এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  খ্যাঁটন  চেখেছি পথে যেতে  খাই দাই ঘুরি ফিরি

  • তুরুপের তাস ‘পত্রানি মচ্ছি’, তাজা পমফ্রেটের

    দীপঙ্কর দাশগুপ্ত
    খ্যাঁটন | চেখেছি পথে যেতে | ২০ মে ২০২১ | ৪৭৪২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ফারচা, আকুরি, সাল্লি, পপেতা পর ইডু, লগান্যু কাস্টার্ড… শুধু ধানশাক নামটা মাথায় নিয়ে এখানে হাজির হলে আর সব খানার আগে মোক্ষম ভ্যাবাচাকা খেতে হবে। কারণ কলকাতায় পারসি খানার এক বিরল ঠিকানা কিড স্ট্রিটে এমএলএ হস্টেলের ঠিক উলটোদিকে ২০ ফুট বাই ১০ ফুট! নাম তার ‘মনচারজি’জ’দীপঙ্কর দাশগুপ্ত


    ‘‘আপনি ওভাবেও খেতেই পারেন, কিন্তু আমার হাজব্যান্ড বা শ্বশুরমশাই হলে, ডাল, স্যালাড, রাইস সব একসঙ্গে মেখে নিয়ে তারপর খেতেন!’’ কথাটা উড়ে এল রেস্তোরাঁটার ক্যাশ-কাউন্টার থেকে। ভদ্রমহিলাকে সেভাবে এর আগে লক্ষই করিনি। এবার করলাম। একটু পৃথুলা। ছোটো করে কাটা চুল যেন একটু দায়সারা ভাবে আঁচড়ানো। মুখে একগাল হাসি। লক্ষ করলাম এই কারণেই যে, রেস্তোরাঁয় খানা অর্ডার দেওয়ার পর তা কীভাবে খেতে হবে সেবিষয়ে এমন অযাচিত টিপ্পনীর অভিজ্ঞতা এর আগে আমার আর হয়নি।



    এ রেস্তোরাঁ কলকাতায় বিরল পারসি খানার দুটি ঠিকানার একটি।


    এবার ভদ্রমহিলা কাউন্টার ছেড়ে উঠে এলেন। পরিচয় হল। সুপ্রিয়া মনচারজি। যে রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছি, তার মালকিন। রেস্তোরাঁর নাম—মনচারজি’জ। কলকাতার এমএলএ হস্টেলের ঠিক উলটোদিকে। রাস্তাটার নাম কিড স্ট্রিট। রেস্তোরাঁ না বলে ‘ইটারি’ বলাই ভালো। খান ছয়েক টেবিল। সব মিলিয়ে বড়ো জোর শ’ দুয়েক স্কোয়্যার ফিট জায়গা। এখানে ঢুঁ মারার কারণ, রেস্তোরাঁয় ঢুকে সোজা তাকালেই বোঝা যাবে। একটা সাদা বোর্ড। মেনুতে সাধারণ বাঙালি খাবারের নাম-দাম। আর পাশে ইংরেজি হরফে লেখা MANCHERJI’S আর তার নীচে ন-টি পদের নাম।



    এইসব পারসি খানার বাইরেও মেলে আরও নানা পদ। তবে সব পদ রোজ মেলে না, তাই আগে থেকে অর্ডার দিয়ে হাজির হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এক খাদ্যরসিক বন্ধুর সুবাদে তেমন অর্ডার দিয়েই হাজির হয়েছিলাম। আর পারসি খানা বলতে আমবাঙালি যে খানার কথা বলবেনই আমার অর্ডারে সেটিও ছিল অবশ্যই—মাটন ধানশাক। যা এল তা থালা উঁচু করা পোলাও, এক বাটি ভরতি মাংস দেওয়া ডাল আর একবাটি কচুম্বর—ছোটো কুচিকুচি করে কাটা শশা, পেঁয়াজ, টোম্যাটো, লেবুর রস ও নুন দেওয়া। এটাই হল পারসিদের প্রিয় স্যালাড। চামচ দিয়ে একটু করে ডাল তুলে পোলাওতে মেখে একচামচ মুখে দিয়ে আর একচামচ স্যালাড তুলেছি সবে মুখে দেব বলে, ওমনি উড়ে এল সেই টিপ্পনী। আর পাঁচটা জাতখানার মতোই, পারসি খানা শুধু খেলেই হল না, খাওয়ার তরিকাটাও জানা দরকার। বটেই তো,পারসি খানার দুনিয়ায় পাড়ি মানে এক মহা-অ্যাডভেঞ্চার। ভারতে যার শুরু আজ থেকে, তা অন্তত হাজার খানেক বছর আগে।

    ভারতের পারসি সংস্কৃতিতে খানাদানার যে কী গুরুত্ব তা জ্বলজ্বল করছে দুরন্ত নানা পারসি প্রবচন, পরম্পরাগত উপদেশ বা কিংবদন্তিতে—

    প্রবচন
    মুম্বইয়ের এঁদো গলি দিয়ে হেঁটে চলেছে লিকপিকে এক ছোকরা আর তাকে দেখতে পেয়েই আশপাশ থেকে টিটকিরি দিয়ে উঠল জনাকয়েক পারসি যুবক—“আও সেকতা নি সিং, তারু দোহারুন কারোঁ” (ওরে সজনে ডাঁটা, আয় এদিকে একবার, তোকে পিটিয়ে শুক্তো বানাই)।

    উপদেশ
    গুজরাতের ভালসাদ জেলায় আরব সাগরের তীরে উদভাডা পারসিদের পবিত্র তীর্থ। সেখানে জোরস্ত্রিয়ান হেরিটেজ মিউজিয়ামের ভিতরের দেয়ালে লেখা রয়েছে খাদ্য বিষয়ক একটি অনুচ্ছেদ—সেও বা সিমাইয়ের মিষ্টত্ব মনে করিয়ে দেয় আমাদের ব্যবহারও যেন ঠিক সিমাইয়ের মতোই মধুর হয়।

