

মৃত্যু, শারীরিক মানসিক কষ্ট, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন – সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে কৃষকেরা মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন বৎসরকাল। কোনো ভয় বা প্রলোভন তাদের নীতিচ্যুত করতে পারেনি। আজ তার সুফল ফলেছে। ১৯শে নভেম্বর ২০২১, গুরু নানকের জন্মদিনে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশ্বের সামনে পিছু হটতে বাধ্য হলেন এবং সর্বসমক্ষে ঘোষণা করলেন – তাঁর সরকার তিন কৃষি আইন বাতিল করবে।
এখনো এই ঘোষণা বাস্তবায়িত হওয়ার সব ধাপগুলো পেরোতে অনেক পথ বাকি। তার মধ্যে নাট্যাচার্য মোদী কোনো টার্ন অ্যান্ড টুইস্টের উপকরণ রাখবেন কিনা – তা তো জানা নেই, কিন্তু এই বিজয় পালনের আনন্দ এখনই ছড়িয়ে পড়ছে কৃষকদের এবং কৃষক আন্দোলনের সমর্থকদের ঘরে ঘরে। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে জারি রাখা এই আন্দোলন শুধু সময় সীমার কারণে নয়, আরো অন্যান্য অনেক কারণে খুবই বিশেষ।
প্রথমত এই আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক মেজাজ। সব সম্প্রদায়ের কৃষকই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। ২০১৩ সালের মুজফফর নগরের দাঙ্গার যে বিধ্বংসী প্রভাব দুই সম্প্রদায়ের মানুষকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছিল, সেই লজ্জা ও অপমান থেকে এই আন্দোলন তাদের মুক্তি দিয়েছে।
এর তাৎপর্য খুবই গভীর, কারণ মুজফফর নগরের দাঙ্গার ধর্মীয় মেরুকরণকে বিজেপি একটি দীর্ঘস্থায়ী অস্ত্রে পরিণত করে এবং সারা ভারতে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষের হাওয়া তুলে ২০১৪ সালের নির্বাচন হেলায় জিতে নেয়। ২০১৭ সালের নোটবন্দীর ফলে মানুষের অপরিমেয় দুর্দশাও যেন এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়, এবং উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় বিজেপি দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা হাসিল করে। সেখানেই শেষ নয়৷ এই বিভাজনকে এমন শক্তিশালী করে তোলা হয়, যে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনও বিজেপি হেসেখেলে পার হয়ে যায়।
অথচ আজ দেখুন। কৃষক মৈত্রী এই কলঙ্কিত ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। এখন এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠানেও স্থানীয় বিজেপি নেতামন্ত্রীদের ডাকলে ধোপা-নাপিত বন্ধ। পাঞ্জাব হরিয়ানায় স্থানীয় নির্বাচনগুলিতে প্রার্থী করার মতো লোক বিজেপি খুঁজে পাচ্ছে না। লখিমপুর খেরির পিষে মারার ঘটনার পর থেকে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে বিজেপি সাপোর্টাররাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এ যদি বিশেষ অর্জন বলে স্বীকৃতি না পায়, তাহলে আর কী তা পেতে পারে !
শুধু জাঠ-মুসলিম ঐক্য নয়, জমির মালিক ও ক্ষেতমজুরের ঐক্যও এই জয় ছিনিয়ে এনেছে। শুধু মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব নয়, এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে জাতপাত ঘটিত দ্বন্দ্বও খুব বাস্তব। কিছুদিন আগেও এটা অকল্পনীয় ছিল যে তারা একই ঝান্ডা কাঁধে, একই আন্দোলনে সামিল হবে। কিন্তু তাই-ই হয়েছে। তাদের রুজিরোজগার যখন একচেটিয়া পুঁজির গ্রাসে, তখন তারা একই সঙ্গে পুঁজির ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোদী-সরকারের কালা কানুনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
এই জয়ে মহিলাদের অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ঘরসংসার ফেলে তাঁরা আন্দোলন স্থলে দিনের পর দিন পড়ে থেকেছেন, দলে দলে ট্র্যাক্টর চালানো শিখে র্যালিতে যোগ দিয়েছেন। শুধু কমন কিচেনে নয়, মিটিং-এ তাঁদের বিপুল যোগদান এবং আন্দোলনের মুখ হিসেবে নানা বিবৃতি প্রদান নতুন আশার সঞ্চার করেছে। মনে হয় যেন পিতৃতান্ত্রিকতার নিগঢ় তারা অনেকটাই খসাতে পেরেছেন। এটা কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে তা সময় বলবে, কিন্তু কিসাণীর বিপুল অংশগ্রহণকে কিছুতেই লঘু করা যাবে না।
এই বিপুলসংখ্যক মহিলার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কারণ গত তিরিশ বছরে কৃষকের অবস্থা। এই সময়ে লক্ষ লক্ষ কৃষক অপরিশোধ্য ঋণের জালে জড়িয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাঁদের জমিজমা ক্রোক হয়ে গেছে। আর কে না জানে, এইসবের গনগনে আঁচ সবচেয়ে বেশি এসে লাগে মেয়েদের গায়ে। তাঁদের নিজেদের ও পরিবারের নিরাপত্তার বোধ মেয়েদের দলে দলে কৃষক আন্দোলনে যোগ দিতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এতে শুধু আন্দোলনের পুষ্টি ঘটেনি, উপরন্তু সমাজ লিঙ্গসাম্যের পথে কয়েক পা এগিয়ে গেছে।
