আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে পরিবেশের গলা টিপে মারা কেমন জমে উঠেছে তা দেখা বা বোঝার জন্য হিল্লিদিল্লি যাবার দরকার কি! ঘরের পাশে হাওড়া শহর আর তার কোলে সাঁত্রাগাছির ঝিল। সেখান থেকে একবার ঘুরে এলেই তো হয়।
কিছুদিন আগেই খবরে উঠে এসেছিল এই ঝিল, কারণ সুদূর আমেরিকা থেকে সেখানে নাকি বেড়াতে এসেছিল লাল মাথা বহুবর্ণের ডানাওয়ালা ছোট্ট হাঁস। ভোর বেলাতেই ছবি-শিকারিদের ভিড় ঝিলের ধারে, আর অজস্র ক্যামেরার চোখ।সে একরকম ভালই,গরম সিসেয় যে বিঁধে ফেলা হয়নি তাকে, এইই অতিথি হাঁসের ভাগ্যি। শহরের ভিড়ভাট্টা,গরম না-পসন্দ বলে চিড়িয়াখানার পাশ কাটিয়ে বহু বছর হল এই ঝিলে পরিযায়ী পাখি শীতের মাসদুটোতে বেড়াতে আসছে এ আমরা সবাই জানি। এও জানি শুধু ছবি নয়,একসময় নরম তুলতুলে মাংসের লোভ চোখে নিয়েও অনেকে এখানে আসত। সেসব এখন অন্তত প্রকাশ্যে নেই, কিন্তু যা আছে তা হল দূষণ-- অতিকায় অপ্রতিরোধ্য দূষণ। পরিযায়ী পাখিদের ঠাঁই এই জলাশয়ের বিশাল বিস্তারকে ক্রমাগত যারা দূষিত করে তুলছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে দুটি সরকারি সংস্থা- হাওড়া মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এবং সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়েজ। এছাড়াও মরা কচুরিপানার ঝাঁক, নাগরিকদের সচেতনতার অভাবে জলের বুকে ভাসতে থাকা প্লাস্টিকের বোতল, ধারে প্লাস্টিক প্যাকেটের ডাঁই, সেসব তো আছেই।
এসবের জন্য ন্যাশনাল গ্রীণ ট্রাইবুনাল সেই ২০১৭ সালে আড়াই বছর সময় বেঁধে দিয়ে বলেছিল এর মধ্যেই পুরো ঝিলকে দূষণমুক্ত করতে হবে। বর্জ্যপদার্থের ভারে এর বুজে যাওয়া আটকাতে হবে,রুখতে হবে কচুরিপানার রাজ্যবিস্তার। দূষণ আটকাতে হবে যে করেই হোক। আজ ২০২০র প্রায় শেষে দাঁড়িয়ে আশা করা যেতেই পারে যে ট্রাইবুনালের আদেশানুযায়ী এই প্রচুর সময় হাতে পেয়ে ঝাঁ চকচকে হয়ে উঠেছে সাঁতরাগাছি বিল,ফিরে পেয়েছে নিজের অঢেল জায়গা, উধাও হয়েছে স্রোতরুদ্ধ করা আগাছার দল। ঝিলের উত্তরপারের বেআইনি কন্সট্রাকশন বন্ধ হয়েছে এবং বিল্ডিং মেটেরিয়াল ফেলে জলের জমি দখলও বন্ধ হয়েছে। নিশ্চয়ই ট্রাইবুনালের কথা রেখেছে রেল কম্পানি, জমি দিয়েছে সিউয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের জন্য,যাতে দূষিত জল না মিশে যায় ঝিলের জলে, ক্ষতি না হয় জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদ জীবনের। এই গোটা কর্মকান্ডের খরচ দেবে, ট্রাইবুনাল আদেশ দিয়েছিল, হাওড়া মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এবং রেলওয়েজ, যারা বিলকে দূষিত করবার মুখ্য কারিগর।