    কিংবদন্তি
    আদি-মধ্যযুগের পারস্যে সাসানীয় সাম্রাজ্যে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ দুরবস্থায় পড়ে রাজদরবারে আসেন অনুগ্রহের আর্জি নিয়ে। দাক্ষিণ্য বিতরণের আগে জোরস্ত্রিয়ান রাজা তাঁকে পরখ করার জন্য যে ১৩ টি প্রশ্ন করেছিলেন তার মধ্যে ৯ টিই ছিল খাদ্য-সংক্রান্ত। সর্বশ্রেষ্ঠ আহার কোন্‌টা? এই প্রশ্নের উত্তরে সেই ব্যক্তি জবাব দিয়েছিলেন, “সুস্থ-সবল শরীরে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিঃশঙ্ক চিত্তে যখন কেউ খেতে বসে সেটিই হল শ্রেষ্ঠতম আহার।”

    ভোজনরসিক হিসেবে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার এমনটাই আমাদের প্রচলিত ধারণা। কিন্তু খাদ্যপ্রীতিতে বাঙালিরও কয়েক কাঠি ওপরে বোধহয় পারসিরা। ওপরের নমুনাগুলি থেকেই বোঝা যায়, রকের আড্ডায় ঠাট্টা-বিদ্রুপ থেকে শুরু করে মুখফেরতা রসিকতা, তুচ্ছ ইয়ারকি, গালগল্পের মন্তব্য, চলতি কথার সরস বুলি কিংবা দার্শনিক আপ্তবাক্য, জীবনচর্যার সব বাঁকেই খাদ্যের অনুষঙ্গ বা তুলনা টানা পারসি সংস্কৃতির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য।

    ইরানে সাসানীয় সাম্রাজ্যের (সাধারণাব্দ ২২৪–সাধারণাব্দ ৬৫১) হাত ধরে জোরস্ত্রিয়ান ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল। সমৃদ্ধিশালী সাম্রাজ্যের বৈভব ও পরিশীলিত রুচির প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল দেশের খাদ্য-সংস্কৃতিতেও। স্বাদে-বর্ণে-সৌরভে ইরানের খাবারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। কিন্তু সপ্তম শতকের মাঝামাঝি আরবরা দখল করল ইরান। বহু মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেন সানন্দে। কিন্তু সকলে নন। যাঁরা হলেন না, তাঁদের ওপর চলল নানা অত্যাচার। ইসলামি শাসকদের সেই অত্যাচার বা ধর্মান্তর করা এড়াতে, কথিত আছে, জোরস্ত্রিয়ানদের একাংশ প্রথমে হরমুজ দ্বীপ এবং তারপর সেখান থেকে ভারতের দিকে পাড়ি দিলেন। গোড়ায় তাঁদের তরি এসে ভিড়ল দিউতে। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্ভাবনার হাতছানিতে জোরস্ত্রিয়ান শরণার্থীরা ভারতের উত্তর-পশ্চিম কূল অভিমুখে কিছুদিনের মধ্যেই আবার রওয়ানা হলেন। শোনা যায়, তুফান ঝড়ে তাঁদের নৌকা পৌঁছে যায় গুজরাতের সানজানে। সেখানে যে সানজান স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে এই আগমন উদ্‌যাপন করতে, তাতে লেখা আছে এ ঘটনা ঘটে ৯৩৬ সালে।



    গুজরাটের সানজান শহরে ১৯২০ সালে নির্মিত সানজান স্তম্ভ। পারসিদের ভারতে আগমনের স্মৃতিতে তৈরি


    আশ্রয় চাওয়ার জন্য জোরস্ত্রিয়ানদের প্রতিনিধি হিসেবে তিন পুরোহিত সেখানকার রাজা বিজয়াদিত্য, জয়াদিত্য বা জাদি রানার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ, সুঠাম দেহের আগন্তুকদের দেখে রাজা তো প্রমাদ গুনলেন। মনে মনে ভাবলেন, এই বিদেশিদের কিছুতেই তাঁর রাজত্বে স্থান দেওয়া যাবে না। তিনি একটা কৌশল অবলম্বন করলেন। কানায় কানায় পূর্ণ একটি দুধের বাটি দেখিয়ে রাজা তাঁদের বললেন, তাঁর দেশের অবস্থা ওই দুধের বাটিরই মতো। বাইরে থেকে আসা আর কারওকে থাকতে দেওয়ার জায়গা নেই। তখন আগন্তুকদের মধ্যে প্রবীণতম পুরোহিত সেই দুধের মধ্যে কিছুটা চিনি ছড়িয়ে দিয়ে রাজাকে বললেন, দেখুন দুধের স্বাদ আরও মিষ্টি হল কিন্তু বাটি থেকে একটুও উপচাল না। কেউ কেউ আবার বলেন, দুধের মধ্যে ফেলা হয়েছিল গোলাপজল, কেউবা বলেন, আংটি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বাটি থেকে দুধ চলকে পড়েনি। পুরোহিত বলে চলেন, আশ্রয় পেলে পারসিরা নিজেদের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেও স্থানীয় সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করবেন। মুগ্ধ হলেন রাজা। আশ্রয় পেল আগন্তুকের দল। ঠিক এই জায়গা থেকেই পারসিদের গল্পের শুরু। দক্ষিণ ইরানের পার্স বা পারস্য থেকে আসা এই মানুষদের ভারতের মাটিতে আশ্রয়লাভের কাহিনিতে তাই খাদ্যের উপমা হয়ে উঠল এক গুরুত্বপূর্ণ রূপক আর এই ‘দুধ-চিনির আখ্যান’ পরিণত হল এক স্মরণীয় কিংবদন্তিতে।

