সমাধিসৌধ নিজের আর্থসামাজিক অবস্থান প্রদর্শনের একটি মাধ্যম যা আমরা আগের পর্বগুলোতে দেখেছি। এই প্রদর্শন অনেকটাই হত সৌধগুলির বাহ্যিক সৌন্দর্য ও আড়ম্বর প্রদর্শনের মাধ্যমে। আকৃতিগত বিশালতা, মূল্যবান পাথরের ব্যবহার, সূক্ষ্ম ভাস্কর্যের প্রদর্শন- এগুলির মাধ্যমে নিজের এবং নিজের সমাধির গুরুত্ববর্ধন মানুষ করত। লেখার প্রচলন কম ছিল- কারণ দর্শকদের অধিকাংশই নিরক্ষর হত। কিন্তু সমাধিতে নিজেদের কীর্তিগাথা অল্পকথায় লিখে যাওয়ার পরম্পরা কিছু সংস্কৃতিতে ছিল। গ্রীক-রোমানদের সমাধিতে বিদায়-সম্ভাষণের উপস্থিতি আমরা দেখেছি। মিশরে চার হাজার বছর পুরোনো হারখুফের সমাধিতে দেখা যায় পৃথিবীর প্রাচীনতম আত্মজীবনী। আজকের পর্বেও আমরা দেখব এরকমই কিছু আত্মকথা- পাথরে খোদাই করা- প্রাচীন ইরানের।
ইরানের সমাধিনগরী নকশ-এ-রোস্তম। খৃষ্টজন্মের ৫০০ থেকে ৪০০ বছর আগে পাহাড় কেটে নির্মিত ইরানের আকিমেনিড বংশের চারটি বড় আকারের সমাধিসৌধ ও অন্যান্য ভাস্কর্য নিয়ে এই সমাধিনগরী। যে কোনও প্রাচীন শিলালেখের মত নকশ-এ-রোস্তমের লিপিগুলি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার- শুধু ইরান নয়- অনেকগুলি দেশের ইতিহাসের। আকিমেনিড সাম্রাজ্যের রাজধানী পার্সিপোলিসের কাছেই নকশ-এ-রোস্তম। পার্সিপোলিস ছিল রাজধানী আর নকশ-এ-রোস্তম ছিল রাজাদের সমাধিস্থল। দেখা যাক কী কী আছে এখানে।
দারায়ুসের সমাধি- এখানকার আর সব সমাধির মত এটিও পাহাড় কেটে তৈরী- খৃষ্টজন্মের প্রায় ৫০০ বছর আগে। এর প্রবেশপথে রয়েছে একটি দীর্ঘ শিলালেখ। কী তার বিষয়? অবশ্যই দারায়ুসের কীর্তিগাথা। উত্তম পুরুষ অর্থাৎ ফার্স্ট পারসনে লেখা। দারায়ুসের মৃত্যুর দুই দশক আগেই তাঁর সমাধিসৌধ নির্মাণের কাজ শেষ হয়, অতএব এই আত্মকথাও তাঁরই লেখানো। (উত্তম পুরুষে লেখা মানেই সবসময় নিজের লেখানো হয় না।) উল্লেখযোগ্য হল এই শিলালেখ থেকে যে তথ্যগুলি পাওয়া যায়।
দারায়ুসের সমাধির বিশদে যাবার আগে ইরানের আরএকজন সম্রাটের সমাধি আমাদের দেখতে হবে- সাইরাস বা কুরুষ। দুজনের সমাধির পার্থক্যগুলো বুঝতে হবে, এবং এই পার্থক্যগুলো কেন বোঝা প্রয়োজন- সেটাও জানতে হবে।
ছবি: নকশ-এ-রোস্তম
Image credit: By Moosiu22 - Own work, CC BY-SA 4.0
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=73454116
ছবি: সাইরাসের সমাধি
Image Credit: By Bernd81 - Own work, CC BY-SA 4.0
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=63225153
ইরানের প্রথম বড়মাপের সম্রাট ছিলেন সাইরাস। তিনিও আকিমেনিড বংশীয় বলে পরিচিত - দারায়ুসের কয়েক দশক আগের। আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদার থমাস জেফারসন- সাইরাসকে নিজের অনুপ্রেরণা হিসাবে মানতেন। দারায়ুসের সমাধি ছিল পাহাড় কেটে যথাস্থানে তৈরী। সাইরাসের সমাধি কিন্তু ফ্রী-স্ট্যান্ডিং স্ট্রাকচার- পাথর বসিয়ে বসিয়ে পিরামিড বা স্তূপের মত করে তৈরী। একটি পিরামিড আকারের স্তূপের উপর একটি বাড়ী, তার মধ্যেই ছিল সাইরাসের কফিন। এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাপ্ত স্থাপত্য যেখানে বেস আইসোলেশন প্রযুক্তি নামক ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সাইরাসের পিতামহ প্রথম সাইরাসেরও সমাধি প্রায় একইরকম দেখতে তবে ছোট আকারে। অতএব বলা যায়, দারায়ুসের সময় থেকে আকিমেনিড সমাধি প্রযুক্তিগত ও দৃশ্যগতভাবে নূতন রূপ পায়।
