এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  শরৎ ২০২০

  • মহিষমর্দিনী থেকে সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনীর বিবর্তন

    সুদীপ্ত পাল
    ইস্পেশাল | উৎসব | ২৩ অক্টোবর ২০২০ | ৫০৮১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৪ জন)
  • সিংহবাহিনী, মহিষাসুরমর্দিনী, দশপ্রহরণধারিণী- চিরদিনই কি তিনি এমন? নিজের তোলা ছবির অ্যালবাম ঘাঁটতে ঘাঁটতে জেগে উঠল এই প্রশ্নটা, আর পাওয়া গেল কিছুটা উত্তরও। বেরিয়ে এল একটা বিবর্তনের ছবি। অ্যালবামের সবচাইতে পুরোনো দুর্গা- মধ্যপ্রদেশের বিদিশায় উদয়গিরি গুহামন্দিরে। ইনি মহিষমর্দিনী, কিন্তু সিংহবাহিনী নন, হাতের সংখ্যাও বারোটা। অনেকে পঞ্চম শতকের এই মূর্তির নাম দেয় মহিষমর্দিনী। মহিষাসুরমর্দিনী নয়- কারণ মহিষটা মানুষ হয়ে ওঠেনি। এখনও অবধি প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরোনো "স্থাবর" দুর্গামূর্তি এটাই। তারপর সময়ানুক্রমে একে একে অ্যালবাম থেকে বেরোলো সপ্তম শতকের কর্ণাটকের আইহোলের দুর্গা- সিংহ যোগ হয়েছে, মহিষটা মহিষের মতই আছে। তারপর এল সপ্তম শতকেরই তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরমের মহিষাসুরমর্দিনী- সিংহ তো আছেই, মহিষ এখানে মানুষের মত- মহিষের মাথা, মানুষের ধড়, তবে এটা বাঙালীর মহিষাসুর নয়। তারপর পেলাম দ্বাদশ শতকের পাল বা সেন যুগের বাংলার মহিষাসুরমর্দিনী- মহিষাসুরের মাথাটা মানুষের মতই- আমরা এখন যেমন দেখি। ধারাবাহিকতা আর ক্রমবিকাশ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। উদয়গিরি আর আইহোলে দেখে হিন্দুশিল্পকলার সূচনাকালের সিংহভাগই বোঝা সম্ভব, তবু শুধু চারটে ছবি দিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। তাই বেরোলাম আরএকটু খোঁজখবর করতে। সেই অনুসন্ধানই এই লেখার বিষয়।



    উদয়গিরির থেকে পুরোনো মহিষমর্দিনীমূর্তিগুলো অস্থাবর (পোর্টেবল) ও ছোট আকারের- এক থেকে তিন ফুট উচ্চতা। দ্বিতীয় শতকের মথুরা, চতুর্থ শতকের বিজয়ওয়াড়া, ইত্যাদি। এনারাও সিংহবাহিনী নন। হাতের সংখ্যা ছয়, চার এরকম। মধ্যপ্রদেশের উদয়গিরি গুহাসমূহ হল সবচেয়ে পুরোনো বড় আকারের হিন্দু স্থাপত্য যা এখনও টিকে আছে, তাই হিন্দু আইকোনোগ্রাফির সূচনাকাল বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার উদয়গিরি। উদয়গিরি হল অজন্তার শেষ পর্যায়ের পরিণত শিল্পগুলির সমসাময়িক। অজন্তা বাকাটক রাজাদের, আর উদয়গিরি গুপ্ত সাম্রাজ্যের মন্ত্রীদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরী। অজন্তা বৌদ্ধ, উদয়গিরি হিন্দু। উদয়গিরিতে দেবী সিংবাহিনী নন।




    ছবি ১: মধ্যপ্রদেশের বিদিশায় উদয়গিরি গুহামন্দিরে মহিষমর্দিনী- পঞ্চম শতক।

    উদয়গিরি থেকে আরেকটু এগোনো যাক। পঞ্চম শতক থেকে আসা যাক ষষ্ঠ শতকে। বুন্দেলখণ্ডের দশাবতার মন্দির- ভারতের প্রাচীনতম টিকে থাকা ফ্রী-স্ট্যান্ডিং হিন্দু মন্দিরের একটি- এখানেও মহিষমর্দিনীর সিংহ নেই, হাতের সংখ্যা চার। উত্তর কর্ণাটকের বাদামি আর আইহোলে- পাশাপাশি চালুক্য রাজাদের দুটো শহর। বাদামি হল দ্বিতীয় প্রাচীনতম বড়মাপের হিন্দু স্থাপত্য- এরাও গুহামন্দির। শৈল্পিক সুষমায় উদয়গিরির থেকে অনেক এগিয়ে, অজন্তার সঙ্গে কিছুটা হলেও তুলনীয়। এখানেও মহিষমর্দিনীর সিংহ নেই। তবে বাদামির প্রায় সমসাময়িক আরেকটি গুহাশিল্প- আইহোলের রাবণফাড়ি গুহা, সেখানে দেখা গেল সিংহ। তবে এখনও উনি মহিষাসুরমর্দিনী হয়ে ওঠেননি, কারণ মহিষটি এখানে অ্যান্থ্রোপোমর্ফিক বা মানবসদৃশ নয়। 