    যে পারসিরা এত খাদ্যরসিক তাদের খাবারদাবার কেমন? ‘পত্রানি মচ্ছি’, ‘আকুরি’ বা ‘মটন ধানশাকে’র মতো বহুশ্রুত খাবার কি ইচ্ছে হলেই চারপাশের কোনো রেস্তোঁরায় গিয়ে চেখে দেখার সুযোগ রয়েছে? এ সবের সেরা ঠিকানা কোন্‌টা? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেবার আগে স্মরণ করিয়ে দিই পারসিদের রান্নাবান্না একান্তভাবেই পরিবার-কেন্দ্রিক। পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠান, আমাদের উপনয়নের মতো ওদের নভজোত, পারসি নববর্ষ নওরোজ, বিবাহের অনুষ্ঠান লগান, গৃহপ্রবেশ কি নতুন কেনা গাড়ির উদ্‌বোধন, কারখানায় নতুন যন্ত্রপাতির শুভ মহরত অথবা বিবাহবার্ষিকী কি অসুখ থেকে সেরে ওঠার পর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা পরীক্ষায় সাফল্য উদ্‌যাপনের সঙ্গে জড়িত জাশান, ঘাম্বার বা ফারেস্তার প্রথা পালনের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে পারসি খাবারের বৈচিত্র্য।

    এখানে ‘বৈচিত্র্য’ শব্দটা খুব জরুরি। কোনো সংস্কৃতি থেকে পছন্দমতো জিনিসটুকু সানন্দে আহরণ করার বৈশিষ্ট্যেও পারসিরা অনন্য। তার অভিনব সাক্ষ্য বহন করে চলেছে পারসি খানার ঐতিহ্যপূর্ণ ধারা। হিন্দুদের থেকে তাঁরা রান্নায় নিয়ে এলেন সুগন্ধি মশলাপাতি ও গুজরাত উপকূল থেকে সামুদ্রিক মাছের ব্যবহার। একাদশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে বিজয়ী মুসলমানদের থেকে শিখলেন মাংসের নানান পদ, ষোড়শ শতকের পোর্তুগিজ ঔপনিবেশিকরা পরিচয় করালেন আলু, লঙ্কা, আর টোম্যাটোর সঙ্গে। সপ্তদশ শতকে আসা ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশা করে পাশ্চাত্যশিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠা পারসিরা শিখে গেলেন নানারকম কাস্টার্ড, পুডিং, জেলি ও সুফলে বানাতে।

    এইভাবে নানা ঐতিহ্য থেকে সেরা স্বাদ আহরণ করে গড়ে উঠল ভারতে পারসি খানার বিপুল অধ্যায়। এক এক খানার এক এক গল্প—

    সাসনি মাচ্ছি: হোয়াইট স্যসে জারিত মাছ রান্নার পদ্ধতি—ডিমের ফেটানো সাদা অংশ, চিনি আর ‘সারকো’র প্রলেপে টাটকা কাঁচালঙ্কা ও গোটা জিরের ফোড়নে তৈরি।

    সারকো: নভসারিতে এই ভিনিগার তৈরি হয় কাঠের পিপেতে রাখা আখের রসের পাতন প্রক্রিয়ায়। সেই ১৮৮৫ সালে ইদালজি কোলা প্রথম এভাবে বানানো ভিনিগার বিক্রি শুরু করেন। আজ ১৩৫ বছর ধরে সেই দোকান ই এফ কোলা ভিনিগার, মোরব্বা, আচার, মশলা বিক্রি করে বিখ্যাত।

    ডিমের নানা খানা: পারসিরা এককথায় ‘ডিমপাগল’। একটা কেন তাঁরা রোজ অন্তত তিনটে করে বা তারও বেশি ডিম খান নির্দ্বিধায়। পারসি রান্নায় ‘পর ইডা’ (ওপরে ডিম) কথাটা যেন লব্‌জ হয়ে গেছে। যাঁরা মনে করেন রোজ সকালে ডিম সেদ্ধ একটা বোরিং ব্যাপার বা ডিম মানেই কেবল সেই পোচ আর মামলেট তাঁরা শুধু একবার পারসিদের হাতে ডিমের কামাল দেখুন! লেবুর রসে মাখা মশলাদার কুচো চিংড়ির ওপরে ডিম ভেঙে ভাপিয়ে নিলেই হয়ে গেল ‘কুটা পর ইডা’।





    (উপর থেকে) পপেতা পর ইডু, মুর্গি না ফারচা, প্রন পুলাও


    বাচ্চারা এই গরমে তেতো খেতে বায়না করছে? করলা ভাজার ওপর কুসুম না ভেঙে ডিম ফেলে দিলেই তৈরি চটজলদি ‘চোরপাট পর ইডু’। আলুভাজার মাথায় ডিমের টোপর দেওয়া ‘পপেতা পর ইডু’ তো পারসিদের ঘরে ঘরে তুমুল জনপ্রিয়। আর ‘আকুরি’কে তো একডাকে সবাই চেনে। এর মধ্যে আবার ভারুচ শহরের শুকনো ফলের কুচি দেওয়া ‘ভারুচি আকুরি’র বিশেষ নামডাক। ওসব কোলেস্টেরলের ভয়ডর পারসিদের একেবারেই নেই। ক্যালোরির রক্তচক্ষুতেও মোটেই হেলদোল নেই। এর আসল প্রণালীতে চারজনের জন্য ডিমের ভুর্জিতে ৬০০ গ্রাম খাঁটি ঘি ঢালাই দস্তুর। এতে যদি চোখ কপালে ওঠে তাহলে ‘ইডা পাক’ বা ডিমের মিষ্টি হালুয়ার কথা না শোনাই ভালো কারণ ওতে ডিমের কুসুম গোনা-গুনতি করে দেওয়া হয় না।

    পারসিক পরম্পরার খানা: প্রাচীন পারস্যের শিকড়কে যে পারসিরা ভোলেননি তা বোঝা যায় তাঁদের ‘বেরি পুলাও’, ‘বাদাম নু গোস্ত’ বা আরও নানা সুস্বাদু পদে ফল, কিশমিশ ও বাদামের দরাজ ব্যবহারে। ‘সাল্লি জর্দালু মুর্গ’ তো শুকনো ফল দিয়ে রান্না করা এক বিশেষ পদ।

