বেশিদিনের কথা নয়। ২০১৮ সালের ১৩ই ডিসেম্বর। মেঘালয়ের জয়ন্তিয়াতে ১৫ জন খনিশ্রমিক খনির ৪০০ ফুট নীচে আটকে। বেঁচে থাকার আশা খুব কম। কারণ তাদেরই গাঁইতির আঘাতে আঘাতে দুর্বল হয়ে আসা পাথুরে দেওয়াল ভেদ করে পাহাড়ি ঝোরার অফুরন্ত জল ঢুকে পড়েছে খনিগর্ভে। আশেপাশের ১৫ টি খনি সেই জলে প্লাবিত। কতো পাম্প করে জল তুলবে প্রশাসন ! ফাঁদে ফেলা ইঁদুরের মতো নিশ্চিত মৃত্যু নাচছে মানুষগুলোর কপালে, যেমন নেচেছিল চাসনালার শ্রমিকদের কপালে। মানুষ নয়, যেন ইঁদুরই মরছে সুড়ঙ্গের ভেতরে। সার্থকনামা মেঘালয়ের এই র্যাট হোল মাইনিং, ইঁদুরের মতো গর্ত করে কয়লা তোলার আদিম কায়দা।
কয়লা হলো কালো মাণিক। আগামী ২০০ বছরেও কয়লার ব্যবহার কমানো যাবে কিনা সন্দেহ। আমাদের দেশ হলো পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয় কয়লা উৎপাদনকারী দেশ এবং দেশের অভ্যন্তরে এনার্জি ব্যবহারের ৬০% মেটায় এই কয়লা। ফলে কয়লাখনি নিয়ে লোভী মানুষের টানাপড়েন বহুদিনের পুরনো। এই লোভের চক্করে আইনি খনিগুলোর মালিকানা বেসরকারি হাতে তুলে দেবার জন্য নীলাম ডেকেছে কেন্দ্রীয় সরকার। আর যে খনি গুলো বেআইনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে গোটা দেশেই পরিবেশ ধ্বংসের দেদার ব্যবস্থা হয়েছে নির্বিচারে। কারো হুঁশ নেই। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেঘালয় রাজ্য আর তার কয়লাখনিগুলি।
মাত্র দু আড়াই বছর আগে সেখানে র্যাট হোল মাইনিংয়ের যে রমরমা দেখে এসেছি ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। পাহাড়ের পর পাহাড় দাঁড়িয়ে, সব ন্যাড়া আর বিশাল বিশাল ক্ষতচিনহ শরীরে। বুলডোজারের সৃষ্টি করা ক্ষত, কোথাও বা ভারসাম্য রাখতে না পেরে বিশাল ধ্বস। শুকিয়ে গেছে চেরাপুঞ্জি, বৃষ্টি এখন সর্বাধিক মৌসিনরামে। তবুও সে নাকি পুরনো চেরাপুঞ্জির মত নয়। সাত বোনের প্রস্রবণের(seven sisters falls) গা গড়িয়ে আর আগের মত অঝোর ঝরন শ্রাবণজল নামে না। নামবে কী করে, যে বিশাল পাথরের চট্টান থেকে গড়িয়ে নেমেছে সাত বোন, সেই চট্টানেই কয়েক কিলোমিটার দূরে তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল হোটেল, বড়মানুষদের প্রমোদাশ্রয়।
র্যাট হোল মাইনিং এখানে পরিবেশ ও জনজীবনের অভিশাপ। আবার জীবন সচল রাখার জন্য উপার্জনের নিশ্চিত উৎসও বটে। এই টানাপড়েনে কতোবার সরকার বদল হলো, কতোবার এক্টিভিস্ট এবং সাধারণ শ্রমিকের রক্ত ঘামে পাহাড় ভিজে গেল,কিন্তু বন্ধ হল না পাহাড়ের পেট অব্দি ইঁদুরের মত সুড়ঙ্গ খুঁড়ে কয়লা এবং অন্যান্য দামী খনিজ উত্তোলন।
