রমাপদ চৌধুরীর লালবাঈ
ইতিহাসের আকরে লেখক যদি কিছু কল্পনা মিশিয়ে নিজ মুনশিয়ানায় উপস্থাপন করেন তাহলে তা যে কত উপভোগ্য হয় ঐতিহাসিক গল্প উপন্যাসের পাঠক মাত্রই তা জানেন। "ঐতিহাসিক উপন্যাস" শব্দ দুটি একসাথে উচ্চারিত হলে যে লেখকের কথা আমার মতো অনেকেরই প্রথমে মনে আসে তাঁর নাম শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। শরদিন্দু বাবু তার ঐতিহাসিক রচনাকে ফিকশনালাইজড হিস্ট্রির বদলে হিস্টোরিক্যাল ফিকশন বলেছেন। যা জেনে আমার মনে হয়েছে হয়তো শরদিন্দু বাবুর লেখায় ঐতিহাসিক উপাদানের তুলনায় কাল্পনিক উপাদান বেশি। ইতিহাস যেখানে ভীষণ নির্মম লেখকের কলম হয়তো সেখানে কিছুটা সহানুভূতিশীল হয়েছে। আপাত নিরীহ ঘটনা লেখকের কলমের জাদুতে রোমহর্ষক কাণ্ডে পরিণত হয়েছে। আমরা যা পড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছি, আনন্দ পেয়েছি, বেদনা বোধ করেছি। ঐতিহাসিক গল্প উপন্যাসের প্রতি ভালোবাসার শুরু এখান থেকেই।
শরদিন্দু বাবুর লেখা দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে পড়েছি আরো অনেক ঐতিহাসিক উপন্যাস যাদের মধ্যে বাণী বসুর মৈত্রেয় জাতক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জলদস্যু, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ভাঙা ডানার পাখি, দ্বৈপায়নের মীরজাফর, দীপক চন্দ্রের সচল জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য অত্যন্ত প্রিয়। সর্বশেষ এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হল রমাপদ চৌধুরীর লালবাঈ।
সপ্তদশ শতকের কথা, মুঘল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর যখন আওরঙ্গজেব। মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি তখন সর্বাধিক সে সাথে প্রজাপীড়ন ও ধর্মীয় নির্যাতন চরমে উঠেছে। সে সময়ই বাংলার প্রায় স্বাধীন এক রাজ্য মল্লভূম, নাম মাত্র শর্তে মুঘলদের সাথে সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ। সমগ্র ভারতকে এক ধর্মের ছাদের তলায় এনে মুঘল সাম্রাজ্য নিষ্কণ্টক করতে বদ্ধপরিকর আওরঙ্গজেব চূড়ান্ত নির্যাতন শুরু করেছেন বিধর্মীদের উপর। গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দেবালয়। সংগীত, বাদ্য, নৃত্য, চিত্রকলা নিষিদ্ধ হয়েছে। বৈষ্ণব ধর্মীয় মল্লভূমের রাজধানী বিষ্ণুপুর তখন সংগীতের পীঠস্থান। আশ্রয় দিয়েছে একাধিক সংগীতজ্ঞকে। সে সময় বিষ্ণুপুর আসেন তানসেন ঘরানার বংশ দীপ বাহাদুর খান। তার সান্নিধ্যে ধীরে ধীরে সংগীতের যে উৎকর্ষতায় পৌঁছায় বিষ্ণুপুর তা থেকেই জন্ম নেয় বিষ্ণুপুর ঘরানা।
সতেরো শতকের বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ও মল্লভূমের রাজধানী বিষ্ণুপুরের সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক উত্থান পতন এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। উপন্যাসের নাম লালবাঈ হলেও এই উপন্যাসের মূল চরিত্র তাকে বলা যায় না। উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজনীতি। রাজনীতিতে যেমন চিরশত্রু বা চিরবন্ধু বলে কিছু হয়না তেমনি এই উপন্যাসের কোনো চরিত্রকেই ভালো ও খারাপের শ্রেণীবিভাগে আলাদা করে রাখা যায়না। কোনো এক মুহূর্তের লোভ লালসা মত্ত চরিত্র পরের মুহূর্তে ভীষণ মানবিক গুন সম্পন্ন হয়ে উঠেছে। প্রজা-হিতকারী রাজা কখনো হয়ে উঠেছে প্রজা পীড়নকারী অত্যাচারী। মানব চরিত্রের এই দ্বিমুখী রূপকে অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।
উপন্যাসটি শেষ করার পরে তথ্যগুলো নিয়ে ইন্টারনেটে একটু খোঁজাখুঁজি করে যা জানলাম তাতে মনে হল কল্পনার তুলনায় এতে ঐতিহাসিক উপাদান ভরপুর। তবে কি এই উপন্যাসকে ফিকশনালাইজড হিস্ট্রি বলা যায়?