    পত্রানি মচ্ছি: পারসিরা প্রথমে নিরামিষাশী রাজ্য গুজরাতে এলেও মাছ খেতে শিখেছেন ওই সামুদ্রিক উপকূলে এসেই। পমফ্রেট মাছে নারকেল কোরা, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, কাঁচালঙ্কা বাটা মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাপিয়ে বা তাওয়ায় সেঁকে নিয়ে যে অসাধারণ ‘পত্রানি মচ্ছি’র সৃষ্টি তার সঙ্গে বাঙালি রান্না ভেটকি মাছের পাতুরির মিল থাকলেও আদতে তা স্বাদে, বর্ণে, গন্ধে একেবারে আলাদা। পারসিদের সিগনেচার ডিশ হলেও ‘পত্রানি মচ্ছি’তে গোয়ার প্রভাব স্পষ্ট। একসময় পারসিদের বাড়িতে গোয়ার আয়া ও রাঁধুনি রাখার চল ছিল। তাদের কাছ থেকেই এই বিশেষ রান্নাটি পারসিরা রপ্ত করেছেন।

    আর, ধানশাক খাওয়ার তরিকা শেখালেও, সুপ্রিয়া মনচারজির তুরুপের তাসটি এই ‘পত্রানি মচ্ছি’-ই। সে খানা খেতে হাজির হলাম আর-একদিন। অমৃতসমান। এমনিতে ওঁরা পত্রানি মচ্ছিতে ভেটকি মাছের টুকরো দেন। কিন্তু এ জিনিসের আসল স্বাদ পমফ্রেট ছাড়া খোলে না। কলকাতার বাজারে এখন প্রমাণ সাইজের পমফ্রেট মোটেই সস্তা নয়। তাই রেস্তোরাঁর বোর্ডে পমফ্রেটের উল্লেখ নেই। কেউ বিশেষ অর্ডার দিলে আলাদা ব্যবস্থা। পত্রানি মচ্ছি খাবার শখ যখন হয়েছে তখন দামের কথা ভেবে কী লাভ? কাজেই নিজের পছন্দের কথা আগে ভাগে জানিয়ে রেখেছিলাম। টেবিলে বসার পর বিশেষ পদটির জন্য উৎসুক হয়ে আমরা দুই বন্ধু অপেক্ষা করছি। এমন সময় দুটো বড়ো ডিশ এনে হাজির করা হল আমাদের সামনে। তাতে ডিশের এ মাথা থেকে ও মাথা অবধি প্রসারিত সুতোয় বাঁধা কলাপাতায় মোড়া বেশ পুরু একটা বস্তু।



    পত্রানি মচ্ছি


    সুতো কেটে মোড়ক খুলতেই চমক। সাধারণত যে সাইজের পমফ্রেট বিদেশে রপ্তানি করা হয়ে থাকে ঠিক তেমনই বড়ো আস্ত একটা মাছ। রোজের বাজারে সচরাচর এমন বড়ো আকারের পমফ্রেট আজকাল দেখাই যায় না। রেস্তোরাঁয় খেতে এসে যে সত্যিই এত বড়ো পমফ্রেট জুটবে এটা রীতিমতো অভাবনীয় ছিল। মাথা থেকে লেজা পুরো মাছ একেবারে সবুজ প্রলেপে ঢাকা। পুরু পিঠের দিক থেকে আঙুলের আলতো চাপে বেশ খানিকটা মাছ তুলে মুখে দিতেই আহা! কী স্বাদ! একদম তাজা মাছ, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সেই তাজা মাছের সঙ্গে মিলেছে নারকেল, পুদিনা, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা আর লেবুর রসের স্বাদের আশ্চর্য এক ভারসাম্য। ওই প্রলেপ দেওয়া মাছ স্রেফ ভাপিয়ে নিয়ে সামান্য তেলে তাওয়ায় সেঁকে নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে এই উপাদেয় বস্তু।



    আমরা বাঙালিরা কলাপাতায় মোড়া সর্ষে-নারকেলে জারিত যে ভেটকি মাছের পাতুরি গরম ভাতের সঙ্গে মেখে খেতে পরমানন্দ লাভ করি, এই পত্রানি মচ্ছির স্বাদ তা থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র। এতে সেই ঝাঁঝ নেই। আঁশ-ছাড়া সাদা মাছে সেই ঝাঁঝ প্রত্যাশিতও নয়। বরং হালকা পুদিনা-গন্ধী, লেবুর রসের চনমনে রসায়নে পত্রানি মচ্ছি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কাজেই ভেটকি মাছ দিয়ে তৈরি পদের দাম ১৫০ টাকা হলেও প্রায় সাড়ে চারশো গ্রাম সাইজের আস্ত পমফ্রেটের অভিনব পদটি চাখতে হলে ৫০০ টাকা দিতেও কার্পণ্য করার যুক্তি নেই। সুপ্রিয়া অবশ্য জানালেন, সবসময় এই একই সাইজের পমফ্রেট নাও মিলতে পারে। তখন সাইজ অনুযায়ী দামও কম-বেশি হতে পারে।

    তবে এসব খানার রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যেই একটা প্রশ্ন জিভে ওই পত্রানি মচ্ছির স্বাদের মতোই আটকে ছিল। শেষে বলেই ফেললাম—মনচারজি হয়ে এমন খাঁটি বাংলা কী করে শিখলেন বলুন তো?