ছত্তিসগঢ় এবং মেঘালয়ের কয়লাখনির মধ্যে কয়লাস্তরের বিশাল পার্থক্য রয়েছে। প্রথম রাজ্যে এই স্তর যথেষ্ট চওড়া, কিন্তু দ্বিতীয়টিতে খুবই সঙ্কীর্ণ। হয়তো দুটি চওড়া পাথুরে স্তরের মাঝখানে বা একেবারে নীচে রয়েছে সরু একটি কয়লা স্তর। ব্লাস্টিং করলে সবটাই তছনছ হয়ে যেতে পারে। এইরকম ক্ষেত্রে তাই স্থানীয় পদ্ধতিতে কয়লা পাবার জন্য কাজে লাগানো হয় এই র্যাট হোল মাইনিং। পাহাড়ের ভেতর খুদে সরু সুড়ঙ্গ কেটে কেটে এগিয়ে যাওয়া। যদি কয়লাস্তর একেবারে নীচে ভূত্বক লাগোয়া হয় তাহলে আনুভূমিক খনন। সুড়ঙ্গ কেটে তার ভেতর ঢুকে বসে বা এক কাতে শুয়ে গাঁইতি দিয়ে সারাদিন ঠুক ঠুক করে কয়লা কাটা। এই সুড়ঙ্গগুলো শাখা প্রশাখা বিস্তার করে চলে যেতে পারে মাইলের পর মাইল, সেটা নির্ভর করবে পাহাড়টি আড়েবহরে কতোখানি তার ওপর।কাটা সুড়ঙ্গগুলোর উচ্চতা মেরেকেটে ৩/৪ ফুট। নাহলে মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়ার ঝুঁকি বেশি হয়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্কের ঢোকা অসুবিধে হলে হামেশাই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ছোট ছোট শিশুদের। কারণ গুণের বিচারে মেঘালয়ের কয়লা হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম। এক ট্রাক মেঘালয়ের কয়লা গুণমানে ছ'ট্রাক ছত্তিসগঢ়ি কয়লার সমান। ফলে এর একটুও ফেলা যাবে না। বরং প্রাণ নিয়ে টানাটানি চলুক তাদের, ওই যাদের ‘ছোটো ছোটো দুটো পা, ছোটো দুই হাত’।
আর একরকম খনি-খনন চলে মেঘালয়ে। পাহাড়ের ওপরিভাগে কয়লা না থাকলে গভীর গর্ত করে ক্রেনের সাহায্যে অনেক নীচে পেটের ভেতর নামিয়ে দেওয়া হয় একদল শ্রমিককে। পায়ের নীচে দাঁড়াবার জায়গা পেলেই তারা লিডারের আদেশমতো চারদিকে ইঁদুরে-সুড়ঙ্গ খুঁড়তে শুরু করে। যে যে সুড়ঙ্গের ভেতরে কয়লাস্তরের খোঁজ পাওয়া গেল, শ্রমিক সেই সেই অপ্রশস্ত জায়গাতে এক পাশ হয়ে শুয়ে গাঁইতি চালাতে শুরু করে খুব ভোরবেলা থেকে, যতক্ষণ অব্দি না সে বেদম ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এই লম্বা সময় তার কাছে থাকছে শুধু গাঁইতি, হেলমেট ও অন্ধকারে দেখবার জন্য কানের পাশে গোঁজা একটি পেন্সিল টর্চ। এইরকম ৪০০ ফুট গভীরে একটি খনিতে জল ঢুকে বিপদের কথা শুরুতেই জানিয়েছি।
শুধু তো কয়লা নয়, মেঘালয়ের পাহাড়গুলি পরিপূর্ণ নানা দুষ্প্রাপ্য খনিজ পদার্থে।সেগুলোর লোভেও নির্বিচারে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে পাহাড়ের পর পাহাড়। অথচ সেগুলোর কারণেই এতো সুজলা সুফলা ছিলো পরিবেশ।এ যেন হরিণা বৈরি আপনা মাসে। চেরাপুঞ্জির রাস্তায় বেশির ভাগ পাহাড় র্যাট মাই্নিংয়ের ফলে একেবারে অন্তসারশূন্য। কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটির সামনে ট্রাকের টায়ারের মোটা দাগ।ধ্বংসের জলজ্যান্ত প্রমাণ। একটির ভেতরের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়া গেল। সেটির হনন পর্ব তখন শেষ। স্মারক হিসেবে পড়ে আছে পাহাড়ি বাঁশে বানানো একটি ছোট মই। হয়তো সেখানে কোনো প্রস্রবণ ছিল। সেই অতীত সরসতার কথা মনে করিয়ে মাথার ওপর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল চুইয়ে পড়ছে। সঙ্গের খাসি ড্রাইভার পাশের দেওয়াল থেকে আঙুলে বালি তুলে নিয়ে এল এক চিমটে। এমন সাদা আর মোটা দানার মসৃণ বালি ! কলকাতার বিল্ডাররা দেখলে বোধহয় পাগল হয়ে যেতো।
