‘বাঙালীর বিজ্ঞানচর্চা’ সিরিজের প্রথম বই ‘মেঘনাদ সাহা’। প্রকাশক খোয়াবনামা। লেখক গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। তাঁর শিক্ষকতার ও গবেষণার বিষয় মূলত নিউক্লিয় পদার্থ ও জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞান। লেখকের কলমে ফুটে উঠেছে জন্মসূত্রে অতিসাধারণ এক বালকের অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনি।
মেঘনাদ সাহা (৬ অক্টোবর, ১৮৯৩ – ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬)
বইটির নাম দেখলে মনে হয় একজন বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিকের জীবন ও কর্ম নিয়ে এক ভারিক্কি লেখা। থাকবে পর পর দিন মাস বছরের পরম্পরা বজায় রেখে মেঘনাদ সাহার জন্ম, শৈশব, কৈশোর, বড়োবেলা, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা। ধারণাটা ভেঙে যেতে সময় লাগে না। বইয়ের শুরুটা এমন যে শুরু করতেই হবে। পড়া কিছুটা এগোলে আর চোখ সরানো মুশকিল। বইটির আগুপিছু চলনও বেশ আকর্ষণীয়, দিন তারিখ মেনে কালানুক্রমিক মোটেই নয়।
শুরুটা দেখা যাক।
‘অনেক পড়েছিস, আর পড়তে হবে না। কাল থেকে শুধু দোকানে বসবি।’ ‘না বাবা আমি মিডল স্কুলে ভর্তি হব। মাষ্টারমশাই বলেন পড়াশোনা করলে অনেক বড়ো হওয়া যায়।’ ‘পেরাইমারি পাশ করেছিস, যথেষ্ট। সাহার ছেলে, দোকানদারীই তো কপালে আছে। তিনটে চারটে পাশ দিয়ে করবিটা কি? আমি আর তোর ইস্কুলের মাইনে দিতে পারবো না। আর তাছাড়া এই শেওড়াতলি গেরামে আর ইস্কুল কোথায়?’... অনুমান করাই যায় এক বাবা-ছেলের কথপোকথন যেখানে দরিদ্র মুদির দোকানি এক অসহায় বাবা প্রাইমারি স্তরেই ছেলের পড়াশোনা বন্ধ করতে চাইছেন। এই কথোপকথন, কাল্পনিক হয়েও সত্যাশ্রয়ী। এক নিমেষে আমাদের চিনিয়ে দেয় শিশু মেঘনাদের শিশুবেলা। তুলনা এসেই যায় পরবর্তীকালে মেঘনাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর-এক বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ছোটোবেলার কথা।
সত্যোন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪ – ১৯৭৪)
মোটামুটি সম্পন্ন শিক্ষিত সংস্কৃতিবান পরিবারের একমাত্র পুত্রসন্তান সত্যেন্দ্রনাথের পড়াশোনার ব্যাপারে বাবা ভুবনমোহনের অতন্দ্র প্রহরা, সদাসতর্ক দৃষ্টি। দুরন্ত শিশুকে বাগ মানাতে পিতা গুদোমঘরের মেঝেতে অঙ্ক কষতে দিতেন। শিশুও পরমানন্দে অঙ্ক করতেন। বড়ো হলে ভালো ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পরীক্ষার ফলাফল ভালো হবে বলে বাড়ির কাছের স্কুল ছাড়িয়ে সত্যেন্দ্রনাথকে ভরতি করা হল সে সময়ের বিখ্যাত হিন্দু স্কুলে। আর ছোট্ট মেঘনাদ রাত্রে একটু জোরে আওয়াজ করে পড়লে সারাদিনের কঠিন পরিশ্রমে ক্লান্ত বাবার ঘুম ভাঙলে ছেলের কপালে জুটত লাঠির বাড়ি।
আবার ফেরা যাক আগের কথোপকথনের পরের অংশে।
‘লিখতে শিখেছিস, মুখে মুখে যোগ বিয়োগ করতে পারিস, কাল থেকে দোকানে হিসাব করবি।’ একটা নতুন গলা শোনা গেল, ‘না বাবা ওকে পড়তে হবে। গুরুমশাই বলেছেন মেঘনাথের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল।’ ‘কিন্তু গেরামে ইস্কুল নেই, সেই সাত মাইল দূরে শিমুলিয়ায় গিয়ে পড়বে কেমন করে? আমি ইস্কুলের মাইনে কোথা থেকে দেবো?’ ‘সব ব্যবস্থা করে এসেছি। শিমুলিয়া গ্রামের ডাক্তার দাশের বাড়ি থাকবে। ওরাই খেতে দেবে, টাকাকড়িও লাগবে না, নিজের কাজ নিজেই করে নেবে। চটকলে খেটে আমি যা পাই, তার থেকে ওর বই খাতার পয়সা আমি দিয়ে দেবো। তোমাকে কিছু দিতে হবে না।’
