২০২০ সালের কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত রাণা রায়চৌধুরীর এই বইটি একডজন গল্পের। রাণাবাবু অনেকদিন ধরে লিখছেন। অনেক পাঠকের মধ্যে তাঁর লেখালিখির বেশ গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। উল্লিখিত বইয়ের প্রায় সব গল্পই ২০১৯ সালে প্রকাশিত। দীর্ঘদিন ধরে লেখালিখি করার ফলেই তাঁর লেখনীর আয়ত্তে এখন এক নজর-কাড়া মুন্সিয়ানা। তাঁর লেখা গল্পগুলির প্লটের বিভিন্ন বাঁকও বিশেষ আকর্ষণীয়। তবে বিভিন্ন গল্পে ফিরে ফিরে আসা যৌনতার উপস্থাপনের ক্ষেত্রে হয়তো লেখকের মননে এ বিষয়ে নানারকম পূর্ব-সংস্কারাবদ্ধতা কাজ করেছে, যা তাঁর লিখন-অভিজ্ঞতায় চাপা পড়েনি। যেমন একটি গল্পে, একই বাক্যে এক মহিলার বর্ণনায় প্রথমে ‘অন্তর্বাস ছাড়া’ ও তার পর ‘ব্রা ছাড়া’ লেখা; আর-একটি গল্পে দেখতে পাই ‘তবু পিরিয়ড হলেও সে তো আমার মা!’ এ ধরনের বাক্যবন্ধ আধুনিকমনস্কের পাঠ-অভিজ্ঞতায় আঘাত করবে। ছাপার বেশ কিছু ভুল রয়েছে। এ বিষয়ে বিশেষত প্রকাশকের আরও সতর্ক হওয়া জরুরি ছিল।
চারটি গল্পের বই ‘চৌরাস্তা’। তিস্তা চক্রবর্তীর প্রথম গল্পের বই। অণু ও অতি ছোটোগল্পের ফেসবুক সময়ে দাঁড়িয়ে এবইয়ের চারটি গল্প তাদের আকারের জন্য চোখ টেনে নেয়। আকার আরও নজরে পড়ে ছোটো হরফের মুদ্রণের জন্য, তবে তা অনেক পাঠকের পক্ষে কিঞ্চিৎ অসুবিধাজনকও হতে পারে। ভাষার নিরিখে, প্রথম গল্প ‘মেহেরবান’—হিন্দি-উর্দুবচন-বাচন-শের-শায়েরি এগল্পের মাস-মজ্জা। বেশ চটকদার বটে, কিন্তু পড়তে পড়তে এর ভাষার ব্যবহারে যেন ‘কেমন দিলাম’ গোছের একটা আস্ফালন অনুভূত হয়। দ্বিতীয় গল্প ‘মাটির রঙ লাল’-এর শেষ অনুচ্ছেদ অনেক পাঠককেই নস্টালজিক করবে। মনে পড়বে হয়তো একসময়ের একধরনের বাংলা সাহিত্যের কথা যার শেষে থাকত লাল সূর্যের আশ্বাস, সকলের সুখে শান্তিতে বসবাস করার কথা। বইয়ের তৃতীয় গল্প ‘সেকেন্ড ইনিংস’ বৃদ্ধবিবাহের চমৎকার রসাত্মক কাহিনি। অন্য আর-একটি গল্পে দুই সমকামী নারীর সম্পর্ক, টানাপোড়েন, ও অন্যান্য নানা ব্যক্তি ও সমুদয়ের রিরংসা, শঙ্কা প্রভৃতির। তিস্তা গল্প বলতে পারঙ্গম, তাঁর লিখনে সে সম্ভাবনা ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে৷ সুসম্পাদিত হলে তাঁর লেখা জনপ্রিয়তাই শুধু নয়, অন্য নানা আবডালও ছুঁয়ে ফেলতে সক্ষম হবে।
বাংলা সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মূলত ঐতিহাসিক ও দেশপ্রেমমূলক নাট্যকার রূপে খ্যাত। এ ছাড়াও তিনি বাংলা কাব্যসংগীতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এসবের বাইরেও একজন সরকারি কর্মচারী ও আমলা হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলালের ভূমিকার কথা সেভাবে আলোচিত হয় না। ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও বাংলার কৃষক’ বইটির লেখক শতঞ্জীব রাহার এই কাজ সেদিক দিয়ে গুরত্বপূর্ণ।
শিক্ষা, রুচি, সামন্ততন্ত্র লালিত কৃষ্ণনগরে একটি চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা, ইংরেজি সাহিত্য পাঠ ও বিলেত গমন, বিলেত থেকে ফিরে বাধ্যতামূলক ভাবে ইংরেজদের চাকুরি গ্রহণ, সর্বোপরি নিজের স্বাধীনচিত্ত স্বভাব—সব মিলিয়ে এক বিপরীতমুখী সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে দ্বিজেন্দ্রলালের জীবন অতিবাহিত হয়। কৃষিপ্রধান বাংলার মূল চালিকাশক্তি কৃষকদের জীবন-জীবিকার সমস্যার কেন্দ্রটিকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। এর জন্য তৎকালীন ইংরেজ প্রশাসনের কাছে প্রভূত হেনস্থা ও অপমানও সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উত্তর বাংলায় কৃষকদের ক্রমবর্দ্ধমান দুর্দশা চাক্ষুষ করার পর বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের সঠিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে কৃষকের অধিকারকে হাতেকলমে সুরক্ষিত করেন। দ্বিজেন্দ্রলালের লেখা বিভিন্ন কবিতা ও নাটকের উদ্ধৃতাংশ তুলে লেখক দেখিয়েছেন যে বাংলার কৃষক সম্প্রদায়কে নিয়ে তাঁর উদ্বেগ নিছক কাজে-কর্মেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাহিত্যেও তার প্রতিফলন ঘটেছিল।