জয়ন্তিয়ার দিকে আরো খারাপ অবস্থা। পরিবেশের ওপর এই যথেচ্ছাচারের প্রভাব শুধু বৃষ্টি কমে যাওয়াতেই পরিলক্ষিত হচ্ছে এমন নয়, চাষবাস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বাতাসে দূষণের পরিমাণ বাড়ছে, বহু ঝরণা প্রস্রবণ হারিয়ে যাচ্ছে, কপিলি নদীর মতো নদী যা মেঘালয় ও আসাম দুই রাজ্যকেই সিক্ত করে, তার জলে এসিডের মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। ভূপ্রকৃতি সম্পূর্ণ পালটে যাচ্ছে।
অথচ কাগজে কলমে র্যাট হোল মাইনিং নিষিদ্ধ। ২০১৪ সালে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুন্যাল। কিন্তু সেই আদেশ সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করে স্বয়ং রাজ্য সরকার। যে রঙেরই সরকার হোক, তারা চায় মেঘালয়ে র্যাট হোল মাইনিংয়ের রমরমা বজায় থাকুক। তাতে রাজস্ব কমে না। চাকুরিপ্রার্থীর সংখ্যা বাড়ে না। বিপুল পরিমাণ টাকা হাত এবং রঙ বদলাতে পারে। ফলে ট্রাইবুন্যালকে কাঁচকলা দেখিয়ে রমরমিয়ে চলছে এই হননপর্ব, সারা মেঘালয় জুড়ে।
যখন সাধারণ মানুষ লড়ছে এক অচেনা অতিমারির সঙ্গে, যখন লক ডাউনে ঘরের বাইরে যাবার অনুমতি দিচ্ছে না প্রশাসন, তখনও থেমে নেই এই কারবার। ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক, ইঁদুরেরা খুঁড়েই চলেছে পাহাড়ের পেটের ভেতর। গত সপ্তাহেও শিলচরে রেল গেটে বেআইনি কয়লার ট্রাক আটক হয়েছে। কয়লা কারবারিদের সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব আরো একবার সামনে এসেছে।
কিন্তু তাতে কার কী ! দেশের সরকার যেখানে পরিবেশ প্রতিবেশকে গোল্লায় ঠেলে দিচ্ছে সেখানে কার সাধ্য এইসব অনাচারকে আটকায়? এর আগের পর্বে কয়লাখনি নীলাম ও তাতে বিশাল বনভূমি ধ্বংসের কথা লিখেছি। লিখেছি কী ভাবে কর্পোরেটের সামনে থালায় সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে এদেশের সমস্ত খনিজ ও বনজ পদার্থ। যাতে তাদের কোনো অসুবিধে না হয়, সেজন্য আইন পালটে যাচ্ছে দেদার। অতিমারির অছিলায় শুধু ভিডিও কনফারেন্স করে পরিবেশ সম্পর্কিত অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। যদি আসামের বাঘজান তৈলকূপ ও বিশাখাপত্তনমের গ্যাস লিক আমাদেরকে কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে তাহলে তা হওয়া উচিত ছিল এইরকম- এদেশের মাটিতে পরিবেশের সর্বনাশ আটকাতে হলে আমাদের চাই ইন্ডাস্ট্রির তুমুল খিদেকে বশে রাখবার জন্য যথোপযুক্ত পলিসির আশ্রয় নেওয়া। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে?
সরকার জারি করতে চলেছে এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট (EIA) নোটিফিকেশন,২০২০। এতে মেঘালয় তো বটেই, গোটা দেশের পরিবেশ আন্দোলন সাংঘাতিক মার খাবে।এতে প্রথমেই বলা হলো জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থে বা ঐ ধরনের কোনো কাজে পরিবেশের প্রশ্ন বাধা হয়ে দাঁড়ালে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে কেন্দ্রীয় সরকার একাই একশ। কোনো আইন, কোনো ট্রাইবুন্যালের সে ব্যাপারে নাক না গলালেও চলবে। সরকার এবং কর্পোরেটের শুভদৃষ্টির এই স্বর্ণালী লগ্নে কোনো থার্ড পার্টির উপস্থিতির দরকার নেই। আরো মারাত্মক, সেই বোঝাপড়াকে জনসাধারণের গোচরে আনবার কোনো দায় সরকারের আর রইল না। এখন থেকে এক্টিভিস্টরা রাইট টু ইনফর্মেশন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েও কিছুই জানতে পারবেন না। অকাতরে চলবে পরিবেশের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে কর্পোরেটতোষণ। এছাড়া বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিকে ক্যাটেগরি A থেকে ক্যাটেগরি B1 বা B2 তে নিয়ে যাওয়া হবে, কারণ ঐ বিশেষ ক্যাটেগরি গুলিতে জনসাধারণের অনুমোদন বা ট্রাইবুন্যালের রিপোর্ট কোনো কিছুরই দরকার নেই।
আরো আছে। মাইনিং প্রজেক্টের ক্ষেত্রে পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্রের সময়সীমা ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৫০ বছর করা হবে এবং নদী উপত্যকার প্রজেক্টগুলির ক্ষেত্রে তা হবে ১০ বছর থেকে বাড়িয়ে ১৫ বছর। অন্যদিকে যদি কোনো প্রজেক্ট নিয়ে পাবলিকের যদি কিছু বলার থাকে, তাহলে পাবলিক হিয়ারিং এবং সেই সংক্রান্ত এপ্লিকেশন জমা দেবার সময়সীমা ৩০ দিন থেকে কমিয়ে ২০ দিন করা হবে।
এই নতুন ড্রাফট, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, প্রবল ইন্ডাস্ট্রি-বান্ধব। পরিবেশসম্পর্কিত নিয়ম ভঙ্গ করলে খুব অল্প পয়সা দিয়েই ছাড় পাওয়া যাবে। উর্ধসীমা B2 ক্যাটেগরির জন্য প্রত্যহ ২০০০ টাকা,A ক্যাটেগরির জন্য প্রত্যহ ১০,০০০ টাকা।
পাবলিক হিয়ারিং না করা এবং দুর্বল এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্ট কী সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে তা আমরা বাঘজানে দেখে ফেলেছি। এর মধ্যেই তদন্তে প্রকাশ যে অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের কাছে হাইড্রোকার্বন টেস্টিং এবং ড্রিলিং এক্টিভিটি চালিয়ে নিয়ে যাবার মত পরিবেশগত ছাড়পত্র ছিল। ছাড়পত্র যারা দিয়েছে তাদের এসেসমেন্ট ঠিক ছিল না বোঝাই যাচ্ছে। আর যা একেবারেই ছিলো না বলে জানা যাচ্ছে তা হল স্থানীয় মানুষের অভিযোগে কর্ণপাত করা এবং পাবলিক হিয়ারিংয়ের ব্যবস্থা করা।
বোঝাই যাচ্ছে সরকার কী চায়। জাতীয় সুরক্ষা বা ঐ ধরনের কোনো অছিলায় সরকার পাবলিক হিয়ারিং এবং পরিবেশ সম্বন্ধীয় আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে নিজেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চায়। জনমতকে বেশ পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে। এই নতুন ড্রাফট এইভাবেই ১৯৮৬ সালের পুরনো এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এক্টকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেবে। সুবিধে করে দেবে কর্পোরেটের।
এই নয়া এসেসমেন্ট তো কেবল মেঘালয়ের পক্ষে প্রযোজ্য নয়, গোটা দেশেই এর প্রভাব পড়বে জোরালোভাবে। উত্তরপূর্বাঞ্চলের প্রায় সব কটি রাজ্যই জীব বৈচিত্রে ভরপুর, ঘন অরণ্য ছাওয়া, প্রচুর ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি এবং ন্যাশনাল পার্কে পূর্ণ। এমনই সংবেদনশীল এরিয়া এইগুলি যে কয়লা উত্তোলন দূরে থাক, পাবলিক হিয়ারিং এবং জোরদার EIA রিপোর্ট ছাড়া এখানে এমনকি মাঝারি মানের একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি বানালেও তৈরি হতে পারে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা, যা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে পারে এইসব ভঙ্গুর জীব বৈচিত্রময়তাকে। সেসবকে পাত্তা না দিয়ে একের পর এক প্রনয়ণ করা হচ্ছে পরিবেশ বিরোধী, জনবিরোধী সব আইন, যোগ করা হচ্ছে নতুন নতুন এসেসমেন্ট,ডাকা হচ্ছে নীলাম।
র্যাট মাইনিংয়ের ফলে মেঘালয়ের ওই অন্তসারশূন্য ফোঁপড়া পাহাড়ই হয়তো এরপর আমাদের পরিবেশভাবনার প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে।
গেরুয়া ভারতে পরিবেশের টুঁটি টিপে ধরবার ব্যবস্থা বেশ পাকাপোক্ত হয়ে উঠছে এই অতিমারির পর্দার আড়ালে। যে নোটিফিকেশনের কথা বললাম সেটি লক ডাউনের রেশ থাকতে থাকতেই যাতে পাস হয়ে যায় সেজন্য সরকার খুব সচেষ্ট। প্রথমদিকে জানাজানি যাতে বেশি না হয়, জনমত গঠনের আগেই যাতে ব্যাপারটি সেরে ফেলা যায়, সেই চেষ্টা চলছিল।কিন্তু দিল্লি হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের ফলে বাধ্য হয়ে কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনকে এই খসড়া সম্বন্ধে মতামত দিতে বলা হয় এবং তার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় আগামী ১১ই আগস্ট। সেই মতোই তিনটে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের দপ্তরে মতামত জানিয়ে প্রচুর ইমেইল জমা পড়ছিল। সেগুলো সবই সাধারণ মানুষ এবং পরিবেশপ্রেমীদের আশঙ্কা এবং আর্তিতে ভরা। এই খসড়া পাস হলে কী বিপদ নেমে আসবে তা তাদের থেকে ভালো আর কে বুঝবে ?
এই সংগঠনগুলির মধ্যে গ্রেটা থুনবার্গের অনুপ্রেরণায় গঠিত দিল্লির ফ্রাইডেজ ফর ফিউচারও রয়েছে। আর আছে লেট ইন্ডিয়া ব্রিদ এবং দেয়ার ইজ নো আর্থ নামের দুটি প্ল্যাটফর্ম। মূলত এইসব তরুণ পরিবেশকর্মীদের লাগাতার প্রচারের ফলেই খসড়ার বিরোধিতা করে এতো ইমেইল জমা পড়েছে।
এতটা সহ্য হল না সরকার বাহাদুরের। হঠাৎ এদের বিরুদ্ধে নোটিস জারি করা হল যে তাদের কাজকর্ম ইউএপিএ (আনলফুল এক্টিভিটি প্রিভেনশন এক্ট), যা কিনা মূলত সন্ত্রাস প্রতিরোধে ব্যবহার করা হয়,তার আওতায় আনা হবে।কারণ তাদের ওয়েবসাইটে দেশদ্রোহের অনেক মশলা মজুত আছপরে ইউএপিএয়ের হুমকি তুলে নিলেও কোনো নোটিশ না দিয়েই এই ওয়েবসাইটগুলো ব্লক করে দেওয়া হয়।
জরুরী অবস্থার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে এই কন্ঠরোধ। নিজের দেশের পরিবেশ রক্ষায় উৎসাহী হলেও দেশদ্রোহীর তকমা লেগে যেতে পারে। কী ভবিষ্যত এদেশের পরিবেশ আন্দোলনের তা বুঝিয়ে দেবার জন্য সরকার বাহাদুর অনেক কাজ ইতোমধ্যেই করে ফেলেছেন। ভবিষ্যতে আরও কী করেন সেদিক থেকে নজর সরালে চলবে না।
উন্নয়নের নামে প্রকৃতি, পাহাড়, জংগল ধ্বংসের যেন এক মহোৎসব! ইশ, খনির মজুর-শিশুদের ছবিগুলোর দিকে আর তাকানো যায় না।
"তাদের ওয়েবসাইটে দেশদ্রোহের অনেক মশলা মজুত আছপরে ইউএপিএয়ের হুমকি তুলে নিলেও কোনো নোটিশ না দিয়েই এই ওয়েবসাইটগুলো ব্লক করে দেওয়া হয়।"
অনাচার আরও দুর্বিষহ হয় যখন তা সবাই চুপচাপ মেনে নেয়। প্রতিবাদ হচ্ছে জেনে ভাল লাগলো, সর্বত্র আরও প্রতিবাদ হোক।
আরও লেখ প্রতিভা দি।
এই সে দুঃসময় আগত। আমার জরুরী অবস্থার প্রাক মুহুর্তের কথা মনে পড়ছে। কিন্তু এটা তার থেকেও অনেক বেশি শয়তানী ও বজ্জাতিতে পরপূর্ন প্যাকেজ। গেরুয়াধারী রা দেশ টাকে মাত্র সাত বছরে ছিঁবড়ে বানিয়ে ছোবড়া করে দিয়েছে। এবার আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে। আমি তীব্র প্রতিবাদ করছি। যদিও জানি লাভ বিশেষ কিছু এখনই হবেনা, যতদিন না সাধারন মানুষ ঘুমঘোর থেকে জেগে না উঠব।
রাজার জামাকাপড়ের রঙ যাই হোক। তারা সবকিছু বণিকের হাতে তুলে দিতে চায়। এটাই এখন আত্মনির্ভরতার সংজ্ঞা। তাই দেশী-বিদেশী বণিকসংস্থা নিজেদের পেয়ারের লোকদের ক্ষমতায় বসায়: চা বিক্রেতা থেকে দেশের শাসক হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ রাখে আর ইচ্ছেমতো আইনকানুন জারি করিয়ে নেয়। এরই সর্বশেষ উদাহরণ এই পরিবেশবন্ধ্যা নোটিফিকেশন। অতিমারির মধ্যেও লুটেপুটে খাচ্ছে মহাবণিকরা। পুঁজিবাদের মৃত্যুঘন্টা বাজার বদলে রমরমিয়ে চলছে ডিজেস্টার ক্যাপিটালিজম। আরও কুড়িবছর আগে হলে বলা যেত অশনিসংকেত। কিন্তু এসময়ে রীতিমতো নরমেধ চলছে। নগরায়নে, পণ্যের জোয়ারে, মিডিয়ার পুতুলনাচে সব আড়াল পড়ে যাচ্ছে।
