আগের পর্বে আমরা দেখেছি সুলতানি যুগে কীভাবে নূতন প্রযুক্তির (প্রকৃত গম্বুজ ও প্রকৃত খিলান) আর নূতন শিল্পরীতির আবির্ভাব হল, এবং কীভাবে তার মধ্যে হিন্দু মন্দিরশিল্পের প্রভাব দেখা গেল- আমলক, কলস, তোরণ, ছজ্জা, পদ্মফুল- এগুলির মাধ্যমে। এখানে বলা প্রয়োজন, এই হিন্দু প্রভাব একমুখী ছিল না। হিন্দু মন্দিরশিল্পে কিছু মুসলিম প্রভাব সুলতানি এবং বিশেষ করে মুঘলযুগে দেখা যায়। বৃন্দাবনের গোবিন্দদেও মন্দির আর যুগলকিশোর মন্দির, খাজুরাহোর প্রতাপেশ্বর মন্দির এর ভাল উদাহরণ। ভুললে চলবে না সপ্তদশ শতকে বৃন্দাবন একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ হয়ে ওঠে মুঘল ও রাজপুতদের যুগ্ম পৃষ্ঠপোষকতায়। আরএকটা ভাল উদাহরণ হল ষোড়শ শতকে বাংলায় এক-চালা, দো-চালা মন্দিরশিল্পের আবির্ভাব। একচালাকে বেংগল রুফও বলা হয়। চালা-মন্দিরে আংশিকভাবে প্রকৃত গম্বুজের প্রভাব চোখে পড়ে। প্রাক-মুসলিম যুগে বাংলায় ওড়িশার মত রেখদেউলের চল ছিল, চালা-মন্দিরের চল মুসলিম যুগে শুরু হয়। আবার এই চালা-মন্দিরের প্রভাব মুসলিম সমাধিশিল্পে পরবর্তীকালে দেখা যাবে যার একটি উদাহরণ আমরা শেষের দিকে দেখব। অর্থাৎ এই "গঙ্গা-যমুনি" সংস্কৃতির প্রবাহ অনেকটাই দ্বিমুখী ছিল। এছাড়া, ট্রু আর্চের আবির্ভাবের ফলে তৈরী হয় ভারতের প্রাচীনতম বড় মাপের সেতু- শাহী পুল- জৌনপুরে গোমতী নদীর উপর, আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত। যাই হোক আমাদের আলোচ্য বিষয় যেহেতু সমাধিশিল্প তাই অন্য শিল্পের আলোচনায় আমরা যাব না। তবে মনে রাখতে হবে মন্দিরশিল্পে এই নূতন প্রযুক্তির এবং শিল্পরীতির ব্যবহারের পিছনে সুলতানি সমাধিশিল্পের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। এবার দেখব ভারতের মুসলিম শিল্পকলার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুগ- মুঘল যুগে।
ছবি: আকবরের শাহী পুল- জৌনপুর
Image Credit: By Sayed Mohammad Faiz Haider, CC BY-SA 3.0,
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=7932171
৫) পঞ্চম পর্যায়- মুঘল যুগ (১৫২৬- অষ্টাদশ শতক)- হুমায়ুনের মৃত্যুর পনেরো বছর পর নূতন করে বিশেষভাবে ব্যয়বহুল সমাধিসৌধ বানিয়ে তাঁকে পুনঃসমাধিস্থ করা হয়- এখান থেকেই শুরু আড়ম্বরপূর্ণ, ব্যয়বহুল ও শিল্পসুষমামণ্ডিত মুঘল সমাধিশিল্পের ইতিহাস। হুমায়ুনের এই "পুনঃসমাধি" থেকে দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়- এক, মুঘলদের কাছে সমাধিশিল্পের গুরুত্ব- রাজনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক সবরকমের গুরুত্ব, আর দুই, মুঘল সাম্রাজ্যের বর্ধিষ্ণু অর্থনীতি। এরপর ষোড়শ শতকেই তৈরী হয় সেলিম চিস্তির সমাধি। সপ্তদশ শতকে বড়মাপের সমাধিসৌধের মধ্যে আমরা দেখি আকবর, মরিয়ম-উস-জমানি (জোধাবাই নামে জনপ্রিয়), ও জাহাঙ্গীরের সমাধি, নূরজাহানের পিতা ইতমাদ-উদ-দৌল্লার সমাধি, খুসরো বাগের সৌধসমূহ, বিবি কা মকবরা, আর অবশ্যই তাজমহল- প্রত্যেকটিই নিজস্ব উল্লেখের দাবি রাখে।