    তাহলে কী ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি এসে মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী হলেন? এই সময়েই কেন? নানারকম ভাবে এর উত্তর দেয়া যায়। প্রথমে সাহিত্যের আঙ্গিকে আমরা দেখব। প্রতি বছর মহালয়ায় যে চণ্ডীপাঠ হয়, সেটি রচিত হয়েছিল দেবীমাহাত্ম্য নাম দিয়ে। মহিষমর্দিনীকে নিয়ে প্রাচীনতম সাহিত্য। এর আগেও শক্তি বা অনুরূপ দেবীর উল্লেখ সাহিত্যে আছে, মহাভারতের দুর্গাস্তোত্রে তিনি মহিষাসুরনাশিনী, তবে মহিষাসুরবধের বিশদ কাহিনী এটিই প্রথম। এটি মার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্ভুক্ত। মার্কণ্ডেয়পুরাণের রচনাকাল তৃতীয় শতক হলেও, দেবীমাহাত্ম্য মোটামুটি ষষ্ঠ শতকে রচিত বলে মনে করা হয়। ভারতবিদ ওয়েণ্ডি ডনিগার এর কাল নিরূপণ করেছেন আনুমানিক ৫৫০ অব্দ। অনেকের মতে এটি আরও শখানেক বছর পুরোনো হতে পারে। বলা যায়, উদয়গিরি ছিল দেবীমাহাত্ম্য তার পরিণত রূপ পাবার আগে নির্মিত। আর রাবণফাড়ি নির্মিত হয়েছিল যখন দেবীমাহাত্ম্য মোটামুটি একটা পরিণত রূপের দিকে যাচ্ছে। ষষ্ঠ শতকের পর থেকে সিংহ প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য- মহাভারতের দুর্গাস্তোত্রে দেবী মহিষাসুরনাশিনী, কিন্তু সিংহের উল্লেখ নেই। দেবীমাহাত্ম্যে দেবী সিংহবাহিনী। তাহলে দেবীমাহাত্ম্যই কি সিংহের আবির্ভাবের কারণ? 



    যে কোনও ধর্মীয় সাহিত্যের লিখিত রূপের আগে থাকে তাদের কথ্যরূপ। কথ্যরূপকে ঘিরেও মূর্তিনির্মাণ হত, তবে লিখিত রূপগুলো মূর্তিনির্মাণকে একটা সুসংহত রূপ দিতে সাহায্য করে। দেবমূর্তি কেমন দেখতে হবে, কীরকম লক্ষণ থাকবে- এগুলোর ব্যাপারে মোটামুটি একটা নির্দেশিকা থাকত পুরাণসাহিত্যগুলোতে। হুবহু অনুসরণ না হলেও এগুলো মোটামুটি একটা স্থিতিশীল আইকোনোগ্রাফি তৈরী করত। 



    মহিষাসুরে যাবার আগে আমরা সিংহ নিয়ে আরও কিছু আলোচনা করব। সাহিত্য ছাড়াও আরও কয়েকটি আঙ্গিকে আমরা দেবীর সিংহবাহিনী হয়ে ওঠার কারণ দেখব। রাজনৈতিক এবং শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে। 



    কখনও ভেবেছেন কি সিংহ এদেশে গুজরাত ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না, আর বাঘ প্রায় সব রাজ্যে! অথচ প্রাচীন হিন্দু বা বৌদ্ধ ভাস্কর্যশিল্পে সিংহ সর্বব্যাপী আর বাঘ প্রায় অনুপস্থিত। ভারতের জাতীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভের শীর্ষভাগ- সেখানেও সিংহ। রাজারা বসতেন সিংহাসনে। বুদ্ধও শাক্যসিংহ। সিংহ থেকে সিংহল, সিংহ থেকে সিঙ্গাপুর। 



    যাই হোক, সিংহের বাহুল্য অতটা বিস্ময়কর নয়। এখন সিংহ গুজরাতে সীমিত হলেও এই কয়েকশ বছর আগে মধ্য ও পূর্ব ভারতেও সিংহ ছিল। তবে বিস্ময়কর হল সিংহের বিষম গুরুত্ব। যে গৌমাতাকে নিয়ে আজ এত মাতামাতি তারও প্রাচীন হিন্দু মন্দিরশিল্পে তেমন গুরুত্ব ছিল না। বৃষের গুরুত্ব ছিল। সিংহের বিষম গুরুত্বের কারণ অণ্বেষণ করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তবে সিংহের এই বিষম গুরুত্বটা হিন্দুশিল্পের একটা লক্ষণীয় অঙ্গ। অনেকেই মনে করেন সিংহ ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের প্রতীক। অষ্টম শতকের পর থেকে বৌদ্ধধর্ম ক্ষীয়মাণ হতে থাকে, পূর্বভারত বাদে দেশের আর সমস্ত অঞ্চল থেকেই। অষ্টম শতকের ইলোরার পর বৌদ্ধশিল্পে বড়মাপের বিনিয়োগ দেখা যায় না। একাদশ-দ্বাদশ শতকে অনেক হিন্দু মন্দিরে দেখা যায় হাতির উপর সিংহের আক্রমণের দৃশ্য। প্রত্নতত্ত্ববিদ জিওভানি ভেরার্দি সহ অনেকেই এটিকে বৌদ্ধ ধর্মের (হাতি) উপর ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের আধিপত্যের প্রতীকী রূপ বলে মনে করেন। বৌদ্ধ শিল্পেও সিংহের গুরুত্ব ছিল, যা সাঁচীতে বা কারলা গুহায় দেখা যায়। তবে বৌদ্ধশিল্পে সিংহের আক্রমণাত্মক রূপ নেই। মহিষ বা হাতির উপর সিংহের আক্রমণ হিন্দুশিল্পেই দেখা যায়। তাছাড়া বৌদ্ধ শিল্পে অস্ত্রশস্ত্রধারী দেবতা বিশেষ দেখা যেত না। বুদ্ধর উপর মারের আক্রমণের দৃশ্য ছাড়া তেমন হিংসার দৃশ্য প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধশিল্পে তেমনভাবে নেই। অন্যদিকে উদয়গিরির অনন্তশায়ী বিষ্ণু নিদ্রার মধ্যেও সতর্ক, হাতে অস্ত্র। অর্থাৎ পঞ্চম শতক থেকে ভারতীয় শিল্পকলায় একটা পরিবর্তন আসতে থাকে। অস্ত্র ও হিংসার দৃশ্যায়নও বাড়তে থাকে। 



