এ বইটি ঠিক সাহিত্যের কোন জঁর-এর মধ্যে পড়তে পারে, তা নিয়ে সংশয়ের কথা তুলে বিষয়টিকে সমালোচকের হাতেই ছাড়া হয়েছে। যদিও একইসঙ্গে জানানো হয়েছে এটি ডায়েরিধর্মী কাব্যোপন্যাস। কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক অমিতাভ দাসের এটিই প্রথম উপন্যাস, এর আগে ২০ টিরও বেশি বই লিখেছেন তিনি। এই বইটি সন-তারিখ সমেত টুকরো টুকরো লেখার সমাহার। কালানুক্রমিক, যেন একটা নির্দিষ্ট সময়কালের ডায়ারি লেখা, দিনলিপির গোপনতাকে প্রকাশ্যে এনে কোনো এক সংযোগ ঘটাতে চাওয়াই লেখকের লক্ষ। দু-মাস পাঁচ দিনের এই দিনলিপিতে স্পষ্ট রক্তক্ষরণ প্রত্যক্ষ করা যাবে, ভানহীন। ২০১৭ সালের ৬ জুন থেকে সে বছরের অগাস্ট মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত ছোটো বড়ো এন্ট্রি। এক-একদিনের একাধিক এন্ট্রি রয়েছে, মধ্যবর্তী কিছু দিনের আবার কোনো এন্ট্রিই নেই। কোনো কোনো লিপি আবার মাত্র একটি বাক্যের। একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত অমিতাভ নিজে যে সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক, সেই প্রকাশনা থেকেই বেরিয়েছে এই বইটি। এ বইয়ের মুদ্রণও চোখে পড়ার মতো ঝকঝকে, মানানসই প্রচ্ছদ এঁকেছেন মৌমিতা মজুমদার।
অনেক জলের শব্দে জল দিয়ে আলপনা আঁকা হয়েছে। ভূমিকায় এমনটাই লিখেছেন রাজীবকুমার ঘোষ। এ বইয়ে মোট ১৩টি গল্প। প্রতিটি গল্পের শেষে সে গল্পগুলি কোথায় প্রকাশিত, মায় কোথায় প্রথম পঠিত, সে তথ্য দেওয়া রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, একাধিক গল্প পঠিত হয়েছে, কোনো না কোনো বড়োমাপের গল্পপাঠের অনুষ্ঠানে। একটি গল্প পাঠের সময়ে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, সে তথ্যও সন্নিবিষ্ট। গল্পগুলির প্রকাশকাল ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে। দেশ, শুকতারার মতো প্রাতিষ্ঠানিক পত্রের সঙ্গে ছোটো পত্রিকা, সর্বত্রগামী রাজীবের গল্পগুলি।
বইটির পৃষ্ঠপ্রচ্ছদে ১৩ টি বাক্য লেখা, যা ১৩ টি গল্পের পরিচায়ক সূত্র। সে সূত্র থেকে গল্পগুলি বুঝে ওঠা যাবে না, এক কৌতূহল তৈরি করবে পাঠকের মনে। চিনুয়া আচিবির উদ্ধৃতিদানের মাধ্যমে লেখক একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, যে চ্যালেঞ্জ অন্য কারও উদ্দেশে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি নিজের উদ্দেশে। নিশ্চিতভাবেই এর মাধ্যমে এক প্রত্যয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন রাজীব। চমৎকার মুদ্রিত এই বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন একতা ভট্টাচার্য, যে প্রচ্ছদ অনেক বইয়ের ভিড় থেকে অনেক জলের শব্দকে আলাদাভাবে চোখ টানবে।
মাত্র পাঁচটি ছোট্ট গল্প নিয়ে সংকলন। এতটাই ছোটো, যে তাকে ছোট্ট বলতে হয়। কিন্তু তা বলে এগুলি অণুগল্প নয়। অবশ্য পরিচয়ের ক্ষেত্রে একে প্রোজ বলে চিহ্নিত করা রয়েছে। প্রোজ মানে তো গদ্য। এ বইয়ের গদ্যগুলি আত্মজৈবনিক। গল্প বলার পরিচিত ভঙ্গি বা ছাঁদ এখানে মিলবে না। আত্মজৈবনিক মুক্তগদ্য লেখার যে একটা ধারা সম্প্রতি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, বিশেষ করে সোশাল মিডিয়ার সৌজন্যে, ‘আজীবন নির্বাসনে আছি’ সে ধারাতেই আর-এক সংযোজন। লেখক দীপ শেখর চক্রবর্তীর যে পরিচয় পৃষ্ঠপ্রচ্ছদে দেওয়া রয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই কৌতূহল জাগাতে সক্ষম। শুধু লেখালিখিতেই যে দীপ শেখর নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন না, অন্যান্য শিল্পমাধ্যমেও তাঁর গতায়াত যে স্বচ্ছন্দ, তা বোঝা যাবে প্রচ্ছদ দেখলেই। হ্যাঁ, বইটির প্রচ্ছদশিল্পীও লেখক স্বয়ং।