পার্থক্য শুধু স্থাপত্যগত নয়। পার্থক্য আছে সাইরাস আর দারায়ুসের সমাধিলেখতেও। দুটোই উত্তম পুরুষে লেখা। কিন্তু দারায়ুসের সমাধি ছোটখাটো একটা বায়োডেটার মতন- তাঁর আত্মপরিচয়, পিতৃপরিচয়, বংশপরিচয়, জাতিপরিচয়, মহাজাতিপরিচয় তো আছেই, সঙ্গে আছে উপাস্য দেবতার পরিচয় ও গুণগান, নিজের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি বর্ণন, নিজের বিশালত্বের বর্ণন এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল তাঁর অধীনস্থ ২৯টি জাতির পরিচয়।
সাইরাসের সমাধির লিপি এখন আর টিকে নেই, তবে আলেকজান্ডারের অভিযানের সময়কার দুজন পর্যটকের বিবরণ থেকে জানা যায় সেখানে কী লেখা ছিল, যদিও দুটি বিবরণের পার্থক্য আছে। আমি দুটিই দিচ্ছি-
“হে মানব, তুমি যেই হও, যেখান থেকেই আসো, আমি জানতাম তুমি আসবে। আমি সাইরাস, পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। আমাকে বিরক্ত কোরো না, এই সামান্য মাটি দিয়ে আমার দেহকে আবৃত হয়ে থাকতে দাও।”
পাঠান্তরে- “হে পথিক, আমি সাইরাস, পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং এশিয়ার অধিপতি। আমায় বিরক্ত কোরো না, এই স্মৃতিসৌধে আমায় থাকতে দাও।”
সাইরাসের সমাধিলেখতে বংশজাতিপরিচয়, বা ইষ্টদেবতার পরিচয় নেই, বরং এক কথায় তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্যের উল্লেখ আছে- তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। দারায়ুস তাঁর বংশজাতিপরিচয়ের উপর এত গুরুত্ব কেন দিয়েছেন? তার একটা কারণ হল, তিনি সাইরাসের সরাসরি উত্তরসুরী নন, তাঁর বংশপরিচয় নিয়ে সন্দেহ আছে, তাই তাঁর পরিচয় খুব জোর দিয়ে প্রচার করা জরুরী ছিল। এছাড়া তিনি একটি বংশের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যেটিকে মানুষ কয়েক শতাব্দী ধরে মান্য করবে এবং তার কুলদেবতাকে মানুষ প্রায় একেশ্বর হিসাবে উপাসনা করবে। সেইজন্যও তিনি বংশ, জাতি ও দেবতার উপর জোর দিয়েছেন। এবার দেখা যাক দারায়ুস কী লিখে গেছেন নিজের সমাধিলেখতে। এটিকে আমরা তিনভাগে ভাগ করে দেখব (এই ভাগগুলি লেখার ক্রমানুসারে নয়)। প্রথমে দেখব বংশজাতিপরিচয়। এখানে দারায়ুস বলছেন,
অদম দারয়বৌষ (আমি দারায়ুস)- ক্ষায়তিয় বজ্রক (মহান ক্ষত্রিয় বা রাজা)- ক্ষায়তিয় ক্ষায়তিয়ানাম (অর্থাৎ রাজাদের রাজা- এই শব্দটি থেকেই ভবিষ্যতে শাহেনশাহ কথাটা এসেছে)- ক্ষায়তিয় অহ্যায়া বূমিয়া বজ্রকায়া দূরাইয় অপিয় (রাজা এই মহান ভূমির দূর দূরান্তের)- বিষতাস্পহ্যা পুচ (বিষতাস্পের পুত্র) হক্ষামনিষিয় (আকিমেনিড) পার্স পার্সহ্য পুচ (পারসিক এবং পারসিকের পুত্র) অরিয় অরিয়চিত (আর্য ও আর্যবংশজ)।
