ভ্যাকছিনের জন্যি লাইনে দাঁড়াইয়া আছিল জাবেদা বিবি, রুমেলা খাতুন, ফতিমা আখতার, রাণী টুডু, সাইদা আনসারি এবং আরো অনেকেই। এতদিন ধরি শুনেছে যে করুণা এসেছে, করুণা এসেছে, কাজ কাম তো প্রায় লাটে উঠিছিল লগডাউনে, কিন্ত এখুন শুনিছে যেই ভ্যাকছিন আসিছে, পাটির লোক বাড়ি বাড়ি বলি গিছে ভ্যাকছিন নিতি হবে। ক্যানো ভ্যাকছিন না নিলি কি হবে। ফতিমা জিগায়েছিলো। করুণা হবে। করুণা। জ্বরে গা পুড়বে। শ্বাস আটকাই যাবে। তারচে যাও ভ্যাকছিন লয়া আসো। হাসপাতালের পাশে মেডিক্যাল আছে।ঐথনে লাইন দেও। এই যে বলি গেলাম ভ্যাকছিন নিতি, ভোট কিন্ত আমাদের দিবা। চিহ্ন মনে রাখবা।
আমানি খায়ে বারায়েছে সকলে। গতকালের বাসি ভাতে জল দে রাখা ছিল। তাতে শুকনো লঙ্কা ভাজা, সেই ভাজার তেল, নুন আর তেঁতুল। শরীলটাকে তো ঠান্ডা দিতে হবে! সারাদিনের কারবার। ভ্যাকছিন বলি কথা।
সকাল থিকে লাইন। দশটায় কাউন্টার খুলি কাগজ দিবে। আধার কাট হাতে সবাই দাঁড়ায়ে আছে। মেয়েমানুষের পুরোষমানুষের আলেদা লাইন নাই। জাবেদার ঘাড়ের ওপর একটা মুশকো ব্যাটাছেলে দাঁড়ায়ে গেল। সুলেমান আলি। মুখে ত্যানা নাই। ওদের সবাইকে পাটির লোক গতকাল মুখ বান্ধবার ত্যানা দিছে। মেয়েমানুষগুলার সকলের মুখে ত্যানা। মাথা কাপড় দে ঢ্যাকা। শুধু চোক দেখা যায়। চোখে পিচুটি। ক্লান্তি। বিরক্তি সব দেখা যায়।
এগারোটা থেকে চড়া রোদ। কী তাপ কী তাপ মাগো! আর দাঁড়ান যায় না। তারপর ঘাড়ের ওপর মুশকোটা ফোঁস ফোঁস করি শ্বাস ফেলে। জাবেদা লাইন থেকে বাড়ায়ে গেল। গরমে হাত পা জ্বলে। শায়া ঘামে ভিজে লতপত করে। জাবেদার ফুপু চিৎকার করি উঠল, লাইন থিকে সরলি ক্যানে রে?
তারপর দেখা গেল কেউই রোদের তাপে দাঁড়াতে পারতেছে না। ফতিমার মাতাতে বুদ্দি বেশি। সে বলল, ইঁট পাতি রাকো। মানে? কাছাকাছি থেকে ছোট ছোট ইঁট, ঢিল সব কুড়ায়া নিজির নিজির আধার কাট চাপা দিয়া মেয়েমানুষের দল গাচের তলায় বসল। কাছেই গাচ। নজর রাকা যাবে। কাউন্টার খুলে সবে তো বসল। রাণী টুডু, মালতী টুডু ল্যাকাপড়া জানে। বলল, কম্পুটার খারাপ। সেরে তারপর কাগজ দেবে। মেয়ের দল গাচতলা বসি আঁচল দিয়ে ঘাম মোচে। ভাবে হাতপাকা সঙ্গি থাকলে ভালো ছেল।
ফুপু আমিনুলকে বলেচে, এট্টা ঠান্ডা নিয়ায় ব্যাটা। গলা শুকায়। বলেছে কী বলেছে আমিনুল ফোঁস করে উটেচে। তার বয়স ষোলো। এই বয়সে সে এতগুলো মেয়েমানুষের দায়িত্ব নিয়ে হাসপাতালের চত্বরে চক্কর কাটছে। বেলা সাড়ে এগারোটা বাজল, কম্পুটার খুলে না। তারপর ফুপু বলে ঠান্ডা লিয়ায়!