    উত্তরে জানলাম, আদতে পূর্ববঙ্গের বদ্যি পরিবারের কন্যা সুপ্রিয়া সেনগুপ্তের সঙ্গে ১৯৯৭ সালে বিয়ে হল পারসি যুবক মাঞ্চি মনচারজির। সুপ্রিয়ার শ্বশুরবাড়ির ছিল কলকাতায় গুজরাতি ছাপাখানার ব্যাবসা।

    এইখানে বলা দরকার, আজ যদিও কলকাতায় পারসিদের সংখ্যা এসে ঠেকেছে নামমাত্র শ-চারেকে, একসময় এই শহরেও তাঁদের যথেষ্ট বোলবোলাও ছিল। ১৭৬৭ সাল নাগাদ কলকাতায় প্রথম যে পারসি আসেন তাঁর নাম দাদাভাই বেহরামজি বানাজি। সুরাতের আর্মেনিয়ান দালালদের সঙ্গে পারসিদের ব্যাবসায়িক লেনদেন ছিল। এই আর্মেনিয়ানরা প্রথমে মুরশিদাবাদ এবং তারপরে কলকাতায় আসেন। তাঁদের সঙ্গে সম্ভবত কিছু পারসিও ছিলেন। তাই কলকাতায় আর্মেনিয়ান মহল্লা ঘিরেই প্রাথমিক ভাবে কিছু পারসি পরিবারের বসবাস শুরু হয়। ১৭৯৯ সালে কলকাতায় এসেছিলেন স্যার জামশেদজি জিজিভয়। এক আত্মীয়ের ব্যাবসায় মাসিক দু-টাকা বেতনে কাজ শুরু করে পরবর্তী কালে চিনের সঙ্গে আফিমের লেনদেনে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হন। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে তাঁর এক উত্তরসূরীর ত্রাণ সাহায্য নজর কেড়েছিল ব্রিটিশ পত্রিকার। তারা লিখল, ‘প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী জিজিভয় বাংলার দুর্ভিক্ষ তহবিলে যে পরিমাণ অর্থ দান করেছেন তাতে তাঁর চেয়েও বড়োলোক বাঙালিবাবুদের অনেকেরই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেছে।’ ১৮১৭ সালে কলকাতার বাসিন্দা হওয়ার আগেই রুস্তমজি কাওয়াসজি বানাজিও দু-বার চিন অভিযানে গিয়েছিলেন। চিনের সঙ্গে ব্যাবসার সুবিধের জন্য ১৮৩৭ সালে খিদিরপুর ও সালেকিন ডকইয়ার্ড তিনি কিনেছিলেন ছয় লক্ষ টাকায়। কলকাতায় ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রথম অংশীদারি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘রুস্তমজি টার্নার অ্যান্ড কোম্পানি অব ক্যালকাটা’ গড়ে তুলেছিলেন ‘রুস্তমজি বাবু’ বলে জনপ্রিয় এই পারসি ভদ্রলোক যিনি আবার ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

    কিন্তু পারসি সমাজের বাইরের মানুষ কি কলকাতায় ওঁদের খাবারের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন? তেমন কোনো বিখ্যাত পারসি রেস্তোঁরা কি এই শহরে ছিল? কে জানে! ভোজনরসিকের পীঠস্থান কলকাতায় যখন দেশি-বিদেশি খাবারের অজস্র রেস্তোঁরা আর এই করোনা-কাল বাদ দিয়ে সবসময়েই যখন সেসব জায়গায় আগ্রহী মানুষের ভিড় বা বিভিন্ন ফুড-ডেলিভারি অ্যাপের মাধ্যমে মোগলাই, চাইনিজ, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় কিংবা তিব্বতি খাবার আনাবার তাগিদ, পারসি খাবার নিয়ে তখন কলকাতার তেমন আগ্রহ কই? এই শহরের সঙ্গে পারসিদের প্রায় আড়াইশো বছরের সংযোগ থাকলেও পারসি সংস্কৃতি সম্পর্কে আজ আমাদের চর্চা আশ্চর্যজনক ভাবে কম।

    উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, আজ পারসি খাবার কলকাতার মাত্র দুটি জায়গায় পাওয়া যায়। একটি হল বো স্ট্রিটে মানাকজি রুস্তমজি পারসি ধরমশালা যেখানে আবাসিকদের রান্না-খাওয়ার দিকটি দেখভাল করেন ২০১৩ সালের মাঝামাঝি আমেদাবাদ থেকে কলকাতায় আসা দারা আর মেহের হানসোটিয়া। তবে একসঙ্গে কয়েকজনের খাবার আগে অর্ডার দিলে বাইরে থেকেও অতিথিরা এসে খেতে পারেন। আর দ্বিতীয় রেস্তোঁরাটি হল ‘মনচারজি’জ’।

    ফারসি পণ্ডিতের নামাঙ্কিত ড. মহম্মদ ইশাক রোডে (যা এখনও বহুলপরিচিত কিড স্ট্রিট নামে) বাহুল্য-বর্জিত ‘মনচারজি’জ’-এ বসে পারসি খাবারের স্বাদ গ্রহণ করার বাড়তি প্রাপ্তি হল কলকাতার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে ফিরে দেখা। বাঙালি ও পারসি পরিবারের সমন্বয়ের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে এই রেস্তোঁরার সূচনাও যথেষ্ট আকর্ষণীয়।

    সুপ্রিয়ার সঙ্গে গল্প করতে করতে শুনলাম তাঁর এই রেস্তোরাঁ চালুর কাহিনিও। শ্বশুর হোমি একসময় জাহাজে ছিলেন আর শাশুড়ি হিলা পাশাপাশি ছিলেন বিউটিশিয়ান। একইসঙ্গে তাঁরা চালু করলেন পারসি পরিবারের উৎসবে অনুষ্ঠানে কেটারিংয়ের ব্যাবসা। আর করতেন হোম ডেলিভারি। কলকাতার লেনিন সরণিতে খোরশেদ ম্যানসন, ধর্মতলার অপেরা সিনেমা, বিখ্যাত সাকি বার সহ শহরের বেশ কিছু এলাকায় তখন পারসিদের আধিপত্য। সুপ্রিয়ার শাশুড়ি হিলার তুতো বোন ছিলেন সেসময়কার বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী মধুমতী যাঁর আসল নাম ছিল হুতোকসি রিপোর্টার। ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে ‘তালাশ’ থেকে ‘চরস’ পর্যন্ত রুপোলি পর্দায় দাপিয়ে বেড়ানোর সুবাদে বলিউড জগতের সঙ্গে পরিবারটির ঘনিষ্ঠতা ছিল। মধুমতীর সূত্রেই কলকাতায় এলে সুনীল দত্ত ও নার্গিস সুপ্রিয়ার শ্বশুরবাড়িতে আসতেন। একবার জন্মদিনে হিলার হাতের তৈরি ‘প্রন কাটলেট’ খেয়ে সুনীল দারুণ তারিফ করেছিলেন।





