান দিয়ে এসেছে। বাইরে গেলেও বেশী সাজগোজ ও করতো না। ঘরে থাকলে তো নয়ই। ওসব ওর দরকারই হোতো না। কিছু না করেই কচি কলাপাতার মতো সতেজ লাগতো ওকে। সেদিনও, ক্ষুন্ন হয়ে, মূকাভিনয়ে কপট রাগের ভঙ্গিতে ওকে বেশ লাগছিল। হঠাৎ মেশোমশাই বলেন, ‘আচ্ছা এবার এসো সুমন, কেতকী হয়তো অপেক্ষা করছে তোমার জন্য’।
ভেতর অবধি কেঁপে গেছিল সুমনের। মেশোমশাই কী কোনোভাবে টের পেলেন কেতকী এসে নীরবে কী অঙ্গভঙ্গি করছে? অসম্ভব। উনি যেখানে বসে আছেন সেখান থেকে দৃষ্টি ঠিক থাকলেও কেতকীকে দেখতে পাওয়ার কথাই নয়। হয়তো নিছক আপতন। ‘তাহলে আসি, মেশোমশাই’, বলে উঠে এসেছিল সুমন। ছাদের দিকে যেতে যেতে কেতকী মৃদু অভিমানে বলে, ‘মনে হচ্ছিল তুই যেন বাবার সাথে গল্প করতেই এসেছিলি আজ। কতক্ষণ ধরে ডাকছি, হুঁশই নেই’। বাড়িতে আর কেউ নেই। সিঁড়ির মুখে কেতকীকে একটু জড়িয়ে ধরে সুমন বলে, ‘তোকে কখনো রাগতে দেখিনি, কী মিষ্টি লাগছিল’। কেতকীর অভিমান কচুপাতায় জল। নিমেষে হেসে ফেলে, আর বেশী অগ্ৰসর হতে না দিয়ে, নিজেকে ছাড়িয়ে বলে, ‘খুব হয়েছে আর ম্যানেজারি করতে হবে না’।
II ৩ II
কিন্তু অন্য আর একদিন কেতকী সত্যিই একটু ক্ষুব্ধ হয়েছিল। কলেজে কেতকীরা তিন সহপাঠী বন্ধু শিবপুরে কাছাকাছিই থাকতো। ওদের সাথেও সুমনের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল কেতকী। গোপা ছিল লম্বা, রোগা, সিরিয়াস স্বভাবের। কেতকী লবঙ্গলতিকার মতো ছিপছিপে। কিন্তু সুপ্রিয়া বর্ষার জলে পুষ্ট সতেজ পুঁইলতা। তেমনি খোলামেলা স্বভাব এবং হাসি। সুপ্রিয়া এনগেজড ছিল পাড়াতুতো এক দাদার সাথে। সেই দাদা তখন শিবপুর বিই কলেজে থার্ড ইয়ার পড়ছে। পাশ করে চাকরি পেয়ে কিছুদিন বাদে ওদের বিয়ের প্ল্যান। তাই কেতকীর বিশেষ বন্ধু জেনেও ও সাবলীলভাবে মিশতো সুমনের সাথে।
একদিন মরা বিকেলে সুমন কেতকীদের বাড়ি না গিয়ে সরাসরি সুপ্রিয়াদের বাড়ি এসেছে আড্ডা দিতে। দেখে কেতকীও রয়েছে সেখানে। সুমনকে দেখে কেতকী বলে, ‘মা বললো নাকি আমি এখানে’? অর্থাৎ কেতকী ধরেই নিয়েছে সুমন প্রথমে ওদের বাড়ি গিয়ে, ওকে না পেয়ে, তারপর এসেছে এখানে। ও যে কেবল সুপ্রিয়ার সাথেও গল্প করতে আসতে পারে, তা হয়তো কখনো ভাবেনি কেতকী। সুমন সহজভাবে বলে, ‘না আমি এখানেই এসেছি’।
সমলিঙ্গের, সমবয়সী আপাতঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যেও কখনো নানারকম সুক্ষ্ম গূঢ়ৈষা (complex) কাজ করে। তার কিছুকিছু অনুভব করা গেলেও সেসবের মুখোমুখি করা যায় না। ভদ্রতা, চক্ষুলজ্জা বা আমিত্বে বাধে। কখনো তার তির্যক প্রকাশ হয় অন্যভাবে। সমবয়সী লেখক বন্ধুদের কোনো একজন অপ্রত্যাশিত সুযোগ, খ্যাতি, পুরস্কার, প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলে অন্য লেখকবন্ধুর চাপা ইর্ষা প্রকাশ পায় তার কোনো লেখায় যেখানে চরিত্রগুলির নাম অন্য হলেও দুয়ে দুয়ে চার করতে মনযোগী পাঠকের বেগ পেতে হয় না। কখনো শর্তহীন বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুত্বের মধ্যেও উপলব্ধি হয় সুক্ষ্ম অধিকারবোধ।
