আমাদের এই সভ্যতা, জানেনই তো, বিয়ারের অবদান। রুটির জন্য নয়, বিয়ার পানের জন্যেই বার্লির চাষ শুরু হয় দুনিয়ায় - সে প্রায় ৯০০০ বিসিতে। সেই ই প্রথম মানুষের চাষ আবাদে হাতে খড়ি। পতিত জমিনে আবাদ করতে একটা বিপ্লবই ঘটে গেলো। মানুষেরা আর হান্টার গ্যাদারার নয়, তাঁরা হলেন কৃষিজীবী। বৈজ্ঞানিকেরা নানান জিনিস মাথা খাটিয়ে বার করলেন। হাল, লাঙল, সেচ এমনকী গণিত আর লিপিও। মেসোপটেমিয়া থেকে সেই সভ্যতা ছড়িয়ে গেলো সব খানে সব খানে সব খানে।
ইজিপ্ট তো বিয়ার ছাড়া এক পা-ও চলতে পারতো না। লোকে পারিশ্রমিক পেতো বিয়ারে। পানীয় বলুন বা ওষুধ, সবেতেই বিয়ার হাজির। পিরামিড যেমন পাথর ছাড়া হতো না, বিয়ার ছাড়াও সম্ভব ছিলো না।
সিন্ধু সভ্যতাতেও বিয়ার আর ওয়াইনের চল ছিলো। সে তো প্রায় ৩০০০ বি সি।
এরপরে ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে চলে আসুন বৈদিক ভারতে। তা বেদের ভারতে সোমের এতো জাঁকজমক যে অন্যান্য নেশা সামগ্রী বেশ ঢাকা পড়ে যায়। যদিও একেবারে অনুপস্থিত নয়। আর কোনো প্রাচীন ধর্মে কি সোমরসের মতন একটা নেশা সামগ্রী এতোটা জাঁকিয়ে বসেছে?
প্রথমেই জানিয়ে রাখি সোম যদিও একটি পানীয়, তবে এটিকে ঠিক মদ বলা চলে না। একটি পাহাড়ি লতা (কেউ ই ১০০% নিশ্চিত নন, সঠিক ভাবে কোনটি, যদিও বেশ কয়েকটি লতাই ‘আসল সোমলতা’ হওয়ার দাবি রাখে) হিন্দুকুশ পাহাড়ে স্বাভাবিক ভাবেই জন্মাতো, সেগুলি নিয়ে এসে থেঁতো করে সেই রস ভেড়ার লোমের ছাঁকনিতে ছেঁকে পান করা হতো। তা সে সব তো যজ্ঞে, নানান অনুষ্ঠান করে। আর সবার বোধহয় অধিকারও ছিলো না পান করার। সোমরস নিয়ে যা আদিখ্যেতা হতো বেদ জুড়ে সে আর কহতব্য নয়। সোম তো একজন দেবতাই হয়ে গেলেন। তাঁর উদ্দেশ্যে ১২০টি সূক্ত রচনা করা হয়, ঋগ্বেদের নবম মণ্ডল পুরোটাই পবমান সোমের উদ্দেশ্যে রচিত। (‘পবমান’ মানে ক্ষরণশীল। অর্থাৎ সোমরসই এখানে দেবতা)। ইংরাজীতে বলে এনথিওজেন। মানে এক ধরনের হ্যালুসিনোজনিক।
তবে সুরাও ছিলো। দেখুন ঋগ্বেদের ১/১৯১/১০, চামড়ার পাত্রে রাখা সুরা পানের কথা আছে। অষ্টম মণ্ডলে কিন্তু দু জায়গায় (২/১২ আর ২১/১৪) সুরাপ্রমত্ত ব্যক্তিদের নিন্দা করা হয়েছে।
কিন্তু মন্ত্র, সংহিতা, উপনিষদের যুগ শেষ হয়ে স্মৃতির শাসন শুরু হতেই সমাজের মাথারা নেশার উপর একেবারে খড়গহস্ত হয়ে পড়লেন।
মনু যদিও এক জায়গায় (৫/৫৬) সুরাপানকে বৈধতা দিয়েছেন, "স্বাভাবিক জীব বৃত্তি" বলে, পরে কিন্তু বহু জায়গায় সুরাপানকে একেবারে চরমতম অপরাধ বলেছেন। ব্রাহ্মণ হত্যা, গুরুপত্নীগমন আর সুরাপানকে একই স্ট্যান্ডার্ডের চরিত্র দোষ বলেছেন (৯/২৩৫)। আরো অনেক জায়গায় সুরাপানকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মনু ছাড়াও পুরাভারতে উনিশজন ঋষি বিধি-নিষেধের উপর স্মৃতি সংহিতা লিখে গেছেন। সেই সংকলনটি উনবিংশতি সংহিতা নামে বিখ্যাত। সবাই সমসাময়িক নন, আপস্তম্ব, গৌতম আর বশিষ্ঠ এঁরা এক যুগের। বাকি ষোলোজন, বিষ্ণু, পরাশর, ভৃগু ইত্যাদি পরবর্তী সময়ের।
তবে সবাই-ই সুরাপানের উপর হাড়ে চটা। বিশেষত ব্রাহ্মণদের সুরাপান তো স্ট্রিকটলি নো নো। অগ্নিপুরাণেও অনেক কানুনের কথা লেখা আছে। অনেক অর্বাচীন, সেখানেও একই আইন। ব্রাহ্মণরা সুরা পান করতে পারবেন না।
সুরা পান করলে (জেনে বা না-জেনেও) ফুটন্ত সুরা পানে বাধ্য করে তার মৃত্যুই বিধান। না হলে তপ্ত শিসা বা রূপা গলায় ঢেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আরো যা সব শাস্তির নির্দেশ আছে সেগুলি পড়লে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়।
তবে এসব তো সমাজপতিদের চোখ রাঙানো। তাদের সব কথাই শুনলে আর বেঁচে থেকে লাভটা কী? সে রামায়ণ,মহাভরতই বলুন বা পুরাণ। সাধারন মানুষেরা, কিংবদন্তির রাজা-রানিরা মায় ঠাকুর-দেবতারাও চুটিয়ে মদ খেতেন।
রামায়ণে দেখুন হনুমান ছোট্টো আকার ধারণ করে রাবণের অন্তঃপুরে গিয়ে দেখেন মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে রাবণের রানিরা পরস্পরকেকে আলিংগন করে শুয়ে আছেন। তো রাক্ষস মাক্ষস - এরা ঠিক আছে, না হয় ড্রিং করলো'ই। কিন্তু মর্য্যাদা পুরুষোত্তোম রাম? তিনিও তো সীতাকে উদ্ধার করে অযোধ্যায় নিয়ে গিয়ে দিব্যি "স্বহস্তে মৌরেয় মদ্য" দিচ্ছেন সীতাকে। সংগে আছে সুসংস্কৃত মাংস।
বালকাণ্ডে দেখুন ঋষি বিশ্বামিত্র আর বশিষ্ঠ অতিথি সৎকার করছেন সুরাভাণ্ড এনে। বা স্বয়ং সীতা দেবী (অযোধ্যা কাণ্ড) গঙ্গাদেবীকে এক হাজার কলসি সুরা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। বানরেরাও প্রচুর মদ টানতেন। সুগ্রীব তো একবার লক্ষণের সামনে টলমল করতে করতে হাজির হলে বিস্তর বকা খান (কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড)।
মহাভারতে মদ খাওয়ার কথার ছড়াছড়ি। যুদ্ধের সময় নায়কেরা নিত্যই মদ্য পান করতেন চাংগা হবার জন্য। ‘কিরাত দেশীয় মদ্য’ অর্থাৎ আমাদের এখনকার নর্থ ইস্ট রিজিয়ন, সেখানকার পাহাড়ি উপজাতিদের তৈরি মদই বোধহয় সব সেরা ছিলো। রথী মহারথীরা তো খেতেনই, তাদের ঘোড়াদেরও খাওয়ানো হতো। মহাভারতে সবাই-ই মদ খেতেন। বাছবিচার ছিলো না। মহিলারাও পান করতেন। মহারাজা যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞে তো মদের এক হ্রদই দান করেছিলেন অতিথিদের জন্য। তবে ঐ করতে গিয়েই কিন্তু যদুবংশ ধ্বংশ হোলো, সেটাও মনে রাখা উচিৎ।