এই লেখাগুলি ওল্ড পার্সিয়ান ভাষায়। এটি প্রাচীন দুখানি প্রধান ইরানীয় ভাষার একটি (অন্যটি হল আবেস্তান)। স্বাভাবিক ভাবেই বৈদিক ভাষার সাথে প্রচুর মিল। অদম = অহম, ক্ষায়তিয়=ক্ষত্রিয়, বূমি = ভূমি, পুচ = পুত্র, দূর= দূর, অরিয় =আর্য, ইত্যাদি।
ছবি: দারায়ুসের সমাধি
By Bernard Gagnon - Own work, CC BY-SA 4.0
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=67716080
ছবি: দারায়ুসের সমাধিলেখ
By Diego Delso - This file has been extracted from another file: Naghsh-e rostam, Irán, 2016-09-24, DD 11.jpg, CC BY-SA 4.0
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=75159826
জন্মপরিচয়ের উপর এত গুরুত্ব কেন? তার কারণ দারায়ুস সাইরাসের বংশজাত ছিলেন না, আর সাইরাস এবং তিনি একই বংশজাত সেটা প্রমাণ করার দায় তাঁর ছিল। তার জন্য আমাদের দেখতে হবে দারায়ুস কীভাবে সিংহাসনে বসেন। সাইরাসের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ক্যাম্বিসেস, আর তার মৃত্যুর পর সাইরাসের অন্য পুত্র বরদিয়া। কিন্তু রাজদরবারের সাতজন সম্ভ্রান্ত মানুষ দাবি তোলেন এই বরদিয়া সত্যিকারের বরদিয়া নয়, সে আসলে একজন ম্যাজাই (জাদুকর), যে ছদ্মবেশ ধরে বরদিয়া সেজে বসে আছে- যার আসল নাম গৌমাত। সাতজন সম্ভ্রান্ত মিলে এই গৌমাতকে হত্যা করে- দারায়ুস তাদেরই একজন। ইতিহাস কোনওদিনই জানতে পারবে না এই গৌমাত আদৌ কোনও ছদ্মবেশী বহুরূপী ছিল, না কি সিংহাসনের ন্যায্য উত্তরসুরী বরদিয়াই ছিল, যাকে ছলনা করে সরানো হয়। গৌমাতকে সরানোর পর এই সাতজন সম্ভ্রান্ত মানুষের মধ্যে একটা লটারির মত হয় কে সিংহাসনে বসবে সেটা ঠিক করার জন্য। শোনা যায় এখানেও দারায়ুস ছলের আশ্রয় নেন। কীরকম? ঠিক হয়েছিল সকালবেলা এই সাতজন দাবিদার একত্রিত হবে নিজেদের ঘোড়া নিয়ে। যার ঘোড়া প্রথম হ্রেষ্বাধ্বনি তুলবে সেই রাজা হবে। দারায়ুসের ভৃত্য একটি মেয়ে-ঘোড়ার জননাঙ্গে হাত ঘষে সেই হাত দারায়ুসের পুরুষ ঘোড়ার নাকের সামনে ধরেছিল বলে শোনা যায়- এবং তার ফলে উত্তেজিত হয়ে দারায়ুসের ঘোড়াই প্রথম হ্রেষ্বাধ্বনি তোলে। কিছুটা ভাগ্য ও ছলের জোরে সিংহাসনে বসলে নিজেকে সিংহাসনের যোগ্য উত্তরসুরী প্রমাণ করার দায় আরও বেশী হয়ে যায়- আর সেই দায় দারায়ুসেরও ছিল।
এখানেই শেষ নয়, কয়েকমাসের মধ্যে সিংহাসনের আরএক দাবিদার এল- আরএক ব্যক্তি নিজেকে সত্যিকারের বরদিয়া বলে দাবি করল। তাকেও দারায়ুস জব্দ করলেন। যাই হোক, নিজেকে এবং সাইরাসকে একই বংশজাত বলে প্রমাণ করার জন্য দারায়ুস টেনে আনলেন এক কাল্পনিক পূর্বপুরুষকে যার নাম হক্ষামনিষ (গ্রীক উচ্চারণে- আকিমেনিস)। এই আকিমেনিস বা হক্ষামনিষের নামেই আকিমেনিড রাজবংশ, কিন্তু ইনি সত্যিকারের ঐতিহাসিক চরিত্র কিনা জানা নেই। সাইরাস নিজেকে কখনওই আকিমেনিড বলে দাবি করেননি। তাঁর সমাধিতে তাঁর বংশপরিচয় নেই, তাঁর শীলমোহরে তাঁর পূর্বসুরী হিসাবে একমাত্র তেইসপিসের নাম দেখা যায়। একমাত্র তাঁর প্রাসাদের একটি শিলালেখ দেখা যায় যেখানে বলা হয়েছে- "আমি সাইরাস, একজন আকামেনিড"। অনেকে এটিকে দারায়ুসের লেখানো বলেই মনে করে। এই কাল্পনিক আকিমেনিসকে টেনে আনা ছাড়াও দারায়ুস আরও একটা উপায়ে সাইরাসের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলেন। তিনি বিয়ে করলেন সাইরাস-কন্যা অতৌষাকে। অতৌষা এর আগের দু'জন রাজা ক্যাম্বিসেস ও বরদিয়ার ভগিনী ও পত্নী দুইই ছিলেন। এইধরনের ভাইবোনের বিয়ের প্রথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজপরিবারে ছিল- মিশরে ছিল, ইরানে ছিল, আধুনিক ও মধ্যযুগের য়ুরোপে ছিল। অতৌষা বুদ্ধিমতী ও ক্ষমতাসম্পন্না নারী ছিলেন। দারায়ুসের পরবর্তী রাজা ছিল তাঁরই সন্তান জেরক্সিস বা ক্ষায়র্ষা, অর্থাৎ সেই সূত্র ধরে ভবিষ্যতের আকিমেনিডরা সাইরাসেরই বংশধর।
দ্বিতীয় আমরা দেখব দারায়ুসের উপাস্য দেবতার কথা। তাঁর সমাধিলেখতে অহুরমজদার উল্লেখ অন্ততঃ দশবার দেখা যায়। প্রথম পংক্তিই উনি শুরু করেছেন "বগ বজরক ঔরমজদা" অর্থাৎ "ভগবান মহান অহুরমজদা" এই শব্দগুলি দিয়ে। দারায়ুস বলছেন- অহুরমজদা যিনি পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা তিনিই দারায়ুসকে রাজা বানিয়েছেন। অর্থাৎ এখানে শুধু অহুরমজদার করুণা বা অহুরমজদার প্রতি দারায়ুসের ভক্তির বর্ণনাই হচ্ছে না, দারায়ুস এখানে জোর দিয়ে বলছেন তাঁর সাম্রাজ্য আসলে সৃষ্টিকর্তারই বিধান।
এই অহুরমজদার উল্লেখ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এভাবে খোদাই করে লেখা অহুরমজদার নাম এর আগে মাত্র এক জায়গায়ই পাওয়া গেছে, এবং এর আগে অহুরমজদা কোনও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা কখনও পেয়েছেন বলে মনে করা হয় না। লক্ষণীয় হল এখানে দারায়ুস অন্য গুরুত্বপূর্ণ ইরানীয় দেবতা অর্থাৎ মিত্র, বরুণ, বহরাম, অনাহিতা- এদের কারও উল্লেখ করেননি- এবং অহুরমজদাকে একেশ্বর বানানোর একটা প্রচেষ্টা এখানে দেখা যায়। জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম ইরানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হয়ে ওঠে আরও পরে সাসানীয় রাজবংশের সময়ে- দারায়ুসের আরও সাতশ বছর পরে। জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যগুলির রচনা দারায়ুসের তিন শতাব্দী পরে পার্থিয়ান রাজবংশের সময়ে হয়েছিল। কিন্তু জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের প্রথম রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা আকিমেনিডদের সময়ই হয় বলে মনে করা হয়, এবং আকিমেনিড যুগ জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের একটি গঠনমূলক সময় ছিল। দারায়ুসের সমাধিলেখতে জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের উপাস্য দেবতা অহুরমজদার উপস্থিতি এবং তাঁকে একেশ্বর হিসাবে তুলে ধরার একটা প্রচেষ্টা সেরকমই ইঙ্গিত বহন করে। এর আগে জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম ও অহুরমজদা এত গুরুত্ব কখনও পায়নি।
দারায়ুসের অন্যান্য শিলালেখতেও অহুরমজদাকে একেশ্বর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা দেখা যায়। অর্থাৎ একেশ্বরবাদ ও সেটাকে ব্যবহার করে একনায়কতন্ত্র সৃষ্টি করার চেষ্টা দারায়ুস করেছিলেন। তবে পরবর্তী জীবনে উনি অন্য দেবোপাসনার প্রতি সহনশীলতা দেখিয়েছিলেন। দারায়ুসের একেশ্বরবাদ স্থাপনের প্রচেষ্টা তাঁর পরবর্তী পাঁচশো বছরে জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের উত্থানের একটা ভিত্তিপ্রস্তর ছিল সন্দেহ নেই- আর তার প্রতিফলন তাঁর সমাধিলেখতে আমরা দেখতে পাই।
ছবি: জেরক্সিসের সমাধির জাতিসমূহের ভাস্কর্য
Image Credit: By A.Davey - This file has been extracted from another file: Xerxes detail ethnicities.jpg, CC BY 2.0
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=73682194
দারায়ুসের সমাধির তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জাতিসমূহের ভাস্কর্য ও বিভিন্ন জাতির নামোল্লেখ। যে ২৯টি জাতিকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, যারা তাঁকে কর দিয়েছে, এবং তাঁর আইনকে ধারণ করেছে, তাদের নাম এবং ভাস্কর্য দুইই আছে তাঁর সমাধিলেখতে। এই লিপির গুরুত্ব হল অনেক জাতিরই তখনকার পারসিক নাম এবং অস্তিত্বের কথা এই লেখ থেকে জানা যায়। মনে রাখতে হবে, এখনও আমরা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ বা জাতিকেই তাদের পারসিক বা গ্রীক নাম দিয়েই চিনি (আর অনেক গ্রীক নামও পারসিক ভাষা থেকেই এসেছে- যেমন ইন্ডিয়া)। এখানেই পাওয়া যায় হিন্দুষ বা হিদুষ বা হিঁদুষ শব্দটা। গ্রীক শব্দ ইন্ডিয়া/হিদাসপিস, আর ফার্সী শব্দ হিন্দ/হিন্দু/হিন্দোস্তান সবকিছুরই উৎস এই হিঁদুষ শব্দটা। এর মূল উৎস সংস্কৃত শব্দ সিন্ধু। এর চেয়ে পুরোনো ভারতবর্ষের খোদাই করা নাম আর কোথাও নেই। তবে মনে রাখতে হবে, এখানে হিঁদুষ বলতে দারায়ুস মূলত উত্তর পশ্চিম ভারতকেই বিশেষ করে সিন্ধু উপত্যকাকে বোঝাচ্ছেন, কারণ এর থেকে বেশী উনি ভারতবর্ষের মাটি দখল করতে পারেননি। তবে শ'দুয়েক বছর পরের গ্রীক সাহিত্যে ইন্ডিয়া বলতে প্রায় পুরো ভারত ভূখণ্ডকেই বোঝাতো, এবং হিন্দ/হিন্দোস্তান শব্দগুলোও পরে পুরো ভারতকে বোঝানোর জন্যই ব্যবহৃত হতে শুরু করে। আবার ঐ নকশ-এ-রোস্তমেই আরও সাতশ বছর পরে তৃতীয় শতকে শাপুরের শিলালেখতে হিন্দেস্তান শব্দটা দেখা যায়। এছাড়াও এই জাতিসমূহের মধ্যে গদার অর্থাৎ গান্ধারের উল্লেখ পাওয়া যায়। সত্তগীদিয়া বা থতগুষ (অর্থাৎ শত গরুর দেশ) নামক একটি দেশেরও অস্তিত্ব এখানে দেখা যায়। এটির সঠিক অবস্থান জানা নেই, তবে এটি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বলে অনুমান করা হয়। এই তিনটি ভারতীয় জাতির ভাস্কর্যকে পাশাপাশি রাখা হয়েছিল।
দারায়ুস ছাড়াও ওনার অন্য তিনজন উত্তরসুরীদের সমাধিসৌধগুলিতেও বিভিন্ন জাতির মানুষের ভাস্কর্য খোদিত আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে অক্ষত অবস্থায় আছে জেরক্সিসের সমাধিরটি। ভাস্কর্যগুলির ডিটেইল এবং রিয়ালিজম লক্ষণীয়। কার পা বা বুক দৃশ্যমান বা আবৃত রয়েছে- সেগুলো পেশীর ডিটেল দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়। মুখ, দাঁড়ি, শিরস্ত্রাণ সবই স্পষ্টভাবে খোদাই করা হয়েছিল। তবে কিছু কিছু অংশ সময়ের কোপে নষ্ট হয়ে গেছে।
এগুলি থেকে বিভিন্ন জাতির পুরুষদের ঐযুগের পোশাক-আশাক-ফ্যাশন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যেরকম পাশাপাশি রাখা সিন্ধু, সত্তগীদিয়া ও গান্ধারের পুরুষদের (অর্থাৎ ভারতীয় পুরুষদের) দেখা যায় খাটো ধুতি (বা স্কার্ট) আর অনাবৃত বুকে। হরপ্পা-পরবর্তী ভারতের এত ভাল ফ্যাশনের নথি এর থেকে পুরোনো কিন্তু নেই। অন্য সব জাতির পুরুষদের আবৃত বুকে দেখা যায়। মিশর, আরব, ইথিওপিয়া, লিবিয়া- এদের দেখা যায় সুদীর্ঘ আলখাল্লা জাতীয় পোশাকে। তিনটি শক জাতি ও আর্মেনীয়দের দেখা যায় কুর্তা (বা কামিজ) ও পায়জামা (বা প্যান্ট) পরনে। দুটি যবন (অর্থাৎ গ্রীক) জাতির উর্ধ্বাঙ্গে দেখা যায় উত্তরীয়। দাঁড়ি রাখার ফ্যাশন প্রায় সব জাতিতেই ছিল- মিশর ও ইথিওপিয়া বাদ দিয়ে।
ছবি: জেরক্সিসের সমাধির জাতিসমূহের ভাস্কর্যে তিনটি ভারতীয় জাতি
Image Credit: By dynamosquito from France - This file has been extracted from another file: Tomb of Xerxes I Soldiers of all ethnicities supporting the throne of Xerxes with names.jpg, CC BY-SA 2.0
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=73674412
ছবি: জেরক্সিসের সমাধির ভাস্কর্যসমূহ
Image Credit: By A.Davey - Flickr, CC BY 2.0
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=73680903
সবশেষে আমরা জেরক্সিসের সমাধিতে নিচ থেকে উপর চোখ বুলিয়ে নেব। সবার নিচে আমরা দেখতে পাই জাতিসমূহের ভাস্কর্য। লক্ষ করে দেখুন, ওরা সবাই একটা বেদীর মত জিনিসকে দুই হাত দিয়ে তুলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বেদীর দু'ধারে দুটি সিংহের মুখ। হ্যাঁ, এটি একটি সিংহাসন। সম্ভবতঃ এখান থেকেই ভারতে সিংহাসনের ধারণা এসেছিল। এই বেদীর উপরে দুটি ইঁটের স্তূপ দেখা যায়, বাঁদিকের স্তূপের উপরে দাঁড়িয়ে আছেন জেরক্সিস, আর একটি ধনুক হাতে লাঠির মত করে নিয়ে। তাঁর সামনের স্তূপে দেখি প্রজ্বলিত অগ্নি, যা জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের অগ্নি-উপাসনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এদের উপরে আকাশে রয়েছেন এক দেবপুরুষ- একটি ডানাওয়ালা বৃত্তের মধ্যে। ডানার নিচে পাখীর পা-ও দেখা যাচ্ছে। এই ডানাওয়ালা দেবপুরুষের নাম ফরবহর বা ফরোহর। এখনও জরথুষ্ট্রীয়রা (যাদেরকে আমরা ভারতে পার্সী বলি), এই ফরবহরকে নিজেদের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করে। প্রথম দিকে অহুরমজদাকেও ডানাওয়ালা বৃত্ত দিয়ে প্রদর্শন করা হত। ইসলামিক বিপ্লবের আগে ইরানের মুসলিম সম্রাটরাও তাঁদের কোট অফ আর্মে এই ফরবহর এবং অন্যান্য প্রাগিসলামিক প্রতীক (সূর্য, সিংহ, সিমুর্গ পাখী) ব্যবহার করতেন। দুঃখের বিষয়, ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর সবরকমের প্রাণীচিত্রণ নিষিদ্ধ হয়, আর এই ফরবহরও ইরানের সরকারি ও সামরিক প্রতীকাবলী থেকে চিরদিনের মত হারিয়ে যায়।
যতই পড়ছি, খুবই ভালো লাগছে।
দারুন লাগলো এবারের টা ।
excellent.