পেশায় ডাক্তার, নেশায় লেখক শুদ্ধেন্দুর কবিতা, গল্প এবং উপন্যাস মিলিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। সম্পাদনা করেন ‘শামিয়ানা’ পত্রিকা’। চৈত্ররথ তাঁর তৃতীয় উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস কাকতাড়ুয়া পড়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল এই লেখক সম্পর্কে। জীবন্ত ম্যানিকুইনদের নিয়ে লেখা অত্যন্ত জটিল এবং বহুস্তরিক উপন্যাস সেটি। দ্বিতীয় উপন্যাসটি একটি সাইকো থ্রিলার। সে তুলনায় চৈত্ররথের কাহিনি অনেকটাই একরৈখিক। উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্মরত মায়েদের সন্তান রাখার ক্রেশ থাকলেও অসংগঠিত শ্রমজীবীরা, যাদের একটা বিরাট অংশ প্রতিদিন ছোটো বাচ্চাদের অত্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় রেখে কলকাতায় আসে, তাদের বাচ্চাদের জন্যে কি এমন কিছু করা যায় না? এই স্বপ্ন থেকেই চৈত্ররথের জন্ম। এই কাজে নেমে নবনীতা যেমন প্রশাসনিকস্তরের বাধাগুলো টের পেতে থাকে, তেমনি তার পাশে এসে দাঁড়ায় অনেক মানুষ, এমনকি তাদের ফিকে দাম্পত্যেও রং লাগে, বিদেশ থেকে ফিরে আসে তার স্বামী এই শুভ উদ্যোগে পাশে থাকবে বলে। এর পাশাপাশি অনেক গুরুত্বহীন হয়ে যায় নবনীতার নিজের বায়োলজিকাল মা হবার বিষয়টি। যেটি নিঃসন্দেহে একটি পজিটিভ দিক।
পুরাণে চৈত্ররথ ছিল দেববনভূমি, সেই পবিত্র ভূমিকে দেবাসুরের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব পেয়েছিল চণ্ডালপুত্র গন্ধর্ব। পুরাণের এই আখ্যানটিকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন শুদ্ধেন্দু। কিন্তু তা খুব উত্তীর্ণ হয়নি। খানিকটা কষ্টকল্পনা হয়ে থেকেছে। আরও মনোযোগ প্রাপ্য ছিল কাহিনির। তা ছাড়া বড়ো বেশি মুদ্রণপ্রমাদ চোখে লাগে। প্রচ্ছদটি কিন্তু অসাধারণ।
বাংলা সাহিত্যে বালিকাবেলা নিয়ে রচিত উপন্যাস হাতে গোনা যায়। সুলেখা সান্যালের নবাঙ্কুর। পাপিয়া ভট্টাচার্যের ছায়া পড়ে, আলপনা ঘোষের ভাগীরথী। নাহ আর মনে পড়ছে না। আলোচ্য উপন্যাসে সেই অনালোকিত বালিকাবেলাকেই পাখির চোখ করেছেন কবি, গদ্যকার অনুবাদক বিতস্তা। এই দেখার গুরুত্বই আলাদা, কারণ ছোটোবেলার বাধাবন্ধহীন আনন্দ বড়ো তাড়াতাড়ি কেড়ে নেওয়া হয় বালিকাবেলা থেকে। ছেঁটে দেওয়া হয় ডানা। যাজ্ঞসেনী বা মুনাই আবার ক্লেফট প্যালেট নিয়ে জন্মেছিল, তাই তার বাড়তি ছিল শারীরিক প্রতিবন্ধের বাধা। বড়োদের মুখে শোনা দেশভাগ বা নকশাল আন্দোলনের গল্পের সঙ্গে মিশে যায় তার নিজের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। প্রথম ঋতুস্রাব থেকে প্রথম প্রেমের চিঠি তাকে নিজস্ব পরিসর চিনতে শেখায়। উত্তর কলকাতার কালীচরণ ঘোষের গলি থেকে রামপুরহাটের মুক্ত প্রকৃতিতে মুনিয়া খুঁজে বেড়ায় তার অখণ্ড সত্ত্বা। খণ্ডিত করে দেখায় তার কষ্ট। তাই সে মাকে জিজ্ঞেস করে ‘মা তুমি যে বলো আমরা ভারতীয়, আমাদের একটাই দেশ। কিন্তু সকলে যে আলাদা আলাদা দেশের কথা বলে?’ যে বাবা তার মধ্যে চারিয়ে দেন আধ্যাত্মিকতা, তিনিই তার কাছে পাঠানো একটি ছেলের চিঠি পড়ে তাকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকেন, বলেন ‘এই জন্যেই আগেকার দিনে দশ না পেরোতেই বিয়ে দেওয়া হত।... পড়াশোনা এইসব মেয়েদের জন্যে নয়। বিয়ে সংসার আর বাচ্চার জন্ম দেওয়া ছাড়া এর দ্বারা কিছুই হবে না।’ সেদিন মুনাই উপলব্ধি করল পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত জীব নারী। তার মনে জন্ম নিল জেদ। স্বাধিকারের জেদ।
ঝরঝরে গদ্যে লেখা এই সুখপাঠ্য উপন্যাসে ছন্দপতন ঘটিয়েছে সতীর দেহত্যাগের অতিরিক্ত বিবরণ।
শূন্যদশকের কথাকার শান্তনু ভট্টাচার্য গল্পভাষা এবং নির্মাণশৈলীতে এক নিজস্বতা তৈরি করেছেন। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ জনমবৃত্ত (২০১০)-তেই সে প্রতিশ্রুতি দেখা গেছিল। তাঁর কাহিনিতে থাকে এক নিবিড় অন্তর্দৃষ্টি, সামান্য দৃশ্য থেকে তিনি খুঁটে খুঁটে তুলে আনেন অভাবনীয়কে। এই গ্রন্থে এসে দেখা গেল, এবার তাঁর কথাবস্তুতে হাজির অসাধারণ সব চরিত্র। কমলাক্ষ, নিশিকান্ত, ডেভিড, নিধি, আলো মিত্র, বরেন এমন সব চরিত্র হয়তো আমাদের পাশাপাশিই হেঁটে চলে, কিন্তু আমরা তাদের খেয়াল করি না। শান্তনু তাদের তুলে এনেছেন বড়ো যত্নে এবং মমতায়। (কোথাও যেন বিমল করকে মনে পড়ে যায়) যেমন ভূতের গলিতে জন্মানো কনককুমার। তিনি হয়তো এক ব্যর্থ যাত্রা অভিনেতা। প্রতিবার তিনি কাহিনিকারের জন্যে নিয়ে আসেন অদ্ভুত এক একটি জিনিস, যেমন জাঁতি, কোকিল পোষার বাঁশের খাঁচা, খঞ্জনি, মাটির কুঁজো, হামানদিস্তে। আসলে তিনি হারিয়ে যাওয়া সময়ের খানিকটাই তুলে দিতে চাইছেন লেখককে কিংবা পাঠককে। অদ্ভুত জিনিস ছাড়াও অদ্ভুত সব গল্পও তাঁর ঝুলিতে। যেমন তাঁর দুই প্রিয় বন্ধু কমল মিত্র এবং উৎপল দত্ত। দুই শত্রু ছবি বিশ্বাস আর জহর রায়। এদের নিয়ে উদ্ভট সব গল্প। লেখক বিশ্বাস করেন না সেসব, তবু কনককুমার আসেন এবং নানা নামে ডাকতে ডাকতে লেখককে শেষ পর্যন্ত ডাকেন কনককুমার বলে। এই জায়গায় এসে লেখকের সৃষ্টি আর লেখক একাকার হয়ে যায়।
আর এইসব ধরে থাকে তাঁর নিজস্ব ভাষা, ‘তারপর এই চার দেওয়ালের ভেতর আর কী থাকল?—বোধহয় কিছুই থাকল না। কিন্তু দেওয়াল চারটের বাইরে রয়ে গেছে একটা বিরাট শহর। যেখানে রয়েছে পথঘাট, জাহাজঘাটা, শুঁড়িখানা, বেশ্যাপাড়া, নাট্যশালা...’ আর তরঙ্গনগরে নানান চিন্তার তরঙ্গ।
আশার কথা, শান্তনু সেই চিন্তার তরঙ্গ ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
তিনটি বই -ই বিশেষ করে তরঙ্গনগর পড়ার প্রবল ইচ্ছে হ'ল।
ওপরে চারটি বই এর ছবি, যদিও লেখা হয়েছে তিনটি বই নিয়ে। ছবি কিম্বা লেখা ঠিক করে দেওয়া যায়?
সুন্দর এবং সমৃদ্ধ আলোচনা। বর্তমানে অনেক উচ্চমানেের কাজ আমপাঠকদের চোখের আড়ালে থেকে যায়। সাজানো পোস্টের ভিড়ে কতটুকুই বা নজর রাখতে পারা যায়। অসংখ্য ধন্যবাদ।