এই ব্যাপারে শেষ কথা আমার সহ পাঠকেরাই বলবেন।
লালবাঈ
রমাপদ চৌধুরী
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স
হার্ডকাভার মুদ্রিত মূল্য: ১৮১ টাকা
লীলা মজুমদারের সুকুমার
লেখকদের যেমন রাইটার্স ব্লক হয় পাঠকদের তেমন হয় কি? কখনো এমন সময় আসে যখন পড়তে ইচ্ছা করে তবে পড়ে কিছুতেই সেই আমেজটা পাওয়া যায়না। বোধয় বেশ কিছু দিন ধরে গম্ভীর, সিরিয়াস লেখা পড়ে পড়ে মগজে একটা সর পড়ে যায়। তাতে মৃদু তরঙ্গ ওঠে ঠিকই কিন্তু কিছুতেই ঢেউ খেলেনা। বহুদিন ধরে মৃদু অনুরণন রেখে যাওয়ার পাশাপাশি এমন লেখাও পড়া দরকার যা হঠাৎ বেশ কাঁপিয়ে দিতে পারে আবার তার রেশও রেখে যেতে পারে বেশ কিছুদিন। সেই কারণেই সুকুমার সমগ্র কিনলাম দিন কতক আগে।
এ এমন এক সম্পদ যা সার্বজনীন, সর্বকালীন। পুরনো হয়না কিছুতেই। বারবার পড়েও তাই আবার পড়ার ইচ্ছা হয়। যেটুকু পড়েছি তা পুনরায় শুরুর আগে এবারে ভাবলাম সুকুমারের জীবন নিয়ে কিছু পড়ার পরে যদি শুরু করা যায় তবে হইত লেখাগুলোই নতুন করে কিছু উপলব্ধি হবে।
এই ভাবনা থেকেই লীলা মজুমদারের লেখা পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির থেকে প্রকাশিত সুকুমার রায়ের জীবনী শুরু করেছিলাম। জীবনী এর আগে অনেক পড়েছি। কিছু ভূমিকার পর জন্ম দিয়ে যার শুরু। মাঝে নানা ঘটনা, জীবনের সম্ভাবনা, সাফল্য, কাজ নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনার পর মৃত্যুতে সে বইয়ের শেষ। জীবনী গ্রন্থ যদি বেশ মোটা হয় তবে তাতে আলোচনার পরিমাণ বেশি থাকে, ঘটনার ঘনঘটা থাকে পাতার পর পাতা। লেখকের লেখার গুনে তা পড়তেও যে খারাপ লাগে এমন নয় কিন্তু অনেক সময়েই তথ্য ভারে ভারাক্রান্ত মনে হয়। চার্লি চ্যাপলিনের প্রামাণ্য জীবনীর বাংলা অনুবাদ পড়ে তাই এতটাই গুমোট লেগেছিল যে লেখকের নামটাও মনে পড়েনা। ঠিক এই জায়গাতেই এই জীবনী ব্যতিক্রম। বহু ভাল ভাল, চিন্তা ভাবনায় ছাপ রেখে যাওয়া জীবনী পড়লেও এই ঘরানায় এমন রসোত্তীর্ণ লেখা পড়িনি। সুকুমারের বংশের ইতিহাস দিয়ে এই লেখার শুরু। উপেন্দ্রকিশোর নিয়ে বেশ কিছু কথা বলে যখন বইয়ের পাতায় সুকুমারের জন্ম থেকে মধ্য যৌবনে অকস্মাৎ ছেদের সময়ে পৌঁছলাম ও অসীম সম্ভাবনাময় এক দুবছরের শিশুর কথা বলে যখন এই বই শেষ হল তখন পুরুষানুক্রমে একটি পরিবারের মধ্যদিয়ে শক্তি, সংস্কৃতি, উৎকর্ষ, সম্ভাবনা, প্রতিভার প্রকাশ, বিকাশ ও প্রবাহ পরিলক্ষিত হল। তার সাথে উঠে এলো তৎকালীন কলকাতার একটি পারিবারিক ছবি। যে সচ্ছল পরিবার সেকালের বেশ প্রগতিশীল মানুষদের প্রতিনিধি যারা অন্নের জন্য হাপিত্যেশ করেনি, সরাসরি জাতীয়তাবাদী সহিংস বা অহিংস আন্দোলনেও যায়নি, বাবুয়ানায় গা ভাসিয়ে দেয়নি অথচ অলক্ষ্যে বাংলা ও বাঙ্গালির কৃষ্টি'কে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
বইটা পড়ে কোনো কোনো পাঠক অভিযোগ করতে পারেন এ ভক্তের দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা বই। কিন্তু সর্বকালের প্রায় সকল জীবনীকারই নৈর্ব্যক্তিক লেখার বদলে জীবনীতে কিছুটা হলেও ভালো ভালো কথাই লিখেছেন। তুল্যমূল্য বিচার করার কাজটি বোধয় সমালোচক প্রাবন্ধিকদের। সে কথা যে আমারও একবারেই মনে হয়নি তাও নয় আবার রসরচনার বাইরে সুকুমারের অন্যান্য লেখাগুলোর সমালোচনা যে খুব কোমল হয়নি সেও দেখেছি। মাত্র ৩৫ বছর ১০ মাস ১০দিন বয়সে সুকুমার রায় ইহজগৎ পরিত্যাগ করেন। বইটা পড়ে আফসোস হয়েছে আহা যদি আরও কিছুদিন বাংলা সাহিত্যে তাঁকে পাওয়া যেত।
সুকুমার
লীলা মজুমদার
প্রচ্ছদ : পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রকাশক: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
পেপারব্যাক মুদ্রিত মূল্য: ১০০ টাকা
প্রাপ্তিস্থান :
অনলাইনে — কলেজস্ট্রীট ডট নেট
বাড়িতে বসে বইটি পেতে হোয়াটসঅ্যাপে বা ফোনে অর্ডার করুন +919330308043 নম্বরে।