    সিংহের ব্রাহ্মণ্যধর্মী রূপ আরেকটা জায়গায় দেখা যায়। দেবীমাহাত্ম্যের কাহিনীটা তার আগে সংক্ষেপে দেখা যাক। ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ সহ বৈদিক দেবতারা ব্রহ্মার নেতৃত্বে দল বেঁধে এসেছেন দুজন অবৈদিক দেবতা- শিব ও বিষ্ণুর কাছে। তাদের অভিযোগ মহিষাসুর তাদের সবার স্থান নিয়ে নিয়েছে। শিব আর বিষ্ণুও সমাধানে অপারগ। শেষ অবধি সমস্ত পুরুষ দেবতা তাঁদের তেজ (বীর্য?) একত্র করে সৃষ্টি করলেন এক দেবীর। তারপর এক এক করে তাঁর হাতে তুলে দিলেন নিজেদের অস্ত্র। দেবীর লড়াইয়ের কাহিনীতে পুরুষ দেবতারা একটু ক্রেডিট নিলেন আর কী। দেবতাদের তেজ থেকে দেবীর জন্ম হলেও দেবীমাহাত্ম্যের শেষে দেবীর স্তবে সব দেবতাই স্বীকার করলেন এই দেবীই আদ্যা, এনার থেকেই সব দেবতার জন্ম। যাইহোক, দেবতারা অন্য অস্ত্রের সাথে দেবীর হাতে তুলে দিলেন সিংহ- এটি হিমালয়ের উপহার। দেবপ্রদত্ত অস্ত্রগুলি আদিম একাকী যোদ্ধ্রী দেবীর কাহিনীতে ব্রাহ্মণ্য দেবতাদের অনুপ্রেবেশের সুযোগসন্ধান বলা যায়। পঞ্চম শতকের পূর্ববর্তী মহিষমর্দিনীর অন্ততঃ এরকম দুটি মূর্তি আছে যেখানে দেবী খালি হাতে মহিষনিধন করছেন। সিংহ দূরের কথা, ত্রিশূলও নেই। যাই হোক, সিংহটিও কিন্তু এরকমই একটি অস্ত্র। যুদ্ধে দেবী একাই গেলেন, কোনও পুরুষ দেবতা ছাড়াই, তবে সিংহটি সঙ্গে রইল। অর্থাৎ অবৈদিক দেবীর কাহিনীতে একটি ব্রাহ্মণ্য সংযোজন হল। দেবী এলেন অবৈদিক দেবলোক থেকে, সিংহ এল বৈদিক দেবলোক থেকে। 



    মহিষাসুরবধের কাহিনীর কারণ আর ফলাফল যাই হোক না কেন, একটা জিনিস স্পষ্ট- বৈদিক দেবতারা অবৈদিক দেবতাদের কাছে নতিস্বীকার করলেন। প্রথমে তাঁরা বিষ্ণু-মহেশের কৃপাপ্রার্থী হলেন, পরে মহিষমর্দিনীর সামনেও নত হলেন। বিষ্ণু আর শিব যে ব্রাহ্মণ্য দেবলোকে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসাবে মথুরা-অহিচ্ছত্রে তাঁদের মূর্তির বাহুল্য, উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুদ্রায় তাঁদের উপস্থিতি, আর সাহিত্যিক প্রমাণ হিসাবে রামায়ণ-মহাভারতকে দেখানো যায়। এবার মহিষমর্দিনীও প্রতিষ্ঠিত হলেন। অবশ্য ব্রাহ্মণ্যধর্মের দেবলোকে প্রবেশ করার জন্য দেবীকেও গ্রামের মোষের লড়াইয়ের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে বড় মাপের যুদ্ধ করতে হল, আর তার জন্য তাঁর প্রতিপক্ষ মহিষটিকেও আরও জোরদার হতে হল- তাকেও অমিতশক্তিধর দেবশত্রু মহিষাসুর হয়ে উঠতে হল। 



    মহিষমর্দিনীর উৎস ভারতের ঠিক কোন প্রান্তে সেটা বলা একটু কঠিন। প্রথম দিকের মূর্তিগুলি সবই কুষাণ সাম্রাজ্যভুক্ত মথুরা বা তার পঞ্চাশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বিভিন্ন জায়গায় (সোঙ্খ, নগর ইত্যাদি)। মহাভারতে তিনি বিন্ধ্যবাসিনী। ঐ যুগে বাংলায় চন্দ্রকেতুগড় বা তমলুকে যক্ষীদের অনেক সুদৃশ্য মূর্তি পাওয়া গেলেও, মহিষমর্দিনী পালযুগের আগে পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদ নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সহ অনেকের মতে তিনি কোনও কোনও অনার্য জনগোষ্ঠীর দেবী ছিলেন, সম্ভবতঃ মধ্যভারতে। 


