করোনা অতিমারির পর্দার আড়ালে কীভাবে কাজ হাসিল করতে হয় তার টাটকা উদাহরণ কয়লা ব্লকগুলিকে নীলামে তোলা। লোকজন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের কারণে জমায়েত, মিটিং মিছিল ধর্ণা, আদালতের শরণাপন্ন হওয়া কোনো প্রতিবাদই দ্রুত সংগঠিত করতে পারছে না। সরকার ঠিক এইসময়টিকেই বেছে নিলো পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ স্থানে থাকা বিশাল ভারতীয় কয়লা ভান্ডারকে বেসরকারি হাতে তুলে দেবার। নতুন মালিকের কয়লা খনি সংক্রান্ত কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও চলবে এবং তাকে নির্দিষ্ট ভাবে দেখাতেও হবে না যে এই উত্তোলিত কয়লা সে ঠিক কোন কাজে ব্যবহার করতে চলেছে। উপরন্তু কয়লার দামের ওপর কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ রইল না। মানে কোনো দায়ভারই রইল না, শুধু মস্ত জিভ বার করে লাভের মধু খেয়ে যেতে থাকো।
এখানে ইন্টারেস্টেড মধুকরদের নামগুলিও জেনে নেওয়া দরকার। তারা হলো হিন্ডালগো, জিন্দল স্টিল এন্ড পাওয়ার, JSW এনার্জি, আদানি গ্রুপ এবং ওড়িশার সেই কুখ্যাত বেদান্ত। এছাড়াও বিদেশী খেলুড়েদের মধ্যে আছে পিবডি, BHP বিলিটন এবং রিও টিন্টো। কেন এদের হাতে তুলে দেওয়া? প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে স্পষ্ট কয়লা আমদানি কমিয়ে আত্মনির্ভরতা অর্জনের জন্যই এই পদক্ষেপ। কেন তা সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই সম্ভব নয়, সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবেনা জেনেই দেখে নেওয়া যাক এই পদক্ষেপে কতটা মার খাবে ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে আসা এদেশের পরিবেশ।
ভারতের মধ্যপূর্বভাগ জুড়ে জীববৈচিত্রপূর্ণ যে বিশাল অরণ্য তারই ছায়ায় আত্মগোপন করে রয়েছে বেশির ভাগ কোল ব্লক। তার মধ্যে ঝাড়খন্ড, ছত্তিসগড়ের বনাঞ্চল যেমন পড়ে, তেমনি ওড়িশার ঘন বনও বাদ যায় না। ছত্তিসগড়ের হাসদেও আরান্দ অরণ্যের কথাই ধরা যাক না কেন। ১৭০,০০০ হেক্টর জুড়ে সবুজ পাহাড়, নদী, অরণ্য আর সেই মাটির নীচেই নয় নয় করে ১৮ টি কোল ব্লক। ভূমিপুত্ররা প্রতিবাদে এককাট্টা। গ্রামসভাও এই লুন্ঠন চায় না। প্রধান মন্ত্রীকে মিটিংয়ের নথিপত্র পাঠিয়ে পাঠিয়ে তারা ক্লান্ত। অতিমারির আগে বনবাসী মানুষজন ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রার আয়োজন করেছিল। কেস করা হয়েছে। কিন্তু মানুষের লোভ তো কোর্ট কেসেরও তোয়াক্কা করে না। কেসের মতো কেস চলছে, খননের মতো খনন। নাঙ্গা করে ফেলা হয়েছে হাসদেওয়ের অনেক অংশ কয়লা আর খনিজের লোভে। এখন তো তার ওপর সরকারি সীলমোহর পড়ে গেল। খুব শিগগির এমন দিন আসবে যখন সবুজ আস্তরণ সম্পূর্ণ উবে গিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে পড়ে থাকবে কেবল কয়লার অর্ধখনিত কুৎসিত স্তর আর খনিজ বোঝাই ট্রাক চলে যাবে ধুলোমাখা শ্রমিকের মুখের ওপর আরো ধুলো ছড়িয়ে। বলার কথা এইটাই যে এই ১৭০,০০০ হেক্টর জুড়েই খননের ছাড়পত্র দিয়ে দিল সরকার, এক ইঞ্চি জমিও ছাড়েনি। তবুও পরিবেশের কথা এদের মাথায় আছে বলে মনে হয় ?
প্রধানমন্ত্রীজী তার ভাষণে অবশ্য বার বারই বলেছেন পরিবেশের প্রশ্নে কোনো আপোস করা হবে না।
কী জানি মাটির নীচে জমে থাকা খনিজের গন্ধে গাছ শেকড় দ্রুত ছড়ায় কিনা, কিন্তু হাসদেওয়ের মধ্যস্থলে পারসা ব্লকে মাটির নীচে রয়েছে যেমন বিশাল কোল ব্লক ও অন্যান্য খনিজ, ওপরে তেমনি ঠাসা অরণ্য। মাইনিংয়ের জন্য এখানে খোঁড়াখুড়ি হলে গোটা হাসদেও রিজিওন এবং বয়ে চলা হাসদেও নদীর প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধুলোবালি ইঁটপাথরে হারিয়ে যাবে নদীর প্রবাহপথ। নষ্ট সরসতার ওপর দিয়ে গড়গড়িয়ে চলবে বিশাল ডাম্পার।
এই ব্লকেই রয়েছে বহু প্রাচীনকালের এলিফ্যান্ট করিডর বা হাতির দলের চলবার পথ। তবু ২০০৬ সালের Forest Rights Act কে কাঁচকলা দেখিয়ে রমরমিয়ে চলছে সমস্ত রকম জন এবং পরিবেশবিরোধী "উন্নয়ন"। এই কি তাহলে আপোস না করবার উদাহরণ ?
এরকম একশটা উদাহরণ দেওয়া যায়। হাসদেও নিজে মহানদীর শাখা। ঝাড়খন্ডের চাকলা ব্লকের ৫৫% ঢাকা গভীর অরণ্যে। দামোদর ও বাকরি নদীর নিকাশি ক্ষেত্র এই ব্লক। মধ্যপ্রদেশের গোতিতোরিয়া ইস্ট কোল ব্লকে ৮০% ফরেস্ট কাভার এবং এটি সীতারেওয়া নদীর নিকাশি ক্ষেত্র।
মনে হয় কোল ব্লক নীলাম পরবর্তী ভবিষ্যত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আমাদের দুটিই বিকল্প দেবে। হয় মরুভূমিতে বিনষ্টি, নয় অতি বন্যায় সলিলসমাধি। কিছু চাকরির লোভ দেখিয়ে আর উন্নয়নের টোপ ফেলে এই ক্ষতি পূরণ করা যাবে তো ?
এই কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় করা কোল ব্লকগুলির বেসরকারিকরণের নীলাম এই ভঙ্গুর অথচ জীববৈচিত্রপূর্ণ অরণ্য অঞ্চলকে নিকেশ করে পরিবেশের যে ক্ষতি করবে তা অপূরণীয়। এই অঞ্চলগুলির কিন্তু সাংবিধানিক সুরক্ষা কবচ ছিল। সে সবকে হেলায় উড়িয়ে এই নীলাম বার্তা দিচ্ছে এইগুলির মূল্য বিচার হবে কেবল ভূগর্ভে সঞ্চিত কয়লার নিরিখে। সেই কয়লারও নিষ্কাশন হবে ব্যক্তিগত মুনাফা লোটার স্বার্থে। কয়লার দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ তুলে নেওয়া নাহলে কার স্বার্থে ?
আসামে ডেহিং পাটকাই ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙচুয়ারির মোট ১১১ স্কোয়ার কিলোমিটারের ৯৮.৫৯ হেক্টার জমি খুলে দেওয়া হয়েছে খোলামুখ কয়লাখনি হিসেবে ব্যবহৃত হবার জন্য। বাদবাকি অংশে চলবে কয়লা উত্তোলনের ভূগর্ভস্থ কারবার। অথচ এই স্যাংচুয়ারিটি দেশের মধ্যে বৃহত্তম নিরক্ষরীয় নিম্নভূমির বৃষ্টি- অরণ্য ( tropical lowland rainforest)! নদী ঝরণা জলাশয়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম, এই অরণ্যে বাস করে হাতি, চিতাবাঘ, গিবন প্রজাতির বাঁদর, প্যাঙ্গোলিন, ভালুক। ২০০ র বেশি প্রজাতির পাখি, সরীসৃপের সঙ্গে আছে অজস্র ধরণের প্রজাপতি আর অর্কিড। এই জীববৈচিত্রের কী হবে !
এই বিপুল অরণ্য ও পরিবেশ ধ্বংসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে! বিজেপি-শাসিত আসামে অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে রাজ্য সরকার এই ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে ট্যা ফোঁ করেনি। সবার মুখে কুলুপ আঁটা দেখে মাঠে নেমেছে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ। তাও অতিমারি বাস্তবের মাঠে নামতে দেয়নি বলে তাদের বিচরণক্ষেত্র ভার্চুয়াল মাঠ বা সোশাল মিডিয়া। তাদের দেওয়া পোস্টার ভিডিও মিম এবং ফটোগ্রাফে সোশাল মিডিয়া ছয়লাপ, কারণ এই ডাকে বিপুল সাড়া দিয়েছে আসামের অন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
শেষ করি এমনি এক নষ্ট হবার জন্য নির্ধারিত অথচ আপন মহিমায় অপূর্ব এক অরণ্যাঞ্চলের কথা দিয়ে। সেটি হচ্ছে অরুণাচল প্রদেশের দিবাং ভ্যালি। আকাশ-ছোঁয়া পাহাড়, অপরূপ প্রাণী ও মানুষে পূর্ণ এই অঞ্চলকে অনায়াসে ডাকা যায় "দিব্য উপত্যকা" নামে।
মিশমি টাকিন একধরণের দুর্লভ অজ- প্রজাতির তৃণভোজী যা পাওয়া যায় এখানে, মায়ানমারে ও চিনে। পাওয়া যায় "উজ্জ্বল-চক্ষু" প্রজাপতি(ক্যালিরিবিয়া দিবাংগেনসিস) এবং মিশমি রেনব্যাবলার। বলা বাহুল্য এই মিশমি শব্দটি জুড়ে গেছে উপত্যকার ইদু মিশমি সম্প্রদায়ের নাম থেকে। এই আদিম উপজাতীয়দের মধ্যে প্রচলিত আছে শিকার নিয়ে নানা বিধিনিষেধ। যেমন বিলুপ্তপ্রায় হুলক গিবন শিকার এখানে নিষিদ্ধ। আছে বন পাহাড়ের সঙ্গে বন্য জন্তুর প্রতিও অগাধ ভালবাসা। তাই হয়ত অরুণাচলের অন্যান্য ব্যাঘ্র সংরক্ষণ এলাকায় যত বাঘ আছে তার চেয়ে ঢের বেশি আছে দিবাং ভ্যালিতে। অরণ্যের প্রতি ভালবাসা এতো গভীর যে ইদু মিশমি সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের সমাধিতে রাখা থাকে বিভিন্ন শস্য ও বৃক্ষের বীজ সম্বলিত একটি বটুয়া। মৃত্যুর পরেও যেখানে সে যাবে, সেখানেই গড়ে উঠবে গহীন অরণ্য।
গত ২০ শে এপ্রিল ২০২০ করোনা অতিমারিতে ব্যস্ত সাধারণকে অন্ধকারে রেখে একটি ভিডিও কনফারেন্সের পর সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে এই স্বর্গে বন কেটে গড়ে উঠবে বিশাল এক হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট, দেশের বিশালতমগুলির মধ্যে একটি। এই প্রজেক্টের অঙ্গ হিসেবে সরকারি আস্তিনে লুকোনো তাসের মধ্যে রয়েছে দুটি বিশাল বাঁধ, দীর্ঘ সুড়ঙ্গ, ভূগর্ভস্থ পাওয়ারহাউস, ৫০ কিমি ব্যাপ্ত রাস্তাঘাট। এসব করতে কিছু গাছ কাটা তো অবশ্যম্ভাবী। এই "কিছু"র সংখ্যা হলো ২.৮ লাখ গাছ, যাদের অনেকেরই গুঁড়ির ব্যাস ৮ মিটারেরও বেশি। জলে ডুবে যাবে ১,১৭৮ হেক্টর জমি।
মিশমি টাকিন
"উজ্জ্বল-চক্ষু" প্রজাপতি
এই অরণ্য হারালে আর কোনোভাবেই ফিরে পাবার উপায় নেই। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ। হ্যাশট্যাগ দিয়ে ক্যাম্পেন চলছে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকেরা বিরুদ্ধতা করে চিঠি লিখছেন। হুকুম অথবা হাকিম কে আগে নড়ে এখন সেটাই দেখার ব্যাপার। হয়তো দেখা গেল সবই অনড় রইল। মাঝে থেকে নেই হয়ে গেল দিবাং ভ্যালি। নেই হয়ে গেল এদেশের পরিবেশমুখী আন্দোলন।
সেই শূন্যতার দিকেই কি সমবেত যাত্রা আমাদের?
০১)
"উন্নয়ন, উন্নয়ন, উন্নয়ন না ছাই/ রামপালে কর্ণফুলীর কান্না শুনতে পাই"...
এটি এপারের সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের গান।
রামপালে সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে বন ধ্বংসের উপক্রম হয়েছে। আর ছয়ের দশকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে অন্তত এক লাখ পাহাড়ি উচ্ছেদ হয়েছেন, ইতিহাস! ...
০২)
পরিবেশ ও প্রতিবেশ লুন্ঠনের উপযুক্ত সময়ই বটে! ছত্তিসগড় আর আসামের প্রকৃতি বিনষ্টের কথা আগে কিছুটা পড়েছিলাম, এখন বিস্তারিত জেনে বুকের ভিতর যেন কাঁটা বিঁধে গেল, ছবিগুলো কী বেদনা বিধুর নীল!
০৩)
আসলে বোধহয় প্রচণ্ড প্রতিবাদ চাই, একটা ব্রেক থ্রু চাই!
অতিমারীতে শারীরিক উপস্থিতি কঠিন হয়ে যাওয়াটা প্রতিবাদ আন্দোলনের পক্ষে খুব-ই সমস্যার হয়ে গেল।
এই অতিমারিকে সম্পূর্ণ সঙ্কীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করে রাষ্ট্র দেশকে হত্যা করার খেলাটায় এগিয়ে গেল অনেক পা। আমরা শুধু বসে বসে দেখি অসহায় - "এই তো জানু পেতে বসেছি পশ্চিম" -
ভয়ঙ্কর অবস্থা! এই করোনা অতিমারিতেও শাসকদলের লোভ কমেনি, বলা যায় শাসকের পেছনে যারা আসল শাসক তাদের লোভ একরত্তি কমেনি। ধন্য এই আধ্যাত্মিকতার দেশ, কৃচ্ছসাধনের দেশ! কতটা নৃশংস এরা। ধাপে ধাপে কি জলজঙ্গলমাটি সব বিক্কিরি হয়ে যাবে? এ বড় অসময়। সব দিকেই সাঁড়াশি আক্রমণ।
আমি গুরুর কর্তাব্যক্তিদের কাছে অগ্রিম আবেদন জানাচ্ছি-- প্রতিভা সরকারের 'হনন" সিরিজের লেখা সমাপ্ত হলে সেগুলি নিয়ে একটা চটি হোক । যেমন তথ্য নিয়ে রিসার্চ , তেমনই ক্ষুরধার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ। আমি চার নম্বর প্ল্যাটফর্মেও ওঁর এবং এলেবেলের লেখা মন দিয়ে পড়ি। এটি বই হবে এই আশায় এখনই ইঁট পেতে রাখলাম।
দ্বিতীয় ইটটি আমার। এইসব তথ্য-বিশ্লেষণ মলাটবন্দী হওয়া খুব জরুরি।
একেবারে যথাযথ বক্তব্য।
না, অর্গানাইজেশনের সঙ্গে নয়। তবে চেষ্টা চলছে।ফললাভের আশা শূণ্য জেনেও।