আমিনুল শুনতে না পেয়ে মুক ঘুরায় নিল।এদিকে পানির বোতল শেষ। ইঁটের আর ঢিলের লাইনে নজর রাকচে রুমেলা। আধার কাট গেল তো সব শেষ। ভুট দিতি পারবা না। ভুট না দিলি দেশ থিকে বার করি দিবে। কাজেই আধার কাটে নজর রাখতে হবে। না হলে ভ্যাকছিন নাই। আর পাটিকে ভুট না দিলি গ্রামে থাকা নাই। এইসব কঠিন ব্যাপারের মাঝেও মাথায় উকুন চিড়বিড় করে, ঘামাচি চিটপিট করে। ফরিদার বড় আপার বুকে ব্যাতা উঠে।
রাণী আর মালতী পাউরুটি সঙ্গে রেকেচে। পানিবটল লিয়ে এসেচে বড় দেকে। ফরিদা পাউরুটি খেতে না করলো না। কিন্ত আপাকে দেওয়ার উপায় নাই। বুকে ব্যাতা। অম্বলের। চোক একটু লেগেচিল রুমেলার। হঠাৎ দেকে তাদের ইঁটের লাইনের মাজে পুটুং করে একটা কাগজ আর ইঁট গুঁজে চলি গেল এট্টা মেয়েমানুষ। রুমেলার মাতায় আগুন। এ মেয়েছেলেটা পরে এসে আগে ভ্যাকছিন নিতি চায়! লাইনে দাঁড়া শালী। পুরুষমানুষগুলোর মুকে গু। মুচকি মুচকি হাসে। লাইন ভাঙা মেয়েচেলেটার বয়স কম। কেউ কিছু বলল না। সঙ্গে এট্টা বুড়ি আচে। নইলে কমবয়সী মেয়ের তো ভ্যাকছিন হবার কথা না!
জাবেদা, রুমেলা, ফতিমা মেয়েটাকে ছেঁকে ধল্লো। পতমত একুন তো হিঁদু মেয়েছেলে মোসলমান মেয়েচেলে আলেদা করা যায় না। বড়ঘরের হিঁদু মেয়েচেলেরাও সিঁদুর পরেনা, শাকা পরে না। আর গরিবঘরে নিয়মমতো হিঁদু মোসলমান মেয়েচেলে আলাদা করাই যায় বটে কিন্ত একুন সবার মুকে ত্যানা। মাতায় মোসলমান মেয়েমানুষের মত কাপড়জড়ানো। এ মেয়েটার হাত ফাঁকা। এমনিতেই হিঁদু না মোসলমান? জাবেদা হাত ধরে জোরে ঝাঁকালো।
লাইনের মাঝে ঢুকিচিস ক্যানে? শেষে আসিচিস, শেষে লাইন দে।
ছুঁড়িটা কাঁচা বয়সের। ভয় পে গ্যাচে। লাইন বেড়ে হাসপাতালের গেটে। সেকেনে দাঁড়ালে আজ ভ্যাকছিন মিলবে না। কাউন্টার বন্ধ হলেই আর ভ্যাকছিন পাওয়ার উপায় নাই। সকলে জানে। এট্টু দুরে যে বুড়িটা মেয়েমানুষটার সঙ্গের লোক, সে মুক ফেরাতে জাবেদা বুঝি গেল, এরা হিঁদু। বুড়ির কপালে তেলক কাটা। ভ্যাকছিন লাইনে হিঁদু মোসলমান আলেদা নাই। জাবেদা তিনটে হিঁদু বাড়িতে কাজও করে। কিন্তু লাইন ভাঙার জন্য তার মাতা ঠিক নাই। হাত উঠি গেল। মেয়েটার গালে।