    সিংহের আলোচনায় ফেরা যাক। মনে রাখতে হবে, গুপ্তযুগে ভারতে অনেক সামরিক উন্নতি হয়। অতএব শিল্পে তার প্রতিফলন হওয়া, শিল্পে সমরসজ্জার গুরুত্ববৃদ্ধিটা আশ্চর্যের নয়। আর ব্রাহ্মণ্যধর্মের শিল্পে বৌদ্ধদের মতো অহিংসা প্রদর্শনের দায়ও নেই। এটাও সিংহের প্রবেশের কারণ হতে পারে। হাতের সংখ্যা অর্থাৎ অস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার কারণও হতে পারে। 



    শুধু ব্রাহ্মণ্যধর্মের নয়, সিংহ ছিল রাজতন্ত্রের বা রাষ্ট্রব্যবস্থারও প্রতীক। অনেকটা পারস্যের আকামেনিদ সাম্রাজ্যের অনুকরণেই অশোক তৈরী করেন সিংহস্তম্ভগুলি, যা স্বাধীনতার পর ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসাবে গৃহীত হয়। অর্থাৎ ভারতের প্রথম বৃহদাকার সাম্রাজ্য গঠনের পর অশোক সিংহকে কিছুটা নিজের (বা সাম্রাজ্যের) প্রতীক হিসাবেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। আবার জওহরলাল নেহরু ভারতের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে ওঠাটাকেও ঐ একই সিংহস্তম্ভের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এই সিংহস্তম্ভের অনুকরণ বৌদ্ধশিল্পে বহুপ্রচলিত ছিল। গুপ্তসম্রাটদের মুদ্রায় সিংহ থাকত। কুষাণ সম্রাট বিম কদফিসেসের মুদ্রায় প্রথম সিংহাসন দেখা যায়। রাজা সিংহাসনে আসীন। মহাভারতেও সিংহাসনের উল্লেখ আছে। কণিষ্করও রাজদেবী ছিলেন সিংহারূঢ়া ননা। পঞ্চতন্ত্রের সিংহও রাজার বিভিন্ন দোটানারই প্রতীক। তাই যে দেবী যুদ্ধ ও বিজয়কে সূচিত করেন তাঁর আইকোনোগ্রাফিতে সিংহের আবির্ভাব যেন অবশ্যম্ভাবীই ছিল। 



    তাহলে দেবীমাহাত্ম্যের আগে, রাবণফাঁড়ির আগে কি সিংহবাহিনী কেউ নেই? হ্যাঁ, আছে। গুপ্ত সম্রাটদের মুদ্রায় একপিঠে রাজার ছবি, আরেকপিঠে কোনও না কোনও দেবীর ছবি থাকত। কোনও কোনও মুদ্রায় এই দেবী সিংহারূঢ়া। ইনি মহিষমর্দিনী নন। এই দেবীকে কেউ কেউ দুর্গা, কেউ কেউ লক্ষ্মী বলেন। আবার দেবীমাহাত্ম্যের দেবীর অনেকগুলি নামের মধ্যে একটি হল মহালক্ষ্মী। আরও অতীতে ফিরে গিয়ে দেখা যায়, প্রথম শতকে রাজস্থানের নগরে প্রাপ্ত একটি মহিষমর্দিনীর মূর্তিতে সিংহ। এখানে অবশ্য সিংহের স্থান মহিষের নিচে এবং যুদ্ধে তার কোনও ভূমিকা নেই। যাই হোক সিংহের বাধ্যতামূলক দৃশ্যায়ন রাবণফাড়ির পর থেকেই শুরু। 


    অনেকে মনে করেন সিংহবাহিনীর উৎস আরও অনেক প্রাচীন। কেউ কেউ সিংহবাহিনীকে যোগ করেন সুমের-আসিরিয়ার দেবী ইশ্তারের সাথে। তবে মনে রাখতে হবে এদের মধ্যে হাজার বছরের কালিক ব্যবধান আছে, আর স্থানিক ব্যবধান তো আছেই। প্রথম সাধারণ পূর্বশতকের গান্ধারের শক রাজা দ্বিতীয় আজেসের মুদ্রার সিংহারূঢ়া দেবীকে অনেকে এই দুই দেবীর যোগসূত্র হিসাবে দেখেন। (আমি এখানে ‘খৃষ্টপূর্ব শতক’ না বলে ‘সাধারণ পূর্বশতক’ বলছি- ইংরাজী BCE বা Before Common Eraর বাংলা তর্জমা)। মোটামুটি ঐ অঞ্চলেই ছিলেন আরেক দেবী- ননা। ননা ছিলেন কণিষ্কের আরাধ্যা দেবী। আফগানিস্তানে প্রাপ্ত দ্বিতীয় শতকের রবতক শিলালিপিতে লেখা ছিল- কণিষ্ক এই দেবীর কাছ থেকে রাজত্ব অর্জন করেছেন, এনার মন্দির নির্মাণও করেছেন। এনার বেশ কিছু মূর্তি ও মুদ্রা এই অঞ্চলে পাওয়া গেছে। এগুলিতে উনি সিংহারূঢ়া। ননার সঙ্গে ইনানা (ইশ্তারের অপর নাম) নামটির সাদৃশ্য ও সিংহের উপস্থিতির জন্যও ওনাকে অনেকে (ইতিহাসবিদ বি এন মুখার্জী, আস্কো পার্পোলা) ইশ্তারের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন। যাই হোক, আজেস, কণিষ্ক বা গুপ্তদের এই সিংহারূঢ়া দেবীরা কেউই মহিষমর্দিনী নন। 