এই জয়ের বুনিয়াদ রচনায় গুরুত্বপূর্ণ আর একটি কথা বলতেই হয়। আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই দিল্লি-সীমান্তের সমস্ত কলকারখানার বেশিরভাগ শ্রমিক, কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। শুধু সংহতি জাহির করা নয়, লড়াইয়ের ময়দানেও তাঁরা উপস্থিত ছিলেন। আর ছিলেন অগুনতি ছাত্র, বুদ্ধিজীবী,সাংবাদিক, অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত মানুষজন। অন্নদাতাদের অন্নহীন অবস্থা এবং দুর্দশার কথা উপলব্ধি করে তাঁরা দৃষ্টান্তমূলক ঐক্য প্রদর্শন করেছেন। বিজেপি সমর্থকরা ছাড়া সমাজের সব অংশের যোগদান কৃষক আন্দোলনকে এই সময়ের বৃহত্তম গণআন্দোলনের চেহারা দিয়েছে।
আর একটি কথা। তিন কালা কানুন পাশ করানোর আগেই মোদি সরকার শ্রমিকবিরোধী এমন আইন পাশ করিয়েছে, যাতে শ্রমের বোঝা বেড়েছে বহুগুণ, উপরন্তু লাগামছাড়া শোষণের মাত্রাও বিশ্রীভাবে বেড়েছে। সুতরাং আজকের ভারতবর্ষে শ্রমিক ও কৃষকের ভাগ্য এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে, যে আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজি এবং তাদের পোষ্য দেশি কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইতে শ্রমিক-কৃষক জোট অবশ্যম্ভাবী। তার সাফল্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল এই জয়। এই পথেই ভবিষ্যতের লড়াই এগিয়ে যাক।
মোদী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের এ এক অসীম লজ্জা ও অপমানের প্রহর। কারণ কৃষকের দাবি যে মূহুর্তে মেনে নেওয়া হল, সেই মুহূর্তেই এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল সরকারকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ইষ্টমন্ত্র – নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে যেতে হল। তাকে প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিতে হল, সে কার পক্ষে – আন্তর্জাতিক বৃহৎ ব্যবসার, নাকি দেশীয় মার-খাওয়া কৃষকের। আপাতত বাধ্য হয়ে সে কৃষকের – ভবিষ্যতের কোনো ষড়যন্ত্র যদি না পাশা উলটে দেয়।
গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহের অনেক লক্ষণ এই আন্দোলনের দেহে পরিস্ফুট। এই গণসংগ্রাম শুধু নিজেদের মধ্যেই নয়, কী এক মন্ত্রবলে বিপরীতমনস্কদের সঙ্গেও মানসিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছে। উত্তর ভারত মূল কেন্দ্র হলেও সমস্ত দেশেই এর অভিঘাত অনুভূত হয়েছে। অনেক বিজেপি-পন্থীরাও সরকারের দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে। আন্দোলনকারীরা তাদের প্রতিটি দাবির সঙ্গে নিজেদের জীবন-মরণকে এমনভাবে মিলিয়ে দিতে পেরেছে যে অচিরেই সত্যাগ্রহী মনোভাব তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। কঠোর আত্মশৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতায় ভর করে থাকা এই আন্দোলনকে বিরাট ক্ষমতাশালী শত্রু বার বার স্যাবোটাজ করার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে। বিন্দুমাত্র বিচ্যুতিও সহ্য করা হয়নি। যোগেন্দ্র যাদবকেও শৃঙখলাভঙ্গের কারণে কিছুকাল বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
দেশের প্রতিটি কোণায়, যেখানেই রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিক্রি হচ্ছিল, নিপীড়ন নেমে আসছিল, বিরোধী কন্ঠরোধ করা হচ্ছিল রাজদ্রোহ বা সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইন প্রয়োগ করে, সেখানেই কৃষক নেতারা আন্দোলনকারীদের অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন৷ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এর ফলে আপামর জনসাধারণের প্রধান শত্রু কে – সেই সনাক্তকরণ দ্রুত সম্পন্ন হতে পেরেছে।
কৃষক আন্দোলনের জয়ী কৃষকদের টুপিতে আজ অনেকগুলি সাফল্যের পালক। সংসদীয় রাজনীতিতে প্রচলিত ধারার আন্দোলন থেকে পৃথক একটি নতুন আন্দোলন-রীতির জনকদের প্রদর্শিত পথেই এ দেশের ভবিষ্যত আন্দোলনের অভিমুখ, এ আশা করাই যায়।
Amit | 120.22.***.*** | ২০ নভেম্বর ২০২১ ০৬:১৫501327
Amit Sengupta | ২০ নভেম্বর ২০২১ ১২:০৮501331
মুদি | 2405:201:9002:305a:41c2:abc2:c0d6:***:*** | ২০ নভেম্বর ২০২১ ১৫:১৯501336
মণিশংকর বিশ্বাস | 59.154.***.*** | ২১ নভেম্বর ২০২১ ০১:০১501350
হীরক সেনগুপ্ত | 2409:4060:8d:b000:74f4:f441:a3b8:***:*** | ২১ নভেম্বর ২০২১ ১১:৫৬501362
তপন ভট্টাচার্য | 2401:4900:16cb:511:1:2:a020:***:*** | ২১ নভেম্বর ২০২১ ২২:৪৩501371