অনেক জাতির ইতিহাস ইতিহাসের আকারে লেখা নেই। তার কারণও আছে। এক তো ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণের প্রতি আগ্রহ সব জাতির মধ্যে সমানভাবে ছিল না। তাদের প্রতিবেশীরা তাদের ইতিহাস লিখেছে, কিছুটা নিজেদের পছন্দের রঙের কালি দিয়ে। এছাড়া অনেক জাতির লিখিত নথি থাকলেও তাদের ভাষা এখনও বোধগম্য করা যায়নি। এদের ইতিহাস পুনরুদ্ধারে তাদের তৈরী সমাধি-স্মারকগুলো একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনই একটি জাতি ছিল ইতালির এট্রাস্কান-রা। বেশী পুরোনো দিনের কথা নয়। এট্রাস্কানরা আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে পুরো উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ইতালি জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এট্রাস্কানরা ইতালির প্রাগার্য জাতি, যারা ইন্দো-য়ুরোপীয় পরিবারভুক্ত কোনও ভাষায় কথা বলত না। এই নিয়ে চতুর্থবার আমি এই ধারাবাহিকে রোমের কথা বলছি, কারণ একটাই- আগেও বলেছি- কথায় আছে, সব পথই রোমের দিকে যায়। রোমান সংস্কৃতির অনেক কিছুই গ্রীক সংস্কৃতির অনুকরণ- সেটা আমরা জানি, কিন্তু রোমানদের উপর এট্রাস্কান সংস্কৃতির প্রভাব অনেক সময়ই কম আলোচিত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যের ইতিহাসে যে এট্রাস্কানদের প্রভাব অনস্বীকার্য, সেই ইতিহাসে উপেক্ষিত এট্রাস্কানদের নিয়ে আজকের পর্ব।
এট্রাস্কান ভাষা আংশিকভাবেই পাঠোদ্ধার হয়েছে। ইতিহাস নথিবদ্ধকরণের খুব আগ্রহও এট্রাস্কানদের ছিল না। কিন্তু নিজেদের স্বাক্ষর হিসাবে তারা রেখে গেছে অজস্র সমাধিগৃহ। প্রথম দিকের কয়েকটি পর্বে আলোচনা করেছিলাম সমাধির আয়তন এবং সমাধিতে রাখা বিদায়-উপহারের আড়ম্বর থেকে বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃতির সামাজিক বৈষম্যের একটা ধারণা পাওয়া যায়। এট্রাস্কানদের সমাধি থেকে তাদের সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ সদর্থক দিক জানা যায়। এট্রাস্কানদের লৈঙ্গিক সাম্যের একটা ধারণা আমরা ওদের সমাধি থেকে পাই। কীভাবে? সেটাই আমরা দেখব। সেইসঙ্গে এট্রাস্কানদের পারলৌকিক বিশ্বাসের এবং অর্থনীতির ধারণাও ধারণাও আমরা পাব।
কফিনের ঢাকনায় প্রয়াত ব্যক্তির ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি কোনও নূতন জিনিস ছিল না, মিশরীয়রা হাজার হাজার বছর ধরে এটা করে এসেছে। এট্রাস্কানরা হয়তো ঐ শৈলীটারই অনুকরণ করেছে। কিন্তু একটা নূতনত্ব সহকারে, যেটা পরে গ্রীক ও রোমানরা এট্রাস্কানদের থেকে অনুকরণ করেছে। মিশরীয় কফিনের ঢাকনায় যে মানুষের প্রতিকৃতি থাকে তার চোখ থাকে আকাশের দিকে- খুব স্বাভাবিক- কারণ এভাবেই মানুষ শুয়ে থাকে- এভাবেই অধিকাংশ মানুষকে কবর দেয়া হয়। আবার রেনেসাঁ-পরবর্তী য়ুরোপে খৃষ্টানদের যে মানবসদৃশ (anthropomorphic) কফিনের ঢাকনা আমরা দেখি, সেখানেও মূর্তির চোখ আকাশের দিকেই থাকে, এবং হাত দুটো জোড়া থাকে প্রার্থনার ভঙ্গিতে, কখনও বা হাত বুকের উপরে বা প্রবচনের মুদ্রায়ও থাকে। কিন্তু এট্রাস্কানদের কফিনের ঢাকনায় এরকম আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকা মানুষের ভাস্কর্য থাকত না। এট্রাস্কান কফিনের ঢাকনার মানুষেরা কিন্তু তাকিয়ে থাকত দর্শকদের দিকে, জীবন্ত মানুষের মত করে, মুখে হাসি, গতিশীল হাত, কাউচে হেলান দিয়ে বসে, অনেক সময়ে ভোজনের মুদ্রায়। এরা শায়িত নয়, জাগ্রত, প্রাণবন্ত। অর্থাৎ বাকীদের মত এট্রাস্কানরাও পরলোকে বিশ্বাস করত, তবে সেই সঙ্গে তারা পরলোকে নূতন একটা বর্ণময় জীবনের সূচনাকে উদযাপনও করত। আগের পর্বগুলোতেও দেখেছি, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে অনেক সংস্কৃতিতেই মৃত্যুকে নূতন জন্মের সূচনা হিসাবে দেখানো হত- যার একটা উদাহরণ হল মাতৃজঠরে পা মুড়িয়ে বসে থাকা শিশুর মত করে বয়স্ক মানুষকে কবর দেয়া, যেটা প্রাগৈতিহাসিক যুগেও দেখা গেছে। পরলোক ঘিরে অনেক আড়ম্বর আর সব সংস্কৃতিতে থাকলেও উদযাপনের ছবিটা এট্রাস্কানদের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়।
বিভিন্ন পাতালগৃহে এই কফিনগুলো রাখা হত। একেকটা বৃহত্তর পরিবারের একেকটা পুরো পাতালপুরী হত। পাতালগৃহের দেয়ালে থাকত মুরাল বা দেয়ালচিত্র। রোমানদের দেয়ালচিত্র এদের তুলনায় বয়সে কম হলেও রোমান দেয়ালচিত্রগুলো তেমনভাবে টিকে থাকেনি, কারণ ওগুলো বাড়ীর দেয়ালে থাকত। বাড়ীঘর ধ্বসে পড়লে দেয়ালচিত্রও নষ্ট হয়ে যায়। এট্রাস্কানদের দেয়ালচিত্রগুলো অনেক ভালভাবে টিকেছে কারণ ওগুলো পাতালস্থিত সমাধিগৃহে থাকত। কোনও কোনও সমাধিগৃহ মাটির উপরে বা পাহাড় খুঁড়েও তৈরী হত। এট্রাস্কানদের দেয়ালচিত্রকে গ্রীক দেয়ালচিত্রের অনুকরণ বলে মনে করা হয়। গ্রীক দেয়ালচিত্রের কোনও অবশেষ এখন আর নেই, খালি তার ব্যাপকতা বোঝা যায় সমকালীন গ্রীক সাহিত্যে তাদের উল্লেখ থেকে। অতএব হারিয়ে যাওয়া গ্রীক দেয়ালচিত্রেরও একটা আনুমানিক নিদর্শন বলা যায় এট্রাস্কানদের দেয়ালচিত্রকে। আমরা আগের পর্বগুলোতেও দেখেছি, সমাধিগুলো অনেক শিল্পসম্পদের সংরক্ষণে সাহায্য করে।
কী দেখা যায় এই দেয়ালচিত্রগুলোতে। অনেক কিছু, তবে তার মধ্যে লক্ষণীয় হল কাউচে বসে পানভোজনের দৃশ্য- একাধিক পুরুষ ও মহিলা একত্রিত হয়ে। এর থেকে দুটো জিনিস বোঝা যায়। এক, পরলোকের জীবনকে পান-ভোজনের মাধ্যমে উদযাপনে বিশ্বাস করত এট্রাস্কানরা, তাই কফিনের ঢাকনা আর দেয়ালচিত্র দুই জায়গাতেই এই ছবি। যৌনতা ও নাচগানের দেয়ালচিত্রও সমাধিগৃহে থাকত। দুই, নারী-পুরুষের বৈষম্যও এট্রাস্কান সমাজে কম ছিল। কীভাবে বোঝা যায়? এই ধরনের পানভোজনের দৃশ্যে, গ্রীক সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষকে কখনওই একসাথে দেখা যেত না। গ্রীক নারী ছিল মূলতঃ অন্তঃপুরবাসিনী- রাজনীতি ও সমাজে তার ভূমিকা ছিল সীমিত। অতএব গ্রীক কুমোরশিল্পে গোষ্ঠীগত পানভোজনের দৃশ্যগুলোতে পুরুষেরাই একে অপরের সাথে থাকত। রোমানরাও এই ব্যাপারে গ্রীকদের থেকে খুব আলাদা ছিল না। অন্যদিকে এট্রাস্কানদের পানভোজনের দৃশ্যে নারী-পুরুষ একত্রে সামাজিকতা করত।
ছবি: পানভোজনের দৃশ্যে একত্রিত নারী-পুরুষ। পুরুষের রং গাঢ় লাল, নারী সাদাটে। (স্থান: টোম্ব অফ লেপার্ডস, টারকুইনিয়া, ইতালি)। ছবিটি কপিরাইটমুক্ত।
এছাড়া অনেক কফিনের ঢাকনায় ছিল স্বামী-স্ত্রীর যুগলমূর্তি। কাউচে হেলান দিয়ে, দুজনেই দর্শকদের দিকে তাকিয়ে, ভোজনের মুদ্রায়। অথবা একে অপরের দিকে তাকিয়ে। এই ধরনের স্বামী-স্ত্রীর পান ভোজনের দৃশ্য গ্রীক সংস্কৃতিতে নেই। কোনও কোনও যুগলমূর্তি শৈল্পিক বিচারে অত্যন্ত উঁচু মানের, বিশেষ করে হাতের ভঙ্গী, সাজপোশাকের ডিটেলের জন্য। মহিলাদের সামাজিক অবস্থান যে সমসাময়িক গ্রীসের তুলনায় ভাল ছিল এই দেয়ালচিত্র ও মূর্তিগুলো থেকে তো বোঝা যায়ই, আরও কয়েকটি জিনিস এখানে লক্ষণীয়- এক, এই যুগলমূর্তিগুলোতে পুরুষের বৈবাহিক একগামিতা লক্ষণীয়। যদিও পুরুষেরা দাসী বা বেশ্যাদের সাথে সঙ্গমরত হত, কিন্তু স্ত্রীর পরিচয় একজন নারীরই থাকত। যেটাকে আমরা সামাজিক একগামিতা বা বৈবাহিক একগামিতা বলে থাকি। দুই, বিভিন্ন সমাধি থেকে বিভিন্ন মানুষের যে নামগুলো পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় পুরুষেরা পদবী হিসাবে বাবার নাম বা বাবা-মা দুজনের নামই ব্যবহার করত, কিন্তু মেয়েদের শুধুমাত্র মায়ের নামকেই পদবী হিসাবে ব্যবহারের উদাহরণ পাওয়া গেছে। এটাও কিন্তু গ্রীস-রোমের থেকে আলাদা। অর্থাৎ নারীর সামাজিক অবস্থান অনেকটাই ভাল ছিল। সমসাময়িক গ্রীক লেখকরা এট্রাস্কান মহিলাদের স্বাধীনতাকে খুব ভাল চোখে দেখত না, তাদের লেখায় এট্রাস্কান মহিলাদের সহজলভ্যা ও ব্যাভিচারিণী বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
গ্রীক সংস্কৃতির সাথে তুলনা টানার কারণ হল এই দুটি সংস্কৃতির শীর্ষকাল সমসাময়িক, এরা মোটামুটি প্রতিবেশী। তাছাড়া এট্রাস্কানরা গ্রীক সংস্কৃতির অনেক কিছু অনুকরণ করেছিল। আর এট্রাস্কানদের সমসাময়িক ইতিহাস অনেকটাই গ্রীকদের লেখা। রোমান ঐতিহাসিকরাও লিখেছিল, তবে কয়েকশ বছর পর।
ছবি: কফিনের উপর এট্রাস্কান দম্পতি (National Etruscan Museum, Romeএ রক্ষিত)
Image credit: By Sailko - This file was derived from: Sarcofago degli sposi, produzione etrusca di influenza ionica, 530-520 ac ca., dalla banditaccia 01.jpg, CC BY-SA 4.0, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=92126755
ছবি: কফিনের উপর এট্রাস্কান দম্পতি (Museum of Fine Arts, Bostonএ রক্ষিত)
Image credit: https://collections.mfa.org/objects/151377/sarcophagus-and-lid-with-husband-and-wife
এই কফিনগুলি বেশীরভাগই ষষ্ঠ থেকে প্রথম সাধারণ পূর্বশতকে তৈরী। (আমি এখানে ‘খৃষ্টপূর্ব শতক’ না বলে ‘সাধারণ পূর্বশতক’ বলছি- ইংরাজী BCE বা Before Common Eraর বাংলা তর্জমা)। বেশীরভাগই পোড়ামাটির কফিন, পরে পাথরের চল হয়। স্বামী-স্ত্রীর যুগলমূর্তিআলা কফিনের ঢাকনা, কাউচে হেলান দেয়া ভঙ্গিমার কফিনের ঢাকনা- এই শিল্পশৈলীগুলো পরবর্তীকালে গ্রীক ও রোমানরা অনুকরণ করেছিল। এছাড়া এট্রাস্কান সংস্কৃতির আরও অনেক উপাদান, যেমন- মন্দিরের নকশা, অস্ত্রশস্ত্র, কিছু ঐতিহাসিকের মতে গ্লাডিয়েটরের মল্লযুদ্ধ - অনেক কিছুই রোমানরা আত্তীকরণ করেছিল। এট্রাস্কানদের হাইড্রলিক এঞ্জিরিয়ারিঙ বেশ উন্নতমানের ছিল, যা রোমানরা আত্তীকরণ করেছিল। রোমান সংস্কৃতিতে গ্রীক প্রভাব কিছুটা সরাসরি এসেছিল, কিন্তু অনেকটাই এট্রাস্কানদের হাত ঘুরে।
এবার আমরা আরেকটু পিছিয়ে এট্রাস্কানদের আরএকটু পুরোনো ইতিহাসে যাব, যখন এট্রাস্কানরা শবদাহ করত। একদম শুরুর দিকে (নবম থেকে সপ্তম সাধারণ পূর্বশতকে) ওরা এরকম মানুষের মূর্তিসহ কফিন বানাত না। শবদাহের পর ছাই রাখার জন্য যে ভস্মভাণ্ড বানাত, সেগুলোর শিল্পসুষমাও চোখে পড়ার মত। কোনও কোনও ভস্মভাণ্ড যোদ্ধাদের শিরস্ত্রাণের আকারে, কোনওটা কুঁড়েঘরের আকারের। এখান থেকে এট্রাস্কানদের কুঁড়েঘর কেমন হত তার ধারণা পাওয়া যায়। পরে ভস্মভাণ্ডগুলোর ঢাকনাতেও ওরা মানুষের মূর্তি বসানো শুরু করে, একই রকম হেলান দেয়া বসার ভঙ্গীতে। এগুলোতেও স্বামী-স্ত্রীর যুগলমূর্তি দেখা যায়। পরের দিকে প্রায় সমসাময়িক অন্ত্যেষ্টি শিল্পে ভস্মভাণ্ড আর কফিন দুটোই দেখা গেছে।
অন্ত্যেষ্টিশিল্প শুধু সামাজিক আর শৈল্পিক ইতিহাসের স্বাক্ষর বহন করে না, অর্থনৈতিক ইতিহাসেরও একটা ধারণা দেয়। এট্রাস্কানরা সমুদ্র-বাণিজ্যে বিশেষভাবে দক্ষ ছিল। সমাধিগৃহে সোনা এবং বিভিন্ন শিল্পকর্মের প্রাচুর্য থেকে এট্রাস্কান অভিজাতদের ঐশ্বর্যের ধারণা পাওয়া যায়। তাছাড়া সমাধিগৃহগুলোতে শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত বণিকদের বড় যৌথ পরিবারের দেখা পাওয়া যায়। সমাধিগৃহগুলো যৌথ পারিবারিক অনুষ্ঠানের স্থান হিসাবেও ব্যবহার হত। অর্থাৎ সমাধিগৃহগুলো পারিবারিক মেলবন্ধনরক্ষায় সাহায্য করত। ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ সাধারণ পূর্বশতকে এট্রাস্কান অর্থনীতি তার শীর্ষস্থানে পৌঁছেছিল সেটা সমাধিশিল্প থেকেই বোঝা যায়। আবার চতুর্থ শতকের পর থেকে তাদের সমুদ্রবাণিজ্যে কিছু অবক্ষয় শুরু হয় সেটাও বোঝা যায় সমাধিশিল্পের আড়ম্বর উপকূলবর্তী জায়গাগুলো থেকে দেশাভ্যন্তরে স্থানান্তরিত হতে দেখে। গ্রীকদের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের ফলশ্রুতি দেখা যায় সপ্তম সাধারণ পূর্বশতক থেকে যখন এট্রাস্কান শিল্পে গ্রীক প্রভাব বাড়তে থাকে, আর আড়ম্বরও। এই সময়ে গ্রীকদের অনুকরণে বীরত্বের প্রদর্শনও তাদের সমাধিশিল্পে বেশী বেশী করে দেখা যায়। আবার ষষ্ঠ সাধারণ পূর্বশতকে পারস্যের হাতে গ্রীক রাজ্য আয়োনিয়ার পরাজয়ের ফলে অনেক গ্রীক শিল্পী এট্রাস্কানদের শরণাগত হয়, তার ছাপও সমাধিশিল্পে স্পষ্ট।
গ্রীক শিল্পে সমকামিতা যে পরিমাণ দেখা যায় এট্রাস্কান শিল্পে দেখা যায় না। বৈবাহিক একগামী স্বামী-স্ত্রীই হয়তো আদর্শ ছিল। তবে একটি সমাধিগৃহের দেয়ালচিত্রে দুটি পুরুষের সঙ্গমদৃশ্য দেখা যায়। ছবিটা একটু অদ্ভুত। এটিতে পুরুষ দুটির সামনে একটা উত্থিতলিঙ্গ ষাঁড়ের গুঁতোতে আসা দেখা যায়। ষাঁড়টা উদ্দাম কামনার প্রতীক হতে পারে, আবার এটা সমকামবিদ্বেষের ছবিও হতে পারে। যাই হোক, পানভোজন, নাচগান, যৌনতা সবকিছুই থাকত সমাধিগৃহের দেয়ালচিত্রে। অবশ্য সব সমাধিগৃহে দেয়ালচিত্র থাকত না, পারিবারিক ঐশ্বর্যের উপর নির্ভর করত।
ছবি: সমকামিতার দৃশ্য (স্থান: টোম্ব অফ দা বুলস, টারকুইনিয়া, ইতালি)।
Image Credit: By , Public Domain, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=66091
এবার বলি এট্রাস্কানদের একটা বিশাল অবদানের কথা। যে লাতিন লিপিতে আজ ইংরাজী, ফরাসী, স্প্যানিশ সহ পৃথিবীর অনেকগুলি ভাষা লেখা হয়, পৃথিবীর বেশীরভাগ সাক্ষর মানুষ কম বেশী যে লিপির ব্যবহার করে, সেই লাতিন বা রোমান লিপির জন্ম এট্রাস্কান লিপি থেকে। এট্রাস্কান লিপির জন্ম গ্রীক লিপি থেকে।
সবার শেষে প্রশ্ন জাগে এট্রাস্কানরা কোথায় হারিয়ে গেল? রোমের সাথে কয়েকশ বছর ধরে তাদের একাধিক যুদ্ধ হয়। অষ্টম থেকে তৃতীয় সাধারণ পূর্বশতক অবধি অনেকগুলি যুদ্ধের শেষে রোমানরা এট্রাস্কানদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। এট্রাস্কান ভাষা আরও তিন শতাব্দী টিকে থাকে, তারপর লাতিন ভাষার আগ্রাসনে অচল হয়ে যায়। এট্রাস্কান ভাষা যেহেতু ইন্দো-য়ুরোপীয় পরিবারভুক্ত নয়, আর এই পরিবারের আর কোনও ভাষা অবশিষ্ট নেই, তাই ভাষার পাঠোদ্ধারও সম্পূর্ণরূপে সম্ভব হয়নি। লিপির পাঠোদ্ধার করা গেছে, কারণ এট্রাস্কান লিপি পুরোনো গ্রীকলিপি থেকে অনুপ্রাণিত। ধীরে ধীরে এট্রাস্কান ধর্ম মিশে যায় রোমান ধর্মে। এট্রাস্কান দেবী মিনার্ভা রোমানদেরও দেবী হয়ে ওঠেন। এট্রাস্কান পুরোহিতরা রোমান সাম্রাজ্যের যুগেও বিশেষ ভূমিকা পালন করত। এট্রাস্কান শিল্পরীতিগুলো রোমান শিল্পরীতি হিসাবে টিকে থাকে। রোমের রাজতন্ত্রের যুগে রোমের পঞ্চম রাজা- লুশিয়াস- রোমান ছিলেন না, উনি গ্রীক বাবা এবং এট্রাস্কান মায়ের সন্তান। এরপর প্রাচীন রোমের প্রজাতন্ত্রের যুগে আর সাম্রাজ্যের যুগেও অনেক এট্রাস্কান অভিজাত পরিবার প্রভাবশালী ছিল। এইভাবে এট্রাস্কানরা রোমান সংস্কৃতিতে বিলীন হয়ে যায়।
অসাধারণ একটি লেখা।
সমৃদ্ধ হলাম...
অসাধারণ! প্রতিটি পর্বই খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। অনেক কিছু শিখছি, জানছি।
অসাধারণ। এত কিছু জানলাম। ভোগ মানুষ কে সবসময় তাড়িয়ে ফেরে। ভাবা যায় না