‘শুনুন, আপনাকে বলতে আমার যথেষ্ট ইয়ে কষ্ট হচ্ছে... কিন্তু ব্যাপার স্যাপার তাে সবই দেখছেন।' চশমা খুলে শুকনাে হাতেই মুখটা সজোরে ঘষেন মনােজ। একটু চোখ বোজেন -রিভলভিং চেয়ারে হেলিয়ে প্রায় কাৎ হয়ে পড়েন। তারপর ধরমর করে আবার সামনে ঝুকে গােল গােল চোখ করে তাকান। সরাসরি অশােকের চোখে।
অশােকের সময় থেমে আছে। সে ঠায় বসে থাকে। অপলক চোখে তাকায় বসের চোখে।
‘আপনাকে তাে আমরা আর রাখতে পারছি না।' এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলেই ফেলেন মনােজ। আপনার তাে প্ৰায় ইয়ে ঊনতিরিশ বছর হলাে, ঠিক? ভালােই টাকা পাবেন। পি এফ, গ্র্যাচুইটি ইয়ে এইসব নিয়ে।
অশােক চুপ করে থাকে। এই সময়ের জন্য মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাে আজ প্রায় দুই বছর হয়ে গেলাে। এক একটা দিন যায় আর অশােক ভাবে যাক আরেকটা দিন বাঁচলাম। বস লং লীভে গেলে ও স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় অশােক - বস নিজেই ছুটিতে - নিশ্চয়ই কোভালামের বীচ থেকে লং ডিসট্যান্স ফোন করে আমায় স্যাক করবে না। এই করতে করতে ভয় পেতে পেতে ভয় পেতে পেতে ভয় পেতে পেতে দুই বছর হয়ে গেলাে, মনে মনে অনেকবারই এই সীনের মুখােমুখি হয়েছে অশােক। সব সংলাপই নিজের মনে বলে বলে মুখস্থ হয়ে গেছে। এও জানে তার বস মনােজকেও বারবার রিহ্যারস্যাল দিতে হয়েছে। একসাথে ওঠা বসা প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেলাে, অফিসের পিকনিকে আর ফ্যামিলি ডে আউটে কতবারই তাে দুই পরিবার খুব কাছাকাছি। দুজনের বউ’র মধ্যেও খুব প্রেম না থাকলেও যথেষ্ট চেনাজানা আছে। আপদে বিপদে দুজনেই দুজনের বাড়ীতে ছােটেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন। আরাে সমস্যা মনােজের ছেলে আর অশােকের মেয়ে একই কলেজে পড়ছে -সহপাঠী ও বন্ধু।
‘অনেক চেষ্টা করেছিলাম ,বুঝলেন?' মনােজ বলে। ‘অন্ততঃ আরাে কিছুদিন যদি উই ক্যান বাই সাম টাইম। কিন্তু ত্রিপাঠী কে তাে চেনেন ই- কিছুতেই রাজি হলাে না। তাই... বুঝলেন? আপনার তিন মাসের মায়না আর ইয়ে সব রেডি রাখতে বলেছি। আপনি মহেশকে কাজ বুঝিয়ে দিন। মানে। আজকেই...।'
পদচ্যুত লােককে কোম্পা্নি আর রাখতে চায় না। একবার ডিসিশন হয়ে গেলে তক্ষুণি প্রায় ঘাড় ধরে বার করে দেয় - তর আর সয় না।
চিঠিটা এগিয়ে দেয় মনােজ - 'সাইন করে দিন।'
সাপের সামনে মন্ত্রমুগ্ধ খরগােশের মতন জবুথবু হয়ে বসে থাকেন অশােক। রােবটের মতন প্রাণহীন হাতে কাগজটা নেন, কাঁপা হাতে সাইন করেন । প্রায় চোখে জল এসে যাচ্ছিলাে - মনােজ খুব এমবারাসড হয়ে পড়ছিলাে 'উফফফ,কেঁদে না ফেলে'।
সুনন্দ বিশ্বাস তাে বসে ঘরেই একেবারে যাকে বলে পতন ও মূর্চ্ছা - সবাই মিলে ধরাধরি করে বাইরে হলে নিয়ে আসলাে। জ্ঞান ফিরলে কিন্তু সমবেত আহা উহুর মধ্যেও ঐ রেজিগনেশন পেপার সাইন করেই অফিস ছাড়তে হলাে সেদিনই।
এই ক'রে ক'রে বসেদের ভাষায় -ডেড উড তাে কতই দূর হলাে প্রায় সবই পঞ্চাশাের্ধ -অল্প কিছু মধ্য চল্লিশ। প্রৌঢ়দের চেয়ারে বসছে ঝাঁ চকচকে সব যুবক যুবতী। তাদের কাজের ঘরানাই আলাদা। তিনজনের কাজ সামলাচ্ছে এক এক জন -উৎসাহে টগবগ করছে সবসময়। বুড়ােদের দিকে তাকায় অনুকম্পায়। খুব কমই জিজ্ঞেস করে ও অশােকদা -এইটা কী করে করতেন একটু বুঝিয়ে দিন না। এরা সব জানে। সব বােঝে। অনেক ভালাে মেটেরিয়াল কেউ বলেন, বাকিরা মাথা নাড়েন।
চেঞ্জ, চেঞ্জ, চেঞ্জ - কি এই মন্ত্র । আর কী করে বদলাবেন অশােক -বাইশ বছর বয়সে ইংরাজীতে বি এ পাশ করে এই আধা বিদেশী কেমিক্যাল কোম্পানিতে জয়েন করেছিলেন। ঢুকেছিলেন পারচেস ডিপার্টমেন্টে।
আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে এক ধাপ দুধাপ। ব্যাস। অশােক দেখতেন ইম্পাের্ট। আশি সাল নাগাদ সে ছিলাে এক ভয়ানক চক্রব্যূহ। জানতে হতাে আইনের সাত সতেরাে আর কাস্টমস হাউসের সব কজনকে। ব্যাংকের বড়বাবুদের মেজাজ ও ছিলাে অন্যরকম। আর পঁচিশ বছর পরে কাস্টমসের আইন বদলে হয়ে গেছে অনেক বেশি সহজ সরল। ব্যাংকগুলাে তাে বাঘের মতন বসে আছে কী করে আরাে টাকা দেওয়া যায় আর যে সাপলায়ররা নাক উঁচু করে বসে থাকতাে, 'এখন স্টক একেবারে ফাঁকা, নেক্সট দু মাসেও সব বুকড' তারাই এখন মাল বিক্রি করবার জন্য ঝুলােঝুলি। সবই বদলে গেছে। 'দশ গুণ বেশি ইমপাের্ট হয় কিন্তু ই মেইল, কম্পিউটার, মােবাইল -এই সবের কল্যাণে সব খবরই নাকের সামনে। যে কাজ সামলাতে কুড়ি বছর আগে হিমসিম খেতে পাঁচজন আজ মহেশ আর অশােক মিলে সামলাচ্ছে তার দশগুণ কাজ। আসলে মহেশই সব করে -আর অশােক নেহাৎ ই নাম্বার টু। কিন্তু মহেশ কোম্পানির কর্মী নয় -ক্লিয়ারীং হাউস এজেন্সির কর্মচারী, অশােকের কোম্পানিতে ‘আউট সাের্সড'। কর্ণাটকী ছেলে -চমৎকার বাংলা বলে - তুখােড় ইংরাজি।
মনােজ দত্তের ঘর থেকে মাথা নিচু করে বের হয় অশােক -খেয়াল করে ওরই মধ্যে হলের সবাই বিস্ফারিত নয়নে চেয়ে আছে তার মুখের দিকে -'আরেকটা উইকেট পড়লাে'।
একটা ছােট্ট ঘর -অশােক আর মহেশ -দুজনে শেয়ার করে। অশােক মাথা নিচু করে ঘরে ঢােকে, তাও ভালাে মহেশ এখন ঘরে নেই, একটু একাই থাকতে চাইছিলাে অশােক। চেয়ারে ঝুপ করে বসে কিছুক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে দেখে তার ছােট্ট কেবিনকে। সামনের কম্পিউটারের স্ক্রীন সেভারে একটা বড় ঘড়ি -ওটা মহেশই লাগিয়েছিলাে। সামান্য কিছু কাগজ –একটা ডেস্ক ক্যালেন্ডার। এয়ার কন্ডিশন্ড ঘর -কিন্তু নেহাৎই সখের জন্য রাখা একটা পুরােনাে পেপার ওয়েট -সেই যে ভিতরে লাল নীল নক্সা করা -এখন আর পাওয়াই যায় না। আনমনে ড্রয়ার খােলেন -আরাে কিছু কাগজ । একেবারে কোণার দিকে হাত বাড়ালে স্পর্শ পান পাঁপড়ির একটা খুব মৃদু সুগন্ধ। ফিস ফিস করে একটা গলা - বলে 'আছি'।
দরজা খুলে মৈত্রেয়ী ঢােকে। ধপ করে সামনের চেয়ারে বসে বিনা ভূমিকায় বলে 'তাে আপনাকেও যেতে বল্লো অশােকদা' একটু থেমে তারপর বলে 'আমার ও দিন ফুরিয়েছে, মালবিকা লিস্ট দেখেছে -পরের মাসে আমি আর মালবিকা'। অশােক চুপ করে থাকে। মৈত্রেয়ী বলে ‘জানেন তাে দেহপট সহ নট সকলই হারায়? আমারও দিন গেলাে। চুয়াল্লিশ বছর... চাকরি করছি প্রায় আঠারাে বছর বয়স থেকে, লাস্ট ইয়ার পচিশ বছর চাকরির লং সার্ভিস এওয়ার্ড নিলাম মনে নেই?' আরাে প্রশ্ন করে 'কোনাে প্ল্যান করেছেন কি? কী করবেন? টাকা পয়সার সমস্যা ছাড়াও সময়টাও তাে শত্রু। কী করে সময় কাটাবেন? আমি ভেবেই রেখেছি -ঐ যে সুব্রত’র বন্ধুপত্নী যে বুটিকটা খুলেছে, সেখানে কাজ নেবাে। ঠিক সেলসগার্লের চাকরি নয়। আর বেশ ইজ্জত আছে। না? বলুন?' বক বক করতে থাকে মৈত্রেয়ী - যখন রূপ যৌবন ছিলাে তখন এম ডি কেলকার সাহেবের মিস্ট্রেস হয়ে অনেক সুবিধা ভােগ করেছিলাে, অনেক ছড়ি ঘুড়িয়েছিলাে এই মৈত্রেয়ী। কালক্রমে কেলকার সাহেব রিটায়ার করলেন, নতুন এমডির ত্রিপাঠী সাহেবের এইসব দোষ ছিলাে না আর থাকলেও চল্লিশের অপর পাড়ের অস্তগতযৌবনা মৈত্রেয়ীর প্রতি কোনাে দুর্বলতা দেখাননি - কয়েক মাসের মধ্যেই মৈত্রেয়ীকে সরিয়ে একটি চটপটে ছেলেকে রাখলেন নিজের সেক্রেটারি হিসাবে। কোনাে রকমে এডমিন ডিপার্টমেন্টে গিয়ে চাকরি বজায় রাখলাে মৈত্রেয়ী। কিন্তু অশােকের আর ভালাে লাগছে না, ক্লান্ত হাত তুলে বলে মৈত্রেয়ী প্লীজ একটু আমায় সামলে নিতে দিন। কিছু মনে করবেন না। ও কে? মৈত্রেয়ী উঠে পড়ে - ‘না না মাইন্ড করবাে কেনাে। আপনি গুছিয়ে নিন'।
ড্রয়ারটা কেঁপে ওঠে । অশােক হাত ঢুকিয়ে দেয় ড্রয়ারের একেবারে পিছনে মুহূর্তে ফুলেল পরশ পায় - হাত বাইরে আনে। মুঠির ভিতর ছােট্ট পরী বড় বড় চোখ করে তাকায় “তােমার মন খারাপ ?
'আমার আর চাকরি নেই । আজ থেকে... ছুটি।'
'বাঃ । কী ভালাে হলাে। আমরা আরাে গল্প করবাে। না?'
'কোথায় থাকবে পরী। আমাকে তাে এই অফিস ছেড়ে চলে যেতে হবে।'
'ওহ' একটু চিন্তায় পড়ে পরী। যখন চিন্তা করে পরী তখন তার রং হয় বেগেনেটে আর কেমন একটা সামুদ্রিক সৌগন্ধে ভরে যায় অশােকের কামরা। থির থির করে কাঁপতে থাকে পরী -অশােকের মুঠি ভরে ওঠে মখমলি ভায়ােলেট রঙে। চোখে মুখে ছিটে লাগে আর কানের কাছে শােনে গভীর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস। কোন অলৌকিক বেলাভুমিতে আছড়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ'র ব্যার্থ ছোবল। শ্যাওলার আঁশটে গন্ধ।
‘তােমার ব্যাগে থাকবাে আর রাত্রিবেলা ,যেমন নিয়ে যাও আর নিশুত রাতে আমাকে বারান্দায় নিয়ে যাবে - আমরা কালাে আকাশের নিচে দাঁড়াবাে আর মিটমিটে তারাদের ঝিকমিকি আলাে পান করবাে। কেমন?' পরীর রিনরিনে গলা যেন এক জলতরংগের মৃদু অভিসার। সংগীতের প্রচ্ছায়া।
অপলক তাকিয়ে থাকে অশােক -তার করতলে বসে পরী ক্ৰমশঃ খুশির গােলাপিতে আকীর্ণ হয়। পায়ের শব্দে সচকিত অশােক দ্রুত মুঠি বন্ধ করে। মহেশ ঢােকে ,বলে ‘অশােক, সরি টু হিয়ার দ্য নিউস। টেল মি ইফ আই ক্যান হেল্প ইউ এনি ওয়ে'।
ড্রয়ারে পরীকে আস্তে করে নামিয়ে অশােক বলে ‘নাঃ মহেশ, আমি অনেকদিন ধরেই প্রিপেয়ার্ড হচ্ছিলাম - মানে মেন্টালি। ইট ওআজ ওন দি কার্ড। জানতামই তাে। এখন সব গুছিয়ে নিই আর তােমাকে লাঞ্চের আগেই সব হ্যান্ড ওভার করে দেবাে। আর কিছু যদি মনে না করাে আমাকে একটু প্রাইভেসি দেবে, কয়েকটা ফোন করবাে'।
মহেশ লাফিয়ে ওঠে "ইয়েস দাদা নাে প্রবলেম। আপনার যখন দরকার তখন ডাকবেন – আমি টিল দেন। সুরেশের টেবেল থেকে অপারেট করছি"।
অশােক জানে হ্যান্ড ওভার করবার কিছু নেই। সব কাজ বেশ কিছুদিন হলাে মহেশই টেক ওভার করেছিলাে আর অশােক শুধু কমপিউটারের স্ক্রীন সেভারের দিকে তাকিয়ে থাকতাে - ইদানীং তার কাছে ফোন ও আসতাে কম। যার যা দরকার সবাই মহেশকেই জিজ্ঞেশ করতাে। আর অশােক শুধু অপেক্ষা করতাে আর অপেক্ষা করতাে। কখন মহেশ একটু ঘর থেকে বেরােবে - শান্তিতে একটু নিজের জন্য সময়। ড্রয়ার থেকে আলতাে করে তুলে আনবেন পরীকে। ফুর ফুর করে কাঁপবে পরীর পাখা। অই অত্ত টুকুন তাে শরীর - মুখটা অতাে ছােটো যে অশােকের চোখে পড়ার কথাই নয় কিন্তু অশােক ঐ ছােট্টো মুখের দিকে তাকলে সব ডিটেইলস দেখতে পায় স্পষ্ট। স্পষ্ট দেখে সে দু চোখ ভরে দেখে সে - টানা টানা ভুরু, ছােট্টো কপাল, মাথা ভরতি চুল, চুল যেনাে মাকড়সার জালের থেকেও সূক্ষ্ণ। দেখে সরস ঠোঁট, ছােটো ঝিকঝিকে দাঁত। দেখে অসম্ভব সুডৌল চিবুক। ভয় হয় কখন অভিমানে বা দুঃখে পরী হঠাৎ নীল হয়ে যাবে - সাদা ফ্যাকাশে নীল থেকে ঘাের ঘন নীল –এমন নীল যেন কোনাে আলাে তার ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না -নীল চুল ওড়ে অভিমানের বাদলা হাওয়ায় গাঢ় নীল ঠোঁট কাঁপতে থাকে থর থর করে -চিবুকের ডোলে হারিয়ে যায় অতল নীল ঘূর্ণি।
পরী তখন ঝাপসা হয়ে আসে তাকে আর স্পর্শ করা যায় না। কেয়া ফুলের তীক্ষ্ণ গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে
আসে। পরীর দুঃখ আর অভিমানের কম্পন যখন অশােকের ভালােবাসার কম্পনের সাথে মিলে যায় তখন আবার পরী ফিরে আসে।
‘তােমার এখন ছুটি - তাে তােমার মন খারাপ কেনাে?' পরী অবাক হয়। জ্যাকারান্ডা ফুলে ভরা গাছের মতন রেশমী ভায়ােলেট থম থম করে ওঠে।
'তুমি বুঝবে না পরী। কেনাে এই সারা জীবনের মতন ছুটি আমার শিরদাঁড়া বাঁকিয়ে দিচ্ছে, কেনাে আমার শিরা ধমনীতে শীতল রক্তের ঝরণা বয়ে যাচ্ছে, কালাে হয়ে যাচ্ছে দুই চোখ'
অশােক আবার বলে, 'তুমি ঘুমােও পরী'। অশােক ড্রয়ার হাতড়ে বার করে পুরােনাে কিছু কাগজ, প্রায় সবই অদরকারি। কিছু ফেলে দেয় বাজে কাগজের ঝুড়িতে, বাকিগুলাে আলাদা করে রাখে -মহেশকে দিতে হবে।
একবার ফোন তােলে -ডায়াল করে বাড়ীতে। সুপর্ণা ধরে। 'সুপর্ণা শােনাে,শােনাে, একটু আগেই মনােজ আমায় ডেকে টার্মিনশন লেটার ধরিয়ে দিলাে।'
‘ক্কি, ক্কি বলছাে?'
‘টারমিনেশন লেটার। অবশ্য আমিই রিজাইন করলাম। তিন মাসের মায়না, দেড় মাসের লীভ পে আর। গ্রাচুইটি। প্রায় আট লাখ। ব্যাস।'
সুপর্ণা চুপ করে থাকে। এই দিনটার কথা অশােক তাকে বহুবার বলেছে, বহু বার তারা নিজেরা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে আলােচনা করেছে। ছেলেকে বলেছে। ‘প্রিপেয়ার্ড থাকিস।' ছেলে বলেছে ‘চিন্তা কোরাে না - আমি তাে নেক্সট ইয়ারেই চাকরি পাচ্ছি'।
সুপর্ণা বলে ‘মনােজ তােমাকে কী বল্লো?'
'কী আবার বলবে? বল্লো , আমার খুব কষ্ট হচ্ছে এটা আপনাকে বলতে কিন্তু কী করবাে বলুন ? এইই সব। আর শােনাে, আমি আসছি – ঘণ্টা খানেকের মধ্যে। লাঞ্চের আগেই।'
‘কেউ কিছু বল্লো না'
‘নাহ। শুধু মৈত্রেয়ী এসেছিলাে। ওর তাে নেক্সট মান্থ। আর সরােজ তাে টুরে। এই এবার বেরােবাে ঘর থেকে - সবার সাথে হাত মিলিয়ে ...।'
‘আচ্ছা। আসাে।' নিরাসক্তভাবে বলে সুপর্ণা। হয়ত ফোন রেখে দিয়ে ফুপিয়ে কাঁদবে। সারাদিন মন খারাপ থাকবে -অশান্তি।
প্রতীপ ঘরে ঢােকে, একটু লজ্জার হাসি হেসে বলে ‘তাে উনতিরিশ বছর -রাইট ? আর আপনার ছেলেও তাে বি সি এর ফাইনাল ইয়ার। প্রবলেমটা কম। শুনুন। যদি কোনাে চাকরির রিকমেন্ডশনের দরকার হয় তাে চিন্তা করবেন না। আমরা একেবারে বেস্ট ওব রিকমেন্ডেশন দিয়ে দেবাে।'
অশােক চুপ করে থাকে, তার আর ফালতু কথা বলতে ইচ্ছা করে না। বরং মনে হয় কখন এই ঘরখানা থেকে বেরােতে পারবাে -আর ইচ্ছা করে না কোনাে সহকর্মীর আহা উহু শুনতে। সেই একই কথা - ঘ্যানর ঘ্যানর করে। কিন্তু প্রতীপ ওঠে না, বলে 'আপনার তাে দুই মাসের নােটিস তাে আপনি মােবাইলটা রাখতে পারেন কিন্তু কল চার্জ আপনাকে দিতে হবে আর আই ডি কার্ড। এ ছাড়া তাে কোম্পানির এসেট আপনার কাছে কিছু নেই -রাইট ?'
অশােক কোনাে কথা না বলেই মােবাইলটা প্রতীপের হাতে দিয়ে দেন আর বুক পকেট থেকে আই ডি কার্ড। প্রতীপ খুব লজ্জা পায়। 'আরে না না, আপনাকে শুধু এক্সপ্লেইন করতে এসেছিলাম । এগুলাে... এক্ষুণি চাই না।'
হাতের ইশারায় তাকে চলে যেতে বলে অশােক। খুব থতমত খেয়ে উঠে পরে প্রতীপ। 'আচ্ছা টেক কেয়ার।' মুখটা লাল হয়ে গেছিলাে।
ড্রয়ার খুলে অশােক পরীকে মুঠিতে নেয়। 'মাছি তাড়ানাের মত স্রেফ হাত নেড়ে বিদেয় করলাম প্রতীপকে। করে মনটা বেশ খুশি হয়ে গেলাে - জানতামই না লােককে অপমান করতে পারলে এতাে গর্ব, এতাে সুখ হয়।'
পরী অবাক হয় -মুক্তোর মত উজ্জ্বল সাদা হয়ে যায় - বলে ‘কারুর সাথে খারাপ ব্যবহার করলে তােমার ভালাে লাগে ?কেনাে?'
‘লােকের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে বুঝতে পারি নিজের ক্ষমতা। কখনাে ভেবেছি প্রতীপের সাথে নির্ভয়ে ও রকম হাত নেড়ে চলে যেতে বলবাে? হ্যাঃ। কিন্তু পারলাম তত - দুদ্দুর করে দূর করে দিলাম। কী মজা।'
পরী চুপ করে থাকে - তার কপাল থেকে স্নিগ্ধ মুকুতার রং বিচ্ছুরিত হয় -জুই ফুলের সিক্ত সৌরভ টের পায় অশােক। ‘না। কারুর সাথে খারাপ ব্যবহার করাে না। ওতে কেনাে মজা পাবে। ওর দুঃখ কি তােমায় ছুঁয়ে গেলাে না?'
ফোন বাজে ঝন ঝন করে। ঘড়ি দেখে অশােক। দশটা দশ। বারােটার মধ্যেই চুকিয়ে দিতে চায় এই ঝামেলা - তারপর ব্যাগ ঝুলিয়ে শেষবারের মতন বাড়ি ফেরা।
‘হ্যালাে?'
‘অশােক। আমি বুদ্ধ বলছি। শুনলাম তােমার আজ অফিসের শেষ দিন। তাই ভাবলাম তােমাকে ফোন করি। ছ'মাস আগে আমাকেও পাততাড়ি গুটাতে হয়েছিলে-আর সেই দারুণ অপমান আর ত্রাসের দিনে তুমি সন্ধ্যাবেলা আমার বাড়িতে গেছিলে। আমাকে আর রীনাকে অনেক বােঝালে, সান্ত্বনা দিলে, মােটিভেট করলে...'
'হ্যা বুদ্ধদা - ঐ ঘুঁটে আর গােবরের গপ্পো'
‘তাও খুব কম লােকই গেছিলাে আর বিপদের দিনে আমার হাত ধরেছিলাে। তুমি ছিলে। আজ আমার পালা তােমার হাত ধরবার।'
‘পাচ্ছি। আপনার হাতের স্পর্শ পাচ্ছি।'
'আর ভালাে থেকো আর যােগাযােগটা বজায় রেখাে।'
‘রাখবাে। ভালাে থাকবেন। বুদ্ধদা।'
ওয়ারহাউসে রাত দশটা বারােটা পর্যন্ত কাজ করতেন বুদ্ধদা, ট্রান্সপােরটারদের রাখতেন দাঁতে দাঁতে। সব। লরি মালিক, ড্রাইভার আর খালাসীদের চিনতেন -অনেককে ডাকতেন তাদের নামে। এতে খাটতেন কিন্তু একটা নিতান্ত চ্যাংড়া ছােকরি এলাে ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটুট থেকে - রােগী ন্যাংলা মতন চেহারা- গােল গােল চশমা। আর বুদ্ধবাবুর হাতে টারমিনেশন লেটার ধরিয়ে দিয়ে ঐ নবাগত ছােকরা বসলাে ঐ চেয়ারে। এই কলির কেষ্ট সামলাবে কারখানার মজদুর আর ড্রাইভার আর খালাসীদের? ফুঃ। কিন্তু সে সামলালাে - নিতান্ত অবহেলে। যে কাজ বুদ্ধবাবু সামলাতে প্রায় প্রতিদিনই রাত আটটা সাড়ে আটটা, কখনাে রাতে বারােটা পর্যন্ত খেটে করতেন ঐ মুখসর্বস্ব ছেলেটা সে সব কাজ রােজই সেড়ে ফেলতাে ছটার মধ্যে, কী ছিলাে জাদু সেই জানে।
‘পরী, আর তাে কয়েক ঘণ্টা। তারপর বাড়ির পথে। কাল সকালে কী করবাে ঠিক নেই। অফিসের ব্যাগ তুলে রেখে দেবাে লফটের উপর। পরী -তােমাকে কোথায় লুকিয়ে রাখবাে আমার ছােট্টো বাড়ীতে। কোথায় থাকবে তুমি?' পরী অবাক হয় - সে বুঝতে পারে না। সে বড় বড় চোখ করে তাকায় 'কেনাে আমায় লুকিয়ে রাখবে? তুমি আমায় ভালােবাসাে। আমি তােমার বন্ধু। না? তুমি আমায় কত কথা বলাে - তােমার কথা, ছেলের কথা, বউর কথা। তােমার ছেলেবেলাকার কথা। তােমার সব কথাই কি শেষ হয়ে গেলাে? ফুরিয়ে গেলাে?'
অশােক চুপ করে থাকে। তার কত কথাই তাে বলার আছে – কিন্তু বলতে পারে না, অশােকের ইচ্ছা করে এই ভালােবাসা এই স্বপ্ন এই বিশ্বাসের ভুল স্বৰ্গকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে অন্তত একবারের মতন স্বাধীন হয়। আর নয় টালমাটাল পায়ে ভীতুর মতন বেঁচে থাকা - যে দুঃসাহস তেরাে তলা বাড়ীর ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বার আগের মুহূর্তকে আচ্ছন্ন করে রাখে সেই চরাচর ভাসানাে অভিমানে ভরে যায় অশােকের মন।
‘কেনাে তুমি ভয় পাচ্ছাে, লজ্জা পাচ্ছাে সকলের সামনে আমাকে বার করতে? কেনাে আমাকে লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছাে?' অভিমানে তির তির করে কাঁপে পরীর গলা। 'তুমি আমায় ভালােবাসাে না?'
অশােক মাথা নাড়ে। 'তােমায় নিয়ে আমি কোথাও যেতে পারবাে না পরী। তুমি তো সত্যি পরী নও। জীবনের কাছে মার খেতে খেতে আমি তােমাকে কল্পনায় গড়ে তুলেছি। পরী - তুমি কেউ না। কোনােদিনও ছিলে না। তুমি মিথ্যা।' বলে আর অশােকের গলা কাঁপে না। তার হাতের তেলােয় বসে পরী শেষবারের মতন শেষবারের মতন শেষবারের মতন শেষবারের মতন একবার বড় বড় চোখে তাকায়। কী অনুভূতি ছিলাে সেই দৃষ্টিতে অশােক টের পায় না - বুঝবার চেষ্টাও করে না। ঝাপসা হয়ে পরী মিলিয়ে যায় আর ঘন গাঢ় নীল রং ছড়িয়ে পড়ে - অশােকের হাত নীল হয়ে যায়, সেই নীল গড়িয়ে পড়ে তার কেবিনের মেঝেতে সেই নীল বাষ্প হয়ে উড়ে যায় ছােটো জানলায়। এক প্রজাপতির মতন জানলায় ছুঁয়ে যায় সেই অলৌকিক নীল পাখনার স্পর্শ ,তার পর জালনা দিয়ে বেড়িয়ে মিশে যায় শহরের কালি ঝুলি মাখা আকাশে। জুঁই ফুলের শিশির স্নিগ্ধ সুগন্ধ মিলিয়ে যাওয়ার আগে একবার এক ঝলক টের পায় অশােক। শূন্য ড্রয়ারের কাছে বসে থাকে অশােক। আর বসে থাকে। নিষ্ঠুরের মতন দেওয়াল ঘড়ি টিকটিক করেই যায়।।