এখানেও সত্যাশ্রয়ী এক কাল্পনিক কথোপকথন। চটকলকর্মী দাদার প্রচেষ্টায় মেঘনাদ পৌঁছে গেলেন শেওড়াতলির ডাক্তার অনন্ত দাশের আশ্রয়ে— শর্ত একটাই, বাড়ির ছোটোখাটো কাজ করার সঙ্গে নিজের এঁটোবাসন নিজেকেই মাজতে হবে। কেননা ‘সাহা’ নীচু জাত। শিশুটি কঠোর দারিদ্র আগেই বুঝেছিল, এই প্রথম জানল নীচু জাত। এখানে ব্যবহার করা হল মেঘনাদ নামটি। হ্যাঁ, বাবা-মা নাম দিয়েছিলেন মেঘনাথ আর ঠাকুমা মেঘনাদ। কলেজে অর্থবহ মেঘনাদ নামটিই নিয়েছিলেন। রামায়ণের মেঘনাদকে নিকুম্ভিলা যজ্ঞস্থলে অন্যায় ভাবে মেরে ফেলেছিলেন লক্ষণ। এর আভাস আগে পেয়েও তিনি যজ্ঞস্থল ছাড়েননি।
গ্রাম্য, অর্থাভাবে নগ্নপদ নীচুজাত মেঘনাদ বৃত্তি সহ মিডল স্কুল উত্তীর্ণ হয়ে পৌঁছে গেলেন শহরে। ভর্তি হলেন নামকরা ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। জুতো কেনার সামর্থ্য ছিল না তাই নগ্নপদ। বিপদ এল অন্যদিক দিয়ে। সেই সময় সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ। ঢাকা স্কুলও বাদ যায়নি। এই সময় স্কুল পরিদর্শনে এলেন ইংরেজ গভর্নর ব্যমফিল্ড ফুলার। ছাত্ররা তাঁর সামনে নগ্নপদ হয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাল। অন্য ছাত্রদের সঙ্গে বিতাড়িত হলেন নগ্নপদ মেঘনাদ। বঞ্চিত হলেন বৃত্তি থেকেও। তবে বেসরকারি কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল তাঁকে সাগ্রহে ভরতি করে নিল। মাইনেও মকুব করল। কিন্তু নিজের থাকা খাওয়ার খরচ চালাতে ঢাকা শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত টিউশন করতে হতো। বিএসসি, এমএসসি পড়ার সময়ও সাইকেল নিয়ে কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত টিউশন করতে হয়েছে।
বইটির একটি কথোপকথন: স্থান— কিশাোরীলাল জুবিলি স্কুল, কাল—এক সরস্বতী পুজোর দিন। পাত্র মেঘনাদ ও স্কুলের অন্যান্য ছেলেরা ও পুরোহিত। ‘তুই ওখানে ঠাকুরের কাছে কি করছিস? নেমে আয় বলছি’... পুরুতমশাই আবার বললেন ‘হ্যাঁ তোকেই বলছি। তোর এত সাহস হল কেমন করেন? সাহার বেটা সাহা কিনা সরস্বতীর কাছে গেছে? ছুঁয়ে দিলে কি হবে? এক্ষুনি বেরিয়ে যা মণ্ডপ থেকে।’ অপমানে চোখ ফেটে জল এল মেঘনাদের। এই প্রথম সরস্বতী মূর্তির কাছে নীচু জাত বলে যাওয়ার বাধা। ইন্টারমিডিয়েটের পর ভরতি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে, থাকার ব্যবস্থা হিন্দু হোস্টেলে। এখানেও সেই জুবিলি স্কুলের সরস্বতী পুজোর পুনরাবৃত্তি। ‘নীচু জাত’ বলে এখানেও সরস্বতী পুজোর মণ্ডপ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। অপমানে আহত মেঘনাদকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে হোস্টেল ছাড়লেন জ্ঞানচন্দ্র সহ অন্য বন্ধুরা। মিশ্রগণিতে বিএসসি অনার্সে এবং এমএসসি দুটোতেই প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান। সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম।
বই থেকে আবার এক চমকপ্রদ সংক্ষিপ্ত কথপোকথন—‘আমাদের ডেকেছেন স্যার?’ প্রশ্ন তিনটি সদ্য এমএসসি করা তরুণের। ‘হ্যাঁ, আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের ক্লাস শুরু করতে চলেছি। সামনের বছর থেকেই শুরু হবে। কি কি আধুনিক বিষয় পড়াতে পারবে তোমরা?’ ‘স্যার আপনি যা বলবেন, তাই পড়াবো।’ ‘সত্যেন তুমি রিলেটিভিটি পড়াবে। মেঘনাদ তুমি পড়াবে কোয়ান্টাম থিয়োরি। টেবিলের একদিকে মেঘনাদ, সত্যেন্দ্র, শৈলেন—এদের প্রথম দুজন বিএসসি পাস কোর্সের পর আর ফিজিক্স পড়েননি আর টেবিলের অন্যদিকে প্রাজ্ঞ উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। কী পারস্পরিক আস্থা!
