ডিসক্লেইমার: মূলত একটিই বই, সেটির, সারসংক্ষেপ, অন্য দুটো তিনটে বই, আর কিছু নেট ঘাঁটাঘাটি, মাঝে কিছু আমার স্মৃতি হাটকানো। ৬৯-৭১-এ আমি কলকাতায় কলেজে। এখনও কিছু স্মৃতি বেশ পরিষ্কার।
বইটি Garry J Bass লিখিত The Blood Telegram। পুলিৎসার প্রাইজের ফাইনালিস্ট। প্রথম প্রকাশ ২০১৩।
শুরু করতে হবে ১৯৭০-র ভোলা সাইক্লোন থেকে। ৩ নভেম্বরের এই এই সাইক্লোনে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ ভাগ একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। আন্দাজ, প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ মারা যান (তুলনা করুন ২০০৪ সালের জাপানের ৎসুনামিতে মৃত আড়াই লক্ষের কিছু কম মানুষ)।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ত্রাণ আসে অনেক দেরিতে, এবং খুবই কম। পূর্ব পাকিস্তানে তো এমনিতেই ‘আমরা অবহেলিত’ এই মনোভাব খুবই প্রচলিত ছিল, তায় এই সাইক্লোনে সেটা মানুষকে একেবারে ক্ষেপিয়ে দিল। ৭ ডিসেম্বরে, পাকিস্তানের প্রথম গণভোট। শেখ মুজিবের আওয়ামি লিগ একেবারে এক তরফা জিতে গেল পূর্ব পাকিস্তানে।
ফলাফলে জাতীয় সংসদের জন্য জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ টা আসনের মধ্যে ১৬০ টাই আওয়ামি লিগের দখলে। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮ টা আসনে যদিও তারা শূন্য। ইয়াহিয়া খান অনেক আসনেই নিজের প্রার্থী দিয়েছিলেন—তারা সম্পুর্ণ ধরাশায়ী। পশ্চিমের ১৩৮টি আসনের মধ্যে ভুট্টোর দল পেয়েছিল ৮১ টি আসন। পাকিস্তানের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে একক বিজয়ী আওয়ামি লিগ। * (সিটের সংখ্যা নিয়ে রামচন্দ্র গুহ এবং গ্যারি জে বাসের মধ্যে সামান্য তারতম্য আছে। আমি উইকির তথ্যই নিলাম—তাদের তথ্যসূত্র আরও আধুনিক।)
এই দুই প্রদেশ মিলিয়ে আওয়ামি লিগই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এইবারে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া আটকায়ে কে শেখ মুজিবের?
আটকাল ইয়াহিয়া খান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। ডিকটেটর বলাটাই ঠিক।
মুজিবের ছিল ৬ দফা দাবি সনদ। যার মধ্যে প্রধান ছিল বিদেশনীতি ও প্রতিরক্ষা ছাড়া দুই খণ্ড পাকিস্তান নিজের নিজের মতন চলবেন। দরকারে মুদ্রাও আলাদা হতে পারে দুই প্রদেশের। এ ছাড়াও, মুজিব, একান্তে এবং কখনও প্রকাশ্যেও স্বাধীন বাংলাদেশের কথা বলে এসেছেন। ইয়াহিয়ার কাছে সব খবরই পৌঁছাত। ক্ষমতায় থাকা ইয়াহিয়ার কাছে সে এক দুঃসহ অবস্থা।
ওটাই পাকিস্তানের প্রথম গণভোট। ফলাফলেও কোনো ধোঁয়াশা নেই, কিন্তু ইয়াহিয়া খান স্রেফ ‘অমনি করে খেলব না’ বলে মুজিবকে ক্ষমতা দিলেন না। ইয়াহিয়া, ভুট্টো আর মুজিবের পয়লা মার্চের দীর্ঘ বৈঠকেও কোনো সমাধান সূত্র মিলল না, ইয়াহিয়াও তাই ৩ মার্চ থেকে দেশের নতুন সংসদ ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি’ ঘোষণা করে দিলেন। জাস্ট গায়ের জোর।
তো পূর্ববঙ্গে শুরু হল গণবিক্ষোভ। লাগাতার হরতাল। নন-কো-অপারেশন। ৭ মার্চ মুজিব ঘোষণা করলেন এ লড়াই স্বাধীনতার লড়াই।
বই-এর নামকরণ যতই রোমহর্ষক হোক, আসল কারণটা নেহাতই কাকতালীয়।
আর্চার ব্লাড, সেই সময়ে ঢাকাতে আমেরিকান কনসাল জেনারেল ছিলেন। তিনি এই গণহত্যার বিরুদ্ধে একটানা খুব কঠিন ভাষায় টেলেগ্রাম পাঠাতেন ওয়াশিংটনে। তাঁর নামেই এই বই-এর নামকরণ।
ব্লাড তাঁর কেবলগুলিতে ক্রমাগত সাবধান করে যাচ্ছেন তাঁর ঊর্ধ্বতনদের। ব্লাড সাহেব, এর আগে গ্রিসের দূতাবাসের কনসাল ছিলেন। সেখানকার সামরিক জুন্টা নিয়েও তাঁর খোলাখুলি মন্তব্যতে CIA খুবই রুষ্ট ছিল। কিন্তু ব্লাডকে থামানো যায়নি।
বাংলাদেশে (এখন থেকে বাংলাদেশই লিখব) অবস্থা খুবই সঙ্গিন হয়ে পড়ছিল। জনতা এককাট্টা আর আক্রমণাত্মক। রাস্তাঘাটে টহলদারি আর্মির লোকজনকে দেখলে গালি দিত, থুতু ছিটাত। আর্মির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটে গেছে, যদিও মুজিব কিন্তু সমানেই তার সমর্থকদের সামলাবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
ব্লাড, ওয়াশিংটনকে পরিষ্কার জানালেন দুই পাকিস্তানকে আর এক করে রাখা যাবে না। জোর করে এক রাখতে গেলে রক্তগঙ্গা বইবে। কিসিঞ্জারও পালটা জানালেন পাকিস্তানকে কোনো মতেই ‘ডিসটার্ব’ করা চলবে না, ইয়াহিয়াকেও বারণ করা যাবে না গুলি চালাতে।
যদিও ১৩ মার্চ, কিসিঞ্জার এক মেমোতে জানালেন নিকসনকে, বাংলাদেশে অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী আর পাকিস্তানি আর্মিও বেশিদিন এই গণ আন্দোলনকে রুখতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে আমেরিকার উচিত হবে ‘to remain inactive and do nothing’। এমনকি ইয়াহিয়াকে সংযত থাকার কোনো অনুরোধও করার দরকার নেই।
শেষ চেষ্টা একবার হল। ঢাকাতে বৈঠক হল ইয়াহিয়, মুজিব আর ভুট্টোর। দিনটা ২২ মার্চ। মুজিবের কিছু দাবি মেনে নেওয়া হল, তবে স্বাধীন বাংলাদেশ নৈব নৈব চ। কিন্তু তিন পক্ষে মিটমাট হল না।
২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে তোলা হল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
২৫ মার্চ, রাত থেকেই ইস্ট পাকিস্তানের দখল নিল পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। বাংলাদেশের পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীকে নিরস্ত্র করা হল। সমস্ত খবরের কাগজের অফিসে হামলা হল, আগুন জ্বলল প্রেসে। রেডিও ভবন থেকে শুধু সামরিক সংগীত।
তারপরে বেছে বেছে যারা সমাজের পুরোধা, নেতৃত্ব দিতে পারেন, সেইসব মানুষেরা—ডাক্তার, চিকিৎসক, অধ্যাপক... একটানা জবাই হল। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বইল রক্তগঙ্গা।
ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল—যেখানে বিদেশি সাংবাদিকেরা থাকতন—কার্যত সিল করে দেওয়া হল।
পুরো ব্যাপারটাই ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করে ঘটল। নাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। আর্মির সাথে ঢাকার রাস্তায় নামল আমেরিকান M-24 ট্যাংক।
ব্যস। তারপর আর টেনেটুনে নয় মাসও নয়। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরেই নিয়াজি তিরানব্বই হাজার পাক সেনা নিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ জারি হল।
বই-এর লেখক, এই ঘটনাগুলিকে ছুঁয়ে গেছেন মাত্র। উনি পলিটিকাল সায়েন্সের অধ্যাপক। এই সর্বজনবিদিত ঘটনাপ্রবাহের রানিং কমেন্টারি না করে উনি জোর দিয়েছেন ঘটনার নেপথ্যের রাজনীতির। তাকে প্রচণ্ড সাহায্য করেছে নিক্সন কিসিঞ্জারের রেকর্ড করা কথাবার্তা। এ একেবারে হুবহু ডায়ালগ। কোনো লুকোছাপা নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এরকম গণহত্যা অনেক দেশেই হয়েছে। রোয়ান্ডা, বায়াফ্রা, কাম্বোডিয়া, বোসনিয়া। আমেরিকা মাথা ঘামায়নি। বায়াফ্রার মানুষদের দুর্দশা টিভিতে দেখালে জনসন বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন “Just get these nigger babies off my TV set।”
কিন্তু এখানে সেরকম ঘটনা নয়। আমেরিকা গত দুই বছর ধরেই পাকিস্তানকে বিপুল অস্ত্র পাঠিয়ে আসছিল আর এই সংঘাতের সময় আমেরিকা উদাসীন ছিল না, আদৌ না। খোলাখুলি পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থক ছিল।
পাকিস্তানি আর্মি যদিও ঢাকার সব টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিল কিন্তু ব্লাডের কাছে ছিল একটি গোপন ট্রান্সমিটার, সেটার মারফতেই তিনি তাঁর মতামত জানাতেন। আর্চার ব্লাড, ২৭ মার্চ থেকেই হেড আপিসে কেবল পাঠাতে লাগলেন। তাঁর ভাষা আদৌ ডিপ্লোম্যাটিক ছিল না, বরং যেন কোনো উত্তর-সম্পাদকীয়। ব্লাড, তাঁর কিছু বাঙালি বন্ধুকেও মেসেজ নিতে আর পাঠাতে সাহায্য করেছিলেন। ভয়েস অব আমেরিকা, ব্লাডের ওই বিবরণীগুলি সম্প্রচার করলে পাকিস্তান সরাসরি নালিশ করে আমেরিকাকে। এরপর থেকে VOA পাকিস্তানি সরকারি খবরই প্রচার করত।
প্রথম দিকে পাকিস্তানি আর্মির লক্ষ্য ছিল বাঙালি, ধর্মাধর্ম নির্বিশেষে। কিছুদিন পরেই তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল বাঙালি হিন্দুরা। সেরকমই একটি কেবলে আর্চার ব্লাড ‘selective genocide’ কথাটি ব্যবহার করেন। আমেরিকান সংবাদপত্র ও সরকারি মহলে খুব ধাক্কা দেয় এই শব্দবন্ধ।
এমন তো নয় যে আমেরিকা সারা বিশ্বের শান্তিরক্ষার ইজারা নিয়েছিল কোনোদিন। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে যখন দুনিয়া উত্তাল তখনও আমেরিকা একবারও মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদের ধার কাছ দিয়েও যায়নি কেন? সামান্য হিপোক্রেসিও কি আশা করা যেত না?
লেখক বাস তিনটি কারণ বলেছেন। প্রথম দুটি গৌণ। প্রথমত, নিকসন আর ইয়াহিয়া, দুজনের কেউই যখন নিজের নিজের দেশের প্রেসিডেন্ট নন, তখন থেকেই দুজনের মধ্যে একটা সখ্যতা ছিল। নিকসনের অন্তরঙ্গ কথোপকথনের যে টেপ পাওয়া যায় তাতে দুজনের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ হয়েছে একাধিক বার।
দ্বিতীয়ত, নিকসন, ইন্দিরা গান্ধিকে রীতিমতন অপছন্দ করতেন। রাশিয়ার সাথে মাখামাখি, ইন্দিরা সোস্যালিস্ট ঝোঁক—শুধু এগুলিই নয়। মানুষ হিসেবেই ইন্দিরাকে নিকসন পছন্দ করতেন না। এর আগে একবার দুজনের মিটিং হয়েছিল দিল্লিতে মিনিট কুড়ির জন্য। ইন্দিরা নাকি যথেষ্ট উৎসাহ তো দেখানইনি, তায় তাঁর এক সহকর্মীকে হিন্দিতে প্রশ্ন করেন, “এ আরও কতক্ষণ টাইম নেবে?” নিকসনের আর-এক পরামর্শদাতার মতে নিকসন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কোনো মহিলাকে হজম করতে পারতেন না। তো সে কথা বলতে কী, নিকসন গোটা ভারতীয় জাতিকেই অপছন্দ করতেন, বলেছিলেন ভারতীয়রা ‘Slippery and treachorous’। পাকিস্তান ও তার অধিবাসীদের ক্ষেত্রে কিন্তু প্রশংসাই বরাদ্দ ছিল।
মূল কারণটি কিন্তু এইসব ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ নয়। নিকসন-কিসিঞ্জার জুটি তখন চিনের সাথে আবার করে সম্পর্ক গড়বার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে, সবই গোপনে, খুবই গোপনে।
প্রথমে ফ্রান্স ও পরে রুমানিয়ার মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়েছিলেন চিনকে গোপন বার্তা পাঠানোর। কিন্তু নিকসনের পছন্দ ছিল পাকিস্তান। চিনের খুবই বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু এবং লুকোছাপা খেলার পক্ষে সবথেকে নির্ভরযোগ্য দেশ তাই পাকিস্তান। আর তাই নিকসন আর কিসিঞ্জার দুজনই প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন, পাকিস্তানের যেন কোথাও কোনো অসুবিধা না হয়। নিকসন এটাও একাধিকবার বলেছেন, “জাস্ট তিন মাস। কোনো রকমে তিনটে মাস কাটিয়ে চিনের সাথে ডাইরেক্ট চ্যানেল হয়ে গেল আর চিন্তা নেই। পাকিস্তানকে না খুঁচিয়ে ওই তিন মাস আমার চাইই চাই।”
চতুর্থ কারণটি, একেবারেই আমার নিজস্ব ধারণা। সেটি হচ্ছে ভিয়েতনাম। ৬৯ সাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে ওই দেশ থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার। ভিয়েতনাম থেকে মোটামুটি (হেরে গিয়ে না বললেও) না জিতেই ফিরে আসা। যে সময়ে কিসিঞ্জার চিনের সাথে গোপন সখ্য করছেন, সেই সময়ে প্যারিসে উত্তর ভিয়েতনামের সাথেও একই সময়ে খুব গোপনেই একটা ‘বোঝাপড়া’র ডায়ালগ শুরু হয়েছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের যে শেষের সেদিন আগত সেটা আর কারওই অজানা নয়।
ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখেই, ভিয়েতনাম থিয়েটারে আমেরিকার শেষ বড়ো অভিযান। Lam Son 719। লাওসে ঢুকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনারা উত্তর ভিয়েতনামের রসদ চলাচলের পথ ও ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করবে। আমেরিকান সেনারা সরাসরি যোগ দেবেন না এই অভিযানে। এই প্রথমবার তারা দূর থেকে শুধু আর্টিলারি আর বিমান থেকে বোমা ফেলেই সাপোর্ট দেবেন। দক্ষিণ ভিয়েতনাম যে স্বাবলম্বী হয়েছে, নিজের যুদ্ধ নিজেই করতে পারে, জগৎসভায় সেটাই প্রমাণ করতে হবে।
এই লড়াই-এর ফলাফল, আমেরিকার কাছে খুবই নৈরাশ্যের ঘটনা। প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়ে ভিয়েতকংরা কিছুটা পিছু হটে আসলেও, ঝট করে সামলে নিয়ে আবার নিজেদের এলাকাগুলো দখলে নিয়ে নিল। প্রচুর দক্ষিণ ভিয়েতনামি সেনারা নিহত হলেন। সব থেকে বড়ো ক্ষতি হল অস্ত্রশস্ত্রের। বহু বহু ট্যাংক, কামান ও বিশেষ করে প্রচুর হেলিকপ্টার ধ্বংশ ও ক্ষতিগ্রস্ত হল।
অবশেষে ২৫ মার্চ এই লড়াই ‘অফিসিয়ালি’ শেষ করে দক্ষিণিরা ঘরে ফিরলেন। সেই রাতেই খানসেনারা ঢাকা অভিযান চালালেন।
আমেরিকার পক্ষে, নিকসন-কিসিঞ্জার জুটির কাছে বিরাট হার। তাদের দুজনের কাছেই একটা ‘বিরাট’ কিছু ঘটনা চাই, যাতে করে প্রমাণ হয় ইউএসএ আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। চিনের সাথে সখ্যের দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা এই দুইজনকে আবার লাইমলাইটে তুলে ধরবে। আমেরিকার সর্বোচ্চ মহলেও খুব অল্প কিছু লোক জানতেন কী ঘটতে চলেছে।
আর পাকিস্তান থেকে কিসিঞ্জারের গোপনে চিন ঘুরে আসা—সে তো প্রায় জেমস বন্ডের মতন—এক অসাধারণ নাটক। বিস্তারিত আর লিখছি না।
তবে কিসিঞ্জারের এই চিন ভ্রমণে তাঁর ভারত বিদ্বেষ আরও জোরালোই হল। চৌ এন লাই-এর ভারত নিয়ে ‘contempt and historical distrust’ কিসিঞ্জারকে আরও উৎফুল্ল করল। বাংলাদেশ নিয়ে, চৌ এন লাই আর কিসিঞ্জারের মতামত একেবারে খাপে খাপ মিলে গেল। কিসিঞ্জার সহর্ষে জানালেন “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া থেকে তো জানেনই, আমরা ওনার আর ওনার দেশের সাথে কতটা বন্ধুত্বপুর্ণ”। ভারতবিদ্বেষে, লেখক গ্যারি জে বাস জানাচ্ছেন, চিন আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে গেছিল। “দয়া করে ইয়াহিয়াকে জানাবেন যে ভারত কোনো আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিলে আমরা পাকিস্তানকেই সমর্থন করব”, চৌ এন লাই-এর এটাই ছিল বিদায়ী বাক্য।
১৫ জুলাই, নিকসন এক আমেরিকা-ব্যাপী টিভি সাক্ষাৎকারে জানালেন এই সফল দৌত্যের কথা। অবাক দুনিয়া রোমাঞ্চিত হয়েছিল, সন্দেহ নেই। কিসিঞ্জার খুশিতে ডগোমগো হয়ে নিকসনকে জানালেন “Yahya hasn't had such fun since the last Hindu massacre”।
ভারত একটানা লড়ে যাচ্ছে, দেশে ও বিদেশে, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনের জন্য।
প্রথমে বলি দেশের কথা। CPI(M) নিয়েই কিছুটা দুশ্চিন্তা ছিল, কিন্তু বাঙালি আবেগে ভেসে গেল তামাম বাম শিবির। সব ক-টি রাজনৈতিক দলই ইন্দিরার সাথে। পশ্চিমবঙ্গে সে সময়ে সমস্ত বাম মহলের উপরেই চলছে ভয়ানক সরকারি ও কংগ্রেসি অত্যাচার। কতজন জেলে, কতজন ঘরছাড়া, কতজন অনন্ত প্রবাসে। তবু কংগ্রেস ও বাম পার্টিরা একসাথে মিছিল করে ছিলেন বাংলাদেশের সমর্থনে, একসাথে বাংলাবন্ধও ডেকেছিলেন দুই পক্ষ।
নকশালেরা তখন ছত্রভঙ্গ। তবু ‘বহু’ নকশালেরা সেই সময় বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে শামিল হন। কতজন? নাঃ, কোনো তথ্য নেই।
ট্রিভিয়া হচ্ছে, সেই সময়ে, নিতান্ত তুচ্ছশক্তির জনসংঘ ‘মুসলিমদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হিন্দু অভিযান’-এর ডাক দিয়েছিলেন। আর CPI(ML)-র অসীম চট্টোপাধ্যায়ের গ্রুপ চিনের মতানুযায়ী, মুজিবের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের ‘দেশপ্রেমিক’ যুদ্ধকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
আর ভারতের মুসলিম মিডিয়া ও জননেতারা? উৎসাহীরা Muslim Press in India and the Bangladesh Crisis রিপোর্টটি পড়তে পারেন, বিশদে জানতে। মোদ্দাকথা, প্রথম দিকে ভারতের মুসলিম কাগজগুলি মুজিবকে সমর্থন করেছিলেন কিন্তু বাংলাদেশি ‘বিহারি মুসলমানদের উপরে বাঙালিদের অত্যাচার’ নিয়েও সরব ছিলেন, বিশেষত কয়েকটি উত্তর ভারতীয় পত্রিকা। পরের দিকে বেশ কয়েকটি পত্রিকা সরব ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে—সম্পূর্ণ ধার্মিক কারণেই।
দুই বছর আগেই চিন আর রাশিয়া রক্তাক্ত সীমান্ত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল, সেই তিক্ততা জারি ছিল। আর বিশ্বব্যাপী ‘কোল্ড ওয়ার’-এর কানুন মেনে রাশিয়া সর্বাত্মক ভাবেই ভারতের ছায়াসঙ্গী ছিল। সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভারতকে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান নয়, চিনই ভারতের বড়ো বিপদ। কিন্তু সোভিয়েত দেশ ভারতের সাথে না করল কোনো চুক্তি, না পাঠিয়েছিল কোনো সামরিক সাহায্য। একটা টোকেন অর্থ সাহায্য করেছিল শরণার্থীদের জন্য, তবে আমেরিকার এই ব্যাপারে হেলাফেলার অনুদান সোভিয়েতের থেকে অনেক বেশিই ছিল।
সমর্থন চেয়ে ইন্দিরা গান্ধি বিশ্বের ৬১ টি দেশকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কেউই কোনো সাড়াশব্দ করলেন না।
অগত্যা ভাগে ভাগে মন্ত্রীরা ও রাষ্ট্রদূতেরা গেলেন সব দেশে। বিদেশমন্ত্রী স্বরণ সিং সবাইকে নির্দেশ দিলেন, সবার কাছেই যাও। সাংবদিক থেকে রাষ্ট্রপতি। একবার নয়, বারবার যাও।
শিক্ষামন্ত্রী ত্রিগুণা সেন গেলেন এশিয়ায়। জাপান, অস্ট্রেলিয়া বেশ সহানুভুতিক আওয়াজ-টাওয়াজ দিলেন কিন্তু কোনো সমর্থনের ব্যাপারই নেই।
মালয়েশিয়ান মন্ত্রী জানালেন ভুট্টো ওনাদেরকে এর আগে অপমানজনক নামকরণ করেছেন, তাঁরা মোটেই খুশি নন কিন্তু উপায় নেই, ইন্দোনেশিয়া বড্ড চাপ দিচ্ছে, আমরা পাকিস্তানকেই সাপোর্ট করব। থাইল্যান্ড বলল, কী উপায়, চিনকে তো চটানো যাবে না।
কে সি পন্থ সফর করলেন লাতিন আমেরিকা। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নাকি অবাক হয়ে বলেছিলেন, সত্যি? পাকিস্তান এইরকম দুই টুকরো দেশ? তারপরে সহকারীকে বললেন যাও তো, একটা গ্লোব নিয়ে এসো।
তবুও মেক্সিকো আর পানামা, তাও কিছু সহানুভুতি জানালেন। জামাইকা এমনকি কিউবা সেটাও জানালেন না।
ইওরোপেও ভারতের প্রাপ্তি শূন্য। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ইয়াহিয়াকে আক্রমণ থামাতে বললেন কিন্তু ভারতকেও সতর্ক করলেন বাড়াবাড়ি না করতে। জার্মানির উইলি ব্রান্ডট আর-একটু এগোলেন। ফ্রান্স কোনো কথাই বলেনি।
আর মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম দেশেদের তো কথাই নেই। সৌদি এরাব তো খুলামখুল্লা পাকিস্তানের দলে। ভারত ভেবেছিল Non Aligned দেশ, যেমন ইন্দোনেশিয়া হয়তো সমর্থন করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসলামই শেষ কথা বলল। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল যুগোস্লোভিয়া। আর কোনো দেশই ভারতকে সমর্থন জানায়নি।
ইউএনও-তেও ভারত নিঃসঙ্গ। কে সাপোর্ট করবে ভারতকে? নিষ্কলুশ তো কোনো দেশই নেই যে মরাল মাচায় উঠে বসে গণহত্যাকারী পাকিস্তানকে দূষবে, বিশেষত যখন দুনিয়ার বড়োদাদা আমেরিকা হচ্ছে ঘোষিত ভাবে পাকিস্তানের একাকাট্টা সমর্থক।
ভারতের ভয় ছিল পাকিস্তানের নালিশ, সিকিউরিটি কাউন্সিল অবধি যেন না পৌঁছায়। সেইখানে চিন আর আমেরিকা, দুজনেই হাজির। ভারতকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে দেবে।
সেক্রেটরি জেনেরাল ছিলেন ইউ থান্ট। তিনি আবার প্রস্তাব দিলেন ইউ এন-এর শান্তিরক্ষকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক—যেন এটি একটি নেহাৎই আঞ্চলিক দাঙ্গা। ভারত, একাকীই রইল।
শরণার্থীদের জন্য মানবিক অনুদান—ভারতের দরকার ছিল ৪০০ মিলিয়ন ডলারের। সারা দুনিয়া থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে পেয়েছিল কুল্লে ২০ মিলিয়ন।
অনুদান প্রশ্নে নিকসন বললেন, ইন্ডিয়ার এখন যেটা হলে খুশি হই সেটা হচ্ছে একটা বিরাট দুর্ভিক্ষ। কিসিঞ্জার সায় দিয়ে বললেন, “They are such bastards।”
‘দ্য ব্লাড টেলেগ্রাম’ বইটি লেখার পর নিকসনের আরও কয়েকটি টেপ প্রকাশ্যে আসে। একেবারে হাতেগরম এই বছরের 4/5 সেপ্টেম্বরের বিদেশি বা দেশি কাগজে এই নিয়ে সংবাদ আছে। নিকসনের ইন্ডিয়া নিয়ে মনোভাব যে কতটা নীচে ছিল, সেই খেউড় পড়লেই সেটা টের পাবেন।
আর নিকসন?
নিকসনের কোনো সাপোর্ট চাই না। উনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। বয়ে গেছে দুয়ারে দুয়ারে সমর্থন খুঁজে ফেরা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে দেশটাও তো আমেরিকা। সাধারণ মানুষ, সুশীল সমাজ (এখন এই কথাটি যদিও গালাগালির সমার্থক) এবং সমগ্র মিডিয়া। সবাই বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে।
ওর মধ্যেই ওয়াশিংগটন পোস্টে বের হছে ‘পেন্টাগন পেপার্স’। বিভিন্ন খবরের কাগজে নিয়মিত বের হচ্ছে বাংলাদেশের বীভৎস ছবি ও খবর। সাংবাদিকেরা একেবারে নিজেরাই ঘুরে আসছেন রেফিউজি ক্যাম্প আর মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে।
শুধু তাই? ঢাকার কনসাল আর্চার ব্লাড, যিনি একজন সরকারি আমলামাত্র, অকুতোভয়ে হেড আপিসে পাঠাচ্ছেন কেবল, বলা যায় প্রতিবাদপত্র।
২৭ মার্চই উনি কেবল করলেন “We are mute and horrified witnesses to a reign of terror by the Pakistani Military...।” তাঁকে বারবার চুপ করতে বলছিলেন তাঁর সাক্ষাৎ বস, (পশ্চিম) পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত, জোসেফ ফারল্যান্ড, তিনিও থামাতে পারছেন না ব্লাডকে। ফারল্যান্ড নিজে ইয়াহিয়ার অন্ধ সমর্থক এবং চিন আমরিকার গোপন দৌত্যে, যে অল্প, খুবই অল্প কয়জনা আমেরিকান পুরো ব্যাপারটা জানতেন, তিনি তাঁদেরই অন্যতম। প্রেসিডেন্ট নিকসনের ঘরের মানুষ।
ব্লাড ক্রমাগ্ত এই ‘টেলেগ্রাম’ পাঠাতে থাকলেন। সদরদপ্তরে তাঁর কামান দাগানো চললই। তাঁর ভাষাও আরও, আরও আবেগ ভরা হতে থাকল।
অবশেষে ব্লাড যা করলেন তা বোধহয় আর কোনো দেশেই সম্ভব নয়। ৬ এপ্রিল তিনি ঢাকার কনসালেট অফিসের সব (কুড়ি জন) কর্মচারীর সাক্ষরিত, ‘Dissent note’ পাঠালেন ওয়াশিংটনে। নাঃ, (প্রায়) পুরোটাই তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। “Our government has failed to denounce the suppression of democracy. Our government has failed to denounce atrocities. Our government has failed to take forceful measures to protect its citizens while at the same time bending over backwards to placate the West Pak[istan] dominated government and to lessen any deservedly negative international public relations impact against them. Our government has evidenced what many will consider moral bankruptcy... But we have chosen not to intervene, even morally, on the grounds that the Awami conflict, in which unfortunately the overworked term genocide is applicable, is purely an internal matter of a sovereign state. Private Americans have expressed disgust. We, as professional civil servants, express our dissent with current policy and fervently hope that our true and lasting interests here can be defined and our policies redirected in order to salvage our nation’s position as a moral leader of the free world.”
এ তো একেবারে বিদ্রোহ!!!
লেখাই বাহুল্য, তাঁকে ঝটপট সরিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু তাঁর ‘গোপন’ কেবলগুলি কী করে আমেরিকান প্রেসে পৌঁছে যেত, সেটা লেখক খোলসা করে বলেননি।
আর ছিলেন ভারতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত কেনেথ বি কিটিং। তিনি খুবই নৈকষ্যকুলীন আমেরিকান, ব্লাডের মতন বেতনভুক আমলা নন। নিজেও নিকসনের নিপাট সমর্থক, তিনিও কিন্তু একটানা তাঁর পাকিস্তান-বিরোধী মতামত জানিয়ে এসেছিলেন নাগাড়ে, যদিও তার ভাষা, অবশ্যই, ছিল সংযত। আর্চার ব্লাডের মতন উনি নেহাৎই বেতনভুক আমলা নন, কিটিং একজন নামজাদা মানুষ, তাও নিকসন তাঁকেও সামলানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি।
পশ্চিম দুনিয়ার মিডিয়া, ব্রিটিশ ও আমেরিকান, পাকিস্তানি আর্মির গণহত্যা, ধর্ষণ নিয়ে একটানা লিখে গেছে। কেউ বাদ যায়নি। এ ভিন্ন আমেরিকার পাকিস্তানে গোপনে অস্ত্র পাঠানোর খবরও তাঁরা প্রকাশ করে দেন। ডেমোক্র্যাটদের পার্টির এডওয়ার্ড কেনেডিও খুব লড়েছিলেন বাংলাদেশের হয়ে।
আর পাকিস্তানে? সেখানে সবাইই সরকারি লাইন মেনে এসেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের একমাত্র বামপন্থী পার্টি, National Awami Party সরকারি লাইনের বিরোধিতা করে এবং ঝটপট অবৈধ ঘোষিত হয়। আঞ্চলিক ‘জিয়ে সিন্দ’ আন্দোলনের নেতারাও বাংলাদেশের দাবি সমর্থন করেন, কিন্তু সেটি নিতান্তই একটি ফুটনোট মাত্র। এ ছাড়া ইয়াহিয়া দেশের মধ্যে কোনো মিডিয়ার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হননি।
ভারতের সীমান্ত খোলাই রইল। আর প্রতিদিনই ঢল নামছে শরণার্থীর। ক্রমে সংখ্যাটা প্রায় ৮০ লক্ষে এসে পৌঁছাল। এদের প্রায় ৮৫% হিন্দু।
ভারতের কতটুকু সামর্থ্য এদের সবাইয়ের সংস্থান করে? এদের ঠাঁই হল ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম। অবশ্যই পশ্চিমবাংলা। কিছু লোককে পাঠানো হল উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশেও।
কোনোরকমে চাটাই, দরমা বা পলিথিনের দিয়ে ছাদ বানিয়ে যা হোক একটা আস্তানা। চিকিৎসা প্রায় নেইই। দু-বেলা কোনোরকমে খাওয়ার জোটানোই দুঃসাধ্য। বিদেশি কিছু চ্যারিটি সংস্থা কাজ করেছিলেন। আর দেশিরা তো আছেনই।
তবে এই জনস্রোতে, যেরকম আশঙ্কা করা গেছিল, ক্রমশই একটা সংঘাতের চোরাস্রোত শুরু হল। হিন্দু/মুসলমান, ট্রাইবল/বাঙালই, স্থানীয়/শরণার্থী।
ইন্দিরা যেরকম সাহায্য পেয়েছিলেন দেশের সব ক-টি রাজনৈতিক দলের থেকে, সেটা অসুবিধাও হয়ে দাঁড়াল। পার্লামেন্টে, জনসভায়, পত্রপত্রিকায়—সর্বত্রই সরকারের উপর চাপ। সবাই চাইছেন একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। অন্তত ভারত বাংলাদেশকে সরকারি স্বীকৃতি তো দিক। আর যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ হোক।
ইন্ডিয়ান আর্মি আদৌ রাজিই নয়। সৈন্যসংখ্যায় ও রসদে, বাংলাদেশে থাকা পাকিস্তানি আর্মির থেকে ইন্ডিয়ান আর্মি অনেকটাই এগিয়ে কিন্তু মনসুনের বাংলাদেশ সেই সময়ে অগম্য। কোনো বড়ো অপারেশন করা সম্ভবই নয়। ভয় আছে চিনকে নিয়েও।
তাই শুরু হল মুক্তিবাহিনী।
কতকগুলি নিয়ম মেনে চলতে হবে।
এক, কোনো ভারতীয় সেনাই সীমানা লঙ্ঘন করবে না।
দুই, মুক্তিবাহিনী হবে ১০০% স্থানীয় বাঙালি সেনার সংগঠন। যদিও, ভারতের কিছু বাঙালি, সীমানা পার হয়ে লড়াই করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা সবাই ছিলেন সিভিলিয়ান ও ভলান্টিয়ার।
তিন, মুক্তিবাহিনী শুধু গেরিলা যুদ্ধই করবে। ভারী অস্ত্রশস্ত্র তারা পাবে না। ধ্বংসাত্মক কাজ, গুপ্তচরগিরি, পাক বাহিনীকে ব্যস্ত রাখা; মুখোমুখি সংঘর্ষ নয়—অ্যামবুশ, এইসবই ছিল মুক্তিবাহিনীর কাজ।
আবার ভারতীয় অস্ত্র নিয়েও তারা লড়তে পারবে না। কারণ ধরা পড়লে সমূহ আন্তর্জাতিক সমস্যা। সরকারি মদতেই কিন্তু চোরা পথে যা কিছু রাইফেল, গ্রেনেড পাওয়া যায়। সে অতি সামান্য। রাইফেল প্রতি মাত্র দশটা বুলেট দিলে, মুক্তিবাহিনীর এক নেতা বললেন, আমরা কি বুনো শিকারি? দশটা বুলেট দিয়ে লড়াই করব খান সেনাদের বিরুদ্ধে? ভারতের মদতেই লন্ডনের প্রবাসী বাঙালিরা বেলজিয়াম থেকে অস্ত্র কিনে গেরিলাদের পাঠাতে শুরু করল।
ঢাল, তরোয়াল তো নেইই, এমনকি জুতোও নেই। ভিয়েতনামের গেরিলা বাহিনীও অবশ্য কালো পাতলুন, হাফ শার্ট আর হাওয়াই চপ্পল করে কাটিয়ে দিয়েছিল আমেরিকান আর প্রশিক্ষিত দক্ষিণ ভিয়েতনামি রেগুলার আর্মির বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদের অস্ত্রে কোনো কমতি ছিল না আর তাদের ছিল দুই প্রজন্মের প্রস্তুতি আর অঙ্গীকার। তবু জুলাই মাস থেকেই ভারতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছিল।
তবে প্রথম থেকেই ভারতীয় আর্মি আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে খিটিমিটি লাগত। সম্পর্কটা সব সময়েই মসৃণ ছিল না। ভারতীয় সেনারা চাইত মুক্তিবাহিনী রেলওয়ে, সেতু, রসদের গুদাম, যোগযোগ ব্যবস্থা—এইসবেই ফোকাস করুক। পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াই-এর সময় এটা নয়। নভেম্বরের আগে তো কিছুতেই নয়। কিন্তু বাঙালি গেরিলারা তো ভিটেমাটি ছেড়ে মরণপণ—স্বজন হারানোর শ্মশানে খানসেনার চিতা তোলাই তাদের ধ্যানজ্ঞান। খানসেনাদের স্থানীয় সহায়ক ছিল রাজাকার, মূলত বাংলাদেশের বিহারি মুসলিম আর কিছু বাঙালি গোঁড়া মুসলিম, যারা আল বদর নামে আরবি সন্ত্রাসবাদী দলের নাম নিয়ে কাজ করত।
কিছু সাফল্য ছিল চমকপ্রদ। মিহির রায় নামে এক নেভির ক্যাপটেন, ছিলেন মুক্তিবাহিনীর ‘ডুবুরী সেনা’র দায়িত্বে। যে পাকিস্তানি আর্মি তো বটেই বা ভারতের জেনেরাল মানেক শ, এমনকি মিহির রায়ও বিশ্বাস করতেন বাঙালিরা লড়তেই পারে না, তার সেই বিশ্বাস কিন্তু ভেঙেছিল।
তিনি রিক্রুট করেছিলেন সেইসব তরুণদের যারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে খান সেনাদের হাতে কোনো স্বজনের মৃত্যু বা ধর্ষণ দেখেছেন, তায় নদীমাতৃক দেশের ছেলেরা সবাই ছিল দারুণ সাঁতারু। প্রায় দুশো প্রশিক্ষিত ‘ফ্রগম্যান’ বিভিন্ন বন্দরে ঢুকে রাতের অন্ধকারে প্রচুর নৌযান ধ্বংশ করে প্রায় এক লক্ষ টন পণ্য ডুবিয়ে দিয়েছিল। এমনকি খোদ নিকসনও ক্ষুব্ধ হয়েছিল এত ক্ষতি নিয়ে।
কিন্তু এ ধরনের খুচরো আক্রমণ করে কি দেশ ছিনিয়ে নেওয়া যায়? সবই চাই। রাইফেল, মর্টার, গ্রেনেড, ওয়াকি টকি, বায়ানোকুলার, পাকিস্তানি টাকা, মেডিকেল কিট... । মিলত না প্রায় কিছুই। বাংলাদেশি নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেছিলেন “এরকম এক এত বীর সেনাদের এত উপেক্ষা আর কখনও ঘটেনি।” মুক্তিবাহিনী দাবি করেছিল শুধু জুলাই মাসেই তারা পনেরো হাজার খানসেনাকে কোতল করেছে। প্রচুর অতিরঞ্জিত হলেও মাত্রাটা বোঝা যায়। দশ- বারো বছরের নিতান্ত বালকেরাও গ্রেনেড নিয়ে পাক আর্মিকে আক্রমণ করত, খুব কম শিশুই ওই ধরনের আক্রমণ থেকে বেঁচে ফিরত। কিন্তু বাঙালিদের মনে ঘৃণা যে কতটা গভীর সেটা বোঝা যায়।
সেই সময়ে, মনে আছে, কলকাতার এক বাংলা দৈনিকে ফলাও করে ছবি চাপা হয়েছিল এক খান সেনার ছিন্ন মুণ্ড হাতে ঝুলিয়ে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের গর্বিত ও উৎফুল্ল ছবি।
শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ।
মাস গেলে মুক্তি সেনাদের মাথা পিছু একটি সাবান বরাদ্দ ছিল। এ ছাড়া আর কিছুই নিশ্চিত নয়, বিশেষত গোলা বারুদ।
তবে দানা পাকিয়ে উঠছিল এক ফৌজের চেহারা। মাও ৎসে তুং-ও লিখেছিলেন, “লড়াই বেশিদিন চললে গেরিলা বাহিনীও ধীরে ধীরে একটি সাবেকি ফৌজের চেহারা নেয়।” মূলত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দলছুট সেনাদেরকে কেন্দ্র করেই একটি ফৌজ-এর সূচনা হল। নেতৃত্বে ছিলেন ওসমানি। ওনার সম্বন্ধেও অভিযোগ ছিল প্রচুর। উনি রিটায়ার্ড এক কর্নেল যাঁর বেশির ভাগটাই কেটেছে সাপ্লাই করে, রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা বিশেষ ছিল না।
এদিকে পাক সেনাদের বর্বরতা বিশেষত সিস্টেম্যাটিক ধর্ষণ দেশে বিদেশে মানুষদের ক্ষেপিয়ে দিচ্ছিল। দেশে বিরোধীরা তো বটেই, কংগ্রেসের লোকজনেরাও ‘লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই’ বলে এমন হট্টগোল শুরু করেছিলেন যে পরামর্শদাতা ডি পি ধর, ইন্দিরা গান্ধিকে বললেন এই অবস্থায় এমারজেন্সি ডিক্লেয়ার না করলে অবস্থা সামলানো মুশকিল।
ঢাকা থেকে NY Times-র রিপোর্টার শ্যানবার্গ জানালেন পাক আর্মি হিন্দুদের দোকানে বড়ো বড়ো করে H লিখে মার্কা দিয়ে রাখতেন। রেইডের সময় চিৎকার করে তলব করত, এইখানে হিন্দুরা কোন্ জন? ঢাকা শহর, তিনি লিখলেন, এখন ‘half deserted’। সর্বত্র বাংলা সাইনবোর্ড নামিয়ে উর্দু সাইনবোর্ড টাঙানো হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে পাকিস্তান থেকে দূর করে দেওয়া হল।
তবে ভারতীয় সেনারা বসে ছিলেন না। তাঁরা সীমান্ত অঞ্চলে রসদ, ভারী কামান, ট্যাংক আর ফৌজও জড়ো করছিলেন। শীতকাল কবে আসবে? সেই অপেক্ষায় ছিলেন।
পাকিস্তানকে প্রচণ্ড অসুবিধেয় ফেলে দিয়েছিল একটি হাইজ্যাকের ঘটনা। ৭১-র ৩০ জানুয়ারি, তখনও বাংলাদেশে বড়ো আন্দোলন শুরু হয়নি, দুই কাশ্মীরি যুবক একটি ভারতীয় ডোমেস্টিক ফ্লাইটের বিমান ছিনতাই করে লাহোরে নিয়ে সেই বিমান বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিলেন। ভুট্টো, সেই সময়ে ইয়াহিয়ার অধীনে এক মন্ত্রী, এয়ারপোর্টে গিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করলেন ওই দুই যুবকের। সারা পাকিস্তানে একেবারে হুলস্থুলু পড়ে গেল। চারিদিক থেকেই অভিনন্দন আর সংবর্ধনা। কিন্তু এর ফলে ভারত সরকার তার আকাশসীমা আর পাকিস্তানের জন্য উন্মুক্ত রাখল না। কয়েক মাস পরেই, এটা একটা বিরাট বাধা হয়ে গেল পাকিস্তানের পক্ষে।
বেআইনি ভাবে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর খবর বিরাট হই চই হয়ে কাগজে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কিসিঞ্জার আর সাহস পেলেন না নতুন করে যুদ্ধসামগ্রী পাকিস্তানে পাঠানোর। পাকিস্তানি জেনারেলদের বুঝিয়ে বললেন তাও ভালো ইকোনোমিক এইড তো পাঠাতে পারছি, অস্ত্র পাঠাতে গিয়ে ধরা পড়লে সেটাও বাতিল হয়ে যাবে।
ঘরে বাইরে, সেনেটে, কংগ্রেসে, টিভিতে কাগজে নিকসন নাজেহাল হয়ে পড়ছেন। ব্লাডকে ওয়াশিংটনে ফালতু পোস্টে সরিয়ে দিলেও ঢাকাতে তার অধস্তনেরা হাল ছাড়েনি, টেলিগ্রামও নয়। নয়াদিল্লি থেকে রাষ্ট্রদূত কিটিংগও ক্রমাগত অস্বস্তিতে ফেলছেন তাঁদের।
ওদিকে জোয়ান বয়েজ গাইছেন ‘সং অফ বাংলাদেশ’ তো ১ আগস্টে ম্যাডিসন স্কোয়ারে ৪০হাজার মানুষকে প্রতিবাদী গান শোনালেন জর্জ হ্যারিসন। রবিশংকর ছবি দেখালেন পাকিস্তানি অত্যাচারের। স্টেজে আসলেন বব ডিলান, গাইলেন ভিয়েতনামের যুদ্ধ-বিরোধী গান, “How many deaths will it take till he knows/ Too many people have died?” তখতে তাউসে লিন্ডন বি জনসন নেই, রয়েছেন রিচার্ড নিকসন। কিন্তু গানের মর্ম তো বদলায়নি।
৮ অগাস্ট ভারত সফরে এসে সোভিয়েট বিদেশ মন্ত্রী গ্রোমিকো ভারতীয় সেনাকে ‘শান্তিকামী সেনা’ বললেন আর অল্প কিছু অস্ত্র, যেমন কামান, পেট্রল বোট, হেলিকপ্টার ইত্যাদি সরবরাহের কথাও জানালেন। তাইই সই। ৯ অগাস্ট একটি সোভিয়েত ভারত চুক্তিও সাবুদ হল। দুই দেশের কেউ আক্রান্ত হলে অন্য দেশ তাকে সাহায্য করবে—সেটাও মোটামুটি স্পষ্টই বলা হল। কিসিঞ্জার প্রমাদ গুনলেন, ভারত-পাকিস্তানের বিবাদ তাহলে তো আর আঞ্চলিক সমস্যা নয় বরং একটা বিশ্বসমস্যা হয়ে গেল, আর ভারতও আর ‘নন অ্যালাইনড’ রইল না।
এর আগে ইন্দিরা গান্ধি, নিকসনের দুটি চিঠি, একটি ১ মে আর অন্যটি কিসিঞ্জার হাতে করে এনেছিলেন জুলাইতে, কোনোটারই উত্তর দেননি। এইবারে সোভিয়েত চুক্তির সাথে সাথেই তিনি আমেরিকায় নিকসনের আমন্ত্রণ স্বীকার করলেন। ব্যালান্সের খেলা।
তবে হাকসারের তৈরি করা বয়ানে ইন্দিরার চিঠি ছিল প্রচণ্ড কড়া। ইয়াহিয়াকে হিটলারের সাথে তুলনা করলেন, আরও লিখলেন পাকিস্তানি প্রচার নেহাতই গোয়েবলীয় কৌশল। উফ। খোদ আমেরিকার বন্ধু দেশকে এরকম অপমান? কী দাপট।
নিকসন-কিসিঞ্জারের তখন জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। সেনাটর টেড কেনেডি নিজের চোখে দেখতে ভারতে আসলেন ১০ অগাস্ট। তাঁকে তো ধরা গৎ-এর রাজকীয় সম্বর্ধনা দেওয়া হলই, আর তাঁকে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হল রেফিউজি ক্যাম্পে। নিজের চোখেই সীমান্তে দাঁড়িয়ে দেখলেন শরণার্থীদের অবিরল স্রোত। এক সময়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি নামলে বাকি সকলের মতন উনিও ভিজে একশা। টেড কেনেডির সঙ্গী ছিলেন শরণার্থী বিশেষজ্ঞ নেভিন স্ক্রিমশও। ভাঙা, নোংরা, দুর্গন্ধ ক্যাম্পে তাঁরা ঘুরে বেড়ালেন। অদম্য কেনেডি গভীর রাত পর্যন্ত এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে গেলেন, দেখলেন হাসপাতালও।
ফিরবার পথে দিল্লিতে প্রেস কনফেরেন্সে তাঁকে প্রশ্ন করা হল বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে না কি? কেনেডি প্রশ্ন এড়ালেন না, সরাসরি বললেন হ্যাঁ। আরও বললেন দেশে ফিরে উনি সাধ্যমতন চেষ্টা চালাবেন পাকিস্তানে যাতে মার্কিন আর্থিক, বিশেষত সামরিক সাহায্য না যায়।
ক্রমশই আমেরিকার পক্ষে পাকিস্তানকে সমর্থন করা বিশেষত সাহায্য করা মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। ভিয়েতনাম নিয়েও তো নাজেহাল। মাই লাই গণহত্যা নিয়ে তুমূল আন্দোলন চলছে। আমেরিকা যায় কোথায়?
আর-একটা ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তন প্রেমে অধীর হয়ে চিন যদি সত্যিই ভারতকে আক্রমণ করে? তখন? চিন যে কমিউনিস্ট।
ভারতের R&AW (পরে RAW) অনুমান করেছিল, চিন হুমকি-টুমকি দেবে, কিন্তু ভারতকে আক্রমণ করতে সাহস পাবে না। চিন থেকে সত্যিই শুরু হল ভারতকে নিয়ে এক নাগাড়ে বিষোদ্গার। কিসিঞ্জার কিন্তু ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে জানালেন চিন-ভারত যুদ্ধ হলে আমেরিকা ভারতকেই সর্বাত্মক সহায্য করবে। তবে ভারত যে অম্লানবদনে সেটা গিলে নিয়েছিল তা নয়।
তাদের বিশ্বাস ছিল দুটি—এক তো সোভিয়েত রাশিয়া আর আর-একটি শীতকাল। বরফে সব কিছু ঢাকা পড়লে চিন আর ভারতে আঁচড়ও কাটতে পারবে না। দূর থেকেই যা চেঁচামিচি করবে।
৭ নভেম্বর, বাংলাদেশের অল্প ভিতরে ইন্ডিয়ান আর্মির উপস্থিতির ছবি ও খবর দিয়ে ফ্রন্ট পেজ রিপোর্ট করলেন NY Times-এর সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গ। ভারতীয় আর্মির বক্তব্য ওটা তাড়া করে ঢুকে পড়া। সীমান্ত অঞ্চলে দুই পক্ষেই হয়। ভারত কিন্তু ক্রমশই বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চলে নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করছেন। বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে দশ মাইল পর্যন্ত অনুপ্রবেশের ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানের সেনারাও আর আদৌ উজ্জীবীত নন। নিজেদের দেশের লোকেদের উপরই হানাদারি ও বর্বরতা চালিয়ে তারাও ডিমরালাইজড।
আর বাংলাদেশে রণাঙ্গণে মুক্তিবাহিনী এখন অনেক বেশি সুসজ্জিত আর সংগঠিত। পাকিস্তানি আর্মি ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। আর ভারতে শরণার্থীর স্রোত কমলেও, থামেনি।
(তখন) আনন্দবাজারের স্টার সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত যশোর পর্যন্ত ঘুরে আসলেন। মুক্তিবাহিনীর হাতে মুরগির ঝোল আর ভাত খেয়ে ফিরলেন। সেই বয়ানে তারিফ আর ব্যাঙ্গ, দুটোই জুটেছিল ওনার কপালে।
অক্টোবরের শেষে কিসিঞ্জার আর-একবার চিনে গেলেন। চৌ এন লাই আর কিসিঞ্জার একেবারে একমত আমেরিকা আর চিন ছাড়া পাকিস্তানকে সরবে সমর্থন আর কেউ করে না। দু-পক্ষই মনে করেন পরের মাসেই ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করবে।
নিকসন রেগেমেগে কিসিঞ্জারকে বললেন ভারতকে সব রকম অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দাও। সে সময়ে সেটা প্রায় বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার। ভারতের কাছে প্রচুর আর খুবই জরুরি।
২৪ অক্টোবরে, ইন্দিরা আর হাকসার, গেলেন ইওরোপে। সেইখান থেকে যাবেন আমেরিকায়। পশ্চিমের দেশগুলি এখন একটু নরম। ফ্রেঞ্চ সাহিত্যিক আঁদ্রে মারলো জানালেন মুক্তিবাহিনীর জন্য তিনি যুদ্ধে যেতেও রাজি। ইয়াহিয়া টের পাচ্ছেন ব্যাপারটা আর সুবিধের নেই। তিনি কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেন। প্রথমেই কুখ্যাত টিক্কা খানকে সরিয়ে একটু কম কুখ্যাত এ এ নিয়াজিকে বসানো হল পূর্ব পাকিস্তানের আর্মি চিফ করে। একজন বাঙালি সিভিলিয়ানকে (আবদুল মোতালেব মালিক) নাম কা ওয়াস্তে গভর্নর করা হল।
কিন্তু তিনি গোঁ ধরলেন, মুজিবের বিচার চাই। অপরাধ দেশদ্রোহিতা। আর তার শাস্তি যে মৃত্যুদণ্ড, সে নিয়ে কারওই দ্বিধা ছিল না। সবাই, এমনকি আমেরিকাও হাঁ হাঁ করে উঠল। পাকিস্তানকে সমস্ত রকমের সাহায্য যে আমেরিকা এইবারে বন্ধ করে দিতে, নিতান্তই বাধ্য হবে, সেটাও জানিয়ে দিল।
বাংলাদেশে চাষ-আবাদ বিশেষ হয়নি, একটা ভয়ানক দুর্ভিক্ষ আগত প্রায়। আমেরিকা ঢেলে সাহায্য পাঠাল—যা হোক, দুর্ভিক্ষ এড়ানো গেল। কিন্তু পাকিস্তানের কথা শুনে কোনো শরণার্থীই আর ফিরে গেলেন না, হিন্দুরা তো নয়ই, মুসলিমরাও নয়।
ইয়াহিয়া আর-একবার চেষ্টা করলেন, যদি কিছু বাঙালি নেতাকে ধরে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি আদায় করে কোনো সমঝোতা করা যায়। কিন্তু কাউকেই পেলেন না। মুজিবের সাথে আলোচনা করতে ইয়াহিয়া আদৌ রাজি নন। হাকসার বললেন, ব্রিটিশ সরকারও তো গান্ধি আর নেহরুর সাথে বারবার কথা চালিয়েছেন। কিসিঞ্জার আক্ষেপ করে বললেন, যে ইয়াহিয়াকে চিনতাম সেই ইয়াহিয়া আর নেই।
আসলে ইয়াহিয়া তখন বাঘের পিঠে বসে। তার আর নেমে আসবার উপায় ছিল না।
৪ নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধি ওয়াশিংটনে। স্টেট ডিনারে সমস্ত প্রোটোকল ভেঙে তিনি পাকিস্তানকে ধুয়ে দিলেন।
পরের দিনে, ওভাল অফিসে, নিকসন কিসিঞ্জারের মুখোমুখি ইন্দিরা হাকসার। দুজনেই ফুঁসছেন। কাজের কাজ কিছুই হল না। খালি ইন্দিরা গান্ধি যে এক পাও পিছোবেন না, সেটা পরিষ্কার হল।
পরের দিনে আর-এক দফা বৈঠক। নিকসন ইচ্ছে করেই ইন্দিরাকে মিনিট তিরিশেক অপেক্ষা করিয়ে রাখলেন, সমঝে দিলেন, বুঝে নাও, কে বস? ওই আর-একদফা নিষ্ফল কথা কাটাকাটি। দু-পক্ষই সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করুক—নিকসনের এই প্রস্তাব ইন্দিরা “একটু ভেবে দেখি” বলে পাশ কাটালেন।
কিসিঞ্জার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন এত খারাপ মিটিং, নিকসন আর কখনোই অন্য কোনো দেশের প্রধানের সাথে করেননি।
যুদ্ধ যে হবেই, সবাই সেটা বুঝল। ঢেউ দেখে নাও ডুবাবার কোনো ইচ্ছে নেই ভারতের।
এদিকে মুক্তিবাহিনী দারুণ লড়ছেন বাংলাদেশে।
কামালপুর, বেলোনিয়াতে বেশ কতকগুলো পাকিস্তানি ঘাঁটি ধ্বংশ হল। লালমনির হাট আর শালুতিকরের সামরিক এয়ারস্ট্রিপ কিছুদিনের জন্য দখলে নিল মুক্তিবাহিনী, সেই সুযোগে ভারত থেকে রসদ চলে এল বিমানপথে।
বড়ো ঘটনা ঘটল বয়রাতে। নভেম্বরের ২১-২২ তারিখ। ভারতীয় আর মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তান হারাল আটটি M-24 লাইট ট্যাংক। এইবারে আকাশযুদ্ধেও অনেক উন্নত প্রযুক্তির তিনটি পাক F-86 স্যাবর জেট দুটি ভারতীয় মিগ-২১ আর আদ্দিকালের ন্যাট ফাইটারের হাতে ধ্বংস হল। একটা কারণ হয়তো পাক এয়ারফোর্সে বাঙালি পাইলট অনেক বেশি ছিল। তাদেরকে বসিয়ে রেখে নিতান্ত শিক্ষানবিশ পাইলটের হাতে ওই বিমান ছেড়ে দেওয়ার ফল। তাও পাকিস্তান আরও কয়েক ব্যাটালিয়ন (হাজার খানেক) সেনা পাঠাল বাংলাদেশে। শেষ চেষ্টা।
কিসিঞ্জার আর নিক্সন, দুজনেই তো ক্ষেপে অস্থির। এক সহকর্মী বললেন UNO-তে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। কিসিঞ্জার জানালেন, মাথা খারাপ? UNO-তে নিয়ে গেলে তো Pakistan will get raped।
সবাই জানেন, খুচখাচ নয়, এইবারে যুদ্ধ লাগবে দুই দেশে। তো অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী করার আছে?
ভারত বাংলাদেশে হানা দেবার দিন ঠিক করেছিল ৪ ডিসেম্বর। কিন্তু ৩ ডিসেম্বরের সন্ধ্যাবেলাতেই পাকিস্তান অতর্কিতে বিমানহানা দেয়—পাঞ্জাব, রাজস্থান আর উত্তরপ্রদেশের বিমানঘাঁটিগুলোতে।
১৯৬৭ সালে আরব ইসরায়েল লড়াইতে ঠিক এমনই ঘটেছিল। সম্মিলিত আরব হানাদারির ঠিক আগেই ইসরায়েল আচমকা বিমান আক্রমণ করে আরব দেশগুলির ৭০% বিমান মাটিতেই ধ্বংস করে ফেলে আর সেই যুদ্ধে ইসরায়েলের জয় প্রায় তখনই নিশ্চিত করে ফেলেছিল। পাকিস্তানও সেরকমই কিছু প্ল্যান করেছিল। নিশ্চয়ই ভারতের কাছে খবর ছিল। সীমান্তের কোনো বিমানঘাঁটিতেই ভারতের কোনো সামরিক বিমান ছিল না।
প্রথম রাউন্ডে ভারতের দারুণ জয়। বিশ্ববাসী জানল পাকিস্তানই প্রথম আগ্রাসী আক্রমণ চালিয়েছে, এইবারে ভারতের হয়ে প্রত্যুত্তর দেওয়াতে কোনো বাধা রইল না।
ইন্দিরা গান্ধি সেদিন কলকাতায়। হুড়মুড়িয়ে ফিরলেন দিল্লিতে। আর পাকিস্তান কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় বিমান হানা চালিয়েই থেমে যায়নি। তাদের স্থলবাহিনী, ট্যাংক, কামান, ইনফ্যানট্রি নিয়ে মাঝ রাত থেকেই হামলা চালাল কাশ্মীর (পুঞ্চ এবং ছাম্ব-এ) আর পাঞ্জাবে (হুসেইনওয়ালা আর ফাজিলকায়)। ৪ ডিসেম্বরেই, ইয়াহিয়া, আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।
ব্যাস, আর রাখঢাকের ব্যাপার নেই। ভারতীয় বিমানও পরের দিনে ঢাকায় বোমা ফেলল। বাংলাদেশের আকাশে ভারতের বিমানের সংখ্যা তিনগুণ। খুব তাড়াতাড়িই বাংলাদেশের আকাশে একচেটিয়া হয়ে গেল ভারতীয় বিমানেরা।
ইয়াহিয়া জানতেনই বাংলাদেশকে রক্ষা করা যাবে না। বিদেশি দাদা-জ্যাঠারা এসে অল্পদিন পরেই যুদ্ধ থামিয়ে দেবে, ততদিনে পশ্চিমা ফ্রন্টে বিশেষত কাশ্মীরে যতটা পারা যায় জমি দখল করে নেওয়া যাক।
ভারতও জানত। মানেকশ-ও জানতেন—মেরেকেটে আটদিন, তার মধ্যেই ঢাকা দখল করতে হবে।
সেই মতন বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী আর ভারতের যৌথ স্ট্র্যাটেজি ছিল, বড়ো রাস্তা, সড়কপথ, সেতু এবং সব শহরকে বাইপাস করে মেঠো পথেই ঢাকা পৌঁছানো। অসামান্য সাহায্য ছিল মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশের নাগরিকাদের। তারা পথঘাটের নদীনালা, সব ঠিক চিনিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে ভারতীয় বাহিনীকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন। এক পাকিস্তানি সেনা পরে বলেছিলেন, ভারতীয় সেনার কাছে আমাদের সিক্রেট কিছুই অজানা ছিল না। কোথায় ট্রেঞ্চ, কোথায় বাংকার, গোলা বারুদের ঘাঁটি—এই সবই ভারতীয়দের হুবহু জানা ছিল।
প্রথম চার-পাঁচ দিনে পশ্চিম ফ্রন্টে একমাত্র ছাম্ব অঞ্চলেই পাকিস্তান কিছুটা সাফল্য পেয়েছিল। পাকিস্তানও যতটুকু পেরেছিল বিমান, আর্টিলারি, ট্যাংক... তার বেশির ভাগটাই এই সেক্টরেই জড়ো করেছিল। আর বাংলাদেশে তো চিন্তা কিছু নেই। লক্ষ্য হচ্ছে কত তাড়াতাড়ি ঢাকায় পৌঁছে যাওয়া যায়।
৬ ডিসেম্বরে ভারত আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। এই যুদ্ধ যে দখলদারির যুদ্ধ নয়—বরং বাংলাদেশকে যোগ্য স্থান করে দেওয়া, এটা তারই লড়াই।
ধুর। এ তে কি আর ভবি ভোলে? সিকিউরিটি কাউন্সিলে আমেরিকা রেজোলিউশন পাঠাল—অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ, সেনা প্রত্যাহার, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হ্যান-ত্যান। ভোটে তেরোর মধ্যে এগারোটা ভোটই ভারতের স্বার্থের বিপক্ষে। পোল্যান্ড আর রাশিয়া শুধু বিপক্ষে। রাশিয়ার ভেটো, আর রেজোলিউশনের বয়ান বদলে আর-একবার ভোট এবং একই ফলাফল।
অগত্যা জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে ভোটাভুটি। সেদিন ডিসেম্বরের সাত তারিখ। কাজের কাজ কিছু নয়, শুধু ভারতের উপর কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো। সেই ভোটে ১০৪ টি দেশ যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে ভোট দিল। রাশিয়া আর ভুটান ছাড়া কেউই নেই ভারতের পাশে।
রাশিয়া পাশে না থাকলে ভারত সেদিন নিঃসঙ্গ ছিল। জনমত সত্যিই ঘুরল। আমেরিকাতেও পত্রপত্রিকা সেনেটরসমূহ, ভারতের যুদ্ধবাজি পছন্দ করলেন না। কিসিঞ্জার আশ্বস্ত হয়ে বললেন, “যাক, বাঙালিদের জন্য ফ্যাঁচফ্যাঁচানি আপাতত মুলতুবি রইল।”
সীমান্ত-সংঘর্ষ এখন টোট্যল ওয়ার। ভারতও, নৌযুদ্ধও শুরু করল। তবে দুই দেশের ভাঁড়ারই তো ঠনঠনে। জাহাজ লাও বললেই বা পাচ্ছেন কোথায়? ভারতের সবেধন নীলমণি বিমানবাহী জাহাজ ভিক্রান্ত, মূলত ব্রিটিশদের তৈরি জাহাজ। সেই ঝরঝরে জাহাজ নিয়ে ভারতীয় নৌসেনারা নিজেদের মধ্যেই ঠাট্টা ইয়ার্কি চালাত। আর পাকিস্তানের তুরুপের তাস আমেরিকার কাছে থেকে লিজ নেওয়া (১৯৬৩) দ্রুত আক্রমণের উপযুক্ত সাবমেরিন ঘাজি। ৩ ডিসেম্বরে যুদ্ধও শুরু হল আর রহস্যজনক ভাবে পরের দিনই, ভাইজাগ থেকে অল্প দূরে ঘাজির সলিলসমাধি হল। সেটা ভারতীয় ডেস্ট্রয়ার রাজদূতের ডেপথ চার্জের ফলে না কি কোনো দুর্ঘটনা, সেটা এখনও জানা যায় না।
ফলে নিষ্কণ্টক ভিক্রান্ত বাংলাদেশের দরিয়ায় ঢুকে চট্টগ্রামের তেলের ঘাঁটি পুড়িয়ে দিল, বন্দরকেও অকেজো করে দিল।
পশ্চিমেও চমকপ্রদ ভাবে ভারতীয় নৌবহর আর বিমানবাহিনী নাগাড়ে হামলা করে করাচি বন্দরকে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত করল, সব থেকে বড়ো কথা, পাকিস্তানের প্রায় ৮০% তেল সেখানে মজুত থাকত, সেগুলিও সম্পুর্ণ নষ্ট হল।
ইয়াহিয়া বললেন, কিছু তো করুন, ইরানের মাধ্যমেই না হোক আমাদের কিছু অস্ত্রশস্ত্র, বিশেষত যুদ্ধবিমান পাঠান। ইরান তৎক্ষণাৎ রাজি, বলল আমেরিকা যদি আমাদের পাঠানো রসদ রিপ্লেস করে দেয় তো আমরাও পাঠাব। জর্ডনকেও অনুরোধ করলেন ইয়াহিয়া, অন্তত আট কি দশটা F-104 স্টার ফাইটার পাঠান। জর্ডন জানাল আপত্তি নেই, তবে আমেরিকার হুকুম ছাড়া সেটা সম্ভব নয়।
টার্কি আর সৌদি আরবকেও তলব করা হল। চোরাপথে পাকিস্তানকে অস্ত্র পাঠাতে সবাই রাজি, যদি আমেরিকা আবার সেগুলি রিপ্লেস করে দেয় তবেই।
নিকসন কিসিঞ্জারের মিটিং চলল দফায় দফায়, স্টেট ডিপার্টমেন্ট আর পেন্টাগনের সাথে। দুই দফতরও স্পষ্ট জানাল এটা একেবারেই বেআইনি। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এরকম কোনো third party transfer-এর ‘ব্যবস্থা’ করতে পারেন না। তো এই দুইজনকে আবার ‘বেআইনি’র ভয় কে দেখায়?
নিকসন, আবার ব্রেজনেভকে ব্যক্তিগত চিঠি পাঠালেন, ভারতকে সামলান। কিসিঞ্জার সোভিয়েত দূতকে একেবারে আল্টিমেটাম দিলেন, বারো তারিখ দুপুরের মধ্যে ভারত যুদ্ধবিরতি না মানলে ‘আমেরিকা বাধ্য হবে অন্য ব্যবস্থা’ নিতে। রীতিমতন হুমকি।
এদিকে জর্ডন থেকে সৌদি হয়ে যুদ্ধ বিমান আসতে শুরু করে দিল পাকিস্তানে।
১০ ডিসেম্বরে কিসিঞ্জার গেলেন নিউ ইয়র্কে। সেইখানে CIA-র গোপন বাড়িতে বৈঠক করলেন চিনের রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়ার সাথে। কিসিঞ্জারের সাথে হাজির (সেসময়ের) UNO-তে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশও। ওঁরা অনুরোধ করলেন চিন যেন সীমান্তে সেনা সমাবেশ শুরু করে দেয়। ভারতের উপর সবরকমের চাপই যেন বহাল থাকে।
১১ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া বুঝলেন, আর আশা নেই। তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। ঘোষণা করলেন শেষ মুসলিমের মৃত্যু না হওয়া অবধি ঢাকা লড়ে যাবে। তার সাথে নিয়াজিকে জানালেন একটু আরও ধরে রাখো, আমেরিকান 7th Fleet এই এল বলে।
ডি পি দার-ও ছুটলেন মস্কোতে। চিন যদি আক্রমণ করে তাহলে? ভারত কি পারবে তিন সীমান্তে লড়াই চালাতে? সোভিয়েত জানাল যে সেরকম হলে সোভিয়েতও তার চিন সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করবে, তবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এখুনি নয়।
যা হোক, ১২ তারিখে দুপুরের মধ্যেই সোভিয়েত দেশ কিসিঞ্জারকে জানাল, ইন্দিরা গান্ধির সাথে কথা হয়ে গেছে। ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের আর যুদ্ধে আগ্রহী নয়। কিসিঞ্জার তাতেই খুশি। একটু তো মুখ বাঁচল। বাংলাদেশ তো গন কেস, তবু যা হোক পাকিস্তানকে নিয়ে চিন্তা নেই। কিসিঞ্জার আর নিকসন, দুইজনেই দুজনের দারুণ প্রশংসা করলেন। এ যেন তাঁদেরই যুদ্ধ জয়।
চিন কিন্তু কথা রাখেনি। সীমান্তে কোনো সেনা সমাবেশই তাঁরা করেননি। খামোখা রাশিয়ার বন্ধুকে চটিয়ে লাভ কী? তবে আমেরিকা একটা দারুণ লোক দেখানো পদক্ষেপ নিলেন, তাঁরা Nuclear powered বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ ও আরও কিছু সঙ্গী যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে দিলেন বঙ্গোপসাগরে। নাকি আটকে থাকা আমেরিকান দূতাবাসের কর্মীদেরকে উদ্ধার করতে।
ভিয়েতনামের যুদ্ধ তখনও চলছে যদিও আমেরিকা প্ল্যান মাফিক মার্কিন সেনারা দেশে ফেরা শুরু করে দিয়েছেন। ঘা তখনও শুকায়নি। আর-একটা এশিয়ান দেশে কি জড়িয়ে পড়বে আমেরিকা? কেউই বিশ্বাস করেননি। কিন্তু একটা নার্ভাসনেস তো ছিলই।
ততদিনে ভারতীয় সেনা ঢাকাকে তিনদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছেন। বাংলাদেশ তো হাতের মুঠোয়। পশ্চিম ফ্রন্ট নিয়ে বোঝাপড়ায় তাই ভারতের আপত্তি আর রইল না। আর সমগ্র পাকিস্তানের অস্তিত্বই যদি বিপন্ন হয়ে ওঠে তবে চিন আর আমেরিকাকে—কিছু তো একটা করতেই হবে। একই সাথে দুই সুপার পাওয়ারের জোটকে অনেক চ্যালেঞ্জ করেছে ভারত, আর নয়।
সেই মতন হাকসার মানেকশকে নির্দেশ দিলেন পশ্চিম ফ্রন্টে সেনারা যেন ‘extreme care’ নিয়ে যুদ্ধ করেন!! এটা ডিফেনসিভ লড়াই, জমি দখলের নয়। UNO-তে ভারত ক্রমাগত বক্তৃতা, বিতর্ক ও আলোচনা করে যতটা পারে সময় আদায় করে নিতে লাগল।
CIA-ও নিকসনকে জানাল ভারত পশ্চিম ফ্রন্টে আর লড়াইতে আগ্রহী নয়, আগ্রাসী তো নয়ই।
১৩ ডিসেম্বর, মানেকশ-এর চিফ অফ স্টাফ জেনারেল জেকব (ইনি আবার একজন ইহুদি—পাকিস্তানের পক্ষে আর-এক বিড়ম্বনা) জানালেন তারা ঢাকার শহরতলিতে পৌঁছে গেছেন। এদিকে রাশিয়াও জানিয়েছে সিকিউরিটি কাউন্সিলে আর ভেটো তারা দেবে না। সময় আর নেই।
মানেকশ তৃতীয় বারের জন্য নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠালেন। জানালেন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের কোনো ক্ষতি হবে না। ভারত জেনেভা কনভেনশন মেনে চলবেন। নিয়াজি পালটা ইউএনও-তে আর্জি পাঠালেন অবিলম্বে সিজফায়ার-এ ভারতকে বাধ্য করা হোক, না হলে বহু প্রাণহানি হবে। ইয়াহিয়া বললেন, ঠিক কথা। ভারতীয় দখলদারি সেনারা তো ইস্ট পাকিস্তানে হলোকাস্ট চালাচ্ছেন।
তবে নিয়াজির সতর্কবাণী ‘বহু প্রাণহানি হবে’ এটা সত্যিই। যুদ্ধের শেষ ক-দিনেও পাক সেনা আর রাজাকারেরা আরও বহু বাঙালি প্রতিষ্ঠিত মানুষকে হত্যা করছিলেন। পুরুষ ও মহিলাও। মানেকশ একটানা প্রচার চালাচ্ছেন মাইকে। আত্মসমর্পণ করুন। আপনাদের সাথে জেনিভা চুক্তি মেনেই আচরণ করা হবে।
ভারত কিন্তু 7th fleet-এর উপস্থিতিকে থোড়াই কেয়ার করে চট্টগ্রাম আর কক্সবাজারে আরও আঘাত করল।
ডিসেম্বর ১৫, 7th Fleet থাইল্যান্ড থেকে একেবারে বাংলাদেশের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেল। নানান গুজব বাজারে। কেউ কেউ বলছেন আমেরিকান মেরিনেরা ল্যান্ড করতে শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশে, কেউ বলছেন ভারতীয় ও মার্কিন সেনার মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। পার্লামেন্টে বিদেশমন্ত্রী স্বরণ সিং পর্যন্ত নিউক্লিয়ার যুদ্ধ এড়াতে যুদ্ধবিরতির পক্ষে সওয়াল করলেন। এ যেন এক হলিউডি মুভি।। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টান টান উত্তেজনা।
সারা দেশে প্রচণ্ড আমেরিকা-বিরোধী হিস্টিরিয়া। বাজপেয়ী থেকে সিপিআইএম, সবাই মিলে বিপুল হই হই। কিসিঞ্জারেরই শুধু কোনো চিন্তা নেই, জানালেন “ইন্ডিয়ানেরা কে কী ভাবল সেই নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যাথা নেই।”
১৬ ডিসেম্বর। নিয়াজিকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন এরকম এক ভারতীয় কমান্ডার চিঠি পাঠালেন নিয়াজিকে—“প্রিয় আবদুল্লা, আমি এখন ঢাকায়। যুদ্ধ তো শেষ। আমি পরামর্শ দিচ্ছি আপনি আমার কাছেই আত্মসমর্পণ করুন। আমি আপনার দায়িত্ব নিচ্ছি।”
নিয়াজিও তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন “মানুষের প্রাণ বাঁচানোই প্রথম কাজ।” আত্মসমর্পণে তাঁর সম্মতিও জানালেন।
মানেকশ তখুনি জেকবকে পাঠালেন।
ফিরে দেখলে জানা যায়, ঢাকার উপকণ্ঠে তখন মাত্র তিন হাজার ভারতীয় সেনা, শহরের মধ্যে পাক সেনার সংখ্যা ছাব্বিশ হাজার। কিন্তু পাক সেনার আর এই হেরে যাওয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। শহরের পথে পথে পাক সেনার সাথে যা লড়াই তা চালিয়েই যাচ্ছেন মুক্তিবাহিনী।
নিয়াজি প্রথমটা একটু মেজাজ দেখালেন। “কে বলল আমি আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছি? আমি তো যুদ্ধবিরতির কথাই বলেছি।” জেকব জানালেন, আধ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে ঠিক করুন কী করবেন?” নিয়াজি আর কোনো সময় নষ্ট করলেন না। আত্মসমর্পণের দাবি মেনে নিলেন।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, সেদিন দুপুরেই, আনুষ্ঠানিক ভাবে অশ্রুসজল নিয়াজি আত্মসমর্পণের চুক্তিতে সাক্ষর করলেন জেনারেল অরোরার কাছে। রেস কোর্সে এই অনুষ্ঠান ছিল খুবই গম্ভীর ও নিয়মমনিষ্ঠ।
প্রচণ্ড হর্ষধ্বনির মধ্যে পার্লামেন্টে ইন্দিরা গান্ধি এই ঘোষণা করলেন। জেনিভা কনভেনশন মেনেই যে ভারত আর মুক্তিবাহিনী চলবে, সেই ঘোষণাও।
পরের দিন, ১৭ ডিসেম্বরে, রাত আটটায় ভারতীয় বাহিনী পশ্চিম ফ্রন্টে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করল।
কিসিঞ্জার খুব খুশি। কিন্তু নিকসনের রাগ আর ফোঁসফোঁসানি কমেই না। কিসিঞ্জার কিন্তু এই যুদ্ধ শেষের কৃতিত্ব নিজের কোলেই টানলেন, “আমরা পরাজয়কে বিজয় করে তুলেছি।” তারপর সারাদিন রিপোর্টারদের ফোন করে নিজের ভূমিকা বিস্তারিত জানালেন। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে জানালেন, “বাবারে, এই ভারতীয়গুলো... জানি না আপনারা এতদিন ওদের কী করে সহ্য করে ছিলেন?” কিসিঞ্জার অতঃপর ইউএনও-তে একটি নিস্তেজ রেজোলিউশনের খসড়া পাঠালেন। বিমর্ষ বুশ বললেন “এইসব মিটলে আমি আর জাতিপুঞ্জে থাকতে চাই না। রোয়ান্ডার মতন একটা ঠান্ডা জায়গায় বদলি চাই।”
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে মুজিব এলেন ঢাকায়। রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হল।
প্রতিশ্রুতি মতন ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিলেন।
তবে বাংলাদেশে নিউরেমবার্গের মতন কোনো বিচারসভা হয়নি। দুনিয়ার চাঁইদের আর কারওই ওই নিয়ে উৎসাহ ছিল না। মাথাব্যথাও নয়।
ঢাকার রাস্তায় এবং বাংলাদেশের অন্যত্র খানসেনাদের সহযোগীদের উপর বেশ কিছু নির্যাতন আর হিংসার খবর আসছিল। বাধ্য হয়ে, প্রতিরক্ষার জন্য, পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের হাতে কিছু অস্ত্র তুলে দেওয়ার মহানুভবতাও দেখিয়েছিল ভারতবর্ষ। যাঁদের কথা, কিছুটা তথ্যাভাবেই লিখতে পারিনি, তাঁরা হচ্ছেন বাংলাদেশের ‘বিহারি’ মুসলিম। যুদ্ধের পর স্বাভাবিক ভাবেই দারুণ দুর্দশায় দিন কাটে ওনাদের। ভারত বা পাকিস্তান কেউই চায়নি ওদের। আর বাংলাদেশে তো তারা ঘৃণিত ঘরশত্রু।
ঢাকার পতনের পর, পাকিস্তানে তখন আর-এক মিলিটারি অভ্যুত্থানের জোর গুজব। দু-দিন পরেই ইয়াহিয়া পদত্যাগ করে ভুট্টোকে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন। ভুট্টোও তৎক্ষণাত তাঁকে গৃহবন্দি করলেন। আট বছর পরে মুক্ত হলেও তিনি আর প্রকাশ্যে আসেননি। নিভৃতেই তাঁর মৃত্যু হয়। ভগ্নহৃদয় নিয়াজিও নিজের দেশে ফিরে শুধু অপমান আর লাঞ্ছনা পান। এই ভুট্টোও এক আগামীতে পাকিস্তানের বধ্যভূমিতে ফাঁসিকাঠে দোল খেলেন সাধারণ কয়েদির মতন। এইই ভবিতব্য।
অনেক ধন্যবাদ ডিডি।
কিন্ত পশ্চিম সীমান্তে লাহোরের ইছোগিল খাল পর্যন্ত ভারতীয় ফৌজ পৌঁছে যাওয়া এবং সিমলা চুক্তির কথা ? অন্তত এক পারাগ্রাফ?
এই ব্লাড টেলেগ্রাম বইটা ২০১৩-১৪ তে পড়েছিলাম। নিক্সন কিসিঞ্জার সময়কার বিভিন্ন ডিক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টস ভিত্তি করে লেখা। পড়তে পড়তে একেক সময় এমন মাথা গরম হয় যে কি বলব।
৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এলে রাশিয়া তাদের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন শো করে। যা অনেক আগে থেকে সেখানে অপেক্ষা করেছিল .
সোভিয়েত নিউক্লিয়ার সাব আগে থেকেই পজিসন নিয়ে থাকতে দেখে ৭ম নৌবহর মুখ ঘুরিয়ে ফিরে যায় .
এটা মুটামুটি আয়কসেপ্টেড তথ্য .. এই লেখায় বাদ পড়ে যাওযায় ওই জায়গাটা একটু অসম্পূর্ন লাগছে
কমোডোর পেরি কি ওই নৌবহরের লিডিং যুদ্ধজাহাজ ছিল ? কেমন আবছা মত ওই নামটা মাথায় আসছে।
আচ্ছা।
আসলে ব্যাপারটা কী, উৎসব স্পেশালে প্রায় সব লেখাই খুব স্লিম, ট্রিম। এক কাপ কফি খেতে খেতেই এক একেকটা লেখা শেষ হয়ে যায়। আর এই লেখাটা তো এমনিতেই বেশ রেকারিং ডেসিমেলের মতন ধ্যড়ধ্যাড়ে - তাই ইচ্ছা থাকলেও অনেক প্রসংগ বাদ দিয়েছি।
@রঞ্জন। সিমলা চুক্তি নিয়ে এই বইতে যেটুকু আছে সে টুকুই লিখছি - ১৯৭২' জুন মাসে এই চুক্তি হয়। ভারতের হাতে দরাদরির সবকটা তাস থাকা সত্ত্বেও ভারত প্রায় যুধিষ্ঠিরীয় মহানুভবতা দেখায়। সব যুদ্ধবন্দী ফেরৎ দেয়, ইনক্লুডিং যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার স্পেসিফিক অভিযোগ ছিলো। আর এটা কিন্তু মুজিব সরকারের সন্মতি নিয়েই। প্রায় পাঁচ হাজার স্কোয়ার কি মি অধিকৃত পাক ভূমিও ফিরিয়ে দেয় ভারত।
মানেকশ বলেচিলেন (প্যারাফ্রেজিত) "পরাজিত সৈন্যদলকে কখনোই বিশ্বাস করতে নেই। বদলা তারা নেবেই"। বিরোধী দলও সন্তুষ্ট ছিলো না, কথিত ছিলো যুদ্ধে আমরা যা জিতেছি সিমলায় আমরা সেটাই হারালাম।
বাকীটাও লিখছি।
@রঞ্জন -পাক ভারত যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে আমেরিকা খুব`ই উদ্বিগ্ন ছিল। কিছুটা কারণ পাকিস্তানের প্রায় সব বড় শহর `ই পুবের সীমান্ত ঘেঁষা। বিশেষতঃ লাহোর। ভারতের আর্টিলারীর সহজ আওতায়। তূলনীয় একমাত্র ভারতীয় শহর অমৃতসর। কিন্তু সেখানে পাক মোটেই হামলা করবে না।
পশ্চিমা ফ্রন্টের যুদ্ধ নিয়ে এক আধটা বই/ডকু পড়েছি। আনফর্চুনেটলি সেগুলি সবই আর্মির লোকের লেখা এবং সব আর্মির লোকের লেখার (মন্টেগোমারী,জুখব ইঃ) মতনই অসম্ভব বোরিং। তারা ইতিহাস তো লেখেন নি, মনে হয় হেড কোয়ারটারে রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন।
তবে নিকসন কিসিন্জারের টেপ শুনলে বোঝা যায় পাকিস্তান বেশ বেকায়দাতেই ছিলো।
@PM
আপনি লিখলেন।
"৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এলে রাশিয়া তাদের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন শো করে। যা অনেক আগে থেকে সেখানে অপেক্ষা করেছিল .
সোভিয়েত নিউক্লিয়ার সাব আগে থেকেই পজিসন নিয়ে থাকতে দেখে ৭ম নৌবহর মুখ ঘুরিয়ে ফিরে যায় ."
এই তথ্য আমার জানা নেই। কোল্ড ওয়ারের নিয়মমতন সব সাগরেই দুই পক্ষেরই (রাশা, আমেরিকা) কিছু সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজ ঘোড়াফেরা করে। এখনো হয়। সেই মতন রাশিয়ার সাবমেরিন অনেক আগের থেকেই হাজির ছিলো। আমেরিকার সেটা অজানা হওয়ার কথাও নয়। রাশিয়া তার সাবমেরিন "শো" করবে কেনো? আর যুদ্ধ বিরতি পর্যন্ত্য তো ৭থ ফ্লীট বাংলাদেশের কাছেই হাজির ছিলো।
তবে আমেরিকান ৭ ফ্লীটের পিছু পিছু রাশান যুদ্ধ জাহাজও এসেছিলো ভ্লাদিভোস্তক বন্দর থেকে রওয়ানা হয়ে।। তবে তারা যখন বঙ্গোপসাগরে পৌঁছেছিলেন ততোদিনে যুদ্ধও শেষ।
অ্যাক্চুয়ালি ,উপরের এই তথ্যটুকুও আমিও এইমাত্র নেট "ঘেঁটে" জানলাম।
আপনার কাছে আরো তথ্য থাকলে দিন না ? জমবে।
কোন বিচার যে হলো না, এটাই দুঃখের।
ইংরেজী বইতে কমলপুর আর বিলোনিয়াকে কামালপুর, বেলোনিয়া করে দিয়েছে? ঐদুটো ত্রিপুরার সীমন্তবর্তী জায়গা।
লেখাটা প্রচন্ড ভালো, ডিডির লেখা যেমন হয়।
"Selective Genocide" cable by Archer Blood - https://history.state.gov/historicaldocuments/frus1969-76ve07/d125
Note of Dissent by US Consulate of Dacca to Washington Dept of State - https://history.state.gov/historicaldocuments/frus1969-76v11/d19
প্রাইমারি সোর্স - ঘোড়ার মুখের জিনিস! :)
সিমলা চুক্তি নিয়ে একটা গুজব আছে। পাকিস্তানিরা বলে। ভুট্টো সাহেব নাকি যখন সেই মিটিংএ আসেন, তখন তাঁকে দেখেও ইন্দিরাজী উঠে দাঁড়ান নি। এইটা ভুট্টো সাহেব খেয়াল করেন এবং খুব অপমানিত বোধ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল যে তিনি পরাজিত দেশের প্রধান বলেই ইন্দিরাজী এরকম ব্যবহার করেছিলেন। তখন তিনিও ঠিক করেন যে যুদ্ধে হেরে গেলেও এই চুক্তিতে তিনি পাকিস্তানকে জিতিয়ে দেবেন। এবং সেটাই হয়। ভারতের হাতে সব তাস থাকা সত্ত্বেও, কিচ্ছু সুবিধা করতে পারেনি। আসলে তখন হয়তো ইন্ডিয়াও কনফিডেন্সে রয়েছে, ভাবছে যে পরের যুদ্ধে কাশ্মীরও নিয়ে নেবে। কিন্তু সেটা আর হয়নি।
@দীপ্তেন
কাহিনীটি এতটা সরল নয়| ডিসেম্বর ৫ থেকে ৭ এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতকে TASK FORCE 74 নৌবহর দ্বারা আক্রমণের পরিকল্পনা ভারতের বিদেশ মন্ত্রালয়ের গোচরিভুত হয়। অতঃপর শ্রীমতী গান্ধী সরাসরি Brezhnev কে Indo-Soviet (Indo-Russian নয় ) মৈত্রী এবং পারস্পরিক সুরক্ষার গুপ্ত চুক্তি কার্যকর করতে অনুরোধ করেন। তৎক্ষণাৎ Vladivostok থেকে একটি cruiser, একটি destroyer ও চারটি আণবিক ডুবোজাহাজের 10th Operational Battle Group (Pacific Fleet) নৌবহর Admiral Vladimir Krugyalovএর নেতৃত্বে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে রওয়ানা হয়।
সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক সেই সময়ে একটি Soviet নৌবহর Malacca প্রণালী দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে গৃহবন্দরে ফিরছিল। এই নৌবহরে একটি cruiser, একটি destroyer এবং দুটি আণবিক ডুবোজাহাজ ছিল। এই বহর তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে সিংহলের দিকে যাত্রা করে এবং 10th Operational Battle Group এ যোগদান করে। Admiral Krugyalov এর নেতৃত্বে সর্বমোট দুটি cruiser, দুটি destroyer, ছটি আণবিক ডুবোজাহাজ আর কিছু ছোট সৈন্যবাহী জাহাজ TASK FORCE 74 এর বহরপ্রধান যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ USS Enterprise (Star Trek এর নয় )এর সম্মুখবর্তী হয়ে তার পথ আটকে দাঁড়ায়। ডুবোজাহাজদুটি killer whale কৌশলে জল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এসে আণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেপন নালিকাগুলি খুলে দিয়ে ভীতি প্রদরদর্শনকারী ভঙ্গিতে দাঁড়ায়।
এদিকে যেহেতু ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অন্ডকোষের ভূমিকা পালন করে থাকে (বামটি Germany) , তাই একটি ইংরেজ নৌবহর সিংহল দিয়ে আরব সাগরে পৌঁছোবার জন্য যাত্রা করে। তার মধ্যে HMS Eagle নামক যুদ্ধবিমানবাহী পোত, HMS Albion নামক সৈন্যবাহক রণতরী এবং কিছু destroyer ছিল। এই বহরটি সিংহলের কাছে Soviet দের সামনে পড়ে এবং তাদের commander Admiral Gordon 'Sir, we are too late. There are the Russian atomic submarines here, and a big collection of battleships' জাতীয় রিপোর্ট দিয়ে চম্পট দেয়। মার্কিন TASK Force 74 নৌবহর ১৭/১৮ তারিখ নাগাদ Tonkin ফিরে আসে।
নীচের URL এ Admiral Krugyalov এর টেলিভশন সাক্ষাৎকারে এই ঘটনাবলীর বিবরণ ঘোড়ার মুখ থেকে শুনতে পাওয়া যাবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ সাক্ষাৎকারটি রুশ ভাষায় কিন্তু অবধানপূর্বক শুনলে মোটামুটি বোঝা যাবে।
@Ranjan Roy
ইছোগিলের যুদ্ধ ১৯৬৫র ঘটনা। ইছোগিল খাল লাহোর নগরের সীমানায় অবস্থিত। ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী ওদিকে অগ্রসর হয়নি।
কৌশিক সাহাকে ধন্যবাদ।
এতো সব আমার জানা ছিলো না। অল্প যে কয়টা লেখা পড়েছি তাতে পারমনবিক শক্তির জাহাজের কথা কমই ছিলো। বরং সেটার পলিটিকাল ইমপ্যাক্ট কীরকম ছিলো বাংলাদেশের যুদ্ধের শেষ কদিনে সেটাই প্রতিপাদ্য ছিলো।
ইতিহাসের এই এক দারুন ম্যাজিক। যতো দিন যায় তত নানান নতুন তথ্য জানা যায়। যেটা জেনে এসেছি, সেটাও পাল্টে যায়।
দীপ্তেন
ডিডিদা , তখন আমি আপনার কমেন্ট মিস করে গেছিলাম ।কিছু তথ্য দিলাম --
<"In an interview to a Russian TV program after his retirement, Admiral Kruglyakov, who commanded the Pacific Fleet from 1970 to 1975, recalled that Moscow ordered the Russian ships to prevent the Americans and British from getting closer to “Indian military objects”. The genial Kruglyakov added: “The Chief Commander’s order was that our submarines should surface when the Americans appear. It was done to demonstrate to them that we had nuclear submarines in the Indian Ocean. So when our subs surfaced, they recognised us. In the way of the American Navy stood the Soviet cruisers, destroyers and atomic submarines equipped with anti-ship missiles. We encircled them and trained our missiles at the Enterprise. We blocked them and did not allow them to close in on Karachi, Chittagong or Dhaka."
At this point, the Russians intercepted a communication from the commander of the British carrier battle group, Admiral Dimon Gordon, to the Seventh Fleet commander: “Sir, we are too late. There are the Russian atomic submarines here, and a big collection of battleships.” The British ships fled towards Madagascar while the larger U.S. task force stopped before entering the Bay of Bengal "
https://www.rbth.com/articles/2011/12/20/1971_war_how_russia_sank_nixons_gunboat_diplomacy_14041
>
Another telephone conversation between the scheming duo reveals a lot about the mindset of those at the highest echelons of American decision making:
Kissinger: And the point you made yesterday, we have to continue to squeeze the Indians even when this thing is settled.
Nixon: We've got to for rehabilitation. I mean, Jesus Christ, they've bombed—I want all the war damage; I want to help Pakistan on the war damage in Karachi and other areas, see?
Kissinger: Yeah
Nixon: I don't want the Indians to be happy. I want a public relations programme developed to piss on the Indians.
Kissinger: Yeah.
Nixon: I want to piss on them for their responsibility. Get a white paper out. Put down, White paper. White paper. Understand that?
Kissinger: Oh, yeah.
Nixon: I don't mean for just your reading. But a white paper on this.
Kissinger: No, no. I know.
Nixon: I want the Indians blamed for this, you know what I mean? We can't let these goddamn, sanctimonious Indians get away with this. They've pissed on us on Vietnam for 5 years, Henry.
Kissinger: Yeah.
Nixon: Aren't the Indians killing a lot of these people?
Kissinger: Well, we don't know the facts yet. But I'm sure they're not as stupid as the West Pakistanis—they don't let the press in. The idiot Paks have the press all over their place.
থ্যাম্ক ইউ PM।
এ গুলো জানা ছিলো না।
গত বছরের ৪/৫ সেপ্টেম্বরে আরো কিছু নিকসন কিসিন্জার টেপ "বেরিয়েছে"। নেটেও পাওয়া যায়। আলসেমীতে দেখি নি।
নিকসন কিসিন্জার একেবারে অবসেসভলি অ্যান্টি ইন্ডিয়া ছিলো। শুধু সরকারই নয়, একেবারে ভারতীয় জাতি নিয়েও ঘোর বিদ্বেষী ছিলেন। চৌ এন লাইও।
ডিডিদা /দীপ্তেন এক লোক বলে জানতাম ... সুদীপ বাবুও একই লোক না আলাদা ?
আরে ছ্যা ছ্যা। সবই তো কেন্দ্রগতং নির্বিশেষমের একেবারে চ।
গুচর জন্মলগ্ন থেকে ভালো নাম (দীপ্তেন) ও পরে ডাকনাম (ডিডি)নিয়ে অবিরত লিখে আসছি। বছর চোদ্দো পনেরো তো হয়েই গেলো।
তারপরে অধুনা কী হইতে কী হইয়া গেলো - লগিনের চক্রব্যুহতে পড়ে আর তো বেরোতে পারি না। সেই নাম /পদবী , কান কটকট করে কি না - এ সব নিয়ে ছাপা হচ্ছে।
অন্যরা কী সুন্দর নিজ নিজ নিকে লিখে থাকে। হায়।
দীপ্তেন /ডিডি
<
বোঝ --কদিন আগেও ইমোজি পড়ত এখন আর পড়ছে না