    (উপর থেকে) চিকেন কাটলেট, প্রন কাটলেট, চিকেন সাল্লি


    সেই শাশুড়ি হিলাই সুপ্রিয়াকে সযত্নে পারসি রান্নার খুঁটিনাটি শিখিয়েছেন। সেঁকা পাউরুটি দিয়ে ‘ডিমের আকুরি’, ‘মুর্গিনা ফারচা’, বড়ো সাইজের আস্ত পমফ্রেটে বানানো ‘পত্রানি মচ্ছি’, ‘মাটন ধানশাক’ আর ‘কচুম্বর’ খেতে খেতে সুপ্রিয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পরিবেশনে কোনো ঘটা নেই— ছোটোখাটো ইটারিতে যেমন হয়। কিন্তু কলকাতায় বসেই যে এমন উপাদেয় এবং একেবারে ‘আসলি’ পারসি খাবার মেলে তা ওখানে না খেলে অজানাই থেকে যেত। সুপ্রিয়া বলছিলেন, প্রতিটি পদে মশলার সঠিক পরিমাণ যোগ করে কী করে দরদ ও নিষ্ঠার সঙ্গে রান্না করতে হয় তা তাঁর শাশুড়ির কাছেই শেখা। সৌভাগ্যের ব্যাপার সেই বিখ্যাত ‘প্রন কাটলেট’ আর দুর্দান্ত চিকেন কাটলেটও সেখানে আমাদের খাবার সুযোগ হয়েছে।

    গত বছরে সুপ্রিয়া তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন। শ্বশুর-শাশুড়িও প্রয়াত হয়েছেন অনেকদিন আগে। একমাত্র কন্যা ক্রিষ্টিয়া উচ্চশিক্ষার জন্য বেঙ্গালুরুতে। এখন এই প্রতিকূলতার মধ্যেও কীভাবে একা হাতে ব্যাবসা সামলাচ্ছেন এই বঙ্গললনা, সেটাই এক কাহিনি হতে পারে। পারসি সমাজে সুপ্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা এমনই যে তাদের বড়ো কোনো অনুষ্ঠানে তাঁরই ডাক পড়ে। বছর দশেক আগে চালু এই রেস্তোঁরার পাশাপাশি সুপ্রিয়া নিয়মিত অন্তত দশ-পনেরোটি পারসি পরিবারে হোম ডেলিভারি করতেন। তার মধ্যে অন্যতম বউবাজারের অক্রূর দত্ত লেনে সংগীতকার ভি বালসারার বাড়ি এবং স্টুডিও। জনসচেতনতার অভাবে এখন রোজকার ভিত্তিতে পারসি খাবারের চাহিদা কম থাকায় সুপ্রিয়াকে রেস্তোঁরায় বাঙালি খাবারের ব্যবস্থাও রাখতে হয়েছে। তবে ‘চিকেন ফারচা’, ‘আকুরি’, ‘চিকেন ধানশাক’, ‘সাল্লি মুর্গ’, ‘চিকেন কাটলেট’ আর ‘লগান্যু কাস্টার্ড’ রোজের মেনুতেই রয়েছে। আর ‘মাটন ধানশাক’, ‘মাটন কিমা প্যাটিস’, ‘পপেতা পর ইডু’, ‘পত্রানি মচ্ছি’ বা ‘পারসি চিকেন কারি’ খেতে চাইলে আগে অর্ডার দিতে হবে।

    বছর কয়েক আগে কয়েকটি বিদেশি কনস্যুলেটের কর্মীদেরও পারসি খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সুপ্রিয়া। পারসি রান্নার আসল স্বাদ ও মান বজায় রাখতে তাঁর সব মশলা আনাতে হয় মুম্বই বা পুনে থেকে। ‘ধানশাক’, ‘সাল্লি বোটি’ বা ‘মচ্ছি’র ঠিকঠাক মশলা কলকাতায় একেবারেই অমিল। শহরের খাদ্যপ্রেমীরা চাইলে তাঁদের ‘বেরি পুলাও’য়ের মতো বিখ্যাত পারসি পদও রেঁধে খাওয়াতে চান সুপ্রিয়া। পারসি খাবারের সমঝদার না জুটলে অচিরেই সেইসব ঐতিহ্যপূর্ণ পদের ঠাঁই হবে কেবল ইতিহাসের পাতায়। সাধে কি আর কানাডা-প্রবাসী পারসি লেখক রোহিন্টন মিস্ত্রির উপন্যাস, ‘ফ্যামিলি ম্যাটার্স’-এর একটি চরিত্র ‘ধানশাক’, ‘পত্রানি মচ্ছি’, ‘মুর্গিনা ফারচা’ ও ‘লগান্যু কাস্টার্ডে’র রেসিপি ‘টাইম ক্যাপসুলে’ পুরে সংরক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছে!