বড়মাপের সমাধিসৌধ রয়েছে এমন অনেক মানুষের যাদের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় আছে। যেমন যোধাবাই এবং আনারকলি। বিভিন্ন কিংবদন্তী এবং মুঘল-এ-আজম ছবিটির দৌলতে আমরা এদের জলজ্যান্ত মানুষ বলে ভাবি। এবার প্রশ্ন হল কাল্পনিক চরিত্রের কি সমাধি হয়? একটু দেখা যাক। পৃথিবী জুড়ে কাল্পনিক চরিত্রের সমাধির অভাব নেই- অনেকসময় একজনের সমাধি জনশ্রুতিতে অন্যকারও সমাধি বলে চালানো হয়- তবে এই গুজবধর্মী কাহিনীগুলো খুব ব্যয়বহুল সমাধিসৌধর ক্ষেত্রে হয় না, কারণ আড়ম্বরপূর্ণ সমাধির উদ্দেশ্যই হল নিজেদের নাম রেখে যাওয়া। আর মুঘলবংশের সমাধি মানেই ব্যয়বহুল সমাধি। যাই হোক, যাকে আমরা যোধাবাই বলে জানি তিনি হলেন মরিয়ম-উজ-জমানি, আকবরের দ্বিতীয়া স্ত্রী, জাহাঙ্গীরের মা- তিনি হিন্দু রাজপুতবংশজাত তবে যোধপুরের সাথে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁর জন্মগত নাম জানা নেই, তবে আকবরের প্রথম পুত্রের মা হবার পর তাঁর সাম্মানিক নামকরণ হয় মরিয়ম-উজ-জমানি (অর্থাৎ পৃথিবীর মেরীমাতা)। মুঘলরা যেহেতু নিজেদের বিশ্বের অধিপতি হিসাবে দেখাত, তাই মরিয়ম-উজ-জমানি, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আলমগীর- এই জাতীয় নামকরণ। কিংবদন্তী অনুসারে মরিয়ম বিয়ের পরেও হিন্দুধর্ম অনুসরণ করতেন, কিন্তু লক্ষণীয় হল হিন্দুমতে শবদাহ না করে ইসলামী মতে তাঁকে কবর দেয়া হয়। আসলে আকবর ও মরিয়ম দুজনেই আকবর প্রবর্তিত মিশ্র ধর্মমত দীন-এ-ইলাহী অনুসরণ করতেন। মরিয়মের সমাধিসৌধ আকারে বিশাল এবং গম্বুজহীন মুঘল সমাধিগুলির একটি। এটি লোদী যুগের একটি অট্টালিকার সংস্কার করে জাহাঙ্গীর তৈরী করেন। যোধাবাইএর সমাধির রহস্য জানা গেল, এবার দেখা যাক আনারকলির সমাধি। এটি লাহোরে অবস্থিত। এটি আকবর এবং মরিয়মের সমাধির তুলানায় পুরোনো, ষোড়শ শতকের শেষভাগে নির্মিত। এটি ব্রিটিশ যুগে একাধিকবার হস্তান্তর হয়, গীর্জা হিসাবেও ব্যবহার হত, এখন সরকারি পাঞ্জাব আর্কাইভ হিসাবে ব্যবহার হয়। এই সৌধের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল এখন আর জানা নেই। এই সৌধে একটি সমাধিও আছে। এটি জাহাঙ্গীরের তৃতীয়া স্ত্রী সাহিব জামালের সমাধি বলে অনেকে মনে করে। কিন্তু স্থানীয় কিংবদন্তীতে এটি আনারকলির সমাধি হয়ে গেছে! হয়তো বারবার হাতবদলের ফলে মূল তথ্যাবলী হারিয়ে গেছে।
মুঘলরা হিন্দু শিল্পরীতির আত্তীকরণ করলেও এবং পাশ্চাত্য তথা ভারতীয় মিনিয়েচার শৈলীর চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষকতা করলেও কখনওই এই দুই শৈলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ- মানুষ বা পশুপাখীর চিত্রায়ণ যা ইসলামবিরুদ্ধ- মুঘল সমাধিতে দেখা যায়নি। তবে আকবরের সমাধির বাইরের দরজার দু'পাশের জ্যামিতিক নকশায় চারখানি স্বস্তিকা দেখা যায়। মনে রাখতে হবে ইসলামী নকশায় বিভিন্ন জ্যামিতিক চিহ্নের মধ্যে স্বস্তিকা খুঁজে পাওয়া খুব আশ্চর্যের নয়- ইরানের বিভিন্ন স্থাপত্যেও দেখা গেছে। তবে আকবরের সমাধির ক্ষেত্রে এদের কেন্দ্রীয় অবস্থান লক্ষণীয়। এছাড়া ছাদে সারিবদ্ধভাবে বসানো ক্রস দেখতে পাওয়া যায়। এই স্বস্তিকা এবং ক্রস ইচ্ছাকৃত নাকি নেহাত জ্যামিতিক চিহ্ন সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না।
ছবি: আকবরের সমাধির বাইরের দরজা। দরজার দুদিকে চারটি স্বস্তিকা লক্ষণীয়।
Image Credit: By Anupam Mukherjee - Own work, CC BY-SA 4.0,
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=82591630
ছবি: আকবরের সমাধির মূল ভবন, ছাদের উপরে ক্রসের সারি লক্ষণীয়।
Image Credit: By Anupamg - Own work, CC BY-SA 4.0,
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=51759389
এলাহাবাদের খুসরো বাগে অন্ততঃ চারটি উল্লেখযোগ্য মুঘল সমাধিসৌধ আছে যার মধ্যে নিসার বেগমের মকবরা সবচেয়ে আকর্ষণীয়। পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজ মুঘলযুগের একটা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য যা নিসার বেগমের মকবরায় দেখা যায়। যদিও রাশিয়ার স্থাপত্যেও পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজ দেখা যায়- দুটি দেশে স্বতন্ত্র ভাবেই এর উদ্ভব হয়েছিল, এবং দৃশ্যগত পার্থক্যও আছে। পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজের একটা ক্রমবিকাশ কালানুক্রমে বেশ কয়েকটি সমাধি দেখলে বোঝা যায়। লোদি যুগের বড়া গুম্বদ (পঞ্চদশ শতক), হুমায়ুনের সমাধিসৌধ (ষোড়শ শতক), নিসার বেগমের মকবরা ও তাজমহল (দুটিই সপ্তদশ শতক)। গোলকাকার থেকে একটু একটু করে পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজের বিবর্তন এদের মধ্যে দেখা যায়, যা আমরা নিচের চারটি ছবিতে দেখব।
ছবি: লোদি যুগের বড়া গুম্বদ (পঞ্চদশ শতক)
Image Credit: By Vssun - Own work, CC BY-SA 3.0,
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=12374769
ছবি: হুমায়ুনের সমাধিসৌধ (ষোড়শ শতক)
Image Credit: By https://www.flickr.com/photos/posk/ -
https://www.flickr.com/photos/posk/2993469078/, CC BY 2.0, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=6884409
ছবি: নিসার বেগমের মকবরা (সপ্তদশ শতক)
Image Credit: By सत्यम् मिश्र - Own work, CC BY-SA 4.0,
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=40701039
ছবি: তাজমহল (সপ্তদশ শতক)
Image Credit: By Biswarup Ganguly, CC BY 3.0,
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=35427658
মুঘল সাম্রাজ্যের বাইরে সপ্তদশ শতকেই দাক্ষিণাত্যে আমরা দেখি কর্ণাটকের বিজাপুরে দুটি উল্লেখযোগ্য সমাধি- ইব্রাহিম রৌজা (ব্ল্যাক তাজ- ১৬২৭- অনেকে এটিকে তাজমহলের অনুপ্রেরণা বলে মনে করে) আর গোল গম্বুজ (১৬২৬-১৬৫৬)। দুটিই আদিলশাহী রাজপরিবারের সমাধি। গোল গম্বুজ তখনকার
এশিয়ার বৃহত্তম গম্বুজ। আয়তনে পৃথিবীর তখনকার বৃহত্তম দুটি গম্বুজ- প্যান্থেওন আর ফ্লোরেন্স ক্যাথিড্রালের প্রায় সমান। মুঘল যুগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অ-মুঘল সমাধি হল বিহারের সাসারামে শেরশাহের সমাধি- ষোড়শ শতকে।
ষোড়শ শতকের শেষভাগ এবং সপ্তদশ শতকে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম য়ুরোপের সঙ্গে তুলনীয় ছিল- জার্মানির থেকে বেশী, এবং ফ্রান্স-ইতালি-ব্রিটেনের সমতুল্য, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অনেকটাই বেশী (অর্থনীতিবিদ অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসন এবং তাঁর উত্তরসুরী ম্যাডিসন প্রোজেক্টের ঐতিহাসিক জিডিপির হিসাব অনুযায়ী)। এটা মাথাপিছু জিডিপি। আর সামগ্রিকভাবে বিশ্বের জিডিপির প্রায় এক চতুর্থাংশ ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। এর প্রতিফলন দেখা যেত সমাধিশিল্পের আড়ম্বরেও। সেরা মুঘলসমাধিগুলি প্রায় সবই ১৫৬৫ থেকে ১৬৬০এর মধ্যে নির্মিত। হুমায়ুন থেকে শাহজাহান অবধি মুঘল সম্রাট আর তাঁদের স্ত্রীদের সমাধিসৌধ নির্মাণে যে পরিমাণ বিনিয়োগ দেখা যায়, তা ঔরঙ্গজেব এবং পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। ঔরঙ্গজেবের কবর খুব সাদামাটা এবং সেটা তাঁর ইচ্ছাকৃতই। ঔরঙ্গাবাদের 'দখনি' তাজ অর্থাৎ বিবি কা মকবরা ঔরঙ্গজেবের পাঁচ দশকরের রাজত্বের একদম শুরুর দিকে তৈরী, তারপর ধীরে ধীরে তিনি অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা শুরু করেন, এবং তার প্রভাব শিল্পকর্মেও চোখে পড়ে। এই অনাড়ম্বরতার কারণটা ঠিক অর্থনৈতিক নয়- কারণ ১৭০০ সাল নাগাদও ভারতের অর্থনীতি শক্তিশালী ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ভারতের অর্থনৈতিক অধোগতি আর মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের ফলে সমাধিশিল্পের আড়ম্বর আরও ও হ্রাস পায়।
তবে ঔরঙ্গজেব-পরবর্তী যুগের অর্থাৎ ক্ষীয়মান মুঘলসাম্রাজ্যের সময়কার কিছু সমাধি- দিল্লীতে মুঘল অভিজাত সফদরজঙ্গের সমাধি (১৭৫৪), লক্ষ্ণৌএর বড়া ইমামবারা (১৭৯১) আর মাইসোর প্রদেশের শ্রীরঙ্গপট্টনমের হায়দার আলির সমাধি (১৭৮৪) উল্লেখযোগ্য। মনে রাখতে হবে মোটামুটি ১৮০০ সাল নাগাদও মাইসোরের অর্থনীতি শক্তিশালী এবং বৃটেনের সঙ্গে তুলনীয় ছিল, যদিও ভারতের অন্যান্য অংশে তখন দ্রুত অর্থনৈতিক অবক্ষয় শুরু হয়ে গেছে।
কেইনসীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সরকারি হস্তক্ষেপ। সরকার যখন স্টিমুলাস প্যাকেজের মাধ্যমে জীবিকা সৃষ্টি করে তখন সেখান থেকে বাজারে আরও নূতন নূতন পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা সৃষ্টি হয়, এবং সেই চাহিদা থেকে নূতন নূতন আয় এবং সেই আয় থেকে আরও নূতন নূতন পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা সৃষ্টি হয়- এভাবে একটা সুদূরপ্রসারী চাহিদা ও আয়ের প্রবাহ সৃষ্টি হয়। কেইনস প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পাশ্চাত্য জগতের আর্থিক মন্দার এইভাবে সমাধান করেছিলেন। অবধের নবাব আসফ-উদ-দৌলা ১৭৮৪র দুর্ভিক্ষজনিত মন্দার এইভাবে সমাধান করেছিলেন, কেইনসের দেড়শো বছর আগে। নবাব প্রায় সাত বছর ধরে লক্ষ্ণৌএর বড়া ইমামবারা তৈরী করিয়েছিলেন এবং সাত বছর ধরে অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন। শোনা যায়, দিনের বেলা শ্রমিকরা যা তৈরী করত তার অনেকটাই রাত্রিবেলা উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা নষ্ট করে দিত। এইভাবে নূতন নূতন কাজের চাহিদা সৃষ্টি হত।
বড়া ইমামবারা অবশ্য শুধুই সমাধি হিসাবে তৈরী হয়নি, এর মূল উদ্দেশ্য ধর্মীয় ব্যবহার ছিল, তবে এর মধ্যে আসফ-উদ-দৌলার সমাধিও রয়েছে।
আগের পর্বের আলোচনাটা অনেক বেশী দিল্লী-কেন্দ্রিক ছিল। এই পর্বে বিজাপুর, লক্ষ্ণৌ এবং মাইসোরের আলোচনা হল। এবার বলব বাংলার কথা। অর্থনৈতিকভাবে মুঘলযুগে বাংলার বিশেষ স্থান ছিল, কিন্তু যে কারণেই হোক, বাংলায় খুব আড়ম্বরপূর্ণ সমাধি নেই। বাংলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমাধিসৌধ হল ত্রিবেণীর জাফর খাঁ গাজী মসজিদ, মালদহের একলাখি সমাধিসৌধ আর ফতে খাঁর সমাধিসৌধ, এবং মুর্শিদাবাদের আজিমুন্নিসা বেগমের সমাধি। এর মধ্যে প্রথম দুটি সুলতানি যুগের, শেষের দুটি মুঘল বা মুঘল-পরবর্তী যুগের। প্রথমটি সমাধির থেকেও দরগা এবং মসজিদ হিসাবে বেশী পরিদৃষ্ট হয়। দিল্লীতে আমরা যেরকম দেখেছি, বাংলায়ও একইরকম বিবর্তন দেখা যায়। চতুর্দশ শতকের জাফর খাঁ গাজী মসজিদ অনেকটাই তৈরী হয় বিভিন্ন হিন্দু শিল্পের অবশেষ থেকে, পঞ্চদশ শতকে একলাখি সমাধিসৌধ তৈরী হয় স্বতন্ত্রভাবে তবে শিল্পরীতিতে হিন্দু প্রভাব লক্ষণীয়। একলাখিতে প্রকৃত খিলান এবং গম্বুজ দেখা যায়, যেটা জাফর খাঁ গাজীতে নেই। একলাখি ছিল বাংলার প্রথম বাঙালী মুসলিম সুলতান জালালুদ্দিনের (এর আগের বাংলার সুলতানরা সবাই তুর্কী ছিল) সমাধি। এখানে বাংলার নিজস্ব পোড়ামাটির কাজ দেখা যায়। আবার মুসলিম প্রভাবে বাংলায় যে চালা-মন্দিরশিল্পের সূচনা হয়, তার প্রভাব দেখা যায় গৌড়ের অষ্টাদশ শতকের ফতে খাঁর সমাধিতে। এটি একটি দোচালা স্থাপত্য যেটি অনেকটা গ্রাম বাংলার বাড়ীকে অনুকরণ করে অনেক বড় আকারে।
ছবি: একলাখি সমাধিসৌধ, মালদহ
Image Credit: By Ajit Kumar Majhi - Own work, CC BY-SA 4.0,
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=51885014
ছবি: ফতে খাঁর সমাধিসৌধ, মালদহ
Image Credit: By Gautam Tarafder - Own work, CC BY-SA 4.0,
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=51894984
বাংলার সমাধিশিল্পের আড়ম্বর দিল্লী বা দাক্ষিণাত্যের থেকে অনেক কম ছিল- তবে তার অর্থ এই নয় যে অর্থনৈতিক ভাবে বাংলা কম সমৃদ্ধ ছিল। মুঘল যুগে মুঘল সাম্রাজ্যের অর্ধেক জিডিপি আর পৃথিবীর এক অষ্টমাংশ জিডিপি বাংলা সুবা থেকেই আসত। বস্ত্রশিল্প ও জাহাজনির্মাণে বাংলা অগ্রণী ছিল। মুঘল যুগে দিল্লী ও সমীপবর্তী অঞ্চলের ব্যয়বহুল সমাধিগুলো সবই যে মুঘল রাজবংশের তা নয়- অনেক অভিজাতরাও সমাধির পিছনে অনেক খরচ করত। আধ্যাত্মিক বা সাংস্কৃতিক বা সামাজিক- যে কোনও কারণেই হোক- খুব ব্যয়বহুল সমাধি বাংলায় বিশেষ নেই।
ফিরে আসি মুঘল সমাধিতে। গম্বুজ, খিলান, মার্বেল আর দামী দামী পাথরের টালি তো ছিলই, মুঘল সমাধিতে এর সঙ্গে থাকত আরএকটা নান্দনিক উপাদান- স্বর্গোদ্যান! এই বাগানগুলিকে বলা হত চারবাগ- অর্থাৎ চারটি কোয়ার্টারে বিভক্ত বাগান- সমাধিসৌধের চারকোণে বা সামনে। এটি পারস্য থেকে অনুপ্রাণিত। প্রাক-ইসলামিক ইরানে চারবাগ নির্মাণ করা হত। আড়াই হাজার বছর আগে ইরান-সম্রাট কুরুষ বা সাইরাসের সমাধি ছিল একটি চারবাগে। ইসলাম-পূর্ব ইরানে, জরথুষ্ট্রীয় ধর্মে স্বর্গোদ্যান বা চারবাগের ধারনা পাওয়া যায়। পুরোনো ইরাণীয় শব্দ পরিদৈজ় (পাঁচিল ঘেরা বাগান) থেকেই ফার্সী শব্দ ফিরদৌস, গ্রীক ভাষার হাত ঘুরে ইংরাজী শব্দ প্যারাডাইস। জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের স্বর্গোদ্যানের কল্পনাই বিভিন্ন আব্রাহামী ধর্মে (খৃষ্টান ও ইসলাম) পরবর্তীকালে গৃহীত হয়। আব্রাহামী ইডেন গার্ডেনের ধারণা ইরানের চারবাগের ধারণা থেকেই এসেছে। প্রাক-ইসলামিক ইরান থেকে ইসলামিক ইরানে, আর সেখান থেকে মুঘলযুগের ভারতবর্ষে এই উদ্যানসমাধির ধারণা আসে। চারবাগে সমাধিস্থ হওয়া প্রতীকীভাবে স্বর্গোদ্যানে পরলোকবাসেরই ইঙ্গিত বহন করে।
এবার আমরা শেষবারের মত একবার দেখব তাজমহলের বাহ্যিক রূপ- উপর থেকে নিচে:
- সবার উপরে আছে তামগা (মুঘল সাম্রজ্যের সীল)- তামগা হ'ল ইসলামপূর্ব তুর্কো-মোঙ্গল সংস্কৃতির অঙ্গ।
- তার নিচে চাঁদ- ইসলামের প্রতীক।
- তার নিচে তিনটি কলস, আমলক, উল্টোনো পদ্মফুল- হিন্দু শিল্পরীতির প্রভাব। হিন্দুমন্দিরের আমলক-কলস অনেকটাই বৌদ্ধস্তূপের ছত্র ও যষ্টির অনুকরণ- অতএব ২৩০০ বছর পুরোনো সাঁচীস্তূপ জাতীয় বৌদ্ধ সমাধিশিল্পের পরোক্ষ প্রভাব বলা যায়।
- তার নিচে গম্বুজ- রোমান প্রযুক্তি।
- তার চারধারে ছত্রী- ভারতীয় সংযোজন- তাদের মাথায়ও কলস, আমলক, পদ্মফুল।
- তার নিচে ট্রু আর্চ ব্যবহার করে অনেকগুলি দরজা- আড়াই হাজার বছর পুরোনো এট্রাস্কান এবং রোমান প্রযুক্তি।
- প্রতিটা আর্চের উপরে ইসলামিক ফ্লোরাল মোটিফ।
- মূল দরজাকে ঘিরে আরবি ভাষায় ক্যালিগ্রাফি- কুর'আনের পংক্তি।
- সবার নিচে তাজমহলের সামনে রয়েছে- চারবাগ- পারসিক স্বর্গোদ্যান।
এভাবেই বিভিন্ন শিল্পরীতি, প্রযুক্তি ও আধ্যাত্মিক ধারণাকে একত্রিত করে গড়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম সমাধি-শিল্পের একটি- তাজমহল। নানা সংস্কৃতির মিলনস্থল ভারতবর্ষ। তাই এদেশের অন্যতম সেরা সমাধিশিল্পে এতগুলো সংস্কৃতির স্রোত এসে মিলিত হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। এই মিলনেরই প্রতিভূ হয়ে চারশ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাজমহল।
পরের পর্বে আসব অন্য দেশের কাহিনী নিয়ে।
(চলবে)
ছবি: তাজমহল
Image Credit: By Muhammad Mahdi Karim - Own work (Original text: self-made), GFDL 1.2,
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=19956337
বেশ তথ্যসমৃদ্ধ। ধন্যবাদ লেখাটির জন্যে।
মুগ়ল সাম্রাজ্যে বাংলা একটি উপনিবেশের মতই ছিল । রাজস্বের সিংহ ভাগ দিল্লিতে যেত আর উত্তর ভারতের সৌধগুলি তৈরী হত ।
খুবই তথ্যনির্ভর আর উপভোগ্য লেখাটি, একনাগাড়ে পড়ে ফেলা গেলো ।