কিন্তু আসল ছবিটা একেবারেই উলটো এবং আড়াই বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি গোছের। বিল আছে বিলেই,বরং এনক্রোচমেন্ট বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্যান্য দূষণ। রেল সাফ জানিয়ে দিয়েছে জবরদখলকারীদের না ওঠালে তার কিছু করার নেই। তিনবছর আগে ঝিল সাফ করতে গিয়ে মিউনিসিপাল কর্পোরেশন জলজ পাখির বাসা বানানোর মতো নিয়ন্ত্রিত কচুরিপানার ঘেরও সাফ করে দিয়েছিল। এমন অবস্থা যে পাখি আসাই বন্ধ ছিল দু তিন বছর। তারা হাত উঠিয়ে নিলেও আবার অবস্থা স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছে। তার পেছনে নাগরিকদের একাংশ ও প্রকৃতি সংসদ, হাওড়া বিজ্ঞান চেতনা সমণ্বয় প্রভৃতি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রভূত প্রচেষ্টার কথা বলতেই হয়। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট বায়োডাইভার্সিটি বোর্ড কিছু অর্থসাহায্য করে। ফলে গত বছরও প্রায় তিন হাজার পাখি এসেছে। তবে পক্ষীকূলের বৈচিত্র্য ক্রমহ্রাসমান। হাওড়া মিউনিসিপাল কর্পোরেশন বা সাউথ ইস্টার্ণ রেলওয়েজ
বোধহয় টাকা খরচ করেনি এই বিবেচনায় যে খরচ করে লাভ কী, যখন আইন অমান্য করলেও শাস্তি পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই?
এই বিবেচনা খুব ভ্রান্ত নয়, কারণ গণতান্ত্রিক দেশে অন্যায়ের প্রতিবিধান করে বিচারব্যবস্থা। কিন্তু পরিবেশসংক্রান্ত মামলা যা এখন আদালতে ঝুলে রয়েছে, দেখা গেছে খুব কষে হিসেব করলেও তা শেষ হতে হতে লেগে যেতে পারে ৯ থেকে ৩৩ বছরের কিছু বেশি সময়। এই হিসেব ৪ঠা জুন,২০২০র। এই নিষ্পত্তি-না-হওয়া স্তূপীকৃত মামলার স্তূপ ক্রমে বাড়বে।অপরাধীর ছাতির মাপও।
হিসেবটা একটু সহজ করে বুঝে নেওয়া যাক। এখন যে হারে পরিবেশ সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে তাতে কম বেশি দেড় বছর লাগে ৩৫,০০০ মামলার রায় বেরুতে।শুধু ২০১৮ সালের গোড়াতেই ৪৫,০০৮ টি পরিবেশসংক্রান্ত মামলা রুজু হয়েছে। বছরের বাদ বাকি সময়টুকুতে আরো ৩৪,৫০৩ টি কেস। তাহলে মোট দাঁড়াল ৭৯,৫১১ টি কেস। ঐ বছরের শেষে না মেটা মামলার সংখ্যা ৪৮,২৩৮ টি। এটি শুধু এক বছরের হিসাব। এইভাবে বছরের পর বছর জমা হতে থাকে নতুন পুরনো মামলা।
সাঁত্রাগাছি আর কী দোষ করল, নিষ্পত্তির হার এইরকম হলে ইচ্ছাকৃত অপরাধ তো বাড়বেই।
আর এক রকমও আছে। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখালে নানা কথা উঠতে পারে, ফলে আইনকেই পালটে দিই।
বেআইনি খননকে আইনি করার চেষ্টা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পরিবেশ আইনে আনা একটি সংশোধনীতে।
এ দেশের খনি আইনে এখন অব্দি যে ব্যবস্থা আছে তাতে বেআইনি ভাবে কোনো খনিজ নিষ্কাশন করলে সরকার চাইলে তার মূল্যের সবটাই, ১০০% উশুল করে নিতে পারে। এই আইনের বলেই ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছিল যে উড়িষ্যাতে পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে যে লৌহ এবং ম্যাঙ্গানিজ আকরিক নিষ্কাশন করা হয়েছে, তার গোটাগুটি মূল্য, টাকার অঙ্কে যা দাঁড়ায় ১৭,৫৭৬ কোটি টাকা, তা সরকারকে ফেরত দিতে হবে।
কিন্তু আইনভঙ্গকারীকে এইরকম শাস্তি বোধহয় আর দেওয়া যাবে না। গত আগস্ট মাসের ২৪ তারিখে খনিমন্ত্রক একটি নোটিশ জারি করে, যাতে নানা "সংশোধনে"র প্রস্তাব আছে। এইরকম একটি প্রস্তাব হল বেআইনি খননের সংজ্ঞা পালটে দেওয়া।
বে আইনি ভাবে নিষ্কাশনের সবটাই নয়, এখন থেকে নজরে থাকবে কোথায় সে নিষ্কাশন হয়েছে, খনির লিজ নেওয়া অংশে নাকি তার বাইরে। এই সংশোধনী পাস হয়ে গেলে খনির লিজ নেওয়া এলাকায় যা কিছুই হোক না কেন, খনিজের উপর্যুপরি নিষ্কাশ (over-extraction of minerals) বা অন্যভাবে পরিবেশ সংক্রান্ত আইন বা বনাঞ্চলের বিশেষ আইনকে লঙ্ঘন করা, আর বেআইনি খনন বলে গণ্য হবে না। মাইনিং কোম্পানিগুলির পৌষমাস, পরিবেশের সর্বনাশ। সরকারের জরিমানা জারিও বন্ধ।
২০১৭ সালের ঐ রায় কিন্তু মাইনিং কোম্পানিগুলিকে সতর্ক করে দিয়েছিল। ওই বিপুল ক্ষতিপূরণ উঠে এসেছিল কেবল উড়িষ্যার তিনটে জেলা থেকে, তাও শুধুমাত্র লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ আকরিক বেআইনি ভাবে নিষ্কাশনের জন্য। অন্য রাজ্যে অন্য আকরিকের জন্য এই হারে ক্ষতিপূরণ ধার্য হলে সরকারি কোষাগারে কত টাকা জমা পড়ত? এই রায় দেখিয়ে যারা ক্রমাগত বে আইনি খননে ব্যস্ত, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা যেত না?
কিন্তু গেরুয়া ভারতে তা না করে অবাধ লুন্ঠনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। আর তা করা হচ্ছে ভীষণ তাড়াহুড়ো করে। যেন এই অতিমারির পর্দা সরে যাবার আগেই ঘোলা জলে মাছ ধরে ফেলতেই হবে।
খনিমন্ত্রকের নোটিশের ওপর সাধারণ পাবলিকের কোনো মন্তব্য করবার বা কোন প্রস্তাব দেবার থাকলে তা করতে হবে মাত্র ১০ দিনের মধ্যে। যদিও প্রি-লেজিসলেটিভ কনসালটেশন পলিসিতে কম করেও ৩০ দিন সময় দেবার কথা বলা আছে। আরো ভয়ংকর কথা হচ্ছে খনি মন্ত্রক জনগণের জন্য প্রস্তাবিত পরিবর্তনের একটি সারাংশ মাত্র প্রকাশ করেছে, সংশোধনীর মূল ড্রাফটে কী আছে কেউ জানে না।
তাও হয়ত তাড়াহুড়ো করে ১০ দিনের মধ্যেই টিকাটিপ্পনি সমেত তার মতামত জনসাধারণ পাঠিয়ে দিল খনি মন্ত্রকের ঠিকানায়, কিন্তু তা যদি পছন্দ না হয় সরকারের তাহলে কী হতে পারে? কেন, যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই অপছন্দের মন্তব্যগুলো পৌঁছবে সেগুলোকে লাটে তুলে দিতে পারে। শুনে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, ঠিক এটাই হয়েছে কয়েকমাস আগে এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্টের সময়। তাদের মাধ্যমে আসা মন্তব্য পছন্দ হয়নি বলে লেট ইন্ডিয়া ব্রিদ, ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার এবং দেয়ার ইজ নো আর্থ নামে তিনটে প্ল্যাটফর্মকে সরকার অকেজো (ইনএক্সেসিবল) করে দিয়েছে। অথচ মানুষ তো আপত্তি জানাবেই, কারণ ড্রাফটে পরিবেশ দপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজ শুরু করে দেবার অনুমতির ব্যবস্থা আছে।আরো যা যা আছে তার মধ্যে পরিবেশের দিক থেকে ভয়ংকরতম হল সীমান্ত এলাকায় ( যে কোন দেশের সঙ্গে লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল থেকে ১০০ কিমি অব্দি এরিয়াল ডিস্ট্যান্স বা বায়ুগত দূরত্ব) রাস্তা অথবা পাইপ লাইনের কাজে কোনো পাবলিক হিয়ারিং হবে না, সাধারণ মানুষের দুর্গতি হলেও সেকথা শোনা হবে না। স্পষ্ট বোঝা যায় হিমালয় পর্বতাঞ্চলে এর ফলাফল কী হবে। এই অঞ্চলে বিন্দুমাত্র ভুল ডেকে আনতে পারে দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিকৃতি। তার প্রভাব যে কী সর্বনেশে হতে পারে তা আমাদের কল্পনারও অতীত।
দেশের ভেতরেও জলপথসংক্রান্ত প্রজেক্ট, ন্যাশনাল হাইওয়েজ নির্মাণ,১৫০,০০০ স্কোয়ার মিটারের কন্সট্রাকশনে (আগে এটা ছিল ২০,০০০ স্কোয়ার মিটার) কোনো পরিবেশগত ছাড়পত্রের দরকার হবে না।
সর্বনাশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এদেশ, সাঁত্রাগাছির ঝিল থেকে সাতপুরা পাহাড় অব্দি সবার ওপরে সর্বনাশের কালো ছায়া। জবাবদিহির দায় নেই কারো। আছে শুধু অতিমারিকে ঢাল ক'রে নিজেদের ভয়ংকর কর্পোরেটবান্ধব এজেন্ডাকে বাস্তবায়িত করবার শয়তানি পরিকল্পনা।
"সর্বনাশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এদেশ, সাঁত্রাগাছির ঝিল থেকে সাতপুরা পাহাড় অব্দি সবার ওপরে সর্বনাশের কালো ছায়া। জবাবদিহির দায় নেই কারো। আছে শুধু অতিমারিকে ঢাল ক'রে নিজেদের ভয়ংকর কর্পোরেটবান্ধব এজেন্ডাকে বাস্তবায়িত করবার শয়তানি পরিকল্পনা।"
দারুণ লিখেছেন!
দোরগোড়ায় "দাঁড়িয়ে", না সর্বনাশের কর্দমে প্রোথিত | এই দুইয়ের তফাৎ না বুঝলে আরো দুঃখ অনিবার্য!
সমস্যাটি বিষয়ে হয়তো সবাই সচেতন। কিন্তু এভাবে তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বক্তব্যটি সংক্ষেপে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসটি জরুরি দেশের কাজ । এগিয়ে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ লেখককে। আশা থাকে, একদিন আমরাও সচেতন হবো।
ধন্যবাদ। অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় লেখা। আরো ছড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি।
সমস্যার পুরো ছবি সুন্দর ভাবে ধরা হয়ছে। এনাজননর লেখাগুলো গুরুর ওজন বাড়িযেছে ।
এক একটা জলাভূমি শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের উদাসীনতা বলব নাকি অন্য কিছু? কারুর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সামান্য কিছু শুভ উদ্যোগ, যা যথেষ্ট নয়, চোখে পড়ে। তাদের লড়াইও অসম একটা লড়াই।
প্রয়োজনীয় লেখা। হনন এর প্রতিটি পর্বই পড়েছি। জঙ্গল, খনি, জলাভূমি, পরিবেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত মুন্সিয়ানার সঙ্গে লেখক উদ্ঘাটন করেছেন। আজকের জন্য প্রয়োজনীয় লেখা।