    সুপ্রিয়া মনচারজি 'গুরুচন্ডা৯'র পাঠকদের জন্যে পার্সিদের প্রিয় একটি পদের রেসিপি জানিয়েছেন। কলকাতার পার্সি পরিবারে তো বটেই, তাঁদের কাছে শুনে আরও অনেকেই এখন 'সুপ্রিয়া আন্টি'র হাতের রান্না 'চিকেন রস' খাওয়ার জন্যে আগেভাগে অর্ডার দিয়ে রাখেন। একদম ঝাল-মশলা বিহীন হালকা স্বাদের চিকেন বা 'মাটন রস' গুমোট গরমে তো বটেই, এমনকি বছরের যে কোন সময়েই খুব উপাদেয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে 'মনচারজি'তে গিয়ে এই পদ চেখে দেখতে পারেন আর ইচ্ছে হলে এখনই এই প্রায় ঘরবন্দি অবস্থায় চটপট নিজেও একবার রান্না করে দেখতে পারেন মাংসের এক নতুন পদ।

    চিকেন / মাটন রস

    মুরগি বা খাসির মাংস -- ১ কেজি
    এলাচ/দারুচিনি/লবঙ্গ -- আন্দাজ মতো সামান্য পরিমাণে
    শুকনো লঙ্কা -- ২ টি
    আলু -- ৩ টা (বড় ডুমো করে কাটা)
    পেঁয়াজ -- ৩ টি বড় লম্বা করে কুচনো
    আদা বাটা -- এক টেবিল চামচ
    রসুন বাটা -- দুই টেবিল চামচ
    হলুদ গুঁড়ো -- এক চা চামচ
    জিরে গুঁড়ো -- এক টেবিল চামচ
    লবন -- স্বাদ মতো
    সাদা তেল -- তিন টেবিল চামচ

    প্রণালী: প্রথমেই কড়া গরম করে এক টেবিল চামচ সাদা তেলে পেঁয়াজ বাদামি করে ভেজে তুলে রাখুন। এবার একটা ডেকচিতে বাকি দুই টেবিল চামচ সাদা তেল গরম করে চারটি ছোট এলাচ, এক খন্ড দারুচিনি, গোটা তিনেক লবঙ্গ ফেলুন। দুটো শুকনো লঙ্কা দিন। একটু নেড়ে নিয়ে মাংস, আলু, রসুন, আদা বাটা, হলুদ ও জিরে গুঁড়ো দিয়ে বেশ করে কষিয়ে নিন। স্বাদ মতো লবন দিন। তারপরে পেঁয়াজ ভাজা হাতে গুঁড়ো করে মাংসের ওপর ছড়িয়ে দিন। এই রান্না পাতলা হবে। কাজেই সেই অনুযায়ী পরিমান মতো জল দিয়ে একবার নেড়েচেড়ে ঢেকে দিন। টগবগ করে ফুটতে থাকলে আঁচ কমিয়ে দিন। কিছু পরে দেখুন মাংস সুসিদ্ধ হল কিনা। হয়ে গেলে ঢাকনা খুলে আরও দু-মিনিট টগবগ করে ফুটিয়ে ঢাকনা দিয়ে গ্যাস বন্ধ করে নামাবার আগে মিনিট পাঁচেক রেখে দিন। গরম ভাত বা ফুলকো রুটির সঙ্গে বাটিতে তুলে পরিবেশন করুন। স্রেফ চুমুক দিয়ে বা সেঁকা পাঁউরুটির সঙ্গেও এই 'রস' খেতে মজা।




    তথ্যসূত্র:

    1. পার্সি ফুড অ্যান্ড কাস্টমস / ভিকু জে মানেকশ / পেঙ্গুইন / ১৯৯৬
    2. পার্সি বোল ২ / সুনি তারাপোরওয়ালা ও মেহের মারফতিয়া / গুড বুকস / ২০১৬
    3. পাইওনিয়ারিং পার্সিস / প্রোচি এন মেহতা / নিয়োগী বুকস / ২০২০

    নিবন্ধ ও প্রতিবেদন:

    1. Sugar in the Milk: A Parsi Kitchen Story : NPR, March 20, 2008
    https://www.npr.org/2008/03/20/88505980/sugar-in-the-milk-a-parsi-kitchen-story
    2. A Bid to Maintain One of the World’s Oldest Culinary Traditions / The New York Times Style Magazine, May 8, 2009
    https://www.nytimes.com/2019/05/08/t-magazine/parsi-food.html
    3. The melting pot: The evolution of Parsi cuisine, Hindustan Times, August 12, 2016
    https://www.hindustantimes.com/more-lifestyle/the-melting-pot-the-evolution-of-parsi-cuisine/story-T7uFW6pKAJ36olwTGh8B3L.html
    4. The curious case of the vanishing Parsis, Hindustan Times, Brunch, August 12, 2015
    https://www.hindustantimes.com/brunch/the-curious-case-of-the-vanishing-parsis/story-60jjm3jRNXr0RZTqg57zzJ.html
    5. Parsi on My Plate: How Bawa Cuisine Is Adding Spice to the Indian Palate
    https://www.thebetterindia.com/59341/parsi-cuisine-india/
    6. The Parsi food pilgrims, livemint.com, June 20, 2015
    https://www.livemint.com/Leisure/FjntEjywwrkBfmEhtcMpyO/The-Parsi-food-pilgrims.html
    7. Parsi food is more than ‘dhansak’, June 17, 2017
    https://www.livemint.com/Search/Link/Author/Priyadarshini-Chatterjee
    8. Kolkata's Persian connection, Frontline, January 17, 2020
    https://frontline.thehindu.com/arts-and-culture/heritage/article30441795.ece
    9. The last bastons of Parsi food in Kolkata,
    https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/the-last-bastons-of-parsi-food-in-kolkata/articleshowprint/58867272.cms

    Blog: https://www.sodabottleopenerwala.in/food/

    website:
    1. https://cineplot.com/madhumati-memories/
    2. https://zoroastrians.net/category/food/
    3. https://migrationology.com/britannia-co-parsi-restaurant-mumbai/
    4. https://faroutmagazine.co.uk/freddie-mercury-chicken-dhansak-recipe/
    5. https://www.iranicaonline.org/articles/parsi-communities-ii-in-calcutta
    6. https://madantheatres.com/2015/08/09/indias-first-talkie-presentation-melody-of-love/
    7. http://parsiana.com

    8. https://www.nativeplanet.com/udvada/#overview
    9. https://www.cntraveller.in/story/visit-sleepy-town-udvada/




    গ্রাফিক্স: মনোনীতা কাঁড়ার
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • খ্যাঁটন | ২০ মে ২০২১ | ৪৭৪২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • আলোকে | 2401:4900:22e0:a397:60d0:7414:9557:***:*** | ২০ মে ২০২১ ১১:৫৩106199
  • Very nice রিডিং 

  • dc | 122.178.***.*** | ২০ মে ২০২১ ১২:৪৯106200
  • দারুন ভালো লাগলো পড়তে। পার্সি খাবার আমার খুব প্রিয়। বম্বে আর গোয়াতে কয়েকবার খেয়েছি, ব্যাঙ্গালোরেও খেয়েছি। সাল্লি বোটি আর বেরি পোলাও বোধায় ওদের সিগনেচার ডিশ (মটন, ল্যাম্ব আর চিকেন তিনটেরই সাল্লি বোটি হয়)। চিকেন ফারচাও অসাধারন খেতে হয়। তবে পত্রানি মচ্ছি অতোটা ভাল্লাগেনি, তার চেয়ে আমাদের পাতুরি ভালো।   

  • আহেম | 2a03:90c0:1b5::***:*** | ২০ মে ২০২১ ১৫:০৭106201
  • ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে তাঁর ত্রাণ সাহায্য নজর কেড়েছিল ব্রিটিশ পত্রিকার। তারা লিখল, ‘প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী জিজিভয় বাংলার দুর্ভিক্ষ তহবিলে যে পরিমাণ অর্থ দান করেছেন তাতে তাঁর চেয়েও বড়োলোক বাঙালিবাবুদের অনেকেরই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেছে।’ 


    ইয়ে, জিজিভয় ১৮৫৯ সালে মারা গেছেন।

  • নীলাঞ্জন হাজরা | 182.66.***.*** | ২০ মে ২০২১ ১৫:২৮106202
  • @ আহেম, Sir Jamshetji Jijibhoy, 6th Baronet. 1909 - 1968। সম্ভবত বলা হচ্ছে এনার কথা। নীলাঞ্জন হাজরা। 

  • Dipankar Dasgupta | ২০ মে ২০২১ ২০:০৮106206
  • @আহেম @নীলাঞ্জন দুজনকেই ধন্যবাদ।  জিজিভয়ের উত্তরসূরির দেওয়া অনুদানের প্রসঙ্গই হবে।  বাক্যে আমার প্রমাদ ঘটায় দুঃখিত।   

  • kk | 97.9.***.*** | ২০ মে ২০২১ ২০:৪২106208
  • বেশ লাগলো, বেশ লাগলো। সুন্দর লেখা। ডিমের আকুরি আগে বানাতাম। আমাদের পাই ও বানাতো। ধানসাকও করি, নানারকম ডাল দিয়ে।

  • Sohini Sengupta | 115.96.***.*** | ২২ মে ২০২১ ০০:৩১106262
  • দারুন সুস্বাদু লেখা | করোনার ভূত নামলেই যেতে হবে সুপ্রিয়াদেবীর হেঁসেলে | 

  • শ্যামলেন্দু বিশ্বাস | 115.187.***.*** | ২৩ মে ২০২১ ০৯:৫৪106338
  • পারসি হেঁশেলে নিরামিষ কি বহিরাগত ? কৌতূহল রহিয়া গেল।আরো একবার সমীর দাশগুপ্ত র "সুখাদ্যের সন্ধানে" বইয়ের তাক তছনছ করিতে অনুপ্রাণিত করিল।লেখক-কে সেলাম।প্রসঙ্গত সমীর দাশগুপ্ত ও বদ্যি।   

  • Dipankar Dasgupta | ২৯ মে ২০২১ ১৩:০৮106567
  • শ্যামলেন্দু বিশ্বাস। আপনাকে ​​​​​​​আন্তরিক ​​​​​​​ধন্যবাদ। ​​​​​​​আরে ​​​​​​​আপনি ​​​​​​​সমীর ​​​​​​​দাশগুপ্তের ​​​​​​​বইটির উল্লেখ করলেন বলে চমৎকৃত হলাম। সে বই যে আমার অতি প্রিয়। কতবার যে পড়ি! পারসিদের নিরামিষ রান্না কিছু আছে। তবে সেগুলি অধিকাংশ স্যালাড-ধর্মী। পেঁয়াজ নিরামিষ ধরলে 'কচুম্বর',  'ধাই মা ভিদা' অর্থাৎ দই-ঢ্যাঁড়শ বা 'ভেঙ্গানা নে ধাই নি বুড়িয়ানি' অর্থাৎ আমাদের দই-বেগুনের রকমফের আর কি! নিরামিষ সব্জি যাই হোক না কেন পারসিরা তাতে ডিম বা মাংস বা লইট্যা মাছ যোগ করতেই পছন্দ করেন।  তবে নব্য প্রজন্মের অনেক পারসি 'ভেগান' হতে চান আর সচেতন ভাবে মাছ-মাংস এড়িয়ে চলেন।  তখন বিয়েবাড়ি বা নভজ্যোত বা অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানে কদর বেড়েছে 'খাটটু মিঠু ইস্টু'-র।  মটরশুঁটি, বিনস, গোটা গোটা ছোট পেঁয়াজ, ফুলকপির টুকরো, ছোট আলু, ওল, ভিনিগার, টোম্যাটো, কাঁচালঙ্কা, রসুনের কোয়া, আদার কুচি, ধনেপাতা, ও সামান্য পুদিনা পাতা সহযোগে তৈরি এই 'ইস্টু' সবার দিলখুশ! আবার কোকুম আর আধপাকা পেয়ারা বা সজনে ডাঁটা দিয়েও ওদের হরেক পদ আছে।            

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন