মণিপুরের দাঙ্গায় মৃতের সংখ্যা শতাধিক। আধলক্ষ মানুষ ঘরছাড়া, রিলিফ ক্যাম্পে আছে। ঘরছাড়া কিন্তু ক্যাম্পে নেই, এমন মানুষের সংখ্যা ধরলে গৃহহীনের সংখ্যা আরো বেশি। অনেকে প্রতিবেশী রাজ্যে পালিয়ে এসেছে- সরকারি হিসেব অনুযায়ী শুধু মিজোরামেই এগারো হাজার শরণার্থী। মণিপুরে প্রতি ষাটজন মানুষের একজন ঘরহারা। মহিলারা পথে নামতে বাধ্য হয়েছে - কেউ দাঙ্গা করতে, কেউ শান্তিরক্ষা করতে।
মণিপুরের তিনটি প্রধান জনগোষ্ঠী হল মৈতৈ, নাগা ও কুকি। বর্তমান সমস্যা মূলতঃ মৈতৈ আর কুকিদের মধ্যে। মৈতৈদের বেশিরভাগই ইনার মণিপুর অর্থাৎ উপত্যকা অঞ্চলে বাস করে। নাগা আর কুকিরা বেশিরভাগ আউটার মণিপুর অর্থাৎ পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করে। কুকিরা বিশেষ করে চুড়াচাঁদপুর জেলায় সংখ্যায় ভারি। মৈতৈরা সিংহভাগ হিন্দু। কিছু সংখ্যক মৈতৈ মুসলিম, সানামাহি-ধর্মী ও খৃষ্টান। কুকিরা বেশিরভাগ খৃষ্টান। দাঙ্গার কারণ ধর্মীয় নয়, জাতিগত। দাঙ্গায় মৈতৈদের সতেরোটা মন্দির পুড়েছে, কুকিদের ২২১টা চার্চ- ২রা জুনের ইন্ডিয়া টুডের রিপোর্ট অনুযায়ী। ঐ সময় অবধি মৈতৈদের প্রায় দু'হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। কুকিদের প্রায় দেড় হাজার।
শুরুতেই অনেকগুলো সংখ্যা একের পর এক তুলে ধরার উদ্দেশ্য হল দাঙ্গার ব্যাপ্তি ও ভয়াবহতাটা বোঝা। হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষিত ভারতীয়রা শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সমস্যার গল্প শুনে ভারতে ভোট দেয়, তাই দেশের ভেতরের সমস্যার কথা তাদের বলার জন্য সবার প্রথমে ঘরহারা মানুষ আর ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ি ও ধর্মস্থানের সংখ্যা তুলে ধরা জরুরি।
কুকি জনগোষ্ঠী ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার- তিনটি দেশ জুড়ে বিস্তৃত। মায়ানমারে সামরিক জান্তার উত্থানের পরে কুকি শরণার্থীদের মণিপুরে আসা আর সেই নিয়ে মৈতৈদের ক্ষোভের কথা গত ডিসেম্বর থেকে শোনা যাচ্ছিল। তবে সমস্যার ইতিহাস অনেক পুরোনো। মণিপুরে মৈতৈদের পরে বৃহত্তম জনগোষ্ঠীরা হল নাগা আর কুকি যারা আউটার মণিপুর বা পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দা। ১৯৯০এর দশকে নাগা আর কুকিদের মধ্যে ব্যাপক সংঘাত শুরু হয় জমি নিয়ে। নাগা উগ্ৰপন্থীরা তখন নাগালিম বা গ্ৰেটার নাগাল্যান্ডের স্বপ্ন দেখছে। নাগা আগ্ৰাসনের প্রতিবাদে একের পর এক কুকি জঙ্গি সংগঠন গড়ে ওঠে। অন্ততঃ তিরিশখানা কুকি জঙ্গি সংগঠন ঐসময়ে গড়ে ওঠে। ২০০৮ সালে ভারত ও মণিপুর সরকারের অনেক চেষ্টার পর বেশিরভাগ কুকি জঙ্গি সংগঠন রাজি হয় অস্ত্র সংবরণ করতে। পঁচিশটা সংগঠন ভারত সরকার ও মণিপুর সরকারের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট সই করে- যার নাম Suspension of Operations (SoO)। এই বোঝাপড়া অনুযায়ী কুকি সংগঠনগুলো রাজি হয় অস্ত্র সংবরণ করতে। চুক্তি অনুযায়ী শুধুমাত্র নিজেদের ক্যাম্প এবং নেতাদের সুরক্ষিত করার জন্য যেটুকু অস্ত্র দরকার সেটা তারা রাখতে পারবে। বাদবাকি অস্ত্র তারা ভারত সরকারের হাতে তুলে দেয়নি তবে ক্যাম্পে তালাবন্ধ রাখতে রাজি হয়েছে। নিয়মিত ভারত সরকার ও কুকিদের যৌথ পরিদর্শকদের তরফ থেকে এই তালাবন্ধ অস্ত্রের পরিদর্শন করা হয়। হিসেব মেলানো হয় কোনো অস্ত্র নিরুদ্দিষ্ট কিনা। অস্ত্র হারিয়ে গেছে মানে হল সেটা নিয়ে কোনো উগ্ৰপন্থী কোথাও হামলা করতে বেরিয়েছে। এই অস্ত্র সংবরণের পরিবর্তে সরকার থেকে এই সংগঠনগুলো মাসিক স্টাইপেন্ড পায়, যেটা ২০২২এ প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী ক্যাডার-প্রতি ছয় হাজার টাকা। এই স্কিমে মোট বৃত্তিভোগীর সংখ্যা অন্তত ২২০০। বার্ষিক ব্যয় ষোলো কোটির মত।
এই এগ্ৰিমেন্ট প্রতিবছর রিনিউ হয়, অর্থাৎ এগ্ৰিমেন্টের স্থায়িত্ব চিরন্তন নয়- এক বছর করে করে এর দৈর্ঘ্য। বর্তমান দাঙ্গা চলাকালীন ক্যাম্পগুলিতে সরকার থেকে পরিদর্শন করে দেখা গেছে ষাট শতাংশের মত অ্যাটেন্ডেন্স, যেটা খুব একটা সুবিধার লক্ষণ নয়। কুকি সংগঠনগুলোকে মাসিক বৃত্তি দেয়া নিয়ে মৈতৈদের চিরকালই ক্ষোভ ছিল। ২০২৩এর মার্চে মণিপুরের বিজেপি সরকার প্রথম চেষ্টা করে SoO চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার, এবং দুটি কুকি সংগঠনকে তারা এই চুক্তি থেকে বহির্ভূত করে। এর ফল খুব একটা ভালো হয়নি।
এবার বিষয়টা মৈতৈদের দিক থেকে দেখা যাক। মৈতৈরা মনে করে কুকিরা এই বার্ষিক বৃত্তির অপপ্রয়োগ করছে। এই অর্থ তারা নূতন নূতন অস্ত্র কিনতে ব্যবহার করছে, আফিম চাষে বিনিয়োগ করছে এবং এর ফলে অবৈধ নারকোটিক ট্রেড ঐ অঞ্চলে চলছে। এই কৃষি ও বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত অর্থ কুকি উগ্ৰপন্থীদের আরো শক্তিশালী করছে। তারা মায়ানমার থেকে আসা কুকিদের কাজে লাগাচ্ছে সস্তার শ্রমিক হিসেবে, এবং শিক্ষানবিশ উগ্ৰপন্থী হিসেবেও। মৈতৈদের দাবি মায়ানমার থেকে হওয়া কুকি অনুপ্রবেশ কুকি সংগঠনগুলোর লোকবল বৃদ্ধি করছে। মৈতৈদের বক্তব্য- সংরক্ষিত বনাঞ্চলে নূতন নূতন গ্ৰাম গজিয়ে উঠছে যেখানে মায়ানমারের কুকিরা বসত করছে আর নারকোটিক ভেষজের চাষ হচ্ছে।
এই দাঙ্গার ফলে মৈতৈরা বেশি বেশি করে NRC করার দাবি করছে। সাধারণ ভাবে এই দাঙ্গার ফলে উত্তর পূর্ব ভারতে এনআরসি-র পক্ষে আর সিএএ-র বিপক্ষে জনমত তৈরি হবে। বিজেপি কিন্তু দুটোরই সপক্ষে জনমত তৈরি করতে চায়। এবার যদি এসবের ফলে বিজেপি সিএএ থেকে দূরে সরে আসে, আসাম ও ত্রিপুরার বাঙালি হিন্দু ভোটাররা বিজেপির উপর ভরসা হারিয়ে ফেলবে। অবশ্য বিজেপি একেক রাজ্যে একেক রকম গল্প বানাতে জানে- যেটা আমরা আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের ২০২১এর বিধানসভা নির্বাচনে দেখেছি। আসামে বিজেপি সিএএ নিয়ে নীরব ছিল, দক্ষিণবঙ্গে মতুয়া সম্প্রদায়কে তারা সিএএ-র আশ্বাস দিচ্ছিল। আট দফায় নির্বাচন হওয়াতে বিজেপির এই সুবিধা হয়েছিল, একেকটা দফায় একেকটা জনগোষ্ঠীর জন্য একেকটা গল্প।
মৈতৈরা তাদেরকে ট্রাইবাল স্টেটাস দেবার দাবি একাধিকবার তুলেছে, কারণ তারা মনে করে তারা ট্রাইবাল স্টেটাস না থাকায় তাদের হাতে জমির অধিকার যথেষ্ট পরিমাণে নেই, এবং উল্টে তাদের জমিতে নাগা ও কুকিরা ভাগ বসাচ্ছে। আইনতঃ মৈতৈদের পক্ষে পাহাড়ে জমি কেনা সম্ভব নয়, কিন্তু নাগা ও কুকিরা উপত্যকায় জমি কিনতে পারে। ২০এ এপ্রিল ২০২৩এ মণিপুর হাইকোর্ট থেকে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয় মৈতৈদের শিডিউল ট্রাইব স্টেটাস দেয়ার বিষয়ে পর্যালোচনা করতে। ২৭এ এপ্রিল, মুখ্যমন্ত্রীর চুড়াচাঁদপুরে একটি ওপেন এয়ার জিম উদ্বোধন করার আগের দিন প্রতিবাদ হিসেবে জিমটা পোড়ানো হয়। তার আগে থেকে অনুপ্রবেশ নিয়ে মৈতৈ আর কুকিদের মধ্যে তিক্ততা চলছিল। তবে পুরো বিষয়টা দাঙ্গার রূপ নেয় ৩রা মে। ঐদিন মৈতৈদের ট্রাইবাল স্টেটাসের প্রতিবাদে কুকিরা মিছিল বের করে চুড়াচাঁদপুরে। প্রায় ষাট হাজার লোকের মিছিল। এখান থেকে অশান্তি শুরু হয়, পাল্টা মার হিসেবে মৈতৈরা ইম্ফল শহরে কুকিদের ঘরবাড়ি আক্রমণ করে।
২০০৮ সালে রাজস্থানে যখন বিজেপি সরকার, তখন মীনা আর গুজ্জরদের মধ্যে কয়েক মাস ব্যাপী দাঙ্গা হয়, কারণ গুজ্জররা ওবিসি থেকে শিডিউল ট্রাইব হয়ে উঠতে চেয়েছিল। মীনারা ট্রাইবাল গোষ্ঠী, এবং এতে অসন্তুষ্ট হয়। তার আগে জাঠদের ওবিসি কোটার আওতায় আনা হয়েছিল বলে গুজ্জররা অসন্তুষ্ট ছিল কারণ তাদের কোটায় ভাগ বসেছিল। অতএব তারা ট্রাইবাল স্ট্যাটাস দাবি করছিল। ট্রাইবাল স্টেটাস শুধু চাকরি আর উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণ নয়, সেখানে জমির অধিকারের প্রসঙ্গও আসে।
সমস্যাটা হচ্ছে অ-ট্রাইবালদের ট্রাইবাল হয়ে ওঠার দাবি তুলে আন্দোলন বিভিন্ন রাজ্যে ছড়াচ্ছে, আর তার প্রতিক্রিয়ায় ট্রাইবালদের অসন্তোষও বাড়ছে। যদিও মণিপুরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, পশ্চিমবঙ্গে কুর্মি আর সাঁওতাল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী সম্প্রতি দুবার রেল-রোকো করেছে। কুর্মিরা ট্রাইবাল স্টেটাস চায়, আর সাঁওতালরা তাতে অসন্তুষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও এটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
আমরা এতক্ষণ মৈতৈদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টা দেখলাম। এবার কুকিদের বক্তব্য দেখা যাক। তাদের দাবি মায়ানমার থেকে কুকি অনুপ্রবেশের বিষয়টা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। এছাড়া বনদপ্তরের তরফ থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক কুকিকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে। ৩৮খানা কুকি অধ্যুষিত গ্ৰামকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, কারণ সেগুলো সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পড়ে। মূলতঃ এই উচ্ছেদ নিয়ে তিক্ততা শুরু হবার পরই মণিপুর রাজ্য সরকার দুটি কুকি সংগঠনকে SoO চুক্তি থেকে বহিষ্কারের পরিকল্পনা করে। এছাড়া কুকিদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হল কুকি সংগঠনগুলোকে অস্ত্র সংবরণ চুক্তির আওতায় আনা হলেও, মৈতৈ জঙ্গি সংগঠনগুলো (UNLF, PLA, KYKL ইত্যাদি) কখনওই অস্ত্র প্রত্যাহার করেনি এবং এখনও তারা সক্রিয়।
টিভি এবং প্রিন্ট মিডিয়াতে মণিপুর দাঙ্গার কভারেজ তেমন চোখে পড়ে না। অনলাইন মিডিয়াতেও আলাদা করে খুঁজতে হয় মণিপুরের খবর। মিডিয়ার এই এড়িয়ে চলার একটা উদ্দেশ্য হল সরকারি ব্যর্থতাকে চাপা দেয়া। সরকারি উদ্যোগ কতটা ধীরগতির সেটা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি ভারতীয় সেনার প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিশিকান্ত সিং, যিনি মণিপুরবাসী আর টুইটারে চিরকাল বিজেপিকে সমর্থন করে এসেছেন, তিনি এখন মণিপুরের পরিস্থিতিকে সিরিয়া আর নাইজেরিয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন এবং stateless কথাটা ব্যবহার করছেন, আর টুইটারে অনেক আর্মি ভেটেরান তাঁকে সমর্থনও করছেন। তবে এখানে একটু সতর্ক থাকা দরকার, কারণ টুইটারে অনেকেই কড়া আর্মি অ্যাকশনের দাবি তুলছে।
এই মুহূর্তে উত্তর পূর্ব ভারতের যে রাজ্যগুলোয় হিন্দু তথা স্থানীয় সনাতনী ধর্মের প্রাধান্য (মণিপুর, অরুণাচল, আসাম ও ত্রিপুরা) সেগুলি বিজেপির নিয়ন্ত্রণে। আর খ্রিস্টান প্রধান রাজ্যগুলো (নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয়) বিজেপির জোটসঙ্গীদের হাতে। অর্থাৎ পুরো উত্তর পূর্ব ভারত বিজেপি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু মণিপুরের দাঙ্গা পরিস্থিতি দেড় মাস পরেও তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। মায়ানমারের সামরিক সরকারের উপর ভারত সরকার চাপ তৈরি করতে পারেনি- ওদিক থেকে আসা শরণার্থীদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে। প্রতিবেশী দেশে ঢুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্প বলে শাসকদল ভোট পায়, কিন্তু নিজের দেশের দুই যুযুধান গোষ্ঠীকে সামলাতে তারা হিমসিম খাচ্ছে।