লেখাটা পড়ে অসহায় লাগছে, ক্ষোভ হচ্ছে, সেটাই এখানে লিখে গেলাম। লেখাটা ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। যেন সবাই স্বীকার করি আমরা বিপন্ন। আমফান থেকে বিহার-অসমের বন্যা কিছুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা প্রকৃতির খেয়াল নয়-- এ চিন্তা অ্যাকাডেমিয়া থেকে প্রলেতারিয়েত মহল সবখানে আলোচিত হোক। এই নৈরাশ্যের মধ্যেও আশাবাদী আমরা।
এটা এতটাই ভয়াবহ যে এর অর্ধেক যদি সত্যি হয় তাহলে কিছু বলবার বা লিখবার মতো মনের অবস্থা থাকে না। কি ভয়ংকর ।
শুভ বুদ্ধির উদয় হোক এ ছাড়া আর কি বা বলতে পারি।
সবই তো তথ্য প্রমাণ ছবি দিয়ে লেখা। নেটে তো আছেই, সব ঘটনা গুলোও কাগজে মিডিয়ায় বার হওয়া। এমনকি পরিবেশকর্মীদের বিরুদ্ধে ইউএপিএর হুমকির ব্যাপারটাও সব কাগজ কভার করেছে।
ফলে অর্ধেকটা তো বটেই, পুরোটাই সত্য। শিউরে ওঠার মতো সত্য।
এই ল্যাম্পপোস্টের ব্যাপারটা কী !!
মেঘালয়ের কয়লা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের স্তর ও rat mining নিয়ে অসাধারণ বাস্তব তথ্য দিয়েছেন৷ আসলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ওখানকার খনিজ পদার্থ পাহাড়ের অভ্যন্তর থেকে উত্তোলন সম্ভব নয় তাই দশকের পর দশক জুড়ে বিভিন্ন লোভী সরকারের বদান্যতায় এই অতি বিপজ্জনকভাবে মাইনিং পদ্ধতি চলে আসছে যা পূর্ণতা পেয়েছে মানব ও পরিবেশ বিদ্বেষী বিজেপি সরকারের আমলে৷ সামগ্রিকভাবেই এই লুন্ঠনকার্য্য চালাচ্ছে এই সরকার যার স্পষ্ট ছবি আপনি তুলে ধরেছেন৷ এইভাবেই আপনি প্রতিবেদন লিখতে থাকুন দিদি, যতটা সম্ভব সচেতনতা তৈরী হোক আর হোক প্রতিবাদ নানানভাবে
২০১৮-র ডিসেম্বরে মেঘালয়ের কয়লাখনিতে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল তাতে ঠিক কত জনের যে মৃত্যু হয়েছিল সেটাই স্পষ্ট হয়নি। বেআইনী "ইঁদুরের গর্তে" তো আর হিসেব রাখা হয় না। তবে ওখানে জল ঢোকার পর আসাম থেকে আসা এক মহিলা দুই শিশু সন্তান নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন অনেক দিন। না, তাঁর হারানো স্বামীকে ফিরে পাওয়া যাবে এই আশায় নয়। তিনি যে আর ফিরবেন না সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তবে সেটা সরকারি ভাবে সেটা জানানো হলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে এটুকুই ছিল তাঁর ভরসা। তাঁর কী হয়েছিল শেষ পর্যন্ত জানা নেই। আজ এই লেখা পড়ে ওই মহিলার কথা মনে পড়ল।
দ যথার্থই বলেছেন, "পরিবেশ ফরিবেশ আবার কি! যত্তসব ব্যাগড়াবাদীর দল। সব ভেঙেচুরে, খুঁড়ে তুলে, কেটে সাফ করে তবে না উন্নয়ন।" তবে সেই উন্নয়নটা যে ঠিক কার সেটাই বুঝে উঠতে পারি না।