    কেউ কেউ সিংহবাহিনীকে যোগ করেন হরপ্পা সভ্যতার ব্যাঘ্রদেবীর সাথে। ওখানকার অন্ততঃ দুটি শীলমোহরে দেখা গেছে একজন নারী যার উর্ধ্বাংশ মানবী, আর নিম্নাংশ হল একটি চারপেয়ে বাঘ। আবার মহিষমর্দনের দৃশ্যও হরপ্পার শীলমোহরে আছে। একজন (সম্ভবতঃ পুরুষ) একটি বর্শা দিয়ে একটি মহিষকে নিধন বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে, আর তার পিছনে বসে আছে এক ধ্যানী যোগী। এই ছবির দার্শনিক বা ধর্মীয় তাৎপর্য জানা নেই- তবে অনেকে মনে করেন এটি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে মহিষনিধনের একটি দৃশ্য। এই প্রসঙ্গে বলি, মহাভারতে আর স্কন্দপুরাণে এক পুরুষ মহিষাসুরনাশকের কাহিনী দেখা যায়- তিনি হলেন স্কন্দ- যাঁকে আমরা কার্তিক বলি। তাঁকেও অনেক লড়াই করে বৈদিক দেবলোকে প্রবেশ করতে হয়েছে। 



    ষষ্ঠ শতকের মহিষমর্দিনীতে সিংহের আবির্ভাব সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত দৃষ্টি দিয়েও দেখা যায়। অশোকের সময়ে এবং তারপর শুঙ্গ, সাতবাহন এবং কুষাণদের সময়েও- অর্থাৎ তৃতীয় শতক অবধি ভারতে বৌদ্ধশিল্পই প্রধান শিল্প ছিল। বৌদ্ধ শিল্পকলাতেই বেশী বিনিয়োগ হত। গুপ্তযুগেও অর্থাৎ চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে বৌদ্ধ শিল্পকলা এক ধাপ এগিয়েই ছিল। গুপ্তপূর্বযুগে বৌদ্ধধর্মের বাইরে উল্লেখযোগ্য ছিল যক্ষ বা যক্ষীদের মূর্তিনির্মাণের শিল্প- যার মধ্যে বাংলার বিশেষ করে চন্দ্রকেতুগড়ের যক্ষীদের পোড়ামাটির মূর্তিগুলি, বিহারের পালিশ করা যক্ষীমূর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যক্ষরা বৌদ্ধধর্মে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আবার তাদের ঘিরে স্বতন্ত্র ধর্মবিশ্বাসও ছিল। যাই হোক, শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের শিল্পনির্মাণ আকারে তুলনামূলকভাবে ছোট হত। মথুরা আর অহিচ্ছত্র থেকে অনেক হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে দ্বিতীয় শতকের পর থেকে- আবার সেখানেও বৈষ্ণব শিল্পের প্রাধান্য বেশী। এই শিল্পকর্মগুলি ছোট বা মাঝারি আকারের। বৌদ্ধদের সাঁচীর তোরণ বা ভরহুতের প্রাচীর বা কারলা গুহার মত বড় আকারের উৎকৃষ্ট স্থাপত্য হিন্দুধর্মে দেখা যায় না ষষ্ঠ শতকের আগে। অতএব আকার এবং ডিটেলিং যে সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাবে সেটা স্বাভাবিক। প্রথম দিকের মহিষমর্দিনীগুলির মধ্যে তাই আড়ম্বর কম। তারা আকারেও ছোট। শুধু দেবী আর মহিষ। শুধু মূল দুটি চরিত্র, কোনও বাহুল্য নেই।



    উদয়গিরির আগের কোনও হিন্দু মন্দির টিকে নেই। মোটামুটি উদয়গিরি, বাদামি, আইহোলের মাধ্যমে বড় আকারের পাথরের হিন্দুমন্দিরের প্রচলন শুরু হয়। অর্থাৎ হিন্দু দেবদেবীদের বড় করে বানানোর সুযোগ এল। আগে বাহুল্য-বর্জিত মিনিমালিস্টিক রূপ ছিল। এখন পরিবর্তন এল। সেটাও সিংহের সংযোজনের পথ কিছুটা প্রশস্ত করল। আবার বাদামির গুহাসমূহতে দেখি শিবের নিজস্ব গুহা, জৈনদের নিজস্ব গুহা, বিষ্ণুর দু'খানি নিজস্ব গুহা। দেবীর কোনও নিজস্ব গুহা নেই। শিবের গুহার একপ্রান্তে উনি আছেন। এখানেও উনি বাহুল্যবর্জিত। এখানেও তাঁর সিংহ নেই। 



    রাবণফাড়ির পর সপ্তম শতকে আইহোলেতেই দেখা গেল আরেকটি মহিষমর্দিনী, সিংহবাহিনী দুর্গা। এবার গুহামন্দির নয়। কাঠামোভিত্তিক বা ফ্রী-স্ট্যান্ডিং মন্দির। যে মন্দিরের দেয়ালে এই মূর্তিটি খচিত আছে সেটিকে এখন দুর্গামন্দির বলা হয়, তবে তখনও এটি দুর্গামন্দির ছিল কিনা জানা নেই। শিল্পসুষমায়ও এটি আগের দুর্গামূর্তিগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে। তবে এখনও মানবসদৃশ মহিষাসুরের আবির্ভাব হয়নি, যদিও দেবীমাহাত্ম্যে মহিষের মানবরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলি, চালুক্যদের তৈরী আইহোলের মন্দিরগুলো প্রাচীনতম কাঠামোভিত্তিক বা ফ্রী-স্ট্যান্ডিং হিন্দু মন্দিরগুলোর মধ্যে পড়ে। এর থেকে পুরোনো যা কিছু ছিল সবই কাঠের বা ইঁটের- এখন আর তেমনভাবে টিকে নেই। এছাড়া বাদামির মূল গুহাসমূহের বাইরের কিছু ভাস্কর্যেও দেবীর সিংহবাহিনী রূপ দেখা গেল। 




    ছবি ২: কর্ণাটকের আইহোলের দুর্গা মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী- সপ্তম শতক।

    সপ্তম শতকের আইহোলের সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনী শৈল্পিক বিচারে দৃষ্টান্তমূলক। কিন্তু মোটামুটি ঐ সময়েই আরেকটি শৈল্পিক উত্তরণ দেখা যায়। সপ্তম শতকের মাঝামাঝি- তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরমে পল্লব রাজাদের পৃষ্টপোষকতার তৈরী একটি গুহাশিল্প- যার নাম দেয়া হয়েছে মহিষাসুরমর্দিনী গুহা। দেবীমাহাত্ম্যে মহিষ আর মহিষাসুরে কোনও পার্থক্য করা হয়নি। মহিষাসুরমর্দিনী আর মহিষমর্দিনীর পার্থক্যটা অনেকটাই শৈল্পিক। আধুনিক ঐতিহাসিকরা এই পার্থক্যটিকে গুরুত্ব দেন। মহাবলীপুরমের আগে মানবসদৃশ মহিষ দেখা যায়নি। এখনকার পুজোর প্যাণ্ডেলে আমরা মহিষাসুরের মানবরূপ দেখি। আবার এই মানবরূপেই দুটি রূপ আছে। আমরা পৌরাণিক সাহিত্য বা  দেশবিদেশের প্রাচীন শিল্প ঘাঁটলে দেখি পশু-মানুষের মেলবন্ধন নানারকম হয়। মুখটা পশুর, ধড়টা মানুষের। অথবা মুখটা মানুষের ধড়টা পশুর। প্রথমটা ভারতে বেশী, দ্বিতীয়টা পাশ্চাত্যে বেশী। এছাড়া আরও নানারকম শরীরবিন্যাস হতে পারে। প্রথম দিকের মানবসদৃশ মহিষাসুর, যেমন মহাবলীপুরমের মহিষাসুরের মাথাটা মহিষের, বাকী শরীরটা মানুষ। অনেকটা গণেশ, নৃসিংহ বা বরাহ অবতারের মত। 



    মহাবলীপুরমের মহিষাসুরমর্দিনী গুহা ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এটি শুধুমাত্র একটি বা একজোড়া দণ্ডায়মান মূর্তি নয়। বেশ নাটকীয় একটা কাহিনীকথন আছে এই গুহা-ভাস্কর্যে। দেবীর চারদিকে আছে উড়ন্ত বামনাকার যোদ্ধারা, দেবী সিংহের উপরে বসে, এবং সিংহটিকে দেখলে বেশ গতিশীল বলে মনে হয়। আশেপাশের ডিটেল, দেবীর বসার ভঙ্গীর মাধ্যমে এই গতিশীলতা আনা হয়েছে। তাছাড়া দেবীর প্রধান দুটি হাতে রয়েছে ধনুক, এবং ধনুকটি দেখে মনে হবে সেটি থেকে তিনি সদ্য তীর নিক্ষেপ করেছেন। সবই একটা পাথর কেটে তৈরী! দেবী তন্বী। মহিষাসুর আকারে দেবীর থেকে বড়- এটাও কিন্তু আগের ভাস্কর্যগুলির তুলনায় ব্যতিক্রম। মহিষাসুর বা মহিষ- যাই বলুন না কেন- এখানে সে দেবীর পদতলে নেই- যেটা আগে দেখা যেত। মহিষাসুরের দিকের যোদ্ধারা অনেকেই ভূপতিত। এইরকম জীবন্ত, নাটকীয়, গতিময় চিত্রায়ণ- পাথরের উপর- ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে এর আগে বিরল। সাঁচীর তোরণে হয়তো কিছুটা এইরকম গতিময় কাহিনীকথন এর এক হাজার বছর আগে দেখা গেছে। তবে এরকম নাটকীয়তা এবং একটা ফ্রেমে একাধিক আবেগকে তুলে ধরা একমাত্র পরবর্তীকালের য়ুরোপের রেনেসাঁ যুগের চিত্রশিল্পে দেখা যায়। 


    যাই হোক, এর থেকে বোঝা যাচ্ছে ধীরে ধীরে হিন্দু শিল্পের আকার, উৎকর্ষ সবকিছুই এই সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে মহিষমর্দিনী হয়ে উঠেছেন মহিষাসুরমর্দিনী। 




    ছবি ৩: মহাবলীপুরমের মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী- সপ্তম শতক।