আশুতোষ ভুল করেননি। এরপর মেঘনাদের কর্মচঞ্চল দিনপঞ্জি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহায়ক, পদার্থবিদ্যা ও ফলিত গণিতে অধ্যাপনা, ডিএসসি ডিগ্রি ও প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ ডিগ্রি লাভ, পালিত বৃত্তি পেয়ে বিদেশে গবেষণা। আবার কলকাতায় ‘খয়রা’ অধ্যাপক পদে যোগ দিয়ে বছর দু-এক বাদে চলে যান এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখানে প্রতিষ্ঠা করেন ইউপি অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স (পরে নামকরণ হয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাকাদেমি অব সায়েন্স। তিনি মূলত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী হলেও এলাহাবাদে পদার্থবিদ্যার আরও অনেকগুলি শাখায় শিক্ষকতা ও গবেষণা করেন। তাঁর অত্যন্ত উচ্চমানের গবেষণা ‘তাপীয় আয়নন তত্ত্ব’। বলা হয় এই তাপ আয়নন তত্ত্ব বিশ্ববিজ্ঞানে এক বড়ো অবদান, সেই সঙ্গে এই তত্ত্ব জ্যোতিপদার্থবিদ্যায় এক নতুন দিক খুলে দিলো। এ ছাড়াও স্বদেশে ও বিদেশে বহু উচ্চমানের গবেষণা করেছেন। মেঘনাদের গবেষণাকে অনুসরণ করে বিদেশে গবেষণা হয়েছে।
অনেকটা এগিয়ে আবার বইয়ের সঙ্গে পিছু হাঁটা। বন্ধুর ডাকে ঢাকায় এসে মেঘনাদ জানালেন ‘পাউলির প্রবন্ধটা পড়ে দেখো, প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটা অদ্ভুত সমীকরণ এমনি এমনি ধরে নিয়েছে, কোথা থেকে সেটা হল বোঝার চেষ্টাই করেনি। আমার বিশ্বাস এটা কেমন করে এল তা উদ্ধার করতে তুমি পারবে।’ সত্যিই বুঝলেন মেঘনাদের বন্ধু। একটা চিঠি লিখলেন। তারিখ দিলেন ৪ জুন ১৯২৪। নীচে সই করলেন এস এন বোস। চিঠিটা ভাঁজ করে খামে পুরলেন, তার সঙ্গে দিলেন একটি গবেষণাপত্র। খামের ওপর প্রাপকের ঠিকানা লেখা প্রফেসর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, কত অল্প কথায় কিছুটা নাটকীয় ভাবে লেখক পৌঁছে দিলেন সত্যেন্দ্রনাথের বিশ্বখ্যাত গবেষণা ‘বোস স্ট্যাটিসটিক্সে’র সূচনা পর্বে। মেঘনাদের অবদানও জানতে পারলাম।
অ্যালবার্ট আইনস্টাই ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু
মেঘনাদের এলাহাবাদের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী জীবনে গবেষণার পাশাপাশি দেশের বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক শীর্ষপদে বসেছেন, বিখ্যাত হয়েছেন। যেমন প্রতাপ কিশোর কিচলু, ডি এস কোঠারী, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আত্মারাম, বি ডি নাগচৌধুরী। তিনি নতুনের পথে হেঁটেছেন। সেই সময়ে এলাহাবাদে বিজ্ঞানের আধুনিকতম বিষয় নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করেও পরিকাঠামোর অভাবে বন্ধ করে দিতে হয়। পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যার ভবিষ্যৎ গুরুত্ব বুঝে এর পঠনপাঠন ও গবেষণার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রতিষ্ঠা করেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (মেঘনাদের মৃত্যুর পর নাম হয় সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স)। এখানে ভারতের প্রথম সাইক্লোট্রন স্থাপনের মূল উদ্যোক্তা মেঘনাদ। এ ছাড়া এখানে শুরু হয় আয়নমণ্ডলে বেতার তরঙ্গ বিস্তার, মহাজাগতিক রশ্মি এবং জীব পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা। আবারও মেঘনাদকে উপেক্ষা করা হল। এর প্রধান কারণ হয়তো বিজ্ঞান গবেষণার ভরকেন্দ্র কলকাতা থেকে দিল্লিতে চলে যাওয়া। মেঘনাদ ভারতের নিজস্ব পরমাণু শক্তি দপ্তর খোলার উদ্যোগ এবং পরিকাঠামো নির্মাণে যুক্ত ছিলেন—কিন্তু স্বাধীন ভারতের পরমাণু শক্তি আয়োগ গঠিত হলে তার চেয়ারম্যান করা হল সম্ভ্রান্ত শিল্পপতি পরিবারের সদ্য কেম্ব্রিজ প্রত্যাগত নেহরু-ঘনিষ্ঠ হাোমি জাহাঙ্গির ভাবাকে। অথচ ভাবার গবেষণার বিষয় ছিল মহাজাগতিক রশ্মি।
এ কি রাজনীতি? না নিম্নবিত্ত, নিম্নবর্ণ এবং যথেষ্ট বংশমর্যাদা না থাকার মাশুল? সারাজীবনই উচ্চবর্ণ, উচ্চবিত্ত, উচ্চ বংশমর্যাদাসম্পন্নদের কাছে পেয়েছেন অপমান, অবহেলা। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ‘বামপন্থী’ তকমা। মেঘনাদকে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো করার প্রস্তাব দেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফাউলার প্রমুখ কয়েকজন। আর তাঁকে ব্রিটিশ-বিরোধী ও বলশেভিক আখ্যা দিয়ে প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস নিজস। ফাউলার রাজনীতির থেকেও প্রাধান্য দিলেন মেঘনাদের বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বকে। ১৯২৭ মেঘনাদ রয়্যাল সোসাইটির ফেলো। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা। শোনা যায় তিনি যে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নন সেটা নাকি কারও মনে ছিল না। শেষ পর্যন্ত ওনাকে ফেলো করা হলো ১৯৫৮ সালে, ৬৫ বছর বয়সে।
আবার পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ সম্পর্কে আইনস্টাইন মিনকাউস্কির জার্মান ভাষায় লিখিত মূল প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদ করছেন সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ। সম্ভবত এটিই আইনস্টাইনের মূল নিবন্ধের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ। এই সময়কালেই মেঘনাদ কিছুদিন কলকাতায় খয়রা অধ্যাপক পদে ছিলেন। এই ‘খয়রা অধ্যাপক’ পদ সৃষ্টির এক মজার বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে আলোচ্য বইটিতে। লেখকের কথায় “কলকাতা হাইকোর্টে খয়রার রাজা গুরুপ্রসাদ সিংহের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তাঁর স্ত্রী রানী বাগেশ্বরী। দুজনের মধ্যে মীমাংসার শর্ত হিসাবে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছ’ লাখ টাকার ব্যবস্থা করেছেন। সেই টাকায় পাঁচটি নতুন অধ্যাপক পদ তৈরি হয়েছে।” আশুতোষের তৎপরতায় রাজা-রানির বিবাদের মামলার মধুরেণ সমাপয়েৎ-এ তৈরি হওয়া একটি ‘খয়রা’ অধ্যাপক পদ পেলেন মেঘনাদ। যুক্তিবাদী, ন্যায়পরায়ণ, লড়াকু এই মানুষটির সংঘাত হয়েছে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সি.ভি. রমনের সঙ্গে। কিছুটা প্রাদেশিকতার অপবাদও জুটেছে। সংঘাত হয়েছে রমনের ছাত্র কৃষ্ণান এবং ভাবার সঙ্গে। বিজ্ঞাননীতি প্রণয়ন ও বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিরোধ প্রিয় বন্ধু ভাটনগরের সঙ্গে। অবশ্যই নিজেও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন।
সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়ে জিতেছেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রিয়তম ছাত্র মেঘনাদ আচার্যের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়েছেন দুর্ভিক্ষ, খরা, উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বন্যার মোকাবিলায়। টেনেসি ভ্যালির বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী বাঁধ পরিকল্পনা দেখে এসে ভারতে তার প্রয়োগ করেছেন। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, পঞ্জিকা ও ক্যালেন্ডার সংস্কার, এমন বহু কাজে এবং শিল্পদ্যোগী ভারতের অন্যতম রূপকার শুধু নয় জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান ও তার প্রায়োগিক দিক জানাতে প্রফুল্লচন্দ্রকে সভাপতি করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন এবং এর মুখপত্র সায়েন্স অ্যান্ড কালচার পত্রিকা। প্রতিষ্ঠা করেছেন ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি। সভাপতি হিসাবে এবং পরে ডিরেক্টর হিসাবে নতুন করে গড়ে তুলছেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অব সায়েন্স। একই সঙ্গে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের দায়িত্ব, লোকসভার কাজ ছাড়াও পালন করেছেন আরো বহু দায়িত্ব। মেঘনাদ রক্তচাপে কিছুটা অসুস্থ। এই সময় প্রস্তাবিত বাংলা-বিহার সংযুক্তিতে আপত্তি জানাতে এবং ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের সমর্থনে রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের মতামত জানাতে দিল্লি যান। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার জন্য একটি ট্যাক্সি নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্দেশে রওনা হন। যাত্রা শেষে ট্যাক্সি থেকে নেমে দু-এক পা হাঁটতেই অজ্ঞান পয়ে পড়ে যান। সে জ্ঞান আর ফেরেনি। দিনটি ছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬।
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স। বউবাজারের পুরনো বাড়ি। ছবি আনুমানিক ১৯০৭
পিছিয়ে গেলে দেখবো কিশোরীলাল জুবিলি স্কুলে এবং হিন্দু হোস্টেলে দুটি সরস্বতী পুজোয় জুটেছিল লাঞ্ছনা, অবমাননা। আর ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ ছিল তাঁর জীবনের শেষ সরস্বতী পূজা। কিছু আকর্ষণীয় অণুকাহিনি, সময়কে এগিয়ে পিছিয়ে কিছু কথপোকথনে সাজানো দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটি আগাগোড়া আকৃষ্ট করেছে। শেষ অধ্যায়ের শেষের দিকে দেখতে পাই দরদি স্বামী, স্নেহশীল পিতা, বন্ধু এবং ছাত্রবৎসল মেঘনাদকে। শত কাজের মধ্যেও পরিবার এবং পরিজনদের প্রতি কর্তব্য পালন কখনও ভুলে থাকেননি। এই তালিকায় ছিলেন আশ্রয়দাতা ডা. অনন্ত দাসও। নিজের শৈশবের দারিদ্র মনে রেখে এলাহাবাদে ও কলকাতায় গরিব ছাত্রদের আশ্রয় দিয়েছেন। প্রখর ব্যক্তিত্ব, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, কিছুটা অসহিষ্ণুতা, সেই সঙ্গে অদম্য আশাবাদ মেঘনাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিছু স্বদেশীয় বিজ্ঞানীর উচ্চম্মন্যতা, রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতা, বিদেশি বিজ্ঞানীর উন্নাসিকতা—সব প্রতিকূলতা জয় করে হয়ে উঠেছেন অনন্যসাধারণ।
বইটি পড়া শেষ হলে উপলব্ধি করা যায় মহান এক স্বদেশপ্রেমী, মানবদরদি মেঘনাদকে যার জন্য বেদনা বোধ হয়, একই সঙ্গে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। লেখক গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়কে আবারও ধন্যবাদ জানাই এমন একটি বই উপহার দেবার জন্য। ধন্যবাদ জানাই খোয়াবনামাকে এমন একটি বই প্রকাশের জন্য। তবে কোথাও যেন একটা আক্ষেপ রয়ে গেল। বইয়ের কোথাও, কোনোভাবেই কি মেঘনাদের জন্মতারিখটি উল্লেখ করা যেত না? মেঘনাদের জন্ম ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর।
বাঙালি বিজ্ঞানীরা বঞ্চিত। সত্যেন বোস এবং মেঘনাদ সাহা অনায়াসে নোবেল পেতে পারতেন।