সেদিন সুমনের জবাব শুনে কেতকীর ভাবান্তর নজর এড়ায় না সুমনের। একটু পরে কেতকী উঠে পড়ে। সুমনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি বাড়ি যাচ্ছি, তুই কি আসবি?’ সুমন বলে, ‘এই তো এলাম, তুই আয়, আমি যাচ্ছি একটু বাদে। কেতকী চুপচাপ চলে যায়। কেন জানি, সেদিন ওর চলে যাওয়ার ভঙ্গিটা একটু বিষন্ন মনে হয় সুমনের। কেতকী চলে যেতেও সুমন সহজভাবেই গল্প করছিল সুপ্রিয়ার সাথে। একটু বাদে ওর বোন ও মা’ও এলেন বাজার থেকে। সুমনকে ওরাও পছন্দ করে। চা মুড়ির সাথে গল্প হোলো খানিক সবাই মিলে।
কেতকী চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেক বাদে সুমন গেল কেতকীদের বাড়ি। অন্ধকার হয়ে গেছে। উঠোনের পাশে রান্নাঘরের জানলায় গিয়ে দাঁড়ায় সুমন। ও জানে এ সময় রাতের রান্না করে কেতকী। ওকে জানলায় দেখে মুখ তুলে তাকায়। পরনে আগুন রঙা শাড়ি। আঁচের তাপে টকটকে ফরসা মুখে লালচে আভা। অপূর্ব লাগছে। কিন্তু থমথমে মুখে মাখা টসটসে অভিমান। ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে, ‘এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি? আর একটু থাকতে পারতিস ওখানে।’
সুমন বোঝে, কোথায় বিঁধেছে। বলে, ‘চা খাওয়াবি না?’ কেতকী বলে, ‘ওমা, তোকে চা না খাইয়ে আসতে দিলো সুপ্রিয়া?’ সুমন বোঝে এখন ওর ম্যানেজারির পালা। বলে, ‘খাইয়েছে, তবে মাসীমাও ছিলেন বলে সিগারেট খেতে পারিনি। আর একবার খেতে চাই, খাওয়াবি?’ হয়তো এতোক্ষণ সুপ্রিয়াদের বাড়ি আড্ডার সময় মাসীমাও ছিলেন শুনে আবার ভাবান্তর হয় ওর। বলে, ‘ঘরে গিয়ে বোস, আনছি’। সেদিন চা খেয়ে ছাদে গিয়ে দুজনেই আর অন্যদিনের মতো সহজভাবে আড্ডা দিতে পারে না। সেদিন সুমন নিশ্চিতভাবে বুঝেছিল, ইচ্ছে হলেই সাইকেল নিয়ে কেতকীদের বাড়ি দুদ্দাড়িয়ে চলে এলেও, টানটা কেবল একতরফা নয়।
।। ৪ ।।
দূর্গাপূজোর ছুটির পর কলেজ খুলতেই সুমন জানতে পারে প্রায় গোটা ডিসেম্বরটা কাটবে দেওঘরে সার্ভে ক্যাম্পে। সিনিয়ররা জানালো, দিনে ফিল্ডওয়ার্ক, রাতে রিপোর্ট বানানো, ড্রয়িং করা এসব নিয়ে ক্যাম্পের দিনগুলো দারুণ কাটবে। দেওঘরের মতো মনোরম জায়গায়, শীতকালে, উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে বন্ধুদের সাথে হৈচৈ করে একমাস কাটবে ভেবে সুমনের আনন্দ আর ধরে না। সেদিন বিকেলে কলেজ থেকে ফিরেই সুমন সাইকেল ছোটায় কেতকীদের বাড়ি।