    দাক্ষিণাত্যের কথা যখন উঠল তখন বলি এই মহাবলীপুরমের মহিষাসুরমর্দিনীকে ঐতিহাসিকেরা প্রাচীন তামিল দেবী কোত্রবই হিসাবে চিহ্নিত করেন। প্রাচীন তামিল সঙ্গম যুগের জৈন মহাকাব্য চিলপ্পতিকারম-এ (যাকে অনেকে তামিল সাহিত্যের ইলিয়াড বলেন) এই দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে রচিত। দেবীমাহাত্ম্যর থেকে পুরোনো সাহিত্যও হতে পারে এটি। চিলপ্পতিকারম কাব্যে এই দেবীর কিছু উল্লেখ আছে- তিনি ত্রিনয়নী, মৃত মহিষের মাথায় দণ্ডায়মান, আর তাঁর মহিষাসুরমর্দনের ঘটনার উল্লেখও করা হয়েছে। এই অংশ যদি প্রক্ষেপ না হয়, তাহলে বলা যায় তামিল সাহিত্যেও মহিষাসুরমর্দনের কাহিনী সমানভাবেই পুরোনো। এই দেবীকে কুমারী, কাবুরী, লক্ষ্মী ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইনি এয়িণার নামক একটি যোদ্ধা (মতান্তরে ডাকাত অথবা শিকারী) জনগোষ্ঠীর উপাস্য দেবী। যুদ্ধ ও বিজয়ের দেবী। এই এয়িণাররা ধনুর্বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিল। লক্ষণীয় যে শুধু মহাবলীপুরম নয়, অষ্টম শতকের কাঞ্চীপুরমের কৈলাশনাথ মন্দিরেও তিনি ধনুর্ধারিনী। আমরা বাঙালীরা দেবীর মূল দুটি হাতে তীর ধনুক দেখতে অভ্যস্ত নই। উত্তর ভারতে দেবীর মূল অস্ত্র ত্রিশূল বা বর্শা। আর অতীতে তিনি খালি হাতেও মহিষবধ করেছেন। 



    মহাবলীপুরমের পর এইরকম মহিষের মাথা আর মানুষের শরীরআলা মহিষাসুর আরও অনেক জায়গায় দেখা গেছে- যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ওড়িশার ভুবনেশ্বরের বৈতাল দেউল- অষ্টম শতকে। তবে এখানে যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্বেগ নয়, বরং মন্দিরের বাদবাকী ভাস্কর্যের সাথে সাযুজ্য রেখে একটা এরোটিক আভাস আছে। ওড়িশায় এরকম আরও কয়েকটি মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি পাওয়া গেছে। মহিষাসুর এখানে দেবীর পদতলে যত না যুদ্ধপ্রার্থী, তার থেকে বেশী প্রণয়প্রার্থী। সিংহের কামড়, ত্রিশূলের আঘাত, আর দেবীর হাতের নাগের দংশনে মহিষাসুর যেন কামদষ্ট। দেবী এখানে প্রত্যাখ্যানের মুদ্রায়। দেবীমাহাত্ম্যের পরবর্তী অনেক পুরাণে দেখা যায় মহিষাসুর দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে বিবাহের প্রস্তাব দিচ্ছে। বামনপুরাণ অনুযায়ী দেবী বলেন তাঁর কুলপ্রথা অনুসারে মহিষাসুরকে শুল্ক (কন্যাপণ) দিতে হবে। এখানে ইঙ্গিত আছে, দেবী শুল্ক হিসাবে মহিষাসুরের মাথা চেয়ে নিতে পারতেন, কিন্তু উনি বলেন- ওনার কুলে যে পুরুষ কন্যাকে যুদ্ধে জয় করতে পারে সেই পুরুষই কন্যাকে বিবাহ করার যোগ্য- এটাই শুল্ক। সেখান থেকেই যুদ্ধের সূত্রপাত। এই বিবাহপ্রস্তাব ও প্রত্যাখ্যান হয়তো ফুটে উঠেছে এই শৈলীর ভাস্কর্যগুলিতে। 



    বাঙালীর পরিচিত মহিষাসুরের মাথাটা মহিষের আর শরীরটা মানুষের নয়। বরং দেখা যায় সে একটা কাটা মহিষের শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে। এই রূপও মোটামুটি অষ্টম শতক থেকে দৃশ্যমান হতে থাকে, আর ধীরে ধীরে এটাই দেবীর সর্বাধিক প্রচলিত রূপে পরিণত হয়। এই রূপের একটা নিদর্শন কলকাতা জাদুঘরে পাল বা সেন যুগের একটি পাথরের দুর্গামূর্তিতে দেখা যায়। মহিষাসুরমর্দিনীর আরও বিবর্তন পরবর্তীকালে হয়েছে, চার পুত্রকন্যা যোগ হয়েছে। 



    মহিষমর্দিনীর ইতিহাস যে প্রায় হাজার দু'য়েক বছর পুরোনো তা আমরা দেখেছি, সাধারণী একাকিনী গ্রাম্য যোদ্ধ্রীর ব্রাহ্মণ্যধর্মের দেবলোকে উত্তরণ আমরা দেখেছি, তার জন্য সাধারণ মহিষকে অমিতশক্তিধর দেবশত্রু মহিষাসুর হয়ে উঠতে হয়েছে- তাও আমরা দেখেছি। সেই মহাযোদ্ধ্রীর বাংলার সংসারী মেয়ে হয়ে ওঠার কাহিনী আরেকটা বিবর্তন, সেটা আমরা অন্য কখনও দেখব। 




    ছবি ৪: পাল বা সেন যুগের বাংলার মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী- দ্বাদশ শতক।

    ছবি: লেখকের তোলা

    তথ্যসূত্র:


    • Agrawala, R. (1958). The Goddess Mahiṣāsuramardinī in Early Indian Art.Artibus Asiae, 21(2), 123-130. doi:10.2307/3248870
    • Harle, J. (1970). On a Disputed Element in the Iconography of Early MahiṣāsuramardinīArs Orientalis, 8, 147-153.
    • Viennot, O. (1956). The Goddess Mahishâsuramardinî in Kushâna Art.Artibus Asiae, 19(3/4), 368-373. doi:10.2307/3248773
    • Verardi, Hardships and Downfall of Buddhism in India (New Delhi, 2011), 221.
    • ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
    • বামনপুরাণ: ইংরাজী অনুবাদ- মকরন্দ জোশী।
    • শ্রী শ্রী চণ্ডী (দেবীমাহাত্ম্য): বাংলা অনুবাদ- কালীমোহন বিদ্যারত্ন।
    • এছাড়া অনেক তথ্য উল্লিখিত মন্দির ও গুহাগুলির (উদয়গিরি, বাদামি কেভস, আইহোলে দুর্গামন্দির, রাবণফাড়ি, মহাবলীপুরমের মহিষাসুরমর্দিনী কেভ) সাইনবোর্ড ও উইকি পেজ থেকে সংগৃহীত।

    পড়তে থাকুন, শারদ গুরুচণ্ডা৯ র অন্য লেখাগুলি >>
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ২৩ অক্টোবর ২০২০ | ৫০৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amit | 121.2.***.*** | ২৩ অক্টোবর ২০২০ ০৪:৪৮98789
  • অসাধারণ লেখাটা। 

  • kk | 97.9.***.*** | ২৩ অক্টোবর ২০২০ ০৫:১৪98790
  • ছবি আর লেখা দুইই খুব ভালো লাগলো। চমৎকার সলিড রিসার্চ। অনেক কিছু জানলাম। মহীষ আসলে কিছুর প্রতীক নিশ্চয়ই? সেই নিয়েও কিছু পড়তে পারলে ভালো লাগবে। লেখককে অনুরোধ করে রাখলাম। কখনো সময় বা ইচ্ছে হলে যদি সেই নিয়ে লেখেন।

  • Ramit Chatterjee | ২৩ অক্টোবর ২০২০ ১০:০৮98803
  • ভারতে বিভিন্ন অসুররাই ফিসিকাল নানা অবজেক্টের প্রতীক। আসলে সেই অবজেক্টটাকে পোষ মানানোর বা কাজে লাগানোর প্রতীক এই যুদ্ধ টা। যেমন ইন্দ্র বৃত্র কে বধ করে ছিল, সেটা ভীষণ মেঘ হয়ে বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি হওয়ার ঘটনা, যেই বৃষ্টি কৃষি ও বসবাসের জন্য জরুরি ছিল। তেমন মহিষ কে পোষ মানিয়ে কৃষিকাজে নিযুক্ত করার একটা প্রতীক হলেও হতে পারে এই মহিষাসুর বধ। মহিষ গরু বা ষাঁড় এর চেয়ে অনেক টাফ প্রাণী আর অনেক পরিশ্রম ও করতে পারে। 


    আবার এই মহিষাসুর এর প্যারালাল গ্রিক মিথে ও পাওয়া যায় মিনোটরের বেশে। ওখানে এটা    ভূমিকম্প্পের প্ৰতীক 

  • Ramit Chatterjee | ২৩ অক্টোবর ২০২০ ১০:১১98804
  • ওই এলাকায় ষাঁড়ের দৌড় বা ষাঁড়ের ওপর ওঠার একটা খেলা খুব জনপ্রিয় ছিল, অনেকটা জাল্লিকাত্তুর মত সেটাও মিনোটরের মিথকে ইন্ধন যোগায়।

  • সুদীপ্ত পাল | ২৪ অক্টোবর ২০২০ ১১:৫০98852
  • @kk অসুর কিসের প্রতীক সেটা অনেকটাই নির্ভর করে কাকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, তার উপর। উত্তর একাধিক। বিভিন্ন পুরাণ, মহাভারত আর লোককাহিনী থেকে এই সংঘাতের বিভিন্ন ব্যাখ্যা আনা যায়- বিনোদনমূলক ক্রীড়া, অস্ট্রোএশিয়াটিক জাতির সাথে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সংঘাত, জঙ্গলের সাথে কৃষির সংঘাত, মানুষের সাথে পশুর, নারীর সাথে পুরুষের, প্রণয়প্রার্থীর সাথে কাংক্ষিতার।

  • সুদীপ্ত পাল | ২৪ অক্টোবর ২০২০ ১১:৫২98853
  • @Ramit Chatterjee   কৃষির সাথে যোগ, পোষ মানানোর ব্যাপারটা আমারও মনে হয়। মিনেটরের রেফারেন্সটার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

  • সম্বিৎ | ২৪ অক্টোবর ২০২০ ১২:১৯98856
  • অসামান্য লেখা। কুর্নিশ করলাম।


    "সেই মহাযোদ্ধ্রীর বাংলার সংসারী মেয়ে হয়ে ওঠার কাহিনী আরেকটা বিবর্তন, সেটা আমরা অন্য কখনও দেখব।"

    - এইটা হোক।

  • Lipikaa Ghosh | ২৮ অক্টোবর ২০২০ ১৬:১৮99267
  • অসাধারণ একটা আলোচনা ।খুব সমৃদ্ধ হলাম। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম 

  • কৌশিক ঘোষ | ১৩ নভেম্বর ২০২১ ০০:১৬501069
  • ব‍্যাপক, ব‍্যাপক।
    মন্তব‍্যগুলোও মূল‍্যবান।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন