ইউনিফর্ম সিভিল কোড এক ধাক্কায় করার জিনিস নয়। হিন্দুদের মধ্যেও কিন্তু বিবাহ আর উত্তরাধিকার আইন ইউনিফর্ম নয়। পুরুষের বহুবিবাহ সবচেয়ে বেশি হিন্দু ট্রাইবালদের মধ্যে- প্রতি একচল্লিশজনের একজন মহিলার সতীন আছে- সাম্প্রতিক ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে অনুযায়ী। তারপরে আসে মুসলিমরা। হিন্দু হোক বা খৃষ্টান, ট্রাইবালদের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব আইন ব্যবহারের অনুমতি আছে। অধিকাংশ ট্রাইবাল গোষ্ঠীতেই মেয়েরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায় না। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। একটা উদাহরণ হল-সাঁওতাল পরগনা প্রজাস্বত্ব আইন (1949) কন্যাদের জমির উত্তরাধিকারের অনুমতি দেয় যদি তাদের পিতা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে থাকেন এবং সেক্ষেত্রে বরকে ঘর জামাই হওয়া বাধ্যতামূলক।
২০০৫ সালের Hindu Succession (Amendment) Actএ স্পষ্ট করা হয় হিন্দু ট্রাইবালদের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনই অনুসরণ করতে হবে এবং মেয়েদের উত্তরাধিকার দিতে হবে, কিন্তু সেটা বাস্তবে অনুসৃত হয়নি বলে ২০১৮তে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আবার নূতন করে এটা বলবৎ করা হয়। তারপরেও বিশেষ কিছু বদলায় নি। ট্রাইবালরা ভয় পায় তাদের মেয়েরা বহির্বিবাহ করলে মেয়ে, জমি, সম্পত্তি সব বাইরে চলে যাবে।
ট্রাইবাল টেনেন্সি অ্যাক্টগুলো মেয়েদের উত্তরাধিকার আর বহির্বিবাহ দুইয়ের ক্ষেত্রেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ছোটনাগপুর টেনেন্সি অ্যাক্ট, 1908 খুব স্পষ্টভাবে মুণ্ডা মেয়েদের উত্তরাধিকার নিষিদ্ধ করে বিশেষ করে খুঁৎকাঠি জমির ক্ষেত্রে। ইংরেজরা চেষ্টা করেছিল খুঁৎকাঠি জাতীয় যৌথ মালিকানা তুলে দিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা আনার- কিছুটা নিজেদের স্বার্থেই যাতে জমি কেনাবেচা সহজ হয়। মুণ্ডা বিদ্রোহের শেষে ইংরেজরা বাধ্য হয় খুঁৎকাঠি ফিরিয়ে আনতে। Wilkinson's rule (১৮৩৭) আর Bhil Parganas Tenancy Act, 1949এও মেয়েদের উত্তরাধিকার নিষিদ্ধ। এই আইনগুলো এখনও কার্যকর। ২০১৮তে গুজরাত হাইকোর্ট সংবিধানের ভিত্তিতে ভিল পরগণা অ্যাক্ট বাতিল করলেও, গুজরাত সরকার হাইকোর্টের রায় নাকচ করে দেয়। মানে এক্ষেত্রে বিজেপির গুজরাত সরকারই ব্যর্থ হয়েছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনতে। সেখানে মোদিজির "এক দেশ এক আইন" নেহাতই ছেলেভুলানো স্লোগান।
আইনগুলো তুলতে গেলে ট্রাইবালরা চটে যাবে, আর যে তিনটে ট্রাইবাল অধ্যুষিত রাজ্যে বছর শেষে নির্বাচন - রাজস্থান আর বিশেষ করে মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড়- এগুলোতে বিজেপির হার নিশ্চিত হবে। এদের মধ্যে এই মুহূর্তে মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকার। ট্রাইবালদের চটালে লোকসভায় বিজেপির বর্তমান তিনশো সিটের চল্লিশখানা হাতছাড়া হওয়ারও সম্ভাবনা প্রবল।
ভারতের সাতশো খানা ট্রাইবের সাতশো আলাদা আলাদা বৈবাহিক আর উত্তরাধিকার আইন আছে। অনেক আইনই নথিবদ্ধ নয়। কিছু আইন ব্রিটিশরা লিখিত আকারে আনে।ইউনিফর্মিটি আনার জন্য প্রথম কাজ হবে সাতশোখানা আইন স্টাডি করা। এটা নয় মাসে সম্ভব? না। মোদি সরকার গত নয় বছরে এরকম স্টাডি করেছে বলে জানা নেই।
অনেকে প্রশ্ন তুলবে- যদি সব ট্রাইবালকে হিন্দু আইনের আওতায় আনতে হয় তাহলে তাদের আইনগুলো আলাদা আলাদা স্টাডি করার কী দরকার? দরকার আছে, কারণ পুরোনো উত্তরাধিকার আর মালিকানার সঙ্গে নূতনের একটা কনটিনিউইটির প্রয়োজন হয়।
মুসলিমদের থেকেও ট্রাইবাল গ্ৰুপগুলো ইউনিফর্ম সিভিল কোড নিয়ে বেশি নড়েচড়ে বসেছে। বিভিন্ন ট্রাইবাল গোষ্ঠীর বক্তব্য- Chotanagpur Tenancy (CNT) Act, Santhal Pargana Tenancy (SPT) Act, Wilkinson Rule, PESA law এগুলোর সঙ্গে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধ তৈরি হবে।
আরেকটা প্রশ্ন আসে। হিন্দু ইউনাইটেড ফ্যামিলি যে বিশেষ ট্যাক্স ছাড় পায় সেটা কি তুলে নেয়া হবে, নাকি মুসলিম আর খৃষ্টানদেরকেও এই সুবিধা দেয়া হবে?
বিজেপি পুরো জিনিসটা একটা দায়সারা অরডিনান্স দিয়ে সারতে পারে। সেক্ষেত্রে বিজেপির কী লাভ হবে? মুসলিমরা প্রতিবাদে বসবে আর সেটা দেখে হিন্দুদের আবেগ উথলে আসবে আর তারা বেশি বেশি করে বিজেপিকে ভোট দেবে। কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক দেখে উত্তর প্রদেশ আর উত্তরাখণ্ডের লোকেরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল।
আবার উল্টোটাও হতে পারে। কর্ণাটকের সংরক্ষণ নিয়ে বিজেপির পরীক্ষানিরীক্ষায় বেনিফিশিয়ারিরা উল্টে চটে গিয়েছিল। ট্রাইবালরা অনেক জায়গাতেই বিজেপির উপর চটে আছে। মণিপুরের কুকিরা এখন চটে আছে। মণিপুর দাঙ্গার ফলে আশেপাশের রাজ্যগুলোয় উদ্বাস্তুদের ভিড় বাড়তে থাকায় আসাম, মিজোরাম আর নাগাল্যান্ডের ট্রাইবালরাও অসন্তুষ্ট। সিএএর মাধ্যমে বহিরাগতদের ভারতে আনা নিয়ে তাদের রাগ বহুদিন ছিল। মণিপুরের মতো ছোট রাজ্যে বিজেপি দাঙ্গা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে, দেশজুড়ে বিক্ষোভ হলে কী করে সামলাবে? আবার, কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনে পনেরো খানা এসটি আসনের সবকটায় বিজেপি হেরেছে, যদিও তার কারণ স্পষ্ট জানা নেই। মধ্য, পূর্বমধ্য ও পশ্চিম ভারতে ট্রাইবাল আসনের সংখ্যা বেশি, আবার এই অঞ্চলগুলো বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। ট্রাইবালরা বিক্ষুব্ধ হলে বিজেপির ২০২৪এ ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।