দেওঘর যেতে তখনও দেড়মাস বাকি। খুব উৎসাহ নিয়ে খবরটা জানাতে কেতকীর মুখটা একটু যেন ম্লান হয়ে গেল। অস্ফূটে বলে, ‘তুই তাহলে পুরো ডিসেম্বরটা থাকবি না? ধ্যাৎ, ভাল্লাগে না।’ তবে কেতকী মেয়ে, তায় ভীড়ের মধ্যেও চোখে পড়ার মতো সুন্দরী। অনেক পুরুষের মুগ্ধতা মাখানো দৃষ্টির তারিফে অভ্যস্ত। সুন্দরী নারীদের দূর্বলতা প্রকাশ না করাই সহজাত প্রবৃত্তি। বরং পুরুষের একতরফা দুর্বলতা অনুভব করেও উদাসীন ভঙ্গিতে এড়িয়ে যেতেই তারা অভ্যস্থ। তাই পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলে, ‘তবে তুই তো আর বেড়াতে যাচ্ছিস না, ওটা তোদের প্র্যাক্টিক্যাল, যেতে তো হবেই। খুব আনন্দ করবি মনে হচ্ছে। তোদের ছেলেদের কি মজা। আচ্ছা, দেওঘরে তো ডিসেম্বরে খুব ঠান্ডা পড়ে শুনেছি। তুই যা এ্যালবেলে, ভালো মতো শীতের পোষাক নিয়ে যাস কিন্তু। না হলে ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারে। ওখানে ভালো ডাক্তার বদ্যিও পাবি না। আচ্ছা, আমি তোকে একটা হাফ সোয়েটার বুনে দেবো, কেমন।’
পরের সপ্তাহে গিয়ে সুমন দেখে হলুদ, মেরুন উল দিয়ে একমনে একটা সোয়েটার বুনছে কেতকী। বলে, ‘নিউ মার্কেট থেকে এনেছি। তুই ফর্সা তো, এই কম্বিনেশনটা তোকে মানাবে। আচ্ছা, একবার দাঁড়া তো, দেখি ঘরটা ঠিক নিলাম কি না।’ বর্ডারটা সুমনের গায়ে ফেলে ও সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ে, ‘যাক বাবা, আন্দাজে নিয়েছিলাম, কিন্তু ঠিক হয়েছে।’
দিন দশেক বাদে গিয়ে সুমন দেখে পিঠের দিকটা শেষ। বুকের দিকটাও অর্ধেকের বেশি হয়ে গেছে। সেদিন বিকেলে বাড়িতে কেউ নেই। সুমনকে দেখেই জানতে চায় কেতকী, আগের দিন আনবি বলেছিলি, এনেছিস? সুমন মাথা নেড়ে জানায় এনেছে। নিয়মিত দিনপঞ্জী লেখার অভ্যেস সুমনের নেই। তবে মাঝে মধ্যে কিছু কথা, ঘটনা নাড়া দেয়। সেসব অনূভবই হারিয়ে যাওয়ার আগে ভাষার তবকে জড়িয়ে রেখে দেয় ডায়েরীর পাতায়। তাতে অনেক সময় থাকতো কেতকীকে নিয়ে ওর কল্পনাবিলাস। সপ্তাহে বার দুয়েক আড্ডা দেবার পরেও ডায়েরীতে কাউকে নিয়ে লেখার তাগিদ হয়তো ঐ বয়েসেই মানায়।
কেতকী সুমনের ডায়েরী পড়তে চাইতো। বলতো, ‘তোর লেখার ভঙ্গীটা খুব সাবলীল। কতো সামান্য কথা, ঘটনার ওপরেও সুন্দরভাবে খেলিয়ে কত কী লিখিস তুই! আমি তো বাবা কোনোদিন পারব না। ডায়েরী হচ্ছে আত্মকথন, তাই এতে মিথ্যাভাষণ করবি না। যদি কিছু পরিস্কার ভাবে লিখতে না পারিস প্রচ্ছন্ন ভাবে, রূপকের সাহায্যে লিখবি কিন্তু কপটতা করিসনা।’
চার বছর মিশেও সুমন ওর ডায়েরীর পাতাতেও ঐ তিনটি শব্দের প্রত্যাশিত বাক্যটি লেখে নি। তবে কেতকীকে নিয়ে ডায়েরীর পাতায় রাঁধা কিছু খেয়ালী পোলাওয়ের বিবরণ পড়েও কেতকী রুষ্ট হয়নি। বরং মাস ছয়েক আগে প্রথমবার ওর ডায়েরী পড়ে সুমনকে একটা ছোট্ট চিঠি লিখেছিল কেতকী - এই বয়সেই আমি নানা রকম পুরুষ চরিত্র দেখে ফেলেছি। কিন্তু সামনে বসে গল্প করা তুই আর ডায়েরীর পাতায় ফানুস ওড়ানো তুই যেন দুটো আলাদা মানুষ। এতদিন মিশেও তোর বাহ্যিক আচরণে এহেন ভাবনার কোনো প্রকাশ দেখি নি কখনো। আশ্চর্য!
সেদিন চেয়ারে বসে টেবিলে দুহাত রেখে নিমগ্ন হয়ে ডায়েরীটা পড়ছে কেতকী। টকটকে লাল একটা স্লীভলেস ব্লাউজ পড়েছে। চোখের সামনে থোড়ের মতো পেলব অনাবৃত বাহু। টসটসে অধরোষ্ঠ যেন আধচোষা লেবু লজেন্স। মাঝে মাঝে ঠোঁটের ফাঁকে খেলা করছে পাতলা হাসির পরত। সুমন সদ্য শেষ করেছে সুনীলের 'স্বপ্ন লজ্জাহীন'। তার কিছু রেশ হয়তো পড়েছে সাম্প্রতিক লেখায়। সুমনের মনে হচ্ছে সুনীলের অনবদ্য লেখনীতে জীবন্ত মনীষাই যেন সামনে বসে আছে।
পড়া শেষ করে কেতকী মিটিমিটি হেসে বলে, ‘ক্রমশ তোর কলম খুব সাহসী হয়ে যাচ্ছে! তবে লেখার ধরণটা খুব আন্তরিক। চালিয়ে যা। আচ্ছা দাঁড়া, তোকে একটা জিনিস দেখাই।’ কেতকী ঝোলা ব্যাগ হাঁটকে একটা কলেজের খাতা বের করে। কয়েকটা পাতা সরিয়ে, ‘এই তো পেয়েছি’, বলে পাতাটা খুলে খাতাটা সুমনের দিকে বাড়ায়। ‘কী এটা?’ বলে সুমন। কেতকী বলে, নিজেই পড়ে দ্যাখ।’ সুমন খাতাটা নিয়ে দেখে তাতে একটা পুরো পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা - "কী খবর?" - নীচে তারিখ দিয়ে সই করা - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
অবাক হয়ে সুমন বলে, ‘কী করে পেলি?’ মুচকি হেসে কেতকী বলে, ‘তবেই দ্যাখ, তুই এ্যাতো সুনীলদার ভক্ত অথচ আমি কেমন অটোগ্ৰাফ পেয়ে গেলাম।’ সুমন অধৈর্য হয়ে বলে, ‘কী ভাবে পেলি, সেটা বলবি তো?’
‘আচ্ছা বাবা, বলছি, শোন। পরশু বিকেলে এ্যাকাডেমিতে গেছিলাম, কলেজের কজন মিলে একটা নাটক দেখার কথা ছিল। আমি আগে পৌঁছে গেছি। হাতে সময় ছিল তাই নেহাত টাইম পাস করতেই কী একটা ছবির প্রদর্শনী হচ্ছিল, ঢুকেছিলাম। টিকিট ফিকিট নেই। ছবির কিছু বুঝিও না আমি। এমনিই ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। হঠাৎ আমার ডানপাশে দেখি সুনীলদা। একটা ছবির দিকে খুব মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছেন।’
‘আমি ছবি ছেড়ে সুনীলদাকে ভ্যালভ্যাল করে দেখছি। উনি মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, "কী দেখছো?" আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আপনাকে। উনি মুচকি হেসে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, "ছবি কিন্তু ওদিকে।" আমি লজ্জায় একশেষ, ঢোঁক গিলে বলি, আমার এক বন্ধু আপনার খুব ভক্ত, ও আমায় আপনার অনেক লেখা পড়িয়েছে।’
‘সুনীলদা আবার মুচকি হেসে বললেন, "ও, তোমার বন্ধু আমার ভক্ত, তুমি নও।" অপ্রস্তুত হয়ে কথা ঘোরাতে তাড়াতাড়ি এই খাতাটা বার করে বলি, একটা অটোগ্ৰাফ দেবেন, আমার বন্ধুকে দেখাবো। ও খুব খুশি হবে। "আর তুমি?" সুনীলদার চোখে মুখে চাপা হাসি। আমিও, বলে আমি পালিয়ে বাঁচি।’
সুমন বলে, ‘জানিস তো সুনীলদার লেখায় পড়েছি, উনি অচেনা পুরুষদের সাথে খেজুরে আলাপ করতে একদম পছন্দ করেন না। কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের সাথে একবার আলাপ হলে জীবনে তাদের মুখ ভোলেন না। তাহলে তোর মুখটাও সুনীলদার মনে শিলালিপি হয়ে রয়ে গেল।’
রাঙিয়ে ওঠে কেতকী, ‘বাজে বকিস না, ওটা আবার আলাপ নাকি। দু একটা মাত্র কথা। সেদিন ওখান থেকে বেরিয়েই হয়তো উনি ভুলে গেছেন আমায়। অমন কতজনের সাথে রোজ দেখা হয় ওনার। সুমন বলে, ‘কিন্তু তাদের সবাই তোর মতো সুন্দরী নয়। তুই পাঁচপেঁচি গোছের দেখতে হলে সুনীলদা হয়তো ঘুরেও দেখতেন না। তুই নিশ্চিত সুনীলদার মনে ছাপ ফেলেছিস, তা না হলে অতো বড়ো করে উনি লিখতেন না, "কী খবর?" - যেন কতদিনের চেনা।’
কেতকী চোখ পাকিয়ে বলে, ‘এবার কিন্তু গাঁট্টা খাবি তুই, এই জন্যই তোকে আমি প্রথমে দেখাই নি এটা, ঠিক জানতাম ইয়ারকী মারবি।' সুমন বলে, ‘তোর ঠোঁটটা আজ এমন চকচক করছে কেন রে?’ কেতকী বলে, ‘আর বলিস না, আমার মেজদি, ঐ যে হিউস্টনে থাকে রে, ছুটিতে এসেছে এখানে। ও জানে আমি লিপস্টিক লাগাই না, তাই আমার জন্য ন্যাচারাল লিপগ্লস এনেছে। ওটাই একটু লাগিয়েছি। কেন, ভাল্লাগছে না?’
সুমন বলে, ‘না, না, ভালোই লাগছে, তবে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।’ কেতকী ভ্রুভঙ্গী করে বলে, ‘অন্যরকম মানে?’ সুমনের প্রথমেই যা মনে হয়েছিল সেটাই মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, ‘তোর নীচের ঠোঁটটা যেন আধচোষা লেবু লজেন্সের মতো চকচক করছে।’
হিলহিলে শরীরে ঢেউ তুলে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে কেতকী। ও জানে চুলে হাত দিলে রেগে যায় সুমন তবু সেই ফরসা থোড় হাত বাড়িয়ে সুমনের কোঁকড়া চুল খুবসে ঘেঁটে দিয়ে বলে, ‘ডায়েরী লিখে লিখে দেখছি তোর উর্বর মস্তিস্কে আজকাল নানান অদ্ভুত উপমা আসছে। আচ্ছা, বাজে না বকে, এবার একটু উঠে দাঁড়া তো, সামনেটা যতটা বুনেছি একটু দেখে নিই, V-টা কোথায় ফেলবো।’
উঠে দাঁড়ায় সুমন। সোয়েটারের সামনের অংশটা নিয়ে কেতকীও উঠে এসে দাঁড়ায় ওর সামনে। হলুদ মেরুন দুটো উলের গোলা লেগে আছে কাঁটায়। মাপ নেওয়ার জন্য ও দাঁড়িয়েছে একদম গা ঘেঁষে। ঘরে ঢুকেই আজ যে হালকা সুবাসটা পেয়েছে সেটা এবার ঝাপটা মেরে উচাটন করে দেয় মন। ‘কি রে, পারফিউম মেখেছিস নাকি? ওটাও কি দিদি দিয়েছে? তোকে তো বাড়িতে কখনো সেন্ট লাগাতে দেখিনি?’ খুশী খুশী গলায় কেতকী বলে, ‘হুঁ, ঠিক ধরেছিস। সেটাই একটু লাগিয়েছি। গন্ধটা ভালো না?’ সুমন বলে, ‘হ্যাঁ, খুব মিষ্টি গন্ধ, বিদেশী দামি সেন্ট, ভালো তো হবেই।’
কেতকীর বাঁ হাতটা উলের গোলা সমেত দুটো কাঁটা সুমনের গলার কাছে ধরে আছে। ওর কলকে ফুলের মতো কড়ে আঙুল গলায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে। অংশত বোনা সোয়েটারটা ঝুলছে বুকের ওপর। কেতকীর ডান হাতটা সোয়েটারের ওপর দিয়ে সুমনের বুকের ওপর নড়াচড়া করছে V-এর অবস্থানটা বোঝার জন্য। কেতকী মুখটা একবার তুলতেই হঠাৎ সুমন দেখে সেই চকচকে লেবু লজেন্স ওর মুখের একদম কাছে। কেতকী খুব মন দিয়ে মাপ নিচ্ছিল। কিন্তু মেয়েদের অজান্তেই ওদের কিছু সরল আচরণ ছেলেদের মনে সৃষ্টি করতে পারে অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া।
কেমন যেন ঘোর লেগে যায় সুমনের। দুহাতে হঠাৎই জড়িয়ে ধরে ওকে। প্রবল আলিঙ্গনে ওর নরম শরীরটা মিশে যায় সুমনের শরীরে। কেতকীর দুটো হাত দড়ি থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় খসে পড়া গামছার মতো স্খলিত ভাবে ঝুলে পড়ে দুপাশে। উলের গোলা সমেত আধবোনা সোয়েটার ছিটকে পড়ে মেঝেয়। সুমন ওর বুকে অনুভব করে দুটি স্বর্গীয় পারাবতের স্পর্শ। সেই অনির্বচনীয় স্পর্শানুভূতি তখনও অবধি সুমনের জীবনে অনাস্বাদিত। শিরশিরিয়ে ওঠে ওর সারা শরীর। তীব্র কোনো প্লাবনের অভিঘাতে পরক্ষণেই নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় ওর বাঁ হাত। মাথার পিছনে হাত দিয়ে কেতকীর মুখটা নিমেষে টেনে আনে নিজের কাছে। এতো নরম, এতো কবোষ্ণ হয় নারীর ওষ্ঠ! সেই প্রথম অনুভব করে সুমন।
গভীর আশ্লেষে আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থেমে গেছিল সুমনের সময়। কেতকীর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। না প্রতিরোধ না আবাহন। যেন অচেতন সমর্পণ। কেতকীর শরীর যখন সুমনের আলিঙ্গনে আবদ্ধ, সুমনের ওষ্ঠ যখন প্রবল তৃষ্ণায় শুষে নিচ্ছে ওর ওষ্ঠের উত্তাপ, তখনও কেতকীর ঝুলে থাকা দুটো হাত সুমনকে ক্ষণিকের জন্যও জড়িয়ে ধরে না। তাহলে কী ভুল হয়ে গেল? এতদিন মিশে, অনেক সুযোগ পেয়েও সুমনের কখনো কোনো বিচ্যূতি হয়নি, সেই আত্মনিয়ন্ত্রণ কী ক্ষণিকের দূর্বলতায় হারিয়ে ফেললো ও? সুমনের প্রতি বিশ্বাসে কী চিড় ধরলো কেতকীর?
প্রথম থেকে শরীরকেন্দ্রীক আকর্ষণে কেতকীর অনীহা লক্ষ্য করেছে সুমন। যৌবনে নারী ও পুরুষের মধ্যে দেহাতীত প্রেম বা প্লেটোনিক লাভ হয়তো সোনার পাথরবাটির মতই অবাস্তব কিন্তু মূলতঃ হরমোন প্রভাবিত সম্পর্কের টান যে ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য এ ব্যাপারে ওরা দুজনেই ছিল সহমত।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথায় শশী কুসুমকে বলে, 'শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?' ওদেরও মনে হোতো নিবিড় কোনো মানসিক টান ক্ষণস্থায়ী শারীরিক আকর্ষণের চেয়ে অনেক মহার্ঘ। হামলে পড়া পুরুষ ছিল কেতকীর দু চক্ষের বালাই। ও যে সুমনকে পছন্দ করতো, সহজ ভাবে মিশতো তার প্রধান কারণ সুমনের মধ্যে কখনো হ্যাংলামো দেখেনি ও। কিন্তু ওর নারীত্বের আবেদন যে সুমনের কাছে মূল্যহীন নয় সেটাও ও জানতো সুমনের ডায়েরী পড়ে।
হঠাৎ এই বোধোদয়ে যেমন আচম্বিতে ওকে জড়িয়ে ধরেছিল সুমন, তেমনি আচমকাই ছেড়ে দেয়। আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থা থেকে হঠাৎ অবলম্বনহীন হয়ে একটু টলে গিয়ে টেবিলটা ধরে সামলে নেয় কেতকী। নীচু করে রাখা ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে গেছে। কয়েক পলের সূচীপতন নীরবতা। তারপরেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কেতকী। মনে সংশয়ের দোলাচল নিয়ে বসে থাকে সুমন।
।। ৫ ।।
প্রায় মিনিট পনেরো বাদে দুটো চায়ের কাপ হাতে ঘরে আসে কেতকী। মুখে চোখে জল দিয়ে এসেছে। ঠোঁটে লিপগ্লসের চিহ্নমাত্র নেই। সহজ ভাবে বলে, কি রে, ভ্যাবলার মতো বসে আছিস কেন? নে, চা খা। একটা কাপ বাড়িয়ে দেয় সুমনের দিকে।
সুমন আড়চোখে দেখে ওকে। একটু আগের ঘটনার লেশমাত্র রেশ নেই ওর ব্যবহারে। সুমনের দৃষ্টি থমকে যায় ওর ঠোঁটে। ফর্সা মুখে ওপরের ঠোঁটের একটু অংশ এখনও গাঢ় লালচে হয়ে আছে। তাহলে কি উত্তেজনার বশে বেশ জোরেই ... ছি ছি! ওর মনের কথাটা পড়ে ফেলে কেতকী। অস্ফুটে বলে, ‘ভোঁদড় একটা। এভাবে কেউ...।’ বাক্যটা অসমাপ্ত রেখেই টেরিয়ে তাকায় সুমনের দিকে। মুখে বিষ্ময় ও কৌতুকের হেঁয়ালী প্রলেপ।
‘ক্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস যে? তোকে সাধাসিধে ভাবতাম, কিন্তু পেটে পেটে এ্যাতো? ঐ সুনীলদাই তোর মাথা খেয়েছেন মনে হচ্ছে।’ কেতকীর কৌতুকে তির্যক প্রশ্রয় সুস্পষ্ট। তবে সুমন তখন ছিল নিতান্তই গোলা। মিনমন করে বলতে যায়, ‘আসলে মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল। মিষ্টি সেন্টের গন্ধ, অতো কাছে তোর লজেন্সের মতো ঠোঁট, আর...।’ তড়বড় করে কেতকী থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘খুব হয়েছে, তোকে আর অজুহাতের ফিরিস্তি দিতে হবে না, পাজী কোথাকার। চা খেয়ে তুই এখন কেটে পড়। আমায় একবার স্যারের কাছে যেতে হবে নোটস আনতে।’
সেদিন চলে আসার সময় সুমনের বেশ অভিমান হয়েছিল। চার বছরের মেলামেশায় সেই প্রথম কেতকী ওকে নিজে থেকে চলে যেতে বললো। এর আগে অনেকবার চলে আসার আগে ও বলেছে, আর একটু বোস না বাবা। আসলে এক হাতে যে তালি বাজে না সেই প্রবাদবাক্যটি সেদিন সুমনের মনে পড়েনি। ও বোঝেনি সংকোচের দ্বিধা কেটে যেতে সেদিন ফাঁকা বাড়ীতে সংযমের বাঁধ ভাঙার ভয় কেতকীরও ছিল। ভয়টা শুধু সুমনকে নয়, ভয় ছিল হয়তো ওর নিজেকেও। তাই বাইরে যাওয়ার ছল করে ও সুমনকে ভাগিয়ে দিয়েছিল।
আলোচনায় দেহাতীত প্রেমের ধ্বজা ওড়ালেও একুশের সজীব যৌবন চার বছরের অন্তরঙ্গতায় ওটুকু নৈকট্য দাবি করতেই পারে। সেটা মোটেই দোষেরও কিছু নয় বরং খুবই স্বাভাবিক। অল্প আলাপে পুরুষের একতরফা হামলে পড়া স্বভাব মেয়েদের অবাঞ্ছিত লাগলেও দীর্ঘ মেলামেশার পরেও প্রিয়জনের নৈকট্যে অনাসক্তি আবার অস্বাভাবিক লাগতে পারে।
পুরুষ কাছে টানতে চাইবে, নারী রহস্য করে এড়িয়ে গিয়ে সেই টান জিইয়ে রাখবে। কখনও বা ধরা দেবে নিজের মর্জিতে। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। এতদিন সুমনকে সেই প্রচলিত ছকে ফেলতে না পেরে কেতকী হয়তো ভেবেছিল সুমনের সেই তাগিদই হয়তো কম। তাই হঠাৎ ওর নারীত্বের আকর্ষনে সুমনকে অমন প্রবল ভাবে সাড়া দিতে দেখে ভালো লাগার আবেশে সেও হয়তো বিহ্বল হয়ে যায়। মেয়েরা তো পরিস্কার করে কিছু বলে না। ভোঁদড়, পাজী এসব কপট বিশেষণই হয়তো লুকিয়ে ছিল সেই আবেশের তির্যক প্রকাশ। গোলা সুমন সেদিন তা বোঝেনি।
সেদিনের ঘটনার পর ক্যাম্পে যাওয়ার আগে অবধি আরো বেশ কয়েকবার সুমন ওদের বাড়ি গেছে। বাড়িতে কেউ না থাকলেও ওরা সহজ ভাবেই আগের মতো আড্ডা দিয়েছে। কেবল মাঝে মধ্যে ওর মুখের দিকে সুমনকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেতকী চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়েছে, ‘এ্যাই, আবার কোনো বদমায়েশীর ফন্দী আঁটছিস? ভালো হবে না বলছি।’
সুমনের আত্মসম্মান জ্ঞান ছিল টনটনে। কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারে ছিল নিরেট। তাই কেতকীর কপট ধমকের আড়ালে যে অনুক্ত হাতছানি তা ও দেখতে পায়নি। ফলে তারপর যতদিন ওদের সম্পর্ক ছিল আর কোনোদিন সুমনের আচরণে কোনো 'বিচ্যূতি' প্রকাশ পায়নি। সুমন ভাবতো সেটা ওর আত্মসংযমের পরাকাষ্ঠা। কেতকী কী ভাবতো তা ও ভেবে পায়নি।
আর মাপ না নিয়েই কেতকী শেষ করে দিয়েছিল সেই সোয়েটার। গায়ে দিতে দেখা গেল V-টা একটু ঢিলে রয়ে গেছে। কেতকী দেখে বলে, ‘ইস, V-টা ঠিক হয়নি।’ সুমনের গালে মৃদু ঠোনা মেরে বলে, ‘তুই পাজীটা এর জন্যে দায়ী, বেশ বুনছিলাম, দিলি সব গুলিয়ে।’ ওই সামান্য ত্রুটিতে অবশ্য কিছুই এসে যায় না কারণ সুমনের প্রতি কেতকীর সখ্যতা মাখা ছিল ঐ সোয়েটারে। ওই সামান্য বিকৃতি আসলে ক্ষণিকের এক মধুর বিচ্যুতির স্মারক।
।। ৬ ।।
ক্যাম্পে গিয়ে সুমন ওর কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধুকে বলে, ‘জানিস এই সোয়েটারটা না কেতকী বুনে দিয়েছে।’ শুনে ওদের কী আহ্লাদ। ‘তাই নাকি? তাহলে তো তোর একদমই শীত করছে না, কী বলিস? আমাদের তো মা, দিদি ছাড়া আর কেউ বুনে দেওয়ার নেই। একটু হাত বুলোতে দে মাইরি, ফীল করি।’ বন্ধুদের চ্যাংড়ামি সুমন বেশ উপভোগ করে। ওর অনেক বন্ধুরা যখন মেয়েদের নিয়ে জল্পনা কল্পনা হাসি মস্করা করতো, সুমন তখন বিগত চার বছর ধরে এক জলজ্যান্ত সুন্দরীর সাথে নির্ভেজাল আনন্দে চুটিয়ে মিশেছে। কেতকী শুধু সুন্দরীই নয়, তার স্বভাবটিও ছিল কোমল, অন্তরঙ্গ।
যৌবনে নারীর শীতল প্রত্যাখানে অপমানিত পৌরুষ হয়ে যেতে পারে কর্কশ, বিপথগামী। সবল পুরুষের হবে সংযমী হৃদয়, তাতে অযথা উঠবে না ভাবাবেগের তরঙ্গ, উঠলেও তার পাথরপ্রথিম মুখচ্ছবিতে ফুটবে না অন্তর্লীন বেদনার সামান্য আঁকিবুঁকি, একান্তে ক্ষণিক ক্রন্দনও সর্বৈব নৈব নৈব চ। এই হচ্ছে সমাজে পুরুষের প্রচলিত ম্যানলি ইমেজ। অজান্তেই এই ইমেজ অনুশীলনে রত অধিকাংশ মেল শভিনিস্ট। যারা এ ছকে পড়ে না, নারীর মধুর আন্তরিক সঙ্গ তাদের মননকে করতে পারে গভীর সংবেদনশীলতায় সমৃদ্ধ। সুমনের কাছে কেতকীর সাহচর্য ছিল সেরকম। গন্তব্য নয়, যতদিন সম্ভব সখ্যতার সহযাত্রাই ছিল সুমনের কাছে অতীব আনন্দময়।
ফেরার দিন ছাত্র, পাচক, সাহায্যকারী নিয়ে প্রায় সত্তর জন। তার ওপর আছে সার্ভের যন্ত্রপাতি, ব্যক্তিগত মাল। সরকারী কলেজের শিক্ষামূলক ভ্রমন, বাজেট কম। তাই RMS ভ্যান সংলগ্ন একটা অর্ধেক জেনারেল ডাব্বা রিজার্ভ করা হয়েছে। ওতেই ওরা যাবে। জশিডি জংশনের সাইডিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা। মোগলসরাই প্যাসেঞ্জার এলে তার সাথে জুড়ে দেওয়া হবে। ট্রেন প্রচুর লেট। কামরা অন্ধকার। কেউ শুয়ে পড়েছে। কয়েকজন মোমবাতি জ্বালিয়ে তাস খেলছে। বাকিরা আড্ডা মারছে। রাত প্রায় দুটো। স্টেশনে একা পায়চারি করছে সুমন। ঘুম আসছে না। কাল কেতকীর সাথে দেখা হবে। মাত্র এক মাসের অদেখা। কিন্তু মনে হচ্ছে কতদিন হয়ে গেছে।
নির্জন প্ল্যাটফর্ম। উলিকটের ফুলহাতা গেঞ্জির ওপর সুমন পরেছে কেতকীর বোনা সোয়েটার, তার ওপর চাপিয়েছে বাবার দেওয়া পুলিশের ওভারকোট। মাথায় হনুমান টুপী। তাও শেষ ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো বিহারের ঠান্ডার দাপট টের পাওয়া যাচ্ছে। একবার ওভারকোটের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে সোয়েটারের ওপর নিজের বুকে হাত বোলায় সুমন। আঙ্গুলে স্পর্শ করে সেই ঠিকঠাক না হওয়া V. নিমেষে অলীক উষ্ণতার আবেশে ভরে যায় মন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।