মধুরেণ বললে পরক্ষণেই মনে আসে সমাপয়েৎ শব্দটি। আসলে শেষ নয়, জীবনের শুরু থেকেই মধুর সঙ্গে জীবনের যোগ। শিশুর জন্মের পরে ঠোঁটে মধু ছোঁয়াবার রীতি বহুল প্রচলিত। সেই সঙ্গে মায়ের অন্তরের শুভ প্রার্থনা থাকে, সন্তানের যেন মধুর বচন হয়। বাচ্চাদের মধু খাওয়ানো নিয়ে কৌতুককর একটি কাহিনী শুনিয়েছেন বাঙালির গৌরবময় অতীতের অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক মধু বসু। সাদা-কালো যুগে 'আলিবাবা' ও 'বীরেশ্বর বিবেকানন্দে'র মতো ছবি পরিচালনা করে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন। বিদেশে ক্যামেরার কাজ শিখতে গিয়ে আলফ্রেড হিচককের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন কিছুদিন। নিজের নাম মধু কিভাবে হল সে সম্পর্কে তিনি আত্মজীবনীতে লিখছেন -- "মধু নামটি যে কেন হল তারও একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। শুনেছি, আমি যখন কয়েক মাসের শিশু, তখন আমাকে একদিন মধু খাওয়াতে গিয়ে আমার গলায় মধু আটকে যায় -- আমার তখন প্রায় দম বন্ধ হবার অবস্থা। মা ব্যস্ত হয়ে ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। ডাক্তার এলো এবং তারপরে সব ঠিক হয়ে গেল। এই সময় আমাদের এক চাকর ছিল -- নাম পাহাড় (পরে প্রায় পুরাতন ভৃত্যের' পর্যায়ে পড়েছিল) সে আমার নাম দিল মধু। এর পর বাড়িতে সকলেই আমাকে মধু বলে ডাকতে শুরু করে এবং সেই নামটাই বহাল থেকে গেল।" তাঁর স্কুল-কলেজ বা বিলেত যাবার সময় পাসপোর্টে নাম ছিল সুকুমার। কিন্তু জার্মানিতে থাকার সময় সুকুমার ও মধু নিয়ে নাম বিভ্রাটে দেশে ফিরে তিনি সুকুমার নামটি বাতিল করে দেন। সুপরিচিত হয়ে ওঠেন মধু বসু নামেই।
মধুর প্রসঙ্গ উঠলে আমাদের স্মরণ করতে হবে শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরামকে। তিনি মধুপ্রিয়। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত দারুবিগ্রহের বুকের কাছে ধরা বাম হাতটিতে মধুর বাটি। হাতের ফাঁকে গোঁজা রয়েছে একটি হল। মাথার উপরে অনন্তনাগের প্রসারিত ফণার নিচে ডান হাতের মুঠিতে ধরা মুষল। তিনিই তো বলদেব কিংবা পুরীর মন্দিরে জগন্নাথদেবের পাশে বসা বলভদ্র। পুরাণের গল্পে আছে, দেবতা ও অসুরদের ক্ষীরসাগর মন্থনে উঠে এসেছিলেন সুরার ঘড়া হাতে দেবী বারুণী। তিনি জলপরী, সুরাসুন্দরী -- সুরার দেবী। বারুণী দেবীর নামানুসারেই স্বর্গীয় মদিরার নাম বারুণী। গোকুলের বনে গোপিনীদের সঙ্গে ক্রীড়াকৌতুকের সময় এই বারুণী পান করে তুরীয়ানন্দে মোহিত হয়েছিলেন বলরাম । শ্রীমদ্ভাগবতে রয়েছে --
"বরুণপ্রেষিতা দেবী বারুণী বৃক্ষকোটরাৎ।
পতন্তি তদ বনং সর্বং স্বগন্ধেনাধ্যবাসয়ৎ।।"
[ভাগবত পুরাণ, স্কন্দ ১০, অধ্যায় ৬৫, শ্লোক ১৯]
গাছের কোটর থেকে অনিঃশেষ ধারায় ঝরে পড়ছে বরুণ দেবের প্রেরিত স্বর্গীয় সুরা বারুণীর অমর্ত্য সুধা। আর সেই মধু সৌরভে আমোদিত সমগ্র অরণ্য। শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতির কূটচর্চা থেকে শতহস্ত দূরে থাকা তাঁর দাদা বলরাম মধু-সুরা পানে সুখী। সংস্কৃত সাহিত্যে মধু সহযোগে বারুণী পানীয় প্রস্তুত করার পদ্ধতির কথাও বলা রয়েছে। দুধ, দই, মালাই, মধু আর গোলাপ জল মিশিয়ে তৈরি বারুণী আজও বিশেষ ভাবে নিবেদন করার প্রচলন রয়েছে বলরাম জয়ন্তী বা হাল-ষষ্ঠীতে প্রচুর শস্য সম্পদের প্রার্থনায়। বলরাম কৃষক সম্প্রদায়ের প্রিয় দেবতা। আবার মধু থেকে সরাসরি গাঁজন প্রক্রিয়ায় বারুণী প্রস্তুত করার হদিসও রয়েছে সংস্কৃত সাহিত্যে। মধু থেকে জাত বলে বিষ্ণু, কৃষ্ণ এবং ইন্দ্রের পরিচিতি মাধব নামেও। সহস্রদল পদ্ম-কোরকের মধ্যে স্থির হয়ে থাকা নীল মধুপ হলেন বিষ্ণু। প্রভাতের সূর্যরশ্মির উষ্ণ স্পর্শে প্রস্ফুটিত পদ্ম থেকে মুক্ত হয়ে উড়ে যায় মধুলোভী মধুকর। একটি ইংরেজি কবিতায় তার সুন্দর বর্ণনা রয়েছে –
“When the sun rises, the lotus flower opens
And frees the bees from their prison.”
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইতিহাস, পুরাণ ও সাহিত্যে রয়েছে মৌমাছি ও মধুর অজস্র দৃষ্টান্ত। প্রাচীন মিশরের সূর্যদেবতা রা। মাটিতে ঝরে পড়া তাঁর অশ্রুবিন্দুই রূপান্তরিত মৌমাছিতে। গ্রিসের প্রাচীন অরণ্যদেবী আর্টেমিসের প্রতীকও মৌমাছি। খ্রিস্টীয় রূপকে মৌমাছিকে মনে করা হয় কুমারী মেরির দূত। ক্যাথলিক ধর্ম ভাবনায় যীশুর জন্মদাত্রী মাতা মেরির সঙ্গে মধু উৎপাদনকারী মৌমাছির একাত্মতার অনুভব রয়েছে। মৌমাছি ও মধু খ্রিস্টীয় সংস্কৃতিতে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। মৌমাছির কর্মনিষ্ঠা ও পবিত্রতা ক্যাথলিক যাজকদের আদর্শ। বাইবেলের জেনেসিসে রয়েছে --
"Their father Israel then told them: "if it must be so, then do this: Put some of the land's best products in your baggage and take them down to the man as gifts: some balm and honey...".
অমৃতলোক থেকে মর্ত্যের মানুষের জন্যে নিয়ে আসা হচ্ছে দুটি শ্রেষ্ঠ উপহার -- বেদনানাশক মলম এবং শক্তিবর্ধক মধু। বাইবেলের যুগে মৌমাছির প্রতীকী গুরুত্ব আধুনিক কালে কমলেও সেই অতীত মর্যাদার নিদর্শন আজও টিকে রয়েছে। তাই পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের রেশমের গাউনে শোভা পায় সোনালী ও রুপোলি মৌমাছির বুটিদার নকশা। ব্রিটেনের ঐতিহ্যগত লোককথা মৌমাছির গৌরবগাঁথায় সমৃদ্ধ। বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী হিসেবে মৌমাছির বিস্তর কদর সাফোকে। সেখানে মৌমাছিকে পরিবারের সদস্য হিসেবেই দেখা হয়। ইয়র্কশায়ারে মৌমাছি মারলে চরম শাস্তির রেওয়াজ। তবে এর শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত ম্যানচেস্টারে। বিগত দেড়শ বছর ধরে মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে এমন একটি শিল্পোন্নত শহরকে গড়ে তোলার ইতিহাস স্মরণে রাখতে নির্বাচন করা হয়েছে অভিনব এক প্রতীক। শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে তাই বিশ্বের প্রথম শিল্পোন্নত শহর ম্যানচেস্টারের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত শ্রমিক মৌমাছি। অসংখ্য কাপড়ের কল আর কারখানার সমন্বয়ে ঠিক যেন এক মৌচাকের মধুভাণ্ডের মতো সমৃদ্ধি এসেছিল এই শহরে। আজও সেখানে মৌমাছি-খচিত অলংকার বা স্যুভেনিরের জনপ্রিয়তা।
খ্রিস্টপূর্ব দুই-তিন হাজার বছর আগে রচিত ভারতের প্রাচীনতম ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বেদে মৌমাছি ও মধুর প্রচুর উল্লেখ আছে। শুধু ঋগ্বেদই মধুর উল্লেখ করা হয়েছে প্রায় ৩০০ টি ক্ষেত্রে। মধুর সঙ্গে এসে পড়ে তুলসীর প্রসঙ্গও। বিষ্ণু ও কৃষ্ণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে তুলসীর পবিত্রতা। সংস্কৃত কিংবদন্তি অনুযায়ী একদা তুলসী ছিল কৃষ্ণের প্রিয় সুন্দরী নারী। তুলসীর স্মৃতি অমর করে রাখতে সেই নারীকে তুলসী গাছে রূপান্তরিত করলেন কৃষ্ণ। কৃষ্ণের ইচ্ছানুযায়ী তাঁর কোন পুজোই তুলসী ছাড়া সম্পন্ন হবে না। হিন্দু বিশ্বাস মতে মধু দেবভোগ্য। কাজেই চাক ভেঙে মধু সংগ্রহের সময় হাতে একটি তুলসী পাতা রাখা বিধেয়। আর এভাবেই মধু সংগ্রহের কাজটির সঙ্গেও ধর্মীয় অনুষঙ্গ জড়িত। ঈশ্বর স্বয়ং যে মৌমাছিতে বাঁধা পড়েছেন। আবার মৌমাছির দেবী হলেন ভ্রামরী। দেবী দুর্গারই একটি রূপ। তিনি বধ করেছিলেন অরুণাসুরকে। লক্ষ্মী তন্ত্রে দেবী নিজেকে ভ্রামরী বলে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি বলছেন, অরুণ নামে এক রাক্ষস মুনি-ঋষি ও মানুষের অনেক ক্ষতি করবে। তখন তিনি মৌমাছির ঝাঁকে মৌমাছি রূপে আবির্ভূত হবেন এবং অরুণাসুরকে বধ করে জগতে আবার শান্তি ফিরিয়ে আনবেন। কথিত আছে হৃদচক্রের কেন্দ্রস্থলে ভ্রামরীর অবস্থান এবং মৌমাছির গুঞ্জন তাঁরই সৃষ্টি। মৃদু এই গুণগুণ ধ্বনির সঙ্গে যেন বেদের ছন্দোময় মন্ত্রোচ্চারণের সাদৃশ্য রয়েছে।
হিন্দুদের লোকাচারেও মধুর তাৎপর্য অসীম। জন্ম, বিবাহ থেকে মৃত্যু সবেতেই মধুর ব্যবহার। গলায় যাতে আটকে না যায় সেইজন্যে শিশুর জন্মের পর সোনার আংটি দিয়ে ঠোঁটে মধু ছোঁয়াবার রীতি আছে। শিশুর ছ-মাস বয়সে শক্ত খাবার দেওয়ার সূচনায় তার মুখে দিতে হবে দই, মধু আর ঘি। বিবাহের পর নববধূ বরণের সময় কনের ঠোঁটে ও কানেও মধু দেওয়ার প্রচলন আছে। নতুন সংসারে এসে বধূর মিষ্টি কথা যেন সকলের মন জয় করে নিতে পারে এবং কারও কটুবাক্য শুনলেও বধূটি যেন নিজস্ব হৃদয়ের মাধুর্যে সেই কথার তিক্ততা কাটিয়ে উঠতে পারে। সব অশুভ দূর করে সুখী দাম্পত্য জীবনের সূচনা হয় মধু দিয়েই। দক্ষিণ ভারতের কিছু জায়গায় ভাবি স্ত্রীর বাড়িতে প্রথম এলে পাত্রকে খাওয়ানো হয় দই ও মধু। আবার পারলৌকিক ক্রিয়াতেও মধু অপরিহার্য। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের চতুর্দশ সূক্তের ত্রয়োদশ মন্ত্রে রয়েছে --
"যমায় সোমং সুনুত যমায় জুহুতা হবিঃ।
যমং হ যজ্ঞ গচ্ছত্বগ্নিদূতো অরংকৃতঃ।।"
এই অন্ত্যেষ্টি মন্ত্রে পুরোহিতদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে, মৃত্যুর দেবতা যমরাজের কাছে যেন উৎসর্গ করা হয় মধুর মিষ্টতায়। যমরাজের জন্যে সোমরস ঢালো। যমের প্রতি অলংকৃত এই উৎসর্গের বার্তা অগ্নির মাধ্যমে পৌঁছে যাবে যমের কাছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বর্ণিত রীতি অনুযায়ী শবদেহের অস্থি সংগ্রহ করে একটি মৃৎপাত্রে দই ও মধুতে ডুবিয়ে তা ঝুলিয়ে রাখতে হবে বৃক্ষশাখায়। আর একটি প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী জনৈক ব্রাহ্মণ তাঁর মায়ের দেহ দুধ, দই, ঘি, মধু ও চিনির মিশ্রণে ধুইয়ে দিয়েছিলেন। তবে এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত ও পবিত্রতম মন্ত্রটি রয়েছে ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলে।
"ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্নঃ সন্তোষধীঃ।
মধু নক্তম উতোষসো মধুমৎ পার্থিবং রজঃ।
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাং অস্তু সূর্যঃ। ওঁ।"
এই মন্ত্রের অপূর্ব অনুবাদ আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের রচনায় -- "বায়ু মধু বহন করিতেছে। নদী সিন্ধু সকল মধুক্ষরণ করিতেছে। ওষধি বনস্পতি সকল মধুময় হউক। রাত্রি মধু হউক, ঊষা মধু হউক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হউক। সূর্য মধুমান হউক।" বিশ্বজনীন কল্যাণ কামনায় ভারতীয় ঋষিদের এই প্রার্থনা গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধি থেকে উৎসারিত। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় মধুর ব্যবহারের কথা আমরা পাই গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসিতেও। ইলিয়াডে অ্যাকিলিসকে দেখা যায় বন্ধু পেট্রোক্লাসের শবাধারে বয়াম থেকে মধু ঢালতে (ইলিয়াড, ২৩, ১৭০)। একই ভাবে ওডিসিতে অ্যাগামেমননের বিবরণে দেখা যায় অ্যাকিলিসকে দাহ করার আগে তার শরীরে দেওয়া হয়েছিল মলম ও মধুর মোটা প্রলেপ (ওডিসি, ২৪, ৮৮)।
মধু থেকে তৈরি মদিরাই সভ্যতার উদ্দেশে মানুষের প্রথম পদক্ষেপ। গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর 'সিম্পোসিয়ামে' রয়েছে, অ্যাফ্রোদিতির জন্মদিনে জিউসের উদ্যানে পোরাসকে কিভাবে পেনিয়া অতিরিক্ত মধু পান করিয়ে মাতাল করে দিয়েছিল তার বর্ণনা। এই কাহিনী সুরা আবিষ্কারের আগে। সংস্কৃত মধু শব্দের সঙ্গে গ্রিক 'মেথু' ও আংলো-স্যাক্সন 'মেডু' বা 'মিড' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত মিল রয়েছে। মধু গাঁজিয়ে তৈরি হয় যে পরম রমণীয় মদিরা সেটি হল 'মিড'। আধুনিক যুগেও মিড একটি জনপ্রিয় পানীয়। আসলে মিড হল বিশ্বের প্রাচীনতম অ্যালকোহোল জাতীয় পানীয়। মধু থেকে উৎপন্ন এই পানীয়ের প্রথম আবিষ্কার চিনের উত্তরাঞ্চলে খ্রিস্ট জন্মের সাড়ে ছ-হাজার বছর আগে। অর্থাৎ চাকা আবিষ্কারেরও আগে থেকে মিডের প্রচলন। আর খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০-১৮০০ সালে মিডের নিদর্শন মিলেছে উত্তর স্কটল্যান্ড সহ ইউরোপের নানা জায়গায় সিরামিক ও পটারিতে। গ্রিক পুরাণে মিডকে গণ্য করা হয় 'নেকটার অব দ্য গডস', 'অ্যামব্রোসিয়া' বা দৈবসুরা হিসেবে। ইংরেজ সাহিত্যিক চসারের ক্যান্টারবেরি টেলসের অন্যতম চরিত্র মিলার রবিন মিড পানীয়তে আসক্ত ছিলেন। আর এই মিডের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন ইংরেজি মহাকাব্য 'বেউলফে' বর্ণিত বিশ্বের একদা শ্রেষ্ঠতম ও বৃহত্তম মিড-হল হেওরটের রোমহর্ষক কাহিনী। ষষ্ঠ বা অষ্টম শতকে ডেনমার্কের পটভূমিতে যা রচিত। প্রবল সমৃদ্ধশালী রাজা রথগার সমাজের গণ্যমান্য অতিথি আপ্যায়নের জন্যে নির্মাণ করিয়েছিলেন হেওরট। পান-ভোজনের এক বিরাট সুদৃশ্য হলঘর। সেখানে সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে খানা-পিনার সঙ্গে উপস্থিত যোদ্ধারা নিজেদের সাহসিকতার রোমাঞ্চকর গল্প শোনান একটা করে। সেই অভিজাত জমায়েতে হাতে হাতে ঘুরতে থাকে মধু-মদিরা মিড। পানপাত্রে চুমুক দিতে দিতে সকলে রুদ্ধশ্বাস কাহিনী শোনেন আর বীর যোদ্ধাদের তারিফ করেন। কিন্তু সেই আনন্দ আর উল্লাসের পরিবেশে হঠাৎ একদিন নেমে এলো তীব্র আতঙ্কের ছায়া। কাছের জলাভূমি থেকে এসে হেওরটে হানা দিল বিকট দানব গ্রেন্ডেল। ভোজসভায় ঢুকে রাজা রথগারের বীর সেনা ও অভিজাত অতিথিদের একের পর এক ধরে আস্ত গিলে ফেলতে লাগল সে। দীর্ঘ বারো বছর ধরে চলল এই দানবের হানাদারি। দিনেমারদের এই দুর্দশার কথা শুনে অবশেষে এগিয়ে এলেন সুইডেনের গিটস প্রদেশের তরুণ রাজপুত্র অসম সাহসী বীর বেউলফ। নিজের কয়েকজন যোদ্ধাকে নিয়ে বেউলফ হাজির হেওরটের নৈশভোজে। ওদিকে হলঘরের বিরাট ভারি দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছে গ্রেন্ডেল আর প্রথমেই গিলে ফেলেছে এক যোদ্ধাকে। পরমুহূর্তেই মুখোমুখি বেউলফের। বেউলফ কিন্তু তরবারি বের না করে গ্রেন্ডেলের বিশাল হাতখানা প্রচণ্ড জোরে চেপে ধরেছেন। সেই চাপ এমনই মারাত্মক যে বিপদ বুঝে পালাতে গিয়ে গ্রেন্ডেলের কাঁধ থেকে ছিঁড়ে পড়ল তার হাত। আর সেই কাটা হাত নিয়ে বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়লেন বেউলফ। ডেনমার্কের রাজা রথগারের মধু-মদিরার পান-ভোজনের আসর হল বিপন্মুক্ত।
চিনির বাণিজ্য ব্যাপক ভাবে শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত মিষ্টির উপকরণ বলতে ছিল শুধুই মধু। চতুর্দশ শতক থেকে ইংল্যান্ডে এল (ale) এবং তারপরে বিয়ার ও ওয়াইন মিডের বাজার দখল করে। সপ্তদশ শতকে চিনির আমদানি আরও বেড়ে যাওয়ায় মৌমাছি পালন আর তেমন লাভজনক রইল না। কিন্তু আধুনিক কালে শরীর স্বাস্থ্যে চিনির ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে যখন ক্রমেই সচেতনতা বাড়ছে তখন মধুর প্রাকৃতিক গুণ ও তার মাহাত্ম্য নিয়ে নতুন করে চর্চা জরুরি।
মধুর টানেই মানুষের নজর আকৃষ্ট হয় মৌমাছির প্রতি। প্রাগৈতিহাসিক মেসোলিথিক যুগেও মধুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ এবং তার গুরুত্বের সন্ধান মিলেছে। স্পেনে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বেশ কিছু গুহাচিত্রে দেখা যাচ্ছে, লিকপিকে মই বেয়ে মানুষ ওপরে উঠছে চাক ভেঙে মধু পাড়তে। প্রস্তর যুগের এমন আরও নিদর্শন পাওয়া গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিন্তু মধুর প্রতি মানুষের কেন এই সুপ্রাচীন অদম্য আকর্ষণ? পুষ্টিকর উপাদান ছাড়াও নিজস্ব গুণে মধু নানা কারণে মানুষের কাছে ছিল একটা ম্যাজিকের মতো। আখ এবং আঙুর চাষের প্রচলনের আগে মধুর একমাত্র তুলনা ছিল খেজুর। কিন্তু খেজুর পচে বা নষ্ট হয়ে গেলেও মধু কখনও নষ্ট হয় না কারণ মধুতে রয়েছে পচন-নাশক গুণ। খাবার-দাবার, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং ধর্মীয় আচারে মধুর ব্যবহার বিভিন্ন সংস্কৃতিতে চলে আসছে সেই আদি কাল থেকেই। সুতরাং মৌমাছি পালনের প্রথা শুরু হবার অনেক আগে এতটুকু মধু সংগ্রহের জন্যেও মানুষের চেষ্টার অন্ত ছিল না। মধু অত্যন্ত মূল্যবান ছিল বলেই অরণ্য এবং গুহা-কন্দরে চাকভাঙা মধু আহরণে মানুষ ছিল তৎপর। মানুষ ও মৌমাছির সম্পর্ক বেড়ে চলায় গড়ে উঠল মৌ পালনের সংস্কৃতি। খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ অব্দে মিশরের একটি সূর্য মন্দিরে মৌমাছি পালনের প্রাচীনতম সাক্ষ্য মেলে। সেখানকার দেওয়ালচিত্রে দেখা গেছে মৌমাছি, মৌচাক, মধু সংগ্রহ এবং বহু মানুষ মিলে মধু প্যাকেজিংয়ের কর্মকাণ্ডের বিবরণ। তবে মধুমক্ষীশালার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মেলে তার বহু পরে নবম বা দশম শতকের মধ্যভাগে ইজরায়েলে। মৌচাকের শৈলী এবং তার অভ্যন্তরের জগৎ সম্পর্কেও গভীর কৌতূহল ছিল। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বা প্লিনির রচনায় রাজনীতির সঙ্গে মৌমাছির কর্মকুশলতার তুলনা রয়েছে। মহাকবি ভার্জিল রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক জটিলতার ব্যাখ্যা করতে গিয়েও মৌচাকের রূপকল্প ব্যবহার করেছেন। রোমান সাম্রাজ্যে অত্যন্ত লাভজনক ও লোভনীয় মধু উৎপাদন শিল্পের ওপরে বিরাট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল বলে মৌপালকের সুরক্ষায় ছিল বিশেষ আইন।
রোমান সাম্রাজ্যের রন্ধনশৈলী নিয়ে চতুর্থ শতকে একটি বই লিখেছিলেন এপিসিয়াস -- 'দে রে কুলিনারিয়া'। সেটিই ইউরোপের কার্যত প্রাচীনতম রান্নার বই। সেই বই আধুনিক কালে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে -- 'কুকারি অ্যান্ড ডাইনিং ইন ইম্পেরিয়াল রোম'। সেই বইয়ের মোট ৪৬৭ টি রেসিপির মধ্যে দেড়শোটিরও বেশি রেসিপিতে রয়েছে মধুর উল্লেখ। তবে শুধু রান্নাই নয়, চোখের অসুখ, দেহের ক্ষত, ঘা ইত্যাদি সরিয়ে তুলতেও মধুর ব্যবহারের কথা বলেছেন প্লিনি। প্রোপলিস বা মৌচাকের আঠা দিয়েও ক্ষত চিকিৎসার নিদান রয়েছে।
আমরা আবার ফিরি ভারতীয় পুরাণে। সেখানেও তো মধুর জয়জয়কার। গ্রিক দেবতা ইরসের মতোই আমাদের প্রেমের দেবতা কামদেব। তাঁর আখের তৈরি ধনুকের জ্যা মৌমাছিদের মালায় গাঁথা। এর নিহিতার্থ বোধ হয় এই যে দেবতার শরে বিদ্ধ হলেও তা অবশ্যই মধুর পীড়ন। আবার মধুতে উপচে পড়া রথ মধুবাহনে আসীন অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের হাতে ধরা চাবুক মধুকাশ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু মধু। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৫৭ সূক্তের দ্বিতীয় শ্লোকে আমরা পাই --
"যদ্যুঞ্জাথে বৃষণমশ্বিনা রথং ঘৃতেন নো মধুনা ক্ষত্রমুক্ষতম্।
অস্মাকং ব্রহ্ম পৃতনাসু জিন্বতং বয়ং ধনা শূরসাতা ভজেমহি।।"
অশ্বিনীগণ, আপনারা যখন উদার করুণা বর্ষণের জন্যে আপনাদের এই রথকে ব্যবহার করবেন, মধু-সিঞ্চনে আমাদের শক্তিকে সতেজ করবেন; তখন আমাদের সকলের জন্যে পর্যাপ্ত খাদ্য প্রদান করুন; আমরা যেন বীরদের দ্বন্দ্বের মাঝেও ধনার্জনে বঞ্চিত না হই।" এর ঠিক পরের শ্লোকেই অশ্বিনী ভ্রাতৃদ্বয়ের শ্বেত অশ্ব সংযুক্ত দ্রুতগামী রথকে মধুবাহন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে মধুর অফুরন্ত ভাণ্ডার এবং ধন-সম্পদ। জাগতিক সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত করতে তার আবাহন করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ইউরোপের বহু দেশে প্রচলিত বিশ্বাস, মধুসেবনে বাগ্মিতা শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং সংগীত প্রতিভার আরও বিকাশ ঘটে। বেদের বেশ কিছু অংশে মৌমাছির সঞ্চিত মধুর সঙ্গে পবিত্র সোমরসের কোন ফারাক করা হয়নি। সেখানে দুয়েরই সমমর্যাদা। শতপথ ব্রাহ্মণে মধুকে বিবেচনা করা হয়েছে বৃক্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্যাস হিসেবে। এমনই তার মাহাত্ম্য যে মধু সেবন বেদের সারবস্তু আয়ত্ত করার সঙ্গে তুলনীয়। কাজেই ছাত্রদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও শারীরিক সামর্থ বাড়াতে মধু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কোন মন্ত্রে আবার মধুর সঙ্গে সূর্যের তেজের তুলনা করা হয়েছে। বৈদিক রীতিতে মধুপর্কের উল্লেখ পাওয়া যায়। গার্হস্থ্য জীবনের উপদেশ সম্বলিত বেদের অংশ গৃহ্যসূত্রে এবং মনুসংহিতায় বলা আছে, গৃহস্থের প্রথমেই সম্মানীয় অতিথিকে মধুপর্কের বাটি দিয়ে আপ্যায়ন করতে হবে। সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণে মধু ও খাদ্যের প্রশস্তি।
চিনে সপ্তদশ শতকে মধুর প্রাচুর্যের কথা উল্লেখ রয়েছে। ১৬৫৭ সালে ব্রিটিশ ধর্মযাজক এবং
ভূ-পর্যটন বৃত্তান্তের বিখ্যাত সংকলক স্যামুয়েল পারচাস লিখেছেন --
“There is great abundance of honey in China, for they wonderfully delight in keeping bees there, there is also very much wax, you may lade ships, nay fleets therewith.”
অর্থাৎ মোম ও মধুতে শুধু একটি-দুটি জাহাজ নয়, পুরো নৌবহর বোঝাই করার কথা বলা হল। বুঝতে অসুবিধে নেই, চিনে মধু ছিল এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সামগ্রী। চৈনিক সাহিত্যে মৌমাছির প্রথম উল্লেখ মেলে Erh Ya শীর্ষক এক রচনায় খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে। কিন্তু মধুর প্রতি বাইরের বিশ্বের নজর পড়ে তারও বহু বহু শত বছর পরে। মৌমাছি নিয়ে বেশ মজার কাহিনী আছে চিনা লোককথায়। কথিত আছে, কুনলুন পাহাড়ের ওপরে এমন অতিকায় মৌমাছি আছে যা দশ ফিট দীর্ঘ এবং যে মৌমাছি হুল ফোটালে হাতিও নিমেষে মরে যায়! এমন মৌচাক বাড়ির আশপাশে থাকলে নিশ্চয়ই বিভীষিকা! মধুর প্রশস্তি পাওয়া যায় চিনের তৃতীয় শতকের কবি কুও পো-র কবিতায়। ১৭২৭ সালের চাইনিজ এনস্লাইকোপিডিয়ায় মৌমাছি সম্পর্কে আলাদা একটি বিভাগ আছে। এছাড়া আরও তিরিশ পাতা জুড়ে রয়েছে মধুর নানা বিবরণ। মৌমাছি নিয়ে চিনে বেশ কিছু জনপ্রিয় প্রবাদও আছে যেগুলির মধ্যে রয়েছে গভীর দার্শনিক ভাবনা। যেমন "মৌমাছি বানায় মধু, আর সেই মধু পান করে মানুষেরা" অথবা "চাক ভাঙলে মধু ভোগ করে অন্যেরাই"। সপ্তম ও অষ্টম শতকে কিন্তু চিনে মধুর সঙ্গে মেশানো হত আফিম। ১৯১১ সালে সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লেখা হয়েছিল, আফিমের বিরুদ্ধে অভিযানে চিনের ইউনান প্রদেশে পোস্ত চাষে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় মধু উৎপাদনও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ পোস্তর বিকল্প হিসেবে গম বা মটরশুঁটি চাষে মৌমাছিদের মধু সংগ্রহে বিরাট ক্ষতি হয়। পোস্ত ফুলের প্রতি মৌমাছিদের আকর্ষণ অনেক বেশি।
পোস্ত ফুলের অভাবে মৌমাছির মধু সঞ্চয়ে বাধার সমস্যার বিষয়টি দেখি অন্য ভাবে প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখায়। তিনি লিখছেন, "কালে কালে ফুলের ফসল বদল হয়ে থাকে, তখন মৌমাছির মধু-যোগান নতুন পথ নেয়। ফুল চোখে দেখবার পূর্বেই মৌমাছি ফুলগন্ধের সূক্ষ্ম নির্দেশ পায়, সেটা পায় চারদিকের হাওয়ায়। যারা ভোগ করে এই মধু তারা এই বিশিষ্টতা টের পায় স্বাদে। কোনো কোনো বনের মধু বিগলিত তার মাধুর্যে, তার রঙ হয় রাঙা; কোনো পাহাড়ি মধু দেখি ঘন, আর তাতে রঙের আবেদন নেই, সে শুভ্র; আবার কোনো আরণ্য সঞ্চয়ে একটু তিক্ত স্বাদেরও আভাস থাকে" (নবজাতক, সূচনা)। নানা অঞ্চলে, নানা আবহাওয়ায় নানা ফুলের নানা মধু। স্বাদে, বর্ণে ও সৌরভে সেই মধু স্বতন্ত্র। তবে আশঙ্কার কথা বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে মধুও বহু ক্ষেত্রে তার বিশিষ্টতা ও নিজস্ব প্রাকৃতিক গুণ হারাচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শস্যক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ, উইপোকার আক্রমণ, পরাগমিলনে বাধা এবং মৌচাক থেকে শ্রমিক মৌমাছির আচমকা অন্তর্ধান। মৌচাক বিপর্যয়ের সমস্যা ডেকে আনে 'কলোনি কোল্যাপস সিনড্রোম'। হয়ত এর দরুন দেখা দেবে মধু-দুর্ভিক্ষ! কী আশ্চর্য! বহু যুগ আগে রবীন্দ্রনাথও কি মধু-সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছিলেন? নাহলে তিনি কেন লিখবেন --
"তল্লাস করেছিনু, হেথাকার বৃক্ষের
চারি দিকে লক্ষণ মধু-দুর্ভিক্ষের।
মৌমাছি বলবান পাহাড়ের ঠাণ্ডার,
সেখানেও সম্প্রতি ক্ষীণ মধুভাণ্ডার —
হেন দুঃসংবাদ পাওয়া গেছে চিঠিতে।"
(প্রহাসিনী, সংযোজন)
আমরা বরং প্রার্থনা করি, মধু-দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি যেন না দেখা দেয় এবং মৌমাছি যেন ফুলে ফুলে উড়ে উড়ে তার মধু সঞ্চয় করে চলে।
"কাল যে কুসুম পড়বে ঝরে
তাদের কাছে নিস গো ভরে
ওই বছরের শেষের মধু
এই বছরের মৌচাকেতে।”
(মহুয়া, শেষ মধু)