সমাজে সুরাপানের স্বীকৃতি নিয়ে কোনো ব্ল্যাংকেট ব্যান ছিলো না। তবে একটা রাশ তো টান হতোই। কোটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দেখি সুরাধ্যক্ষ নামে একটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পদও ছিলো। তিনি পুরো আবগারি ব্যাপারটাই কন্ট্রোল করতেন। ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে শুরু করে কেল্লায়, বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে যাতে সাপ্লাই ঠিক ঠাক চলে সেদিকে তাঁর নজরদারি থাকতো।
মদ্যপানে নানান আইন মানতে হতো। পানশালায় শুধু ‘সচ্চরিত্র’ লোকেদেরই পরিমিত মদ দেওয়া হতো। শুধু মাত্র নামী লোকেরাই পানশালার বাইরেও মদ নিয়ে যেতে পারতেন। বাকিদের সুরাপান শুধু পানশালার মধ্যেই অ্যালাউ করা হোতো।
কোটিল্য এরপর নানান মদের লিস্টি দিয়েছেন, যেমন মেদক, প্রসন্ন, আসভ, অরিষ্ট, মৈরেয় আর মধু। মধু মানে কিন্তু হানি নয়, আঙুরের থেকে তৈরি ওয়াইন। উনি রেসিপিও দিয়েছেন। একটা শুনুন। মৈরেয় বানাতে কী কী অ্যাডিটিভ লাগে। মেষশৃংগী গাছের ছাল গুড়ের সাথে মিশিয়ে বাটতে হবে। তার সাথে দিন গোলমরিচ ও ত্রিফলা চুর্ণ। ব্যাস,এটাই সিক্রেট রেসিপি। আমের রস থেকেও মদ হোতো। কতো রকমের মদ ছিলো? আয়ুর্বেদে বলে ষাটটি। কোটিল্য উল্লেখ করেছেন প্রায় দশ-বারোটির কথা। অগ্নিপুরাণেও আছে সাত-আটটির নাম। তন্ত্র ঘাঁটলেও গোটা দশেক জেনেরিক মদের নাম পাওয়া যায়।
উৎসবের সময় চার দিনের জন্য আবগারি আইন শিথিল করা হোতো। তখন যে কেউ মদ তৈরি করতে পারতেন (তবে একটা লাইসেন্স ফি লাগতো)। আর ওষুধ হিসেবে বাড়িতেই মদ তৈরি করতেও কোনো বাধা ছিলো না।
বাৎস্যায়নের লেখাতেও নাগরিক জীবনে মদের কথা লেখা আছে। কিন্তু অবাক কথা যে ৬৪ কলায়, যেখানে বিছানা পাতা বা জল থাবড়ানোটাও আর্ট বলে শিখতে হতো, সেই বিশাল লিস্টিতে মদ বানানো বা অ্যাপ্রিসিয়েট করা নিয়ে কোনো কথা নেই।
তবে একবার পুরাণের সময় শুরু হলে আর কল্পনাশক্তিকে বেঁধে রাখা গেলো না। ১৮ টি মহাপুরাণ, ৩৬টি উপপুরাণ, আরো কতো যে পুরাণ, এ প্রায় এক মহাসাগর। এক পণ্ডিত হিসেব করে দেখিয়েছেন যতোগুলি পুরাণ এখনো পাওয়া যায় সেগুলিকে একত্র সংগ্রহ করলে প্রতিটি ৫০০ পাতার প্রায় পাঁচশো ভল্যুম বই হবে।
আর একই গল্পের কতো যে পাঠ ভেদ রয়েছে তার আর সীমা নেই। তবু দেখুন, সাগর মন্থন করে হরেক সামগ্রী পাওয়া যাবার পর প্রাদুর্ভূত হোলো সুরা। দেবতারা সেটি গ্রহণ করলে তাঁরা পরিচিত হন সুর বলে আর দানবেরা অসুর বলে। ভাবুন, পুরো ক্লাসিফিকেশন হয়ে গেলো সুরাপান নিয়ে।
পুরাণের দেবতাদের সুরাপানে কোনো বাধা নেই। এক অবতার বলরাম তো সারাক্ষণই টুপভুজংগ হয়ে থাকেন। গণেশের অনেক মূর্তিতেই দেখা যায় তিনি মদের পাত্র হাতে। দেবীরাও স্বচ্ছন্দে মদ্যপান করতেন। মহিষাসুরকে বধ করতে দেবী চণ্ডী সুরাপান করে যুদ্ধে নামেন। বহু অসুরদলনী বা কালীমূর্তিও মদের পাত্র নিয়ে কল্পিত হয়েছেন।
উল্টো কথাও আছে। অনেক পুরাণেই মদ্যপান নিয়ে নিষেধ আছে। কালিকাপুরাণে তো বলাই আছে মদ্যপ ব্যাক্তিকে হত্যা করলেও পাপ হয় না। আশ্চর্য্য যে এই পুরাণেই নরবলির বিধানও আছে।
বীরাচারী তন্ত্রে মদ্যপান শুধু বিধেয়ই নয়, ওটা মাস্ট। নানান রীতি-নীতিও আছে। যেমন একজনের পাত্র অন্যজনে ব্যবহার করবেন না। পাত্র কখনই শূন্য বা কানায় কানায় টইটম্বুর রাখা উচিৎ নয়। দু জনের পাত্রে ঠোকাঠুকিও, মানে চিয়ার্স করা, নিষিদ্ধ।
কুলার্ণব তন্ত্রের "পীত্বা পীত্বা পুনঃ পীত্বা, যাবৎ পততি ভূতলে" তো খুবই ফেমাস লাইন। যতক্ষণ না মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন ততক্ষণ পান করেই চলুন, শুধু তাই-ই নয়, আবার সামলে সুমলে উঠে বসে ফের শুরু করুন - এরকম নির্দেশই রয়েছে।
বুদ্ধধর্ম হচ্ছে মডারেশনের ধর্ম। মদপান খুব স্পষ্ট ভাষাতেই বারণ করা আছে। কিন্তু বুদ্ধধর্মের অফশুট, তান্ত্রিক বুদ্ধধর্ম সে সব মানে না। তারাতন্ত্র বা রুদ্রযামলে গল্প আছে কৃচ্ছ্রসাধন করে বশিষ্ঠ মুনি হাজার বছর তপস্যা করেও দেবীর সাক্ষাত পেলেন না। যখন ক্রুদ্ধ হয়ে দেবীকে শাপ দিতে গেলেন তখন দেবী এসে নির্দেশ দিলেন মহাচীনে গিয়ে জনার্দনের অবতার বুদ্ধদেবের শিষ্যত্ব নিতে।
বশিষ্ঠ তো মহাচীনে গিয়ে দেখেন বুদ্ধদেব একেবারে টং হয়ে বসে আছেন। অপরিমিত মদ্যপান করে তাঁর চোখ দুটি একেবারে লাল। ক্ষুব্ধ হলেও বশিষ্ঠ তাঁকেই আচার্য্য মেনে তপস্যা শুরু করলেন তান্ত্রিক মতে এবং অবশেষে সিদ্ধি লাভ করলেন।
পুরাভারতের মধ্যে তন্ত্রের পুঁথিগুলো একেবারে শেষের দিকে। ৮০০ থেকে ১০০০ এ.ডি পর্যন্ত। তারপরের পুঁথিদের আর পুরাভারত বলা চলে না।
তবে তন্ত্রের এই মাদ্যিক কাল্ট আমার মনে হয় হিন্দু ধর্মের এক ফুল সার্কেল l সেই বেদের সোমরস নিয়ে মাতামাতি যেন পুনর্জন্ম নিলো তন্ত্রের বিজয়াপান নিয়ে। ধর্ম ও মদের বৃত্ত সম্পুর্ণ হল।
অলংকরণঃ সুমেরু মুখোপাধ্যায়