বিনি খুব সন্তর্পণেই চুপেচেপে কাজটা করিছিল। এত লম্বা লাইনে দাঁড়ালে আজ আর ভ্যাকছিন হবে না। দিদাকে কাল আবার লিয়ে আসতে হবে। কাল আবার তার মঙ্গলচণ্ডীর উপাস। আজ কাজের বাড়ি ঢুকতে যদি আরো বেলা হয়, তবে কপালে দুঃখু আছে। তারপর বাড়ি গে ভাত রানতে হবে। ডাল। একটা তরকারি। নইলে সুনুর বাপ লাতি দিয়ে কোমরে আবার মারবে। এইসব ভেবে সে চোট্টামি করিছিল। তারপর সব মেয়েমানুষের মাতায় কাপড়। মুকে ত্যানা। দিদার কাগজটা বার করে নিতে পাল্লেই হল।
চড় মারার পর স্বভাবতই একটা গন্ডগোল হল। সুলেমান আলি বনাম গোবিন্দ নস্কর। মোসলমান মেয়ে হিঁদু মেয়েকে চড় মেরেচে সেটা বেশি খারাপ না হিঁদু মেয়ে চোট্টামি করে লাইন ভেঙেচে এইটে বেশি খারাপ, বিষয়টা আর এটা থাকল না। অন্যদিকে গড়াতে যাচ্চিল।
ওদিকে কাউন্টারে লাইন এগুচ্চে। কম্পুটার ঠিক হয়ে গিচে। বিনি চড় হজম করে ফরিদাকে বলল, লাইনে দাঁড়ালে আজ ভ্যাকছিন হবে না। ভ্যাকছিন আজ না হলে কাল আবার কাজের বাড়ি লেট হবে। দিদার মাতা ঘুরে। কিন্ত ভ্যাকছিন নিতে বলেচে পাটি। বিনা পয়সার ভ্যাকছিন নিতে বলিচে। ভোট দিতে হবে তো। বিনা পয়সার ভ্যাকছিনের খবর দিয়েছে।
জাবেদা, ফরিদা চমৎকৃত হল। এই খেনেও তাই। যে পাটি বিনা পয়সার ভ্যাকছিনের খোঁজ দেয়, ভুট তাকে দেয়!
এই বেটিও আমানি খেয়ে কাজে বেরায়েছে। বাড়ি গে বরের লাথি খাবে। বিনিকে বড় আপন মনে হল। মাথায় কাপড়। মুকে ত্যানা। বিনি রুমেলা আর জাবেদার মাজে দাঁড়িয়ে গেল। কাজের বাড়ি লেট হলে নিজের বাড়িতেও লেট। আর কোমরে লাথির বেদনা কেমন বিনিও জানে, জাবেদাও জানে।
এখন মাতায় কাপড়, মুখে ত্যানা, পেটে আমানি আর কোমরে মরদের লাথি। হিঁদু মোসলমান মেয়েমানুষ আলেদা করা যায় না।
সুলেমান, আজগর আর গোবিন্দ, সুদেবের হাতাহাতি থামিয়ে, চালান করে পুলিশ যখন মেয়েমানুষগুলোর খোঁজ করতে এল, কাউকে ধরতে পারল না। কাউকে চেনাও গেল না। কেউ কোনো কথাও বলল না। খবরের কাগজের লোক হিঁদু মুসলমান গন্ডগোল, ভ্যাকসিনলাইনে অরাজকতা এইরকম একটা খপর করেছিল বটে, সেটা জুবেদা বা বিনি কেউই পড়েনি। বস্তুত কেউই পড়েনি।
বাহ।
খুব ভালো লাগলো। শেষটুকু অতুলনীয়।
খুব সুন্দর।